আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক বাংলার ষষ্ঠ পাঠের প্রথম বিভাগ ‘সিন্ধুতীরে’ থেকে কিছু বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পূর্বের পরীক্ষায় এগুলি প্রায়শই দেখা গেছে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।

সিন্ধুতীরে দেখি দিব্যস্থান। – এই দিব্যস্থানের পরিচয় দাও। এখানে যে উদ্যানটির কথা আছে তা উল্লেখ করো।
দিব্যস্থানের পরিচিতি – সৈয়দ আলাওল অনূদিত পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত ‘সিন্ধুতীরে’ কবিতাংশে যেখানে সমুদ্রের মধ্যে মান্দাসে করে পদ্মাবতী পৌঁছান, সেখানেই ছিল এক দিব্য পুরী। কবির ভাষায়, তা ছিল ‘মনোহর দেশ’। সেখানের মানুষের জীবনে কোনো দুঃখ-কষ্ট ছিল না। সমাজে নৈতিক আদর্শ ছিল অত্যন্ত উঁচু; সত্য, ধর্ম, এবং সদাচার ছিল সমাজের মূল ভিত্তি। অর্থাৎ, মানুষজন ছিল ধার্মিক এবং সৎ আচার-আচরণে অভ্যস্ত।
উদ্যানের পরিচয় – সমুদ্রতীরে অবস্থিত দিব্যস্থানটি সমুদ্রকন্যা পদ্মাকে আকৃষ্ট করেছিল। এর উপরিভাগে ছিল প্রচুর ফলফুলে ভরপুর এক পর্বত। তার পাশে সুরম্য এক উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন সমুদ্রকন্যা পদ্মা। সেখানে নানান মনোহর ফুল ফুটত, যেগুলোর সুগন্ধে চারপাশ ভরে উঠত। বিভিন্ন উপকারী বৃক্ষে নানা ফল ধরে থাকত। তারই মধ্যে ছিল এক অতি মনোরম প্রাসাদ – ‘বিচিত্র টঙ্গি’। সেই প্রাসাদ স্বর্ণ নির্মিত এবং নানান রত্নে সাজানো ছিল। যখন প্রাসাদের উপর আলো পড়ত, তখন নানান রঙের বর্ণালি বিচ্ছুরিত হত। তাই কবিতায় প্রাসাদের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘হেম রত্নে নানা রঙ্গি’। অর্থাৎ, সোনা এবং মণিমাণিক্যের ছটায় চারদিক আলো করে বহু বর্ণে শোভা পাচ্ছিল এই অপূর্ব পুরী। এভাবেই মনোরম উদ্যানটি সম্পূর্ণতা পেয়েছিল।
দেখিয়া রূপের কলা বিস্মিত হইল বালা/অনুমান করে নিজ চিতে। – কে, কাকে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন? সেই কন্যা সেখানে কীভাবে এসেছিল? তাঁকে দেখে কী মনে হয়েছিল?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদ্বয় – সৈয়দ আলাওল অনূদিত পদ্মাবতী কাব্যের ‘পদ্মা-সমুদ্রখণ্ড’ থেকে নেওয়া ‘সিন্ধুতীরে’ কবিতায় সমুদ্রকন্যা পদ্মা — অচেতন সিংহল-রাজকন্যা পদ্মাবতীর রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।
কন্যার আগমন – ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করে রত্নসেনের কাছে দান ভিক্ষা করে প্রত্যাখ্যাত হয় সমুদ্র। তখন সমুদ্রের অভিশাপে রত্নসেনের নৌকা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে একটি মান্দাসে রত্নসেন ও সখীসহ পদ্মাবতী আশ্রয় নিলেও সেটিকে রক্ষা করা যায়নি। মান্দাস দু-টুকরো হয়ে পদ্মাবতী রত্নসেন থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। প্রবল ঢেউ পদ্মাবতীদের মান্দাসটিকে তীরে নিয়ে যায়। সেখানে পৌঁছোনোর আগেই ভয়ে সখীসহ পদ্মাবতী চেতনা হারান। যেখানে তাঁরা পৌঁছোন তা ছিল এক মনোরম পুরী।
কন্যাকে দেখে প্রতিক্রিয়া – পদ্মাবতীকে দেখে পদ্মার মনে হয়েছিল যে, ইন্দ্রের অভিশাপে স্বর্গের নর্তকী বিদ্যাধরী যেন স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে মাটিতে অচেতন হয়ে পড়ে আছেন। পদ্মাবতীর ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ এবং আলুথালু বেশ দেখে পদ্মা এ-ও অনুমান করেন যে, ওই কন্যার ওপর দিয়ে প্রবল ঝড় বয়ে গেছে। এলোমেলো চুল এবং বেশ-বাসের এই অবস্থা দেখে পদ্মার মনে হয় যে, হয়তো সমুদ্রযাত্রার পথে দুরন্ত ঝড়ে বাতাসে নৌকা ভেঙে তাঁরা এই বিপদে পড়েছিলেন। সমুদ্রের কষ্টেই তাঁর এই অজ্ঞান অবস্থা।
অচৈতন্য পড়িছে ভূমিতে। – কার কথা বলা হয়েছে? তাকে দেখে কার, কী মনে হয়েছিল? তিনি এই অবস্থায় কোন্ ভূমিকা নিয়েছিলেন?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি – সৈয়দ আলাওল অনূদিত পদ্মাবতী কাব্যের ‘পদ্মা-সমুদ্রখণ্ড’ থেকে সংকলিত ‘সিন্ধুতীরে’ নামক কাব্যাংশের উল্লিখিত অংশে পদ্মাবতীর কথা বলা হয়েছে।
উদ্দিষ্ট ব্যক্তির মনোভাব – পদ্মাবতীর বিস্ফারিত চোখ, এলোমেলো পোশাক এবং চুল দেখে সমুদ্রকন্যা পদ্মা অনুমান করেন যে, সমুদ্রের প্রবল বাতাসে নৌকা ভেঙে বোধহয় মেয়েটির এই কষ্ট। শুধু তা-ই নয়, গভীর সহানুভূতি দিয়ে পদ্মা দেখতে পান যে, মেয়েটির শ্বাস তখনও অল্প অল্প পড়ছে। স্নেহশীল পদ্মা বিধাতার কাছে মেয়েটির জীবন প্রার্থনা করেন। তিনি প্রত্যাশা করেন তাঁর পিতার পুণ্যের ফলে এবং তাঁর নিজের ভাগ্যের কারণে যেন মেয়েটির জীবন ফিরে আসে।
পদ্মার ভূমিকা – পদ্মাবতীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার আশায় পদ্মা শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেই থেমে থাকেননি, বরং তাঁর চিকিৎসারও যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সখীগণসহ পদ্মাবতীকে বস্তু দিয়ে ঢেকে উদ্যানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি তাঁর সখীদের নির্দেশ দেন। সেখানে তন্ত্রাচারের মাধ্যমে, বিধিমতো মন্ত্রপাঠ করে নানা মহাগুণসম্পন্ন ঔষধের দ্বারা তাঁদের চিকিৎসা করা হয়। আগুন জ্বালিয়ে পায়ে ও মাথায় সেঁক দেওয়া হয়। চার দণ্ডের মতো যত্নের সঙ্গে শুশ্রূষা হওয়ার পরে চার সখীসহ পদ্মাবতী চেতনা ফিরে পান।
পঞ্চকন্যা পাইলা চেতন। – পঞ্চকন্যা কে কে? তাদের অচৈতন্যের কারণ কী? কীভাবে তারা চেতনা ফিরে পেয়েছিল?
পঞ্চকন্যার পরিচয় – সৈয়দ আলাওল রচিত পদ্মাবর্তী কাব্যের অংশবিশেষ ‘সিন্ধুতীরে’ কাব্য-কাহিনিতে বর্ণিত পঞ্চকন্যার মধ্যমণি হলেন সিংহল – রাজকন্যা পদ্মাবতী। আর তাঁর চারজন সখী হলেন চন্দ্রকলা, বিজয়া, রোহিণী ও বিধুন্নলা।
অচৈতন্য হওয়ার কারণ – স্বামী রত্নসেনের সঙ্গে রাজকন্যা পদ্মাবতী সমুদ্রপথে চিতোরে ফেরার সময় হঠাৎ তাঁদের জলযানটি সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে এবং ডুবে যায়। রত্নসেন এবং সখীসহ রাজকন্যা কোনোরকমে একটি মান্দাসে আশ্রয় নেন। শেষপর্যন্ত মান্দাস দ্বিখণ্ডিত হয়ে চার সখীসহ রাজকন্যা রত্নসেনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। খণ্ডিত ভেলায় ভাসতে ভাসতে তাঁরা সমুদ্রতীরের ভূমিতে পৌঁছান। কিন্তু প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে অসম লড়াই, দৈহিক ক্লেশ ইত্যাদির প্রভাবে রাজকন্যা ও তাঁর সখীরা জ্ঞান হারান।
চেতনা ফিরে পাওয়া – পঞ্চকন্যার এই অবস্থায় দেবতা সমুদ্রকন্যা পদ্মা নিরঞ্জনকে স্মরণ করেন এবং তাঁর সখীদের চিকিৎসাকর্মে ব্রতী হওয়ার নির্দেশ দেন। প্রাণপণ সেবাশুশ্রূষা করে পঞ্চকন্যার জীবন রক্ষাই ছিল তাঁর মনের ইচ্ছা। সেই অনুযায়ী শুকনো কাপড় দিয়ে সখীসহ রাজকন্যার শরীর আবৃত করা হয়। আগুন জ্বেলে সর্বাঙ্গ সেঁক দেওয়া হয় এবং তন্ত্রমন্ত্র সহকারে মহৌষধ প্রয়োগ করা হয়। একটানা চার দণ্ড সেবাশুশ্রূষার পর পঞ্চকন্যা চেতনা ফিরে পান। দয়ালু পদ্মার আন্তরিক সেবাযত্নে সখীসহ পদ্মাবতীর জ্ঞান ফিরে আসে।
সিন্ধুতীরে কাব্যাংশটিতে কবির রচনারীতির যে বিশেষত্ব দেখতে পাওয়া যায় লেখো।
রচনারীতির বিশেষত্ব – ‘সিন্ধুতীরে’ কাব্যাংশে, অচৈতন্য অপরিচিতা রাজকুমারী পদ্মাবতীর প্রতি সমুদ্রকন্যা পদ্মার যে সহানুভূতি ও ভালোবাসা প্রকাশ পায়, তা মানবিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন। কাব্যাংশের সংক্ষিপ্ত পরিসর সত্ত্বেও এই গভীর আবেগের প্রকাশ কবির রচনারীতির এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য।
ত্রিপদী ছন্দের প্রয়োগ – কবি আলাওল ধীরলয়ের ত্রিপদী ছন্দ ব্যবহার করে আবেগময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। শেষের দিকে ভণিতায় পাঁচালির রীতির প্রয়োগও দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ –
শ্রীযুত মাগন গুণী মোহন্ত আরতি শুনি
হীন আলাওল সুরচন।।
- শব্দ প্রয়োগের বৈশিষ্ট্য – আরবি ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও, আলাওলের কাব্যে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ তুলনামূলক কম। এর পরিবর্তে, তৎসম শব্দের বিস্তৃত ব্যবহার লক্ষ করা যায়, যেমন ‘সদাচার’, ‘সুতা’, ‘পুষ্প’, ‘মনোহর’, ‘স্বর্গভ্রষ্ট’, ‘কেশ’ ইত্যাদি।
- কাব্যিক শব্দ প্রয়োগ – কাব্যিক শব্দের ক্ষেত্রেও আলাওল অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। যেমন – ‘মাঝারে’, ‘চিতে’, ‘তুরিত’ ইত্যাদি শব্দের যথাযথ প্রয়োগ তাঁর রচনারীতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। আলাওল মূলত আখ্যানকাব্য রচনা করতেন, যার ফলে ‘সিন্ধুতীরে’ পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে গল্পের মতো অনুভূতি হয়।
- সাবলীল লেখনী – কবি আলাওল প্রতিটি দৃশ্যকে ছবির মতো সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলেছেন। তাঁর সাবলীল ও স্বচ্ছ লেখনী কাব্যাংশটিকে সহজপাঠ্য করে তুলেছে। ঘটনার পরম্পরাকে তিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে সাজিয়েছেন, যা পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়ক।
- নাটকীয়তা – ‘সিন্ধুতীরে’ কাব্যাংশের নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে কবি আলাওল একটি চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। কাব্যাংশের শেষে তিনি লিখেছেন – “হীন আলাওল সুরচন”। এটা প্রমাণ করে যে, ‘সিন্ধুতীরে’ আলাওলের একটি সুন্দর সৃষ্টিকর্ম।
সিন্ধুতীরে কবিতায় পদ্মার চরিত্রটি যেভাবে পাওয়া যায় আলোচনা করো।
অথবা, সিন্ধুতীরে কবিতা অবলম্বনে সমুদ্রকন্যার আচার-আচরণ ব্যাখ্যা করো।
- কথামুখ – সৈয়দ আলাওলের অনূদিত পদ্মাবতী কাব্যের ‘পদ্মাসমুদ্রখণ্ড’ থেকে সংকলিত ‘সিন্ধুতীরে’ কবিতায় পদ্মা সবচেয়ে সক্রিয় চরিত্র। তিনি সমুদ্রকন্যা। কাহিনিতে তাঁর কিছু বিশেষত্ব লক্ষ করা যায়।
- সৌন্দর্যপ্রিয় – পদ্মার মধ্যে ছিল সৌন্দর্যপ্রিয়তা। যে উদ্যান তিনি তৈরি করেছেন, সেখানে নানা মনোহর ফুল সুগন্ধ বিস্তার করেছে, গাছে নানা ফল ধরেছে। তাঁর প্রাসাদটিও ছিল সোনায় মোড়া। তার ওপর নানান রত্নের সজ্জা সেই প্রাসাদের সৌন্দর্যও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
- প্রাণচঞ্চল – পদ্মা ছিলেন প্রাণচঞ্চল। রাত্রি শেষ হতেই দেখা যায়, সকালবেলা সখীদের সঙ্গে হাসিখেলায় মেতে উঠে তিনি তাঁর প্রিয় উদ্যানের দিকে চলেছেন। সখীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত মধুর।
- মানবিক – পদ্মা চরিত্রটি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর মানবিকতায়। অপরিচিতা পদ্মাবতীকে সমুদ্রতীরের মান্দাসে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তাঁর উৎকণ্ঠা, ঈশ্বরের কাছে তাঁর কাতর প্রার্থনা যেন আত্মীয়ের সঙ্গে আত্মীয়তার সেতু তৈরি করেছে। তাঁর নির্দেশে পদ্মার সখীরা তন্ত্র-মন্ত্র-মহৌষধি সহযোগে আগুনের সেঁক দিয়ে পদ্মাবতীর চেতনা ফিরিয়েছে। মধ্যযুগের কবিতায় আলাওলের সৃষ্ট এই চরিত্রটিতে মানবিকতা এক অসামান্য বিশেষত্ব। এভাবেই সমুদ্রকন্যা পদ্মা হয়ে উঠেছেন অনন্যা।
সিন্ধুতীরে কবিতার মূল চরিত্র পদ্মাবতী ও পদ্মার পরিচয় দাও। পদ্মাবতীকে দেখে পদ্মার ভাবনা ও প্রতিক্রিয়া আলোচনা করো।
পদ্মাবতীর পরিচয় – পদ্মাবতী ছিলেন সিংহল রাজকন্যা। তাঁর পিতা ছিলেন গন্ধর্বসেন। পদ্মাবতীর অপরূপ সৌন্দর্যের কথা শুনে চিতোর রাজা রত্নসেন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে রত্নসেনের সঙ্গে পদ্মাবতীর বিয়ে হয় এবং বিয়ের পরে দেশে ফেরার সময় তাঁরা সামুদ্রিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন।
পদ্মার পরিচয় – অন্যদিকে, পদ্মা ছিলেন সমুদ্রকন্যা। সমুদ্রতীরে তাঁর যে সুরম্য উদ্যান আছে এবং সোনায় মোড়া যে প্রাসাদ তিনি তৈরি করেছেন, তা পদ্মার সৌন্দর্যপ্রিয়তার অসামান্য উদাহরণ। সখীদের নিয়ে হাসিখেলায় প্রাণচঞ্চল রূপেই পদ্মাকে কবিতায় পাওয়া যায়।
পদ্মার ভাবনা ও প্রতিক্রিয়া – পদ্মাবতীর বিস্ফারিত চোখ, এলোমেলো পোশাক এবং চুল দেখে সমুদ্রকন্যা পদ্মা অনুমান করেন যে, সমুদ্রের প্রবল ঝড়ে নৌকা ভেঙেই বোধহয় মেয়েটি এই কষ্ট পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গভীর সহানুভূতির সঙ্গে পদ্মা দেখেন যে, মেয়েটির শ্বাস তখনও অল্প অল্প পড়ছে। স্নেহশীল পদ্মা বিধাতার কাছে মেয়েটির জীবন প্রার্থনা করেন। তিনি প্রত্যাশা করেন, তাঁর পিতার পুণ্যের ফলে এবং তাঁর নিজের ভাগ্যের কারণে মেয়েটির জীবন যেন ফিরে আসে। পদ্মাবতীকে দেখে পদ্মার মনে হয়েছিল যে, ইন্দ্রের অভিশাপে স্বর্গের নর্তকী বিদ্যাধরী যেন স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে মাটিতে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন। পদ্মাবতীর ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ এবং এলোমেলো বেশ দেখে পদ্মা এ-ও অনুমান করেন যে, ওই কন্যার ওপর দিয়ে প্রবল ঝড় বয়ে গেছে। এলোমেলো চুল এবং বেশবাসের এই অবস্থায় পদ্মার মনে হয় যে, হয়তো সমুদ্রযাত্রার পথে দুরন্ত ঝড়ে নৌকা ভেঙে তাঁরা এই বিপদে পড়েছেন। সমুদ্রের কষ্টেই তাঁর এই অজ্ঞান অবস্থা।
সিন্ধুতীরে কাব্যাংশ অবলম্বনে সৈয়দ আলাওলের কবিপ্রতিভার পরিচয় দাও।
- কথামুখ – আলাওলের ‘সিন্ধুতীরে’ কাব্যাংশের শুরুতেই সমুদ্রকন্যা পদ্মার দিব্যপুরীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
- সৌন্দর্যপ্রীতি – সেই মনোহর পুরীর বর্ণনায় আলাওলের সৌন্দর্যপ্রীতির পরিচয় ফুটে উঠেছে। পদ্মার প্রাসাদের নিকটে এক পর্বত অবস্থিত। তার পাশে ছিল ফুল ও ফলে ভরা অপূর্ব এক উদ্যান। কবির ভাষায় –
“নানা পুষ্প মনোহর সুগন্ধি সৌরভতর
নানা ফল বৃক্ষ সুলক্ষণ।
তাহাতে বিচিত্র টঙ্গি হেমরত্নে নানা রঙ্গি
তথা কন্যা থাকে সর্বক্ষণ।”
- শব্দ প্রয়োগ – মধ্যযুগে রচিত এই কাব্যের ভাষা তৎসম শব্দে ভরপুর হলেও তা হৃদয়গ্রাহী। কাহিনি-কাব্যের ধারা অনুসারে আলাওল ঘটনাক্রমকে কাহিনির মতো সাজিয়েছেন।
- উদার মানবিক চরিত্রের প্রকাশ – সমুদ্রকন্যার উদার মানবিক চরিত্রের প্রকাশ কাব্যাংশটিকে সর্বজনীন করেছে। সম্পূর্ণ অপরিচিতা পদ্মাবতীর প্রতি তাঁর উদ্বেগ এবং তাঁকে সুস্থ করে তোলার আকুলতা নিখাদ মানবিকতা প্রদর্শন করেছে।
- রূপমাধুরীর বর্ণনা – কাব্যের নায়িকা পদ্মাবতীর রূপমাধুরীর বর্ণনায় আলাওল অত্যন্ত দক্ষ। অচৈতন্য পদ্মাবতীকে দেখে সমুদ্রকন্যার মনে হয়েছিল – “ইন্দ্রশাপে বিদ্যাধরী / কিবা স্বর্গভ্রষ্ট করী / অচৈতন্য পড়িছে ভূমিতে।” অর্থাৎ, ‘নিপতিতা চেতনরহিত’ নারীর রূপসৌন্দর্যে স্বর্গীয় স্পর্শ থাকতে পারে, তবে সে যে মর্ত্যপৃথিবীর একজন, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।
- রূপচরিত্রের নির্মাণ – মানব-মানবীর রূপচরিত্র নির্মাণে আলাওল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। এইভাবে ‘সিন্ধুতীরে’-র ছোট পরিসরেও আলাওলের উচ্চ কবিপ্রতিভার পরিচয় স্পষ্ট হয়েছে।
সিন্ধুতীরে কাব্যাংশটির নামকরণ কতদূর সার্থক হয়েছে তা বিচার করো।
নামকরণ সাহিত্যের প্রবেশের চাবিকাঠি। সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘সিন্ধুতীরে’ নামকরণটি কবির দেওয়া নয়। কাব্যকাহিনির বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে সংকলকগণ এ ধরনের নামকরণ করেছেন।
সিংহল-রাজকন্যা পদ্মাবতী তাঁর স্বামীর সঙ্গে চিতোরে ফেরার সময় সামুদ্রিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। তাঁদের জলযানটি সমুদ্রে ডুবে যায়। একটি মান্দাসে রত্নসেন ও সখীসহ পদ্মাবতী আশ্রয় নিলেও সেটি রক্ষা পায়নি। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝায় মান্দাস দ্বিখণ্ডিত হয়ে পদ্মাবতী রত্নসেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। দুর্যোগজনিত কষ্টে রাজকন্যা জ্ঞান হারিয়ে সমুদ্রতীরে পড়ে থাকেন। সাগরকন্যা পদ্মা ভোরবেলা সুরম্য উদ্যানে এসে এই দৃশ্য দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি সখীদের নির্দেশ দেন অচৈতন্য রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে। সখীরাও সেই নির্দেশ অনুযায়ী রাজকন্যা পদ্মাবতীকে উদ্যানের মাঝখানে নিয়ে এসে চার দণ্ড ধরে নানা সেবাযত্নের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এটাই হল সংক্ষিপ্ত কাব্যকাহিনি। এখানে লক্ষণীয় যে, যাবতীয় ঘটনা ঘটেছে সমুদ্রের তীরবর্তী স্থানে। কাব্যাংশটির শুরুতেও এই সমুদ্রতীরবর্তী ‘দিব্যস্থান’-এর শোভা-সৌন্দর্য বর্ণিত হয়েছে।
সিন্ধুতীরে শব্দটির অর্থ সমুদ্রতীরে। সেই স্থাননামের উল্লেখেই কাব্যাংশটির নামকরণ করা হয়েছে। এই অংশে সংঘটিত যাবতীয় ঘটনা এবং বর্ণিত যাবতীয় বিষয় সমুদ্রতীরকেন্দ্রিক। যে চরিত্রদের কেন্দ্র করে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে, তার চেয়ে যে স্থানটিতে কাহিনিটি ঘটেছে, সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ রূপে প্রকাশিত হয়েছে। এই দিক থেকে বিচার করলে নামকরণটি বিষয়কেন্দ্রিক এবং যথাযথ হয়েছে বলা যায়।
সিন্ধুতীরে কাব্যাংশ অবলম্বনে পদ্মার মনোহর প্রাসাদের বর্ণনা দাও। সখী-সহ রাজকন্যা পদ্মাবতীর রূপ দেখে সমুদ্রলক্ষ্মীর কী ধারণা হয়েছিল?
মনোহর প্রাসাদের বর্ণনা – ‘সিন্ধুতীরে’ কাব্যাংশে দেখা যায়, সমুদ্রতীরে এক দিব্যস্থানে ফুলে-ফলে ভরা এক সুরম্য উদ্যান রচনা করেছিলেন সমুদ্রকন্যা পদ্মা। সেই উদ্যানের মধ্যেই ছিল তাঁর সুরম্য প্রাসাদ। প্রাসাদটি ছিল অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর এবং বৈচিত্র্যময় — ‘বিচিত্র টঙ্গি’। এই প্রাসাদটি ছিল স্বর্ণনির্মিত এবং নানান মূল্যবান রত্নে সজ্জিত। রত্নখচিত সেই প্রাসাদে আলো পড়লে বর্ণালি বিচ্ছুরিত হতো। ‘হেম রত্নে নানা রঙ্গি’ অর্থাৎ সোনা ও রত্নের সম্ভারে প্রাসাদটি বিচিত্র ও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছিল।
পদ্মাবতীর রূপদর্শনে সমুদ্রলক্ষ্মীর ধারণা – সমুদ্রতীরের সেই অসামান্য পরিবেশে সখীদের নিয়ে উদ্যানে যাওয়ার সময় সমুদ্রকন্যা পদ্মা সমুদ্রতীরের মান্দাসটিকে লক্ষ্য করেন। দ্রুত কাছে গিয়ে অচেতন চার সখীর মধ্যে থাকা পদ্মাবতীকে তিনি দেখতে পান। পদ্মাবতীর রূপ দেখে সমুদ্রকন্যা বিস্মিত হন এবং তাঁর মনে হয়, সৌন্দর্যে তিনি স্বর্গের অপ্সরা রম্ভাকেও পরাজিত করতে পারেন — “দেখিয়া রূপের কলা বিস্মিত হইল বালা।” সমুদ্রকন্যার ধারণা হয়, ইন্দ্রের অভিশাপে স্বর্গের গায়িকা বিদ্যাধরী যেন স্বর্গচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে এসে অচেতন হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর স্থির দৃষ্টি, এলোমেলো বেশভূষা দেখে পদ্মার মনে হয়, যেন কোনো দুর্যোগ পদ্মাবতীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ছবিতে আঁকা মূর্তির মতো সেই সুন্দরী মেয়েটির তখন সামান্য শ্বাস-প্রশ্বাসই বইছিল।
আজকের আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক বাংলার ষষ্ঠ পাঠের প্রথম বিভাগ ‘সিন্ধুতীরে’ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রাসঙ্গিক হতে পারে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকে, তবে আপনি আমাকে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। এছাড়াও, পোস্টটি শেয়ার করে আপনার পরিচিতদের সহায়তা করতে পারেন যারা এর প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন