আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক বাংলার পঞ্চম পাঠের প্রথম অংশ, ‘অভিষেক,’ এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করবো। এই অংশটি মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই বিষয়ে প্রায়শই পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য খুবই উপকারী হবে।
কবি পরিচিতি
জন্ম –
1801 খ্রিস্টাব্দের 25 জানুয়ারি, বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার অন্তর্গত সাগরদাঁড়ি গ্রামে মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত, মা জাহ্নবী দেবী।
ছাত্রজীবন –
1833 খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন কলকাতার হিন্দু কলেজের জুনিয়র স্কুল বিভাগে ভর্তি হন। পরের বছর ওই স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় শেকসপিয়ারের কবিতা থেকে আবৃত্তির জন্য তিনি পুরস্কার পান। 1841 খ্রিস্টাব্দে তিনি জুনিয়র বৃত্তি নিয়ে হিন্দু কলেজের সিনিয়র বিভাগে ভর্তি হন এবং 1842 খ্রিস্টাব্দে স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণপদক লাভ করেন। পরিবারের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও 1843 খ্রিস্টাব্দের 9 ফেব্রুয়ারি মধুসূদন কলকাতার ওল্ড মিশন গির্জায় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। 1844 – এর নভেম্বরে তিনি বিশপ্স কলেজে গ্রিক, লাতিন ও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হন।
কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন –
1848 সালে মধুসূদন মাদ্রাজ চলে যান এবং ব্ল্যাক টাউনের অ্যাসাইলাম স্কুলে ইংরেজির শিক্ষকরূপে যোগ দেন। বিয়ে করেন মেরি রেবেকা ম্যাকটাভিসকে। Timothy Penpoem ছদ্মনামে Madras Circular and General Chronicle, Athenaeum এবং Spectator পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগেও তিনি কাজ করতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে Athenaeum পত্রিকা সম্পাদনা করেন। 1849 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য The Captive Ladie।
1851 খ্রিস্টাব্দে তিনি Hindu Chronicle নামক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। 1852-তে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি হাই স্কুলের শিক্ষক নিযুক্ত হন। 1854-তে তিনি দৈনিক Spectator পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পান। 1855 খ্রিস্টাব্দে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। চার সন্তানের জননী রেবেকার সঙ্গেও এই সময় তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। পরের বছর তিনি এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়াকে বিয়ে করেন। অর্থকষ্ট ও স্থায়ী চাকরির অভাবের মধ্যেও তিনি সাহিত্যচর্চা বন্ধ করেননি। 1859 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে তাঁর শর্মিষ্ঠা নাটক প্রকাশিত হয়। সেপ্টেম্বরে নাটকটি বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে অভিনীত হয়ে প্রশংসিত হলে তিনি নাটক রচনায় আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। 1860 – এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয় পদ্মাবতী নাটক, মে মাসে প্রকাশ পায় তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য। 1861 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় মেঘনাদবধ কাব্য – এর প্রথম খণ্ড। এ বছর 12 ফেব্রুয়ারি ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ প্রবর্তনের জন্য তিনি কালীপ্রসন্ন সিংহের বাড়িতে সংবর্ধিত হন।
মার্চ মাসে পাদরি লঙ – এর ভূমিকা-সহ By a Native ছদ্মনামে নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন। জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় তাঁর ব্রজাঙ্গনা কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য (দ্বিতীয় খণ্ড) এবং আত্মবিলাপ। আগস্টে প্রকাশিত হয় কৃষ্ণকুমারী নাটক। 1862 খ্রিস্টাব্দে বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকাশিত হয়। এ সময়ে তিনি কিছুদিনের জন্য হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদনাও করেন। 1862 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে আইন পড়ার জন্য মধুসূদন ইংল্যান্ড যান। কিন্তু আবহাওয়া ও বর্ণবিদ্বেষ সহ্য করতে না পেরে জুন মাসে কবি ফ্রান্সের ভার্সাইতে চলে যান। সেখানে তিনি চরম আর্থিক সংকটে পড়েন, যা থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে মুক্ত করেন। এখানে বসেই মধুসূদন তাঁর বিখ্যাত সনেটগুলি রচনা করেন।
1866 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাবলী প্রকাশিত হয়। এ বছরের 17 নভেম্বর তিনি ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। 1867 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। 1870 – এ তিনি প্র্যাকটিস ছেড়ে প্রিভি কাউন্সিলের অনুবাদ বিভাগের পরীক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। 1871 – এর সেপ্টেম্বরে তাঁর হেক্টর বধ কাব্য প্রকাশিত হয়। এ সময় হাইকোর্টের চাকরি ছেড়ে দেন মধুসূদন এবং 1872 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চকোট রাজার আইন-উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। আবার সেপ্টেম্বরে তিনি আইনব্যবসায় ফিরে আসেন। সে বছরের ডিসেম্বরে বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য অর্থের বিনিময়ে মায়াকানন রচনা করেন। একই সাথে লেখা শুরু করেন তাঁর অসমাপ্ত রচনা বিষ না ধনুর্গুণ।
জীবনাবসান –
1873 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মধুসূদন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে বছরই 29 জুন রবিবার বিকেলে মধুসূদন প্রয়াত হন।
উৎস
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যর প্রথম সর্গ ‘অভিষেক’ থেকে পাঠ্য অংশটি নির্বাচিত হয়েছে।
সারসংক্ষেপ
পাঠ্য কবিতার সূচনাতেই দেখা যায়, সোনার আসন ছেড়ে উঠে ইন্দ্রজিৎ ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে প্রণাম করে, তাঁর সেখানে আসার কারণ জানতে চান। ধাত্রী প্রভাষার ছদ্মবেশে আসা দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রজিৎকে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ এবং লঙ্কার দুর্দশার বিষয়ে জানান। রাবণ যে প্রতিশোধের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সে কথাও তিনি বলেন। রাতের যুদ্ধে যাঁকে তিনি হত্যা করেছেন, সেই রামচন্দ্র কীভাবে তাঁর প্রিয় অনুজকে বধ করেছেন, তা ভেবে ইন্দ্রজিৎ অত্যন্ত বিস্মিত হন। দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রজিৎকে রাক্ষসদের বংশ এবং সম্মান রক্ষার জন্য দ্রুত লঙ্কায় ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। ক্রুদ্ধ ইন্দ্রজিৎ আকস্মিক এই দুর্ঘটনার সংবাদ শুনে নিজেকে তীব্রভাবে ধিক্কার দেন। শত্রু যখন লঙ্কাকে ঘিরে ধরেছে, তখন তিনি প্রমোদবিলাসে মত্ত ছিলেন — এটাই ছিল তাঁর আত্মধিক্কারের কারণ। শত্রুদের পরাজিত করে সমস্ত অপবাদ ঘোচাতে এবং লঙ্কাকে সুরক্ষিত করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন।
যুদ্ধের সাজে নিজেকে প্রস্তুত করতে করতে ইন্দ্রজিতের সামনে স্ত্রী প্রমীলা এসে তাঁর গতি রোধ করেন। প্রমীলা ইন্দ্রজিৎকে যুদ্ধে যেতে দিতে চান না। তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ইন্দ্রজিৎ প্রমীলাকে আশ্বস্ত করেন এবং রামচন্দ্রকে বধ করে দ্রুত ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর ইন্দ্রজিৎ রথে চড়ে রাবণের কাছে পৌঁছান। রাবণ তখন পুত্রের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সৈন্যদল ইন্দ্রজিতকে দেখে বিজয়ধ্বনি করে ওঠে। বাবার কাছে রামচন্দ্রকে বধ করার অথবা তাঁকে বন্দি করে আনার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন ইন্দ্রজিৎ। তবে রাবণ তাঁকে মহাযুদ্ধে পাঠানো নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। ভাগ্যের বিপর্যয় এবং পুত্রের মৃত্যুর কারণে তিনি চিন্তিত ছিলেন। মৃত ব্যক্তির পুনর্জীবন তাঁর চিন্তার বাইরে এবং এটাকে তিনি নিয়তির খেলা বলে মনে করেন। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। লঙ্কার অপমান দূর করাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কুম্ভকর্ণকে অকালে জাগিয়ে যুদ্ধে পাঠানোর ফলাফল কী হয়েছিল তা স্মরণ রেখেও শেষ পর্যন্ত রাবণ ইন্দ্রজিতের ইচ্ছাকে সম্মান জানান। তিনি ইন্দ্রজিতকে ইষ্টদেব অগ্নির পূজা করে এবং নিকুন্তিলা যজ্ঞ সমাপ্ত করে পরদিন সকালে যুদ্ধে যেতে বলেন। পরে গঙ্গাজল দিয়ে সেনাপতি পদে ইন্দ্রজিতের অভিষেক সম্পন্ন করেন।
নামকরণ
কোনো সাহিত্যের অন্দরমহলে প্রবেশের চাবিকাঠি হলো নামকরণ। নামকরণের মাধ্যমেই লেখক তাঁর বক্তব্যকে প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠা দেন। পাঠকদের ক্ষেত্রেও বিষয়বস্তু বোঝার জন্য নামকরণ অত্যন্ত জরুরি ও সহায়ক বিষয়। সাহিত্যে নামকরণ বিভিন্ন দিক থেকে হয়ে থাকে — চরিত্রধর্মী, বিষয়ধর্মী অথবা ব্যঞ্জনধর্মী। যে – কোনো দিক থেকেই সাহিত্যের নামকরণ সম্ভব।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য – এর প্রথম সর্গের নাম ‘অভিষেক’। পাঠ্য অংশটি প্রথম সর্গ থেকে গৃহীত হয়েছে, তাই প্রথম সর্গের নাম অনুসরণে এই কাব্যাংশের নাম হয়েছে ‘অভিষেক’।
লঙ্কার প্রমোদকাননে ইন্দ্রজিৎ ছিলেন বিলাসে মত্ত। এমন সময় ছদ্মবেশী লক্ষ্মণ তাঁকে দিলেন বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ। ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদের আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে যান ইন্দ্রজিৎ। ক্রোধে, আত্মধিক্কারে নিজের পরে থাকা কুসুমদাম, কনক বলয়, কুণ্ডল ছুড়ে ফেলেন। তারপর মহাতেজে জ্বলে ওঠেন বীরশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজিৎ। প্রতিজ্ঞা করেন — “ঘুচাব এ অপবাদ, বধি রিপুকুলে।” যুদ্ধসাজে সজ্জিত হন তিনি। দেখা যায় তাঁর মেঘবর্ণ রথ, তার চাকায় বিজলির ছটা। আকাশে উড়ন্ত ইন্দ্রধনুর মতো রাক্ষস-পতাকা। অন্যদিকে, তখন পুত্রশোকে বিহ্বল লঙ্কারাজ রাবণও যুদ্ধোন্মত্ত। মেঘনাদ উপস্থিত হলেন সেখানে এবং পিতার কাছে রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। কিন্তু রাবণ একমাত্র জীবিত পুত্রকে যুদ্ধে পাঠাতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। মায়াবী রামের ছলনা তিনি জানেন। মরেও যে রামচন্দ্র বেঁচে উঠতে পারে, তার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের আসন্ন যুদ্ধ কতদূর ফলপ্রসূ হবে — এই চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়েন লঙ্কেশ্বর রাবণ। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ — “দেখিব এবার বীর বাঁচে কি ঔষধে।” অবশেষে রাবণ পবিত্র গঙ্গাজল দিয়ে অভিষেক করলেন কুমারে। অর্থাৎ কাব্যের বিষয়বস্তু যে অভিমুখে পরিচালিত হয়েছে বা যে পরিণতি লাভ করেছে তা হলো ইন্দ্রজিতের সেনাপতি-পদে অভিষেক। সুতরাং, বিষয়বস্তুর নিরিখে নামকরণটি সার্থক ও যথাযথ।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক বাংলার পঞ্চম পাঠের প্রথম অংশ, ‘অভিষেক,’ এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশা করছি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকে বা কোনো বিষয় পরিষ্কার না হয়, তাহলে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। এছাড়াও, পোস্টটি আপনার পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন যাদের এটি কাজে লাগতে পারে। ধন্যবাদ!