অভিব্যক্তি ও অভিযোজন মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের চতুর্থ অধ্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই অধ্যায় থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে। এই নিবন্ধে, আমরা এই অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করব এবং বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন ও উত্তরের একটি তালিকা প্রদান করব।
জীবনের সংজ্ঞা দাও। জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে মিলার এবং উরে-র পরীক্ষাটি সংক্ষেপে লেখো।
জীবন একটি অসংখ্যায় সম্ভাবনার সমুদ্র, স্বপ্নের দিকে অগ্রসর হতে চাইছে মানুষ।
জীবন
বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য (যেমন — প্রজনন, বিপাক) যেগুলি সজীব বস্তু থেকে জড়বস্তুকে পৃথক করে, তাদের প্রকাশকেই জীবন বলে।
মিলার ও উরে-র পরীক্ষা
1953 সালে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের এক ছাত্র স্ট্যানলি মিলার এবং এক বিখ্যাত গ্রহবিজ্ঞানী হ্যারল্ড উরে সর্বপ্রথম ওপারিন-হ্যালডেনের তত্ত্বের ওপরে একটি পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তির সম্বন্ধে জোরালো প্রমাণ উপস্থাপন করেন।
বিজ্ঞানীদ্বয় এই পরীক্ষার জন্য একটি বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেন। এই যন্ত্রটিতে দুটি প্রকোষ্ঠ ছিল, যাদের মধ্যে একটি বৃহৎ (5L) ও একটি ছোটো (500ml)। এই যন্ত্রের মাধ্যমে প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য ওই প্রকোষ্ঠগুলির মধ্যে বৃহৎ প্রকোষ্ঠটিতে মিথেন, হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়ার মিশ্রণ নেওয়া হয় এবং ছোটো প্রকোষ্ঠে জল রাখা হয়। এরপর বার্নার দিয়ে জল ফোটানো হয়। ফলে জলীয় বাষ্প উৎপন্ন হয়, যা একটি নলের মাধ্যমে বৃহৎ প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। বড়ো প্রকোষ্ঠে টাংস্টেন নির্মিত ইলেকট্রোডের দ্বারা তড়িৎমোক্ষণ করা হয়, প্রাচীন পৃথিবীর বজ্রপাতের মতো। এর ফলে উৎপন্ন গ্যাস মিশ্রণকে একটি নলের মধ্যে দিয়ে চালনা করা হয় এবং ঠান্ডা জলের প্রবাহ দ্বারা মিশ্রণটিকে ঘনীভূত করা হয়। সমগ্র ব্যবস্থাপনাটি এক সপ্তাহ ধরে চালনা করা হয়।
পরীক্ষায় প্রাপ্ত রাসায়নিক পদার্থগুলি বিশ্লেষণ করে প্রায় 20টি অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া যায়। এ ছাড়া অন্যান্য কিছু জৈব অ্যসিডও পাওয়া যায়। প্রাপ্ত দ্রব্যগুলির মধ্যে প্রধান ছিল গ্লাইসিন, অ্যালানিন, গ্লুটামিক অ্যাসিড, অ্যাসপারটিক অ্যাসিড প্রভৃতি। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে প্রাচীন পৃথিবীতে অক্সিজেনবিহীন বিজারক পরিবেশে, বজ্রপাত, অতিবেগুনি রশ্মি ও অগ্ন্যুৎপাতের প্রভাবে বিভিন্ন অজৈব পদার্থ থেকে জটিল জৈব যৌগ গঠিত হয়। এই যৌগগুলি জীবের দেহ গঠনের মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তিতে সাহায্য করে।
বিবর্তন বা জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে হৃৎপিণ্ড- ঘটিত প্রমাণ ও অগ্রপদের সাদৃশ্যগত প্ৰমাণ আলোচনা করো। অথবা, শারীরস্থানগত প্রমাণের সাহায্যে অভিব্যক্তি ব্যাখ্যা করো।
বিবর্তন হলো জীবনের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, যা সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে মানুষকে নির্ধারণ করে এবং প্রগতির পথে নিরত করে।
জৈব অভিব্যক্তির শারীরস্থানগত প্রমাণ
বিভিন্ন ধরনের জীবের অঙ্গের তুলনামূলক আলোচনা করলে বোঝা যায় যে অঙ্গগুলির অন্তর্গঠনের মধ্যে মৌলিক সাদৃশ্য বর্তমান। এ ছাড়া আরও বোঝা যায় যে সরল জীব থেকে ধীরে ধীরে জটিল জীবের উৎপত্তি হয়েছে। এখানে কতকগুলি জীবের শারীর- স্থানগত কাঠামোর আলোচনা করা হল।
- হৃৎপিণ্ড ঘটিত প্রমাণ – মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পক্ষী, স্তন্যপায়ী প্রভৃতি প্রাণীর হৃৎপিণ্ডের গঠন পরীক্ষা করলে দেখা যায়, সামান্য পার্থক্য থাকলেও এদের মৌলিক গঠন একই। যে সামান্য পার্থক্য দেখা যায়, তা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বসবাসের দরুন অভিযোজনের মাধ্যমে ঘটে থাকে। 1. মাছের হৃৎপিণ্ড সরল প্রকৃতির এক্ষেত্রে কেবল দুটি প্রকোষ্ঠ বর্তমান — একটি অলিন্দ এবং একটি নিলয়। 2. উভচর শ্রেণির প্রাণীদের হৃৎপিণ্ডে তিনটি প্রকোষ্ঠ বর্তমান, যথা — দুটি অলিন্দ এবং একটি নিলয়। 3. সরীসৃপের হৃৎপিণ্ডে দুটি অলিন্দ ও একটি অর্ধবিভক্ত নিলয় থাকে। (ব্যতিক্রম– কুমির, এদের চারটি প্রকোষ্ঠযুক্ত হৃৎপিণ্ড বর্তমান)। 4. আবার, পক্ষী ও স্তন্যপায়ী উভয়েরই হৃৎপিণ্ডে চারটি প্রকোষ্ঠ থাকে — দুটি অলিন্দ ও দুটি নিলয়। এদের নিলয় ও অলিন্দ সম্পূর্ণরূপে দ্বিধাবিভক্ত। মাছের হৃৎপিণ্ডে কেবল অধিক CO2 যুক্ত রক্ত প্রবাহিত হয়। উভচরের হৃৎপিণ্ডে অধিক O2 সমৃদ্ধ রক্তের সঙ্গে অধিক CO2 যুক্ত রক্তের সামান্য মিশ্রণ ঘটে থাকে। অর্থাৎ, এদের হৃৎপিণ্ড কিছুটা উন্নত প্রকৃতির। সরীসৃপের হৃৎপিণ্ডে অধিক CO2 – যুক্ত ও অধিক O2 -যুক্ত রক্তের মিশ্রিত হওয়ার প্রবণতা প্রতিরোধের প্রচেষ্টা দেখা যায়। তবে পক্ষী বা স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে অধিক CO2 যুক্ত ও অধিক O2 -যুক্ত রক্ত কোনোভাবে মেশে না। অর্থাৎ, এদের হৃৎপিণ্ড উভচর অপেক্ষা উন্নত কিন্তু সর্বাপেক্ষা উন্নত হৃৎপিণ্ড পক্ষী ও স্তন্যপায়ীদের মধ্যে দেখা যায়।
- সিদ্ধান্ত – সুতরাং, বিভিন্ন প্রাণীগোষ্ঠীর হৃৎপিণ্ডের মৌলিক গঠন থেকে প্রমাণিত হয় যে সরল প্রাণী থেকে ধীরে ধীরে জটিল প্রাণীর সৃষ্টি হয়। এটি অভিব্যক্তির বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যতা প্রমাণ করে। এ ছাড়া হৃৎপিণ্ডের গঠনগত ও কার্যগত বিকাশের ক্রম থেকে পৃথিবীতে এদের আগমন-ক্রম বোঝা যায়। এদের আগমনের ক্রম হল-
মাছ→ উভচর→ সরীসৃপ→ পাখি ও স্তন্যপায়ী
- অগ্রপদের সাদৃশ্যগত প্রমাণ – পাখি, বাদুড়, তিমি, ঘোড়া, মানুষ প্রভৃতি মেরুদণ্ডী প্রাণীর অগ্রপদের অস্থির গঠন প্রায় অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও কাজ ভিন্ন। বিভিন্ন পরিবেশে অভিযোজনের ফলে এদের অগ্রপদের বহিরাকৃতিগত পরিবর্তন ঘটেছে। পাখি ও বাদুড়ের অগ্রপদ ডানায় রূপান্তরিত হয়, তিমির ফ্লিপার, ঘোড়ার অগ্রপদ, মানুষের হাত-সবগুলিই গঠনগতভাবে এক। প্রত্যেক অগ্রপদেই হিউমেরাস, রেডিয়াস ও আলনা, কারপাল, মেটাকারপাল, ফ্যালানজেস ইত্যাদি অস্থি আছে। কেবলমাত্র অভিযোজনের ফলে এরা আকৃতিগতভাবে বিভিন্ন হয়।
এর থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, সব মেরুদণ্ডী প্রাণী একই প্রকার উদ্বংশীয় জীব বা পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্ট হয়েছে। সমসংস্থ অঙ্গ প্রকৃতপক্ষে অপসারী অভিব্যক্তিকে প্রমাণ করে।
ঘোড়ার বিবর্তন সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ঘোড়ার বিবর্তন হলো ঘোড়ার স্বাভাবিক প্রকৃতি এবং আদর্শগুলির পরিবর্তন যা যাত্রায় গাড়ি সম্পর্কিত প্রয়োজনগুলির উপস্থাপন করে।
ঘোড়ার বিবর্তন
ঘোড়ার বিবর্তন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় — ঘোড়া তার প্রথম পূর্বপুরুষ ইওহিপ্পাস থেকে পরপর আরও তিনটি দশা অতিক্রম করে আধুনিক কালের ঘোড়া অর্থাৎ ইকুয়াস-এ উপনীত হয়েছে। প্রতিটি যুগের ঘোড়ার জীবাশ্ম পাওয়া গেছে বলে এদের বিবর্তনের সম্পূর্ণ ইতিহাস জানা সম্ভব হয়েছে। নীচে বিবর্তনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রাপ্ত ঘোড়ার জীবাশ্মের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল।
দশা | বৈশিষ্ট্য |
ইওহিপ্পাস | ঘোড়ার আদি পূর্বপুরুষ। প্রায় 55 মিলিয়ন বছর আগে এই ঘোড়া পৃথিবীতে বসবাস করত। এদের উচ্চতা ছিল। প্রায় 11-12 ইঞ্চি (28cm)। এদের সামনের পায়ে 4টি ও পেছনের পায়ে 3টি করে আঙুল ছিল। এদের শরীরের তুলনায় মাথা ও হাত-পা ছোটো ছিল। এদের ঊষাকালের ঘোড়া বলা হয়। |
মেসোহিপ্পাস | ইওহিপ্পাসের পরে এসেছিল মেসোহিপ্পাস, প্রায় 40 মিলিয়ন বছর আগে। এদের উচ্চতা ছিল প্রায় 24 ইঞ্চি (60cm)। এইসময় তৃণভূমির সৃষ্টি হয়, তাই দৌড়োনোর সুবিধার জন্য এদের অগ্রপদের একটি আঙুল হ্রাস পায়। অর্থাৎ এদের সামনের এবং পেছনের পায়ে 3টি করে আঙুল ছিল। এই আঙুলগুলি মাটি স্পর্শ করতে পারত। এদের অন্তবর্তী ঘোড়া বলা হয়। |
মেরিচিপ্পাস | মেসোহিপ্পাস-এর পরে প্রায় 25 মিলিয়ন বছর আগে ঘোড়ার যে পূর্বপুরুষটি এসেছিল তার নাম মেরিচিপ্পাস। এদের উচ্চতা ছিল প্রায় 40 ইঞ্চি (100cm)। এদের সামনের এবং পেছনের পায়ে 3টি করে আঙুল থাকলেও, শুধু মাঝের আঙুলই মাটি স্পর্শ করত না। এদের পায়ের তৃতীয় আঙুলটি লম্বা ও চওড়ায় বৃদ্ধি পেয়ে ক্ষুরের সৃষ্টি হয়। এদের গ্রীবা অংশও বৃদ্ধি পায়। এদের রোমন্থক ঘোড়া বলা হয়। |
প্লিওহিপ্পাস | মেরিচিপ্পাস পর্যায়ের পরে প্রায় 10 মিলিয়ন বছর পূর্বে এসেছিল প্লিওহিপ্পাস। এদের উচ্চতা ছিল প্রায় 50 ইঞ্চি (108cm)। এদের উভয় পায়ে 3টি করে আঙুল থাকলেও সবকটি আঙুল মাটি স্পর্শ করতে পারত না। মাঝের আঙুলটি বৃদ্ধি পায় এবং বাকি আঙুলগুলি ক্ষুদ্র হয়ে এদের তৃতীয় অঙুলের দু-পাশে বিন্যস্ত থাকত। এরা প্রথম এক আঙুলযুক্ত ঘোড়া। এরা আকারে ছোটো হলেও প্রায় বর্তমান ঘোড়ার মতো দেখতে ছিল। |
ইকুয়াস | প্লিওহিপ্পাস পর্যায়ের পরে আজ থেকে 10 লক্ষ বছর পূর্বে আবির্ভূত হয়েছে ইকুয়াস। এদের আধুনিক ঘোড়া বলা হয়। এদের উচ্চতা প্রায় 60 ইঞ্চি (150cm)। এদের পাশের আঙুলগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ছোটো হয়েছে। এদের পায়ে ক্ষুর দ্বারা আবৃত একটি মাত্র শক্ত আঙুল দেখা যায়। এদের গ্রীবার দৈর্ঘ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। |
নিষ্ক্রিয় অঙ্গ কাকে বলে? বিবর্তনের সপক্ষে নিষ্ক্রিয় বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গঘটিত প্রমাণ আলোচনা করো
নিষ্ক্রিয় অঙ্গ হলো শরীরের অংশ যা অসচ্চল বা অকর্মসাধ্য হয়ে থাকে, যা প্রাণিসম্পদের কাজ না করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
নিষ্ক্রিয় অঙ্গ
যেসব অঙ্গ পূর্বপুরুষের দেহে অথবা সমগোত্রীয় অন্য জীবের দেহে সক্রিয় থাকলেও দীর্ঘকাল অপ্রয়োজনীয়তার ও অব্যবহারের কারণে ক্রমবিবর্তনের ফলে সংশ্লিষ্ট জীবটির দেহে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ছোটো আকারের ও কার্যহীন অঙ্গে পরিণত হয়েছে তাদের লুপ্তপ্রায় বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বলে।
বিবর্তনের সপক্ষে নিষ্ক্রিয় অপঘটিত প্ৰমাণ
1. ঘোড়া, গিনিপিগ প্রভৃতি তৃণভোজী প্রাণীর পৌষ্টিকতন্ত্রের ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্রের সংযোগস্থলে অবস্থিত সিকাম একটি সক্রিয় অঙ্গ যা মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রাকার নিষ্ক্রিয় ভারমিফর্ম অ্যাপেনডিক্সে পরিণত হয়েছে। সিকামের কাজ হল সেলুলোজ জাতীয় খাদ্যের পরিপাকে সাহায্য করা। মানুষের খাদ্যে সেলুলোজের পরিমাণ কম থাকায় অব্যবহারজনিত কারণে এটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। 2. বানরে সক্রিয় ল্যাজ মানুষের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের শেষপ্রান্তে নিষ্ক্রিয় কক্সিস-রূপে অবস্থান করে। 3. মানুষের চোখের উপপল্লব বা তৃতীয় পল্লব, বহিঃকর্ণের পেশি, উদরের খণ্ডিত পেশি, তৃতীয় পেষক দন্ড প্রভৃতি হল লুপ্তপ্রায় অঙ্গ। 4. পাখিদের মধ্যেও লুপ্তপ্রায় অঙ্গের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন — উটপাখি, এমু, কিউই প্রভৃতি পাখির ডানা নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে। 5. আদা, হলুদ প্রভৃতির ভূনিণ্মস্থ কাণ্ডের শল্কপত্র, কালকাসুন্দা উদ্ভিদের বন্ধ্যা পুংকেশর বা স্ট্যামিনোড উদ্ভিদের নিষ্ক্রিয় অঙ্গ।
নিষ্ক্রিয় অঙ্গের উপস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে নিষ্ক্রিয় অঙ্গযুক্ত জীব, ওই একই প্রকৃতির সক্রিয় অঙ্গযুক্ত উদ্বংশীয় জীব থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এটি বিবর্তনবাদকেই সমর্থন করে।
সমসংস্থ অঙ্গ কীভাবে জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে তা বুঝিয়ে দাও।
সমসংস্থ অঙ্গ হলো একটি শরীরের অংশ যা সমগ্র প্রণিসম্পদের ব্যবহার এবং সমতুল্য কাজ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
জৈব অভিব্যক্তির সমসংস্থ অঙ্গঘটিত প্রমান
যেসব অঙ্গ উৎপত্তি ও গঠনগত দিক থেকে এক হলেও কার্যগত দিক থেকে ভিন্ন তাদের সমসংস্থ অঙ্গ বলে।
- প্রাণীর ক্ষেত্রে সমসংস্থ অঙ্গ – বাদুড়, তিমি, বিড়াল, মানুষ প্রভৃতি প্রাণীর অগ্রপদের কাজ বিভিন্ন প্রকার। কিন্তু এদের প্রত্যেকের অগ্রপদ গঠনগতভাবে মোটামুটিভাবে একই ধরনের। বিভিন্ন পরিবেশে থাকার দরুন এদের অগ্রপদের পরিবর্তন ঘটেছে। বাদুড়ের অগ্রপদ (ডানা) ওড়ার জন্য, তিমির অগ্রপদ (ফ্লিপার) সাঁতার কাটার জন্য, বিড়ালের অগ্রপদ দৌড়োনের ও হাঁটার জন্য, মানুষের অগ্রপদ (হাত) সৃজনশীল কাজের জন্য বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এদের গঠন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়। প্রত্যেক অগ্রপদেই হিউমেরাস, রেডিয়াস ও আলনা, কারপাল, মেটাকারপাল, ফ্যালানজেস ইত্যাদি অস্থি আছে। এ ছাড়া অগ্রপদের নির্দিষ্ট পেশি, স্নায়ুবিন্যাসও প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একইরকম হয়ে থাকে। এর থেকে প্রমাণিত হয়, সব মেরুদণ্ডী প্রাণী একই প্রকার উদ্বংশীয় জীব থেকে সৃষ্ট হয়েছে।
- উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সমসংস্থ অঙ্গ – উদ্ভিদের মধ্যে বেলের শাখা-কন্টক, ঝুমকোলতার কাণ্ডের আকর্ষ, ফণীমনসার পর্ণকাণ্ড, আলুর স্ফীতকন্দ প্রভৃতি প্রত্যেকেই পরিবর্তিত কাণ্ড এবং এগুলি সমসংস্থ অঙ্গ। উপরোক্ত উদাহরণগুলি থেকে বোঝা যায় বিভিন্ন জীবগুলি উৎপত্তিগতভাবে এক হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার কারণে তাদের কাজ ও বহিরাকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে, একই উদ্বংশীয় জীব থেকে উদ্ভূত জীবগোষ্ঠী বিভিন্ন পরিবেশে অভিযোজনের কারণে কার্যগত ও বাহ্যিক গঠনগত দিক থেকে বিভিন্ন হয়। অর্থাৎ, সমসংস্থ অঙ্গ সাধারণভাবে অপসারী বিবর্তনকে চিহ্নিত করে।
সমবৃত্তীয় অঙ্গ কীভাবে জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে, তা লেখো।
সমবৃত্তীয় অঙ্গ হলো একটি শরীরের অংশ যা একটি সমবৃত্তীয় আকার ধারণ করে এবং বৈশিষ্ট্যগুলি সমান্তরাল সম্পাদন করে।
জৈব অভিব্যক্তির সমবৃত্তীয় অঙ্গঘটিত প্রমাণ
যেসব অঙ্গ উৎপত্তি ও গঠনগত দিক থেকে ভিন্ন হলেও কার্যগত দিক থেকে এক, তাদের সমবৃত্তীয় অঙ্গ বলা হয়।
- প্রাণীর সমবৃত্তীয় অঙ্গ – পতঙ্গ ও পাখির ডানা ওড়ার জন্য ব্যবহৃত হলেও এদের উৎপত্তি ও গঠনগত দিক থেকে কোনো সাদৃশ্য নেই। পতঙ্গের ডানা কিউটিকূল বা বহিঃকঙ্কালের প্রসারিত অংশ, অন্যদিকে পাখির ডানা পালক আবৃত অগ্রপদ বিশেষ। প্রাণীর অপর একটি সমবৃত্তীয় অঙ্গ হল মৌমাছি ও কাঁকড়াবিছের হুল। কার্যগতভাবে এরা উভয়ক্ষেত্রেই আত্মরক্ষায় সাহায্য করে, তবে এদের গঠন পৃথক। মৌমাছির হুল পরিবর্তিত ওভিপোজিটার ও কাঁকড়াবিছের হুল হল অন্তিম উদর খণ্ডকের রূপান্তর।
- উদ্ভিদের সমবৃত্তীয় অঙ্গ – মটর গাছের পাতার আকর্ষ ও ঝুমকোলতার কাণ্ডের আকর্ষ একইরকম কাজ করলেও এরা উৎপত্তি ও গঠনগতভাবে ভিন্ন। মটর গাছের আকর্ষ রূপান্তরিত পাতা ও ঝুমকোলতার আকর্ষ হল রূপান্তরিত শাখা। অর্থাৎ একই পরিবেশে বসবাস ও একই ক্রিয়াকলাপের জন্য এরূপ সমবৃত্তীয় অঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে।
উপরোক্ত উদাহরণগুলি থেকে বোঝা যায় যে নানারকম জীব একই পরিবেশে একইরকমভাবে অভিযোজিত হয় ও তার ফলে তাদের মধ্যে আপাত কাৰ্যগত মিল সৃষ্টি হয়। সমবৃত্তীয় অঙ্গ অভিসারী বিবর্তনকে প্রমাণ করে।
ল্যামার্কের বিবর্তন তত্ত্বের মূল বক্তব্যগুলির উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করো।
ল্যামার্কের বিবর্তন তত্ত্ব হলো প্রাণিসম্পদের প্রজনন প্রক্রিয়ায় ঘটে যা বিভিন্ন পরিবর্তনের ফলে অনুকরণ করার জন্য প্রজনন বৈশিষ্ট্যের চেয়ে প্রাথমিকভাবে সাধারণত ক্ষমতা ধারণ করে।
বিবর্তন সম্পর্কিত ল্যামার্কের মতবাদ
ল্যামার্ক 1809 সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফিলজফিক জুলজিক’-এ বিবর্তনের বিজ্ঞানভিত্তিক মতবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর মতবাদকে ল্যামার্কবাদ বা ল্যামার্কিজম বলে। ল্যামার্কের বিবর্তন তত্ত্বের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল —
- অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ শক্তি – জীবনের অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রভাবে জীবের সমগ্র দেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আকার বৃদ্ধি পায়।
- চাহিদা থেকে নতুন অঙ্গের সৃষ্টি – পরিবেশের পরিবর্তন সকল জীবকে প্রভাবিত করে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন চাহিদার সৃষ্টি হয়। এই চাহিদার ফলে নতুন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সৃষ্টি হয়।
- ব্যবহার ও অব্যবহারের সূত্র – ল্যামার্কের মতে, জীবদেহের কোনো অঙ্গ ক্রমাগত ব্যবহৃত হতে থাকলে অঙ্গটি শক্তিশালী, সবল ও সুগঠিত হয়, পক্ষান্তরে জীবদেহের কোনো অঙ্গ দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে সেটি ক্রমশ দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয় ও অবশেষে অবলুপ্ত হয়ে যায়।
- ব্যবহারের সপক্ষে উদাহরণ – বহুকাল আগে জিরাফের গলা ছোটো ছিল। কিন্তু কালক্রমে উঁচু গাছের পাতা খাদ্যরূপে গ্রহণের চেষ্টায় গলাটি ক্রমশ লম্বা হয়ে গেছে। এটি ব্যবহারের সপক্ষে প্রমাণ দেয়।
- অব্যবহারের সপক্ষে উদাহরণ – মানুষের পূর্বপুরুষের ল্যাজ ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে আজ নিষ্ক্রিয় অঙ্গ কক্সিসে পরিণত হয়েছে। অতীতে উটপাখির ডানা সক্রিয় থাকলেও বংশপরম্পরায় অব্যবহারের ফলে তা নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এগুলি অব্যবহারের সপক্ষে যুক্তি দেয়।
- অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ – ল্যামার্ক এই সূত্রে বলেন — আপন প্রচেষ্টায় জীবদ্দশায় যেসব বৈশিষ্ট্য জীব অর্জন করে, সেইসব বৈশিষ্ট্য পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে, অর্থাৎ এক জনু থেকে অপর জনুতে সঞ্ঝারিত হয়। এককথায়, জীবের অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ঘটে। যেমন — বহুকাল আগে জিরাফের গলা ছোটো ছিল। কিন্তু কালক্রমে উঁচু গাছের পাতা আহরণের চেষ্টায় তা ক্রমশ লম্বা হয়েছে। এই লম্বা গলার বৈশিষ্ট্যটি বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে আজকের লম্বা গলাযুক্ত জিরাফের আবির্ভাব হয়েছে।
- নতুন প্রজাতির উদ্ভব – অর্জিত গুণাবলি বংশপরম্পরায় বাহিত হওয়ার ফলে অনেকগুলি প্রজন্ম বাদে প্রজাতির মধ্যে পরিবর্তন আসে এবং অবশেষে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। ল্যামার্কের মতে এটাই হল বিবর্তনের মূল পদ্ধতি।
অভিব্যাক্তি হল একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি জীব তার পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। অভিযোজনের ফলে একটি জীব তার পরিবেশে আরও ভালভাবে বেঁচে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। অভিযোজন এবং বিবর্তন একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। অভিযোজনের মাধ্যমে জীবের মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত হয়।