আজকের এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের “সারাংশ” নিয়ে আলোচনা করবো। এই অংশ নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নবম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন নিয়মিত আসে।

সারাংশ হল কোনো রচনার বক্তব্যের নির্যাসটুকুর সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ। সাধারণত কোনো প্রবন্ধে তথ্য, তত্ত্ব, তর্ক, যুক্তি, দৃষ্টান্ত-এসবের মধ্যে যে চিন্তা-ভাবনা বিস্তারিত হয় তার মূল কথাটি সরলভাবে সহজ ভাষায় নৈর্ব্যক্তিকভাবে বলা হবে সারাংশে।
তাহলে ভাবার্থ যেখানে রচনার অন্তর্গত ভাবটির নিগূঢ় অর্থকে বুঝে নিতে চায়, সেখানে সারাংশ লিখিত ভাবনাটির সারবস্তুটিকে বলে দেয় মাত্র। ভাবার্থ লেখার সময় যে লিখছে তার নিজের বোঝার ধরন জুড়ে যায় বলে ভাবার্থ একটু তাৎপর্যমূলক। তুলনায় সারাংশের ক্ষেত্রে মূল রচনায় বলা কথার বাইরের কোনো কথা বলার দরকার হয় না।
ফলে দুটিই মূলের সংক্ষিপ্ত রূপ হলেও সারাংশের তুলনায় ভাবার্থ প্রয়োজনে আরও একটু বিশদ হতে পারে। তবে ভাবসম্প্রসারণে মূল ভাবটিকে যেভাবে বিস্তারিত করা হয় এখানে তা করা হয় না। ভাবসম্প্রসারণের ক্ষেত্রে দু-এক ছত্রে সংক্ষেপে প্রকাশিত কোনো গভীর ভাবের ব্যঞ্জনা বা সংকেতকে, ওই ভাবের বা বিষয়ের মধ্যে নিহিত যুক্তি ও প্রাসঙ্গিক ভাব-পরম্পরার ভিত্তিতে উন্মোচিত করে একটি স্পষ্ট পরিণতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ ভাবসম্প্রসারণ লেখার সময় অভিমুখ থাকে কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে, ভিতর থেকে বাইরের দিকে আর ভাবার্থ ও সারাংশ লেখার সময় তার অভিমুখ উলটে যায়, তখন যেতে হয় বাইরে থেকে ভিতর দিকে।
সারাংশ লেখার সময় খেয়াল রাখবে –
- উদ্ধৃত গদ্যাংশ বা কাব্যাংশ বারবার পড়ে মূল কথাটি কী, তা বুঝতে হবে।
- তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য ও শব্দগুলিকে চিহ্নিত করলে মূল ভাব বা বিষয়ের অনুধাবনে সুবিধা হবে।
- উদ্ধৃত গদ্যাংশ ও কাব্যাংশের লেখকের নাম জানা থাকলেও উল্লেখের দরকার নেই।
- উত্তম পুরুষ বা মধ্যম পুরুষ সূচক বক্তব্য উল্লেখ না করে সাধারণভাবে আলোচনা কাম্য।
- উক্তি-প্রত্যুক্তি থাকলে তার নির্যাসটুকু বিবৃতিমূলক রীতিতে নিজের ভাষায় প্রকাশ করতে হবে।
- লেখার ভাষা হবে সহজসরল এবং নিজস্ব। মূলের কোনো অংশ হুবহু লেখা যাবে না।
- সারাংশের আয়তন মূল লেখাটির এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেকের কম হবে। ভাবার্থের ক্ষেত্রে মূলের থেকে তার আয়তন কম হলেও সারাংশ-লিখনের মতো এত নির্দিষ্টতা নেই।
নবম শ্রেণী – বাংলা – সারাংশ
1. পরকে আপল করিতে প্রতিভার প্রয়োজন। অন্যের মধ্যে প্রবেশ করিবার শক্তি এবং অন্যকে সম্পূর্ণ আপনার করিয়া লইবার ইন্দ্রজাল, ইহাই প্রতিভার নিজস্ব। ভারতবর্ষের মধ্যে সে প্রতিভা আমরা দেখিতে পাই। ভারতবর্ষ অসংকোচে অন্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে এবং অনায়াসে অন্যের সামগ্রী নিজের করিয়া লইয়াছে। ভারতবর্ষ পুলিন্দ, শবর, ব্যাধ প্রভৃতিদের নিকট হইতেও বীভৎস সামগ্রী গ্রহণ করিয়া তাহার মধ্যে নিজের ভাব বিস্তার করিয়াছে-তাহার মধ্য দিয়াও নিজের আধ্যাত্মিকতাকে অভিব্যক্ত করিয়াছে। ভারতবর্ষ কিছুই ত্যাগ করে নাই এবং গ্রহণ করিয়া সকলই আপনার করিয়াছে।
এই ঐক্য বিস্তার ও শৃঙ্খলা স্থাপন কেবল সমাজ-ব্যবস্থায় নয়, ধর্মনীতিতেও দেখি; গীতায় জ্ঞান, প্রেম ও কর্মের যে সামঞ্জস্য স্থাপনের চেষ্টা, তাহা বিশেষরূপে ভারতবর্ষের।
পৃথিবীর সভ্যসমাজের মধ্যে ভারতবর্ষ নানাকে এক করিবার আদর্শরূপে বিরাজ করিতেছে, তাহার ইতিহাস হইতে ইহহি প্রতিপন্ন হইবে।
উত্তর –
বৈচিত্র্যের মধ্যে একতাই ভারতবর্ষের সনাতন সাধনা। বহু ভাষা-বহু ধর্ম-বহু সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র এই ভারতবর্ষ। এ মিলন এমনই অপরিহার্য ও অবশ্যম্ভাবী যে, দেশবৈরী বিদেশিও এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মানবতীর্থ ভারতের একতায় কেউ বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি কোনোদিনই। এ দেশের ধর্মনীতিতে ঐক্য ও শৃঙ্খলা পৃথিবীর অন্যান্য দেশকেও প্রভাবিত করেছে।
2. ভ্রাতৃত্ব বাহিরের অবস্থা – ভ্রাতৃভাবে যদি থাকি, সকলের এক সম্পত্তি, এক হিত, এক চেষ্টা যদি থাকে, তাহাকেই ভ্রাতৃত্ব বলে। বাহিরের অবস্থা অন্তরের ভাবে প্রতিষ্ঠিত। ভ্রাতৃপ্রেমে ভ্রাতৃত্ব সজীব ও সত্য হয়। সেই ভ্রাতৃপ্রেমেরও প্রতিষ্ঠা চাই। আমরা এক মায়ের সন্তান, দেশভাই; এই ভাব এইরূপে ভ্রাতৃপ্রেমের প্রতিষ্ঠা, কিন্তু সেই ভাব যদি রাজনৈতিক একতার বন্ধন হয়, তাহাতে সামাজিক একতা হয় না। আরও গভীর স্থানে প্রবেশ করিতে হয়, যেমন নিজের মাকে অতিক্রম করিয়া দেশভাইয়ের মাকে উপাসনা করি। সেইরূপে দেশকে অতিক্রম করিয়া জগজ্জননীকে উপলব্ধি করিতে হয়। খণ্ডশক্তিকে অতিক্রম করিয়া পূর্ণশক্তিতে পৌঁছিতে হয়। কিন্তু যেমন ভারতজননীর উপাসনায় শরীরের জননীকে অতিক্রম করিয়াও বিস্মৃত হই না, তেমনি জগজ্জননীর উপাসনায় ভারতজননীকে অতিক্রম করিয়া বিস্মৃত হইব না।
উত্তর –
প্রকৃত ভ্রাতৃপ্রেমের দ্বারাই ভ্রাতৃত্ব বাস্তবায়িত হয়। একই দেশমাতার সন্তানবলে এই ভ্রাতৃত্ববোধ যদি রাজনৈতিক একতার বন্ধন হয়, তা সামাজিক একতার হয় না। এর জন্য জগজ্জননীকে উপলব্ধি করতে হয়। জগজ্জননীর উপলব্ধির অর্থ ভারতজননীকে বিস্মৃত হওয়া নয়। যেমন ভারতজননীর উপাসনা সত্ত্বেও শরীরের জননী তাঁর আসনচ্যুত হন না।
3. যিনি ক্ষমতাপন্ন লোক তিনি নিজের কীর্তির মধ্যেই বাঁচিয়া থাকেন। তিনি যদি নিজেকে বাঁচাইতে না পারেন, তবে তাঁহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা আমরা করিলে তাহা হাস্যকর হয়। বঙ্কিমকে কি আমরা স্বহস্তরচিত পাথরের মূর্তিদ্বারা অমরত্বলাভে সহায়তা করিব? আমাদের চেয়ে তাঁহার ক্ষমতা কি অধিক ছিল না। তিনি কি নিজের কীর্তিকে স্থায়ী করিয়া যান নাই? হিমালয়কে স্মরণ রাখিবার জন্য কি চাঁদা করিয়া তাহার একটি কীর্তিস্তম্ভ স্থাপন করার প্রয়োজন আছে? হিমালয়কে দর্শন করিতে গেলেই তাহার দেখা পাইব – অন্যত্র তাহাকে স্থাপন করিবার উপায় করিতে যাওয়া মূঢ়তা। কৃত্তিবাসের জন্মস্থানে বাঙালি একটা কোনো প্রকারের ধূমধাম করে নাই বলিয়া, বাঙালি কৃত্তিবাসকে অবজ্ঞা করিয়াছে, একথা কেমন করিয়া বলিব? যেমন ‘গঙ্গা পূজি গঙ্গাজলে’, তেমনি বাংলাদেশে মুদির দোকান হইতে রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত কৃত্তিবাসের কীর্তি দ্বারাই কৃত্তিবাস কত শতাব্দী ধরিয়া পূজিত হইয়া আসিতেছেন। এমন প্রত্যক্ষ পূজা আর কিসে হইতে পারে?
উত্তর –
প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা নিজের কীর্তির জোরেই অমরত্ব লাভ করেন। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অপরের সহায়তা অনাবশ্যক। অপরের নির্মিত পাথরের মূর্তি কিংবা স্মারকস্তম্ভ ছাড়াই ব্যক্তিমাত্রে আপন কীর্তিতে বা হিমালয় আপন বিশালত্বের মহিমায় জনমনে চিরস্থায়ী। আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আপামর বাঙালি যেভাবে কৃত্তিবাসকে তাঁর কীর্তির মাধ্যমে পূজা করে আসছে, সেই প্রত্যক্ষ পূজাই কীর্তিমানকে চিরজীবী করে।
4. প্রত্যেক ক্ষুদ্র মানুষটি বৃহৎ মানুষের সঙ্গে নিজের ঐক্য নানা মঙ্গলের দ্বারা নানা আকারে উপলবিধ করিতে থাকিবে। এই উপলব্ধি তাহার কোনো বিশেষ কার্যসিদ্ধির উপায় বলিয়াই গৌরবের নহে, ইহা তাহার প্রাণ, ইহাই তাহার মনুষ্যত্ব, অর্থাৎ তাহার ধর্ম। এই ধর্ম হইতে সে যে পরিমাণে বঞ্চিত হয় সেই পরিমাণেই সে শুষ্ক হয়। আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে বহুদিন হইতেই ভারতবর্ষে আমরা সে শুষ্কতাকে প্রশ্রয় দিয়া আসিয়াছি। আমাদের জ্ঞান, কর্ম, আচার, ব্যবহারের, আমাদের সর্বপ্রকার আদান-প্রদানের, বড়ো বড়ো রাজপথ এক একটা ছোটো ছোটো মণ্ডলীর সম্মুখে আসিয়া খণ্ডিত হইয়া গিয়াছে; আমাদের হৃদয় ও চেষ্টা প্রধানত আমাদের নিজের ঘর নিজের গ্রামের মধ্যেই ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে, তাহা বিশ্বমানবের অভিমুখে নিজেকে উদ্ঘাটিত করিয়া দিবার অবসর পায় নাই। এই কারণে আমরা পারিবারিক আরাম পাইয়াছি, ক্ষুদ্র সমাজের সহায়তা পাইয়াছি, কিন্তু বৃহৎ মানুষের শক্তি ও সম্পূর্ণতা হইতে আমরা অনেক দিক হইতে বঞ্চিত হইয়া দীনহীনের মতো বাস করিতেছি।
উত্তর –
ঐক্যবদ্ধ থাকার মতো বড়ো জিনিস আর কিছুই নেই। আমরা প্রত্যেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডিতে স্বতন্ত্রভাবে, স্বাধীনভাবে থাকতে ভালোবাসি। তাই বৃহত্তর ক্ষেত্রের অপার আনন্দ উপলব্ধি করতে পারি না। আমরা যদি আমাদের জ্ঞান, কর্ম, আচার-ব্যবহার এমনকি সব রকমের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রেও উদার ও বৃহৎ ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারি তবে মহত্তম আনন্দের উপলব্ধি হয়।
5. সাহিত্যিক রুচি নানা কারণে বদলায়; এবং অতীতের সেই যুগের সাহিত্যই আমাদের ভালো লাগে, যে যুগের সঙ্গে আমাদের মনের মিল বেশি। নিকটতম অতীত সর্বদাহ ঈষৎ হাস্যকর। মহাকালের এই অব্যবস্থিতচিত্রতা লেখককে ভবিষ্যতের ওপর অত্যন্ত বেশি নির্ভর করতে নিষেধ করে। কোনো কোনো মহামান্য লেখক সচেতনভাবেই চেষ্টা করেছেন বর্তমানকে জয় করতে; এর উদাহরণ শেক্সপীয়র স্বয়ং, উদাহরণ ডিকেন্স। খদ্দের ধরবার বা রাখবার জন্য এমন কিছু নেই যা না করেছেন তাঁরা; ভাঁড়ামি, রক্তারক্তি, হৈ-হল্লা যা কিছু এলিজাবেথীয় দর্শকের প্রিয়, শেক্সপীয়র কোনটাতেই কার্পণ্য করেননি; ডিকেন্স উপন্যাসের কিস্তি বাজারে ছোড় উদবিগ্নভাবে কাটতিলক্ষ্য করতেন। কোনো একবার বিক্রি কম হলেই পরের সংখ্যায় কিছু একটা কারসাজি করতেন কাটতি বাড়াবার জন্য। সে উদ্দেশ্যে গল্পের প্লট বদলাতে কি চরিত্রের চেহারা ফেরাতেও তাঁর আপত্তি ছিল না। খদ্দেরকেও খুশি করবার এই ব্যবসাদারি ইচ্ছে থেকেই লেডি ম্যাকবেথ -এর, ফলস্টাফ -এর, পিকউইক -এর জন্ম।
উত্তর –
যুগের রুচিবোধ অনুসারে সাহিত্য স্বীকৃতি লাভ করে, নিকটতম অতীত ঈষৎ হাস্যকর বলেই দক্ষ, সচেতন লেখকেরা অতীত-অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমানকে জয় করে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভবিষ্যতের পথে এগিয়েছেন। ডিকেন্স, শেক্সপিয়রের মতো সাহিত্যিকেরা মানুষের অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্যকেও সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন।
6. রামায়ণের যদি কোনো চরিত্র ঠিক আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করা যায় তবে তাহা একমাত্র ভরতের চরিত্র। সীতা লক্ষণকে যে কটূক্তি করিয়াছিলেন তাহা ক্ষমাই নহে। রামচন্দ্রের বালিবধ ইত্যাদি অনেক কার্যই সমর্থন করা যায় না। লক্ষ্মণের কথা অনেক সময় অতি রুক্ষ ও দুর্বিনীত হইয়াছে; কৌশল্যা দশরথকে বলিয়াছিলেন, ‘কোনো কোনো জলজন্তু যেমন স্বীয় সন্তানকে ভক্ষণ করে তুমিও সেইরূপ করিয়াছ।’ কিন্তু ভরতের চরিত্রে কোনো খুঁত নাই। পাদুকার ওপর হেমছত্রধর জটাবল্কলধারী এই রাজর্ষির চিত্র রামায়ণে এক অদ্বিতীয় সৌন্দর্যপাত করিতেছে। কৈকেয়ীর সহস্র দোষ আমরা ক্ষমার্ঘ মনে করি, যখন মান হয় তিনি এরূপ সুপুত্রের গর্ভধারিণী।
উত্তর –
বিচিত্র চরিত্রের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের অন্যতম জাতীয় মহাকাব্য রামায়ণ। নানা চরিত্রের গুণ-দোষ, মহত্ত্ব, আদর্শগত দিক বিশ্লেষণ করলে শ্রেষ্ঠ আদর্শনিষ্ঠ চরিত্র হিসেবে স্থিতধী, ঋষিসিদ্ধ, স্বল্পবাক্, বিনয়ী, কৈকেয়ীপুত্র ভরতকেই চিহ্নিত করা যায়। বিনয়ী এই রাজকুমার রামায়ণ মহাকাব্যের এক দুর্লভ সৌন্দর্যময় সম্পদ। ভরতের মতো সুপুত্রের জন্মদাত্রী বলে কৈকেয়ীর সমস্ত দোষই ক্ষমার যোগ্য।
7. সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা দুর্বল, যারা বঞ্চিত, উৎপীড়িত, মানুষ যাদের চোখের জলের কোনও হিসাব নিলে না, নিরুপায়, দুঃখময় জীবনে যারা ভেবেই পেলে না সমস্ত থেকেও তাদের কিছুতেই অধিকার নেই – এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে। এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে। তাই আমার কারবার শুধু এদের নিয়ে। সংসারের সৌন্দর্য-সম্পদে ভরা বসন্ত জানি আনে তার কোকিলের গান, আনে প্রস্ফুটিত মালিকা, মালতী, জাতী, যূথী – আনে গন্ধ ব্যাকুল দক্ষিণা পবন। কিন্তু যে আবেষ্টনের মধ্যে আমার দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে গেল তার ভেতর এরা দেখা দিলে না। এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সুযোগ আমার ঘটল না। সে দারিদ্র্য আমার লেখার মধ্যে চাইলেই চোখে পড়ে, কিন্তু অন্তরে যাকে পাইনি – শ্রুতিমধুর শব্দবাশির অর্থহীন মালা গেঁথে তাকে পেয়েছি বলে প্রকাশ করার ধৃষ্টতাও আমি করিনি।
উত্তর –
এই বিশ্বসংসারে এক শ্রেণির মানুষ শুধু দিয়েই গেল। বিনিময়ে পেল কেবল অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, অত্যাচার, উৎপীড়ন, দুঃখ-যন্ত্রণা। তাদের এই বঞ্চনায় ক্ষুব্ধ লেখক মানুষের কাছে নালিশ জানাতেই লেখনী ধরেছিলেন। তাই তাঁর লেখার মধ্যে দারিদ্র্যের ছাপ পড়লেও বাস্তব পৃথিবীর রুক্ষতায় প্রকৃতির রূপসৌন্দর্য প্রকাশে জীবনব্যাপী বিমুখ থেকেছেন এই লেখক।
8. সুখ প্রতিদিনের সামগ্রী, আনন্দ প্রত্যহের অতীত। সুখ শরীরের কোথাও পাছে ধূলা লাগে বলিয়া সংকুচিত, আনন্দ ধূলায় গড়াগড়ি দিয়া নিখিলের সঙ্গে আপনার ব্যবধান ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া দেয়। এইজন্য সুখের পক্ষে ধূলা হেয়, আনন্দের পক্ষে ধূলা ভূষণ। সুখ কিছু হারায় বলিয়া ভীত। আনন্দ যথাসর্বস্ব বিতরণ করিয়া পরিতৃপ্ত। এইজন্য সুখের পক্ষে রিক্ততা দারিদ্র্য, আনন্দের পক্ষে দারিদ্র্যই ঐশ্বর্য। সুখ, ব্যবস্থার বন্ধনের মধ্যে আপনার শ্রীটুকুকে সতর্কভাবে রক্ষা করে। আনন্দ সংসারের মুক্তির মধ্যে আপন সৌন্দর্যকে উদারভাবে প্রকাশ করে। এইজন্য সুখ বাহিরের নিয়মের মধ্যে বদ্ধ, আনন্দ সে-বন্ধন ছিন্ন করিয়া আপনার নিয়ম আপনি সৃষ্টি করে। সুখ, সুধাটুকুর জন্য তাকাইয়া বসিয়া থাকে। আনন্দ, দুঃখের বিষয়কে অনায়াসে পরিপাক করিয়া ফেলে। এইজন্য কেবল ভালোটুকুর দিকেই সুখের পক্ষপাত-আর আনন্দের পক্ষে ভালো-মন্দ দুই-ই সমান।
উত্তর –
মানুষের জীবনে সুখ এবং আনন্দ দুটি সমান্তরাল ধারায় বয়ে চলে। কিন্তু এই দুটির অনুভব একে অপরের চেয়ে পৃথক। সুখ প্রতিদিনের, আনন্দ চিরকালীন। সুখ কৃত্রিম পারিপাট্যে আচ্ছাদিত, আনন্দ স্বাভাবিক ঔদার্যে মণ্ডিত। হারানোর ভয়, দারিদ্র্যের আশঙ্কা, নিয়মের বন্ধন সুখকে নিজের গণ্ডির মধ্যে তটস্থ, সীমাবদ্ধ করে রাখে, তার হাহুতাশ শুধুমাত্র সুধার জন্য। আনন্দ সব কিছুর ঊর্ধ্বে আপন নিয়মে অসীম, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ সবই আনন্দের সহচর।
9. অনেকেই বলিবেন, ইংরেজের প্রাধান্য এবং ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রাধান্য সাদৃশ্য-কল্পনা সুকল্পনা নহে। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় শূদ্রপীড়ক হইলেও স্বজাতি-ইংরেজেরা ভিন্নজাতি। ইহার এইরূপ উত্তর দিতে ইচ্ছা করে যে, যে পীড়িত হয়, তাহার পক্ষে স্বজাতির পীড়ন ও ভিন্ন জাতির পীড়ন, উভয়ই সমান। স্বজাতীয়ের হস্তে পীড়া কিছু মিষ্ট, পরজাতীয়ের পীড়া তিক্ত লাগে, এমত বোধ হয় না। কিন্তু আমরা সে উত্তর দিতে চাহি না। যদি স্বজাতীয়ের পীড়ায় কাহারও প্রীতি থাকে, তাহাতে আমাদিগের আপত্তি নেই। আমাদিগের এইমাত্র বলিবার উদ্দেশ্য যে, আধুনিক ভারতের জাতি-প্রাধান্যের স্থানে প্রাচীন ভারতে বর্ণ-প্রাধান্য ছিল; অধিকাংশ লোকের পক্ষে উভয়ই সমান।
তবে ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে যে, পরাধীন ভারতবর্ষে উচ্চশ্রেণীর লোকে স্বীয় বুদ্ধি, শিক্ষা, বংশ এবং মর্যাদানুসারে প্রাধান্য লাভ করিতে পারে না। যাহার বিদ্যা এবং বুদ্ধি আছে, তাহাকে যদি বুদ্ধিসঞ্চালনের এবং বিদ্যার ফলোৎপত্তির স্থল না দেওয়া যায়, তবে তাহার প্রতি গুরুতর অত্যাচার করা হয়। আধুনিক ভারতবর্ষে এরূপ ঘটিতেছে। প্রাচীন ভারতবর্ষে বর্ণবৈষম্যগুণেও তাহা ছিল, কিন্তু এ পরিমাণে ছিল না।
উত্তর –
আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা মানুষ। অনেকের মনে ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, ভিন্নজাতির পীড়নের তুলনায় স্বজাতির পীড়ন অনেকাংশে সহনীয়। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। মানুষ হয়ে মানুষকে পীড়ন বা লাঞ্ছনা করা সনাতন ভারতবর্ষের ‘বর্ণবৈষম্য’ প্রথার আধুনিক, পরিবর্ধিত রূপ। এর প্রতিকার হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
10. বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষায় সামান্যতা বা উচ্চতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন সরলতা এবং স্পষ্টতা। যে রচনা সকলেই বুঝিতে পারে এবং পড়িবামাত্র যাহার অর্থ বুঝা যায়, অর্থ গৌরব থাকিলে তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট রচনা। তাহার পর ভাষায় সৌন্দর্য। সরলতা এবং স্পষ্টতার সহিত সৌন্দর্য মিশাইতে হইবে। অনেক রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য সৌন্দর্য, – সে স্থলে সৌন্দার্যর অনুরোধে শব্দের একটু অসাধারণত্ব সহ্য করিতে হয়। প্রথমে দেখিবে তুমি যাহা বলিতে চাও, কোন ভাষায় তাহা সর্বাপেক্ষা পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত হয়। যদি সরল প্রচলিত কথাবার্তার ভাষায় তাহা সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট ও সুন্দর হয়, তবে কেন উচ্চ ভাষার আশ্রয় লইবে? যদি সে পক্ষে টেকচাঁদী বা হুতোমী ভাষায় সকলের আপেক্ষা কার্য সুসিদ্ধ হয়, তবে তাহাই ব্যবহার করিবে। যদি তদপেক্ষা বিদ্যাসাগর বা ভূদেববাবু প্রদর্শিত সংস্কৃতবহুল ভাষায় এ ভাবে অধিক স্পষ্টতা ও সৌন্দর্যপ্রাপ্তি হয়, তবে সামান্য ভাষা ছাড়িয়া সেই ভাষার আশ্রয় লইবে। যদি তাহাতেও কার্যসিদ্ধ না হয়, আরো উপরে উঠিবে, প্রয়োজন হইলে তাহাতে আপত্তি নাই, নিষ্প্রয়োজনেই আপত্তি।
উত্তর –
রচনার ভাষা কেমন হবে তা নির্ভর করে বিষয়ের ওপর। বক্তার বক্তব্য সহজসরলভাবে সৌন্দর্যের আবরণে পরিবেশন করা দরকার। লেখার উপযোগী ভাষা, তা সে যে যুগের বা কালেরই হোক-না কেন, তা-ই গ্রহণীয়। এমনকি রচনার বিষয় যদি আলালী বা বিদ্যাসাগরীয় ভাষা দাবি করে, তাতেও বারণ নেই। বর্জনীয় শুধু একটিই ব্যাপার-তা হল রচনায় অপ্রয়োজনীয় ভাষার ব্যবহার।
11. অতি কাছে এসেছেন আজ বাংলার কবি এই প্রতিদিনের মানুষের সংসারে। সারাজীবনের ঐশ্বর্য তিনি যাদের উদ্দেশে দিচ্ছেন, তারা অতি বুদ্ধিমান জ্ঞানের ব্যবসায়ী নয়। তারা শস্যশ্যামল দিগন্তে ঘেরা প্রাত্যহিক মানুষ। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে অধিকারী ভেদ নেই; এখানে সকলেরই নিমন্ত্রণ। মাঝি এল তার পাল তোলা নৌকা নিয়ে, গঞ্জের হাট থেকে লোক এল বিবিধ পসার হাতে করে – কেউ হালে বলদ জুতছে, কেউবা শহরে কাজ করে দোকানে বা অফিসে। কত ঘরের নিভৃত কাহিনী জীবনের ধ্যানমালায় গ্রথিত হল তাঁর আজকের কবিতায়। অথচ এই সংবেদনশীল দৃষ্টিতে সত্যদর্শিতার সাহস আরও প্রদীপ্ত হয়েছে, তার পরিচয় পেয়েছি তাঁর এই নববর্ষের অভিভাষণে। ভয়হীন তাঁর দৃষ্টি, কেননা সেখানে প্রেমের অপরাজেয় শক্তি রয়েছে-মানুষকে ভালবাসেন বলেই তিনি মানুষের ভ্রষ্টতাকে এমন করে মোহমুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পারেন।
উত্তর –
মানুষের প্রতি যার বিশ্বাস অটুট, সত্যের প্রতি দায় আছে যার, তিনিই পারেন জীবনকে নির্মোহ দৃষ্টিতে ও নিরপেক্ষতায় বিশ্লেষণ করতে। রবীন্দ্রকাব্যে এ সম্পদ ছিল বলেই তা সর্বসাধারণের হৃদয়ের ধন হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জীবন অভিজ্ঞতার বিচিত্রতা ও মানুষকে ভালোবেসে সত্যভাষণের সাহসিকতা দেখাতে পেরেছিলেন বলেই তিনি কালজয়ী।
12. আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষা – জীবনরক্ষার এই দুই উপায় ছাড়া মানুষের আরো একটি বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষ অতি দুর্বল জীব, সবল শত্রুর নিকট হইতে আত্মরক্ষার জন্য সে আর একটা কৌশল আশ্রয় করিয়াছে। মানুষ দল বাঁধিয়া বাস করে, সেই দলের নাম সমাজ। দল বাঁধিয়া থাকিতে হইলে স্বাধীনতাকে ও স্বাতন্ত্র্যাক সংযত করিতে হয় – নতুবা দল ভাঙ্গিয়া যায়। যে পাশব প্রবৃত্তি সমাজকে তুচ্ছ করিয়া মানুষকে কেবল আত্মরক্ষার দিকে প্রেরিত করে, দলের কল্যাণার্থে মানুষ সেই পাশবিক প্রবৃত্তির সংযমে বাধ্য হয়। এইজন্য যে বুদ্ধি আবশ্যক, তাহার নাম ধর্মবুদ্ধি। ইহা বিশিষ্টরূপে মানবধর্ম। ইহা সমাজরক্ষার অনুকূল, ইহা লোকস্থিতির সহায়। আত্মরক্ষার ও বংশরক্ষার অভিমুখে যে সকল প্রবৃত্তি, তাহা মানুষকে এক পথে প্রেরণ করে, আর মানুষের ধর্মবুদ্ধি যাহা মুখ্যত – সমাজরষ্কার অর্থাৎ লোকস্থিতির অনুকূল, গৌণত – আত্মরক্ষার অনুকূল মাত্র, তাহা মানুষকে অন্যদিকে প্রেরণ করে। সামাজিক মানুষকে এই দুই টানাটানির মধ্যে পড়িয়া সামঞ্জস্যবিধানের চেষ্টা করিতে হয়। এই সামঞ্জস্য স্থাপনের নিরন্তর চেষ্টাই মানুষের নৈতিক জীবন।
উত্তর –
আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষা – এই দুটি স্বাভাবিক উপায় ছাড়া মানুষের অন্যতম আর একটি বৈশিষ্ট্য হল সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করা। সমাজের দলবদ্ধতা চিরস্থায়ী করতে হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যকে সংযত করে নিজের পাশবিক প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিতে হবে। এই জন্য ধর্মবুদ্ধি আবশ্যক। এই ধর্মবুদ্ধির অপর নাম মানবধর্ম। একদিকে ধর্মবুদ্ধি অন্যদিকে আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষার প্রবৃত্তি – এই দুইয়ের সামঞ্জস্যবিধানের চেষ্টা করতে হয় মানুষকে। এই চেষ্টাতেই মানুষের নৈতিক জীবন গড়ে ওঠে।
13. ভজন পূজন সাধন আরাধনা
সমস্ত থাক পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস ত্তরে।
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন-মনে
কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে-
দেবতা নহি ঘরে।
তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
করছে চাষা চাষ-
পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
খাটছে বারো মাস
রৌদ্র জলে আছেন সবার সাথে,
ধূলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে-
তাঁরি মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয়রে ধূলার পরে।
উত্তর –
পূজা-অর্চনা, সাধনা ও দেবতার নামকীর্তন – সমস্ত ত্যাগ করতে হবে। দেবালয়ের দরজা বন্ধ করে গোপনে যাঁকে পুজো করা হয়, সেই দেবতা সেখানে থাকেন না। যেখানে শ্রমজীবী কৃষক মাটি ভেঙে চাষ করছে, সারা বছর পাথর ভেঙে পথ তৈরি করছে শ্রমিকের দল-কর্মযোগী দেবতা সেখানে চলে যান। এভাবেই মানবদরদী ঈশ্বরের মতো শুচি কাপড় ছেড়ে ধুলোর মাঝে আসতে হবে। অর্থাৎ ধ্যান-পুজো ছেড়ে কর্মকেই ধর্ম বলে গ্রহণ করতে হবে।
14. আমরা পরবাসী। দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না। যতক্ষণ দেশকে না জানি, যতক্ষণ তাকে নিজের শক্তিতে জয় না করি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়। আমরা এই দেশকে আপনি জয় করি নি। দেশে আনক জড় পদার্থ আছে, আমরা তাদেরই প্রতিবেশী। দেশ যেমন এইসব বস্তুপিন্ডের নয়, দেশ তেমনি আমাদেরও নয়। এরই নাম জড়ত্ব-একেই বলে মোহ, যে মোহাভিভূত সে-ই তো চির-প্রবাসী। সে জানে না সে কোথায় আছে। সে জানে না তার সত্য সম্বন্ধ কার সঙ্গে। বাহিরের সহায়তার দ্বারা নিজের সত্যবস্তু কখনই পাওয়া যায় না। আমার দেশ আর কেউ আমাকে দিতে পারে না। নিজের সমস্ত ধন-জন-প্রাণ দিয়ে দেশকে যখনই আপন বলে জানতে পারব তখনই দেশ আমার স্বদেশ হবে। পরবাসী স্বদেশে যে ফিরেছি তার লক্ষণ এই যে, দেশের প্রাণকে নিজের প্রাণ জানি। পাশে প্রত্যহ মরছে দেশের লোক রোগে উপবাসে আর আমি পরের উপর সব দোষ চাপিয়ে মঞ্চের উপর দেশাত্মবোধের বাগবিস্তার করছি। এত বড় অবাস্তব অপদার্থতা আর কিছুই হতে পারে না।
উত্তর –
দেশে জন্মালেই দেশ আপনার হয় না। আবার পরবাসে থাকলেই যে দেশকে আমরা ভুলে যাব তা নয়। তাই দেশকে ভালোবাসলে দেশের প্রতিটি কণাকে ভালবাসতে হবে। তবেই দেশ আপন হবে। শুধু মুখে বড়ো বড়ো কথা বললে চলবে না। দেশের কীসে মঙ্গল হবে সে-চিন্তা করতে হবে। দেশের লোকের ভালো-মন্দের অংশীদার হয়ে, তাদের পাশে বিপদের সময় দাঁড়াতে হবে। তবেই দেশকে প্রকৃত ভালোবাসা হবে। আমরা যদি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ি তবে তা আমাদের অপদার্থতারই সামিল।
15. আমাদের জাতীয় সাহিত্য আমাদের মাতৃভাষা বাংলাতেই হইবে। কোনো জাতি কখনো কেবল বিদেশী ভাষার চর্চায় বড় হইতে পারে নাই। ইউরোপ যখন ল্যাটিন ছাড়িয়া দেশী ভাষা ধরিয়াছিল তখন হইতেই ইউরোপের অন্ধকার যুগের অবসান হইয়া আধুনিক উন্নত যুগের আরম্ভ হইয়াছে। যেদিন ইংল্যান্ড, নর্মান-ফ্রেঞ্চ ত্যাগ করিয়া এক সময়ের ঘৃণিত স্যাকসন ভাষাকে বরণ করিয়া লইল সেদিন ইংল্যান্ডের জাতীয় জীবনের তথা উন্নতির সূত্রপাত হইল। যখন হইতে জার্মানী, ফরাসী ভাষার মোহপাশ কাটাইয়া তাহার মাতৃভাষাকে পূজার স্থান দিল, তখন হইতে জার্মানীর জাতীয় জীবনের উন্নতি হইল। সাহিত্যের দু’একটি শাখা বিদেশী মাটিতে টিকিতে পারে, কিন্তু সমগ্র সাহিত্য বিদেশী আবহাওয়ায় বাঁচিতে পারে না। রোমান যুগের পরবর্তীকালের ইওরোপের বিপুল ল্যাটিন সাহিত্য কোথায়? সাহিত্যসাধনা যদি সম্পূর্ণরূপে সার্থক করিতে চাও তবে তোমাকে মাতৃভাষার মধ্য দিয়া সাহিত্য রচিতে হইবে।
উত্তর –
মাতৃভাষাই জাতীয় জীবনে উন্নতিসাধনের একমাত্র পথ। ইউরোপে অন্ধকার যুগের অবসানের মূলে রয়েছে দেশীয় ভাষার ওপর গুরুত্ব আরোপ। ইংল্যান্ড, জার্মানি ইত্যাদি ইউরোপের দেশগুলির উন্নতির প্রধান হাতিয়ার স্বদেশি ভাষা। সামান্য কিছু বিদেশি ভাষায় রচিত সাহিত্য বিদেশিদের কাছে আদৃত হলেও অধিকাংশ সাহিত্য দেশীয় ভাষায় রচিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে সাহিত্য রচিত হলে সাহিত্যসাধনা সার্থক হতে পারে, নতুবা নয়।
16. আমরা বলি, নিউটন মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করেছেন। মাধ্যাকর্ষণ কি ওঁর জন্যে এককোণে অপেক্ষা করছিল? ছিল ওঁর মনে; উপযুক্ত সময়ে সেটা জানতে পারলেন। পৃথিবী যা কিছু জ্ঞানলাভ করেছে, সব মন থেকে উৎপন্ন; জগতের অনন্ত গ্রন্থাগার তোমার মনেই রয়েছে। বাইরের জগৎ শুধু তোমার মনকে পর্যবেক্ষণ করার উদ্দীপনা জোগায়, কিন্তু তোমার পর্যবেক্ষণের বিষয় হল তোমার মন। একটি আপেল পড়ার ঘটনা নিউটনকে উদ্দীপ্ত করল, তিনি নিজের মনে আলোচনা করলেন। মনে মনে চিন্তার সব পূর্বতন সূত্রগুলিকে সাজিয়ে নিয়ে তাদের মধ্যে এক নতুন সম্বন্ধ আবিষ্কার করলেন, তাকেই আমরা বলি মাধ্যকর্ষণের সূত্র। সে সূত্র আপেলে ছিল না, পৃথিবীর কেন্দ্রের কোনো বস্তুতে ছিল না।
অতএব আধিভৌতিক বা আধ্যাত্মিক সব জ্ঞানই মানুষের মনে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা আবিষ্কৃত হয় না, আবৃত থেকে যায়, আবরণ যখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় তখন আমরা বলি, “আমরা শিখছি”। এই উন্মোচনের অগ্রগতির উপরেই জ্ঞানের অগ্রগতি নির্ভর করে।
উত্তর –
মনের মধ্যেই জ্ঞানের উৎপত্তি। মন থেকেই প্রকৃত পর্যবেক্ষণ হয়। যা নিউটন করেছিলেন। নিউটন মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আপেল পড়ার ঘটনা থেকে মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের আবিষ্কার। অধিভৌতিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান সবসময় আবিষ্কৃত হয় না। মনের আবরণ উন্মোচনেই জ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভব।
17. বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে সাহিত্যিকের একটি স্থানে মিল আছে। ইতর সাধারণ সকলেই সম্মুখে যাহা পাড়, তাহাই কুড়াইয়া লইয়া সেই কয়টা জিনিসকে জীবনের কাজে লাগাইয়া যেনাতনপ্রকারেণ তাড়াতাড়ি জীবনযাত্রায় দৌড়ইয়া চলিতেছে, আশেপাশে যাহা আছে, তাহার প্রতি মনঃসংযোগের অবকাশ পাইতেছে না। কিন্তু কয়েকজন লোক আশেপাশে চাহিয়া অন্যে যাহা দেখে না, তাহাই দোখন এবং ইত্তর সাধারণকে যখন দেখান তখন তাহারা নূতন কি দেখিলাম বলিয়া চমকিয়া ওঠে। বৈজ্ঞানিক বলেন – “দেখ এতো বাস্তবিক সত্য, তা তুমি এতদিন দেখ নাই। ইহা হইতে জীবনের কত প্রয়োজন সিদ্ধি, জীবনযুদ্ধে কত সাহায্য ঘটিতে পারে।” – সাহিত্যিক বলেন – “দেখ এতো সুন্দর দৃশ্যের প্রতি তুমি এতকাল তাকাও নাই। ইহা হইতে কত আনন্দ মিলিতে পারে, জীবনযুদ্ধের আনুষঙ্গিক দুঃখ কত কমাইতে পারা যায়।” – একজন যেখানে সত্যের অন্যজন সেখানে সুন্দরের আবিষ্কার করেন।
উত্তর –
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে অপার সৌন্দর্য, অনন্ত বিস্ময়। সাধারণ মানুষের চোখে যা স্থূল, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিকের অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তার আছে এক অপরূপ রূপমাধুরী। তার মধ্যেই তাঁরা খুঁজে পান রূপ-রস-গন্ধময় এক বিচিত্র জীবনের স্বাদ। সত্য ও সুন্দরের পূজারির মধ্যে আনন্দবিগ্রহ তখনই মূর্ত হয়ে ওঠে।
18. সাহেবরা যদি পাখী মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। গ্রীণলন্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাওরি জাতিরও ইতিহাস আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্তি, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষধচরিত ও গীতগোবিন্দ লেখা হইয়াছে, যে দেশ উদয়ানাচার্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, সে দেশের ইতিহাস নাই। মার্শম্যান, স্টুয়ার্ট প্রমুখ প্রণীত পুস্তকগুলিকে আমরা সাধ করিয়া ইতিহাস বলি, সে কেবল সাধপূরণ মাত্র।
ভারতবর্ষীয়দিগের যে ইতিহাস নাই, তাহার বিশেষ কারণ আছে। কতকটা ভারতবর্ষীয় জড়প্রকৃতির বলে প্রপীড়িত হইয়া, কতকটা দস্যুজাতীয়দিগের ভয়ে ভীত হইয়া ভারতবর্ষীয়েরা ঘোরতর দেবভক্ত। বিপদে পড়িলেই দেবতার প্রতি ভয় বা ভক্তি জন্মে। যে কারণেই হউক, জগতের যাবতীয় কর্ম দৈবানুকম্পায় সাধিত হয়, ইহা তাহাদিগের বিশ্বাস। এজন্য শুভের নাম “দেব”, অশুভের নাম “দুর্দৈব”। এরূপ মানসিক গতির ফল এই যে, ভারতবর্ষীয়েরা অত্যন্ত বিনীত; সাংসারিক ঘটনাবলীর কর্তা আপনাদিগকে মান করেন না, দেবতাকেই সর্বত্র সাক্ষাৎ কর্তা বিবেচনা করেন। এজন্য তাঁহারা দেবতাদিগেরই ইতিহাস-কীৰ্ত্তলে প্রবৃত্ত; সেখানে যে মনুষ্যগণ যে দেবতার আংশিক অবতার, নয় দেবানুগৃহীত; সেখানে দৈবের সংকীর্ত্তনই উদ্দেশ্য। এই জন্য আমাদের ইতিহাস নাই। এইরূপে লোকাচার ও শাস্ত্রব্যবহারপাশে বদ্ধ হইয়া দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা চিরকাল বাল্যবিবাহ নিবন্ধন অশেষ ক্লেশ ও দুরপনেয় দুর্দশা ভোগ করিতেছি।
উত্তর –
গ্রিনল্যান্ডের মতো ছোটো পাশ্চাত্য দেশের ইতিহাস থাকলেও সুবৃহৎ, সমৃদ্ধিশালী ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস নেই। অদৃষ্টবাদী, দৈবনির্ভরতায় বিশ্বাসী এবং ভীত জড় প্রকৃতির ভারতবাসী সময় ও সমাজসচেতন নয় বলেই তারা ইতিহাসবিমুখ। তাই সুমহান আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের পুণ্যভূমি হওয়া সত্ত্বেও ভারতবর্ষ বাল্যবিবাহরূপ নানা প্রকার অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ভেদাভেদ ও শাস্ত্রীয় অপব্যাখ্যায় জর্জরিত।
19. সহজভাবে আপনার জীবনের প্রাত্যহিক কাজ করে যাওয়ার চেয়ে সুন্দর এবং মহৎ আর কিছু হতে পারে না। মাঠের তৃণ থেকে আকাশের তারা পর্যন্ত তাই করছে; কেউ গায়ের জোরে আপনার সীমাকে অতিক্রম করবার জন্য চেষ্টা করছে না বলেই প্রকৃতির মধ্যে এমন গভীর শান্তি এবং অপার সৌন্দর্য। অথচ প্রাত্যকে যেটুকু করছে সেটুকু সামান্য নয়-ঘাস আপনার চূড়ান্ত শক্তি প্রয়োগ করে তবে ঘাসরূপে টিকে থাকতে পারে, শিকড়ের শেষ প্রান্তটুকু পর্যন্ত দিয়ে তাকে রসাকর্ষণ করতে হয়। সে যে নিজের শক্তি লঙ্ঘন করে বটগাছ হবার নিষ্ফল চেষ্টা করছে না, এইজন্যই পৃথিবী এমন সুন্দর শ্যামল হয়ে রয়েছে। বাস্তবিক, বড়ো বড়ো উদ্যোগ এবং লম্বা চওড়া কথার দ্বারা নয়, কিন্তু প্রাত্যহিক ছোটো ছোটো কর্তব্য সমাধা দ্বারাই মানুষের সমাজে যথাসম্ভব শোভা এবং শান্তি আছে। বসে বসে হাঁসফাঁস করা, কল্পনা করা, কোনো অবস্থাকেই আপনার যোগ্য মনে না করা, ইতিমধ্যে সমুখ দিয়ে সময়কে চলে যেতে দেওয়া, এর চেয়ে হেয় আর কিছু হতে পারে না। যখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করা যায়, নিজের সাধ্যায়ত্ত সমস্ত কর্তব্য সত্যের সঙ্গে, বলের সঙ্গে, হৃদয়ের সঙ্গে, সুখদুঃখের ভিতর দিয়ে পালন করে যাব, এবং যখন বিশ্বাস হয় তা করতে পারব, তখন সমস্ত জীবন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, ছোটোখাটো দুঃখবেদনা একেবারে দূর হয়ে যায়।
উত্তর –
যথাযথভাবে নিজের প্রাত্যহিক ছোটো ছোটো কর্তব্য পালনেই জীবন সুন্দর হয়। প্রকৃতিতে ক্ষুদ্র তৃণ থেকে শুরু করে সকলেই নিজ নিজ নির্দিষ্ট কাজটুকু করে ধরিত্রীকে সুন্দর, সুষমামণ্ডিত করেছে। তাই আমাদের উচিত অলীক কল্পনা, চিন্তায় কালাতিপাতের পরিবর্তে যাবতীয় ক্ষুদ্র দায়িত্বপালনের দ্বারা বহমান সময়ের যথাযথ ব্যবহার করা। আন্তরিকভাবে মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করে গেলে জীবনের দুঃখ দূর হয়ে, মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়।
20. জাতীয় আদর্শ-ব্যবস্থার প্রতিফলন হয় জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায়। সাহস করে একথাও বলা যায় যে, দেশের ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবনলক্ষ্যকে রূপ দেয় শিক্ষা, আবার জীবনলক্ষ্যও গড়ে তোলে শিক্ষাব্যবস্থা। এ-কথা শুধু যে মানুষের বেলাতেই ঘটে তা নয়, আমরা যাকে নিচু থাকের জীব বলি তাদের বেলাতেও। তির্যক প্রাণীদের শাবকেরাও বড়োদের আচার-আচরণ অনুকরণ করে ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রার জন্যে তৈরী হয়। মানবশিশুর মানস-গঠনেও অনেকখানি কাজ করে এই অনুকরণ-প্রবৃত্তি; তবে তার অনুকরণ-প্রবৃত্তিতে থাকে সচেতন ইচ্ছাও, শুধুই সহজ আবেগ নয়। এইভাবে শিক্ষা নিয়েই মানুষ বয়স্ক জীবনের দায়দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রস্তুত হয়। এখানেই মানবশিশুর সঙ্গে তির্যক জীবদের পার্থক্য। মানুষের সজ্ঞান, সুপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পশুপাখীদের আবেগ ও প্রবৃত্তিপ্রধান শিক্ষাব্যবস্থার তফাৎ।
উত্তর –
জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় আদর্শের আয়নাস্বরূপ। ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত জীবনের লক্ষ্যও শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা নির্ণীত হয়। মনুষ্যকুলের মতো জীবকুলও তার পূর্বপুরুষদের অনুকরণ করে চলে। তবে মানবসন্তানের সহজাত আবেগচালিত অনুকরণবৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির কারণেই মানুষের শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতির সঙ্গে মনুষ্যেতর প্রাণীদের শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতির পার্থক্য রয়েছে।
21. রামায়ণে দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ করেন নাই, মানুষই নিজ গুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন। মানুষেরই চরম আদর্শ স্থাপনের জন্য ভারতের কবি মহাকাব্য রচনা করিয়াছেন, এবং সেদিন হইতে আজ পর্যন্ত মানুষের এই আদর্শচরিত বর্ণনা ভারতের পাঠকমন্ডলী পরমাগ্রহের সহিত পাঠ করিয়া আসিতেছেন। রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়াছে। পিতা-পুত্রে, ভ্রাতায়-ভ্রাতায়, স্বামী-স্ত্রীতে যে ধর্মের বন্ধন, যে প্রীতি-ভক্তির সম্বন্ধ রামায়ণ তাহাকে এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে। দেশজয়, শত্রুবিনাশ, দুই প্রবল বিরোধী পক্ষের প্রচন্ড আঘাত-সংঘাত, এই সমস্ত ব্যাপারই সাধারণতঃ মহাকাব্যের মাধ্য আন্দোলন ও উদ্দীপনা সঞ্চার করিয়া থাকে। কিন্তু রামায়ণের মহিমা রামায়ণের যুদ্ধকে আশ্রয় করিয়া নাই, সে যুদ্ধ-ঘটনা রাম ও সীতার দাম্পত্যপ্রীতিকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষ্য মাত্র। পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভাতার জন্য ভাতার আত্মত্যাগ, পতি-পত্নীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে রামায়ণ তাহাই দেখাইয়াছে।
উত্তর –
রামায়ণে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির চরম আদর্শ স্থাপন করা হয়েছে। এই মহাকাব্যের চরিত্রগুলি দেবত্বের অবনমন নয়, বরং দৈব গুণান্বিত মানবের দেবত্বে উত্তরণ। আদর্শ পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, রাজা-প্রজার মধ্যে যে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, যা ভারতবর্ষের চিরকালের ঐতিহ্য, তাকেই তুলে ধরা হয়েছে রামায়ণে।
22. জীবন সম্বন্ধে একটি মহাসত্য এই, যেদিন হইতে আমাদের বাড়িবার ইচ্ছা স্থাগিত হয় সেইদিন হইতে জীবনের উপর মৃত্যুর ছায়া পড়ে। জাতীয় জীবন সম্বন্ধে একই কথা। যেদিন হইতে আমাদের বড় হইবার ইচ্ছা থামিয়াছে সেইদিন হইতেই আমাদের পতনের সূত্রপাত হইয়াছে। আমাদিগকে বাঁচিতে হইবে, সঞ্চয় করিতে হইবে, এবং বাড়িতে হইবে। তাহার জন্য কি করিয়া প্রকৃত ঐশ্বর্য লাভ হইতে পারে একাগ্রচিত্তে সেইদিকে লক্ষ্য রাখিবে।
দ্রোণাচার্য শিষ্যগণের পরীক্ষার্থ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘গাছের উপর যে পাখিটি বসিয়া আছে তাহাই লক্ষ্য, পাখি কি দেখিতে পাইতেছ?’ অর্জুন উত্তর করিলেন, ‘না, দেখিতে পাইতেছি না, কেবল তাহার চক্ষুমাত্র দেখিতেছি।’ এইরূপ একাগ্রচিত্ত হইলেই বাহিরের বিঘ্ন-বাধার মধ্যেও অবিচলিত থাকিয়া লক্ষ্যভেদ করিতে সমর্থ হইবে। তবে সেই লক্ষ্য কি? লক্ষ্য, শক্তি সঞ্চয় করা, যাহার দ্বারা অসাধ্যও সাধিত হয়।
জীবন সম্বন্ধে পরীক্ষা করিয়া দেখা যায় যে, শক্তিসঞ্চয় দ্বারাই জীবন পরিস্ফুটিত হয়। তাহা কেবল নিজের একাগ্র চেষ্টার দ্বারাই সাধিত হইয়া থাকে। যে কোনোরূপ সঞ্চয় করে না, সে পরমুখাপেক্ষী, সে ভিক্ষুক, সে জীবিত হইয়াও মরিয়া আছে।
যে সঞ্চয় করিয়াছে সে-ই শক্তিমান, সে-ই তাহার সঞ্চিত ধন বিতরণ করিয়া পৃথিবীকে সমৃদ্ধিশালী করিবে।
উত্তর –
জীবনের অগ্রগতি তখনই সম্ভব যখন জীবনের ভান্ডারে শক্তি সঞ্চিত থাকবে। যে এই জ্ঞান শক্তি সঞ্চয় করতে অক্ষম, সে পরনির্ভরশীল, ভিক্ষুকের সমতুল্য। তার সাহায্যে এই জীবন তথা পৃথিবীর কোনো সদর্থক উপকার, উন্নতিসাধন সম্ভব নয়। অর্জুনের মতো একাগ্রতার সাধনাতেই জীবনের অগ্রগতির লক্ষ্যপূরণ সম্ভব। একাগ্রতার জোরে, অসাধ্যসাধনের প্রকৃত শক্তি আহরণ করে জাতীয় জীবনে সমৃদ্ধি আনতে হয়।
23. শিক্ষিত লোকের মনে অশিক্ষিত জনসাধারণের প্রতি একটা অস্থিমজ্জাগত অবজ্ঞা আছে। যথার্থ শ্রদ্ধা ও প্রীতির সঙ্গে নিম্নশ্রেণীর গ্রাম-কর্মীদের সংসর্গ করা তাদের পক্ষে কঠিন। আমরা ভদ্রলোক, সেই ভদ্রলোকের সমস্ত দাবী আমরা নীচের লোকেদের কাছ থেকে আদায় করব, এ কথা আমরা ভুলতে পারি নে। আমরা তাদের হিত করতে এসেছি, এটা তারা পরম সৌভাগ্য জ্ঞান করে, এক মুহূর্তে আমাদের পদানত হবে, আমরা যা বলব তাই মাথায় করে নেবে, এ আমরা প্রত্যাশা করি। কিন্তু ঘটে উল্টো। গ্রামের চাষীরা ভদ্রলোকদের বিশ্বাস করে না। তারা তাদের আবির্ভাবকে উৎপাত এবং তাদের মতলবকে মন্দ বলে গোড়াতেই ধরে নেয়। দোষ দেওয়া যায় না, কারণ যারা উপরে থাকে তারা অকারণে উপকার করবার জন্যে নীচে নেমে আসে এমন ঘটনা তারা সর্বদা দেখে না – উল্টোটাই দেখতে পায়। তাই যাদের বুদ্ধি কম, তারা বুদ্ধিমানকে ভয় করে। গোড়াকার এই অবিশ্বাসকে এই বাধাকে নম্রভাবে স্বীকার করে নিয়ে যারা কাজ করাত পারে, তারাই এ কাজের যোগ্য। নিম্নশ্রেণীর অকৃতজ্ঞতা অশ্রদ্ধাকে বহন করেও আপনাকে তাদের কাজে উৎসর্গ করতে পারে, এমন লোক আমাদের দেশে অল্প আছে। কারণ নীচের কাছ থেকে সকল প্রকারে সম্মান ও বাধ্যতা দাবী করা আমাদের চিরদিনের অভ্যাস।
উত্তর –
শিক্ষিত অশিক্ষিতকে মনেপ্রাণে অবজ্ঞা করে, নিম্নশ্রেণি উচ্চবর্গকে করে অবিশ্বাস। বহুকালব্যাপী উচ্চবর্গ দ্বারা নিম্নবর্গের শোষণ ও বঞ্চনার ফলেই এমন মনোভাব তৈরি হয়েছে। নীচের অকৃতজ্ঞতা ও অশ্রদ্ধাকে যুগে যুগে বহন করে প্রকৃত মানবিক হিতার্থে নিম্নশ্রেণির কাজে আত্মোৎসর্গ করার লোক আমাদের দেশে অল্পই আছে।
24. ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু অধিকাংশ লোকের শ্রমনিবেদনের পরেও ভারতের কৃষির অবস্থা দুর্বল। সুতরাং কৃষকদের অবস্থা অন্যান্য শিল্পশ্রমিকদের অবস্থা অপেক্ষা অনেক খারাপ। আবার কৃষকদের মধ্যেও দুইটি শ্রেণীবিভাগ করা যায়। কিছু কিছু কৃষকের নিজস্ব জমি আছে এবং সেই জমিতেই তাহারা সারা বছর নিযুক্ত থাকে। কিন্তু ভারতবর্ষের অধিকাংশ কৃষকেরই জমি নাই। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর কৃষকদের বলা হয় কৃষিশ্রমিক। যে ব্যক্তি বৎসরের অর্ধেক বা তাহার বেশি সময় অপরের জমিতে মজুরী গ্রহণ করিয়া কাজ করে, তাহাদিগকে কৃষিশ্রমিক বলিয়া ‘সর্বভারতীয় কৃষিশ্রমিক অনুসন্ধান কমিটি’ সংজ্ঞাভুক্ত করিয়াছেন। কৃষিশ্রমিকদিগকে দুইভাগে ভাগ করা যায় – সাময়িক শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিক। সাময়িক শ্রমিকের কৃষিক্ষেতে নিয়োগের কোন নিশ্চয়তা থাকে না। অপরপক্ষে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরা বৎসরে অন্তত কিছুকাল কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকে। এই কৃষিশ্রমিকদের মধ্যে ভূমিহীন কৃষক, সামান্য ভূমিসম্পন্ন কৃষক, রায়ত এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের গ্রাম কারিগরকেও গণ্য করা হয়। যেহেতু ইহাদের নিজস্ব জমি বা উপজীবিকা হইতে সংবৎসরের সংস্থান হয় না, সেই জন্য ইহারা বাধ্য হইয়া কৃষিশ্রমিকের কার্য করিয়া থাকে।
উত্তর –
কৃষিনির্ভর দেশ ভারতের কৃষির অবস্থা খুবই দুর্বল হওয়ায় ‘কৃষিশ্রমিক’দের অবস্থাও শোচনীয়। এদের বেশির ভাগেরই নিজস্ব জমি নেই বলে বৎসরের অর্ধেক সময়ই এরা অপরের জমিতে কাজ করে। এরা আবার সাময়িক ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকে বিভক্ত। এরা অনিশ্চিত অথবা কিছুকাল কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকে। এ ছাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র শিল্পের কারিগররাও জীবিকার জন্য কৃষি শ্রমিকের কাজ করে।
25. 1176 সালে গ্রীষ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লিতে শত শত মৃন্ময় গৃহ, মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পলাইয়াছে ঠিকানা লহি, আজ হাটবার, হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহিন হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে, ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে, দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে, অধ্যাপক টোল বন্ধ করিয়াছে, শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না, বৃক্ষে পক্ষী দেখি না, গোচরণে গোরু দেখি না, কেবল শ্মশানে শৃগাল-কুক্কুর। এক বৃহৎ অট্টালিকা-তাহার বড় বড় ছড়ওয়ালা থাম দূর হইতে দেখা যায়-সেই গৃহারণমধ্যে শৈলশিখরবৎ শোভা পাইতেছিল। শোভাই বা কি! তাহার দ্বার রুদ্ধ, গৃহ মনুষ্যসমাগমশূন্য, শব্দহীন, বায়ু প্রবেশের পক্ষেও বিঘ্নময়। তাহার অভ্যন্তরে ঘরের ভিতর মধ্যাহ্নে অন্ধকার, অন্ধকারে নিশীথ ফুল্লকুসুম-যুগলবৎ এক দম্পতি বসিয়া ভাবিতেছে। তাহাদের সম্মুখে মন্বন্তর।
উত্তর –
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বিপর্যস্ত পদচিহ্ন গ্রামে প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহ চলছে। গ্রামখানি গৃহময় হলেও জনহীন। বাজারে দোকান-পাট থাকলেও চারিদিক নীরব-নিস্তব্ধ। তাঁতি, ব্যবসায়ী, দাতা, অধ্যাপক সবাই আপন কর্ম পরিত্যাগ করেছে। শ্মশানতুল্য জনহীন গ্রামে একটিই মাত্র সুবৃহৎ অট্টালিকা চোখে পড়ে, যার দ্বার রুদ্ধ। সেই গৃহমধ্যে রাত্রিতে ফোটা দুটি ফুলের মতো দম্পতি মন্বন্তরের কথা ভাবছে।
26. সে নিশ্চিন্দিপুর আর নাই। এখন যদি সে এখানে আবার বাসও করে সে অপূর্ব আনন্দ আর পাইবে না – এখন সে তুলনা করিতে শিখিয়াছে, সমালোচনা করিতে শিখিয়াছে, ছেলেবেলায় যারা ছিল সাথী – এখন তাদের সঙ্গে আর অপুর কোনদিকেই মিশ খায় না – তাদের সঙ্গে কথা কহিয়া আর সে সুখ নাই, তারা লেখাপড়া শিখে নাই, এই পঁচিশ বছর গ্রাম ছাড়িয়া অনেকেই কোথাও যায় নাই – সবারই পৈতৃক কিছু জমিজমা আছে, তাহাই হইয়াছে তাদের কাল, তাদের মন তাদের দৃষ্টি পঁচিশ বৎসর পূর্বের সেই বাল্যকালের কোঠায় আজও নিশ্চল। … কোনদিক হইতে অপুর আর কোন যোগ নাই তাহাদের সহিত। বাল্যে কিন্তু এসব দৃষ্টি খোলে নাই – সব জিনিসের উপর একটা অপরিসীম নির্ভরতার ভাব ছিল – সব অবস্থাকেই মানিয়া লইত বিনা বিচারে। সত্যকার জীবন তখনই যাপন করিয়াছিল নিশ্চিন্দিপুরে।
উত্তর –
তুলনা ও প্রতিতুলনার বশবর্তী হয়ে অপুর মানসপটে শৈশবের নিশ্চিন্দিপুরের সঙ্গে বর্তমানের নিশ্চিন্দিপুরের কোনো মিলই নেই। বাল্যসাথিরা কূপমণ্ডুকের মতো বাল্যবেষ্টনী ও জমিজমার মধ্যে আটকে থাকায় তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এখন আর অপুর সুখ নেই। একদিন নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে অপুর শৈশব পূর্ণ নির্ভরতায় কাটলেও আজ সেই সত্যকার জীবন বহুদূরে।
27. রাত্রির যে একটা রূপ আছে, তাহাকে পৃথিবীর গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, জল-মাটি, বন-জঙ্গল প্রভৃতি জাতীয় দৃশ্যমান বস্তু হইতে পৃথক করিয়া, একান্ত করিয়া দেখা যায়, ইহা যেন আজ প্রথমে চোখে পড়িল। চাহিয়া দেখি, অন্তহীন কালো আকাশতলে পৃথিবী-জোড়া আসন করিয়া গভীর রাত্রি নিমীলিত চক্ষে ধ্যানে বসিয়াছে, আর সমস্ত বিশ্বচরাচর মুখ খুঁজিয়া নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া অত্যন্ত সাবধানে স্তবধ হইয়া অটল শান্তি রক্ষা করিতেছে। হঠাৎ চোখের উপরে যেন সৌন্দর্যের তরঙ্গ খেলিয়া গেল। মনে হইল কোন মিথ্যাবাদী প্রচার করিয়াছে – আলোই রূপ, আঁধারের রূপ নাই? এতবড় ফাঁকি মানুষে কেমন করিয়া নীরবে মানিয়া লইয়াছে? এই যে আকাশ-বাতাস স্বর্গ-মর্ত্য পরিব্যাপ্ত করিয়া দৃষ্টির অন্তরে বাহিরে প্লাবন বহিয়া যাইতেছে, মরি! মরি! এমন অপরূপ রূপের প্রস্রবণ আর কবে দেখিয়াছি! এ ব্রহ্মাণ্ডে যাহা যত গভীর, যত অচিন্ত্য, যত সীমাহীন – তাহা ততই অন্ধকার। অগাধ বারিধি মসীকৃষ্ণ; অগম্য গহন অরণ্যানী ভীষণ আঁধার; সর্ব লোকাশ্রয় আলোর আলো, গতির গতি, জীবনের জীবন সকল সৌন্দর্যের প্রাণপুরুষও মানুষের চোখে নিবিড় আঁধার। কিন্তু সে কি রূপের অভাবে? যাহাকে বুঝি না, জানি না, যাহার অন্তরে প্রবেশের পথ দেখি না – তাহাই তত অন্ধকার। মৃত্যু তাই মানুষের চোখে এত কালো, তাই পরলোকের পথ এমন আঁধারে মগ্ন।
উত্তর –
বাস্তবের দৃশ্যমান জগতে আলোই রূপ, আঁধার রূপহীন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গভীর, অচিন্ত্য ও সীমাহীন বস্তুই অন্ধকারে পূর্ণ। অগাধ জলরাশি, গহন অরণ্য, এমনকি জীবনের সকল সৌন্দর্যের প্রাণপুরুষও আমাদের চোখে নিবিড় আঁধার। আসলে যাকে বুঝি না, যার ভিতরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ তা ততই অন্ধকার। আর এই কারণেই মৃত্যু ও পরলোকের পথ আঁধারে ঢাকা।
28. পূর্বে এমন দিন ছিল যখন ইংরেজি পাঠশালা হইতে আমাদের একেবারে ছুটি ছিল না। বাড়ি আসিতাম, সেখানেও পাঠশালা পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া আসিত। বন্ধুকেও সম্ভাষণ করিতাম ইংরেজিতে, পিতাকেও পত্র লিখিতাম ইংরেজিতে, প্রাণের কথা বলিতাম ইংরেজি কাব্যে, দেশের লোককে সভায় আহ্বান করিতাম ইংরেজি বক্তৃতায়। আজ যখন সেই পাঠশালা হইতে একেবারে না হউক, ক্ষণে ক্ষণে ছুটি পাইয়া থাকি তখন সেই ছুটির সময়টাতে আনন্দ করিব কোথায়, মাতার অন্তঃপুরে নহে কি? দিনের পড়া তো শেষ হইল, তারপর ক্রিকেট খেলাতেও না হয় রণজিৎ হইয়া উঠিলাম। তার পরে? তার পরে গৃহবাতায়ন হইতে মাতার স্বহস্তদ্ভালিত সন্ধ্যাদীপটি কি চোখে পড়িবে না? যদি পাড়, তবে কি অবজ্ঞা করিয়া বলিব, ‘ওটা মাটির প্রদীপ’। এই মাটির প্রদীপের পশ্চাতে কি মাতার গৌরব নাই? যদি মাটির প্রদীপ হয় তো সে দোষ কার? মাতার কক্ষে সোনার প্রদীপ গড়িয়া দিতে কে বাধা দিয়াছে? যেমনই হউক না কেন, মাটিই হউক আর সোনাই হউক, যখন আনন্দের দিন আসিবে তখন এইখানেই আমাদের উৎসব, আর যখন দুঃখের দিন ঘনাইয়া আসে তখন রাজপথে দাঁড়াইয়া চোখের জল ফেলা যায় না – তখন ওই গৃহ ছাড়া আর গতি নাই।
উত্তর –
পূর্বে ইংরেজি পাঠশালায় বন্দি থাকার দরুন ঘরে-বাইরে আমাদের প্রকাশ মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। ছুটির আনন্দ-উপভোগের উপযুক্ত স্থান মায়ের হাতে গড়া গৃহকোণ। মায়ের হাতে জ্বালা সন্ধ্যা-প্রদীপ গৌরবের বস্তু, তা সে মাটিরই হোক অথবা সোনার। আসলে মায়ের হাতে জ্বালা প্রদীপের আলোতেই উৎসবের আনন্দ ঘনীভূত হয়ে ওঠে। আর দুঃখের দিনে গৃহকোণই আমাদের প্রকৃত আশ্রয়স্থল।
29. আমাদের দেশের সকল অমঙ্গলের মূল কোথায়। যেখানে আমরা বিচ্ছিন্ন। অতএব আমাদের দেশে বহুকে এক করিয়া তোলাই দেশহিতের সাধনা। বহুকে এক করিয়া তুলিতে পারে কে? ধর্ম। প্রয়োজনের প্রলোভনে ধর্মকে বিসর্জন দিলেই বিশ্বাসের বন্ধন শিথিল হইয়া যায়। যে অধর্ম দ্বারা আমরা অন্যকে আঘাত করিতে চাই সেই অধর্মের হাত হইতে আমরা নিজেকে বাঁচাইব কী করিয়া, মিথ্যাকে-অন্যায়কে যদি আমরা কোনো কারণেই প্রশ্রয় দিই ভবে আমরা নিজেদের মধ্যেই সন্দেহ বিশ্বাসঘাতকতা ভ্ৰাতৃবিদ্রোহের বীজ বপণ করিব – এমন একটি প্রদীপকে নিভাইয়া দিব যে আলোকের অভাবে পুত্র মাতাকে আঘাত করিবে, ভাই ভাইয়ের পক্ষে বিভীষিকা হইয়া উঠিবে। যে ছিদ্র দিয়া আমাদের দলের মধ্যে বিশ্বাসহীন, চরিত্রহীন ধর্মসংশয়ীগণ অবাধে প্রবেশ করিতে পারিবে সেই ছিদ্রকেই দলবৃদ্ধি শক্তিবৃদ্ধির উপায় মনে করিয়া কি কোনো দূরদর্শী কোনো যথার্থ দেশহিতৈষী নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন।
উত্তর –
পরস্পর থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অমঙ্গল সারা দেশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। একে দূর করার ক্ষমতা আছে সত্য ধর্মের। মিথ্যাকে ও অন্যায়কে আশকারা দেওয়ার ফলে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, হিংসা, সন্দেহ বা অবিশ্বাস আখেরে ক্ষতি করে আমাদেরই। এগুলি এড়িয়ে সত্যের প্রতি একনিষ্ঠ থাকলে দেশ ও দশের মঙ্গল।
30. আমাদের বিলাসিতা বাড়িয়াছে বলিয়া অনেকে মনে করেন যে, ইহা আমাদের ধনবৃদ্ধির লক্ষণ। কিন্তু এ কথা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে যে, পূর্বে যে অর্থ সাধারণের কাজে ব্যয়িত হইত এখন তাহা ব্যক্তিগত কাজে ব্যয়িত হইতেছে। ইহাতে ফল হইতেছে দেশের ভোগবিলাসের স্থানগুলি সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিতেছে – শহরগুলি ফাঁপিয়া উঠিতেছে – কিন্তু পল্লীগুলিতে দারিদ্র্যের অবধি নাই। সমস্ত বাংলাদেশের পল্লীতে দেব-মন্দির ভাঙিয়া পড়িতেছে। পুষ্করিণীর জল স্নান-পানের অযোগ্য হইতেছে, গ্রামগুলি জঙ্গলে ভরিয়া উঠিয়াছে এবং যে-দেশ বারো মাসে তের পার্বণে মুখরিত হইয়া থাকিত, সে-দেশ নিস্তবধ নিরানন্দ হইয়া গিয়াছে। দেশের অধিকাংশ অর্থ শহরে আকৃষ্ট হইয়া কোঠাবাড়ি, গাড়িঘোড়া, সাজ-সরঞ্জাম ও আহার-বিহারেই উড়িয়া যাইতেছে। অথচ যাঁহারা এইরূপ ভোগবিলাসে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন তাঁহারা প্রায় কেহই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে নাই; তাঁহাদের অনেকেরই টানাটানি, অনেকেরই ঋণ, আনকেরই পৈতৃক সম্পত্তি মহাজনের দায়মুক্ত করিবার জন্য চিরজীবন নষ্ট হইতেছে। যে ধন সমস্ত দেশের বিচিত্র অভাবাক চারিদিকে মোচনের জন্য ব্যাপ্ত হইত, সেই ধন সংকীর্ণ স্থানে আবদ্ধ হইয়া ঐশ্বর্যের মায়া সৃজন করিতেছে তাহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। সমস্ত শরীরকে প্রতারণা করিয়া কেবল মুখেই যদি রক্তসঞ্চার হয়, তবে তাহাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না।
উত্তর –
বিলাসিতা মানেই ধনবৃদ্ধির লক্ষণ নয়। পূর্বের সমষ্টিগত ভাবনা থেকে মানুষ হয়েছে আত্মকেন্দ্রিক; তাই ভোগবিলাসের মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত ভাবনা। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার বাড়বাড়ন্ত দেখা দিলেও গ্রাম্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেনি, নিরানন্দের মধ্যেই দিন কাটছে। তাদের বাড়ি-গাড়ি, আহার-বিহার সবের মধ্যেই টানাটানি। সাতপুরুষের ভিটেমাটি মহাজনের কবলে। তাই বিলাসিতা বাড়লেও সকলেই যে একই পথের পথিক এমন কথা বলা যাবে না। ভোগ রসনাতৃপ্তি করে, কিন্তু শরীরের কলকবজা হয় বিকল।
31. দেখ, আমি চোর বটে কিন্তু আমি কি সাধ করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁহারা বড় বড় সাধু চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাঁহারা অনেক চোর অপেক্ষাও অধার্মিক। তাঁহাদের চুরি করিবার প্রয়োজন নাই বলিয়াই চুরি করেন না। কিন্তু তাঁহাদের প্রয়োজনাতীত ধন থাকিলেও চোরের প্রতি মুখ তুলিয়া চাহেন না, ইহাতেই চোর চুরি করে। অধর্ম চোরের নহে-চোর যে চুরি করে সে অধর্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শতগুণে দোষী। চোরের দণ্ড হয়, চুরির মূল যে কৃপণ তাহার দণ্ড হয় না কেন?
উত্তর –
চোরের চুরি করার কারণ অভাব। তার অভাব সৃষ্টির মূলে আছে কৃপণ ধনীর প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধনসঞ্চয়। কৃপণ ধনী সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখে বলেই দরিদ্র মানুষ চুরি করতে বাধ্য হয়। তাই মূল দোষী কৃপণ সম্পদশালীরই দণ্ড হওয়া উচিত।
32. ভারতবর্ষের একটি সম্পূর্ণ ভৌগোলিক মূর্তি আছে। এর পূর্বপ্রান্ত থেকে পশ্চিমপ্রান্ত এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত যে একটি সম্পূর্ণতা বিদ্যমান, প্রাচীনকালে তার ছবি অন্তরে গ্রহণ করার ইচ্ছা দেশে ছিল, দেখতে পাই। একসময়, দেশের মনে নানা কালে নানা স্থানে, যা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, তা সংগ্রহ করে এক করে দেখবার চেষ্টা, মহাভারতে খুব সুস্পষ্টভাবে জাগ্রত দেখি। তেমনি ভারতবর্ষের ভৌগোলিক স্বরূপকে অন্তরে উপলব্ধি করার একটি অনুষ্ঠান ছিল, সে তীর্থভ্রমণ। দেশের পূর্বতম অঞ্চল থেকে পশ্চিমতম অঞ্চল এবং হিমালয় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত সর্বত্র এর পবিত্র পীঠস্থান রয়েছে, সেখানে তীর্থ স্থাপিত হয়ে একটি ভক্তির ঐক্যজালে সমস্ত ভারতবর্ষকে মনের ভিতরে আনার সহজ উপায় সৃষ্টি করেছে।
উত্তর –
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের ভৌগোলিক বিভিন্নতাকে একটি সম্পূর্ণতার মূর্তির মধ্যে এক করে দেখার চেষ্টা হয়েছে। মহাভারতে তার নজির আছে। তীর্থভ্রমণ ছিল সেই উপলব্ধির একটি উপায়। আসমুদ্রহিমাচল সর্বত্র তীর্থস্থাপনের ফলে ভক্তির সূত্রে ভারতবর্ষের ভৌগোলিক স্বরূপটি একটি সামগ্রিকতায় প্রকাশিত হত।
33. পৃথিবী আমাদের যে অন্ন দিয়ে থাকে, সেটা শুধু পেট ভরাবার জন্য নয়, সেটাতে আমাদের চোখ জুড়োয়, আমাদের মন ভোলে। আকাশ থোক আকাশে সূর্যকিরণের যে স্বর্ণরাগ দিগন্ত থেকে দিগন্তে পাকা ফসল ফলায়, তারই সঙ্গে সুর মেলায় এমন সোনার রাগিণী। সেই রূপ দেখে মানুষ কেবল ভোজনের কথাই ভাবে না; সে উৎসবের আয়োজন করে। সে দেখতে পায় লক্ষ্মীকে, যিনি একইকালে সুন্দরী ও কল্যাণী। ধরণীর ধনভাণ্ডারে কেবল যে আমাদের ক্ষুধানিবৃত্তির আশা, তা নয়; সেখানে আছে সৌন্দর্যের অমৃত। গাছের ফল আমাদের ডাক দেয় শুধু পুষ্টিকর শস্যপিণ্ড দিয়ে নয়, রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ দিয়ে। ছিনিয়ে নেবার হিংস্রতার ডাক এতে নেই, এতে আছে একত্র নিমন্ত্রণের সৌহার্দ্যের ডাক।
উত্তর –
বসুন্ধরার দান করা শস্য ক্ষুধানিবৃত্তি ছাড়াও রূপে-রসে-গন্ধে-বর্ণে মানুষের সৌন্দর্য তৃষ্ণারও নিবারণ ঘটায়। হিংস্র দখলদারিতে সেই নিমন্ত্রণের অপমান হয়। উৎসবের মধ্যেই মানুষ দেখতে পায় সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর কল্যাণময়ী সৌন্দর্য।
34. যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। আমরা কিয়ৎ পরিমাণে আবশ্যক শৃঙ্খলে বদ্ধ হইয়া থাকি এবং কিয়ৎ পরিমাণে স্বাধীন। আমাদের দেহ সাড়ে তিল হাতের মধ্যে বন্ধ কিন্তু ভাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণের গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য আনকখানি স্থান রাখা আবশ্যক। নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটি, অর্থাৎ যতটুকু কেবলমাত্র শিক্ষা অত্যাবশ্যক তাহারই মধ্যে শিশুদিগকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনই তাহাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না শিখাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না – বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে আনকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।
উত্তর –
শুধুমাত্র প্রয়োজনের শৃঙ্খলেই মানুষের জীবন বদ্ধ থাকতে পারে না। ঘরের আয়তন শরীরের তুলনায় অনেক বেশি হয় যাতে চলাফেরার স্বাধীনতায় স্বাস্থ্য, আনন্দ বজায় থাকে। শিক্ষাক্ষেত্রেও আবশ্যক শিক্ষার সঙ্গে শিশুদের স্বাধীন সৃজনমুখী পাঠ। তবেই যথার্থ মানসিক বিকাশ সম্ভব।
35. পৃথিবীতে যাহার দিকে তাকাও দেখিবে – সে নিজের অবস্থায় অসন্তুষ্ট। দরিদ্র কিসে ধনী হইবে সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন; ধনী চোর-ডাকাতের ভয়ে অস্ত, রাজা শত্রুর ভয়ে ভীত। এককথায় পৃথিবীতে এমন কেহ নাই যে পূর্ণ সুখে সুখী। অথচ কৌতুকের বিষয় এই – পৃথিবী ছাড়িয়া যাইতেও কেহ প্রস্তুত নহে। মৃত্যুর নাম শুনিলেই দেখি মানুষের মন শুকাইয়া যায়। মানুষ যতই দরিদ্র হউক, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, যদি অনাহারে কাটাতেই হয়, পৃথিবীর কোনো আরামই যদি ভাগ্যে না থাকে তথাপি সে মৃত্যুকে চাহে না। সে যদি কঠিন পীড়ায় পীড়িত হয়, যদি শয্যা হইতে উঠিবার শক্তিও না থাকে, তথাপি সে মৃত্যুর প্রার্থী হইবে না। কে না জানে যে শত বৎসবের পরমায়ু থাকিলেও একদিন না একদিন মরিতে হইবে।
উত্তর –
ধনী, দরিদ্র এমনকি দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মানুষও অতৃপ্ত-অসুখী জীবন কাটায়। তথাপি কেউই জীবন ত্যাগ করতে চায় না। মৃত্যু অনিবার্য, জীবন দুঃখের, তবু কেউ মৃত্যু চায় না- এ -এক কৌতুকের বিষয়।
36. যেটা পাঠ্য বই, তাতে ছবিটা থাকা চাই লেখাতেই, রংটা লাগালো চাই ক্ষুদ্র এবং খুব সম্ভব অনিচ্ছুক পাঠকের মনটিতেই। সেইসঙ্গে দ্রষ্টব্য ছবি – থাকা ভালো নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা অতিরঞ্জিত হলে তাতে উদ্দেশ্যের পরাভব ঘটে। যদি বলি ‘লাল ফুল, কালো মেঘ’ সেটা তো নিজেই একটা ছবি হল, মেঘলা দিনে মাঠের মধ্যে কোথাও একটি লাল ফুল ফুটে আছে এরকম একটা দৃশ্যেরও তাতে আভাস থাকে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে টকটকে লাল হুবহু একটি গোলাপ ফুল বসিয়ে দিলে তাতে চোখের সুখ কল্পনাকে বাধা দেয়। এখানে উদ্দেশ্য হলো – চোখ ভোলানো নয়, চোখ ফোটানো আর দেহের চোখ অত্যধিক আদর পেলে মনের চোখ কুঁড়ে হয়ে পড়ে, কল্পনা সবল হতে পারে না।
উত্তর –
পাঠ্যবইয়ে আঁকা ছবি, ছবির ইঙ্গিতকে অতিক্রম করে নিজেই স্বপ্রতিষ্ঠ হলে লেখার প্রয়োজনীয়তায় বাধা পড়বে। অলংকরণ হিসেবে তার কাজ পাঠকের কল্পনাশক্তিকে উদ্দীপ্ত করে লেখার মধ্যে নিহিত ছবিটির ইশারাকে স্পষ্ট করে তোলা।
37. প্রবাহই জীবন। মানুষ যতক্ষণ বাঁচিয়া থাকে, ততক্ষণ একটা ধারা তাহার ভিতর দিয়া অনুক্ষণ বহিয়া যাইতে থাকে। বাহিরের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় যাবতীয় বস্তুকে সে গ্রহণ করে, আবার ত্যাগও করে যাহাতে তাহার আবশ্যক নাই, যে বস্তু দূষিত, তাহাকে পরিবর্জন করাই প্রাণের ধর্ম। কিন্তু মরিলে আর যখন ত্যাগ করিবার ক্ষমতা থাকিবে না তখনই বাহির হইতে যাহা আসে তাহা কায়েম হইয়া বসিয়া যায় এবং মৃতদেহটাকে পচাইয়া তোলে। জীবন্ত সমাজ এ নিয়ম স্বভাবতই জানে। সে জানে, যে বস্তু তাহার কাজে লাগিতেছে না, মমতা করিয়া তাহাকে ঘরে রাখিলে মরিতেই হইবে।
উত্তর –
জীবনের ধর্ম গ্রহণের মধ্য দিয়ে দূষিত, অনাবশ্যক বস্তুগুলি বর্জন করা। বহনক্ষমতার অভাবে মৃত্যুর পর দেহে পচন ঘটে তেমনি সমাজকেও জীবন্ত থাকতে গেলে, অপ্রয়োজনীয় লোকাচার, সংস্কার, নিয়মবিধি, যা জীর্ণ, অব্যবহার্য-তা নির্মমভাবে পরিত্যাগ করতে হবে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের “সারাংশ” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই অংশটি নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নবম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন নিয়মিত আসে। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমরা সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ।





মন্তব্য করুন