আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় “প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর থেকে “সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

আদিবাসীরা অরণ্যের উপর কীভাবে নির্ভরশীল ছিল?
ভারতের আদিম আদিবাসীরা অরণ্যের উপর দারুণভাবে নির্ভরশীল ছিল। অরণ্যাঞ্চলই ছিল তাদের বসবাসের একমাত্র জায়গা।
আদিবাসীরা অরণ্যের নির্ভরশীলতা –
তারা বনের ফলমূল, কাঠ, মধু সংগ্রহ এবং বন্য পশুশিকার করে জীবিকানির্বাহ করত। অরণ্য ছিল আদিবাসীদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দে বসবাস করত।
বনাঞ্চলগুলির উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির দুটি কারণ উল্লেখ করো।
উনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকার ভারত উপনিবেশের বনাঞ্চলগুলির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়।
বনাঞ্চলগুলির উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির কারণ –
বনাঞ্চলগুলির উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির দুটি কারণ হল –
- ব্রিটিশ অর্থনীতির স্বার্থে ব্যবহার – বিশাল ও সম্পদপূর্ণ ভারতীয় বনভূমিকে ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণে এনে ব্রিটিশ অর্থনীতির স্বার্থে তা ব্যবহার করাই ছিল বনাঞ্চলগুলির উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
- যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে – ইউরোপে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জাহাজ নির্মাণের জন্য কাঠের জোগান সুনিশ্চিত করার তাগিদেই ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতীয় বনাঞ্চলগুলির উপর কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করে।
ব্রিটিশ সরকার অরণ্য সনদ (1855 খ্রিস্টাব্দ) -এর দ্বারা কী পদক্ষেপ নেয়?
ব্রিটিশ সরকার অরণ্য সনদ (1855 খ্রিস্টাব্দ) -এর দ্বারা পদক্ষেপ –
ব্রিটিশ সরকার ভারতের অরণ্যগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য অরণ্য সনদ ও ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি 1855 খ্রিস্টাব্দে অরণ্য সনদ জারি করেন। এর দ্বারা –
- ভারতের অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ ও কাঠের ব্যাবসার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- অরণ্যের মূল্যবান কাঠ, যেমন- শাল, সেগুন প্রভৃতি সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
ডেইট্রিক ব্রান্ডিস কে ছিলেন?
ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় অরণ্যগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য অরণ্য সনদ ও ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে।
ডেইট্রিক ব্রান্ডিসের ভূমিকা –
- ব্রিটিশ সরকার 1864 খ্রিস্টাব্দের 1 নভেম্বর বন বিভাগ গঠন করে। ডেইট্রিক ব্রান্ডিস নামে একজন জার্মানকে এই বিভাগের ইনস্পেকটর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
- ব্রান্ডিসের অধীনে এবং সহকারী হিসেবে ক্লেসোরার সহায়তায় ভারতে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত বন ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়।
ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন বলতে কী বোঝো?
ভারত ছিল ব্রিটিশ সরকারের একটি উপনিবেশ। ব্রিটিশ সরকার তার ভারত উপনিবেশের অরণ্যগুলির উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য অরণ্য সনদ ও ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে।
ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন –
ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন বলতে বোঝায় ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর চালু হওয়া অরণ্য আইনগুলিকে। এক্ষেত্রে দুটি আইনের কথা সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। যথা –
- 1865 খ্রিস্টাব্দের অরণ্য আইন এবং
- 1878 খ্রিস্টাব্দের অরণ্য আইন।
বলাবাহুল্য, আইন দুটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তোলে।
দিকু কাদের বলা হত?
দিকু শব্দের অর্থ প্রতারক বা প্রবঞ্চক। আদিবাসি-উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে ইংরেজদের আশ্রিত ও মদতপুষ্ট জমিদার, জোতদার, মহাজন, ঠিকাদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীদের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তাদের শোষণ ও নিপীড়নে উপজাতিদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। এই বহিরাগত মধ্যস্বত্বভোগীরাই আদিবাসিদের কাছে ‘দিকু’ নামে অভিহিত হত।
কবে দ্বিতীয় ভারতীয় অরণ্য আইন পাস হয়? এই আইনের দ্বারা কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়?
দ্বিতীয় ভারতীয় অরণ্য আইন –
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের শাসন কায়েম করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রকার আইন কার্যকর করেছিল – যার মধ্যে অন্যতম ছিল অরণ্য আইন। 1865 খ্রিস্টাব্দের অরণ্য আইনের সংশোধনীরূপে ঔপনিবেশিক সরকার ভারতে 1878 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে।
দ্বিতীয় ভারতীয় অরণ্য আইনের পদক্ষেপসমূহ –
দ্বিতীয় ভারতীয় অরণ্য আইনের দ্বারা –
- অরণ্য অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা – সংরক্ষিত, সুরক্ষিত এবং শ্রেণি বহির্ভূত অরণ্য।
- এই আইনের দ্বারা অরণ্য অঞ্চলের পরিচালনা, অরণ্য সম্পদের উপর ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়।
সংরক্ষিত অরণ্য কী?
ভারতের আদিম আদিবাসীরা অরণ্যের উপর দারুণভাবে নির্ভরশীল ছিল। অরণ্য ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দে বসবাস করত। উনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকার ভারত উপনিবেশের অরণ্যগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য অরণ্য সনদ ও ভারতীয় অরণ্য আইন পাস করে।
সংরক্ষিত অরণ্য –
- ভারতীয় অরণ্য অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার জন্য 1878 খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতীয় অরণ্য আইন’ প্রবর্তিত হয়। এই আইন অনুযায়ী অরণ্য অঞ্চলকে সংরক্ষিত, সুরক্ষিত এবং শ্রেণি বহির্ভূত অরণ্য – এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। সংরক্ষিত অরণ্যের উপর কোম্পানির পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
- সংরক্ষিত অরণ্য অঞ্চলে গাছ কাটা নিষিদ্ধ ছিল। এই অরণ্য থেকে উপজাতি গোষ্ঠী ব্যক্তিগতভাবে কাঠ জোগাড় করলেও সেই সমস্ত কাঠ বিক্রি করার অধিকার তাদের ছিল না।
1927 খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় অরণ্য আইন -এর দ্বারা সরকার কী কী পদক্ষেপ নেয়?
1927 খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় অরণ্য আইন পূর্ববর্তী অন্যান্য অরণ্য আইনগুলির মতোই ব্রিটিশ সরকারের অধীনে সম্পাদিত হয়েছিল।
1927 খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় অরণ্য আইন দ্বারা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ –
- ব্রিটিশ সরকার 1927 খ্রিস্টাব্দের অরণ্য আইন দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশের অরণ্যভূমিকে সংরক্ষিত, সুরক্ষিত ও গ্রামীণ – এই তিন ভাগে ভাগ করে।
- এই আইনে অরণ্যের ভিতরে কোন্ কাজগুলি নিষিদ্ধ এবং অরণ্য আইন ভঙ্গ করলে কী কী শাস্তি দেওয়া হবে তা উল্লেখ করা হয়।
ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন বলতে বোঝায় 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর চালু হওয়া অরণ্য আইনগুলিকে।
ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের উদ্দেশ্য –
- ভারতে রেলপথ নির্মাণের উদ্দেশ্যে রেলের স্লিপার তৈরির জন্য কাঠ সংগ্রহ করা।
- ইউরোপে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জাহাজ নির্মাণের জন্য কাঠের জোগান সুনিশ্চিত করা।
- বনাঞ্চল থেকে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
- অরণ্যগুলির উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করা।
বিদ্রোহ (Revolt) বলতে কী বোঝো?
বিদ্রোহ (Revolt) –
বিদ্রোহ হল প্রচলিত ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করা। প্রচলিত শাসনব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোকে সাধারণভাবে ‘বিদ্রোহ’ বলা হয়। প্রচলিত ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই বিদ্রোহ বলে চিহ্নিত হয়েছে, যথা – চুয়াড় বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ, পাবনা বিদ্রোহ প্রভৃতি।
অভ্যুত্থান (Uprising) বলতে কী বোঝো?
অভ্যুত্থান (Uprising) –
অভ্যুত্থান বলতে বোঝায় প্রচলিত শাসনব্যবস্থা বা শক্তির বিরুদ্ধে কোনো নতুন শক্তির উত্থানকে। অভ্যুত্থানকে এক অর্থে বিদ্রোহ বলা যেতে পারে। শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহ বা উত্থান হলে তাকে ‘গণ অভ্যুত্থান’ বলা হয়। আবার ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহকে ‘জাতীয় অভ্যুত্থান’ বলা হয়।
বিপ্লব (Revolution) বলতে কী বোঝায়?
বিপ্লব (Revolution) –
বিপ্লব বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার অতি দ্রুত ও কার্যকরী পরিবর্তন। যখন কোনো দেশে পুরাতনতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমনকি চিন্তার জগতে ব্যাপক ও সর্বাত্মক পরিবর্তন ঘটে, তখন তাকে ‘বিপ্লব’ বলে। যেমন – ফরাসি বিপ্লব।
কুদেতা (Coup de etat) কাকে বলে?
কুদেতা (Coup de etat) –
কুদেতা বা ‘Coup de etat’ বলতে বোঝায় ‘a sudden, violent and illegal overthrow of a government specially by military force’। বাংলায় একে সামরিক অভ্যুত্থান-ও বলে। এই জাতীয় ঘটনাকে কখনও কখনও ‘প্রাসাদ বিপ্লব’-ও বলা হয়। তবে একে প্রকৃত বিপ্লবের মর্যাদা দেওয়া যায় না।
জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তিতুমিরের সংঘাতের কারণ কী ছিল?
কৃষ্ণদেব রায়ের জমিদারি পুঁড়া গ্রামে তিতুমিরের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বিরুদ্ধে দরিদ্র হিন্দু ও মুসলিম কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে তিতুমির স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। পুঁড়া গ্রামে ওয়াহাবি মসজিদ নির্মাণ শুরু হলে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় মোটা অঙ্কের জরিমানা ধার্য করেন এবং ওয়াহাবিদের বিশেষ পরিচয় জ্ঞাপক দাড়ি রাখার উপর আড়াই টাকা কর ধার্য করেন। এই সকল কারণেই জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তিতুমির ও তাঁর অনুগামীদের সংঘাত চরমে ওঠে।
পঞ্চম আইন কবে পাস হয়? এই আইনে কী বলা হয়েছিল?
1830 খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক পঞ্চম আইন জারি করেন।
এই আইনে নীলকরদের সঙ্গে নীলচাষিদের চুক্তিভঙ্গ করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে চাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার আইনি বৈধতা পায়।
সরকার কোন্ কোন্ বছর ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট পাস করে? কী উদ্দেশ্যে এই আইন পাস হয়?
ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট –
ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় উপনিবেশে যথাক্রমে 1871 খ্রিস্টাব্দে, 1911 খ্রিস্টাব্দে ও 1924 খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট পাস করে।
ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট -এর উদ্দেশ্য –
ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে মূলত ভারতে আদিবাসী সম্প্রদায় যারা বিভিন্ন অনৈতিক কাজকর্মে যুক্ত এবং শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে তাদের উপযুক্ত শাস্তিপ্রদানের কথা বলা হয়।
দশম আইন কবে পাস হয়? এই আইনে কী বলা হয়েছিল?
দশম আইন –
1859 খ্রিস্টাব্দে দশম আইন পাস করা হয়েছিল।
দশম আইনে কৃষকদের জমির মালিকানা ও পাট্টা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে জমিদাররা এই আইন ফাঁকি দিয়ে কৃষককে জমি থেকে বল-পূর্বক উৎখাত করতে থাকলে কৃষকরা একজোট হয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিল।
ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় কৃষকদের কীভাবে শোষণ করত?
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় কৃষকদের নানাভাবে শোষণ করত –
- ইংরেজ কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করার পর কৃষকদের কাছ থেকে অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায় করতে থাকে।
- কোম্পানি জোর করে কৃষকদের নীল, তুলো, আফিম প্রভৃতি বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদন করতে বাধ্য করত। এ ছাড়া ব্রিটিশ সরকার কৃষক ও উপজাতি গোষ্ঠীর এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তাদের চিরাচরিত আইন ও বিচারব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়।
চুয়াড় কারা?
অথবা, কোন্ বিদ্রোহ চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত?
চুয়াড় –
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ধলভূম ও বর্তমান ঘাটশিলা অঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল অবস্থিত ছিল। এই জঙ্গলমহলের অধিকাংশ কৃষিজীবীদের ইংরেজ ও ইংরেজ সমর্থকরা চুয়াড় বলে অভিহিত করত।
চুয়াড় বিদ্রোহ –
- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই জঙ্গলমহল অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি করলে চুয়াড়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটি চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
- ঘাটশিলার জমিদার জগন্নাথ সিং ধলের নেতৃত্বে 1768 খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। 32 বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলেছিল।
পাইক কাদের বলা হত? পাইকান জমি কী?
পাইক –
চুয়াড়রা মূলত মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও ধলভূম অঞ্চল নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার জঙ্গলমহল বনাঞ্চলের অধিবাসী। কৃষিকাজ ও পশুশিকারের পাশাপাশি এরা স্থানীয় জমিদারদের অধীনে সৈনিক বা পাইক -এর কাজ করত বলে, এদের ‘পাইক’ বলা হত।
পাইকান জমি –
জমিদারদের অধীনে যারা সৈনিকের কাজ বা পাইক-বরকন্দাজের কাজ করত তাদেরকে যে জমি জমিদারেরা নিঃশুল্কে ভোগদখলের জন্য দিতেন সেই জমিগুলিকে বলা হত ‘পাইকান জমি’।
ধর্মীয় ভাবাবেগ আদিবাসী-উপজাতি বিদ্রোহগুলিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ধর্মীয় ভাবাবেগ আদিবাসী-উপজাতি বিদ্রোহগুলিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। একদিকে যেমন খ্রিস্টান মিশনারিদের বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আদিবাসী-উপজাতি জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, অন্যদিকে আদিবাসী-উপজাতি জনগোষ্ঠীর নেতারা সুকৌশলে ধর্মীয় প্রতীক বা ভাবাবেগকে আন্দোলনের সাথে যুক্ত তার গণভিত্তি সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিধু-কানু, বিরসা মুন্ডা প্রমুখ আদিবাসী নেতারা বিদ্রোহ সংগঠিত করতে ‘ঈশ্বরের স্বপ্নাদেশ’-কে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে মুসলিম সমাজের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও তাদের নেতাদের নাম লেখো।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে মুসলিম সমাজের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হল ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন।
- ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা – সৈয়দ আহমেদ, এনায়েত আলি, তিতুমির প্রমুখ।
- ফরাজি আন্দোলনের নেতা – হাজি শরিয়ত উল্লাহ্, মহম্মদ মুসিন বা দুদু মিঞা, নোয়ামিঞা প্রমুখ।
ভাগনাডিহির মাঠে কী ঘটেছিল?
1855 খ্রিস্টাব্দের 30 জুন সিধু, কানুর নেতৃত্বে দশ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে সমবেত হন এবং তারা অত্যাচারী বহিরাগত জমিদার ও ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামের শপথ নেয়। বস্তুতপক্ষে ভাগনাডিহির এই সমাবেশের মধ্য দিয়েই সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়।
চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে 1798-1799 খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর এলাকায় চুয়াড় বিদ্রোহ হয়েছিল।
চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ –
- উচ্চহারে রাজস্ব আদায় – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মেদিনীপুর এলাকায় রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করার পর উচ্চহারে রাজস্ব আদায় করতে শুরু করে। এর ফলে এই অঞ্চলের জমিদার ও কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়।
- সূর্যাস্ত আইন – 1793 খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলস্বরূপ প্রবর্তিত সূর্যাস্ত আইনের প্রয়োগের দ্বারা অনেক জমিদারের জমিদারি হাতছাড়া হয়েছিল। এর ফলে তারা বিদ্রোহ করেছিল।
চুয়াড় বিদ্রোহ কয়টি পর্বে হয়েছিল ও কী কী?
ব্রিটিশ কোম্পানির আমলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ধলভূম ও বর্তমান ঘাটশিলা অঞ্চল নিয়ে গঠিত জঙ্গলমহল অঞ্চলের আদিবাসী চুয়াড়রা ব্রিটিশ কোম্পানির বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল, তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
চুয়াড় বিদ্রোহের বিভিন্ন স্তর –
এই বিদ্রোহের দুটি পর্যায় ছিল –
- প্রথম পর্ব – প্রথম পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ হয় 1768 খ্রিস্টাব্দে। ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিং ধল প্রথম চুয়াড়দের নিয়ে খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করেন।
- দ্বিতীয় পর্ব – 1798 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে মেদিনীপুরের রাইপুর পরগনায়। এই বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন রাইপুরের জমিদার দুর্জন সিং।
দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ কবে হয়? পাইক চুয়াড়রা কেন এই বিদ্রোহ করেছিল?
দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহ –
দ্বিতীয় পর্বে বিদ্রোহ ঘটেছিল 1798 থেকে 1799 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বাঁকুড় জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম এবং মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিম অংশের চুয়াড় আদিবাসীরা এই বিদ্রোহ শুরু করে।
দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ –
জমিদারদের জমি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করলে তাদের পাইকান জমিগুলিও হাতছাড়া হয়ে যাবে, এই আশঙ্কায় পাইক চুয়াড়রাও বিদ্রোহ করেছিল।
দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহে জঙ্গলমহলের কোন্ কোন্ অঞ্চল উত্তাল হয়েছিল? এই পর্বের বিদ্রোহে কারা নেতৃত্ব দেন?
দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের অঞ্চলসমূহ –
দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহে জঙ্গলমহলের নারায়ণগড়, রায়পুর, বাসুদেবপুর, তমলুক, জলেশ্বর, বলরামপুর, রামগড়, শালবনি ও মেদিনীপুর পরগনা উত্তাল হয়েছিল।
দ্বিতীয় পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ –
এই পর্বের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন – দুর্জন সিং, মাধব সিং, গোবর্ধন দিকপতি, মোহনলাল, লাল সিং, অচল সিং প্রমুখ।
চুয়াড় বিদ্রোহের অবসান হয় কীভাবে?
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে 1798-1799 খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর এলাকায় চুয়াড় বিদ্রোহ হয়েছিল।
চুয়াড় বিদ্রোহের অবসান –
- ব্রিটিশ সরকার চুয়াড় বিদ্রোহ দমনের জন্য বিভিন্ন কূটকৌশল প্রয়োগ করে। তারা বিভেদনীতি প্রয়োগ করে চুয়াড় সর্দার ও পাইকদের পুলিশের কাজে নিযুক্ত করে বিদ্রোহীদের নিস্তেজ করে দেয়।
- বিদ্রোহী চুয়াড়দের চুয়াড় সর্দারদের অধীনে রাখা হয়। এ ছাড়া অর্থের দ্বারা স্বাধীন চুয়াড়দের ক্রয় করে ব্রিটিশ সরকার চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করে। এইভাবে বিদ্রোহের অবসান হয়।
চুয়াড় বিদ্রোহের ফলাফল কী হয়েছিল?
চুয়াড় বিদ্রোহের ফলাফল –
চুয়াড় বিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। যথা –
- বিদ্রোহী জমিদারদের সঙ্গে সরকারের আপস – ব্রিটিশ সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্যে চুয়াড় বিদ্রোহ দমন করতে না পেরে বিদ্রোহী জমিদারদের সঙ্গে আপস করেছিল।
- জঙ্গলমহল জেলা গঠন – ব্রিটিশ সরকার চুয়াড় বিদ্রোহ প্রভাবিত এলাকাগুলিকে নিয়ে 1805 খ্রিস্টাব্দে 18 নং রেগুলেশন জারি করে ‘জঙ্গলমহল’ জেলা গঠন করে। বাঁকুড়াকে জঙ্গলমহল জেলার সদর দপ্তর করা হয়।
কোল বিদ্রোহের (1831-1832 খ্রিস্টাব্দ) কারণ কী?
ছোটোনাগপুর অঞ্চলের কোলরা 1831-1832 খ্রিস্টাব্দে জমিদার, মহাজন ও অত্যাচারী ইংরেজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
কোল বিদ্রোহের কারণ –
- অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় – ছোটোনাগপুর অঞ্চলের ইজারাদাররা অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায় করত। তারা কোলদের উপর অত্যাচার করত এবং তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিত।
- কোলদের উপর ব্রিটিশ আইনের প্রয়োগ – ব্রিটিশ সরকার কোলদের উপর ব্রিটিশ শাসন, বিচার ও রাজস্ব সংক্রান্ত আইনকানুন প্রবর্তন করে। এর ফলে কোলদের সমাজব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয় ও তারা ক্ষুব্ধ হয়।
কোল বিদ্রোহের বিস্তার কীভাবে হয়? এই বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
কোল বিদ্রোহের বিস্তার –
1820 খ্রিস্টাব্দে বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলে কোলরা প্রথম বিদ্রোহ করে। 1831 খ্রিস্টাব্দে সেই বিদ্রোহের বিস্তার ঘটে রাঁচি জেলার মুন্ডা ও ওঁরাও সম্প্রদায়ের মধ্যে। এরপর বিদ্রোহ মানভূম, সিংভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ ইত্যাদি অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
কোল বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ –
কোল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ হলেন বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা, সিংরাই মানকি, ঝিন্দরাই মানকি প্রমুখ।
কোল বিদ্রোহীদের পদক্ষেপগুলি কী ছিল?
বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী কোলরা ইংরেজ, মহাজন বা বহিরাগত ‘দিকু’দের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিল, তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
কোল বিদ্রোহীদের বিভিন্ন পদক্ষেপ –
- কোলদের উপর শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদে তারা বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত প্রমুখের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হতে থাকে।
- 1831 খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলার মুন্ডা ও ওঁরাও সম্প্রদায়ের কৃষকরা সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কোল বিদ্রোহীরা তিরধনুক, কুড়ুল প্রভৃতির সাহায্যে ইংরেজদের মোকাবিলা করেছিল। জোতদার, জমিদার, মহাজনদের বাড়িতে বিদ্রোহীরা অগ্নিসংযোগ করে তাদের হত্যা করে।
কীভাবে কোল বিদ্রোহ দমন করা হয়?
1820 খ্রিস্টাব্দে কোল উপজাতি সম্প্রদায় ইংরেজ, মহাজন বা বহিরাগত ‘দিকু’দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে, যা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। প্রবল সাহসিকতার সঙ্গে তারা জোতদার, জমিদার, ইংরেজদের মুখোমুখি হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।
কোল বিদ্রোহের দমন –
- কোল বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংরেজরা কলকাতা, পাটনা, দানাপুর ও সম্বলপুর থেকে সৈন্য এনেছিল।
- আধুনিক অস্ত্র এবং গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে হাজার হাজার কোল নরনারী ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করে 1833 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কোল বিদ্রোহ দমন করেছিল।
কোল বিদ্রোহের দুটি গুরুত্ব লেখো।
কোল বিদ্রোহের গুরুত্ব –
কোল বিদ্রোহের দুটি গুরুত্ব হল –
- কোল বিদ্রোহের শেষে সরকার ছোটোনাগপুর অঞ্চলকে পৃথক ‘সীমান্ত রাজ্য’ বলে ঘোষণা করে সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
- কোল অধ্যুষিত অঞ্চলে জমি জরিপ করে ভূমি বন্দোবস্ত করা হয়।
দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি বলতে কী বোঝো?
কোলরা হল বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী এক উপজাতি গোষ্ঠী। তারা ইংরেজ, মহাজন বা বহিরাগত ‘দিকু’দের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিল, তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1820 খ্রিস্টাব্দে কোলরা প্রথম বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদুরপ্রসারী।
দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি –
- কোল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশ সরকার ছোটোনাগপুর অঞ্চলে ‘দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি’ নামে একটি নতুন অঞ্চল গঠন করে।
- ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলে জমিদারদের হাত থেকে জমি গ্রামর প্রধানদের হাতে ফেরত দেওয়ার এবং ব্রিটিশ আইনকানুন কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
চুয়াড় ও কোল বিদ্রোহের দুটি পার্থক্য লেখো।
চুয়াড় ও কোল বিদ্রোহের দুটি পার্থক্য –
চুয়াড় ও কোল বিদ্রোহের দুটি পার্থক্য হল –
- চুয়াড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে; কিন্তু কোল বিদ্রোহ হয়েছিল বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।
- চুয়াড় বিদ্রোহীদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ইংরেজরা এবং কোল বিদ্রোহীদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল জমিদার ও মহাজনরা।
সাঁওতাল কারা? সাঁওতাল বিদ্রোহ কোথায় কোথায় ছড়িয়ে পড়েছিল?
সাঁওতাল –
সাঁওতালরা হল কঠোর পরিশ্রমী, শান্তিপ্রিয় এক কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়। সাঁওতালরা বীরভূম, মানভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মুরশিদাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করত। ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব নীতির চাপে তারা রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশে বনভূমি পরিষ্কার করে বসবাস ও চাষবাস শুরু করে। সাঁওতালরা বিভিন্ন কারণে 1855 খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের বিস্তার –
1855 খ্রিস্টাব্দের 30 জুন ভগনাডিহির মাঠে 10 হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে সিধু ও কানুর নেতৃত্বে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। সেখান থেকে এই বিদ্রোহ মেদিনীপুর, বীরভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, ছোটোনাগপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
এলাকাচাষ ও বে-এলাকাচাষ কী?
নীলকর সাহেবরা এদেশে নীল চাষের ক্ষেত্রে উক্ত দুটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। নীলকরের নিজের জমিতে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নীলচাষ ‘এলাকাচাষ’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে, কৃষকের জমিতে দাঁদন প্রদানের মাধ্যমে নীলচাষ ‘বে-এলাকাচাষ’ নামে পরিচিত।
তবে ‘বে-এলাকাচাষ’ নীলকরের পক্ষে বেশি লাভজনক হওয়ায় তারা কৃষককে বলপূর্বক এই চাষে বাধ্য করত।
জমিজমার ব্যাপারে সাঁওতালরা কী বিশ্বাস করত?
জমি সংক্রান্ত বিষয়ে সাঁওতালদের বিশ্বাস –
সাঁওতালরা বিশ্বাস করত যে, জমিতে সর্বপ্রথম যারা পরিশ্রম করে ফসল ফলাবে সেই জমি তাদেরই প্রাপ্য। এই নিয়ম অনুসারেই তারা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, মানভূম, ছোটোনাগপুরের জমির উপর অধিকার ভোগ করত। ইংরেজদের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সাঁওতালদের চিরাচরিত এই বিশ্বাসের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দেয়।
দামিন-ই-কোহ কী?
দামিন-ই-কোহ –
‘দামিন-ই-কোহ’ কথার অর্থ হল পাহাড়ের প্রান্তদেশ। সাঁওতালরা বিভিন্ন কারণে নিজেদের এলাকা ছেড়ে রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশে বসবাস শুরু করেছিল। তারা বহু পরিশ্রম করে এখানের জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষযোগ্য ও বাসযোগ্য জমি তৈরি করেছিল। সাঁওতালদের এই নতুন অঞ্চলকেই বলা হয় ‘দামিন-ই-কোহ’।
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?
দামিন-ই-কোহ বলে পরিচিত রাজমহল পাহাড়সংলগ্ন এলাকার সাঁওতালরা 1855 খ্রিস্টাব্দে জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ –
- অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায় – সাঁওতালদের এলাকায় 18 বছরের মধ্যে 10 গুণ রাজস্ব বৃদ্ধি করা হয়েছিল। অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করার জন্য সাঁওতালরা ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
- মহাজনদের শোষণ – মহাজনরা সাঁওতালদের ঋণ দিয়ে 50%-500% পর্যন্ত সুদ আদায় করত। অতিরিক্ত সুদ ও নানা রকমভাবে শোষণের ফলে সাঁওতালরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এ ছাড়া বহিরাগত ব্যবসায়ীদের প্রতারণা, রেলকর্মী ও ঠিকাদারদের অত্যাচার, খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা সাঁওতালদের ধর্মান্তরিতকরণের প্রচেষ্টা সাঁওতাল বিদ্রোহকে ত্বরান্বিত করেছিল।
কেনারাম ও বেচারাম কী?
দামিন-ই-কোহ অঞ্চলে বহিরাগত ব্যবসায়ীরা দুই ধরনের বাটখারা ব্যবহার করত।
কেনারাম –
ব্যবসায়ীরা যখন সাঁওতালদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনত তখন বেশি ওজনের বাটখারা ব্যবহার করত। এই বেশি ওজনের বাটখারা কেনারাম নামে পরিচিত ছিল।
বেচারাম –
আবার ব্যবসায়ীরা যখন সাঁওতালদের লবণ, চিনি প্রভৃতি পণ্য বিক্রয় করত, তখন কম ওজনের বাটখারা ব্যবহার করত। এই কম ওজনের বাটখারাকে বলা হত বেচারাম।
কামিয়াতি ও হারওয়াহি কী?
কামিয়াতি ও ‘হারওয়াহি’ হল দুই প্রকারের চুক্তি বা বন্ড, যা ঋণদাতা মহাজন ও ঋণগ্রহীতা সাঁওতালদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়।
কামিয়াতি –
কামিয়াতি চুক্তি হল ঋণগ্রহীতা যতদিন না ঋণশোধ করতে পারবে ততদিন তাকে মহাজনের জমিতে বেগার খাটতে হবে।
হারওয়াহি –
হারওয়াহি চুক্তি হল ঋণগ্রহীতাকে মহাজনের জমিতে বিনা পারিশ্রমিকে লাঙল দিতে হবে। আর 33 শতাংশ সুদ-সহ ঋণশোধ করতে হবে।
দাঁদন কী?
দাঁদন –
দাঁদন শব্দের অর্থ অগ্রিম। নীলকররা নিজের জমিতে নীলচাষ (এলাকাচাষ) অপেক্ষা কৃষকের জমিতে নীলচাষ (বে-এলাকাচাষ) বেশি লাভজনক মনে করে তাদের বলপূর্বক বিঘা প্রতি মাত্র দুই টাকা দাঁদন গ্রহণের বিনিময়ে নীলচাষে বাধ্য করত। এক্ষেত্রে কৃষক তার উৎপাদিত নীল বিনা লাভে নীলকরদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হত।
ভগনাডিহির মাঠ স্মরণীয় কেন?
দামিন-ই-কোহ বলে পরিচিত রাজমহল পাহাড়সংলগ্ন এলাকার সাঁওতালরা 1855 খ্রিস্টাব্দে জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, যা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
ভগনাডিহি মাঠের ভূমিকা –
সাঁওতালরা মহাজন, জমিদার ও সরকারি কর্মচারীদের মিলিত শোষণ ও অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ হয়ে 1855 খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। 1855 খ্রিস্টাব্দের 30 জুন ভগনাডিহির মাঠে 10 হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে সিধু ও কানুর নেতৃত্বে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। প্রকৃতপক্ষে ভগনাডিহির মাঠ থেকেই সাঁওতালরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তাই সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসে ভগনাডিহির মাঠ বিশেষভাবে স্মরণীয়।
খেরওয়ার আন্দোলন বলতে কী বোঝো?
1855-1856 খ্রিস্টাব্দে ‘দামিন-ই-কোহ’ অঞ্চলে সাঁওতালরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, কালক্রমে তা বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। 1855 খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহের পর 1870 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয় খেরওয়ার আন্দোলন।
খেরওয়ার আন্দোলন –
- খেরওয়ার ছিল মূলত সাঁওতালদের একটি ধর্মীয় আন্দোলন। ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও অচিরেই এটি একটি কৃষক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।
- এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সাঁওতালদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি এবং স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করা।
ডহর কথার অর্থ কী? সিধু-কানু ডহর কোথায় আছে?
ডহর কথার অর্থ –
সাঁওতালি ভাষায় ‘ডহর’ কথার অর্থ হল ‘খোলা বা উন্মুক্ত চত্বর’।
সাঁওতাল বিদ্রোহের দুই প্রধান নেতা সিধু ও কানু-র স্মরণে কলকাতার এসপ্ল্যানেড বা ধর্মতলার একাংশের নামকরণ করা হয়েছে সিধু-কানু ডহর।
সাঁওতাল বিদ্রোহে বিদ্রোহীরা কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়?
1855-1856 খ্রিস্টাব্দে ‘দামিন-ই-কোহ’ অঞ্চলে সাঁওতালরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ বীরভূম, বাঁকুড়া, মানভূম
অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহীদের পদক্ষেপ –
- 1855 খ্রিস্টাব্দের 30 জুন ভগনাডিহির মাঠে 10 হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে সিধু ও কানুর নেতৃত্বে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে।
- আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লাঠি, বল্লম, তিরধনুক নিয়ে সাঁওতালরা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে।
- বিদ্রোহীরা বহু নীলকুঠি ও রেলবাংলো ধ্বংস এবং অত্যাচারী জমিদার ও মহাজনদের হত্যা করেছিল।
কীভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের অবসান হয়?
ব্রিটিশ আমলে সংঘটিত উপজাতি বিদ্রোহগুলির মধ্যে সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সাঁওতাল বিদ্রোহের অবসান –
- আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লাঠি, টাঙ্গি, বল্লম, তিরধনুক নিয়ে যুদ্ধ করে শেষপর্যন্ত সাঁওতালরা পরাজিত হয়েছিল।
- প্রায় 23 হাজার বিদ্রোহীকে ইংরেজ সৈন্য নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ইংরেজরা সিধু, কানু-সহ অন্যান্য বীর সাঁওতাল নেতাদের ফাঁসি দিয়েছিল, অনেক বিদ্রোহীদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল এবং তাদের গ্রামগুলি ধ্বংস করে দিয়েছিল। এভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের অবসান হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল কী হয়েছিল?
অথবা, সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ছিল?
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল বা গুরুত্ব –
1855 খ্রিস্টাদে সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল। তবে এই বিদ্রোহের ফলে –
- সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন – সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ করকার সাঁওতাল এলাকাগুলি নিয়ে সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করে।
- মহাজনদের শোষণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি – ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের এলাকায় ‘দিকু’ মহাজনদের বসবাস নিষিদ্ধ করে। মহাজনদের সুদের হারও নির্দিষ্ট করে দেয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি কী ছিল?
সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি –
1855 খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। কৃষিজীবী সাঁওতালরা তাদের উপর অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এই আন্দোলনে সাঁওতাল ছাড়াও অন্যান্য দরিদ্র কৃষকরাও যোগদান করে। সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে কৃষিজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রাম।
মুন্ডা কারা? খুৎকাঠি প্রথা কী?
মুন্ডা –
বর্তমান ছোটোনাগপুরের রাঁচি ও সিংভূম অঞ্চলে যে আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করত, তারা মুন্ডা নামে পরিচিত। 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ও অত্যাচারী দিকুদের বিরুদ্ধে মুন্ডারা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা মুন্ডা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
খুৎকাঠি প্রথা –
‘খুৎকাঠি প্রথা’ কথার অর্থ হল যৌথ কৃষিব্যবস্থা। মুন্ডারা বহুকাল ধরে জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিকাজ করত এবং জমির যৌথ মালিকানা ভোগ করত। ব্রিটিশ আমলে তাদের যৌথ কৃষিব্যবস্থা বা ‘খুৎকাঠি প্রথা’-র অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা চালু করায় মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।
মুন্ডা উলগুলান কী?
মুন্ডা উলগুলান –
আদিবাসীদের ব্যবহৃত শব্দ ‘উলগুলান’ কথার অর্থ বিরাট তোলপাড় বা বড়ো আলোড়ন। ভারতে উপজাতীয় কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসের অন্যতম বড়ো ঘটনা ছিল 1899-1900 খ্রিস্টাব্দ সময়পর্বে রাঁচিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত মুন্ডা উলগুলান বা মুন্ডা বিদ্রোহ।
মুন্ডাদের উপর জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ কর্মচারীদের শোষণ ও অত্যাচারের ফলে উলগুলান শুরু হয়েছিল। বিরসা মুন্ডার মৃত্যুর পর এই উলগুলানের অবসান ঘটে।
মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?
1899-1900 খ্রিস্টাব্দে রাঁচি, সিংভূম অঞ্চলে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ হয়েছিল।
মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ –
- যৌথ কৃষিব্যবস্থায় ভাঙন – মুন্ডারা জঙ্গল পরিষ্কার করে যৌথভাবে কৃষিকাজ করত। ব্রিটিশ সরকারের ভূমিরাজস্ব নীতির ফলে তাদের এই ব্যবস্থা ভেঙে যায়।
- বেগার খাটানো – জমিদার, মহাজনরা মুন্ডাদের বিনা মজুরিতে বেগার খাটাত। এর ফলে তারা ক্ষুব্ধ হয়।
মুন্ডা বিদ্রোহের সামাজিক ব্যবস্থা কীভাবে দায়ী?
মুন্ডা বিদ্রোহের সামাজিক ব্যবস্থার দায়িত্ব –
মুন্ডারা 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের জন্য সামাজিক ব্যবস্থা নানাভাবে দায়ী ছিল। যেমন –
- খুৎকাঠি প্রথার অবসান – মুন্ডারা জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিকাজ করত। ব্রিটিশ আমলে তাদের যৌথ কৃষিব্যবস্থা বা খুৎকাঠি প্রথার অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যবস্থা চালু করায় মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।
- ব্রিটিশ আইন বলবৎ – মুন্ডারা তাদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত হত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুন্ডাদের উপর ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রয়োগ করলে মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয় ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
খ্রিস্টানদের জন্য মুন্ডাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন কীভাবে বিপন্ন হয়েছিল?
খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব –
খ্রিস্টান মিশনারি ও বহিরাগতদের আগমনের জন্য মুন্ডাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন নানাভাবে বিঘ্নিত হয়। মুন্ডাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রচার শুরু হলে তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক ধর্মের উপাসনা অনেকাংশে কমে যায়। এ ছাড়াও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে মুন্ডাদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বেশ কিছু ধ্যানধারণাগত পরিবর্তন ঘটে।
মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল?
মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য –
অরণ্যবাসী মুন্ডাদের বিদ্রোহের পিছনে প্রধান লক্ষ্য ছিল নিম্নরূপ –
- দিকুদের বিতাড়ন – বহিরাগত ‘দিকু’ ও ঠিকাদার শ্রেণির লোকেরা অর্থ উপার্জনের জন্য মুন্ডাদের এলাকায় মাদক দ্রব্য বিক্রি শুরু করে। এতে মুন্ডাদের চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটলে তারা এই ‘দিকু’দের বিতাড়নের জন্য সোচ্চার হয় ও বিদ্রোহ করে।
- ব্রিটিশ শাসনের অবসান – ব্রিটিশ আমলে মুন্ডাদের যৌথ কৃষি বা খুৎকাঠি প্রথায় ভাঙন ধরে। সরকার জমিতে ব্যক্তিগত কৃষিব্যবস্থা চালু করলে এবং ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন (1878 খ্রিস্টাব্দ) দ্বারা মুন্ডাদের থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিলে মুন্ডারা এই শাসনের অবসানের জন্য বিদ্রোহ করে।
বিরসা মুন্ডার নতুন ধর্মমত সম্পর্কে কী জানো?
1899-1900 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিলেন বিরসা মুন্ডা।
বিরসা মুন্ডার নতুন ধর্মমত –
বিরসা মুন্ডা এক নতুন ধর্ম দর্শনের উদ্ভাবন করতে গিয়ে নিজেকে ধরতি আবা বা ধরণীর পিতা বলে ঘোষণা করেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল স্বাধীন মুন্ডারাজ্য প্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিদেশিদের বহিষ্কার ও খাজনা বন্ধের আহ্বান জানান।
বিদ্রোহের পর ‘বিরসা সম্প্রদায়’ নামে একটি মুন্ডাগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা বিরসা মুন্ডাকে ভগবানের মতো সম্মান করত।
মুন্ডা বিদ্রোহ শুরু করার জন্য বিরসা কী ধরনের সামরিক প্রস্তুতি নেন?
1899-1900 খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা মুন্ডা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
মুন্ডা বিদ্রোহ শুরু করার জন্য বিরসার সামরিক প্রস্তুতি –
- প্রায় 6000 মুন্ডাকে নিয়ে বিরসা মুন্ডা একটি সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর গয়া মুন্ডা সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
- বিরসা মুন্ডা ও তাঁর অনুচরেরা 1899 খ্রিস্টাব্দের 24 ডিসেম্বর রাঁচি ও সিংভূম জেলায় গির্জা, থানা, অফিস আক্রমণ করে ধ্বংস করেন।
মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ছিল?
1899-1900 খ্রিস্টাব্দে রাঁচি, সিংভূম অঞ্চলে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল।
মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব –
মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল লক্ষণীয় –
- প্রজাস্বত্ব আইন পাস – মুন্ডা বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের সমস্যাসমাধানের জন্য ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন, 1908 পাস করে।
- বেগার প্রথার অবসান – ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের বেগার খাটানোর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে জমিদার এবং মহাজনদের শোষণ থেকে মুন্ডারা রেহাই পায়।
রংপুর বিদ্রোহ কবে, কাদের মধ্যে হয়? ‘ডিং খরচা’ কী?
রংপুর বিদ্রোহ –
পূর্ণিয়ার অত্যাচারী ইজারাদার দেবী সিংহের বিরুদ্ধে 1783 খ্রিস্টাব্দে নুরুলউদ্দিনের নির্দেশে রংপুরের হিন্দু ও মুসলমান কৃষকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
ডিং খরচা –
1783 খ্রিস্টাব্দে রংপুর বিদ্রোহ চলাকালে বিদ্রোহীরা নুরুলউদ্দিনকে ‘নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করে সরকার পরিচালনা ও বিদ্রোহ চালানোর জন্য তাঁকে যে কর প্রদান করে, তা ডিং খরচা নামে পরিচিত।
রংপুরের কৃষকদের উপর কীরূপ শোষণ চলত?
অথবা, রংপুর বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?
1783 খ্রিস্টাব্দে বাংলার রংপুরের কৃষকরা ইজারাদার দেবী সিংহের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা রংপুর বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
রংপুর বিদ্রোহের কারণ –
রংপুর বিদ্রোহের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –
- রংপুরের ইজারাদার দেবী সিংহ স্থানীয় জমিদার ও কৃষকদের উপর অত্যধিক হারে রাজস্ব ধার্য করলে প্রজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
- নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব দিতে না পারার জন্য অনেক জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
- দরিদ্র কৃষকরা রাজস্ব দেওয়ার জন্য বা বিভিন্ন প্রয়োজনে মহাজনের কাছে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে বাধ্য হত এবং মহাজনরাও এই সুযোগে কৃষকদের চরম শোষণ করত ফলে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
রংপুর বিদ্রোহের স্বাধীন সরকার সম্পর্কে কী জানো?
পূর্ণিয়ার অত্যাচারী ইজারাদার দেবী সিংহের বিরুদ্ধে 1783 খ্রিস্টাব্দে নুরুলউদ্দিনের নির্দেশে রংপুরের হিন্দু ও মুসলমান কৃষকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
রংপুর বিদ্রোহের স্বাধীন সরকার –
1783 খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ শুরু হলে রংপুরের বিদ্রোহীরা একটি স্বাধীন সরকার গঠন করে। বিদ্রোহীরা তাদের মধ্য থেকে নুরুলউদ্দিনকে ‘নবাব’ এবং দয়ারাম শীল নামে অপর এক ব্যক্তিকে ‘নবাবের দেওয়ান’ রূপে ঘোষণা করে। এভাবে হিন্দু-মুসলিম সকল কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে।
ভিল কারা?
ভিল –
ভারতবর্ষের একটি প্রাচীনতম আদিবাসী সম্প্রদায় হল ভিল। গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের খান্দেশ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এই আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করত। এরা স্বাধীন ও স্বনির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। ভিলরা বিভিন্ন কারণে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, যা ভিল বিদ্রোহ নামে ইতিহাসখ্যাত।
ভিল বিদ্রোহের কারণ কী?
মধ্য ও পশ্চিম ভারতের আদিবাসী ভিলরা 1819 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটি ভিল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
ভিল বিদ্রোহের কারণ –
ভিল বিদ্রোহের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –
- মহাজনদের অত্যাচার – মাড়োয়ারি মহাজনরা ভিলদের কাছ থেকে অত্যন্ত চড়া হারে সুদ আদায় করত ও তাদের সর্বস্বান্ত করত। ফলে তারা ক্ষুব্ধ হয়।
- খান্দেশ দখল – ইংরেজরা 1818 খ্রিস্টাব্দে খান্দেশ অধিকার করে এবং তাদের নিয়মকানুন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ভিলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের নামকরণের তাৎপর্য লেখো।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের নামকরণের তাৎপর্য –
মুঘল যুগের শেষদিকে ভারতের বিভিন্ন ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায় বাংলা ও বিহারের নানা অংশে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। গিরি ও দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী এবং মাদারি সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিরদের উপর ব্রিটিশ কোম্পানি নানাভাবে অত্যাচার করত। ব্রিটিশ সরকার বিভিন্নভাবে এই সন্ন্যাসী ও ফকিরদের স্বার্থ বিঘ্নিত করেছিল। এর ফলে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের জীবননির্বাহ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ায় এটি সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে সুপরিচিত।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ লেখো।
1763 খ্রিস্টাব্দে বাংলার সন্ন্যাসী-ফকিররা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ –
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –
- অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় – বাংলায় ব্রিটিশ সরকারের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চালু হলে কৃষিজীবী সন্ন্যাসী-ফকিরদের কাছ থেকেও অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা শুরু হয়।
- তীর্থকর – সন্ন্যাসী-ফকিররা মাঝে মাঝে দলবদ্ধভাবে নিজ নিজ তীর্থক্ষেত্রে তীর্থ করতে যেত। ব্রিটিশ সরকার তাদের উপর তীর্থকর আরোপ করলে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ কবে, কোথায় হয়? এই বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
1763-1800 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অনুষ্ঠিত সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল ছিল সমগ্র বঙ্গদেশ ও বিহার প্রদেশ।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ –
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য নেতৃবর্গ হলেন মজনু শাহ, মুসা শাহ, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, চিরাগ আলি প্রমুখ।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহে মজনু শাহ ও মুসা শাহ – এর অবদান কী?
মজনু শাহ ও মুসা শাহ -এর অবদান –
1770 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ অঞ্চলে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহে উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মজনু শাহ ও তাঁর ভ্রাতা মুসা শাহ।
ম্যাজিস্ট্রেট হ্যামিলটন -এর বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। নাটোরের জমিদার রানি ভবানী-সহ বিভিন্ন ধনী জমিদারদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেও ব্যর্থ হয়ে মজনু শাহ অনেক কষ্টে লড়াই চালিয়ে যান। 1773 খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর মুসা শাহ বিদ্রোহ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থ হল কেন?
1763-1800 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সন্ন্যাসী ও ফকিররা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছিল, তা ইতিহাসে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ –
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণগুলি হল নিম্নরূপ –
- 1766 খ্রিস্টাব্দ থেকে সন্ন্যাসী-ফকিরদের মধ্যে আত্মকলহের ফলে বিদ্রোহীরা দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
- মজনু শাহ, ভবানী পাঠকদের মতো নেতারা পরাজিত ও নিহত হলে উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে এই বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।
- উন্নত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও সাংগঠনিক শক্তির অভাবে তারা ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারলে এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ছিল?
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের গুরুত্ব –
বাংলার সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (1763-1800 খ্রিস্টাব্দ) ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
- প্রথম ভারতীয় বিদ্রোহ – সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ছিল কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রথম বিদ্রোহ।
- পরবর্তী বিদ্রোহের উপর প্রভাব – সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও পরবর্তী ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহগুলিকে তা প্রভাবিত করেছিল। বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও প্রেরণা জুগিয়েছিল।
ওয়াহাবি কাদের বলা হয়? ওয়াহাবি আন্দোলনের আসল নাম কী?
ওয়াহাবি –
ওয়াহাবি ছিল মুসলমানদের একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর প্রবর্তক ছিলেন আরবের আবদুল ওয়াহাব। তাঁর অনুগামীদের বলা হত ‘ওয়াহাবি’।
ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম –
ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম তারিকা-ই-মহম্মদীয়া অর্থাৎ মহম্মদ প্রদর্শিত পথ।
ওয়াহাবি কথাটির অর্থ কী? ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা কীভাবে হয়?
ওয়াহাবি কথাটির অর্থ –
ওয়াহাবি কথার অর্থ হল নবজাগরণ।
ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা –
আরবে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন আবদুল ওয়াহাব। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। তাঁর মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন তিতুমির।
সৈয়দ আহমদ কে ছিলেন? ওয়াহাবি আন্দোলন ভারতের কোন্ কোন্ অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল?
সৈয়দ আহমদ –
ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমদ। তিনি ইসলাম ধর্মের মধ্যে ‘শুদ্ধিকরণ’ আন্দোলন শুরু করেন। তিনি তাঁর গুরু আজিজের মতো ঘোষণা করেন যে, ইংরেজ-শাসিত ভারত হল ‘দার-উল-হারব’। সুতরাং ইংরেজদের উচ্ছেদ করে একে ‘দার-উল-ইসলাম’ বা ধর্মরাজ্যে পরিণত করতে হবে।
ওয়াহাবি আন্দোলনের বিস্তার –
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল অন্যতম। ভারতে এই আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছিল পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বাংলা, মাদ্রাজ প্রভৃতি অঞ্চলে।
তারিকা-ই-মহম্মদীয়া-র গুরুত্ব কী?
তারিকা-ই-মহম্মদীয়া –
‘তারিকা-ই-মহম্মদীয়া’ শব্দের অর্থ হল মহানবি মহম্মদ প্রদর্শিত পথ। অষ্টাদশ শতকে মহম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব (1703-1787 খ্রিস্টাব্দ) নামে এক ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর প্রবর্তিত আন্দোলন ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম তারিকা-ই-মহম্মদীয়া।
ওয়াহাবি আন্দোলনের লক্ষ্য কী ছিল?
ওয়াহাবি আন্দোলনের লক্ষ্য –
ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন অনেকগুলি লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল।
- ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার দূর করা – ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার দূর করার জন্য ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।
- ইসলামের রাজ্য প্রতিষ্ঠা – স্থানীয় বিধর্মী শাসক ও ব্রিটিশদের তাড়িয়ে ভারতে ইসলামিক ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
- ধর্মসম্মত মুসলিম সমাজ গঠন – হজরত মহম্মদের আদর্শ অনুসরণ করে ধর্মসম্মত মুসলিম সমাজ গঠন করার উদ্দেশ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
তিতুমির কেন বিখ্যাত?
তিতুমির –
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা ছিলেন মির নিশার আলি বা তিতুমির। তিনি রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির সংস্পর্শে এসে ওয়াহাবি আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বাংলায় জমিদার, মহাজন, নীলকর ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। তিতুমির ‘বাঁশের কেল্লা’ তৈরি করে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে বীরের মৃত্যুবরণ করেন।
কৃষ্ণদেব রায় তিতুমিরের অনুগামীদের উপর কীভাবে অত্যাচার চালান? এর পরিণতি কী হয়েছিল?
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মির নিশার আলি বা তিতুমির।
তিতুমিরের অনুগামীদের উপর অত্যাচার –
বারাসত অঞ্চলের পুড়া গ্রামের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তিতুমিরের অনুগামীদের উপর নানাভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালান। তিনি ওয়াহাবিদের দাড়ির উপর \(2\frac12\) টাকা হারে কর ধার্য করলে তাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়।
তিতুমিরের অনুগামীদের পরিণতি –
এই অবস্থায় 1830 খ্রিস্টাব্দে তিতুমিরের নেতৃত্বে প্রায় 300 অনুগামী কৃষ্ণদেব রায়ের বাসভবন আক্রমণ করে এবং লুঠপাট চালায়।
তিতুমিরের স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কী জানো?
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা তিতুমির জমিদার, মহাজন, নীলকর ও ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
তিতুমিরের নেতৃত্বে স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা –
- তিতুমির বারাসত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসানের কথা বলে নিজেকে স্বাধীন ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। মইনুদ্দিন নামক জনৈক ওয়াহাবিকে প্রধানমন্ত্রী এবং গোলাম মাসুমকে তিনি তাঁর সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করেন।
- তিনি বারাসতের নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি ‘বাঁশের কেল্লা’ নির্মাণ করেন। এরপর ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষণা করেন।
বাঁশের কেল্লা কে নির্মাণ করেন এবং কেন?
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল অন্যতম। 1820 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1885 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় 65 বছর ধরে এই আন্দোলন চলেছিল।
বাঁশের কেল্লা –
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা তিতুমির জমিদার, মহাজন, নীলকর ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। বারাসত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসানের কথা বলে তিনি নিজেকে স্বাধীন ‘বাদশাহ’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বারাসতের নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি ‘বাঁশের কেল্লা’ নির্মাণ করেন। এটি ছিল আন্দোলন সংগঠনের প্রধান কেন্দ্রস্বরূপ।
তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল?
তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব –
তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
- তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এটি কৃষক বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
- অত্যাচারী জমিদার, নীলকর সাহেবদের দ্বারা নির্যাতিত মানুষদের সংগঠিত করে তিতুমির বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ফলে ওয়াহাবি আন্দোলন ক্রমশ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়।
ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলাফল কী ছিল?
ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলাফল –
ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
- মুসলিম সমাজের শুদ্ধিকরণ – ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলে মুসলমান সমাজের আচার-আচরণ অনেকাংশে কুসংস্কারমুক্ত হয়।
- মুসলমানদের ঐক্যবোধ – ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলে আন্দোলনকারী মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে উঠেছিল। ঐক্যবদ্ধভাবে জমিদার ও সরকারের বিরোধিতা করেছিল তারা।
ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃতি কী ছিল?
ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃতি –
ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল তারিকা-ই-মহম্মদীয়া। মুসলমান ধর্মের সংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এই আন্দোলন ক্রমশ অত্যাচারী জমিদার ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। বাংলায় তিতুমিরের নেতৃত্বে অত্যাচারিত কৃষকরা জমিদার ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়। ফলে ওয়াহাবি আন্দোলন কৃষক আন্দোলন ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়।
ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার দুটি কারণ উল্লেখ করো।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ওয়াহাবি আন্দোলন। 1820 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1885 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় 65 বছর ধরে এই আন্দোলন চলেছিল।
ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার দুটি কারণ –
ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার দুটি কারণ হল –
- ইংরেজদের মতো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর জন্য যে আর্থিক সংগতি ও অস্ত্রশস্ত্র থাকা প্রয়োজন তা ওয়াহাবিদের ছিল না।
- তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে সব শ্রেণির কৃষককে যুক্ত করা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে ওয়াহাবিদের সঙ্গে অন্যান্য কৃষক সম্প্রদায়ের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
ফরাজি কথাটির অর্থ কী? ফরাজি আন্দোলন বলতে কী বোঝো?
ফরাজি কথাটির অর্থ –
ফরাজি কথাটি ‘ফরাজ’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ আল্লাহ-র আদেশ।
ফরাজি আন্দোলন –
উনিশ শতকে ভারতে মুসলমানদের মাধ্যমে ইসলামের পুনরুজ্জীবন নিয়ে যে আন্দোলন চলেছিল, তা পূর্ব বাংলায় ফরাজি আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন হাজি শরিয়ঊল্লাহ।
হাজি শরিয়ঊল্লাহর ধর্মীয় আদর্শ কী ছিল?
হাজি শরিয়ৎউল্লাহ 1820 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ফরাজি আন্দোলনের সূচনা করেন।
হাজি শরিয়ৎউল্লাহর ধর্মীয় আদর্শ –
হাজি শরিয়ৎউল্লাহ ঘোষণা করেন যে, ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে ইসলামবিরোধী নানা কুসংস্কার ও দুনীর্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাই তিনি কোরানের নির্দেশ পালন করে ইসলাম ধর্মের সংস্কারসাধনের কথা বলেন।
হল্কা ও খলিফা বলতে ফরাজি আন্দোলনে কী বোঝাত?
উনিশ শতকে ভারতে মুসলমানদের মাধ্যমে ইসলামের পুনরুজ্জীবন নিয়ে যে আন্দোলন চলেছিল, তা পূর্ব বাংলায় ফরাজি আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। হাজি শরিয়ৎউল্লাহ 1820 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ফরাজি আন্দোলনের সূচনা করেন।
হল্কা ও খলিফা বলতে ফরাজি আন্দোলন –
- হাজি শরিয়ৎউল্লাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন অর্থাৎ দুদু মিঞা ফরাজি আন্দোলনের পরিচালক হন। তিনি বাংলাদেশে তাঁর প্রভাবিত অঞ্চলে ‘ফরাজ-ই-খিলাফৎ’ নামে এক প্রশাসন গঠন করে বাংলাদেশকে কয়েকটি অঞ্চল বা হল্কায় বিভক্ত করেন।
- প্রতি হল্কায় একজন করে খলিফা নিযুক্ত করা হয়, যার দায়িত্ব ছিল ওই হল্কার জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার প্রতিহত করা।
ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য কী ছিল?
ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য –
বাংলার ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। ফরাজি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল –
- ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার দূর করা – ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার দূর করে পুনর্জাগরণ ঘটানো।
- ইসলামের রাজ্য প্রতিষ্ঠা – বিধর্মী ইংরেজ শাসকদের তাড়িয়ে বাংলায় ইসলামের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
- ধর্মসম্মত মুসলিম সমাজ গঠন – ইসলাম ধর্মের আদর্শসম্মত মুসলিম সমাজ গঠন করা।
ফরাজি আন্দোলনের দুটি বৈশিষ্ট্য লেখো।
ফরাজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য –
ফরাজি আন্দোলনের দুটি বৈশিষ্ট্য হল –
- ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরে তা রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।
- ফরাজি আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল দরিদ্র কৃষিজীবী মুসলিম শ্রেণি।
দুদু মিঞা কী কী কাজের মাধ্যমে ফরাজি আন্দোলনকে সুসংবদ্ধ করেন?
বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলন ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। 1818 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1906 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলেছিল।
দুদু মিঞার নেতৃত্বে ফরাজি আন্দোলন –
- হাজি শরিয়ৎউল্লাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন বা দুদু মিঞা ফরাজি আন্দোলনের পরিচালক হন। তাঁর লক্ষ্য ছিল জমিদারি শাসন ও বিদেশি ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ করে স্বাধীন মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
- দুদু মিঞা বাংলাদেশে তাঁর প্রভাবিত অঞ্চলে ‘ফরাজ-ই-খিলাফৎ’ নামক এক প্রশাসন গঠন করে ফরাজি আন্দোলনকে সুসংবদ্ধ করেন। দুদু মিঞার নেতৃত্বে ফরাজিরা জমিদার ও নীলকরদের আক্রমণ করে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল।
দুদু মিঞা স্মরণীয় কেন?
ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক হলেন হাজি শরিয়উল্লাহ। 1840 খ্রিস্টাব্দে হাজি শরিয়ৎউল্লাহ-র মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন বা দুদু মিঞা ফরাজি আন্দোলনের পরিচালক হন।
দুদু মিঞা স্মরণীয় হওয়ার কারণ –
- দুদু মিঞার তত্ত্ব ছিল বৈপ্লবিক। তিনি বলতেন, ‘জমি আল্লাহের দান। সুতরাং, জমির উপর কর ধার্য করার অধিকার কারও নেই।
- সুদক্ষ সংগঠক দুদু মিঞা বাংলাদেশে তার প্রভাবিত অঞ্চলে ‘ফরাজি-খিলাফৎ’ নামে এক প্রশাসন গড়ে তোলেন।
- তিনি বাংলাদেশকে কয়েকটি হল্কায় বিভক্ত করে প্রতি হল্কায় একজন করে খলিফা নিযুক্ত করেন, যার দায়িত্ব ছিল ওই হল্কায় জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার প্রতিহত করা। দুদু মিঞার নেতৃত্বে ফরাজিরা জমিদার ও নীলকরদের আক্রমণ করে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল।
দুদু মিঞার মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলনের জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল কেন?
ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। শরিয়ৎউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
দুদু মিঞার মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলনের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ –
দুদু মিঞার মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলনের জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়েছিল। কারণ –
- দুদু মিঞার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কর্মসূচির উপর গুরুত্ব প্রদানের পরিবর্তে তিনি ধর্মীয় কর্মসূচির উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। এর ফলে বহু হিন্দু এই আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যায়।
- এই আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে ধর্মীয় আন্দোলনের রূপ নিলে ফরাজি আন্দোলনের জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়ে যায়।
ফরাজি আন্দোলন কি ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলন?
উনিশ শতকে ভারতে মুসলমানদের মাধ্যমে ইসলামের পুনরুজ্জীবন নিয়ে যে আন্দোলন চলেছিল, তা পূর্ব বাংলায় ফরাজি আন্দোলন নামে পরিচিত হয়।
ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি –
ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
- ধর্মীয় সংস্কার – ইসলাম ধর্মের শুদ্ধতা রক্ষা, প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধন, সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ এবং ইসলাম ধর্মের বিশ্বজনীন আবেদন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আন্দোলন শুরু হয়।
- কৃষক আন্দোলন – ধর্মীয় রং -এর ছোঁয়া লাগলেও এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষকদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
- ব্রিটিশবিরোধিতা – ফরাজি আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করতে না পারলেও বাংলা থেকে ব্রিটিশ বিতাড়নের প্রেরণা জুগিয়েছিল।
ঐতিহাসিক বিনয়ভূষণ চৌধুরি বলেছেন, ফরাজি আন্দোলন মূলত প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন হিসেবে দেখা দিলেও শেষ বিচারে কৃষক আন্দোলনের ব্যাপ্তি লাভ করেছিল।
ফরাজি-খিলাফৎ কী?
ফরাজি-খিলাফৎ –
ফরাজি আন্দোলনের অংশ হিসেবে দুদু মিঞা বাংলাদেশে যে ফরাজি প্রশাসন গড়ে তোলেন, তাকে ফরাজি-খিলাফৎ বলা হয়। এই শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন স্বয়ং দুদু মিঞা। তাঁকে বলা হত ওস্তাদ। আর তাঁর শিষ্যদের বলা হত শাকরেদ। তাঁর প্রধান কার্যালয় ছিল বাহাদুরপুর গ্রাম।
ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল?
হাজি শরিয়ৎউল্লাহ 1820 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ফরাজি আন্দোলনের সূচনা করেন।
ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব –
- শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন – ফরাজি আন্দোলন ছিল বাংলার দরিদ্র কৃষকদের উপর জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
- মুসলমান সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠা – ফরাজি আন্দোলনের ফলে দরিদ্র মুসলমান কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।
পাগলপন্থী নামে কারা পরিচিত?
পাগলপন্থী সম্প্রদায় –
ঔপনিবেশিক কালপর্বে অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর পরগনার পাহাড়ি অঞ্চলে গারো ও হাজঙ্গ উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের বসবাস ছিল। ফকির করিম শাহ এই উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে এক ধর্মমত প্রচার করেন, যা পাগলপন্থী নামে পরিচিত। তিনিই ছিলেন পাগলপন্থী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা।
পাগলপন্থী আন্দোলন –
করিম শাহের পুত্র টিপু শাহের নেতৃত্বে 1825 খ্রিস্টাব্দে যে জমিদার ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হয়, তা পাগলপন্থী আন্দোলন নামে পরিচিত।
পাগলপন্থী বিদ্রোহ কী? এই বিদ্রোহের কারণ কী?
পাগলপন্থী বিদ্রোহ –
1825-1827 খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর অঞ্চলের গারো, হাজঙ্গ ও হাড়ি উপজাতিরা ফকির। করিম শাহের পুত্র টিপুর নেতৃত্বে জমিদার ও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ গড়ে তোলে, তা পাগলপন্থী বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয়।
পাগলপন্থী বিদ্রোহের কারণ –
1824 খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধ শুরু হলে ইংরেজ সরকারকে সাহায্য করার অজুহাতে জমিদারগণ গারো উপজাতিদের উপর বিপুল পরিমাণ করভার চাপালে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
নীলকররা ভারতে নীলচাষে কেন আগ্রহী হয়ে উঠেছিল?
ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষে যেসকল গুরুত্বপূর্ণ কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল, নীল বিদ্রোহ তার মধ্যে ছিল নানাদিক থেকে উল্লেখযোগ্য।
নীলকররা ভারতে নীলচাষে আগ্রহের কারণ –
নীলকররা বিভিন্ন কারণে ভারতে নীলচাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। যেমন –
- ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপের সুতিবস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে সেগুলি রং করার জন্য নীলের চাহিদা দেখা দেয়। এই প্রয়োজন মেটাতে ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলা থেকে ইউরোপের বাজারে নীলের চালান করত।
- চাষিদের দিয়ে জোর করে নীলচাষ করিয়ে নীলকর সাহেবরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করত।
এলাকা চাষ বা নিজ আবাদি চাষ বলতে কী বোঝো?
ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় নীলকরদের দুরকম নীলচাষের জমি ছিল। যথা – এলাকা চাষ বা নিজ আবাদি চাষ এবং বেএলাকা চাষ বা রায়তি আবাদ।
এলাকা চাষ বা নিজ আবাদি চাষ –
- এলাকা চাষ বা নিজ আবাদি চাষ – এইপ্রকার নীলচাষের জমি ছিল নীলকরদের জমিদারির খাসজমি। এই জমিতে নীলের চাষ করতে নীলকরদের নগদ টাকা খরচ করে দূর থেকে শ্রমিক ভাড়া করে আনতে হত।
- নীল কমিশনের হিসাব অনুসারে নিজ এলাকা বা নিজ আবাদি 10 হাজার বিঘা জমিতে নীলচাষের জন্য নীলকরদের খরচ পড়ত মোট \(2\frac12\) লক্ষ টাকা।
কী কী কারণে নীলকরেরা রায়তি প্রথাতেই নীলচাষ করার পক্ষপাতী ছিলেন?
নীলকরেরা রায়তি প্রথাতেই নীলচাষ করার পক্ষপাতী কারণ –
মূলত দুটি কারণে নীলকরেরা রায়তি পদ্ধতিতে নীলচাষ করতেন।
- প্রথমত, এই পদ্ধতিতে নীলকরদের জমি কেনার প্রয়োজন হত না।
- দ্বিতীয়ত, বিঘা প্রতি মাত্র 2 টাকা দাদন নিয়ে চাষিরা নীল উৎপাদন করতে বাধ্য হত। ফলে ইংরেজদের নীলচাষের খরচ অনেক কম পড়ত।
কৃষকরা কেন নীলচাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল?
নীলকর সাহেবরা বাংলার নীলচাষিদের উপর নানাভাবে অত্যাচার করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত।
নীলচাষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ –
বাংলার কৃষকরা নীলচাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হত। কারণ –
- নীলচাষ কৃষকদের কাছে একেবারে লাভজনক ছিল না। নানান কৌশলে নীলকর সাহেবরা কৃষকদের তাদের নিজেদের জমিতেই নীলচাষ করতে বাধ্য করত।
- নীলচাষের জন্য যাবতীয় খরচ কৃষককেই বহন করতে হত। দাদনের সামান্য যে টাকা তারা পেত সেখান থেকেই চাষিকে লাঙল, সার, বীজ প্রভৃতি কিনতে হত। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
পঞ্চম আইন কী? পঞ্চম আইন কৃষকদের কী ক্ষতি করেছিল?
নীলকর সাহেবরা নানাভাবে নীলচাষিদের অত্যাচার করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। দাদন বা অগ্রিম অর্থ দিয়ে এবং আরও বিভিন্ন পদ্ধতিতে জোর করে তাদের নীলচাষে বাধ্য করত।
পঞ্চম আইন –
লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক 1830 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম আইন পাস করেন। এই আইনে বলা হয় যে, কোনো চাষি দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
কৃষকদের উপর পঞ্চম আইনের প্রভাব –
পঞ্চম আইনকে ব্যবহার করে নীলকর সাহেবরা নানাভাবে নীলচাষিদের নিপীড়ন করত। অত্যাচারিত নীলচাষিরা আদালতে গিয়েও সুবিচার পেত না। প্রকৃতপক্ষে, এই আইন ছিল নীলকরদের স্বার্থরক্ষার জন্য, চাষিদের জন্য নয়।
নীলকররা নীলচাষিদের উপর কীভাবে অত্যাচার করত তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, নীলকরেরা কীভাবে চাষিদের উপর অত্যাচার করত?
নীলকরদের নীলচাষিদের উপর অত্যাচার –
নীলকরেরা নানাভাবে চাষিদের উৎপীড়ন করে নীলচাষে বাধ্য করত। যেমন –
- চাষির গোরুবাছুর ধরে নীলকুঠিতে আটক করে রাখা হত।
- দাদন নামে এক ধরনের অগ্রিম অর্থ জোর করে চাষিকে দিয়ে দেওয়া হত যার বিনিময়ে উৎপাদিত নীল নীলকরদেরই হাতে তুলে দিতে হত।
- নীলচাষের জন্য জমির মাপে কারচুপি করা হত।
- নীলচাষে রাজি না হলে চাষিকে মারধর করা হত।
নীল বিদ্রোহ বলতে কী বোঝায়?
নীল বিদ্রোহ –
ব্রিটিশ নীলকর সাহেবরা ভারতে কৃষকদের জোর করে নীলচাষ করাত। নীলচাষ করার ফলে চাষিদের খাদ্যাভাব ও অর্থাভাব সৃষ্টি হয়। এর ফলে চাষিরা সংঘবদ্ধভাবে নীলচাষ না করার জন্য যে আন্দোলন করে, তাকে নীল বিদ্রোহ বলা হয়। 1859-1860 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় নীল বিদ্রোহ হয়।
নীল বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?
বাংলার নীলচাষিরা 1859-1860 খ্রিস্টাব্দে নীলচাষ না করার জন্য যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
নীল বিদ্রোহের কারণ –
- নীলকর সাহেবদের অত্যাচার – নীলকর সাহেবরা নীলচাষিদের নানাভাবে অত্যাচার করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে চাষিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।
- দাদন প্রথা – নীলকর সাহেবরা নীলচাষিদের দাদন বা অগ্রিম নিতে বাধ্য করত এবং একবার অগ্রিম নিলে চাষিরা সারাজীবন নীলচাষ করতে বাধ্য থাকত।
নীল বিদ্রোহ কবলিত কয়েকটি অঞ্চলের নাম লেখো। এই বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
1859 মধ্যভাগ থেকে নীল বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। নদীয়া, যশোহর, পাবনা, রাজশাহি, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।
নীল বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ –
1859-1860 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় হওয়া নীল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন নদিয়ার বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস, বাঁশবেড়িয়ার বিশ্বনাথ সর্দার, মালদার রফিক মণ্ডল, চব্বিশ পরগনার রহিমউল্লাহ প্রমুখ।
দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস কে ছিলেন? তাঁরা কেন বিখ্যাত?
1859 খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার নীলচাষিরা নীল বিদ্রোহের সূচনা করেছিল।
নদিয়া জেলার চৌগাছা গ্রামের বাসিন্দা দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ছিলেন নীল বিদ্রোহের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাঁদের নেতৃত্বেই নদিয়া জেলায় সর্বপ্রথম নীল বিদ্রোহের সূচনা হয়। নীলচাষিদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য তাঁরা বাংলার ওয়াট টাইলর নামে পরিচিত হন।
বঙ্গদেশে নীল বিদ্রোহে কত কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল? তাদের সংগ্রামী কৌশল কী ছিল?
বাংলার নীলচাষিরা 1859 খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহের সূচনা করে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের 60 লক্ষ কৃষক এই বিদ্রোহে যোগদান করেছিল।
বঙ্গদেশে নীল বিদ্রোহে সংগ্রামী কৌশল –
কৃষকদের সংগ্রামী কৌশলগুলি হল –
- নীল বিদ্রোহে কৃষকরা তিরধনুক, ইট, পাটকেল প্রভৃতি নিয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল।
- নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনীর আসার খবর পাওয়া মাত্র কৃষকরা ঢাকঢোল বাজিয়ে সকলকে সতর্ক করে দিত। নীলকর সাহেবদের নীলকুঠিগুলিতে তারা আগুন লাগিয়ে দিত।
কৃষকদের পক্ষ নিয়ে কোন্ কোন্ জমিদার নীল বিদ্রোহে অংশ নেন?
নদিয়া, যশোহর, বারাসত, পাবনা, রাজশাহি, ফরিদপুর প্রভৃতি বাংলার বিভিন্ন স্থানে নীল বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল।
কৃষকদের পক্ষ নিয়ে যেসকল জমিদার নীল বিদ্রোহে অংশ নেন, তারা হলেন – নাড়াইলের জমিদার রামরতন মল্লিক, রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পালচৌধুরী, চণ্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায় প্রমুখ।
নীলচাষিদের আন্দোলনের পদক্ষেপগুলি কী ছিল?
বাংলার নীলচাষিরা 1859-1860 খ্রিস্টাব্দে নীলচাষে অস্বীকার করে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত ছিল।
নীলচাষিদের আন্দোলনের পদক্ষেপ –
- নীল বিদ্রোহের প্রথম সূচনা হয় তৎকালীন নদিয়া জেলার চৌগাছা গ্রামে। নীলচাষিরা দলে দলে বর্শা, তরোয়াল প্রভৃতি নিয়ে বিদ্রোহে অংশ নেয়।
- নীলকরদের কুঠিগুলি আক্রমণ করে বিদ্রোহীরা সেগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা কীরূপ ছিল?
বাংলার নীলচাষিরা 1859 খ্রিস্টাব্দে নীলচাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা –
নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিরা বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল। তারা নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল। জেমস লঙ ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এজন্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল।
কলকাতার কোন্ কোন্ সংবাদপত্র নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করে?
অথবা, কোন্ কোন্ পত্রপত্রিকা ও লেখা থেকে নীল বিদ্রোহের কথা জানা যায়?
সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকা –
নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংঘটিত নীল বিদ্রোহের প্রতি সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রপত্রিকাগুলির অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল।
- হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার মাধ্যমে নীল বিদ্রোহের খবরাখবর বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ও অকুণ্ঠ জনসমর্থন লাভ করে।
- সোমপ্রকাশ পত্রিকাও নীলচাষিদের পক্ষ সমর্থন করে। নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে এই পত্রিকা প্রেরণা জোগায়।
এ ছাড়া সংবাদ প্রভাকর, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সমাচার দর্পণ ইত্যাদি পত্রিকাগুলিও নীলচাষিদের উপর অত্যাচারের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরেছিল।
নীল বিদ্রোহে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা কীরূপ ছিল?
বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে শুরু হওয়া নীল বিদ্রোহের সময় কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির অধিকাংশ লোক বিদ্রোহ সম্পর্কে উদাসীন থাকলেও কয়েকজন শিক্ষিত হৃদয়বান ব্যক্তি নীলচাষিদের সমর্থনে কলম ধরেন।
নীল বিদ্রোহে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা –
‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নীল বিদ্রোহের প্রতি সহমর্মী অবস্থান নিয়েছিলেন। নীলচাষিদের দুর্দশা এবং নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে সুচিন্তিত প্রবন্ধ রচনা করে তিনি সরকারের চোখ খুলে দেন।
‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল –
- যে চাষি একবার নীলচাষ করেছে, বেঁচে থাকতে তার আর মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই।
- নীলচাষে কোনো চাষিই ন্যায্য দাম পায় না। নীলচাষে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি ইত্যাদি।
মূলত হরিশচন্দ্রের উদ্যোগেই নীল বিদ্রোহের খবরাখবর বাংলায় শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সাংবাদিক শিশির কুমার ঘোষের অবদান নীল বিদ্রোহের ক্ষেত্রে কেন গুরুত্বপূর্ণ?
শিশির কুমার ঘোষের অবদান –
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নীল বিদ্রোহের উপর একাধিক রচনা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শিশির কুমার ঘোষের অবদান চিরস্মরণীয়। বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে নীলচাষিদের উপর অত্যাচারের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ হিন্দু প্যাট্রিয়ট ও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করে বিদ্রোহীদের পক্ষে তিনি প্রবল জনমত গড়ে তুলেছিলেন। এইজন্য তাঁকে বাংলার প্রথম ‘Field Journalist’ বলা হয়।
নীলদর্পণ নাটক বিখ্যাত কেন?
দীনবন্ধু মিত্র তাঁর বিখ্যাত ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনা করে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের একটি মর্মস্পর্শী জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেন।
নীলদর্পণ নাটক –
1860 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি প্রকাশিত হয়। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও কৃষকদের দুর্দশার এক বাস্তব চিত্র নাটকের প্রতিটি চরিত্রে ফুটে উঠেছিল। এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদ রেভারেন্ড জেমস লঙ সাহেবের নামে প্রকাশিত হলে তা পড়ে ইংরেজদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়। নীলকররা লঙ সাহেবের নামে মানহানির মামলা করলে তাঁর 1000 টাকা জরিমানা হয়। লঙ সাহেবের জরিমানার টাকা কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় জমা দেন। ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি নীলকরদের উপর বিশেষ চাপ সৃষ্টি করেছিল।
নীল বিদ্রোহকে কেন ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন ও গণ আন্দোলন বলা হয়?
নীল বিদ্রোহকে ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন ও গণ আন্দোলন বলার কারণ –
নীল বিদ্রোহ প্রকৃতিগতভাবে ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণ আন্দোলন। কারণ –
- এই আন্দোলন মূলত কৃষকদের সমস্যাকে কেন্দ্র করে ঘটেছিল।
- হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রায় 60 লক্ষের মতো কৃষক এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন বহু শিক্ষিত ব্যক্তি।
নীল বিদ্রোহ অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহ থেকে আলাদা কেন?
বাংলার নীলচাষিরা 1859-1860 খ্রিস্টাব্দে নীলচাষ না করার জন্য যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
নীল বিদ্রোহ অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহ আলাদা হওয়ার কারণ –
নীল বিদ্রোহ নানাদিক থেকে অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহ থেকে আলাদা ছিল। কারণ –
- নীল বিদ্রোহ ছিল নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ – এটি অন্যান্য বিদ্রোহের মতো জমিদার বা মহাজনবিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার ও জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে নীলচাষিরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল।
- নীল বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাংলার কৃষকরা ভারতের ইতিহাসে প্রথম ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করে। ভারতে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এই ঘটনা ছিল অভিনব।
- নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংঘটিত নীলবিদ্রোহকে বাংলার বহু বুদ্ধিজীবী এবং সংবাদপত্র পত্রিকাগুলি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল।
নীল কমিশন কী? নীল কমিশন কী কী সুপারিশ করে?
নীল কমিশন –
নীল বিদ্রোহের তীব্রতা ও ব্যাপকতা লক্ষ করে বাংলার ছোটোলাট জে পি গ্রান্ট 1860 খ্রিস্টাব্দের 31 ডিসেম্বর নীল কমিশন গঠন করেন। মূলত, নীলচাষিদের অভাব-অভিযোগ ও বাংলায় নীলচাষ সম্পর্কে অনুসন্ধান করাই ছিল এই কমিশনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
নীল কমিশনের সুপারিশ –
- পাঁচ সদস্যের এই কমিশন তার রিপোর্টে জানায় যে, নীলকরদের বিরুদ্ধে নীলচাষিদের অভিযোগুলি সম্পূর্ণ সত্য।
- নীল কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই কমিশন নীলচাষকে নীলচাষিদের ইচ্ছাধীন বলে ঘোষণা করে।
অষ্টম আইন কী?
নীল বিদ্রোহের তীব্রতায় নীলচাষিদের অভাব-অভিযোগ ও নীলচাষ সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য ব্রিটিশ সরকার 1860 খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশন তার প্রতিবেদনে জানায় যে, নীলকর সাহেবরা চাষিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের দিয়ে নীলচাষ করাতে পারবে না।
অষ্টম আইন –
- 1860 খ্রিস্টাব্দে ‘অষ্টম আইন’ পাস করে নীলচুক্তি আইন রদ করা হয়।
- অষ্টম আইন পাসের ফলে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার থেকে চাষিরা রেহাই পায়। এই আইনে নীলচাষকে চাষিদের ইচ্ছাধীন বলে ঘোষণা করা হয়।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহের কারণ কী? এই বিদ্রোহের বিশেষত্ব কী?
পাবনার কৃষক বিদ্রোহের কারণ –
পাবনার কৃষকদের লক্ষ্য ছিল ন্যায্য খাজনা দেওয়া। এ ছাড়া তারা নিজেদের সম্পত্তির অধিকারের নিরাপত্তা, জমিদারদের জমি জরিপ ব্যবস্থা এবং অবৈধ আবওয়াবের বিলোপের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহের বিশেষত্র –
পাবনার কৃষক বিদ্রোহে বিদ্রোহীরা আইনের পথে জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এ ছাড়া এই বিদ্রোহের নেতৃবর্গ ছিলেন হিন্দু এবং আন্দোলনকারীরা ছিল মুসলমান।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
1870 -এর দশকে বাংলার পাবনায় কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা পাবনা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। তারা প্রধানত নিজেদের সম্পত্তির অধিকারের নিরাপত্তা, জমিদারদের জমি জরিপ ব্যবস্থা এবং অবৈধ আবওয়াবের বিলোপের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।
পাবনা কৃষক বিদ্রোহের দুটি বৈশিষ্ট্য –
- পাবনার কৃষক বিদ্রোহে বিদ্রোহীরা আইনের পথে জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃবর্গ ছিলেন হিন্দু এবং আন্দোলনকারীরা ছিল মুসলমান।
- দু-চারটি জায়গায় সামান্য হাঙ্গামা হলেও এই কৃষক বিদ্রোহে হিংসার প্রয়োগ খুব একটা ঘটেনি।
কারা, কী উদ্দেশ্যে দ্য পাবনা রায়ত লিগ গঠন করে?
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় যেসকল কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল পাবনা বিদ্রোহ। পাবনার কৃষকদের মূল লক্ষ্য ছিল ন্যায্য খাজনা দেওয়া।
দ্য পাবনা রায়ত লিগ –
1873 খ্রিস্টাব্দে পাবনার ইউসুফজাই পরগনার কৃষকরা একটি রায়তি সমিতি বা দ্য পাবনা রায়ত লিগ গঠন করে। এই সমিতি জমিদারদের বেআইনি খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদ করে। মাঝে মাঝে খাজনা দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। এই রায়তি সমিতি কৃষকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে জমিদারদের বিরুদ্ধে মামলা করে।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ কতখানি সাম্প্রদায়িক ছিল?
সাম্প্রদায়িক বলা যায় কি? –
পাবনার কৃষক বিদ্রোহকে সাম্প্রদায়িক বলা যায় না। কারণ –
- পাবনা বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায় নামে এক তালুকদার। শম্ভুনাথ পাল ও ক্ষুদিমোল্লা নামে দুই জোতদারও এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। অর্থাৎ বিদ্রোহের বেশিরভাগ নেতৃরা ছিলেন হিন্দু জমিদার ও বিদ্রোহী কৃষকরা ছিল মুসলমান।
- হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এই বিদ্রোহে একসঙ্গে অংশ নিয়েছিল।
ভারতে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহের ফলাফল সম্পর্কে লেখো।
কৃষক বিদ্রোহের ফলাফল –
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে 1763 খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতে অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। এই কৃষক বিদ্রোহগুলির ফলাফল হিসেবে বলা যায় –
- বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিকার – ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানে বাধ্য হয়। অনেকক্ষেত্রে বিদ্রোহের কারণগুলি দূরীভূত করার চেষ্টা করে বিভিন্ন প্রতিকারমূলক আইন পাস করে।
- পরবর্তী বিদ্রোহকে উৎসাহদান – কৃষক বিদ্রোহগুলি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ঐতিহাসিকগণ এই বিদ্রোহগুলিকে পরবর্তী যুগান্তকারী বিদ্রোহগুলির অগ্রদূত বলে অভিহিত করেছেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে ভারতে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল কেন?
ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ও ইংরেজ কর্মচারীদের সীমাহীন শাসন ও শোষণে বহু জমিদার তাঁদের জমিদারি হারায়, চাষি হারায় জমির স্বত্ব, অরণ্যচারীরা হারায় তাদের অরণ্যের অধিকার। অসংখ্য শ্রমিক, শিল্পী, পরিবার বেকার হয়ে পড়ে অর্থাৎ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জীবনকেই দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এরই পরিণতি স্বরূপ দেখা দেয় ভারতবাসীর তীব্র অসন্তোষ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সিপাহি বিদ্রোহের পূর্বে ভারতে সংঘটিত কয়েকটি বিদ্রোহের নাম করো।
1857 খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের পূর্বে ভারতবর্ষের উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহগুলি ছিল – (ক) সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (1763 খ্রি.), কোল বিদ্রোহ (1831-32 খ্রি.), চুয়াড় বিদ্রোহ (1798 খ্রি.), তিতুমিরের বারাসত বিদ্রোহ (1830-31 খ্রি.) সাঁওতাল বিদ্রোহ (1855-56 খ্রি.), মুন্ডা বিদ্রোহ (1899 খ্রি.), নীল বিদ্রোহ (1859 খ্রি.) প্রভৃতি।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে মুসলিমদের ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহগুলি কী কী ছিল?
ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম মুসলিম বিদ্রোহ ছিল ফরাজি আন্দোলন। পাশাপাশি অন্য আর একটি আন্দোলন ছিল ওয়াহাবি আন্দোলন ৷
কোথায়, কবে চুয়াড় বিদ্রোহ শুরু হয়?
1768 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1799 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে একাধিকবার চুয়াড় বিদ্রোহ দেখা দেয়। মেদিনীপুর জেলার লালগড়, রামগড়, জামবনি, কর্ণগড়, বাকুঁড়ার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ঘাটশিলা ও ধলভূমে চুয়াড়রা বিদ্রোহ করে। 1798 খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ।
চুয়াড় কাদের বলা হয়? চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব কারা দিয়েছিলেন?
চুয়াড় বলতে মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল নামে পরিচিত বনাঞ্চলের আদিবাসীদের বোঝাত। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ধলভূমের রাজা জগন্নাথ হল, কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি, রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিংহ, ধানকার শ্যামগঞ্জন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
চুয়াড়রা কী ধরনের কাজকর্ম করত?
চুয়াড়রা মূলত চাষ-আবাদ ও পশুপাখি শিকার করত। জঙ্গলমহলে উৎপাদিত দ্রব্য-সামগ্রী বিক্রি করত। কেউ কেউ আবার জমিদারদের অধীন আধাসামরিক বাহিনী অর্থাৎ পাইক বরকন্দাজের কাজ করত।
পাইকান জমি কাকে বলা হয়?
জমিদাররা তাদের অধীনে পাইকের কাজ করা চুয়াড়দের নগদ অর্থে বেতনের পরিবর্তে যে খাস জমি ভোগ করতে দিত তাকে বলা হয় পাইকান জমি। এই জমি ছিল নিষ্কর জমি। কিন্তু কোম্পানি এই নিস্কর জমির ওপর রাজস্ব ধার্য করলে এবং পাইকান জমি কেড়ে নিলে পাইকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
চুয়াড় বিদ্রোহে জমিদারগণ কী ভূমিকা পালন করেছিল?
ব্রিটিশ শাসকদের আরোপিত মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব জমিদারদের বিদ্রোহী করে তুলেছিল। তাই তারা পাইক বরকন্দাজের সহযোগিতায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়। কৃষকরা জমিদারের বন্ধু না হলেও তারা দলবদ্ধভাবে, নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য জমিদারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ শাসকদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা ও চরম শোষণ-পীড়নের জন্য চুয়াড় বিদ্রোহে যোগ দেয়।
চুয়াড় বিদ্রোহের অবসান হয় কীভাবে?
বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করায় মেদিনীপুরের শাস্তি বিঘ্নিত 1799 খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড় হলে লর্ড ওয়েলেসলি দুটি সেনাদলের সাহায্যে সাড়াশি অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। বহু চুয়াড় বিদ্রোহীকে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। বিদ্রোহীদের গ্রেফতার করে তাদের ঘাঁটিগুলি জ্বালিয়ে ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে এই বিদ্রোহ দমন করে। অন্যদিকে বিভাজন নীতির আশ্রয় নিয়ে চুয়াড় ও পাইকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে কৌশলে চুয়াড় বিদ্রোহের অবসান ঘটায়।
চুয়াড় বিদ্রোহের গুরুত্ব কী?
চুয়াড় বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জমিদার ও তার অনুচরবর্গ, কৃষকদের বিদ্রোহ হলেও এই বিদ্রোহের প্রাণশক্তি ছিল নিপীড়িত কৃষক যাঁরা সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ ছিলেন তাঁরা বুঝেছিলেন জমিদারদের নিপীড়িতদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া অপেক্ষা ব্রিটিশ শাসনের অবসান বেশি জরুরি তাই তাদের আত্মপ্রত্যয় ন্যায্য অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে অনুপ্রেরণা দেয় যা পরবর্তীকালে অনেক আন্দোলনের দিশারি হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দশকে দুটি উপজাতি বিদ্রোহের নাম করো।
ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দশকে দুটি উপজাতি বিদ্রোহ হল কোল বিদ্রোহ ও সাঁওতাল বিদ্রোহ। 1831-32 খ্রিস্টাব্দে কোল বিদ্রোহ শুরু হয় এবং এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন বুদ্ধ ভগৎ, জোয়া ভগৎ, সুই মুন্ডা। অন্যদিকে 1855 খ্রিস্টাব্দে সিধু-কানহুর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ।
কবে, কোথায় প্রথম কোল বিদ্রোহের সূচনা হয়?
1831-32 খ্রিস্টাব্দে ছোটোনাগপুরের রাঁচিতে এই কোল বিদ্রোহ প্রথম শুরু হয়।
কোল বিদ্রোহ কোথায় কোথায় ছড়িয়ে পড়েছিল?
ছোটোনাগপুরের রাঁচিতে এই বিদ্রোহের সূচনা হলেও ক্রমশ এই বিদ্রোহ সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও বহু আগেই এই বিদ্রোহ প্রকাশ পেয়েছিল সিংভূম জেলার শোনপুর পরগনায়।
কোল বিদ্রোহের নেতা কারা ছিলেন?
অন্যান্য বিদ্রোহের মতো কোল বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও স্থানীয় নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়। এঁরা হলেন — সুই মুন্ডা, বুদ্ধ ভগৎ, জোয়া ভগৎ, খাদু পাতর, ঝিন্দরাই মানকি, সূর্য, সিংরাই প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
দর্পনাথ সাহি কে ছিলেন? তাঁর সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কী চুক্তি হয়েছিল?
দর্পনাথ সাহি ছিলেন পালামৌর রাজা। 1770 খ্রিস্টাব্দে দর্পনাথ সাহির সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চুক্তি হয় যে, বাৎসরিক ছয় হাজার টাকা রাজস্বসহ অতিরিক্ত ছয় হাজার টাকা তিনি কোম্পানিকে প্রদান করবেন।
কোল বিদ্রোহের উদ্দেশ্য কী ছিল?
চার্লস মেটকাফ-এর মতে, কোল বিদ্রোহীদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো। এ ছাড়া জমিদার, মহাজন, শস্য ব্যবসায়ী, পুলিশ, কোম্পানির কর্মচারীদের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। কারণ কোল বিদ্রোহীরা এদের ইংরেজ শাসনের অঙ্গ হিসেবেই দেখেছিল। তাই ইংরেজ আশ্রিত লোকজনরা কেউই বিদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
কোল বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?
ছোটোনাগপুর অঞ্চলে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক উচ্চহারে রাজস্ব বৃদ্ধি, জমিদার-মহাজন- ব্যবসায়ীদের শোষণ ছিল কোল বিদ্রোহের মূল কারণ। অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – দেশি মদের ওপর কর স্থাপন, কোলদের ঐতিহ্য বিরোধী আফিম চাষ করতে বাধ্য করা, বেগার খাটানো, নারীদের সম্মান হানি হওয়া। এ ছাড়া বনজ সম্পদের ওপর কোলদের আজন্ম অধিকার ব্রিটিশরা ছিনিয়ে নিলে কোলরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে।
কোল বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করো।
কোল বিদ্রোহে কোলরা ছাড়াও ওঁরাও, হো, মুভা উপজাতির মানুষেরা যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহীরা দিকু, অর্থাৎ বহিরাগতদের এলাকা ছেড়ে যেতে নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ অমান্যকারীদের গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বহু হিন্দু তাদের হাতে পড়ে আদিবাসী দেবতার সামনে বলি প্রদত্ত হয়। কোলদের আক্রমণে সূত্রধর ও কর্মকার ছাড়া কেউই রক্ষা পায়নি। নিম্নবর্গের বহু মানুষ এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে।
কোলবিদ্রোহ কীভাবে দমন করা হয়?
ক্যাপ্টেন উইলকিনসনের নেতৃত্বে 50 নং বেঙ্গল ইনফ্যান্টি এনে প্রায় দুমাস ধরে অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে, অসংখ্য কোল উপজাতির নরনারীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। 1830 খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।
অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিরাট ইংরেজ বাহিনীর তির, ধনুক, বল্লম সজ্জিত বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। এ ছাড়াও আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা, কোলদের মধ্যে ঐক্যের অভাবেও এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।
কোলবিদ্রোহের ফলাফল কী হয়েছিল।
কোল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এই বিদ্রোহের ফলে
1834 খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ – পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি গঠন করা হয় ওই অঞ্চলের উপজাতিদের বসবাসের জন্য।
সরকার সেখানে কোম্পানির নিয়মবিধি কার্যকর না করে উপজাতিদের স্বশাসন, তাদের ঐতিহ্য রীতিনীতি মেনে নেয়।
জমি হস্তান্তরে বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়।
উপজাতীয় গ্রাম- প্রধানদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
মাধব সিং কে ছিলেন? কোলরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন কেন?
মাধব সিং ছিলেন কোম্পানির দেওয়ান। মাধব সিং অত্যন্ত নির্ণয় ও নিষ্ঠুরভাবে কোলদের কাছ থেকে উচ্চহারে রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করলে হতদরিদ্র ও অসহায় কোলরা সর্বস্বান্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।
কোলদের বাধ্য করা হয়েছিল ফসলের বদলে নগদ অর্থে খাজনা প্রদান করতে। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে গেলে তারা মহাজন ও জমিদারদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহ কত খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়? এই বিদ্রোহ কী নামে পরিচিত? সাঁওতাল পরগণা কী নামে পরিচিত?
সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয় 1855 খ্রিস্টাব্দে। এই বিদ্রোহ খেরওয়ারী হুল নামে পরিচিত। সাঁওতাল পরগনা দামিন-ই-কোহ বা মুক্তাঞ্চল নামে পরিচিত।
সাঁওতাল বিদ্রোহ কোথায় কোথায় ছড়িয়ে পড়েছিল?
1855 খ্রিস্টাব্দে ভাগনাডিহি নামক স্থানে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়। ক্রমে তা রাঁচি, হাজারিবাগ, ছোটোনাগপুর, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, ভাগলপুর, মুরশিদাবাদ প্রভৃতি স্থানে বিস্তার লাভ করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ কাদের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়?
সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতারা ছিলেন — সিধু, কানহু, চাঁদ, ভৈরব, ডোমনমাঝি, কালো প্রামাণিক, বীরসিংহ মাঝি প্রমুখ নেতৃবর্গ।
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণগুলি কী কী ছিল?
সাঁওতাল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হল — নতুন ভূমিরাজস্ব নীতি, দামিন-ই-কোহের জাল কেটে সাফ করে দেওয়া, বহিরাগত (দিকু)দের আগমন ও শোষণ, চড়া খাজনা, বেগার শ্রম, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের শোষণ, বেচারাম কেনারাম ও কামিয়াতি নামক ঋণচুক্তির প্রচলন, অরণ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ, খ্রিস্টান মিশনারিদের করবার চেষ্টা, পুলিশ প্রশাসনের নিপীড়িন অনাবৃষ্টি অজন্মা প্রভৃতি।
সাঁওতাল বিদ্রোহের লক্ষ্য কী ছিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহের লক্ষ্যগুলি ছিল –
- দের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
- জমিদার, মহাজন, হংসায়ীদের শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়া।
- সাঁওতালরা, তাদের এই দুরবস্থার জন্য ব্রিটিশদের দায়ী করে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল।
- অরণ্যের অধিকার ফিরে পাওয়াও ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের লক্ষ্য।
কামিয়াতি প্রথা কী?
কামিয়াতি ছিল এক ধরনের বন্ড। সাঁওতালরা মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এই ব্যবস্থায় যতদিন ক্ষণ পরিশোধ করতে পারতো না ততদিন তাদেরকে মহাজনদের জমিতে বেগার খাটতে হত। কামিয়াতি প্রথায় মহাজনরা চড়া ও চক্রবৃদ্ধি হারে শোষ নেওয়ায় সেই ঋণ সাঁওতালরা কোনোদিন শেষ দিতে পারতো না। ফলে তারা চিরবন্দি হতে পড়ত।
হারওয়ারি ব্যবস্থা বলতে কী বোঝো?
দাদন নেওয়া সাঁওতালরা দাদন পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে, তাদের মহাজনদের জমিতে বেগার শ্রমদানের পাশাপাশি অন্যান্য কাজকর্ম করে দেওয়ার ব্যবস্থা হারওয়াহি ব্যবস্থা নামে পরিচিত।
বেচারাম কাকে বলা হয়?
বেচারামকে বলা হয় ছোটো বাউ। বেচারাম আসলে নির্দিষ্ট ওজন অপেক্ষা কম ওজনের এক ধরনের বাটখারা। এর দ্বারা সাঁওতালদের ক্রয় করতে আসা জিনিসপত্র কম ওজনের বাটখারায় মেপে পরিমাণে কম দিয়ে প্রতারিত করা হত।
কেনারাম কাকে বলে?
কেনারাম হল বড় বাউ। কেনারাম আসলে নির্দিষ্ট ওজন অপেক্ষা বেশি ওজনের একধরনের বাটখারা। এর দ্বারা ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের বিক্রি করতে আসা জিনিসপত্র বেশি ওজনের বাটখারার সাহায্যে মেপে ওজনে কম দেখিয়ে সাঁওতালদের ঠকানো হত। এটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না।
সাঁওতাল বিদ্রোহ কী নিছক একটি উপজাতি বিদ্রোহ ছিল?
বিদ্রোহ ছিল না। এই বিদ্রোহে সাঁওতালরা ছাড়াও নিম্নবর্গের সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধুমাত্র একটি উপজাতি সাধারণ মানুষ অর্থাৎ, কামার, কুমোর, দুধের গোয়ালা, তাঁতি (জোলা), তেলি প্রভৃতি নানা পেশার হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় সাহায্য ও সমর্থন করেছিল। বস্তুত এটাকে নিছকই একটি উপজাতি বিদ্রোহ না বলে বরং সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে, মহাজন, জমিদার, ব্যবসায়ীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রাম বলাই শ্রেয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকরা কী মত পোষণ করেন?
আধুনিক গবেষক ও ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহকে শুধুমাত্র একটি উপজাতি বিদ্রোহ মনে করেন না। রমেশচন্দ্র মজুনদারের মতে, 1855-56 খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ রূপে চিহ্নিত। সুপ্রকাশ রায় সাঁওতাল বিদ্রোহকে মহাবিদ্রোহের অগ্রদূতা স্বরূপ আখ্যা দিয়েছেন। কালীকিঙ্কর দত্তের মতে, এই বিদ্রোহ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক বিদ্রোহ।
গিরা কি? সাঁওতালরা গ্রাম লুঠ করে সেখানে কি রেখে আসতেন?
গিরা হচ্ছে শালগাছের ডাল। সাঁওতালরা গ্রাম লুণ্ঠন করে বা ইংরেজদের বাংলোগুলি লুণ্ঠন করে সেখানে চামড়া বাধা বাঁশ পুঁতে রেখে আসত। এটি ছিল সাঁওতালদের অধিকার ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিতবাহী।
কীভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়?
স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে সিধু ও কানহু-র নেতৃত্বে 1955 খ্রিস্টাব্দের 30 জুন ভাগনাডিহির মাঠে 10 হাজার সাঁওতাল এই বিদ্রোহের সূচনা করে। প্রথমে তাঁরা দলবদ্ধভাবে পাঁচ কাঠিয়া গ্রাম আক্রমণ করে। দিঘি থানার দারোগা মহেশলাল দত্তকে হত্যা করে, কেনারাম ভগত সহ পাঁচজন কুখ্যাত মহাজনকে তারা হত্যা করে। এ ছাড়াও তারা সরকারের দপ্তরখানা, জমিদারদের কাছাড়ি এবং মহাজনদের আড়তগুলি আক্রমণ করলে সাঁওতালদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরপর ক্রমশ মহেশপুর, পাদুর, মুরশিদাবাদ ও বীরভূমের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
কারা সাঁওতালদের ওপর শোষণ করত?
সাঁওতালরা অনেকের দ্বারা শোষিত হয়েছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল –
- জমিদার ও তাদের নিযুক্ত খাজনা আদায়কারী
- মহাজন
- ব্যবসায়ী
- রেলপথ নির্মাণের ঠিকাদার
- ইউরোপীয় কর্মচারী
- বহিরাগত দিকুও শস্য ব্যবসায়ী
- নীলকর সাহেব। এরা সকলেই সাঁওতালদের ওপর শোষণ ও অত্যাচার করেছিল।
সাঁওতালদের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন কারা?
সাঁওতাল বিদ্রোহকালে সাঁওতালদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছিল দিঘি থানার দারোগা মহেশলাল দত্ত, কেনারাম ভগত সহ বহু কুখ্যাত মহাজন, পাকুরের রাজবাড়ী, অম্বর পরগনার জমিদার এবং বহু নীলকর সাহেব। রেলপথের ইউরোপিয় কর্মচারী, পদস্থ পুলিশকর্তা, ব্যবসায়ীদের অনেকে সাঁওতালদের দ্বারা নিহত হয়। সাধারণত বিদ্রোহীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হত ইংরেজদের বাংলো এবং জমিদারদের গুদাম ও ধানের গোলা।
কীভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের অবসান হয়?
তির, ধনুক ও বল্লম সম্বল করে সাঁওতালরা কলকাতা দখলের উদ্দেশ্যে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লে ইংরেজ সেনাপতি মেজর বুরাফ 1955 খ্রিস্টাব্দে 16 জুলাই পিরপেত্তির কাছে সাঁওতাল বিদ্রোহীদের হাতে পরাজিত হন। নভেম্বর মাসে সাঁওতাল বিদ্রোহীদের অধীনস্থ সমগ্র এলাকায় সামরিক শাসন জারি করে মেজর জেনারেল লয়েডের নেতৃত্বে 55 নং পার্বত্য বাহিনী সাঁওতালদের আক্রমণ করে। 1856 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উভয়পক্ষের সংঘর্ষ চলে। অবশেষে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন চালিয়ে ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহ দমন করে।
সাঁওতালদের পরাজয়ের কারণ কী?
সাঁওতালদের পরাজয়ের কারণগুলি হল —
- আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব
- সিধু ও কানুর মৃত্যু
- প্রায় 20 হাজার সাঁওতালকে নির্মমভাবে হত্যা করা
- ব্রিটিশ বাহিনী কর্তৃক গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করা প্রভৃতি ছিল সাঁওতালদের পরাজয়ের কারণ।
সিধু, কানুহু ও অন্যান্য সাঁওতালদের কী শাস্তি হয়?
সিধুকে গ্রেফতার করার সাথে সাথে তৎক্ষণাৎ গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়। কান্তু উপেনবান্দায় গ্রেপ্তার হলে কয়েকদিনের মধ্যে তাঁর ফাঁসি হয়। বহু নরনারীকে নিধন করা হয়। প্রায় 20 হাজার সাঁওতালকে হত্যা করা হয়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল কী হয়?
সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী —
- এই বিদ্রোহের ফলে সরকার সাঁওতাল পরগনা নামে একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি করে।
- সাঁওতালদের উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- বাজেয়াপ্ত গবাদি পশু সাঁওতালদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
- মাঝি, পরগনাইন প্রভৃতি সাঁওতাল গোষ্ঠীপতিদের মাধ্যমে সাঁওতালদের বিচার ব্যবস্থা চালু হয়।
- তিন বছরের জন্য বহিরাগতদের সাঁওতাল পরগনায় মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব কী?
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে ে ওঠা এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, শাসক ও শোষক শ্রেণি যন্ত্র ক্ষমতাবান হোক না কেন মনের অদম্য আকাঙ্ক্ষা ও প্রক ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যায়। সামান তির, ধনুক, টাঙ্গি নিয়ে তারা সুসজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যেভাবে লড়েছিল তা অনুসরণযোগ্য যা ভবিষ্যতে আরও বড়ো বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। সুপ্রকাশ রায় তাই সাঁওতাল বিদ্রোহকে মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত বলেছেন।
খেরওয়ার আন্দোলন বলতে কী বোঝো?
খেরওয়ার ছিল সাঁওতালদের একটি ধর্মী আন্দোলন। ভগীরথ মাঝির নেতৃত্বে 1870 খ্রিস্টাব্দে নিজেদের পুরাতন রীতিনীতি, আচার ব্যবহার ছেড়ে হিন্দুদের বৈয়ব ধর্মকে সামনে রেখে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ লক্ষ্য ছিল শুদ্ধ জীবনচর্চা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা, নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা। অন্যদিকে 1855 খ্রিস্টাব্দে সশস্ত্র সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর খেরওয়ার ছিল স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিকল্প একটি পথ।
মুন্ডা বিদ্রোহ করে এবং কার নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল?
মুন্ডা বিদ্রোহ শুরু হয় 1899 খ্রিস্টাব্দে এবং শেষ হয় 1900 খ্রিস্টাব্দে। এই বিদ্রোহ বিরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল।
বিরসা মুন্ডা কে ছিলেন?
বিরসা মুন্ডা ছিলেন মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান নেতা। তাঁর ব্যক্তিত্ব, প্রচেষ্টা ও সাংগঠনিক প্রতিভার ফলেই মুন্ডা বিদ্রোহ তীব্রতর হয়ে উঠেছিল এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছিল। তিনি মুন্ডাদের দীর্ঘদিনের অরণ্য সম্পদের অধিকারের ওপর সরকারি বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি ব্রিটিশরাজের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এজন্য ব্রিটিশ ছাড়াও জমিদার, মহাজন, মিশনারি ও পুলিশের বিরুদ্ধে তিনি সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। মুন্ডাদের কাছে ভগবান রূপে পূজিত এই মহান নেতা 1900 খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
মুন্ডারা কেন জমিদার মহাজনদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন?
মুন্ডারা ছিল নিরীহ, সহজ, সরল, কৃষিজীবী মানুষ। জমিদারি প্রথার প্রসার ঘটলে জমিদাররা কৌশলে মুন্ডাদের জমিগুলি খাস জমিতে পরিণত করে নেয় এবং ক্রমাগত খাজনার হারের বৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। এ ছাড়া মুন্ডাদের জমিদার, মহাজনদের নানারকম বেগার শ্রম দিতে হত। মহাজনরা মুন্ডাদের কাছ থেকে বিশাল সুদও আদায় করতো। এইসব কারণে মুন্ডাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সরকারি প্রশাসন ছিল জমিদার ও মহাজনদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত; ফলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল জমিদার ও মহাজনদের ওপর।
মুন্ডা বিদ্রোহ কোথায় কোথায় প্রসার ঘটে?
1899-1900 খ্রিস্টাব্দের মুন্ডা বিদ্রোহ রাঁচি, হাজারিবাগ, ছোটোনাগপুর, সিংভূমের পার্বত্য অঞ্চল প্রভৃতি জায়গায় প্রসার লাভ করে।
মুন্ডা বিদ্রোহের জন্য সামাজিক ব্যবস্থা কীভাবে দায়ী?
মালিক; তাই তাদের সমাজে প্রচলন ছিল খুঁৎকাঠি প্রথা। কিন্তু -মুন্ডারা বিশ্বাস করত তাঁরাই হল জমির সত্যিকারের ব্রিটিশ শাসনের প্রবর্তন হলে তাদের সেই চিরাচরিত প্রথাকে ভেঙে ফেলে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও সরকার মুন্ডাদের চিরাচরিত মুন্ডারি আইন, বিচার ও সামাজিক ব্যবস্থাসমূহ বাতিল করে তাদের জন্য নতুন আইন প্রচলন করলে মুন্ডারা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। এভাবে মুন্ডাদের প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার ভাঙন ছিল মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
মুন্ডা বিদ্রোহীরা কেন খ্রিস্টান মিশনারিদের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়েছিল?
মুন্ডারা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু মানুষ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারিরা মুন্ডাদের ধর্ম অর্থাৎ মুন্ডারি ধর্ম ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার চালায়। খ্রিস্টান মিশনারিরা নানা প্রলোভন দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে মুন্ডাদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে ধর্মান্তরিত করতে থাকলে মুন্ডারি ধর্মের ধারক ও বাহক মুন্ডারা তাদের ওপর অসম্ভব ক্ষুব্ধ হয়। এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হল মুন্ডা বিদ্রোহ। মিশনারিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লুথারান ও অ্যাংলিকান গোষ্ঠী। স্বাভাবিক কারণেই মুন্ডাদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল খ্রিস্টান মিশনারিরা।
মাঝিহাম মানে কী? ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে শেষ উল্লেখযোগ্য উপজাতি বিদ্রোহ কোনটি?
মাঝিহাম মানে খাসজমি। মুন্ডাদের এলাকায় বহিরাগত ঠিকাদার, মহাজন ও জমিদার শ্রেণি ওই অঞ্চলের জমি (ভূঁইহারি জমি) থেকে মুন্ডাদের বিতাড়িত করে সেগুলি নিজেদের খাসজমিতে পরিণত করে। এইরূপ জমিই মাঝিহাম নামে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে শেষ উপজাতি বিদ্রোহ হল মুণ্ডা বিদ্রোহ (1899-1900 খ্রিস্টাব্দ)।
ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন কবে, কেন পাস হয়?
ব্রিটিশ সরকার 1908 খ্রিস্টাব্দে মুণ্ডাদের অভাব অভিযোগ শুনে সেগুলির সুষ্ঠু সমাধানকল্পে ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে।
মুণ্ডা বিদ্রোহের ফলাফল কী হয়েছিল?
মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। উল্লেখযোগ্য ফলাফলগুলি হল —
- এর ফলে মুন্ডাদের জমিতে খুঁৎকাঠি স্বত্ব পুনঃপ্রবর্তিত হয়।
- ব্রিটিশ সরকার ছোটোনাগপুর অঞ্চলের জন্য ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে।
- এই অঞ্চলের জন্য আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
- বেট বেগার বেগাড়ি নিষিদ্ধ হয়।
- বিরসা সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
ওয়াহাবি কথাটির অর্থ কী? ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্তক কে?
ওয়াহাব শব্দের অর্থ নবজাগরণ। ওয়াহাবি আন্দোলনের নামকরণ হয় আব্দুল ওয়াহাবের নামানুসারে। ওয়াহাবি আন্দোলনের আসল নাম ‘তারিখ-ই-মহম্মদিয়া’ (মহম্মদ নির্দেশিত পথ)। ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন আরব দেশের মহম্মদ-বিন-আব্দুল ওয়াহাব নামক একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। ভারতে এই আন্দোলনের প্রবর্তন করেন দিল্লির সুবিখ্যাত মুসলিম সম্ভ শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর পুত্র আজিজ।
ওয়াহাবি ও ওয়াহাবিবাদ কাকে বলা হয়?
আব্দুল ওয়াহাবের অনুগামীদের বলা হয় ওয়াহাবি; যারা ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধন এবং পুনরুজ্জীবনের জন্য ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। ওয়াহাবি আন্দোলনকারীদের প্রচারিত ধর্মমত ওয়াহাবিবাদ নামে পরিচিত।
ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার দূর করে তারিখ-ই-মহম্মদিয়া প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই আন্দোলনের সূচনা হলেও ক্রমেই তা ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এ ছাড়াও এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল অত্যাচারী শাসক ও জমিদারদের শোষণ থেকে কৃষকদের মুক্ত করা, নিম্নবর্গের মানুষদের আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত করা এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন ও সরকারি উচ্চ পদ গুলিতে ইংরেজদের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরোধিতা করা।
ওয়াহাবি আন্দোলন ভারতের কোন্ কোন্ অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল?
ওয়াহাবি আন্দোলন ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হায়দারাবাদ, বাংলা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল।
দার-উল-হারব ও দার-উল-ইসলাম বলতে কী বোঝায়?
দার-উল-হারব বলতে বোঝায় বিধর্মীদের দেশ বা শত্রুর দেশ। ভারতের ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সৈয়দ আহম্মদ ব্রিটিশ শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ বলে চিহ্নিত করেন। ‘দার-উল-ইসলাম’ কথার অর্থ হচ্ছে ধর্মরাজ্য বা ইসলামের দেশ। অর্থাৎ বিধর্মী ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে ‘দার-উল-ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ওয়াহাবিদের অন্যতম লক্ষ্য।
সৈয়দ আহম্মদ কে ছিলেন?
সৈয়দ আহম্মদ (1786-1831 খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন ভারতের ওয়াহাবি আন্দোলনের পুরোধা। তিনি ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির বাসিন্দা। তিনি মক্কায় গিয়ে ওয়াহাবি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে ফিরে এসে এই ধর্মীয়-রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং তাঁর অনুগামীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি ঘোষণা করেন ধর্মযুদ্ধ দ্বারা ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদের প্রয়োজন।
বালাকোট যুদ্ধে কে, কেন শহিদ হন?
1831 খ্রিস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সৈয়দ আহম্মদ পরাজিত ও নিহত হন। শিখদের নির্যাতনের হাত থেকে পাঞ্জাবের মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য সৈয়দ আহম্মদ জেহাদের ঘোষণা করেন এবং বালাকোটের যুদ্ধে তিনি শহিদ হন।
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্তন কে করেন? কোথায় এই আন্দোলনের প্রধান ঘাঁটি ছিল?
বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্তক তথা নেতা ছিলেন মীর নিসার আলি বা তিতুমির (1782-1831 খ্রিস্টাব্দ)। এই আন্দোলনের প্রধান ঘাঁটি ছিল উত্তর 24 পরগনা জেলার নারকেলবেড়িয়া গ্রাম নামক স্থান।
তিতুমির কে ছিলেন? তিনি কাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন?
তিতুমির ছিলেন বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা। তিনি জমিদার শ্রেণি, নীলকর ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।
তিতুমির কে এবং কেন মনে রাখা হয়?
ওয়াহাবি আন্দোলনের বাংলার প্রধান নেতা ছিলেন তিতুমির। তাঁর নেতৃত্বে বারাসত বিদ্রোহ ছিল ধর্মীয় আন্দোলনের মোড়কে অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এক গ্রামীণ প্রতিবাদী আন্দোলন। তিনি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বাঁশের কেল্লার মধ্যেই বীরের মতো প্রাণ বিসর্জন দেন। বারাসত বিদ্রোহের নায়ক হিসেবেই তাঁকে মনে রাখা হয়।
তিতুমির কাদের নিয়ে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় ওয়াহাবি আন্দোলন গড়ে তোলেন?
বাংলাদেশের ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ তিতুমির জমিদার ও ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে চাষি ও বেকার জোলাদের সংঘবদ্ধ করে নদিয়া, যশোহর ও 24 পরগনা জেলায় গণআন্দোলন গড়ে তোলেন—যা বারাসত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
বাঁশের কেল্লা কে, কোথায় স্থাপন করেন?
তিতুমির ওরফে মির নিশার আলি বাঁশের কেল্লা স্থাপন করেন। বাঁশের কেল্লা স্থাপিত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের 24 পরগনা জেলার নারকেলবেড়িয়া গ্রামে।
তিতুমির বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন কেন?
বিদ্রোহী দরিদ্র মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং ইংরেজ সরকার ও জমিদারের আক্রমণ প্রতিহত করতে তিতুমির বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। বাঁশের কেল্লায় সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে তিনি একটি পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তিতুমির কোথায় ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেন? বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
তিতুমির 24 পরগনা জেলার নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে সেখানে প্রায় 500 অনুগামীদের সমবেত করে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেন। ওয়াহাবি আন্দোলনে বাংলার প্রধান নেতা ছিলেন তিতুমির। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ববৃন্দ হলেন এনায়েৎ আলি, মহম্মদ হোসেন, বিলায়েৎ আলি, মিসকিন শাহ, গোলাম মাসুম প্রমুখ।
তিতুমির কী উপাধি ধারণ করেন? তাঁর উচ্চপদস্থ কর্মচারী হিসেবে কারা নিযুক্ত হন?
তিতুমির বাদশাহ উপাধি ধারণ করেন। তিতুমিরের প্রধান উপদেষ্টা হন মকিন শাহ নামে এক ফকির, মন্ত্রীপদে নিযুক্ত হন মৈনুদ্দিন নামক একজন জোলা, সেনাপতি নিযুক্ত হন গোলাম মাসুম এবং মিস্কিন শাহ ছিলেন তিতুমিরের গোয়েন্দাবাহিনীর প্রধান। তিতুমিরের সমস্ত পদাধিকারীই ছিলেন দরিদ্র কৃষক পরিবারের অন্তর্গত।
তিতুমিরের প্রথম জীবন সম্পর্কে কী জানো?
তিতুমির 1782 খ্রিস্টাব্দে 24 পরগনা জেলার চাঁদপুর নামক গ্রামে এক গৃহস্থ চাষির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথম জীবনে নদিয়ার জমিদারের অধীনে লেঠেলের কাজ করতেন। সে সময় তিনি দরিদ্র কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সময় জমিদারের অত্যাচারের স্বরূপ দেখেছিলেন। যৌবনে তিনি হজ করাতে মক্কায় যান এবং সেখানে তার সাথে সাক্ষাৎ হয় সৈয়দ আহম্মদের। সৈয়দ আহম্মদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বাংলাদেশে ওয়াহাবি আদর্শ প্রচার করেন।
কে, কবে বারাসত বিদ্রোহের সূচনা করেন?
বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ তিতুমির ওরফে মীর নিসার আলি বারাসত মহকুমায় যে বিদ্রোহের সূচনা করেন তা বারাসত বিদ্রোহ নামে পরিচিত। 1830 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1831 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ হয়।
বারাসত বিদ্রোহের কারণ কী?
বারাসত বিদ্রোহের কারণগুলি হল—
- ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধন ও বিশুদ্ধতা প্রতিষ্ঠা।
- জমিদার, নীলকর, পুলিশ, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের শোষণ ও শাসন থেকে দরিদ্র কৃষক, জোলা ও অন্যান্য পেশার মানুষদের মুক্তিদান করা।
- জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ও কুরগাছি এবং নগরপুরের জমিদারদের অত্যাচারের বিহিত করা এবং ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য বিদ্রোহের সূচনা করেন তিতুমির।
তিতুমির তথা ওয়াহাবিরা জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন কেন?
বারাসত অঞ্চলে ওয়াহাবিদের প্রভাব বৃদ্ধি পেলে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তাদের কর্তৃত্ব খর্ব করার জন্য ওয়াহাবিদের দাড়ির ওপর আড়াই টাকা কর ধার্য করেন। মসজিদ নির্মাণ ও মুসলিম নামকরণের জন্যও কর ধার্য করেন। এমনকি মাঝে মাঝে ওয়াহাবিদের দাড়ি উপড়ে নিতেন। কৃষ্ণদেব রায় পাইক-বরকন্দাজ নিয়ে গ্রামের একটি মসজিদে অগ্নি সংযোগ করেন। এছাড়াও ওয়াহাবিদের নামে মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করে কাছারিতে এনে ভীষণ নির্যাতন চালালে কৃষ্ণদেব রায়ের ওপর ওয়াহাবিরা ক্ষুব্ধ হয় এবং প্রতিবাদ স্বরূপ তার গ্রামে আক্রমণ করে।
বাঁশের কেল্লা সম্পর্কে কী জানো?
বারাসতের কাছে নারকেলবেড়িয়া গ্রামে তিতুমির চাষি ও বেকারদের সংঘবদ্ধ করে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। তিনি এখানে অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করে নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন এবং জমিদারদের খাজনা দিতে নিষেধ করে নিজে খাজনা দাবি করেন। বাঁশের কেল্লা ছিল দরিদ্র মানুষের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কলকাতা থেকে আগত ইংরেজ বাহিনীর গোলার আঘাতে বাঁশের কেল্লা পুড়ে যায় এবং বাঁশের কেল্লার মধ্যেই তিতুমিরের মৃত্যু হয় (1831 খ্রিস্টাব্দ)।
বারাসত বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণগুলি কী কী?
বারাসত বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণগুলি হল—
- বিশাল সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর (গোলন্দাজ, অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী) একযোগে আক্রমণ।
- ইংরেজ বাহিনীর কামান ব্যবহার।
- কামানের আঘাতে বাঁশের কেল্লার ধ্বংস।
- তিতুমির ও তার সহযোদ্ধাদের মৃত্যুবরণ।
- বিদ্রোহীদের উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র ও গঠনমূলক কর্মসূচির অভাব প্রভৃতি কারণে বারাসত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল।
তিতুমির ও তার সাথিদের কী পরিণতি হয়েছিল?
তিতুমির যুদ্ধক্ষেত্রেই বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেন। বহু বিদ্রোহী যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। তিতুমিরের প্রায় 800 জন অনুগামীকে বন্দি করা হয়। তিতুমিরের প্রধান সেনাপতি গোলাম মাসুমের ফাঁসি হয়। অন্যান্য বিদ্রোহীদের অধিকাংশের দ্বীপান্তর হয়। অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে ইংরেজ বাহিনী বারাসত বিদ্রোহ দমন করেন।
ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার দুটি কারণ উল্লেখ করো।
ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার নানাবিধ কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি কারণ হল—
- গঠনমূলক কর্মসূচি এবং উপযুক্ত সংগঠন ও সংগঠকের অভাব।
- এটি একটি ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হওয়ায় ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা, বড়ো জমিদাররা এই আন্দোলনে শামিল হননি।
কবে বাংলাদেশে ওয়াহাবি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে? বিদ্রোহীরা নানা জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে কেন?
1831 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ওয়াহাবি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। জমিদারদের কাছারিবাড়ি, নীলকুঠিগুলি আক্রমণ ও ধ্বংস করে বিদ্রোহীরা অগ্নিসংযোগ করেন, কারণ যাতে তাদের ঋণসংক্রান্ত যাবতীয় প্রমাণ লোপাট করা যায়।
মালগুজারি ও মুওয়াহেদুন বলতে কী বোঝো?
মালগুজারি কথার অর্থ হল খাজনা। মুওয়াহ্হেদুন বলতে বোঝায় খাঁটি একেশ্বরবাদী। ওয়াহাবিরা নিজেদের মুওয়াহেদুন বলে পরিচয় দিতেন।
তিতুমির এবং তাঁর অনুগামীরা কিসের বিরোধী ছিলেন?
তিতুমিরের অনুগামীরা—
- মূর্তিপূজা
- পিরের পূজা
- মহাজনি কারবার
- কুসংস্কার
- ব্রিটিশ শাসন প্রভৃতির বিরোধী ছিলেন।
তিতুমিরের বারাসত বিদ্রোহ ক্রমশ ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করে কেন?
ধর্মীয় সংস্কার সাধনের লক্ষ্য নিয়ে বারাসত বিদ্রোহের সূচনা হলেও ক্রমশ তা ইংরেজ বিরোধী হয়ে উঠেছিল, কারণ—
- ঔপনিবেশিক ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা।
- অবশিল্পায়ন।
- নীলকর ও জমিদারদের শোষণ (বিদ্রোহীরা জমিদারদেরও ইংরেজ শাসনের অংশ মনে করত) প্রভৃতি।
ওয়াহাবি আন্দোলনের ভারতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নেতার নাম লেখো।
সৈয়দ আহম্মদ, বিলায়েৎ আলি ও এনায়েৎ আলি (পাটনা), কেরামত আলি (জৌনপুর), জৈনুদ্দিন (হায়দ্রাবাদ), ইমামত আলি (বেরিলী), তিতুমির (বাংলাদেশ) প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিলেন ওয়াহাবি আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব।
তিতুমিরের সংগ্রামের প্রকৃতি কী ছিল?
তিতুমিরের জীবনীকার বিহারীলাল সরকারের মতে, বহু হিন্দু তিতুমিরের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। আবার বহু মুসলিম ভূস্বামীরাও ওয়াহাবিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুতরাং তিতুমিরের সংগ্রাম ধর্মকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও ক্রমশ তা সংকীর্ণ ধর্মীয় সীমারেখা অতিক্রম করে দরিদ্র মানুষের জমিদার ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদী সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে।
ফরাজি কথার অর্থ কী? কে এই আন্দোলনের প্রবর্তন করেন?
ফরাজি কথাটি এসেছে আরবি শব্দ ফরাইজ থেকে। ফরাইজ-এর অর্থ আল্লাহর আদেশ অনুসরণ। ফরাজি কথার অর্থ হল—আল্লাহর আদেশ অনুসরণকারী। ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তন করেছিলেন হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ (1781-1837 খ্রিস্টাব্দ)।
ফরাজি কী? মহম্মদ মহসীন আলাউদ্দিন আহমদ কী নামে জনপ্রিয়?
ফরাজি হল একটি মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠীর নাম। মহম্মদ মহসীন আলাউদ্দিন আহমদ দুদু মিঞা নামে জনপ্রিয়।
ফরাজি আন্দোলন ভারতবর্ষের কোথায় কোথায় ছড়িয়ে পড়ে?
পূর্ববাংলার ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, পাবনা, নোয়াখালি ও ত্রিপুরায় ফরাজি আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এটি জমিদার, নীলকর, ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী রূপ পরিগ্রহ করে।
ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কারা?
ফরাজি আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন হাজি শরিয়ত উল্লাহ। তাঁর মৃত্যুর পর (1840) তাঁর পুত্র দুদু মিঞা ফরাজি আন্দোলনকে সাংগঠনিকভাবে পরিপূর্ণ রূপ প্রদান করেন। দুদু মিঞার মৃত্যুর পর (1862) তার পুত্র নোয়া মিঞা ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেন।
ফরাজি আন্দোলন কী কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় আন্দোলন?
হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য ফরাজি আন্দোলন শুরু করলেও তার পুত্র দুদু মিঞা একে ধর্মীয় মোড়ক থেকে কিছুটা বের করে কৃষক আন্দোলনে উন্নীত করেছিলেন। দুদু মিঞা প্রচার করেন জমি আল্লাহর দান এবং সেখানে জমিদারের কর ধার্য করার অধিকার নেই। তাঁর এই বক্তব্যে বহু হিন্দু-মুসলিম কৃষকরা প্রভাবিত হয়েছিল। তাই একে সম্পূর্ণ ধর্মীয় আন্দোলন বলা যাবে না বরং একে জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন বলা শ্রেয়।
ফরাজি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
ফরাজি আন্দোলন ছিল একটি ব্রিটিশ বিরোধী ধর্মভিত্তিক আন্দোলন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ফরাইজ অর্থাৎ কোরানে নির্দিষ্ট পাঁচটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য যাতে সকল মুসলমান সমাজ মেনে চলে তার জন্য প্রচার কার্য চালানো। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার দূর করে বাংলাদেশকে ‘দার-উল-ইসলামে’ পরিণত করা।
দুদু মিঞা স্মরণীয় কেন?
প্রখর রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি দুদু মিঞা ছিলেন বাংলার ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। শরিয়ৎ উল্লাহর পুত্র, দক্ষ সংগঠক এবং ফরাজি আন্দোলনের অন্যতম নেতা দুদু মিঞার সুযোগ্য নেতৃত্বে ফরাজি আন্দোলন ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন থেকে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়—এ জন্যই দুদু মিঞা স্মরণীয়।
ফরাজি খিলাফৎ বলতে কী বোঝ?
ফরাজিদের সুশৃঙ্খল প্রশাসনকে বলা হয় ফরাজি খিলাফৎ। দুদু মিঞা ছিলেন এই প্রশাসনের স্রষ্টা এবং সর্বোচ্চ পদাধিকারী। তাঁকে বলা হত ওস্তাদ। তাঁর সাহায্যকারীদের বলা হত খলিফা। পূর্ববঙ্গকে তিনি কয়েকটি হল্কায় (অঞ্চলে) বিভক্ত করে ফরাজিদের সংঘবদ্ধ করেন। বাহাদুরপুর ছিল দুদু মিঞার ফরাজি খিলাফৎ-এর প্রধান কার্যালয়।
ফরাজিদের বে-জুম্মাওয়ালা বলা হয় কেন?
ফরাজিরা জুম্মা বা ইদের প্রার্থনায় আপত্তি করতেন বলে এদের বলা হয় বে-জুম্মাওয়ালা। ফরাজিগণ জুম্মা ও ইদ উৎসবের তীব্র বিরোধী ছিলেন। তাঁদের মতে ইংরেজ অধ্যুষিত ভারতবর্ষ ছিল দার-উল-হারব বা বিধর্মীদের দেশ। সুতরাং এই অবস্থায় ভারতে জুম্মা প্রার্থনা উচিত নয় বলে তারা মনে করতেন।
ফরাজি আন্দোলন অন্য কী নামে পরিচিত? হাজি শরিয়ত উল্লাহ কোন আদর্শে বিশ্বাস করতেন?
ফরাজি আন্দোলনের অন্য নাম মিঞা আন্দোলন। হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ আদি-ইসলামীয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন।
দুদু মিঞা কি প্রচার করেছিলেন? তাঁর আদর্শ দ্বারা কারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন?
দুদু মিঞা প্রচার করেন জমি আল্লাহর দান, সুতরাং সেখানে জমিদারের কর ধার্য করার অধিকার নেই। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বহু তাঁতি ও মুসলিম কৃষক সম্প্রদায়।
খলিফা কাদের বলা হত?
ফরাজি খিলাফৎ অনুসারে পূর্ববঙ্গকে কয়টি হল্কায় বিভক্ত করা হয়। হল্কার (অঞ্চল) দায়িত্বে যারা থাকতেন তাদের বলা হত খলিফা। খলিফারা ওস্তাদ (শীর্ষ প্রশাসক)-কে সবসময় সাহায্য করত। খলিফারা নিজ এলাকার সংবাদ সবসময় ওস্তাদের কাছে পাঠাতেন।
দুদু মিঞা তথা ফরাজিরা কেন জমিদারদের দুর্গাপূজা কর প্রদানে বিরোধী ছিলেন?
দুদু মিঞা তথা ফরাজিরা পৌত্তলিকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাই তাঁরা দুর্গাপূজা কর প্রদানে অস্বীকার করেন। তা ছাড়া দুর্গাপূজা করকে তারা উৎপীড়নমূলক কর বলে মনে করতেন।
দুদু মিঞা কবে, কাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেন?
1838 খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞা জমিদার, রক্ষণশীল মুসলমান ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেন।
ফরাজি আন্দোলনের দুটি বৈশিষ্ট্য লেখো।
ফরাজি আন্দোলনের দুটি বৈশিষ্ট্য হল—
- ফরাজি আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মীয় সংস্কারমূলক। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠী।
- এই আন্দোলন বহিরাগত ধর্মীয় আন্দোলন (সৌদি ওয়াহাবিবাদ) থেকে অনুপ্রাণিত।
দুদু মিঞা কী কী কাজের মাধ্যমে ফরাজি আন্দোলনকে সুসংবদ্ধ করেন?
শরিয়ৎ উল্লাহর পুত্র দুদু মিঞা 1840 থেকে 1862 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বাহাদুরপুরে প্রধান কার্যালয় স্থাপন, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তন, লাঠিয়াল ও গুপ্তচর বাহিনী গঠন, প্রভাবাধীন এলাকাকে কয়েকটি হল্কায় বিভক্ত করে প্রতি হল্কায় খলিফা নিয়োগ, অর্থ সংগ্রহ ও কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করা, জমিদার ও নীলকরদের আক্রমণ করা প্রভৃতি কাজ করে ফরাজি আন্দোলনকে সুসংবদ্ধ করেন।
হাজী শরিয়ত উল্লাহ স্মরণীয় কেন?
ইসলাম ধর্মতত্ত্বে সুপণ্ডিত ফরিদপুরের হাজী শরিয়ত উল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশে ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক। তাঁর নেতৃত্বে নির্যাতিত কৃষকদের স্বার্থে ইসলামীয় পুনরুজ্জীবনবাদী ফরাজি আন্দোলন ক্রমে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করে নীলকর, জমিদার ও ব্রিটিশ বিরোধী হয়ে উঠে। বাখরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুরে তাঁর আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। 1840 খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। ফরাজি আন্দোলনে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয়।
ফরাজি আন্দোলন কী হিন্দু বিরোধী ছিল?
ফরাজি আন্দোলন ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও ক্রমশ তা জমিদার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। অধিকাংশ জমিদাররাই ছিল হিন্দু। তবুও এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ফরাজি আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে হিন্দু বিরোধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল না, কারণ এই আন্দোলনে মুসলমান কৃষকদের পাশাপাশি বহু হিন্দু কৃষকও শামিল হয়েছিল। তাই এই আন্দোলনকে হিন্দু বিরোধী আন্দোলন না বলে নিপীড়িত কৃষকদের শোষণের হাত থেকে মুক্তির আন্দোলন বলাই শ্রেয়।
ফরাজি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ/সীমাবদ্ধতা কী ছিল?
ফরাজি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি হল—
- দুদু মিঞার পর ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করার মতো উপযুক্ত নেতার অভাব।
- ইংরেজ ও জমিদার বিরোধিতার বদলে ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বদান।
- ধর্মীয় সংকীর্ণতা।
- রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব।
- পূর্ববঙ্গের সংকীর্ণ স্থানে সীমাবদ্ধ।
- সরকারি দমননীতি প্রভৃতি।
দুদু মিঞার মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলনের জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল কেন?
দুদু মিঞার মৃত্যুর পর (1862) তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ না করে ধর্ম সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। ফলে এই আন্দোলন রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধর্মীয় আন্দোলনে পরিণত হলে ফরাজি আন্দোলনের জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়ে যায়।
ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব কী?
ফরাজি আন্দোলন ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া। ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এই আন্দোলন পরে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষিজীবী মুসলমান শ্রেণি। এইসব দিক থেকে এই আন্দোলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের সাদৃশ্যগুলি কী কী?
ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের সাদৃশ্যগুলি হল—
- আন্দোলন দুটির প্রেরণা এসেছিল ভারতের বাইরে থেকে (সৌদি আরব)।
- দুটি আন্দোলনই ছিল ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন।
- দুটি আন্দোলনেই ধর্মীয় প্রভাব লক্ষ করা যায়।
- আর্থ-সামাজিক দিক থেকে দুটি আন্দোলনই ছিল সামন্ততন্ত্র বিরোধী।
- দুটি আন্দোলনেই ব্রিটিশ বিরোধিতা দেখা যায়।
নীল বিদ্রোহ অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহ থেকে আলাদা কেন?
নীল বিদ্রোহ অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহ থেকে আলাদা কারণ, এটি ছিল একটি নির্দিষ্ট শোষক গোষ্ঠী (নীলকর ইউরোপীয় ব্যবসায়ী)-এর বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন। এই বিদ্রোহে কৃষক, ক্ষুদ্র জমিদার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করেছিল। এমনকি কয়েকজন খ্রিস্টান মিশনারিও বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, যা অন্য কোনো বিদ্রোহে পরিলক্ষিত হয়নি।
নীলকররা ভারতে নীলচাষে কেন আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন?
ইংল্যান্ড ও ইউরোপে বস্ত্র শিল্পের বিকাশ, বস্ত্র রঞ্জনের জন্য নীলের প্রয়োজনীয়তা (কেননা তখনও কৃত্রিম রঞ্জনদ্রব্যের আবিষ্কার হয়নি), নীল রপ্তানি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন প্রভৃতি কারণে নীলকররা ভারতে নীলচাষে আগ্রহী হয়ে উঠে। নীলকরদের লক্ষ্য ছিল অল্পব্যয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা।
নীলবিদ্রোহ কোথায় কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?
নীলবিদ্রোহ বঙ্গদেশে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। বারাসত, যশোহর, পাবনা, খুলনা, রাজশাহী, মালদহ, ফরিদপুর, মুরশিদাবাদ, 24 পরগনা, নদিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি গ্রামের কৃষকরাই নীলবিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন।
নীলবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কারা?
কৃষক সমাজের উপর সুদীর্ঘকালের অমানুষিক অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা নীলবিদ্রোহে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা হলেন—বিচরণ বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস, মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রফিক মণ্ডল, কাদের মোল্লা, মেঘাই সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার প্রমুখ। বঙ্গদেশে 60 লক্ষাধিক কৃষক এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।
নীলবিদ্রোহ কীভাবে সশস্ত্র অভুত্থানের রূপ পরিগ্রহ করে?
প্রশাসনিক স্তরে দীর্ঘদিন আবেদন-নিবেদন করে কোনো সুফল না পাওয়ায় নীলচাষিরা নীলচাষ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাহায্যে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হলে নীলবিদ্রোহ সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে। বিদ্রোহীরা নীলকুঠিগুলি আক্রমণ করে (নদিয়ার কুঠিয়াল স্যামুয়েল ফেড়িকে আক্রমণ; খুলনার অত্যাচারী কুঠিয়াল রেনীকে আক্রমণ)। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে চাষিদের এইভাবে نীলবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করায় ইংরেজ শাসকরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
বিশ্বনাথ সর্দার কে ছিলেন?
বিশ্বনাথ সর্দার ছিলেন বাংলাদেশের নীলবিদ্রোহের অন্যতম পুরোধা। নদিয়া জেলায় চৌগাছা গ্রামের বিশ্বনাথ সর্দার ‘বিশে ডাকাত’ নামে পরিচিত ছিলেন। নদিয়ার ভয়ানক কুঠিয়াল স্যামুয়েল ফেড়িকে তিনি আক্রমণ করেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিশ্বনাথ সর্দারের ফাঁসি হয়। তিনি ছিলেন নীল বিদ্রোহের প্রথম শহিদ।
নীলবিদ্রোহ কাকে বলে? কোথায় এই বিদ্রোহ প্রথম শুরু হয়?
1859-60 খ্রিস্টাব্দে শ্বেতাঙ্গ নীলকরদের বিরুদ্ধে বাংলার নীলচাষিদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ নীলবিদ্রোহ নামে পরিচিত। নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর মহকুমার চৌগাছা গ্রামে 1859 খ্রিস্টাব্দে প্রথম নীলবিদ্রোহ শুরু হয়।
কৃষকরা কেন নীল চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন?
নীলের বাজার দর 10 টাকা থাকা সত্ত্বেও কৃষকরা নীলের দাম পেত গড়ে 2 টাকা আট আনা। এক বিঘে জমিতে নীলচাষ করতে রায়তদের খরচ হত 13 টাকা 6 আনা। আর ওই নীল বিক্রি করে তাঁরা পেত মাত্র 4 টাকা। অথচ ওই একই জমিতে তামাক উৎপাদন করলে তাদের 24 টাকা খরচ হত আর সেই তামাক বিক্রি হত 35 টাকায়। কিংবা ধান উৎপাদন করলে তাদের সারা বছরের খোরাকি হয়ে যেত। এইসব কারণে কৃষকরা নীলচাষ করতে চাইতেন না।
দাদন প্রথা নীলচাষিদের কীভাবে ক্ষতি করেছিল?
দাদন কথার অর্থ হল অগ্রিম। ছলে-বলে-কৌশলে কৃষকদের অগ্রিম প্রদান করে কৃষকদের উৎপাদিত নীল কুঠিতে জমা দিতে বাধ্য করত। দাদন নেওয়া চাষি কতটা জমিতে নীলচাষ করবে তা মেপে দিত নীলকররা। এতে প্রচণ্ড পরিমাণ কারচুপি ছিল (11 বিঘে জমিকে 7 বিঘে ধরে নেওয়া)। সমাচার দর্পণের মতে, ‘যে চাষি দাদন নেয়, তার মরণ পর্যন্ত খালাস নেই।’
নীলকর সাহেবরা রায়তদের জমিতে নীলচাষ করতে বেশি পছন্দ করতেন কেন?
1833 খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইন দ্বারা ইউরোপীয়রা এদেশে জমি কেনার অধিকার পেলেও তারা তা না করে রায়তদের জমিতেই নীলচাষ করতে বেশি পছন্দ করত। কারণ রায়ত নিজের ব্যয়ে লাঙল, সার, বীজ ও নিজের পরিশ্রমে নীল উৎপাদন করত এবং দাদন নেওয়ার জন্য তারা نীলকরদের সেই নীল প্রদানে বাধ্য থাকতো। এতে নীলকরদের প্রচুর লাভ হত। কোনো রকম দুশ্চিন্তা ছাড়াই তারা মাত্র 400 টাকা খরচ করে লাভ করত 1750 টাকা।
বিশ্বনাথ সর্দার ও শিবনাথ ঘোষ কোন্ কোন্ কুঠিয়ালকে আক্রমণ করেছিলেন?
বাংলার ‘রবিন হুড’ তথা নীল বিদ্রোহের পথিকৃৎ বিশ্বনাথ সর্দার তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে অত্যাচারী কুঠিয়াল স্যামুয়েল ফেড়িকে আক্রমণ করেছিলেন। শিবনাথ ঘোষ খুলনার অত্যাচারী কুঠিয়াল রেনীকে আক্রমণ করেছিলেন।
নীলচাষি তথা নীলবিদ্রোহীরা কাদের কাদের সাহায্য পেয়েছিলেন?
বাংলার বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি জমিদার, জোতদার, মহাজন এই বিদ্রোহকে কেবল সমর্থন বা সাহায্যই করেননি বরং তাঁরা নেতৃত্ব প্রদানও করেছেন। এ ছাড়াও কয়েকজন খ্রিস্টান মিশনারিও বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
বঙ্গদেশে নীলবিদ্রোহে কত কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল? তাদের সংগ্রামী কৌশল কী ছিল?
নীলবিদ্রোহে বঙ্গদেশের প্রায় 60 লক্ষাধিক কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল। নীলবিদ্রোহীরা নীলচাষ বন্ধ করে দিতে এক অভিনব সংগ্রামী কৌশল অবলম্বন করেছিলেন – ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গ্রামবাসীদের সতর্ক করা, লাঠি-বল্লম নিয়ে সমবেত হওয়া এবং নীলকরের দলকে আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেওয়া।
নীলচাষ করতে না চাইলে কৃষকদের ওপর কেমন অত্যাচার করা হত?
চাষিরা নীলচাষ করতে না চাইলে নীলকরদের লাঠিয়াল, পাইক, বরকন্দাজ বাহিনী তাদের ধরে এনে মারধোর করত, কুঠিতে আটকে রাখত, গোপন স্থানে এনে আড়ং ধোলাই (বেত্রাঘাত) দিত, ধান-তামাকের জমি নষ্ট করত, গোরু-বাছুর হরণ করত এবং চাবুক পেটা করত।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কারা কারা নীল বিদ্রোহের প্রতি সমর্থন জানায়?
বাংলার মধ্যবিত্ত বহু মানুষ নীল বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, শিশির কুমার ঘোষ, গিরিশ ঘোষ, মনমোহন ঘোষ, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, কিশোরীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ। তাঁরা মামলা মোকদ্দমার খরচ বহন করতেন এবং লেখনীর মাধ্যমে নীলকরদের অত্যাচার জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতেন।
কোন্ কোন্ পত্র পত্রিকা ও লেখা থেকে নীলবিদ্রোহের কথা জানা যায়?
1820-30-এর দশকে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ ও ‘সমাচার দর্পণে’ প্রথম নীলকরদের অত্যাচারের কথা প্রকাশ হয়। পরবর্তীকালে তত্ত্ববোধিনী, হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি বর্ণিত হয়। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ (1860) নাটক নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি বিশ্বব্যাপী প্রচার করে।
ওয়াট-টাইলর নামে কারা পরিচিত? তারা কেন স্মরণীয়?
বাংলাদেশের ‘ওয়াট-টাইলর’ নামে পরিচিত ছিলেন দিগম্বর বিশ্বাস ও বিচরণ বিশ্বাস নামক ভ্রাতৃদ্বয়। চৌগাছা গ্রামের এই ভ্রাতৃদ্বয় প্রথম জীবনে ছিলেন নীলকুঠির কর্মচারী এবং পরবর্তীকালে তাঁরা নীলবিদ্রোহের নেতা হয়ে ওঠেন। তাঁরা তাদের সর্বস্ব ব্যয় করে রায়তদের রক্ষা করার জন্য লাঠিয়াল নিয়োগ করেন এবং মামলা-মোকদ্দমায় সহায়তা করেন। প্রায় 17 হাজার টাকা তারা রায়তদের স্বার্থে ব্যয় করেছিলেন।
নীলবিদ্রোহের সঙ্গে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় – এর সম্পর্ক কী?
হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক ও নীলচাষিদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। তাঁর পত্রিকায় নিয়মিতভাবে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশিত হত। তিনি নীলচাষিদের মামলা চালাবার জন্য অর্থসাহায্য করেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর মতে, “নীলকর অত্যাচার নিবারণ হরিশের এক অক্ষয় কীর্তি। এই কার্যে তিনি দেহ, মন, অর্থ, সামর্থ্য সমর্পণ করিয়াছিলেন”
নীলদর্পণ নাটক সম্পর্কে কী জানো?
‘নীলদর্পণ’ নাটকটির লেখক দীনবন্ধু মিত্র (1860)। এতে নীলকরদের অত্যাচারে একটি কৃষক পরিবারের ধ্বংসের মর্মস্পর্শী কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং পাদ্রী জেমস লং সাহেবের নামে প্রকাশিত হলে তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই নাটক নীলচাষিদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে।
নীল কমিশন কবে এবং কেন গঠিত হয়েছিল?
1860 খ্রিস্টাব্দের 31 মার্চ নীল কমিশন গঠিত হয়। নীলচাষিদের অভিযোগ ও বিক্ষোভ সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য এই কমission গঠন করা হয়।
নীল কমিশন (Indigo Commission) কী কী সুপারিশ করেন?
নীল কমিশনের সুপারিশগুলি হল—
- নীলকরদের ব্যবসা “মূলত ভ্রান্ত, কার্যত ক্ষতিকারক এবং উদ্দেশ্যগত বিচারে পাপমূলক”।
- নীলকরদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি সত্য বলে স্বীকার করা হয়।
- রায়তদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীল চাষ বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
নীলবিদ্রোহ কী সফল হয়েছিল?
হ্যাঁ, নীলবিদ্রোহ সফল হয়েছিল। নীলকররা বাংলায় নীলচাষ প্রায় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। 1860-এর দশকের মধ্যেই বাংলায় নীলচাষের অবসান ঘটে।
নীলবিদ্রোহের গুরুত্ব কী ছিল?
নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব –
- প্রথম সংগঠিত প্যান-বাংলা কৃষক আন্দোলন যেখানে হিন্দু-মুসলিম, কৃষক-জমিদার-মধ্যবিত্ত একত্রিত হয়েছিলেন।
- উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সফল গণআন্দোলনের নজির স্থাপন করে।
- শিক্ষিত সমাজকে কৃষক সমস্যার প্রতি সচেতন করে তোলে।
- সংবাদপত্র ও সাহিত্যের মাধ্যমে গণআন্দোলন গড়ে তোলার পথ দেখায়।
নীলবিদ্রোহের ফলাফল আলোচনা করো।
ফলাফল –
- বাংলায় নীলচাষ প্রায় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় (1870-এর দশক নাগাদ)।
- নীলকররা তাদের মূলধন চা শিল্পে বিনিয়োগ করে।
- দেশীয় মহাজন শ্রেণির উত্থান ঘটে।
- কৃষকদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনার বিকাশ ঘটে।
- নীলদর্পণ মামলার মাধ্যমে প্রকাশ্যেই প্রমাণিত হয় ঔপনিবেশিক বিচারব্যবস্থা কীভাবে শ্বেতাঙ্গদের পক্ষপাতিত্ব করে।
আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় “প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর “সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।
আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।
ধন্যবাদ সবাইকে।
মন্তব্য করুন