বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্বে ভারতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়। এই পরিবর্তনগুলিকে একত্রে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই অধ্যায়ে আমরা সেই পরিবর্তনগুলির বিস্তারিত আলোচনা করব।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ও দেশভাগ সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করো।
ভূমিকা – ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশভাগের মূল ভিত্তি ছিল মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (৩ জুন, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এট্লীর ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত ঘোষণার পরেই লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের বড়লাট পদে নিযুক্ত হয়ে আসেন (২৪ মার্চ, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)।
পরিকল্পনা – জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর মাউন্টব্যাটেন ‘ভারত বিভাগ’ সংক্রান্ত পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা নামে পরিচিত (৩ জুন, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা – মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল —
পাকিস্তান গঠন – ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলিকে নিয়ে পাঞ্জাব ও বাংলাদেশকে খণ্ডিত করে পাকিস্তান নামক একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা যেতে পারে। বাংলা ও পাঞ্জাবের খণ্ডিতকরণের জন্য একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠিত হবে।
গণভোট – উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বালুচিস্তানের লোকেরা গণভোটের মাধ্যমে এই নবগঠিত রাষ্ট্রে যোগদানের প্রশ্নের মীমাংসা করবে। আসামের অন্তর্গত সিলেট জেলা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে কিনা তা গণভোটের মাধ্যমে ঠিক করা হবে।
স্বাধীনতা আইন – ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট শীঘ্রই আইন প্রণয়ন করবে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুনের পরিবর্তে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
উপসংহার – মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত বিভাজন ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। স্বাভাবিক কারণেই মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা মুসলিম লিগ ও জাতীয় কংগ্রেস মেনে নিয়েছিল। দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিধ্বস্ত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে অখণ্ড ভারতীয় আদর্শে বিশ্বাসী কংগ্রেস এই প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হয়। ঐতিহাসিক এস. আর. মেহরোত্র-র মতে, ভারতবিভাগে সম্মত হয়ে কংগ্রেস নেতাগণ অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকারক বিকল্পটি পছন্দ করেছিলেন, (“In agreeing to the partition of India, Congress leaders chose the lesser evil.”) অন্যথায় দাসত্ব, গৃহযুদ্ধ নৈরাজ্য ভারতকে গ্রাস করত।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইন সম্পর্কে একটি টীকা লেখো।
ভূমিকা – লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত বিভাজন পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি স্পষ্ট হলেও চূড়ান্ত হয়নি। তা চূড়ান্ত হয়েছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আইনে (১৮ই জুলাই, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইন – ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই- এ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা বিল পাস হয় এবং ইংল্যান্ড রাজ ষষ্ঠ জর্জের স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে তা আইনে পরিণত হয়, (১৮ই জুলাই, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)। এই আইনের বিভিন্ন দিকগুলি হল —
দুটি রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ – ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করবে এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে।
দুটি রাষ্ট্রের এলাকা – ভারত ডোমিনিয়নের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বোম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পূর্ব-পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ এবং মুসলমান-অধ্যুষিত জেলাগুলি ভিন্ন আসাম, দিল্লি, আজমীর ও কুর্গ। পাকিস্তানের মধ্যে থাকবে ভারতের অবশিষ্ট অঞ্চল, যথা — সিন্ধুপ্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, পূর্ব বাংলা, বেলুচিস্তান ও আসামের শ্রীহট্ট জেলা ।
স্বতন্ত্র-শাসনতন্ত্র গঠন – উভয় ডোমিনিয়নের গণ-পরিষদ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র বা সংবিধান রচনা করবে। যতদিন পর্যন্ত নতুন শাসনতন্ত্র বলবৎ হচ্ছে না, ততদিন ন দুইটি রাষ্ট্রই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন দ্বারা (কিছু রদবদল করে) শাসিত হবে।
দেশীয় রাজ্যের ভবিষ্যৎ – ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট থেকে ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের অবসান হবে। এই রাজ্যগুলি নিজেদের পছন্দমতো ভারত অথবা পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগদানের অধিকার পাবে বা স্বাধীন থাকবে।
উপসংহার – মাউন্টব্যাটেন একটু ধৈর্য ধরে অগ্রসর হলে হয়তো ভারত বিভাজন এড়ানো যেত। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মধ্যে একমাত্র মৌলানা আজাদ ভারত বিভাগের তীব্র বিরোধিতা করেন। ‘Indian Wins Freedom’ গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, দেশ বিভাগের ফলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভবপর ছিল না এবং মন্ত্রি-মিশন পরিকল্পনা গৃহীত হলে ভারতের ঐক্য ও শান্তি উভয়ই বজায় থাকত।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – ভারতের স্বাধীনতালাভের পূর্বে দু’ধরনের রাজ্য ছিল যথা — ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ এবং ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন দেশীয় রাজ্য। দেশীয় রাজ্যগুলি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ছিল স্বশাসনের অধিকারী ; তাই এই রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্তি ছিল জরুরি।
ভারতভুক্তির কারণ – দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির কারণ হল –
রাজ্যগুলির গুরুত্ব – ভারতে দেশীয় রাজ্যগুলির সংখ্যা ছিল ৫৬২টি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই রাজ্যগুলি ছিল সমগ্র ভারত-ভূখণ্ডের ৪৮ শতাংশ এবং এই রাজ্যগুলির লোক সংখ্যাছিল ৯ কোটি।
জাতীয়তাবাদী আদর্শ – ভারতের জাতীয় স্তরের নেতারা অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তাঁরা ভারত ভূ-খণ্ডের ভেতরে কোনো বিচ্ছিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিতে রাজি ছিলেন না।
জনগণের আকাঙ্ক্ষা – দেশীয় রাজ্যগুলি ছিল মধ্যযুগীয় ভাবধারা যুক্ত রাজতান্ত্রিক রাজ্য এবং এখানে ছিল স্বৈরাচারী শাসন ও সমাজ ছিল কুসংস্কারাগ্রস্ত। তাই এখানের তথাকথিত প্রজাদের অধিকাংশ এই অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল।
প্রজা আন্দোলন – গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার দাবিতে প্রজা আন্দোলন’ গড়ে উঠেছিল। দেশীয় রাজ্যগুলিতে ভারতের জাতীয় নেতৃবর্গ ও কংগ্রেসের পক্ষে এই দাবিকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। এই সমস্যার সমাধান ছিল রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি।
উপসংহার – উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ধরে রাখা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পক্ষে ছিল জরুরি। একারণেই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সম্পূর্ণ হয়।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, জাতীয় ঐক্য এবং প্রগতি ও পুনর্নির্মানের জন্য দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ করা হয়। ভারতের ‘লৌহ মানব’ রূপে পরিচিত সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন এক্ষেত্রে প্রধান কৃতিত্বের অধিকারী।
প্রক্রিয়া – সর্দ্দার বল্লভভাই প্যাটেল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণে যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হল –
সংযুক্তিকরণ – বেশ কিছু দেশীয় রাজ্যকে পার্শ্ববর্তী ভারতীয় প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি, বোম্বাইয়ের সঙ্গে দাক্ষিণাত্য ও গুজরাটের রাজ্যগুলিকে সংযুক্ত করা হয়। আবার গাড়োয়াল, রামপুর ও বেনারসকে উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে, কুচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, খাসি পার্বত্য অঞ্চলকে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। মাদ্রাজের রাজ্যগুলিকে মাদ্রাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
বৃহৎ যুক্তরাজ্য গঠন – দেশীয় রাজ্যগুলির বেশ কয়েকটি রাজ্যকে সংযুক্ত করে এক একটি বৃহৎ যুক্তরাজ্য গ্রহণ করা হয়, যেমন — রাজস্থানের যুক্তরাজ্য ছিল পাঞ্জাবের যুক্তরাজ্য, বিন্ধপ্রদেশের যুক্তরাজ্য প্রভৃতি।
কেন্দ্রীয় শাসনাধীন – বেশ কিছু রাজ্যকে কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত এলাকার সঙ্গে যুক্ত করা হয় বা কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে আনা হয়। হিমাচলপ্রদেশ, কাচ্ছ, বিলাসপুর, ভোপাল, ত্রিপুরা ও মণিপুরকে কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে আনা হয়।
উপসংহার – সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ২১৬টি দেশীয় রাজ্যকে পার্শ্ববর্তী প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, ২৭৫টি দেশীয় রাজ্যকে পাঁচটি রাজ্যে পরিণত করা হয় এবং ৬১টি রাজ্যকে সাতটি কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলের সঙ্গে যোগ করে কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে আনা হয়।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলি কী ছিল?
ভূমিকা – ভারতে প্রাক্-স্বাধীনতাপর্বে দু’ধরনের রাজ্য ছিল, যথা — ব্রিটিশশাসিত প্রদেশ এবং ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন দেশীয় রাজ্য। বিভিন্ন সমস্যা অতিক্রম করে ভারত দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করেছিল।
সমস্যাসমূহ – দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলি হল –
বিক্ষিপ্ত সমস্যা – দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এররকম বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে ভূপাল, হায়দরাবাদ, ত্রিবাঙ্কুরসহ বেশ কিছু রাজ্য স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল।
জাতীয়তাবাদী আদর্শে বাধা – অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শ দ্বারা পরিচালিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন থাকার মনোভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেন যে, ভারতের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে কোনো স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করা যাবে না।
প্রজা বিদ্রোহের আশঙ্কা – দেশীয় রাজ্যগুলি রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক ও পশ্চাদপদ ছিল। তাই এই রাজ্যগুলির প্রজারা গণতান্ত্রিক ও উন্নত ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে উৎসুক ছিল। দেশীয় রাজ্যগুলিতে প্রজা বিদ্রোহের আশঙ্কাও দেখা দেয়।
বিশেষ সমস্যা – ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হায়দরাবাদ ও জুনাগড় ব্যতীত অন্যান্য রাজ্যগুলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিভিন্ন জটিলতার কারণে সমগ্র কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে ভারত সরকার ব্যর্থ হয় ; কাশ্মীর সমস্যা আজও বর্তমান।
উপসংহার – উপরোক্ত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কূটনীতি ও শক্তি প্রয়োগ করে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করেন।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তিকরণ সমস্যাকে তুমি কীভাবে বিশ্লেষণ করবে ?
ভূমিকা – ভারতের স্বাধীনতালাভের প্রাক্কালে ৫৬২ টিরও বেশি দেশীয় রাজ্য ছিল এবং এগুলির অধিকাংশই ভারতে যোগ দিলেও জুনাগড়, হায়দরাবাদ, কাশ্মীর যোগ দেয়নি। শুধু তাই নয়, কাশ্মীর এক দীর্ঘসূত্রী সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
কাশ্মীর সমস্যার প্রেক্ষাপট – কাশ্মীর সমস্যার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
হরি সিং – এর সিদ্ধান্ত – কাশ্মীর রাজ্য ছিল স্বাধীন এবং এই রাজ্যের রাজা হরি সিং ছিলেন হিন্দু, কিন্তু তাঁর অধিকাংশ প্রজাই ছিল মুসলিম। হরি সিংহ প্রথমদিকে ভারত বা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রেই যোগ না দিয়ে তার স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হন।
পাকিস্তানের প্রচেষ্টা : রাজনৈতিক-ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কাশ্মীর ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। তাই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্না কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট হন।
শেখ আবদুল্লার ভূমিকা – কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের সভাপতি শেখ আবদুল্লা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে তুলেছিলেন।
পাক-আক্রমণ – পাকিস্তানের মদতপুষ্ট হানাদারগণ কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করে উরি, বারমুলা প্রভৃতি স্থান দখল করে (২২ অক্টোবর, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)।
উপসংহার – উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংহ ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়ে পাঠান। কিন্তু ভারত সরকার মহারাজা হরি সিং-কে শর্ত দেন যে, তিনি যদি ভারতভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেন তবেই ভারত সামরিক সাহায্য প্রদান করবে। এই অবস্থায় মহারাজা হরি সিং শর্তসাপেক্ষে ভারতে যোগদান করেন (২৬ অক্টোবর, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)।
কাশ্মীর সমস্যার প্রকৃতি ও প্রভাব আলোচনা করো।
ভূমিকা – ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সমস্যাবহুল দেশীয় রাজ্যটি হল কাশ্মীর। ঘটনা পরম্পরায় কাশ্মীর ভারতে যোগদান করলেও কাশ্মীর নিজেই ভারতের কাছে একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
সমস্যার প্রকৃতি – প্রাথমিকপর্বে কাশ্মীর ভারতে যোগ দিতে না চাওয়ায় যে সমস্যা তৈরি হল তা হল –
পাক-আক্রমণ – স্বাধীন রাজ্যরূপে কাশ্মীর রাজ্যের একটি ঐতিহ্য ছিল। তাই কাশ্মীর রাজা হরি সিং ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। ইতিমধ্যে পাক-মদতপুষ্ট হানাদারগণ কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করলে হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার শর্তসাপেক্ষে হরি সিং-কে সামরিক সাহায্য করলে হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগ দেন (২৬ অক্টোবর, ১৯৪৭)।
আজাদ কাশ্মীর – কাশ্মীর রাজা হরি সিং-এর সামরিক সাহায্যের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীর থেকে পাক হানাদারদের বিতাড়ন করে। এরপর পাকিস্তান সুপরিকল্পিতভাবে ছদ্মবেশে পাক সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে প্রেরণ করলে ভারত-পাক যুদ্ধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বিরতি (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮) ঘটলেও কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তানের দখলে রয়ে যায়, যা ‘আজাদ কাশ্মীর’ নামে পরিচিত।
প্রভাব – কাশ্মীর সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এনেছিল। প্রথমত, পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পরিপূর্ণভাবে ভারতীয় ইউনিয়নের অন্যতম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। অন্যদিকে কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেরও সূচনা হয়। দ্বিতীয়ত, ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীর সমস্যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল।
দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে জুনাগড়, হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর রাজ্য কীভাবে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যা ছিল জুনাগড়, হায়দরাবাদ রাজ্যের ভারতভুক্তির সমস্যা এবং কাশ্মীর সমস্যা। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দাবাবোর্ডের সঙ্গে তুলনা করে বলেন “হায়দরাবাদ রাজা, জুনাগড় বোড়ে এবং কাশ্মীর রানি’।
বিশেষ সমস্যা – এই তিনটি রাজ্য প্রাথমিকপর্বে ভারতে যোগ দিতে না চাওয়ায় যে সমস্যা তৈরি হল তা হল –
জুনাগড় রাজ্য – কাথিয়াবাড় উপদ্বীপে অবস্থিত জুনাগড় রাজ্যের নবাব মুসলিম হলেও তার ৮০ শতাংশ প্রজা ছিল হিন্দু। জুনাগড় নবাব পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত (১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) গ্রহণ করলে জুনাগড় রাজ্যে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। কাথিয়াবাড়ের কয়েকটি রাজ্যের আবেদনের ভিত্তিতে ভারত সেখানে সৈন্যদল প্রেরণ করে। শেষ পর্যন্ত গণভোটের ভিত্তিতে (ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ) জুনাগড় রাজ্য ভারতে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে মত দেয় এবং তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় (১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ)।
হায়দরাবাদ – হায়দরাবাদের শাসক বিভিন্নভাবে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও ভারত সরকারের নির্দেশ অমান্য করতে সচেষ্ট হয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী সমগ্র হায়দরাবাদ দখল করে (১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ খ্রি:)। পরের বছর নিজাম একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতচুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে হায়দরাবাদ ভারত-ভুক্ত হয়।
কাশ্মীর – স্বাধীন রাজ্যরূপে কাশ্মীর রাজ্যের উপস্থিতির ঐতিহ্য ছিল। তাই কাশ্মীর রাজা হরি সিং ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। ইতিমধ্যে পাক-মদতপুষ্ট হানাদারগণ কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করলে হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার শর্তসাপেক্ষে হরি সিং-কে সামরিক সাহায্য করলে হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগ দেন (২৬ অক্টোবর, ১৯৪৭)।
উপসংহার – দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে এই তিনটি রাজ্যের মধ্যে জুনাগড় ও হায়দরাবাদ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার আপাত সমাধান হলেও তা ভারতে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
হায়দরাবাদের ভারতভুক্তির প্রেক্ষাপট আলোচনা করো।
ভূমিকা – ভারতের স্বাধীনতালাভের প্রাক্কালে ভারতের অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ সমস্যা। এক্ষেত্রে প্রধানতম সমস্যা ছিল। হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর সমস্যা।
হায়দরাবাদ – হায়দরাবাদ শাসক নিজাম মুসলমান হলেও সেখানকার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা ভারতে যোগদানের পক্ষপাতী হলেও নিজাম হায়দরাবাদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। পাশাপাশি ভারত বিরোধী কাজকর্মেরও সূচনা করে। তিনি কাশিম রজভি নামক একজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির প্রভাবে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাহিনী রাজাকার গড়ে তোলেন। এই বাহিনী হায়দরাবাদের অভ্যন্তরে হিন্দু জনসাধারণের উপর অত্যাচার করত।
হায়দরাবাদের ভারতভুক্তি – হায়দরাবাদের শাসক বিভিন্নভাবে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও ভারত সরকারের নির্দেশ অমান্য করতে সচেষ্ট হয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী সমগ্র হায়দরাবাদ দখল করে (১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ)। পরের বছর নিজাম একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতচুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে হায়দরাবাদ ভারত-ভুক্ত হয়।
গুরুত্ব – আনুষ্ঠানিকভাবে হায়দরাবাদের ভারতের অন্তর্ভুক্তি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কারণ— (১) হায়দরাবাদের মুসলিমসহ ভারতের অন্যান্য স্থানের মুসলিমরা নিজাম বিরোধী আন্দোলনে ভারত সরকারের নীতিকে সমর্থন জানায় । তাই হায়দরাবাদের অন্তর্ভুক্তি ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার সূচনা করে। (২) ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজামের সেনাদল ও ‘রাজাকার’ বাহিনীকে দমনের পাশাপাশি তেলেঙ্গানার সংগ্রামী কৃষকদের দমন করে। ফলে এই অঞ্চল পূর্বাপেক্ষা নিরাপদ হয়ে ওঠে।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির প্রভাব আলোচনা করো।
ভূমিকা – প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত অন্তর্ভুক্তিকরণ সমস্যা ছিল প্রধানতম সমস্যা। মূলত সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের উদ্যোগেই দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয় এবং ভারত সমস্যামুক্ত হয়।
প্রভাব – দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রভাববিস্তারকারী ঘটনা। কারণ —
ভৌগোলিক ঐক্যরক্ষা – ভারতের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঐক্য সম্পন্ন হয়। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটো-বড়ো রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ফলে ভারতের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঐক্য সম্পন্ন হয়।
অর্থনৈতিক উন্নতি – দেশীয় রাজ্যগুলি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ছিল পশ্চাদপদ এবং রাজতান্ত্রিক। তাই ভারতের সর্বত্র একই ধরনের অর্থনৈতিক নীতি ও গণতান্ত্রিক আদর্শ পরিব্যাপ্ত হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা – দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিও শক্তিশালী হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জুনাগড়, হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে হায়দরাবাদের নিজাম বিরোধী বা জুনাগড়ের নবাববিরোধী আন্দোলনের সপক্ষে বা কাশ্মীরে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানগণ ভারত সরকারকেই সমর্থন করে।
বৈচিত্র্য – ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ফলে ভারতীয় ঐতিহ্য, বৈচিত্র্য ও ঐক্য অক্ষুণ্ণ থাকে। তা ছাড়া দেশীয় রাজ্যগুলির সিংহভাগ শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতে যোগদান না করলে গৃহযুদ্ধ ছিল অবশ্যম্ভাবী। তাই দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির ঘটনা ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে।
উপসংহার – এভাবে দেখা যায় যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি ভারতের অখণ্ড জাতীয়তাবাদের আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করলেও দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ ভারতের জাতীয় আদর্শ ও সংস্কৃতিকে জোরদার করে তুলেছিল।
সীমানা কমিশন ও তার রিপোর্টের ভিত্তিতে পাঞ্জাব ও বঙ্গবিভাজনের প্রসঙ্গটি বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক ভারত-বিভাজনের প্রস্তাবের পাশাপাশি পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই উদ্দেশ্যে স্যার র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে ও সভাপতিত্বে দুটি সীমানা কমিশন গঠিত হয় (জুলাই, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)।
সীমানা বিভাজনের ভিত্তি – শিখ ও মুসলিম অধ্যুষিত পাঞ্জাব ও মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাকে বিভাজনের জন্য সিরিল র্যাডক্লিফের কাছে কোনো ‘মডেল’ ছিল না। তা ছাড়া র্যাডক্লিফ-এর নেতৃত্বে গঠিত সীমানা কমিশন বঙ্গ ও পাঞ্জাব সীমানা বিভাগের জন্য মাত্র ছয় সপ্তাহ সময় পেয়েছিল। এই স্বল্প সময়ে রিপোর্ট তৈরির জন্য তিনি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস ও প্রাকৃতিক সীমারেখারূপে নদীকেই বিভাজনরেখারূপে গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া অন্যান্য ভিত্তিগুলি হল প্রাকৃতিক সম্পদ, রেল ও বাস যোগাযোগ, প্রশাসনিক কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপরেও ভিত্তি করে তিনি তাঁর রিপোর্ট তৈরি করেন।
সীমানা বিতর্ক – কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরু গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেনকে র্যাডক্লিফ-এর সীমানা বিভাজন সংক্রান্ত-বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বললেও মাউন্ট ব্যাটেন তা করেননি। তবে র্যাডক্লিফের উপর পাঞ্জাব সম্পর্কে শিখ ও মুসলিমদের একটি অদৃশ্য চাপ ছিল। বিভিন্ন ধরনের সাম্প্রদায়িক গুজবও ছড়িয়ে পড়ে।
রিপোর্ট পেশ – র্যাডক্লিফ মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সীমানা কমিশনের রিপোর্ট পেশ করেন (১৬ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর এই রিপোর্টে বাংলাকে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে বিভক্ত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে আসে কলকাতাসহ ৩৬ শতাংশ এলাকা ও ৩৫ শতাংশ অধিবাসী। আবার মুসলমানদের ১৬ শতাংশ পড়ে পশ্চিমবঙ্গে এবং হিন্দুদের ৪২ শতাংশ পড়ে পূর্ববঙ্গে। অন্যদিকে পাঞ্জাবকে পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম পাঞ্জাবে বিভক্ত করা হয়। পূর্ব পাঞ্জাবে আসে সমগ্র পাঞ্জাবের ৩৮ শতাংশ এলাকা ও মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ।
উপসংহার – র্যাডক্লিফ রিপোর্ট ছিল অতি কঠিন, অপ্রিয় ও বিবেকহীন। তাঁর এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ভারত বিভাজন বাস্তবরূপ পায় এবং উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভব হয়। তাই এই রিপোর্ট এক সমস্যার সমাধান করতে অন্য এক সমস্যার সৃষ্টি করে।
ভারতে ১৯৪৭ – এর পরবর্তীকালে উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভব কিভাবে হয়েছিল?
ভূমিকা – ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজন এবং একইসঙ্গে পাঞ্জাব ও বঙ্গবিভাজনের ঘটনা ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার সূচনা করেছিল। ভারত সরকারের কাছে উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল এক বড়ো সমস্যা।
উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভবের কারণ – ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভবের বহুবিধ কারণ ছিল এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
দেশভাগ – লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক মুসলিম লিগের পাকিস্তান দাবি মেনে নিয়ে ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাজন ছিল উদ্বাস্তু সমস্যার মূল কারণ। এর ফলে ভারতের সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানের হিন্দু ও শিখরা নিজেদের বসবাড়ি, জমি-জমা ছেড়ে ভারতে চলে আসতে থাকে।
বঙ্গ ও পাঞ্জাব বিভাজন – স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে গঠিত সীমানা কমিশনের রিপোর্টে বঙ্গকে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ এবং পাঞ্জাবকে পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম পাঞ্জাবে বিভক্ত করা হয়। এই বিভাজনের ফলে পূর্ববঙ্গে বা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের শিখরা ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়।
নিরপত্তার অভাব – উদ্বাস্তু হয়ে হিন্দু ও শিখদের ভারতে চলে আসার মূলে কারণ ছিল দেশভাগজনিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, হিংসা ও নিরাপত্তার অভাববোধ। পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুরা নিরাপত্তার কারণেই ভারতে চলে আসে। একইভাবে ভারত থেকে মুসলমানরা চলে যায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে।
ধর্ম ও সংস্কৃতি – ভারতে উদ্বাস্তুদের আগমনের পশ্চাতে ধর্ম ও সংস্কৃতিরও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি বাস করলেও দেশভাগের প্রাক্কালে ও পরবর্তীকালে এই দুই ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে বহুযোজন দূরত্ব তৈরি হয়। তাই সমধর্মী ধর্ম ও সংস্কৃতির টানেই হিন্দু ও শিখরা ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসে।
উপসংহার – এভাবে দেখা যায় যে, উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভবের পশ্চাতে ছিল রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিংসা, নিরাপত্তার অভাব ও নিরাপদ আশ্রয় অনুসন্ধান প্রভৃতি।
উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগ বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের স্রোত ছিল পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গমুখী। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা উদ্বাস্তুরা পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা কলকাতা ও কলকাতা সন্নিহিত চব্বিশপরগনা, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেয়।
সরকারের উদ্যোগ – উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগের বিভিন্ন দিকগুলি হল —
পুনর্বাসন নীতি – ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উদ্বাস্তু সমস্যার ব্যাপকতা উপলব্ধি করেন এবং এই ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের নীতির ওপর গুরুত্ব দেন। র তাই স্বাধীনতার প্রথম পাঁচ বছর ‘পুনর্বাসনের যুগ’ নামে তপরিচিত।
উদ্বাস্তু শিবির – উদ্বাস্তুদের বাসস্থান, আহার ও নিরাপত্তাদানের জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পূর্বপাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর সংখ্যক অস্থায়ী বাসস্থান বা শিবির তৈরি করা হয়। এই শিবিরগুলিতে নথিভুক্ত উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব ও সরকারি সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।
সরকারি সাহায্য – গ্রামীণস্তরের উদ্বাস্তুদের জমিদান, কৃষিঋণ ও গৃহনির্মাণে ভরতুকি বা সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে উদ্বাস্তুদের জন্য শিল্প ও কারিগরি শিক্ষা প্রদান ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
দিল্লিচুক্তি – ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলিখানের সঙ্গে যৌথচুক্তিতে আবদ্ধ হন (এপ্রিল, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) যা নেহরু-লিয়াক চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে বলা হয় যে, সংখ্যালঘুরা যে যার রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে এবং তার কাছেই প্রতিকার চাইবে। ভবিষ্যৎ দাঙ্গা প্রতিহতকরণের ব্যবস্থা করা হবে এবং উদ্বাস্তুদের নিজের দেশে প্রত্যাবর্তনে উৎসাহদান করা হবে।
উপসংহার – উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও তা ছিল মূলত দিল্লি ও পূর্বপাঞ্জাব নির্ভর। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যা অবহেলিত হয়েছিল। তাছাড়া উদ্বাস্তু শিবিরগুলি ছিল শহর থেকে দূরে এবং অধিকাংশক্ষেত্রেই সেখানে পানীয় জল, শৌচালয় বা ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবাও ছিল না।
উদ্বাস্তু সমস্যার ক্ষেত্রে পাঞ্জাব ও বাংলার পার্থক্যগুলি কী ছিল তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজন এবং একইসঙ্গে পাঞ্জাব ও বঙ্গবিভাজনের ঘটনা ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার সূচনা করেছিল। ভারত সরকারের কাছে উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল এক বড়ো সমস্যা।
পার্থক্য – পাঞ্জাব বিভাজনের সঙ্গে বাংলা বিভাজনের বেশ কিছু মিল থাকলেও পার্থক্য ছিল বেশি, যেমন—
জনহস্তান্তর – পাঞ্জাব বিভাজনের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের মধ্যে জনহস্তান্তর ও সম্পত্তির বিনিময় করা হলেও বাংলার ক্ষেত্রে তা হয়নি।
আগমন – পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটেছিল দু’বছর ধরে। কিন্তু বাংলায় তা ছিল ধারাবাহিক।
আশ্রয়স্থান – ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের স্রোত ছিল পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গমুখী। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা উদ্বাস্তুরা পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা কলকাতা ও কলকাতা সন্নিহিত চব্বিশপরগনা, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেয়।
ভাষাগত সমস্যা – পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের ভাষাগত সমস্যা না থাকার কারণে পাঞ্জাবি ও সিন্ধ্রি উদ্বাস্তুরা দিল্লি, হরিয়ানা, হিমাচলপ্রদেশ, রাজস্থানে উত্তরপ্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারলেও পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত বাংলা ভাষী উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম ছাড়া অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেনি।
উপসংহার – উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় — জওহরলাল নেহরু বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যা অপেক্ষা পাঞ্জাবে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে অধিক গুরুত্ব দেন। তাঁর কথায়, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু উদ্বাস্তুদের পশ্চিমমুখে যাত্রার মূল কারণ ছিল ‘নিছক কাল্পনিক ভয়’।
উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ও দিল্লি চুক্তির মধ্যে। কী সম্পর্ক ছিল তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয় এবং এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক দিক ছিল নেহরু-লিয়াক চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি (৮ এপ্রিল ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ)।
প্রেক্ষাপট – স্বাধীনতালাভের পরবর্তী দু’বছরের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তুদের আগমন বন্ধ হয়ে যায়। তবে মহাত্মা গান্ধির হত্যার পরেও সাম্প্রদায়িক সমস্যা বা অন্যান্য কারণকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হ্রাস পায়নি। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম বাংলায় উদ্বাস্তুদের আগমন হ্রাস পায়নি। এই প্রেক্ষাপটেই জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানকে পালটা চাপ প্রদানের নীতি গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলিখানের সঙ্গে দিল্লি চুক্তি সম্পাদন করেন।
শর্ত – দিল্লি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী
- ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে নিজের রাষ্ট্রের কাছেই সমস্যার প্রতিকার চাইবে।
- পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে কোনো নাগরিক অন্য দেশে শরণার্থী হতে চাইলে তাকে সাহায্য করা হবে।
- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধান ও ভবিষ্যৎ দাঙ্গা প্রতিহতকরণের জন্য অনুসন্ধান কমিটি ও সংখ্যালঘু কমিটি গঠন করা হবে।
- পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীসভায় সংখ্যালঘু প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হবে।
সমালোচনা – দিল্লি চুক্তি উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে যথাযথ বা কঠোর ছিল না। তাই এই চুক্তি অনেকের কাছেই ছিল হতাশাজনক। এই চুক্তির প্রতিবাদে জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রীসভার সদস্য ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ডঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র নিয়োগী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এই চুক্তির বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।
স্মৃতিকথায় দেশভাগ কীভাবে দেশভাগ সম্পর্কিত ইতিহাসচর্চায় নতুন উপাদান সরবরাহ করেছে তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – দেশভাগ সম্পর্কিত ইতিহাসচর্চায় সরকারি নথিপত্রের পাশাপাশি ১৯৭০-এর দশক থেকে ‘আত্মজীবনী’ ও ‘স্মৃতিকথা’কেও উপাদানরূপে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। ‘স্মৃতি’ হল এক জটিল মনস্তত্ত্ব; বর্তমানের প্রেক্ষিতে অতীতের ঘটনাগুলি হাতড়ে হাতড়ে যা মনে করা যায় তাই হল স্মৃতি। তাই দেশভাগের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা উদ্বাস্তু বা প্রত্যক্ষদর্শীদের ‘স্মৃতিকথা’র ভিত্তিতে এ সম্পর্কিত অনেক অজানা ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের স্মৃতি – কথোপকথন বা লেখনীর মাধ্যমে ‘স্মৃতিকথা’য় দেশভাগের ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়, যেমন –
দেশের স্মৃতি – উদ্বাস্তুদের অনেকেই তাঁদের পূর্ববর্তী দেশ বা মাতৃভূমির স্মৃতিচারণ করে থাকে। এই স্মৃতিতে নিজেদের ফেলে আসা ঘড়-বাড়ি, জমি-জায়গা, গাছপালা, বন্ধু-বান্ধব, খাওয়া-দাওয়া, আবহাওয়া-জলবায়ু-র কথা প্রতিফলিত হয়।
দেশভাগের স্মৃতি – লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত-বিভাজন, স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের বঙ্গ ও পাঞ্জাব সীমান্ত নির্ধারণের সময় থেকেই পূর্ববঙ্গের হিন্দু ও পশ্চিম পাঞ্জাবের শিখদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। সর্বক্ষণ তাঁদের তাড়া করত কী হয় কী হয় আতঙ্ক। স্মৃতিকথায় এই আতঙ্কের প্রতিফলন পাওয়া যায়।
দেশ পরিত্যাগের স্মৃতি – হিংসা ও অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসা উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা বা এদেশে জমি-বাড়ি কিনে নতুনভাবে বসবাস শুরুর কথা বা জীবন সংগ্রামের কথা জানা যায়।
ত্রাণ ও পুনর্বাসনের স্মৃতি – ভারত সরকার কর্তৃক উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কথা জানা যায়। এক্ষেত্রে বাংলা অপেক্ষা দিল্লিই অগ্রাধিকার পেয়েছিল। বাংলার উদ্বাস্তুদের যে পুনর্গঠন ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল তা কলকাতার নিকটবর্তী স্থানে ছিল না। এই ক্যাম্পগুলিতে পানীয় জল ও শৌচাগার-এর সমস্যার কথা, কলহের কথা, পুলিশি অত্যাচারের কথা জানা যায়।
উপসংহার – ‘স্মৃতিকথা’ নির্ভর ইতিহাস সবক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে দেশভাগের ফলে যেহেতু বিশাল সংখ্যক শিখ ও হিন্দুকে উদ্বাস্তুরূপে ভারতে আসতে হয়েছিল সেক্ষেত্রে অনেকের স্মৃতির ভিত্তিতে একটি সাধারণ ইতিহাস রচনা করা যেতেই পারে।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও আইন – টীকা লেখো।
ভূমিকা – দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতে অন্তর্ভুক্তিকরণ করে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সমস্যার সমাধান করা হলেও ১৯৫০-এর দশকে রাজ্য পুনর্গঠন সংক্রান্ত সমস্যার উদ্ভব হয়। এই উদ্দেশ্যে গঠিত হয় রাজ্য পুনর্গঠন 1 কমিশন ও আইন (১৯৫৩-৫৬)।
প্রেক্ষাপট – রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠনের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে,
কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি – স্বাধীনতার পূর্বে কংগ্রেস প্রচার করেছিল যে, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে প্রতিটি প্রধান ভাষাগোষ্ঠীর জন্য পৃথক পৃথক ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠিত হবে। র কিন্তু ভারতের স্বাধীনতালাভের পর ভারতের জাতীয় সংহতি ও প্রশাসনিক কারণে কংগ্রেস ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করে। এমনকী কংগ্রেসের দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত জে. ভি. পি. রিপোর্টে (১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ) ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের বিষয়টি থামিয়ে রাখা হয়।
অন্ধ্রপ্রদেশের গঠন – তেলুগু ভাষীদের জন্য পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠিত হলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের দাবি ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে ফজল আলির নেতৃত্বে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয় (আগস্ট, ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ)। রাজ্য পুনর্গঠন করা হবে কি না বা হলেও এর ভিত্তি কী হবে, কত সংখ্যক রাজ্য পুনর্গঠিত হবে বা রাজ্যপুনর্গঠনের সুফল-কুফল আলোচনা করে সুপারিশ করা ছিল এর প্রধান কাজ।
রিপোর্ট পেশ – রাজ্য পুনগঠন কমিশন অনেক আলাপ – আলোচনার পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে বলা হয় যে,
- ইতিপূর্বে গঠিত প্রথম (A), দ্বিতীয় (B) ও তৃতীয় (C) শ্রেণির রাজ্যগুলি বিলোপ করে শুধুমাত্র ‘রাজ্য’ ও ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’রূপে ভারতকে পুনর্গঠন করতে হবে।
- উপজাতি অনুষ্ঠিত এলাকাগুলির ওপর গুরুত্ব প্রদানের পরিবর্তে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন করতে হবে। তবে বোম্বাই ও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযুক্ত হবে না।
- ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের রিপোর্ট কিছু সংশোধনের পর ভারতীয় সংসদের অনুমোদন লাভ করে এবং তা আইনে পরিণত হয় (নভেম্বর, ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ)। এই আইনে ১৬টি প্রদেশ ও ৩টি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য গঠনের কথা বলা হয়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কীভাবে সম্পন্ন হয়েছিল তা আলোচনা করা।
ভূমিকা – ভারতে দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করেছিল এবং এই রাজ্যগুলির সীমানা কী হবে অথবা রাজ্যগুলি ভাষাভিত্তিক বা উপজাতিভিত্তিক রাজ্য হবে কিনা সে সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দেয়। স্বাধীন তেলুগু ভাষাভিত্তিক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠন এই বিতর্কে ইন্ধন জোগায়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন – ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও আইনের ভিত্তিতে ১৬টি প্রদেশ ও ৩টি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য গঠনের কথা বলা হয়। এই আইনের ভিত্তিতে
- হায়দরাবাদ থেকে তেলেঙ্গানাকে বিচ্ছিন্ন করে অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- মালাবার ও ত্রিবাঙ্কুর কোচিনকে যুক্ত করে গঠন করা হয় কেরালা।
- কন্নড় ভাষী অঞ্চলগুলিকে মহীশূরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- কচ্ছ, সৌরাষ্ট্র ও হায়দরাবাদের মারাঠী ভাষী অঞ্চলের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় বৃহত্তর বোম্বাই প্রদেশ।
- বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কিছু অংশ ও পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
প্রতিক্রিয়া – এভাবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠিত হলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিক্রিয়ার সূচনা হয় এবং ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত
- বোম্বাই-প্রদেশকে দু’ভাগ করে মারাঠি ভাষী মহারাষ্ট্র ও গুজরাটি ভাষী গুজরাট রাজ্য তৈরি করা হয়। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে।
- পাঞ্জাব প্রদেশকে ভেঙে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা নামক দুটি রাজ্য তৈরি করা হয় (১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ)।
গুরুত্ব – ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের ফলে কয়েকটি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গড়ে ওঠে, যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি। এর ফলে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী গুরুত্ব লাভ করে। তবে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন ভারতের জাতীয় সংহতির পক্ষে আপাত ক্ষতিকারক হলেও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিতে তা ক্ষতিকারক ছিল না।
উপসংহার – তাই ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন ছিল। রাজ্য পুনর্গঠনের এক যুক্তিসংগত পদক্ষেপ। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের বিষয়টি বেশ কিছু জটিলতারও সৃষ্টি করেছিল।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্ব ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়কালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং একটি নতুন জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করে। স্বাধীনতার পর ভারতের মুখোমুখি অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ছিল এই চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে অন্যতম।