আধুনিক যুগের সূচনার সাথে সাথে ভারতবর্ষে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলন ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, বর্ণভেদ প্রথা, নারীশিক্ষার অভাব ইত্যাদি সমস্যা দূর করা। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে আধুনিক ভাবধারা প্রচারিত হয়।
মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার – বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
কীভাবে সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্য থেকে উনিশ শতকের সমাজের প্রতিকলন পাওয়া যায়?
উনিশ শতকের বাংলার ইতিহাসের একটি বিশেষ উপাদান হল সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্য। এগুলিতে সমসাময়িক সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, কৃষি ও কৃষক, সমাজ ও জাতিবিন্যাসের কথা যেমন জানা যায় তেমনি সমাজের অগ্রগতি ও আধুনিকীকরণের কথাও জানা যায়। ‘বামাবোধিনী নামক সাময়িক পত্রিকা, হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এর মতো সংবাদপত্র, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ ও ‘নীলদর্পণ’ নামক সাহিত্য থেকে একথা জানা যায়।
বামাবোধিনী পত্রিকা বিখ্যাত কেন?
ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক নারীশিক্ষার প্রসার ও নারী সমাজের উন্নয়ন। এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি ছিল বামাবোধিনী’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ (১৮৬৩ খ্রি.)। এই পত্রিকায় নারী সমাজের অবস্থা, শিক্ষাগ্রহণ ও তার তাৎপর্য, চাকরিসহ বিভিন্ন পেশায় যোগদান ও তার অভিজ্ঞতা, গৃহচিকিৎসাসহ গৃহপরিচালনার খুঁটিনাটি সম্পর্কিত রচনা প্রকাশিত হত।
স্ত্রীধন কী?
বামাবোধিনী পত্রিকা থেকে জানা যায় যে, ভারতীয় নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তিই হল স্ত্রীধন এবং এগুলি সাধারণত অলংকার ও পোশাক। বিবাহকালে নারীর ‘পিতৃদত্ত বা পিতার দেওয়া, ‘ভ্রাতৃদত্ত’ বা ভাইয়ের দেওয়া অলংকার ও উপহার ছিল স্ত্রীধনের উৎসস্থল। এছাড়া নারীর মৃত্যুর পর এই সম্পত্তি স্বামী অথবা পুত্রেরা পেত না, তা পেত তার কন্যা বা কন্যারা।
হিন্দু প্যাট্রিয়ট থেকে বাংলার জনজীবন সম্পর্কে কী জানা যায়?
হিন্দু প্যাট্রিয়ট-এ বাংলার জনগণের জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে প্রতিবেদন রচিত হয়েছিল। ইংরেজ শাসনকালে অর্থকরী ফসল (যেমন – পাট, তুলা, তৈলবীজ, আখ) চাষ ও তা বিদেশে রফতানির কারণে কৃষিপণ্য ও খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধির কারণে জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তাদের কর্মসংস্থানও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে
হিন্দু প্যাট্রিয়ট থেকে নীলচাষ সম্পর্কে কী জানা যায়?
হিন্দু প্যাট্রিয়ট নামক সংবাদপত্র হল নীলচাষ ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সম্পর্কে জানার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কৃষকদের কাছে নীলচাষ অলাভজনক হলেও দাদন বা অগ্রিম অর্থ গ্রহণের কারণে নীলচাষিরা নীলচাষ করতে বাধ্য হত। নীলচাষে অনিচ্ছুক কৃষকরা নীলকর সাহেবদের দ্বারা অত্যাচারিত হত।
হুতোম প্যাঁচার নক্শা থেকে কীভাবে কলকাতার সমাজ বিন্যাসের কথা জানা যায়?
কালীপ্রসন্ন সিংহের রচিত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ নামক ব্যঙ্গাত্মক গ্রন্থ থেকে ইংরেজ শাসনের পূর্বে বাংলার বড় বড় বংশের (কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎশেঠ) পতন এবং নতুন বংশের (মল্লিক পরিবার, শীল পরিবার) উত্থানের কথা জানা যায়। এর পাশাপাশি নতুন নতুন জাতের উদ্ভব হয়। এর মূল কারণ ছিল ইংরেজ শাসন ও ব্যাবসা-বাণিজ্য।
হুতোম প্যাঁচার নক্শা থেকে উনিশ শতকের সংস্কৃতির কথা কীভাবে জানা যায়?
হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ থেকে উনিশ শতকের বিভিন্নধর্মী সংস্কৃতির কথা জানা যায় — যেমন, নীলের ব্রত, গাজন সন্ন্যাসী (চড়কি)-দের শিবের কাছে মাথা ঘোরানো বা মাথা চালা, যাত্রাগান, বুলবুলের গান, অশ্লীল শব্দযুক্ত আখড়াই গান প্রভৃতি। এছাড়া চড়কপূজা, নীলষষ্ঠী, রামলীলা, রথ উৎসব, বারোয়ারি দুর্গাপূজাও ছিল সংস্কৃতির অঙ্গ।
নীলদর্পণ নাটকের গুরুত্ব কি?
নীলচাষিদের নীলচাষ ও অনিচ্ছুক নীলচাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারই ছিল ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মূল বিষয়। অনুমান করা হয় যে, নদিয়ার গুয়াতেলির মিত্র পরিবারের দুর্দশাই এই নাটকের মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল। নীল বিদ্রোহ ও ‘নীল কমিশন’ গঠনের পর এই নাটকটি প্রকাশিত হলে পাদ্রি জেমস্ লং এই নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।
গ্রামবার্তা প্রকাশিকা-র কয়েকটি দিক চিহ্নিত করো।
হরিনাথ মজুমদার বা কাঙাল হরিনাথ কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ছিল এক সাময়িক পত্রিকা। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি গ্রাম ও গ্রামবাসী প্রজার অবস্থা প্রকাশ করতে সচেষ্ট হন। এছাড়া এই পত্রিকায় সমসাময়িক বিভিন্ন খবরও প্রকাশিত হত।
ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের গুরুত্ব কী?
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতে শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রতি বছর অন্তত এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করার জন্য সুপারিশ করা হয়। এভাবে সরকার ভারতীয় প্রজাদের
শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আবার এই সুপারিশকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদী শিক্ষার বিতর্ক।
ভারতে শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক বলতে কী বোঝো?
ঊনবিংশ শতকে ভারতীয় জনগণের মধ্যে ‘ভারতে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে শিক্ষাচর্চার মাধ্যম’ কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। এইচ. টি. প্রিন্সেপ, কোলব্রুক প্রমুখ পণ্ডিত শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা অর্থাৎ প্রাচ্য ভাষাকে সমর্থন জানালেও স্যার জন শোর, চার্লস গ্রান্ট, লর্ড মেকলে প্রমুখ পণ্ডিত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার পক্ষেই মত প্রকাশ করেন। আধুনিক ভারতের শিক্ষাচর্চার ইতিহাসে এই বির্তক ‘প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক’ নামে পরিচিত।
কে, কবে ইংরেজি ভাষাকে ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা করেন? এর গুরুত্ব কী?
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষাকে ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা করেন। এর ফলে ভারতে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সরকারি নীতি গৃহীত হয় এবং প্রাচ্য-পাশ্চাত্যবাদী বিতর্কের অবসান ঘটে।
উডের নির্দেশনামা কী?
ভারতের প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষার মধ্যে সামঞ্চসা প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষা-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করার জন্য উনিশ শতকে চার্লস উডের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের সুপারিশগুলিকে ‘উডের নির্দেশনামা বলা হয় (১৮৫৪ খ্রি.)।
ভারতে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারের ক্ষেত্রে চার্লস উডের দুইটি সুপারিশ উল্লেখ করো।
ভারতে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারের ক্ষেত্রে চার্লস উডের অনেকগুলি সুপারিশের (১৮৫৪ খ্রি.) মধ্যে দুইটি সুপারিশ ছিল – 1.সরকারি শিক্ষানীতি রূপায়ণ ও পরিচালনার জন্য সরকারি শিক্ষা বিভাগ গঠন করা।
2. ভারতের প্রেসিডেন্সি শহরগুলিতে (কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই) একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।
হান্টার কমিশন কী?
ভারতের উচ্চশিক্ষার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম হান্টার নামে এক শিক্ষাবিদের নেতৃত্বে ভারত সরকার একটি কমিশন নিয়োগ করে, যা ‘হান্টার কমিশন’ নামে পরিচিত।
ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনে (১৯০৪ খ্রি.) কী বলা হয়েছিল?
ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় আইনে (১৯০৪ খ্রি.) বলা হয়েছিল যে —
1. বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে।
2.বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে সরকার মনোনীত সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে।
ভারতে নারীশিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের অবদান কী ছিল?
ঊনবিংশ শতকে বাংলা তথা ভারতের নারীমুক্তি আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিদ্যালয় পরিদর্শকের সরকারি পদে থাকার সুবাদে তিনি ৩৫টি (মতান্তরে ৪০টি) বালিকা বিদ্যালয় এবং ১০০টি বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছিল ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল স্থাপন।
বেথুন কলেজ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে এই স্কুলের সঙ্গে বালিগঞ্জের ‘বলামহিলা বিদ্যালয়’ বেথুন স্কুলের সঙ্গে সম্মিলিত বা একত্রিত হয়ে বেথুন কলেজে পরিণত হয়। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রথম শ্রেণির কলেজে পরিণত হয়।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কেন?
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মরত উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীদের ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, আইন ও রীতিনীতি শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
হিন্দু কলেজ কখন ও কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের যৌথ উদ্যোগে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে রাজা রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার এবং বিচারপতি হাইড ইস্ট-এর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশের মতে, ডেভিড হেয়ার ছিলেন হিন্দু কলেজের প্রস্তাবক ও এদেশীয় ক ধনবান ব্যক্তিদের আর্থিক সহযোগিতায় তিনি এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আবার ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, হাইড ইস্ট-ই এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাধাকান্ত দেব গুরুত্বপূর্ণ কেন?
রাধাকান্ত দেব কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা হলেও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তিনি হিন্দু কলেজের পরিচালনা এবং ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁর সহযোগিতায় ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা ‘ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ডেভিড হেয়ার বিখ্যাত কেন?
স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী ডেভিড হেয়ার কলকাতার একজন ঘড়ি সারাইওয়ালা হলেও এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। এছাড়াও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘পটলডাঙা অ্যাকাডেমি’ (হেয়ার স্কুল) ; ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ ও ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি। এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন মানবতাবাদী ও সমাজসেবী।
বেথুন বিখ্যাত কেন?
জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ভারতের বড়োলাটের কাউন্সিলের আইন সদস্যরূপে যোগদান করেন (১৮৪৮ খ্রি.)। তিনি এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে সচেষ্ট হন এবং কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালির সহযোগিতায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুল পরবর্তীকালে ‘বেথুন স্কুল’ নামে পরিচিত হয়।
ডা. মধুসূদৰ গুপ্ত বিখ্যাত কেন?
ডা. মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন কলকাতা সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। এই কলেজে তিনি হিন্দু ওষুধের পণ্ডিতরূপে নিযুক্ত হন (১৮৩০ খ্রি.)। আবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এখানে ডাক্তাররূপে যোগদান করেন। তিনি ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি হিন্দু কুসংস্কার উপেক্ষা করে নিজহাতে শব ব্যবচ্ছেদ করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থার কার্য পরিচালনা করত?
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন হত না। শুরুতে এই বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন স্কুল ও কলেজকে অনুমোদন প্রদান করত এবং এন্ট্রান্স ও বি. এ পরীক্ষা পরিচালনা করত। পরীক্ষা শেষে ছাত্রদের সার্টিফিকেট ও ডিগ্রি প্রদান করত।
হাজী মহম্মদ মহসীন বিখ্যাত কেন?
হুগলিতে জন্মগ্রহণকারী হাজী মহম্মদ মহসীন (১৭৩০-১৮১২ খ্রি.) ছিলেন একজন বিত্তবান, মানবতাবাদী ও পরোপকারী ব্যক্তি। তিনি তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি ও সম্পদের উপর ভিত্তি করে দানমূলক একটি ট্রাস্টি সংস্থা গঠন করেন। সমাজসেবামূলক কাজ ও শিক্ষার প্রসারে তিনি এবং তাঁর এই সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনগুলির প্রধান লক্ষ্য বা মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনগুলির প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল –
1. প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারা দ্বারা সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও কুপ্রথার অবসান ঘটানো
2. নারীকল্যাণ সাধন করা
3. সমাজসেবা ও জনকল্যাণমূলক আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটানো।
ব্রাহ্মসমাজ কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন?
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট রাজা রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে ব্রাহ্মসভার নাম পরিবর্তন করে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ রাখা হয়।
ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?
ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল –
1. হিন্দুধর্মের প্রচলিত কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতা দূর করে একেশ্বরবাদের প্রচার বা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করা
2. খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরণের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা।
কে, কবে সতীদাহ প্রথা নিবারণ করেন?
রাজা রামমোহন রায়ের সহযোগিতায় গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর এক আইনের (‘সপ্তদশ বিধি) মাধ্যমে সতীদাহ প্রথা নিবারণ করেন।
উনিশ শতকের একটি সমাজসংস্কার আন্দোলনের উল্লেখ করো। এই আন্দোলনের পুরোভাগে কে ছিলেন?
উনিশ শতকের একটি সমাজসংস্কার আন্দোলন ছিল। ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলন।’ এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষক লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।
ডিরোজিওকে মনে রাখা হয় কেন?
ডিরোজিও ছিলেন একজন যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী ও হিন্দু কলেজের শিক্ষক। তিনি বিখ্যাত ছিলেন কারণ, উনিশ শতকের প্রথমার্ধের একজন উল্লেখযোগ্য সমাজসংস্কারক। প্রগতিশীল চিন্তাধারার ভিত্তিতে তিনি হিন্দু সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের বিরোধিতা করেন। এছাড়া ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ংবেঙ্গল’ আন্দোলনের নেতা হিসাবে ডিরোজিওকে মনে রাখা হয়।
কার উদ্যোগে নব্যবঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়েছিল? এই আন্দোলনের কয়েকজন বিশিষ্ট নেতার নাম লেখো।
হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র উদ্যোগে নব্যবঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাদ মিত্র প্রমুখরা ছিলেন নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা।
ইয়ংবেঙ্গল কাদের বলা হত? এই দলের উদ্দেশ্য কী ছিল?
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র অনুগামীরা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বা ‘নব্যবঙ্গ সম্প্রদায়’ নামে পরিচিত।
ইয়ংবেঙ্গল দলের উদ্দেশ্য ছিল –
1. জনসাধারণের মধ্যে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা প্রচার করা ও যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা,
2. হিন্দুসমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরোধিতা করা,
3. যুক্তিবাদী আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটানো।
সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ কী?
১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিওর অনুগামী নব্যবঙ্গ সম্প্রদায়ের সদস্যগণ ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ নামে এক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের সর্বাঙ্গীন অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং তা জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করার উদ্দেশ্যেই এই সভা স্থাপিত হয়।
লালন ফকির বিখ্যাত কেন?
লালন ফকির ছিলেন একজন বাউল সাধক ও মানবতাবাদী এবং জাতিবিদ্বেষের তীব্র বিরোধী। তিনি প্রথ মুরশিদাবাদের চেউরিয়াতে বাউল সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি সামাজিক ও আধ্যাত্মিক বাউল গান রচনা করেন। তাঁর এই গানগুলি দরিদ্র কৃষকসহ জনগণের কাছে খুব আকর্ষণের বিষয়।
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বিখ্যাত কেন?
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী (১৮৪১ – ১৮৯১ খ্রি.) ছিলেন ব্রাত্মধর্মের একজন বিখ্যাত প্রচারক। তিনি কেশবচন্দ্র সেনের আ সঙ্গে কলকাতার বাইরে পূর্ববঙ্গে ব্রাত্মধর্ম প্রচার করেন। এর পাশাপাশি তিনি এই অঞ্চলে ব্রাত্ম উপাসনা মন্দির, বালিকা বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের ব্যবস্থা করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ কীভাবে ধর্মসমন্বয়বাদী আদর্শ বাস্তবায়িত করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলার হিন্দু সমাজে ব্রাত্মধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের প্রসারকে কেন্দ্র করে। একেশ্বরবাদ ও বহুদেবতাবাদ সম্পর্কিত দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। রামকৃয়দের বিভিন্ন ধর্ম বর্ণিত ঈশ্বরলাভের পথ ধরে ঈশ্বর সাধনা করেন ও সফল হন। তাঁর উপলব্ধির ভিত্তিতে তিনি প্রচার করেন যে, সাকার ও নিরাকার (একই ঈশ্বরের বিচিত্র = রূপ)। একেশ্বরবাদ ও বহুদেবতাবাদ হল ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গ। এভাবে তিনি ধর্মসমন্বয়বাদী আদর্শের প্রচার করেন।
বিবেকানন্দ কীভাবে নবাবেদান্ত মতাদর্শের সূচনা করেন?
মানবতাবাদী ও সমাজপ্রেমী বিবেকানন্দ আত্মমুক্তি অপেক্ষা সমাজে উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী বিবেকানন্দ ‘বনের বেদান্ত’কে ঘিরে’ আনার কথা প্রচার করেন এবং বেদান্তকে মানবহিতের কাজে ব্যবহারের কথা বলেন। এভাবে বিবেকানন্দ বেদান্তের নতুন যে ব্যাখ্যা দেন তা নব্যবেদান্ত নামে পরিচিত।
বাংলার নবজাগরণ কী?
উনিশ শতকে বাংলায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শবাদের ভিত্তিতে সমাজ ও সংস্কৃতিতে এক নবচেতনার উন্মেষ ঘটে, যা নবজাগরণ নামে পরিচিত। নবজাগরণের একটি দিক ছিল বাংলা তথা ভারতের প্রাচীন গৌরবময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পুনর্মূল্যায়ন করা। তবে বাংলার নবজাগরণ ক্রমশ সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি ও বিজ্ঞানচিন্তার ক্ষেত্রেও পরিব্যাপ্ত হয়েছিল।
বাংলায় নবজাগরণের প্রধান ভিত্তি কী ছিল?
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদী আদর্শ ছিল বাংলার নবজাগরণের প্রধানতম ভিত্তি। প্রাচ্য আদর্শের ভিত্তিগুলি হল এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা মাদ্রাসা, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও কলকাতা সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা। প্রাচ্যবাদের চর্চা ভারতের ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটায়। অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা বাংলায় মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, প্রগতিবাদী আদর্শের সঞ্চার ঘটায়। এই দুই আদর্শের ঘাত-প্রতিঘাতেই সৃষ্টি হয় বাংলার নবজাগরণ।
বাংলার নবজাগরণের সীমাবদ্ধতাগুলি কী?
বাংলায় নবজাগরণের সীমাবদ্ধতাগুলি হল — সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন মূলত হিন্দুসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাই তা ছিল হিন্দু নবজাগরণ। এছাড়া নবজাগরণ ছিল শহরকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন ; তাই তার প্রভাব সীমিত ছিল। উপরন্তু নবজাগরণের ফলে জমিদার, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত পেশাজীবী ব্যক্তিরা লাভবান হলেও কৃষকসহ সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়নি।
মাধ্যমিক ইতিহাসে সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়টি অনেক সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে এবং মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে পর্যালোচনা করে। প্রশ্নোত্তর বিষয়টি একটি সংক্ষিপ্ত রূপে সাজানো হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিষয়টি বোঝার সুবিধা হয়। সংস্কার বিষয়টি একটি গভীর বিষয়, যা বিভিন্ন দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। তাই, এই বিষয়টি ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের জীবনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে।
সংস্কারের ফলে ভারতীয় সমাজে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। এই আন্দোলনগুলির ফলে ভারতীয় সমাজে শিক্ষা, নারী অধিকার, ধর্মীয় সহনশীলতা, এবং জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল।