মাধ্যমিক ইতিহাস – উত্তর – ঔপনিবেশিক ভারত – বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সময়কালকে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব বলা হয়। এই সময়কালে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

Table of Contents

মাধ্যমিক ইতিহাস – উত্তর- ঔপনিবেশিক ভারত  বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব

স্বাধীন ভারতের আপাত সমস্যাগুলি কী ছিল?

স্বাধীন ভারতের আপাত সমস্যাগুলি ছিল অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের সমস্যাগুলি হল –

  • পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারত আগত উদ্বাস্তুদের সমস্যা
  • দেশবিভাগজনিত হিংসা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সমস্যা
  • দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ সমস্যা
  • বেকারসমস্যা ও খাদ্যসমস্যা। অন্যদিকে বৈদেশিক সমস্যার মধ্যে প্রধানতম দিক ছিল ঠান্ডা লড়াইজনিত কারণে বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত সমস্যা।

পাকিস্তান ডোমিনিয়ন কী?

ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে ভারত বিভাগ করে পাকিস্তান নামক একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বা ডোমিনিয়ন তৈরি করা হয় ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। এর রাজধানী হয় করাচি এবং এর প্রথম গভর্নর জেনারেল হল মহম্মদ আলি জিন্নাহ। পাকিস্তান ডোমিনিয়নের দুটি অংশ ছিল যথা — পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান।

উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত বলতে কী বোঝায়?

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। এরপর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারত – গঠন শুরু হয়। তাই সাধারণত ১৯৪৭-১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় পর্ব উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত বা নেহরু যুগ নামে পরিচিত।

দেশীয় রাজ্য বলতে কী বোঝায়?

ভারতের স্বাধীনতালাভের প্রাক্কালে ভারতে কাশ্মীর, হায়দরাবাদ, জুনাগড় প্রভৃতি ৫৬২টিরও বেশি দেশীয় রাজ্য ছিল এবং এগুলির অধিকাংশই বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। আবার এগুলির মধ্যে বেশ কিছু রাজ্য ছিল স্বাধীনরাজ্য। এগুলি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটো বা বড়ো আকারে ছড়িয়ে ছিল এবং এগুলির অধিকাংশই ছিল ভারতের তুলনায় পশ্চাদপদ।

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির দুটি কারণ লেখো।

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির দুটি কারণ হল —

  • দেশীয় রাজ্যগুলি ছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা এলাকা; তাই তা ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় সংহতির পক্ষে ছিল বিপজ্জনক।
  • ভারতের স্বাধীনতা আইনে বলা হয় যে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান বা স্বাধীন থাকা তাদের উপরেই নির্ভরশীল। তাই বেশ কিছু রাজ্য ভারতে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানে যোগ দিতে অগ্রসর হয়।

ইনস্ট্রুমেন্ট অব্ অ্যাকসেশন (ICA) কী?

ভারতের দেশীয় রাজ্য দপ্তরের প্রধান সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্তির জন্য কয়েকটি শর্তযুক্ত যে চুক্তিপত্র তৈরি করেন তা ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন নামে পরিচিত। এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী দেশীয় রাজারা ভারত সরকারের কাছ থেকে ভাতা, খেতাব ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা লাভ করত। কয়েকটি দেশীয় রাজ্য ব্যতীত অধিকাংশ দেশীয় রাজ্যের রাজারা এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।

ভারতভুক্তির ক্ষেত্রে কাশ্মীরের রাজা হরি সিং – এর দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?

কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান না করে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন, কারণ —

  • কাশ্মীরের স্বাধীন ঐতিহ্যের ভিত্তিতে কাশ্মীরকে স্বাধীন রাখা
  • গণতান্ত্রিক ভারতে যোগদান করলে তাঁর রাজকীয় মর্যাদার বিলোপ ঘটতো এবং
  • সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রজারা কাশ্মীর রাজ্যের হিন্দুদের অস্তিত্বের সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াত।

কাশ্মীর রাজ্যের ভারতভুক্তির প্রেক্ষাপট কী ছিল?

কাশ্মীর রাজ্যের ঐতিহ্য ছিল স্বাধীন রাজ্যরূপে উপস্থিতি। তাই কাশ্মীর রাজা হরি সিং ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। ইতিমধ্যে পাক-মদতপুষ্ট হানাদারগণ কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করলে হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার শর্তসাপেক্ষে হরি সিং – কে সামরিক সাহায্য করলে হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগ দেন (২৬ অক্টোবর, ১৯৪৭)।

আজাদ কাশ্মীর কী?

কাশ্মীর রাজা হরি সিং – এর সামরিক সাহায্যের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীর থেকে পাক হানাদারদের বিতাড়ন করে। এরপর পাকিস্তান সুপরিকল্পিতভাবে ছদ্মবেশে পাক সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে প্রেরণ করলে ভারত-পাক যুদ্ধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বিরতি (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮) ঘটলেও কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তানের দখলে রয়ে যায়, যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত।

রাজাকার কারা?

দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদের প্রায় ৮৫ শতাংশই ছিল হিন্দু অথচ হায়দরাবাদের শাসক নিজাম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি কাশিম রেজভি নামক একজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির প্রভাবাধীনে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনী রাজাকার নামে পরিচিত। এই বাহিনি হায়দরাবাদের অভ্যন্তরে হিন্দু জনসাধারণের ওপর অত্যাচার করত।

হায়দরাবাদের ভারতভুক্তির গুরুত্ব কী?

আনুষ্ঠানিকভাবে হায়দরাবাদের ভারতের অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব গুলি হল –

  • হায়দরাবাদের মুসলিমসহ ভারতের অন্যান্য স্থানের মুসলিমরা নিজাম বিরোধী আন্দোলনে ভারত সরকারের নীতিকে সমর্থন জানায়। তাই হায়দরাবাদের অন্তর্ভুক্তি ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার সূচনা করে।
  • ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজামের সেনাদল ও রাজাকার বাহিনীকে দমনের পাশাপাশি তেলেঙ্গানার সংগ্রামী কৃষকদের দমন করে। ফলে এই অঞ্চল পূর্বাপেক্ষা নিরাপদ হয়ে ওঠে।

হায়দরাবাদ কীভাবে ভারতভুক্ত হয়।

হায়দরাবাদের শাসক বিভিন্নভাবে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও ভারত সরকারের নির্দেশ অমান্য করতে সচেষ্ট হয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী সমগ্র হায়দরাবাদ দখল করে (১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ খ্রি:)। পরের বছর নিজাম একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতচুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে হায়দরাবাদ ভারত-ভুক্ত হয়।

ফরাসি ও পোর্তুগিজ অধ্যুষিত ভারত এলাকা কিভাবে ভারতভুক্ত হয়?

ভারত স্বাধীন হলে ফ্রান্সের প্রভাবাধীন পণ্ডিচেরী, মাহে ও চন্দননগর এবং পোর্তুগিজ অধ্যুষিত গোয়া, দমন, দিউ ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে উৎসুক হয়ে পড়ে। দীর্ঘ আলাপ, আলোচনা ও সমালোচনার পর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স এই অঞ্চল ত্যাগ করলে তা ভারতভুক্ত হয়। কিন্তু পোর্তুগাল তার দখলীকৃত এলাকা পরিত্যাগে অরাজি হলে ভারতীয় সেনাবাহিনী তা দখল করে (১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ)।

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ফলাফল কী ছিল?

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ফলাফলগুলি হল –

  • ভারতের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঐক্য সম্পন্ন হয়। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটো বড়ো রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ফলে ভারতের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঐক্য সম্পন্ন হয়।
  • দেশীয় রাজ্যগুলি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ছিল পশ্চাদপদ এবং রাজতান্ত্রিক। তাই ভারতের সর্বত্র একই ধরনের অর্থনৈতিক নীতি ও গণতান্ত্রিক আদর্শ পরিব্যাপ্ত হয়।

স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফ বিখ্যাত কেন?

মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক ভারত – বিভাজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে বঙ্গ ও পাঞ্জাবের সীমানা বিভাজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে গঠিত হয় দুটি সীমানা কমিশন। স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফ ছিলেন এই দুই সীমানা কমিশনের সভাপতি। তিনি মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে এই কমিশনের রিপোর্ট পেশ করেন (১৬ আগস্ট, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)। এই সীমানা কমিশনের সঙ্গেই ব্র্যাডক্লিফের নাম উচ্চারিত হয়।

ভারত বিভাজনের জন্য গঠিত সীমানা কমিশন কী?

ভারত বিভাজনের জন্য শিখ অধ্যুষিত পান্থাব ও মুসলমান অধ্যুষিত বঙ্গ-কে বিভাজন করে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই উদ্দেশ্যে স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফের নেতৃত্বে দুটি পৃথক সীমানা কমিশন গঠিত হয়। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কেন্দ্র প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে সীমানা কমিশন বঙ্গ ও পাঞ্জাব বিভাজন করে।

র‍্যাডক্লিফ কীসের ওপর ভিত্তি করে সীমানা কমিশনের রিপোর্ট তৈরি করেন?

র‍্যাডফ্লিক-এর নেতৃত্বে গঠিত সীমানা কমিশন বা ও পাঞ্জাব সীমানা বিভাগের জন্য মাত্র ছয় সপ্তাহ সময় পেয়েছিল। এই স্বল্প সময়ে রিপোর্ট তৈরির জন্য তিনি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস ও প্রাকৃতিক সীমারেখারুপে নদীকেই বিভাজনরেখারূপে গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া অন্যান্য ভিত্তিগুলি হল প্রাকৃতিক সম্পদ, রেল ও বাস যোগাযোগ, প্রশাসনিক কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপরেও ভিত্তি করে তিনি তাঁর রিপোর্ট তৈরি করেন।

উদ্‌বাস্তু বলতে কী বোঝায়?

দেশভাগ-কথাটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত কথাটি হল উদ্‌বাস্তু। দেশভাগের ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণ বা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বা অন্য কোনো কারণে যখন নাগরিকরা মাতৃভূমি পরিত্যাগ করে অন্য দেশে আশ্রয় নেয় তখন তারা উদ্‌বাস্তু নামে পরিচিত। উদ্‌বাস্তুরা মূলত ছিন্নমূল মানুষ ; উদ্‌বাস্তুরা অধিকাংশক্ষেত্রেই জাতিবিদ্বেষের শিকার হয় বা অত্যাচারিত হয়।

ভারতে আগত উদ্‌বাস্তুরা মূলত কোথায় আশ্রয় নেয়?

ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের স্রোত ছিল পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গমুখী। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা উদ্‌বাস্তুরা পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্‌বাস্তুরা কলকাতা ও কলকাতা সন্নিহিত চব্বিশ পরগণা, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেয়।

ভারতে উদ্‌বাস্তু সমস্যার উদ্ভব কীভাবে হয়?

স্বাধীন ভারতের আপাত সমস্যাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – উদ্‌বাস্তু সমস্যা। পাঞ্জাব ও বঙ্গবিভাজনের ফলে পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ববঙ্গ থেকে সেখানকার সংখ্যালঘু শিখ ও হিন্দুদের উদ্‌বাস্তুরূপে ভারতে আগমন ঘটে। এই সমস্ত ছিন্নমূল শরণার্থীরাই উদ্‌বাস্তু নামে পরিচিত। এর ফলে উদ্‌বাস্তুদের বাসস্থান ও খাদ্য সমস্যার সমাধান এবং তাদের পুনর্বাসন সমস্যার সমাধানের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই সমস্যা ভারতের কাছে ছিল এক বড়ো চ্যালেঞ্জ।

পাঞ্জাব বিভাজনের সঙ্গে বাংলা বিভাজনের পার্থক্য কী ছিল?

পাঞ্জাব বিভাজনের সঙ্গে বাংলা বিভাজনের বেশ কিছু মিল থাকলেও পার্থক্য ছিল বেশি, যেমন –

  • পাঞ্জাব বিভাজনের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের মধ্যে জনহস্তান্তর ও সম্পত্তির বিনিময় করা হলেও বাংলার ক্ষেত্রে তা হয়নি।
  • পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্‌বাস্তুদের আগমন ঘটেছিল দু বছর ধরে। কিন্তু বাংলায় তা ছিল ধারাবাহিক।

দেশভাগজনিত হিংসা বন্ধ ও উদ্‌বাস্তু সমস্যার সমাধানে মহাত্মা গান্ধির প্রচেষ্টা কী ছিল?

দেশভাগজনিত হিংসা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও উদ্‌বাস্তু সমস্যার সমাধানে মহাত্মা গান্ধির উদ্যোগ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ —

  • তিনি শান্তির বাণী প্রচারের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা প্রচার করেন।
  • হিংসা ও উদ্‌বাস্তু সমস্যার সমাধানে তিনি কলকাতার বেলেঘাটা-বাড়িতে অনশন শুরু করেন। আবার দিল্লিতে মুসলিমদের পুনর্বাসনের জন্যও তিনি অনশন করেছিলেন।

উদ্বাস্তু শিবির কী?

অন্য দেশ থেকে চ্ছিন্নমূল হয়ে আসা উদ্বাস্তুদের বাসস্থান, আহার ও নিরাপত্তা দানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি অস্থায়ী বাসস্থান বা শিবির উদ্‌বাস্তু শিবির নামে পরিচিত। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গ এরূপ অনেক উদ্‌বাস্তু শিবির তৈরি করেছিল। তবে এগুলি ছিল শহর থেকে দূরে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পানীয় জল, শৌচালয় বা ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবাও ছিল না।

দিল্লি চুক্তি (১৯৫০ খ্রি:) কি?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহর উদ্‌বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে যৌথচুক্তিতে আবদ্ধ হন (এপ্রিল, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে) যা, নেহরু লিয়াকত চুক্তি বা দিতি চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে বলা হয় যে,সংখ্যালঘুরা যে যার রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে এবং তার কাছেই প্রতিকার চাইবে। ভবিষ্যৎ দাঙ্গা প্রতিহতকরণের ব্যবস্থা করা হবে এবং উদ্বাস্তুদের নিজের দেশে প্রত্যাবর্তনে উৎসাহদান করা হবে।

আত্মজীবনী থেকে কিভাবে দেশভাগের কথা জানা যায়?

রাজনৈতিক নেতা বা বিশিষ্ট পণ্ডিত বা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মজীবনী থেকে দেশভাগের কথা জানা যায়। আত্মজীবনী থেকে দেশভাগের প্রেক্ষাপট, দেশভাগের জন্য মহম্মদ আলি জিন্নাসহ মুসলিম লিগ বা ইংরেজ সরকার বা জাতীয় কংগ্রেসের দায়িত্ব নিরূপণ, দেশভাগের প্রতিক্রিয়া, উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভব ও তার সমাধান, স্বাধীন ভারত নির্মাণ প্রভৃতির কথা জানা যায়।

রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন কী?

তেলুগু ভাষীদের জন্য পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠিত হলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের দাবি ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে ফজল আলির নেতৃত্বে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয় (আগস্ট, ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ)। রাজ্য পুনর্গঠন করা হবে কি না বা হলেও এর ভিত্তি কী হবে, কত সংখ্যক রাজ্য পুনর্গঠিত হবে বা রাজ্যপুনর্গঠনের সুফল-কুফল আলোচনা করে সুপারিশ করা ছিল এর প্রধান কাজ।

ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?

স্বাধীনতার পূর্বে কংগ্রেস প্রচার করেছিল যে, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে প্রতিটি প্রধান ভাষাগোষ্ঠীর জন্য পৃথক পৃথক ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠিত হবে। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের জাতীয় সংহতি ও প্রশাসনিক কারণে কংগ্রেস ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করে। এমনকী কংগ্রেসের দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত জে. ভি. পি. রিপোর্টে (১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ) ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের বিষয়টি থামিয়ে রাখা হয়।

পট্টি শ্রীরামালু বিখ্যাত কেন?

পট্টি শ্রীরামালু ছিলেন একজন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন (১৯ অক্টোবর, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ)। ৫৮ দিন অনশনের পর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর অন্ধ্রপ্রদেশে তিনদিন ধরে পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশের দাবিতে দাঙ্গা, বিক্ষোভ প্রদর্শন, হরতাল পালিত হয়। তাই তিনি পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশের উদ্‌গাতা নামে পরিচিত।

মহারাষ্ট্র ও গুজরাট কীভাবে গঠিত হয়?

অবিভক্ত বোম্বাই প্রদেশে মারাঠী ও গুজরাটী ভাষাভাষির মানুষ ছিল। সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি ও মহাগুজরাট নেতা পরিষদ মারাঠী ও গুজরাটী ভাষা অধ্যুষিত দুটি স্বতন্ত্র রাজ্যগঠনের দাবিতে প্রবল গণআন্দোলনের সূচনা করেছিল। এই প্রেক্ষাপটেই কেন্দ্রীয় সরকার বোম্বাই প্রদেশকে বিভক্ত করে পৃথক মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্য গঠন করে (মে, ১৯৬০ খ্রি.)।

ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের ফল কী ছিল?

ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের ফলে কয়েকটি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গড়ে ওঠে, যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি। এর ফলে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী গুরুত্ব লাভ করে। তবে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন ভারতের জাতীয় সংহতির পক্ষে আপাত ক্ষতিকারক হলেও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিতে তা ক্ষতিকারক ছিল না।

তাই এটি ছিল রাজ্য পুনগঠনের এক যুক্তিসংগত পদক্ষেপ। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের বিষয়টি বেশ কিছু জটিলতারও সৃষ্টি করেছিল।

উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব ছিল ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়কালে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই পরিবর্তনগুলি ভারতকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

Share via:

মন্তব্য করুন