আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন উপাদান মাধ্যমিক ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ টপিক ট্রপিক। নিচে দেওয়া প্রশ্নগুলি ভালোভাবে তৈরি করে গেলে তোমরা অবশ্যই মাধ্যমিক পরীক্ষায় একটি ৪ নম্বরের প্রশ্ন কমন পাবে।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদানরূপে সরকারী নথিপত্রকে কিভাবে ব্যবহার করা হয় তা বিশ্লেষণ করো
ভূমিকা – আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সরকারি নথিপত্র। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বড়োলাট ও ভারত-সচিবের দলিলপত্র, বড়োলাটের নিম্নপদস্থ রাজকর্মচারীদের রিপোর্ট বা প্রতিবেদন ও চিঠিপত্র, পুলিশ ও গোয়েন্দা রিপোর্ট।
ব্যবহার পদ্ধতি – সরকারি নথিপত্রগুলি থেকে ভূমিরাজস্ব, বিদ্রোহ, সরকারের (আর্থিক, রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক) নীতির কথা এবং ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের কথা জানা যায়। কিন্তু এই নথিগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্য সবসময় সত্যি হতে নাও পারে।
তাই এক্ষেত্রে কয়েকটি সর্তকতা নেওয়া প্রয়োজন –
নিরপেক্ষ বর্ণনা – সরকারি নথিপত্রগুলির অধিকাংশেই সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা। উনিশ শতকের কৃষক বিদ্রোহগুলিকে আইন শৃঙ্খলার পক্ষে উপদ্রব সৃষ্টিকারী ঘটনা বা উৎপাত বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু বিদ্রোহী কৃষক নেতা বা আন্দোলনকারীদের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, তা ছিল উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন। একারণেই নথিপত্রগুলির নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
বেসরকারী তথ্য – বেসরকারী নথি বা সাহিত্য বা আন্দোলনকারীদের জীবনস্মৃতি বা মুখের কথার মাধ্যমে সরকারি নথিপত্রগুলির বর্ণনা যাচাই করা প্রয়োজন।
সংবাদপত্র – সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বা রচনায় সমসাময়িক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় এবং এগুলি থেকে সরকারি নথির তথ্য যাচাই করা উচিত। অবশ্য সংবাদপত্রগুলির দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও নিরপেক্ষতা ছিল না, বেশ কিছু সংবাদপত্র ছিল ইংরেজ সরকার পন্থী।
ব্যবহারকারী – সরকারি নথিপত্র থেকে নিরপেক্ষ ইতিহাস গড়ে তুলতে হলে নথিপত্র ব্যবহারকারীকে নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। তাঁকে হতে হবে একইসঙ্গে সঠিক তথ্য চয়নকারী ও তথ্যের বিশ্লেষণকারী।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে জীবনস্মৃতির গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো
ভূমিকা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত জীবনস্মৃতি নামক আত্মজীবনীটি একটু ভিন্ন ধরনের, কারণ এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মগঠনের প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন। তাই আধুনিক ভারতের ব্যক্তি ইতিহাস রচনার উপাদানরূপে এই গ্রন্থটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে জীবনস্মৃতির গুরুত্ব –
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত জীবনস্মৃতির গুরুত্বগুলি হল —
স্মৃতিকথা – এই গ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোবেলার শিক্ষারম্ভ ও ওরিয়েন্টাল সেমিনারির শিক্ষাব্যবস্থা এবং নর্মাল স্কুল ও সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নর্মাল স্কুল ত্যাগ করে বেঙ্গল একাডেমি ও পরে সেন্টজেভিয়ার্স নামক ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করেন।
ধর্মীয় সংস্কৃতি – রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ব্রাহ্মনেতা। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর এই রচনার মাধ্যমে গায়ন্ত্রীমন্ত্র ও ব্রত্মসংগীত – এর কথা এবং ব্রাহ্মধর্মের আত্ম সমালোচনাও জানা যায়।
ঠাকুর বাড়ির পরিবেশ – জীবনস্মৃতি থেকে ঠাকুর পরিবারের পারিবারিক ঐতিহ্য ও সাহিত্য কাব্য-নাটক ও চিত্রকলার চর্চার কথা জানা যায়। আবার এরই সূত্র ধরে জাতীয়তাবাদের বিকাশে ঠাকুরবাড়ির অবদানও পরিলক্ষিত হয়।
স্বাদেশিকতা – রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই স্মৃতিকথায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদোগে এবং রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে পরিচালিত একটি স্বাদেশিকতার সভার কথা বলেছেন। এর পাশাপাশি ঠাকুরবাড়ির সাহায্যে নবগোপাল মিত্রের হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
উপসংহার – এভাবে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি থেকে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের আত্মগঠনের কথা অধিক থাকলেও স্বদেশিকতা ও সমকালের কথা কম রয়েছে। তবে এই গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান।
জীবনের ঝরাপাতা নামক আত্মজীবনী আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বিশ্লেষণ করো
ভূমিকা – সরলা দেবী চৌধুরাণীর (১৮৭২-১৯৪৫ খ্রি.) আত্মজীবনী জীবনের ঝরাপাতা – তে ব্যক্তিজীবনের কাহিনির পাশাপাশি রাষ্ট্রজীবনের কথাও বর্ণিত হয়েছে। তাই আত্মজীবনীটি বিভিন্ন কারণে ভারতের আধুনিক ইতিহাসের এক প্রধান গৌণ উপাদান।
জীবনের ঝরাপাতা নামক আত্মজীবনী আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে গুরুত্ব –
ইতিহাসের উপাদানরূপে যে সমস্ত কারণে এই আত্মজীবনীটি গুরুত্বপূর্ণ তা হল –
ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস – সরলাদেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি। তিনি তাঁর রচনার মাধ্যমে ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্যের (মা-বিচ্ছিন্ন দাসীর দাপট, স্নেহবর্ণিত মাস্টার মশায়ের সন্ত্রাস, ঠাকুর বাড়ির স্নিগ্ধ পরিবেশ ও সংস্কৃতি) প্রকাশ করেছেন।
রাজনৈতিক ইতিহাস – উনিশ শতকের শেষদিকে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জড়িত দুই তাত্ত্বিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দের কথাও জানা যায় এই গ্রন্থ থেকে। আবার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা এবং সরলাদেবী কর্তৃক স্বদেশী ভাবধারা প্রচারের প্রসঙ্গও রয়েছে এই আত্মজীবনীতে।
সামাজিক ইতিহাস – এই গ্রন্থ থেকে সামাজিক ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান পাওয়া যায়, যেমন – অভিজাত পরিবারের কায়দা কানুন, দুধমা-ধাইমার মাধ্যমে সন্তান পালনের কথা। নারীশিক্ষার কথা, বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহেবি সংস্কৃতির কথা এবং ব্রাত্মধর্ম ও ব্রাহ্মসমাজের কথাও এই গ্রন্থে রয়েছে।
সাহিত্যিক গুরুত্ব – জীবনের ঝরাপাতা-র মাধ্যমে সরলাদেবী চৌধুরাণীর জীবনকথাও জানা যায়। প্রদেশের বাইরে সরলাদেবীর চাকরি গ্রহণ ও তা সম্পাদন, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং ভারতী নামক পত্রিকা সম্পাদনার কথাও জানা যায়।
উপসংহার – তবে জীবনের ঝরাপাতার কয়েকটি সীমাবদ্ধতা ছিল এবং একারণেই তা পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। তাই এই গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে সমসাময়িক অন্যান্য নথিপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের দ্বারা যাচাই করা প্রয়োজন।
ইন্দিরা গান্ধিকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠি (Letters from a Father to His Daughter) থেকে কিভাবে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়?
ভূমিকা – আধুনিক ভারতের ইতিহাসের অন্যতম উপাদান হল চিঠিপত্র এবং এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইন্দিরাগান্ধীকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠি (Letters From a Father to His Daughter)
ইন্দিরা গান্ধিকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠি ইতিহাসের উপাদান –
জওহরলাল নেহরুর লিখিত উপরোক্ত চিঠি থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের যে সমস্ত উপাদান পাওয়া যায় সেগুলি হল —
চিঠিপত্র সেন্সর – চিঠিপত্র সংবলিত গ্রন্থটির ভূমিকা থেকে জওহরলাল নেহরুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জেলবরণের কথা জানা যায়। এছাড়া আরোও জানা যায়, জেল থেকে জেলবন্দীর ঘন ঘন চিঠি লেখা যেত না, বা একজন জেলবন্দীকে রেফারেন্স বইপত্রও সরবরাহ করা হত না।
আমদানীকারক ভারত – তাঁর চিঠিপত্র থেকে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের তুলা উৎপাদন ও তা কম দামে ইংল্যান্ডে রপ্তানীর কথা জানা যায়। আবার এই তুলায় তৈরি বস্ত্র সামগ্রী ভারতে আমদানী করার কথাও জানা যায়। এভাবে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির দিকটি নির্দেশিত হয়েছে।
খাদ্যসংকট – জওহরলাল নেহেরুর চিঠিপত্র থেকে ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধনী ঘরে খাদ্যের উদ্বৃত্ত ও গরিবদের মধ্যে খাদ্যসংকটের কথা জানা যায়। তিনি অর্থনৈতিক বৈষম্যের দূরীকরণে খদ্দর কিনে পরিধানের কথা প্রচার করেন এবং এভাবে গরীব তাঁতিদের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করার কথা বলেন।
দেশীয় রাজ্যগুলির পরিস্থিতি – জওহরলাল নেহরুর চিঠিপত্র থেকে দেশীয় রাজাদের কথা ও তাদের অর্থক্লিষ্ট প্রজাদের কথাও জানা যায়। তিনি ভারতীয় প্রজাদের অর্থে দেশীয় রাজাদের বিলাসব্যাসন ও শৌখিন গাড়ি চড়ার সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে এই সমস্ত প্রজাদের অন্নকষ্ট, শিক্ষার অভাব ও চিকিৎসার অভাবকেও তুলে ধরেছেন।
উপসংহার – জওহরলাল নেহুরর চিঠিপত্র থেকে ভারতের বিদেশী শাসন, ধর্ম, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের কথা জানা যায় যা আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বঙ্গদর্শন নামক সাময়িক পত্র থেকে কিভাবে ভারত ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়?
ভূমিকা – সরকারি নথিপত্র ও আত্মজীবনী থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের পাশাপাশি সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র থেকেও ভারত ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত মাসিক পত্রিকা বঙ্গদর্শন (১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ)।
বঙ্গদর্শন ও ইতিহাসের উপাদান – বঙ্গদর্শন – এ সাহিত্য রচনার পাশাপাশি ইতিহাস, পুরাতত্ব, সমাজতত্ব, ধর্মতত্ব, বিজ্ঞান ও কৃষিতত্ব আলোচিত হত। এছাড়া গ্রন্থ আলোচনা ও বাঙালির জীবনচর্চাও প্রকাশিত হয়েছিল। তাই বঙ্গদর্শন থেকে প্রাপ্ত উপাদানকে ভারত ইতিহাসের উপাদান রূপে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন –
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত – বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উপর আধুনিক বঙ্গসমাজ নির্মিত হয়েছে। বঙ্গদর্শন – এর এরূপ মতামত ও আলোচনা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আলোচনাকালে উপাদানরূপে ব্যবহার করা যায়।
স্বার্থ সংঘাত – ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজি শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এঁরা স্বার্থ সম্পর্কে উদাসীন ছিল। তাই কৃষক শ্রেণির সঙ্গে শিক্ষিত মানুষের সামাজিক সংঘাত শুরু হয়। বঙ্গদর্শন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করা যায়।
কৃষক স্বার্থ সংরক্ষণ – চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কৃষক স্বার্থ নষ্ট হয়েছিল ; চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথাই ছিল এর মূল কারণ। তাই বঙ্গদর্শন – এ কৃষক স্বার্থ সংরক্ষণের কথা প্রচার করা হয়। স্বাভাবিক কারনেই বঙ্গদেশের কৃষক অসন্তোষের ব্যাখ্যাকালে বঙ্গদর্শন থেকে প্রাপ্ত তথ্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
স্ববিরোধী তথ্য – বঙ্গদর্শন – এর তথ্য স্ববিরোধী। কারণ বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর এই রচনায় কৃষক স্বার্থ সংরক্ষণের পাশাপাশি ইংরেজ ও জমিদারদের হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন।
উপসংহার – এভাবে দেখা যায় বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, জমিদারি ব্যবস্থা এবং কৃষক অসন্তোষ ও কৃষক স্বার্থ সংক্রান্ত আলোচনায় বঙ্গদর্শন থেকে তথ্য পাওয়া যায়। তবে এগুলি ব্যবহারকালে সতর্কতা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চায় ফটোগ্রাফের ব্যবহার কিভাবে করা হয় সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চায় ফটোগ্রাফের ব্যবহার একধরনের নতুন ঐতিহাসিক উপাদান। ১৮৫০-র দশকে ভারতে ফটোগ্রাফি বা ক্যামেরা-ছবি তোলা শুরু হয়।
উপাদান –
ফটোগ্রাফি থেকে ভারতের ইতিহাসের যে সমস্ত উপাদান পাওয়া যায় সেগুলি হল —
স্থাপত্য ও প্রত্নক্ষেত্র সংরক্ষণ – ভারতে ফটোগ্রাফির ব্যবহার শুরু হলে ভারতের স্থাপত্য ও প্রত্নক্ষেত্রগুলিকে ফটোগ্রাফির মাধ্যমে সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এভাবে সংরক্ষিত প্রত্নক্ষেত্রগুলির ফটোগ্রাফি সংরক্ষণ ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
১৮৫৭-র বিদ্রোহ – উনিশ শতকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকালের বিভিন্ন মুহুর্তকে ধরে রাখতে ফটোগ্রাফির সাহায্যে নেওয়া হয়। কলকাতা, বোম্বাই, লখনউ প্রভৃতি স্থানের বিদ্রোহের ছবি এই বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান।
রাজকীয় অনুষ্ঠানের ছবি – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দিল্লি দরবার কলকাতায় ইংল্যান্ডের রাজপরিবার সদস্যদের আগমন বা বিভিন্ন ভাইসরয়ের কার্যগ্রহণের দিন ও অবসরগ্রহণের দিন বা বিভিন্ন ঘটনার ছবি তুলে রাখা হয়। এই সমস্ত ফটোগ্রাফির সাহায্যে ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসন ও ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র ফুটে উঠে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম – বিংশ শতকের শুরু থেকে ভারতীয়দের ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন বা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় ফটোগ্রাফি বিভিন্নভাবে প্রাথমিক উপাদানরূপে ব্যবহৃত হয়। অসহযোগ, আইন অমান্য, ভারতছাড়ো আন্দোলনকালের বিভিন্ন ছবি এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
উপসংহার – ইতিহাসের উপাদানরূপে ফটোগ্রাফির ব্যবহার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলেও ফটোগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নৈর্ব্যক্তিক নয়। ক্যামেরাম্যান বা ফটোগ্রাফার কর্তৃক তোলা ছবি থেকে আমরা সঠিক ইতিহাস পাই না। কারণ এগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারী নির্দেশে গৃহীত ছবি। তাই এগুলির নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন রয়ে যায়।
ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণ করো
ভূমিকা – ইতিহাসচর্চায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল তথ্য সংগ্রহ ও তার বিশ্লেষণ। তথ্যসংগ্রহের জন্য স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলি হল সাধারণ মহাফেজখানা, গ্রন্থাগার বা বিভাগীয় দপ্তর। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানগুলির পাশাপাশি ইন্টারনেট থেকেও ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা –
ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাগুলি হল –
তথ্যের সহজলভ্যতা – দেশ বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র, গ্রন্থাগার ও মহাফেজখানা, মিউজিয়াম প্রভৃতির সংগৃহীত নথিপত্র ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ইন্টারনেট-এ আপলোড-এর ফলে সহজেই তথ্য পাওয়া যায়।
সময় ও খরচ হ্রাস – ইতিপূর্বে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বা বিদেশে গমনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হত। কিন্তু এখন ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা খুব অল্প সময়ে ও অল্প খরচে পাওয়া যায়। ফলে সময়ের অপচয় কমে ও গবেষণা খরচ হ্রাস পায়।
ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে ইন্টারনেট ব্যবহারের অসুবিধা –
ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারের কিছু অসুবিধাও রয়েছে যেমন –
সত্যাসত্যের অনিশ্চয়তা – চাক্ষুষ নথিপত্র ঘেঁটে বা আকর গ্রন্থপাঠ করে ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহের সত্যতা সম্পর্কে যতটা নিশ্চিত হওয়া যায় ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে তা সম্ভব নয়।
তথ্য সূত্রের অভাব – ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহকালে তথ্যের তথ্যসূত্র তেমন থাকে না। ফলে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতাও থাকে না। আবার অনেক সময় ইন্টারনেট-এ তথ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে ; ফলে গবেষণার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
উপসংহার – একথা সত্য যে, কোনো একটি বিষয়ে অল্পসময়ে ইন্টারনেট-এ প্রচুর পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত তথ্য পাওয়া যায়। এই তথ্যগুলি চটজলদি ব্যবহার করা গেলেও পরে আকর গ্রন্থ বা নথিপত্র থেকে মিলিয়ে নেওয়া উচিত। এর ফলে ইতিহাস বিকৃতি ঘটে না।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা – আধুনিক ইতিহাসচর্চার একটি ধারা হল বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস। বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিকাশ, প্রযুক্তির উদ্ভব ও তার অগ্রগতি এবং চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতিই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা নামে পরিচিত।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য – বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল —
জ্ঞানচর্চার ইতিহাস – বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রকৃতি ও মানব শারীরতত্ত্ব সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও তার ব্যাখার ফলেই তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক জ্ঞানের উন্মেষ ঘটেছে। তাই এই ইতিহাস হল বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার ইতিহাস।
অগ্রগতি উপস্থাপন – এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় ইউরোপের রেনেসাঁস পর্বের পরবর্তীকাল থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত সময়ের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শারীরজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতি পরিমাপ করা হয়।
মানবসভ্যতায় প্রভাব – বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা কিভাবে মানব সমাজ ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে এবং দেশের অর্থনৈতিক, সামরিক ও চিকিৎসার ক্ষেত্রকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা আলোচনা করা এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
মানব সভ্যতা থেকে যন্ত্র সভ্যতা – মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে চাকার আবিষ্কার ও আগুনের ব্যবহার ছিল গুরুত্বপূর্ণ সূচনা বিন্দু। আবার মানুষ তার বুদ্ধি ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও তাদের তাই প্রযুক্তির উন্নতি ঘটায়। প্রযুক্তির অগ্রগতিকে চিহ্নিত করে মানবসভ্যতার যন্ত্রসভ্যতায় উত্তরণকে ব্যাখ্যা করা এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার – এভাবে দেখা যায় যে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা আধুনিক ইতিহাসচর্চার এক বিশেষ অঙ্গরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনকি সাধারণ ইতিহাসচর্চা ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
শহরের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো?
ভূমিকা – আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শহরের ইতিহাসচর্চা। ১৯২০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শহর-ইতিহাসচর্চা শুরু হয় এবং ১৯৬০-র দশকে থেকে এই ইতিহাসচর্চায় জোয়ার দেখা দেয়।
শহরের ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য – শহর ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল —
শহরের উদ্ভব ও অবক্ষয় – কেন ও কিভাবে শহরের উদ্ভব ঘটে এবং শহরের প্রসার ও তার অবক্ষয়কে চিহ্নিত করাই হল শহরের ইতিহাসচর্চার প্রধানতম দিক। তাই এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় গড়ে ওঠা শহর বা অবক্ষয়প্রাপ্ত শহর বা মহানগরকে গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া হয়।
শহর-সংস্কৃতি – শহরের বাসিন্দা ও তাদের বিন্যাস, শহরে অভিপ্রয়ানের ইতিহাস এবং তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপকে চিহ্নিত করে শহরের বিবর্তনকে চিহ্নিত করা শহর ইতিহাসচর্চার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
শহর ভূগোল – শহর ইতিহাসচর্চায় শহরের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সামরিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্বকে চিহ্নিত করা হয়। এগুলি শহরের ইতিহাস ও নাগরিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
শহর স্থাপত্য – শহরে নাগরিকদের বাসস্থান, প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিককেন্দ্র নির্মাণ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ, খেলা ও অবসর বিনোদনের জন্য স্টেডিয়াম ও পার্ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়। এভাবে শহরের স্থাপত্যগুলি তৈরি করে স্থাপত্য ইতিহাস। তাই শহর ইতিহাসের সঙ্গে স্থাপত্য-ইতিহাসও জড়িয়ে পড়ে।
উপসংহার – এভাবে দেখা যায় যে, শহর ইতিহাস শুধুমাত্র শহরের উদ্ভব ও অবক্ষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় না, বরং তার সঙ্গে সামাজিক, আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।