মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবনের প্রবহমানতা – জনন – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

যে জৈবনিক পদ্ধতিতে জীব নিজ আকৃতি ও প্রকৃতিবিশিষ্ট এক বা একাধিক অপত্য জীব সৃষ্টির মাধ্যমে নিজের প্রজাতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে বজায় রাখে, তাকে জনন বলে।

জনন প্রধানত দু-প্রকার, যথা — 1. অযৌন জনন এবং 2. যৌন জনন। এ ছাড়া অঙ্গজ বংশবিস্তার বা অঙ্গজ জনন ও অপুংজনি বা পার্থেনোজেনেসিস-এর সাহায্যে জীবেরা জনন সম্পন্ন করে।

জনন কোশাধারে বা জনন-অঙ্গে সৃষ্ট দুটি ভিন্ন জননকোশ, অর্থাৎ পুংগ্যামেট ও স্ত্রীগ্যামেটের মিলনের মাধ্যমে সংঘটিত উন্নততম জনন প্রক্রিয়াকে যৌন জনন বলে। যেমন — মানুষ, খরগোশ, হরিণ প্রভৃতি উন্নত প্রাণীর জনন।

যৌন জননের দুটি বৈশিষ্ট্য হল — 1. যৌন জননে দুই প্রকার গ্যামেট, যথা — শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনের ফলে আপত্যের সৃষ্টি হয়। 2. এইপ্রকার জননের মাধ্যমে ভেদ বা প্রকরণ সৃষ্টি হয়, যা নতুন প্রজাতির সৃষ্টিতে তথা জীবের বিবর্তনে সাহায্য করে।

ভ্রূণস্থলিতে দুটি হ্যাপ্লয়েড পোলার নিউক্লিয়াস মিলিত হয়ে একটি ডিপ্লয়েড ডেফিনিটিভ নিউক্লিয়াস বা নির্ণিত নিউক্লিয়াস গঠন করে।
পোলার নিউক্লিয়াস (n) + পোলার নিউক্লিয়াস (n) = ডেফিনিটিভ নিউক্লিয়াস (2n)

যে যৌন জননে জনন কোশাধার (gametangium)-এর = বাইরে পুং ও স্ত্রীগ্যামেটের মিলন সম্পূর্ণভাবে এবং স্থায়ীরূপে সংঘটিত হয়, তাকে সিনগ্যামি বলে। ক্ল্যামাইডোমোনাস-এ এই ধরনের জনন দেখা যায়।

যে যৌন জননে পুংগ্যামেটটি ক্ষুদ্র ও সচল প্রকৃতির হয়, এবং স্ত্রীগ্যামেটটি বড়ো ও নিশ্চল প্রকৃতির হয়, তাদের মিলনকে উগ্যামি বলে। ইডোগোনিয়াম ও ভলভক্স নামক শৈবাল এবং উন্নতশ্রেণির সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের এইপ্রকার জনন দেখা যায়।

যে যৌন জননে পুংগ্যামেট স্ত্রীগ্যামেট অঙ্গসংস্থানগতভাবে ও শারীরবৃত্তীয়ভাবে একই রকমের হয়, তাদের মিলনকে আইসোগ্যামি বলে। ক্ল্যামাইডোমোনাস (শৈবাল), মনোসিস্টিস (প্রোটাজোমা) ইত্যাদিতে প্রধানত আইসোগ্যামি জনন দেখা যায়।

যে যৌন জননে পুংগ্যামেট ও স্ত্রীগ্যামেটের, আকার, আয়তন ও আকৃতি সমান হয় না এবং গ্যামেটের মিলন জনন- অঙ্গের বাইরে ঘটে, তাকে অ্যানাইসোগ্যামি বলে। যেমন — ক্লামাইডোমোনাস।

নির্দিষ্ট জনন অঙ্গে উৎপন্ন জননকোশের (স্পোর বা রেণু) পারস্পরিক মিলন ছাড়াই শুধুমাত্র দেহকোশ বিভাজিত হয়ে অথবা রেণু উৎপাদনের মাধ্যমে জনন কার্য সম্পাদনের প্রক্রিয়াকে অযৌন জনন বলে। যেমন — ঈস্ট কোরকোদ্‌গম।

অধিকাংশ এককোষী জীবে মাইটোসিস বা অ্যামাইটোসিস কোনো বিভাজন পদ্ধতির দ্বারা দুটি (দ্বিবিভাজন) বা দুইয়ের বেশি (বহুবিভাজন) নতুন অপত্য সৃষ্টি করার পদ্ধতিকে বিভাজন বলে। উদাহরণ: অ্যামিবা (দ্বিবিভাজন) এবং প্লাসমোডিয়াম (বহুবিভাজন)।

যে অযৌন জনন জনন পদ্ধতিতে জনিতৃ জীবদেহের অংশবিশেষ স্ফীত হয়ে মূলদেহ থেকে আলাদা হয়ে নতুন অপত্য সৃষ্টি করে, তাকে বাডিং বা কোরকোদ্‌গম বলে। এই স্ফীত অংশটিকে কোরক বলা হয়।
উদাহরণ: ঈস্ট, হাইড্রা ইত্যাদি।

যে অযৌন জনন পদ্ধতিতে মস, ফার্ন ও ছত্রাকদেহে সৃষ্ট এককোশী রেণু জনিতৃ দেহ থেকে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে ও নতুন অপত্য সৃষ্টি করে, তাঁকে রেণু উৎপাদন বা স্পোরুলেশন বলে।উদাহরণ: ক্ল্যামাইডোমোনাস, পেনিসিলিয়াম প্রভৃতি।

যে অযৌন জনন পদ্ধতিতে জনিতৃ জীবদেহের দেহাংশ থেকে সম্পূর্ণ নতুন জীব সৃষ্টি হয়, তাকে পুনরুৎপাদন বলে।
উদাহরণ: প্ল্যানেরিয়া নামক এককোশী প্রোটোজোয়া।

যে অযৌন জনন পদ্ধতিতে জনিতৃ জীবের দেহ এক বা একাধিক খণ্ডে বিভক্ত হয় ও প্রতিটি খণ্ড, কোশ বিভাজনের দ্বারা একটি পূর্ণাঙ্গ অপত্যে পরিণত হয়, তাকে খণ্ডীভবন বলে।
উদাহরণ: স্পাইরোগাইরা নামক শৈবালে এই প্রক্রিয়ার দ্বারা অঙ্গজ জনন সম্পন্ন হয়। 

উদ্ভিদের অযৌন জননের রেণুগুলি সিলিয়া বা ফ্ল্যাজেলাযুক্ত হলে তা গমনে সক্ষম হয়। এদের চলরেণু বা জুম্পোর বলে।
যেমন — ভলভক্স, ক্ল্যামাইডোমোনাস প্রভৃতি শৈবালের চলরেণু।

জীবের অযৌন জননের রেণু চলনক্ষমতাহীন হলে, তাকে অচলরেণু বা অ্যাপ্লানোস্পোর বলে। যেমন — মিউকর, পেনিসিলিয়াম প্রভৃতি ছত্রাকের রেণু।

নিম্নশ্রেণির জীবের দুটি গ্যামেটের সংযুক্তি পদ্ধতিতে মিলনের ফলে যে ডিপ্লয়েড কোশের সৃষ্টি হয়, তাকে জাইগো- স্পোর বা ভ্রূণরেণু বলে। স্পাইরোগাইরার দেহে দেখা যায়।

যে অযৌন জনন পদ্ধতিতে উদ্ভিদেহের যে-কোনো অঙ্গ বা তার অংশবিশেষ জনিতৃ উদ্ভিদদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোশ বিভাজন ও বৃদ্ধির দ্বারা নতুন অপত্যের সৃষ্টি করে, তাকে অঙ্গজ বংশবিস্তার বা অঙ্গজ জনন বলে। যেমন — মিষ্টি আলু রসালো মূলের সাহায্যে, পাথরকুচি পাতা অস্থানিক পত্রজ মুকুলের সাহায্যে জনন সম্পন্ন করে।

প্রাকৃতিক উপায়ে অঙ্গজ বংশবিস্তারকারী উদ্ভিদগুলি হল — 1. মিষ্টি আলু – এর রসালো মূলের মাধ্যমে অঙ্গজ 1 বংশবিস্তার ঘটে। 2. কচুরিপানা — এর অববায়ব কাণ্ডের মাধ্যমে অঙ্গজ বংশবিস্তার ঘটে। 3. পাথরকুচি – এর পাতায় উৎপন্ন অস্থানিক মূল থেকে অঙ্গজ বংশবিস্তার বৃদ্ধি ঘটে।

বক্রধাবক বা স্টোলন হল একপ্রকার পরিবর্তিত অর্ধবায়ব কাণ্ড। এদের কাণ্ডের পর্বমধ্য ধাবকের তুলনায় লম্বা হয়। শাখাগুলি প্রথমে তির্যকভাবে ওপরের দিকে বৃদ্ধি পায় এবং পরে নীচের দিকে নেমে মাটি স্পর্শ করলে মধ্যাংশ তথা পর্বমধ্য খিলানের মতো বেঁকে থাকে। যেমন — জুই, মেন্থা ইত্যাদি।

মিষ্টি আলুর মূল রসালো প্রকৃতির কন্দাল মূল। এটি প্রকৃতপক্ষে অস্থানিক মূল। এটি খাদ্য সঞ্চয়ের ফলে স্ফীত হয়ে কন্দের আকার ধারণ করে। ব্রততী শ্রেণির উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এই মূল উৎপন্ন হয়। এই মূল উদ্ভিদের অংগজ বংশবিস্তারে সহায়তা করে।

গ্রাফটিং বা জোড়কলমের ক্ষেত্রে যে গাছের কাণ্ড কেটে ফেলে শুধু তার মূল অংশ ব্যবহৃত হয় তাকে স্টক বলে। পক্ষান্তরে যে উন্নত ও অভিপ্রেত উদ্ভিদের শাখা স্টকের সঙ্গে সংযোজিত করা হয়, তাকে সিয়ন বলে।

এই পদ্ধতিতে উদ্ভিদের দীর্ঘ শাখাকে বাঁকিয়ে তার কোনো একটি পর্বকে মাটি-সংলগ্ন করে মাটি দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা হয়। সময়ে সময়ে জল দিতে থাকলে এই অংশ থেকে অস্থানিক মূল নির্গত হয়। পরে মূলসহ শাখাটি কেটে নিয়ে অন্যত্র রোপণ করা হলে সেখান থেকে নতুন গাছ জন্মায়। লেবু, জুঁই, বেল গাছে এইভাবে কৃত্রিম অঙ্গজ জনন করা সম্ভব।

এই পদ্ধতিতে গাছের একটি শক্ত শাখা নির্বাচন করে ওই শাখার কোনো অংশের চারদিক থেকে কিছুটা ছাল চেঁছে সেখানে সারযুক্ত মাটি অথবা গোবরের প্রলেপ লাগিয়ে চট বা কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর নিয়মিতভাবে সেখানে জল দিতে হয়। কিছুদিন পরে সেখানে অস্থানিক মূল বের হলে শাখাটি কেটে নিয়ে অন্যত্র মাটিতে রোপণ করা হয়। এইভাবে একই গাছ থেকে বহু অপত্য সৃষ্টি করা সম্ভব। আম, লিচু, পেয়ারা প্রভৃতি গাছে এইভাবে গুটিকলমের দ্বারা নতুন গাছ সৃষ্টি করা সম্ভব।

অঙ্গজ জনন প্রক্রিয়া যেসকল উদ্ভিদে দেখা যায়, সেগুলি হল — মিষ্টি আলু, গোল আলু, পটল, পেঁয়াজ, কচুরিপানা, পাথরকুচি ইত্যাদি।

যে পদ্ধতিতে ল্যাবরেটরিতে উদ্ভিদের কোশ, কলা বা অঙ্গ নিয়ে কলা কর্ষণের (tissue culture) মাধ্যমে অসংখ্য পূর্ণাঙ্গ অপত্য উদ্ভিদ উৎপাদন করা হয়, তাকে অণুবিস্তারণ বা মাইক্রোপ্রোপাগেশন বলে।

বিচ্ছিন্ন দেহকোশের উপযুক্ত পরিবেশে সম্পূর্ণ জীবদেহে পরিণত হওয়ার ক্ষমতাকে টোটিপোটেন্সি বা পূর্ণত্বক্ষমতা বলে।

মাইক্রোপ্রোপাগেশনের দুটি বৈশিষ্ট্য হল – 1. মাইক্রোপ্রোপাগেশন হল কলাকর্ষণ বা টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভিদের সংখ্যা বৃদ্ধির অঙ্গজ পদ্ধতি। 2. এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভিদের পছন্দমাফিক ভ্যারাইটির দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটানো হয়।

1. মাইক্রোপ্রোপাগেশনে জিনগত প্রকরণ ঘটে না বলে উদ্ভিদটির অভিযোজন ক্ষমতা কম হয়। 2. এটি অভিব্যক্তিতেও সহায়তা করে না।

যে প্রযুক্তি পদ্ধতিতে জীবদেহ থেকে সংগৃহীত কলা, উপযুক্ত পুষ্টিমাধ্যমে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে কর্ষণ করা হয়, তাকে কলাকর্ষণ বা টিস্যু কালচার বলে। মাইক্রোপ্রোপাগেশনে কলাকর্ষণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

বিশেষ কর্ষণ দ্রবণে অক্সিন ও সাইটোকাইনিন হরমোন যুক্ত করা হয়। এই হরমোনগুলি বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রকরূপে ব্যবহৃত হয়।

উদ্ভিদের যে বিশেষ ক্ষুদ্র অংশ অণুবিস্তারণের জন্য ব্যবহার করা হয়, তাকে এক্সপ্ল্যান্ট বলে। ভাজক কলাপূর্ণ অংশ, যেমন — অগ্রমুকুল, মূলাগ্র, কন্দজাতীয় অঙ্গ ইত্যাদি এক্সপ্ল্যান্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

যৌন জননকারী কোনো জীবের জীবনচক্রে হ্যাপ্লয়েড (n) ও ডিপ্লয়েড (2n) জনুর পর্যায়ক্রমিক আবর্তনকে জনুক্রম বলে।
উদাহরণ: ফার্ন, মসসহ যৌন জননকারী সকল উদ্ভিদ এবং প্যারামেসিয়াম, মনোসিস্টিসসহ যৌন জননকারী সকল প্রাণী।

কোনো জীবের হ্যাপ্লয়েড ও ডিপ্লয়েড জনু চক্রাকারে আবর্তিত হলে তার জেনেটিক বস্তুর ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয় জনুক্রমের মাধ্যমে।

জীবের জনুক্রমে ডিপ্লয়েড রেণুধর দশা (2n) ও হ্যাপ্লয়েড লিঙ্গধর দশা (n) পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। রেণুস্থলীর রেণু মাতৃকোশে মিয়োসিস পদ্ধতিতে রেণু উৎপন্ন হয়ে লিঙ্গধর জনু সৃষ্টি হয়। লিঙ্গধর জনু হ্যাপ্লয়েড হয় বলেই তার পুং ও স্ত্রীজনন- অঙ্গে যথাক্রমে হ্যাপ্লয়েড শুক্রাণু (n) ও হ্যাপ্লয়েড ডিম্বাণু তৈরি হয়। তারা মিলিত হলে পুনরায় ভ্রূণ, তথা রেণুধর জনু সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ মিয়োসিস ঘটে বলেই জনুক্রম সম্ভব হতে পারে।

জীবাণুমুক্ত এক্সপ্ল্যান্টকে টেস্টটিউবে কর্ষণ-মাধ্যম (culture media)-এ রাখলে ধীরে ধীরে কোশ বিভাজন শুরু হয় এবং এক্সপ্ল্যান্টের কোশগুলি থেকে অবিভেদিত কোশসমষ্টির সৃষ্টি হয়, একেই ক্যালাস বলে। ক্যালাসের কোশগুলি টোটিপোটেন্ট প্রকৃতির হয় এবং তা থেকে সম্পূর্ণ উদ্ভিদ সৃষ্টি হতে পারে।

মাইক্রোপ্রোপাগেশনের কর্ষণ মাধ্যমে অক্সিন ও কাইনেটিন হরমোনের পরিমাণ বেশি থাকলে শুধু কাণ্ড তৈরি হয়। একে কলোজেনেসিস বা কাণ্ড উৎপাদন বলে।

মাইক্রোপ্রোপাগেশনের কর্ষণ মাধ্যমে অক্সিন ও কাইনেটিন হরমোন কম মাত্রায় থাকলে শুধু মূলের সৃষ্টি হয়। একে রাইজোজেনেসিস বা মূল উৎপাদন বলে।

মাইক্রোপ্রোপাগেশনের দ্বারা ক্যালাস কোশসমষ্টি থেকে জাইলেম বা ফ্লোয়েম কলা সৃষ্টির ঘটনাকে বলে হিস্টোজেনেসিস বা কলা উৎপাদন।