মাইকেল মধুসূদন দত্তের অভিষেক কবিতাটি রামায়ণের মেঘনাদবধ কাব্যের একটি অংশ। এই কবিতায় রাবণের পুত্র ইন্দ্রজিতের যুদ্ধে যাওয়ার আগের প্রস্তুতি এবং তার মনোভাবের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
কবি পরিচিতি
জন্ম – ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার অন্তর্গত সাগরদাঁড়ি গ্রামে মধুসুদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত, মা জাহ্নবী দেবী।
ছাত্রজীবন – ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন কলকাতার হিন্দু কলেজের জুনিয়র স্কুল বিভাগে ভরতি হন। পরের বছর ওই স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় শেকসপিয়রের কবিতা থেকে আবৃত্তির জন্য তিনি পুরস্কার পান। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি জুনিয়র বৃত্তি নিয়ে হিন্দু কলেজের সিনিয়র বিভাগে ভরতি হন এবং ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণপদক লাভ করেন। পরিবারের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি মধুসুদন কলকাতার ওল্ড মিশন গির্জায় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। ১৮৪৪-এর নভেম্বরে তিনি বিশপ্স কলেজে গ্রিক, লাতিন ও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভরতি হন।
কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন – ১৮৪৮-এ মধুসুদন চলে যান মাদ্রাজে এবং ব্ল্যাক টাউনের অ্যাসাইলাম স্কুলে ইংরেজির শিক্ষকরূপে যোগ দেন। বিয়ে করেন মেরি রেবেকা ম্যাকটাভিসকে। Timothy Penpoem ছদ্মনামে Madras Circular and General Chronicle, Athenaeum এবং Spectator পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগেও তিনি কাজ করতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে Athenaeum পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য The Captive Ladie।
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি Hindu Chronicle নামক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। ১৮৫২-তে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি হাই স্কুলের শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৮৫৪-তে তিনি দৈনিক Spectator পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। চার সন্তানের জননী রেবেকার সঙ্গেও এই সময়েই তাঁর আট বছর বাদে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। পরের বছর তিনি এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়াকে বিয়ে করেন। অর্থকষ্ট ও স্থায়ী চাকরির অভাবের মধ্যেও তিনি সাহিত্যচর্চা বন্ধ করেননি। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে তাঁর শর্মিষ্ঠা নাটক প্রকাশিত হয়। সেপ্টেম্বরে নাটকটি বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে অভিনীতও প্রশংসিত হলে তিনি নাটক রচনায় আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ১৮৬০-এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয় পদ্মাবতী নাটক, মে মাসে প্রকাশ পায় তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় মেঘনাদবধ কাব্য-এর প্রথম খণ্ড। এ বছর ১২ ফেব্রুয়ারি ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ প্রবর্তনের জন্য তিনি কালীপ্রসন্ন সিংহের বাড়িতে সংবর্ধিত হন।
মার্চ মাসে পাদরি লঙ-এর ভূমিকা-সহ By a Native ছদ্মনামে নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন। জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় তাঁর ব্রজাঙ্গনা কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য (দ্বিতীয় খণ্ড) এবং আত্মবিলাপ। আগস্টে প্রকাশিত হয় কৃষ্ণকুমারী নাটক। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকাশিত হয়। এ সময়ে তিনি কিছুদিনের জন্য হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদনাও করেন। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে আইন পড়ার জন্য মধুসুদন ইংল্যান্ড যান। কিন্তু আবহাওয়া ও বর্ণবিদ্বেষ সহ্য করতে না পেরে জুন মাসে কবি ফ্রান্সের ভার্সাই-তে চলে যান। সেখানে তিনি চরম আর্থিক সংকটে পড়েন যা থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে মুক্ত করেন। এখানে বসেই মধুসুদন তাঁর বিখ্যাত সনেটগুলি রচনা করেন।
১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাবলী প্রকাশিত হয়। এ বছরের ১৭ নভেম্বর তিনি ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। ১৮৭০-এ তিনি প্র্যাকটিস ছেড়ে প্রিভি কাউন্সিলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। ১৮৭১-এর সেপ্টেম্বরে তাঁর হেক্টর বধ কাব্য প্রকাশিত হয়। এ সময় হাইকোর্টের চাকরি ছেড়ে দেন মধুসুদন এবং ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চকোট রাজার আইন-উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। আবার সেপ্টেম্বরে তিনি আইনব্যাবসায় ফিরে আসেন। সে বছরের ডিসেম্বরে বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য অর্থের বিনিময়ে মায়াকানন রচনা করেন। একই সাথে লেখা শুরু করেন তাঁর অসমাপ্ত রচনা বিষ না ধনুর্গুণ।
জীবনাবসান – ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মধুসূদন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে বছরই ২৯ জুন রবিবার বিকেলে মধুসুদন প্রয়াত হন।
উৎস
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যর প্রথম সর্গ ‘অভিষেক’ থেকে পাঠ্য অংশটি নির্বাচিত হয়েছে।
সারসংক্ষেপ
পাঠ্য কবিতার সূচনাতেই দেখা যায়, সোনার আসন ছেড়ে উঠে ইন্দ্রজিৎ ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে প্রণাম করে তাঁর সেখানে আসার কারণ জানতে চাইছেন। ধাত্রী প্রভাষার ছদ্মবেশে আসা দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রজিৎকে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ এবং লঙ্কার দুর্দশা বিষয়ে জানান। রাবণ যে প্রতিশোধের জন্য যুদ্ধসজ্জার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সে-কথাও বলেন। রাতের যুদ্ধেই তিনি যাঁকে হত্যা করেছেন, সেই রামচন্দ্র কীভাবে তাঁর প্রিয় অনুজকে বধ করল, তা ভেবে ইন্দ্রজিৎ অত্যন্ত অবাক হন। দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রজিৎকে রাক্ষসদের কুল ও মান রক্ষার জন্য তাড়াতাড়ি লঙ্কায় যেতে অনুরোধ করেন। ক্রুদ্ধ ইন্দ্রজিৎ আকস্মিক এই দুর্ঘটনার কথা শুনে নিজেকে তীব্র ধিক্কার দেন। শত্রুদল যখন লঙ্কাকে ঘিরে ধরেছে, তখন তিনি প্রমোদবিলাসে মত্ত-এটাই ছিল তাঁর আত্মধিক্কারের কারণ। শত্রুবধ করে সব অপবাদ ঘোচাতে এবং লঙ্কাকে সুরক্ষিত করতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
যুদ্ধের সাজে নিজেকে সাজিয়ে তোলেন ইন্দ্রজিৎ, এমন সময় স্ত্রী প্রমীলা এসে তাঁর গতি রোধ করে দাঁড়ান। ইন্দ্রজিৎকে প্রমীলা আবার যুদ্ধে যেতে দিতে চান না। আশঙ্কা প্রকাশ করেন ভবিষ্যৎ নিয়ে। প্রমীলাকে আশ্বস্ত করেন ইন্দ্রজিৎ। রামচন্দ্রকে হত্যা করে শীঘ্র ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইন্দ্রজিৎ রথে করে পৌঁছে যান রাবণের কাছে। রাবণও তখন পুত্রের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সৈন্যদল ইন্দ্রজিৎকে দেখে জয়ধ্বনি করে ওঠে। বাবার কাছে রামচন্দ্রকে বধ করার কিংবা তাঁকে বন্দি করে নিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন ইন্দ্রজিৎ। কিন্তু রাবণ সেই মহাযুদ্ধে ইন্দ্রজিৎকে পাঠানোর বিষয়ে নিজের দ্বিধার কথা বলেন। ভাগ্যের বিপর্যয় এবং পুত্রের মৃত্যুর ফলে তিনি যে চিন্তিত, সে-কথাও বলেন। মৃত মানুষের পুনর্জীবন লাভ যে তাঁর বুদ্ধির অতীত এবং নিয়তিরই খেলা, তা-ও স্পষ্ট করতে চান। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে যাবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। লঙ্কার কলঙ্ক দূর করাই তাঁর লক্ষ্য। কুম্ভকর্ণকে অকালে জাগিয়ে যুদ্ধে পাঠানোর ফল কী হয়েছিল তা মনে রেখেও শেষ অবধি রাবণ ইন্দ্রজিতের ইচ্ছাকে মর্যাদা দেন। শুধু তাঁকে ইষ্টদেব অগ্নির উপাসনা করে এবং নিকুন্তিলা যজ্ঞ শেষ করে পরদিন সকালে যুদ্ধে যেতে বলেন। এরপরে গঙ্গাজল দিয়ে তিনি সেনাপতি পদে ইন্দ্রজিতের অভিষেক সম্পূর্ণ করেন।
নামকরণ
কোনো সাহিত্যের অন্দরমহলে প্রবেশের চাবিকাঠি হল নামকরণ। নামকরণের মাধ্যমেই লেখক তাঁর বক্তব্যকে প্রাথমিক প্রতিষ্ঠা দেন।পাঠকদের ক্ষেত্রেও বিষয়বস্তু বুঝবার জন্য নামকরণ অত্যন্ত জরুরি ও সহায়ক বিষয়। সাহিত্যে নামকরণ বিভিন্ন দিক থেকে হয়ে থাকে। চরিত্রধর্মী, বিষয়ধর্মী অথবা ব্যঞ্জনধর্মী-যে-কোনো বিষয় থেকেই সাহিত্যের নামকরণ সম্ভব।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য-র প্রথম সর্গের নাম ‘অভিষেক’। পাঠ্য অংশটি প্রথম সর্গ থেকে গৃহীত হয়েছে, তাই প্রথম সর্গের নাম অনুসরণে এই কাব্যাংশের নাম হয়েছে অভিষেক।
লঙ্কার প্রমোদকাননে ইন্দ্রজিৎ ছিলেন বিলাসে মত্ত। এমন সময় ছদ্মবেশী লক্ষ্মী তাঁকে দিলেন বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ। ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদের আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে যান ইন্দ্রজিৎ। ক্রোধে, আত্মধিক্কারে নিজের পরে থাকা কুসুমদাম, কনক বলয়, কুণ্ডল ছুড়ে ফেলেন। তারপর মহাতেজে জ্বলে ওঠেন বীরশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজিৎ। প্রতিজ্ঞা করেন- ঘুচাব এ অপবাদ, বধি রিপুকুলে।যুদ্ধসাজে সজ্জিত হন তিনি, দেখতে পাওয়া তাঁর মেঘবর্ণ রথ, তার চাকায় বিজলির ছটা। আকাশে উড়ন্ত ইন্দ্রধনুর মতো রাক্ষস-পতাকা। অন্যদিকে, তখন পুত্রশোকে বিহ্বল লঙ্কারাজ রাবণও যুদ্ধোন্মত্ত। মেঘনাদ উপস্থিত হলেন সেখানে এবং পিতার কাছে রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। কিন্তু রাবণ একমাত্র জীবিত পুত্রকে যুদ্ধে পাঠাতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। মায়াবী রামের ছলনা তিনি জানেন। মরেও যে রামচন্দ্র বেঁচে উঠতে পারে তার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের আসন্ন যুদ্ধ কতদূর ফলপ্রসূ হবে-এই চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়েন লঙ্কেশ্বর রাবণ। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ- দেখিব এবার বীর বাঁচে কি ঔষধে। অবশেষে রাবণ পবিত্র গঙ্গাজল দিয়ে অভিষেক করিলা কুমারে। অর্থাৎ কাব্যের বিষয়বস্তু যে অভিমুখে পরিচালিত হয়েছে বা যে পরিণতি লাভ করেছে তা হল ইন্দ্রজিতের সেনাপতি-পদে অভিষেক। সুতরাং বিষয়বস্তুর নিরিখে নামকরণটি সার্থক ও যথাযথ।
অভিষেক কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। এই কবিতাটির মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইন্দ্রজিতের চরিত্রকে নতুন করে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতাটিতে বীরত্ব, সাহস এবং দেশপ্রেমের মতো গুণাবলীর বার্তা দেওয়া হয়েছে।