দশম শ্রেণি – বাংলা – সিন্ধুতীরে – বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

সৈয়দ আলাওলের লেখা সিন্ধুতীরে কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি বিখ্যাত কবিতা। এটি উনিশ শতকের প্রথম দিকে রচিত হয়েছিল। কবিতাটি পদ্মাবতী কাব্যের একটি অংশ।

দশম শ্রেণি – বাংলা – সিন্ধুতীরে – বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

সিন্ধুতীরে দেখি দিব্যস্থান। – এই দিব্যস্থানের পরিচয় দাও। এখানে যে উদ্যানটির কথা আছে তা উল্লেখ করো।

দিব্যস্থানের পরিচিতি – সৈয়দ আলাওল অনুদিত পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত ‘সিন্ধুতীরে’ কবিতাংশে যেখানে সমুদ্রের মধ্যে মান্দাসে করে পদ্মাবতী গিয়ে পৌঁছোন, সেখানেই ছিল এক দিব্য পুরী। কবির কথায় তা ছিল ‘মনোহর দেশ’। সেখানের মানুষের জীবনে কোনো দুঃখকষ্ট ছিল না। সমাজে নৈতিক আদর্শ ছিল অত্যন্ত উঁচুতে সত্য ধর্ম সদা সদাচার। অর্থাৎ মানুষজন ছিল ধার্মিক এবং সৎ আচার-আচরণে অভ্যস্ত।

উদ্যানের পরিচয় – সমুদ্রতীরে অবস্থিত দিব্যস্থানটি সমুদ্রকন্যা পদ্মকে আকৃষ্ট করেছিল। এর উপরিভাগে ছিল প্রচুর ফলফুলে পরিপূর্ণ এক পর্বত। তার পাশে সুরম্য এক উদ্যান রচনা করেছিলেন সমুদ্রকন্যা পদ্মা। সেখানে নানা মনোহর ফুল ফুটে থাকত। তাদের সুগন্ধে চারপাশ ভরে থাকত। বিভিন্ন উপকারী বৃক্ষে নানা ফল ধরে থাকত। তারই মধ্যে ছিল এক অতি মনোরম প্রাসাদ-‘বিচিত্র টঙ্গি’। সেই প্রাসাদ স্বর্ণনির্মিত এবং নানান রত্নে সেটিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। সেই রত্নখচিত প্রাসাদে আলো পড়লে নানান রঙের বর্ণালি বিচ্ছুরিত হত। তাই কবিতায় প্রাসাদের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘হেম রত্নে নানা রঙ্গি’। অর্থাৎ, সোনা এবং মণিমাণিক্যের ছটায় চারদিক আলো করে বহু বর্ণে শোভা পাচ্ছিল এই অপূর্ব পুরী। এভাবেই মনোরম উদ্যানটি সম্পূর্ণতা পেয়েছিল।

দেখিয়া রূপের কলা বিস্মিত হইল বালা/অনুমান করে নিজ চিতে। – কে, কাকে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন? সেই কন্যা সেখানে কীভাবে এসেছিল? তাঁকে দেখে কী মনে হয়েছিল?

উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদ্বয় – সৈয়দ আলাওল অনূদিত পদ্মাবতী কাব্যের ‘পদ্মা-সমুদ্রখণ্ড’ থেকে নেওয়া ‘সিন্ধুতীরে’ কবিতায় সমুদ্রকন্যা পদ্মা- অচেতন সিংহল-রাজকন্যা পদ্মাবতীর রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।

কন্যার আগমন – ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করে রত্নসেনের কাছে দান ভিক্ষা করে প্রত্যাখ্যাত হয় সমুদ্র। তখন সমুদ্রের অভিশাপে রত্নসেনের নৌকা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে একটি মান্দাসে রত্নসেন ও সখী-সহ পদ্মাবতী আশ্রয় নিলেও সেটিকে রক্ষা করা যায়নি। মান্দাস দু-টুকরো হয়ে পদ্মাবতী রত্নসেন থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। প্রবল ঢেউ পদ্মাবতীদের মান্দাসটিকে তীরে নিয়ে যায়। সেখানে পৌঁছোনোর আগেই ভয়ে সখী-সহ পদ্মাবতী চেতনা হারান। যেখানে তাঁরা পৌঁছোন তা ছিল এক মনোরম পুরী।

কন্যাকে দেখে প্রতিক্রিয়া – পদ্মাবতীকে দেখে পদ্মার মনে হয়েছিল যে, ইন্দ্রের অভিশাপে স্বর্গের নর্তকী বিদ্যাধরী যেন স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে মাটিতে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন। পদ্মাবতীর ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ এবং আলুথালু বেশ দেখে পদ্মা এ-ও অনুমান করেন যে, ওই কন্যার ওপর দিয়ে প্রবল ঝড় বয়ে গেছে। এলোমেলো চুল এবং বেশ-বাসের এই অবস্থা দেখে পদ্মার মনে হয় যে, হয়তো সমুদ্রযাত্রার পথে দুরন্ত ঝরে বাতাসে নৌকা ভেঙে তাঁরা এই বিপদে পড়েছিলেন। সমুদ্রের কষ্টেই তাঁর এই অজ্ঞান অবস্থা।

অচৈতন্য পড়িছে ভূমিতে। – কার কথা বলা হয়েছে? তাকে দেখে কার, কী মনে হয়েছিল? তিনি এই অবস্থায় কোন্ ভূমিকা নিয়েছিলেন?

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি – সৈয়দ আলাওল অনূদিত পদ্মাবতী কাব্যের ‘পদ্মা-সমুদ্রখণ্ড’ থেকে সংকলিত ‘সিন্ধুতীরে’ নামক কাব্যাংশের উল্লিখিত অংশে পদ্মাবতীর কথা বলা হয়েছে।

উদ্দিষ্ট ব্যক্তির মনোভাব – পদ্মাবতীর বিস্ফারিত চোখ, এলোমেলো পোশাক এবং চুল দেখে সমুদ্রকন্যা পদ্মা অনুমান করেন যে, সমুদ্রের প্রবল বাতাসে নৌকা ভেঙেই বোধহয় মেয়েটির এই কষ্ট। শুধু তা-ই নয়, গভীর সহানুভূতি দিয়ে পদ্মা দেখেন যে মেয়েটির শ্বাস তখনও অল্প অল্প পড়ছে। স্নেহশীল পদ্মা বিধাতার কাছে মেয়েটির জীবন প্রার্থনা করেন। তিনি প্রত্যাশা করেন তাঁর পিতার পুণ্যের ফলে এবং তাঁর নিজের ভাগ্যের কারণে যেন মেয়েটির জীবন ফিরে আসে।

পদ্মার ভূমিকা – পদ্মাবতীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার আশায় পদ্মা শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেই থেমে থাকেননি, তাঁর চিকিৎসারও যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সখীগণ-সহ পদ্মাবতীকে বস্তু দিয়ে ঢেকে উদ্যানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি তাঁর সখীদের নির্দেশ দেন। সেখানে তন্ত্রাচারের মাধ্যমে, বিধিমতো মন্ত্রপাঠ করে নানা মহাগুণসম্পন্ন ঔষধের দ্বারা তাঁদের চিকিৎসা করা হয়। আগুন জ্বালিয়ে পায়ে মাথায় সেঁক দেওয়া হয়। চার দণ্ড এরকম যত্নের সঙ্গে শুশ্রূষা হওয়ার পরে চার সখী-সহ পদ্মাবতী চেতনা ফিরে পান।

পঞ্চকন্যা পাইলা চেতন। – পঞ্চকন্যা কে কে? তাদের অচৈতন্যের কারণ কী? কীভাবে তারা চেতনা ফিরে পেয়েছিল?

পঞ্চকন্যার পরিচয় – সৈয়দ আলাওল রচিত পদ্মাবর্তী কাব্যের অংশবিশেষ ‘সিন্ধুতীরে’ কাব্য-কাহিনিতে বর্ণিত পঞ্চকন্যার মধ্যমণি হলেন সিংহল-রাজকন্যা পদ্মাবতী। আর তাঁর চার জন সখী হল চন্দ্রকলা, বিজয়া, রোহিণী ও বিধুন্নলা।

অচৈতন্য হওয়ার কারণ – স্বামী রত্নসেনের সঙ্গে রাজকন্যা পদ্মাবতী সমুদ্রপথে চিতোরে ফেরার সময় হঠাৎ তাঁদের জলযানটি সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে এবং ডুবে যায়। রত্নসেন এবং সখী-সহ রাজকন্যা কোনোরকমে একটি মান্দাসে আশ্রয় নেন। শেষপর্যন্ত মান্দাস দ্বিখণ্ডিত হয়ে চার সখী-সহ রাজকন্যা রত্নসেনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। খণ্ডিত ভেলায় ভাসতে ভাসতে তাঁরা সমুদ্রতীরের ভূমিতে পৌঁছোন। কিন্তু প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে অসম লড়াই, দৈহিক ক্লেশ ইত্যাদির প্রভাবে রাজকন্যা ও তাঁর সখীরা জ্ঞান হারান।

চেতনা ফিরে পাওয়া – পঞ্চকন্যার এই অবস্থায় দেবতা সমুদ্রকন্যা পদ্মা নিরঞ্জনকে স্মরণ করেন এবং তাঁর সখীদের চিকিৎসাকর্মে ব্রতী হওয়ার নির্দেশ দেন। প্রাণপণ সেবাশুশ্রূষা করে পঞ্চকন্যার জীবনরক্ষাই ছিল তাঁর মনের ইচ্ছা। সেইমতো শুকনো কাপড় দিয়ে সখী-সহ রাজকন্যার শরীর আবৃত করা হয়। আগুন জ্বেলে সর্বাঙ্গ সেঁক দেওয়া হয় এবং তন্ত্রমন্ত্র সহকারে মহৌষধ প্রয়োগ করা হয়। একটানা চার দণ্ড সেবাশুশ্রূষার পর পঞ্চকন্যা চেতনা ফিরে পান। দয়ালু পদ্মার আন্তরিক সেবাযত্নে সখী-সহ পদ্মাবতীর জ্ঞান ফিরে আসে।

সিন্ধুতীরে কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এটি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবিতাটিতে কবি প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মানুষের প্রেমের মহিমা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতাটি পাঠ করলে পাঠকের মনে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও মানুষের প্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মে।

Share via:

মন্তব্য করুন