এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।” নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোল পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের দ্বিতীয় অধ্যায় “বায়ুমণ্ডল – আর্দ্রতা ও অধঃক্ষেপণ” -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য –
পৃথিবীর উভয় গোলার্ধে মহাদেশগুলির পশ্চিম প্রান্তে 30°-45° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে শুষ্ক গ্রীষ্ম ও আর্দ্র শীত সম্পন্ন জলবায়ু বিরাজ করে। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলিতে এই জলবায়ুর বিস্তার ও প্রভাব বেশি বলে একে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু বলে। এই জন্মায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
উষ্ণতা সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য –
- মৃদুভাবাপন্ন জলবায়ু – ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মৃদুভাবাপন্ন বা সমভাবাপন্ন জলবায়ু। সমুদ্রের তীরে অবস্থিত হওয়ার ফলে এই জলবায়ু অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মের উষ্ণতা খুব বেশি বা কম হয় না অর্থাৎ শীত ও গ্রীষ্মের তীব্রতা বেশি নয়।
- শুষ্ক গ্রীষ্মকাল – এই জলবায়ু অঞ্চলে গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও শুষ্ক। গ্রীষ্মকালে এখানে উষ্ণতা থাকে 21°C-27°C। সমুদ্র থেকে দূরবর্তী স্থানে 30°C -এর বেশি উষ্ণতা লক্ষণীয়।
- মৃদু উষ্ণ শীতকাল – এই অঞ্চলে শীতকাল মৃদু উষ্ণ। এই সময় গড়ে উষ্ণতা থাকে 5°C-10°C -এর মধ্যে।
- বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর – ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর থাকে 15°C-17°C -এর মধ্যে। তবে সমুদ্র থেকে মহাদেশের অভ্যন্তরে দূরত্ব যত বাড়তে থাকে বার্ষিক উষ্ণতার প্রসরতা তত বাড়তে থাকে। যেমন – সমুদ্রতীরবর্তী সানফ্রান্সিসকোতে উষ্ণতার প্রসর যেখানে মাত্র 5.5°C সেখানে সাক্রামেনটোতে 15°C, নেপলসে 16°C এবং রোমে 18°C।
- দৈনিক উষ্ণতার প্রসর – ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের শুষ্কতর স্থানগুলিতে দৈনিক উষ্ণতার প্রসর, বার্ষিক উষ্ণতায় প্রসর অপেক্ষা উচ্চতর। যেমন – আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ উপত্যকায় অবস্থিত সাক্রামেনটোতে জুলাই মাসে দিনের বেলা উষ্ণতা থাকে 45.5°C-46°C এবং রাত্রে উষ্ণতা দ্রুত হ্রাস পেয়ে 15.5°C হয়। অর্থাৎ দৈনিক উষ্ণতার প্রসর হয় প্রায় 30°C।
- কম উষ্ণতা যুক্ত উপকূলীয় অঞ্চল – গ্রীষ্মকালে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে সমুদ্র থেকে দূরবর্তী স্থানগুলিতে উষ্ণতা ‘তুলনামূলক ভাবে বেশি থাকলেও সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে উষ্ণতা বেশ কম থাকে। উপকূলের সঙ্গে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত কয়েকটি শীতল স্রোত উপকূলবর্তী অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতাকে কমিয়ে দেয়। যেমন – ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের শীতল ক্যালিফোর্নিয়া স্রোত, চিলি অঞ্চলের পেরু স্রোত ও কেপ প্রদেশ অঞ্চলে বেঙ্গুয়েলা স্রোত।
বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহ সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য –
- স্থায়ী ক্রান্তীয় উচ্চচাপ – অঞ্চলটি উভয় গোলার্ধের 30°-45° অক্ষাংশে অবস্থিত হওয়ায় স্থায়ী ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় বিরাজ করে। এখানে বায়ুচাপ 1020-1026 মিলিবার হয়।
- চাপ বলয়ের স্থানান্তর – সূর্যের আপাত বার্ষিক গতির জন্য চাপবলয় ও নিয়ত বায়ুপ্রবাহ বলয় ঋতুভিত্তিক 5°-10° স্থান পরিবর্তন করে।
- বায়ুপ্রবাহের দিক – সূর্যের উত্তরায়ণের ফলে উত্তর গোলার্ধের অঞ্চলটিতে গ্রীষ্মকালে কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয় অবস্থান করে। ফলে এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধে শীতকালে উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয়। আবার সূর্যের দক্ষিণায়নের ফলে উত্তর গোলার্ধের অঞ্চলটিতে শীতকালে সুমেরু বৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় অবস্থান করে। ফলে উত্তর গোলার্ধে শীতকালে পশ্চিমা বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকালে আয়ন বায়ু প্রবাহিত হয়।
- স্থানীয় বায়ুর প্রাদুর্ভাব – ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে অসংখ্য ভিন্নধর্মী স্থানীয় বায়ুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই বায়ু বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন – আলজিরিয়াতে খামসিন, টিউনিসিয়াতে ঘিবলি, দক্ষিণ-পূর্ব স্পেন, ইটালি ও উত্তর আফ্রিকাতে সিরোক্কো, স্পেনে লেভেচে, অস্ট্রেলিয়াতে ব্রিক ফিল্ডার প্রভৃতি। আবার শীতকালে ফ্রান্সের রোন উপত্যকায় মিস্ট্রাল, যুগোশ্লাভিয়ার অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলে বোরা, কর্সিকা ও ফ্রান্সে পোনেন্ট প্রভৃতি স্থানীয় বায়ু প্রবাহিত হয়।

মেঘাচ্ছন্নতা ও বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য –
- মেঘমুক্ত গ্রীষ্মকাল – বছরের অধিকাংশ সময়ে আকাশ মেঘমুক্ত, নির্মল, নীলাভ এবং আবহাওয়া রোদ ঝলমলে হয়। তবে গ্রীষ্মের তুলনায় শীতকালে আকাশ কিছুটা মেঘলা থাকে।
- আর্দ্র শীতকাল – বৃষ্টিবহুল আর্দ্র শীতকাল ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য যা মৌসুমি জলবায়ুর বিপরীত। উত্তর গোলার্ধে ডিসেম্বর-মার্চ এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মে-আগস্ট মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়।
- বৃষ্টিপাতের পরিমাণ – এই অঞ্চলে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশ কম প্রায় 25-90 সেমি। কারণ উপক্রান্তীয় সংকীর্ণ সমুদ্রে বাষ্পীভবন কম পরিমাণে হয়।
- ঘূর্ণাবর্তের আবির্ভাব – শীতকালে 4 মাস দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমাবায়ু ও নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলীয় ঘূর্ণবাতের প্রভাবে বার্ষিক বৃষ্টির 75% হয়।
- অসম বৃষ্টিপাত – অঞ্চলটিতে বৃষ্টিপাতের বণ্টন অত্যন্ত অসম। নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে, পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে এবং উপকূল থেকে অভ্যন্তরভাগের দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পায়। উপকূল অঞ্চলে উচ্চভূমি বা পর্বত আর্দ্র পশ্চিমাবায়ুকে বাধা দিয়ে প্রতিবাত ঢালে ব্যাপক শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়। যথা – অ্যাড্রিয়াটিক উপসাগরের ডালমেশিয়ান উচ্চভূমিতে 450 সেমি, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের টেবিল পর্বতে 200 সেমি আবার অনুবাত ঢালে খুবই কম বৃষ্টিপাত হয় (সান্তিয়াগোতে 35 সেমি)।
- বছরে দু-বার বর্ষার আগমন – ভূমধ্যসাগরের উত্তর তীরবর্তী উপদ্বীপ ও উপসাগরে বছরে দু-বার শরৎ ও বসন্তে বৃষ্টিপাত হয়।
তুহিন ও তুষারপাতের বৈশিষ্ট্য –
- ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে সাধারণত তুষারপাত হয় না। তবে অনেক সময় শীতল মেরু বায়ুপুঞ্জের আগমনের জন্য ভূপৃষ্ঠ তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে পড়লে নিম্নভূমি অঞ্চলে তুষারপাত হয়।
- ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের নিম্নভূমিতে তুষারপাত একটি বিরল ঘটনা। ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশের মধ্য ও দক্ষিণ দিকের নিম্নভূমিতে বার্ষিক তুষারপাতের পরিমাণ 2.5 সেমির কম। তবে এই জলবায়ু অঞ্চলের নিকটবর্তী পর্বত ও উচ্চভূমিতে উচ্চতার জন্য উষ্ণতা বেশ কম এবং এই স্থানগুলিতে ব্যাপক তুষারপাত হয়। মধ্য ক্যালিফোর্নিয়া ও ডালমেশিয়ান উচ্চভূমি অঞ্চলে তুষারপাত হয়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু কোথায় দেখা যায়?
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু পৃথিবীর উভয় গোলার্ধে 30°-45° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে মহাদেশগুলির পশ্চিম প্রান্তে দেখা যায়। যেমন –
1. উত্তর গোলার্ধে – ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশ (স্পেন, ইতালি, গ্রিস), ক্যালিফোর্নিয়া (যুক্তরাষ্ট্র), চিলির মধ্যাঞ্চল।
2. দক্ষিণ গোলার্ধে – দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশ, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
1. শুষ্ক গ্রীষ্মকাল (উষ্ণ ও শুষ্ক, বৃষ্টিপাত কম)।
2. আর্দ্র শীতকাল (মৃদু শীত ও বৃষ্টিপাত বেশি)।
3. বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর 15°C-17°C।
4. বার্ষিক বৃষ্টিপাত 25-90 সেমি।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে গ্রীষ্মকাল শুষ্ক কেন?
গ্রীষ্মকালে এই অঞ্চল ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয়ের (30° অক্ষাংশ) প্রভাবে আসে, ফলে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় না এবং বৃষ্টিপাত হয় না। এছাড়া, শুষ্ক আয়ন বায়ু প্রবাহিত হয়।
শীতকালে বৃষ্টিপাত হয় কীভাবে?
শীতকালে পশ্চিমাবায়ু ও নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়। এ সময় সমুদ্র থেকে আর্দ্র বায়ু এসে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে দৈনিক উষ্ণতার প্রসর বেশি কেন?
শুষ্ক অঞ্চলে দিনে তাপ শোষণ ও রাতে দ্রুত তাপ বিকিরণের কারণে দৈনিক উষ্ণতার প্রসর বেশি হয় (যেমন – ক্যালিফোর্নিয়ায় 30°C পর্যন্ত)।
ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর উপকূলে উষ্ণতা কম কেন?
উপকূলের সঙ্গে শীতল সমুদ্রস্রোত (ক্যালিফোর্নিয়া স্রোত, পেরু স্রোত, বেঙ্গুয়েলা স্রোত) প্রবাহিত হওয়ায় উষ্ণতা নিয়ন্ত্রিত হয়।
স্থানীয় বায়ুর উদাহরণ দাও।
1. সিরোক্কো (উত্তর আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগরে প্রবাহিত উষ্ণ বায়ু)।
2. মিস্ট্রাল (ফ্রান্সের রোন উপত্যকায় শীতল শুষ্ক বায়ু)।
3. বোরা (অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলে শীতল বায়ু)।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত অসম কেন?
1. প্রতিবাত ঢালে বেশি বৃষ্টিপাত (ডালমেশিয়ায় 450 সেমি)।
2. অনুবাত ঢালে কম বৃষ্টিপাত (সান্তিয়াগোতে 35 সেমি)।
এই অঞ্চলে কৃষি কী ধরনের হয়?
শীতকালীন বৃষ্টির জন্য জলসেচের প্রয়োজন হয়। প্রধান ফসল –
1. জইতুন, আঙ্গুর, কমলা, লেবু (মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল)।
2. গম, বার্লি (শীতকালীন ফসল)।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই “ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের দ্বিতীয় অধ্যায় “বায়ুমণ্ডল – আর্দ্রতা ও অধঃক্ষেপণ” -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন