নতুন সামাজিক ইতিহাস হল ইতিহাসের অধ্যয়নের একটি পদ্ধতি যা 20 শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভূত হয়েছিল, যা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অভিজাতদের পরিবর্তে সাধারণ মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে। এটি নারী, শ্রমিক এবং সংখ্যালঘুদের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা ও কণ্ঠস্বরকে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে আনার প্রয়াস।
নতুন সামাজিক ইতিহাস আন্দোলন 1960 এবং 1970-এর দশকে একটি বৃহত্তর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্থান থেকে বেড়ে ওঠে, কারণ ঐতিহাসিক এবং অন্যান্য পণ্ডিতরা কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বা প্রান্তিক করা ঐতিহ্যবাহী বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছিলেন। ডায়েরি, চিঠিপত্র এবং মৌখিক ইতিহাস সহ বিভিন্ন সূত্রের উপর অঙ্কন করে, নতুন সামাজিক ইতিহাসবিদরা এমন লোকদের দৈনন্দিন জীবন পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন যারা পূর্বে ঐতিহাসিক বিবরণগুলিতে উপেক্ষা বা উপেক্ষা করা হয়েছিল।
নতুন সামাজিক ইতিহাস কী তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে গড়ে ওঠা নতুন সামাজিক ইতিহাস ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালের বিভিন্ন ঘটনা ও মতাদর্শের ফলশ্রুতি। এই ইতিহাসের মূল বিষয় হল সমাজের সামগ্রিক ইতিহাস
সামাজিক ইতিহাসের বিভিন্ন দিক -সামাজিক ইতিহাস-এর বিভিন্ন দিক হল —
সামাজিক ইতিহাসের নতুনত্ব – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সমাজের নিচুতলার মানুষ ও বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মানুষের ইতিহাস গুরুত্বলাভ করে। এভাবে সামাজিক ইতিহাসের সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে এই ইতিহাসের পরিধি বিস্তৃত হয় ও তা নতুন সামাজিক ইতিহাসরূপে পরিচিত হয়।
এই ইতিহাসের বিষয়গত দিক হল – নতুন সামাজিক ইতিহাস হল আমাদের পারিপার্শ্বিক সমস্ত ঘটনা-বঞ্ছনার তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধান ও তার বিশ্লেষণ। যার পরিধি হল পরিবার থেকে রাষ্ট্র ও বিশ্ব। নতুন ধরনের ও সামাজিক ইতিহাসের বিষয়গত দিক হল শ্রমিক কৃষক ইতিহাস, লিঙ্গগত ইতিহাস, কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাস, অভিপ্রয়াসের ইতিহাস, যুবক ও শিশুসহ পরিবারের ইতিহাস, গোষ্ঠী ইতিহাস, হিংসার ইতিহাস প্রভৃতি।
সংশোধনবাদ – নতুন সামাজিক ইতিহাস ছিল একধরনের ঐতিহাসিক সংশোধনবাদ। এটি হল প্রচলিত রাজনৈতিক,সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাসের একটি বিকল্প ইতিহাস এবং সংশোধনবাদী ইতিহাস।
প্রতিষ্ঠান – নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার জন্য ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য সোশ্যাল সায়েন্স হিস্ট্রি অ্যাসোশিয়েশন’। এটির মুখপত্র হল ‘সোশ্যাল সায়েন্স হিস্ট্রি’।
উপসংহার – নতুন সামাজিক ইতিহাস সমালোচনামুক্ত নয়। অনেকক্ষেত্রেই এই ইতিহাসে প্রচলিত ইতিহাসকে খণ্ডন করা হয় এবং নতুন তথ্য ও সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
নতুন সামাজিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – আধুনিক ইতিহাসচর্চার একটি বিশেষ দিক হল ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চা। এটি ছিল প্রচলিত ইতিহাসচর্চার একটি বিকল্প ও সংশোধনবাদী ধারার ইতিহাসচর্চা।
প্রেক্ষাপট –
নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে —
উন্নয়ন প্রচেষ্টা- প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে উদার সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন, জীবনযাত্রাসহ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রচেষ্টা মানব সমাজে অগ্রগতির সূচনা করে। ফলে সমাজের নিচুতলার মানুষ গুরুত্বলাভ করে
আন্দোলন ও মতাদর্শ – ১৯৬০ ও ১৯৭০ – এর দশকে জাতিবিদ্বেষ, যুদ্ধবিরোধী মানসিকতা, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ফলে ঘটনার নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ শুরু হয়।
অবহেলিত বিষয়ে গুরুত্বদান – ঐতিহাসিক লরেন্স ডব্লু লেভাইন তাঁর ‘Black Culture’ উপর গবেষণালব্ধ বইয়ের প্রথম বাক্যেই ঘোষণা করেন যে, এটাই হল সেই সময় যখন ঐতিহাসিকদের নিজস্ব চেতনা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন এবং একইভাবে গবেষণার মাধ্যমে অবজ্ঞা প্রাপ্ত ও অবহেলিত বিষয়গুলির প্রতি গুরুত্ব দান করা।
ঐতিহাসিকদের প্রচেষ্টা – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কসবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী ইউরোপের ঐতিহাসিকগণ সমাজের নিচুতলা থেকে ইতিহাস রচনার সচেষ্ট হন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক হলেন ক্রিস্টোফার হিল, এরিক জে. হবসবন, প্যাট্রিক জয়েস, এডওয়ার্ড থম্পসন প্রমুখ।
উপসংহার – উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, নতুন সামাজিক ইতিহাসের উত্থানের মূলে ছিল বিভিন্ন ঘটনার ফলশ্রুতি। এই ইতিহাসের মূল বিষয় হল সমাজের সামগ্রিক ইতিহাস।