নবম শ্রেণি – বাংলা – হিমালয় দর্শন – (গল্প) বেগম রােকেয়া

নবম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তকে বেগম রোকেয়ার লেখা হিমালয় দর্শন গদ্যটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই গদ্যে লেখিকা তার হিমালয় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। গদ্যটিতে হিমালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, এবং নারী সমাজের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

নবম শ্রেণি – বাংলা – হিমালয় দর্শন

লেখিকা পরিচিতি

ভূমিকা – আপনারা শুনিয়া বিস্মিত হইবেন যে আমি আজ বাইশ বৎসর যাবৎ ভারতের সর্বাপেক্ষা হতভাগ্য জীবের জন্য রোদন করিতেছি, এই হতভাগ্য জীব কাহারা জানেন? সে জীর ভারতনারী, এই জীবগুলির জন্য কখনও কাহারও প্রাণ কাঁদে না। পশুর চিন্তা করিবারও লোক আছে, তাই যত্রতত্র পশু-ক্লেশ-নিবারণী সমিতি দেখিতে পাই। কিন্তু আমাদের মতো অবরোধ বন্দিনী নারী জাতির জন্য কাঁদিবার একটি লোকও এই ভূভারতে নাই। — এই উক্তির বক্তা বেগম রোকেয়া। বাংলাদেশের মুসলিম নারী প্রগতির ইতিহাসে এক অগ্রণী প্রতিনিধি।

জন্ম ও শৈশব – ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জহিরুদ্দিন মোহম্মদ আবু আলি হায়দার সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন এবং মা ছিলেন রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানি। বেগম রোকেয়ারা ছয় ভাইবোন ছিলেন।

শিক্ষা – সেই সময়ের মুসলিম সমাজের অনুশাসন মেনে রোকেয়া ও তাঁর বোনদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়নি। বাড়িতেই তাঁদের আরবি ও উর্দু শেখানো হত। রোকেয়ার দাদা ইব্রাহিম আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন। তিনি রোকেয়াকে বাড়িতে গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখাতেন। রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম।

ব্যক্তিজীবন – ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন হিসেবে পরিচিত হন। রোকেয়ার স্বামী ছিলেন উদার মনের মানুষ। রোকেয়াকে তিনি লেখাপড়ায় উৎসাহ দিতেন। স্বামীর আগ্রহেই রোকেয়া সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।

শিক্ষাবিস্তারে ভূমিকা – ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে রোকেয়ার স্বামীর মৃত্যু হয়। এর পাঁচ মাস পরে তিনি ভাগলপুরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল নামে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু কিছুদিন পর জমি সংক্রান্ত বিবাদের জেরে স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ কলকাতায় পুনরায় স্কুলটি চালু করেন। বর্তমানে এটিই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল নামে পরিচিত।

সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড – স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত ছিলেন বেগম রোকেয়া। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি মুসলিম নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

সাহিত্যজীবন – ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে পিপাসা নামক একটি বাংলা গল্পের মাধ্যমে বেগম রোকেয়ার সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা Sultana’s Dream বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের একটি মাইলস্টোন। পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি। তাঁর রচনার কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল — প্রবন্ধ ও গল্প-উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষা এবং লিঙ্গসমতার পক্ষে সওয়াল করেছেন। হাস্যরস এবং ব্যঙ্গবিদ্রুপের মাধ্যমে তাঁর রচনাগুলিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থানের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লেখার মাধ্যমে তিনি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ধর্মের নামে নারীজাতির প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন। সর্বোপরি শিক্ষা এবং পছন্দ অনুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারীর মুক্তি সম্ভব নয়, লেখার মধ্য দিয়ে বারবার সেই বার্তাই দিয়েছেন তিনি।

সম্মান ও স্বীকৃতি – বেগম রোকেয়ার স্মরণে বাংলাদেশ সরকার তাঁর পৈতৃক ভিটের ওপরেই বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র নামক একটি গণ-উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। তাঁর নাম স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়।

জীবনাবসান – ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর ভোরবেলা এই বিখ্যাত সমাজসংস্কারক, সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।

উৎস

পাঠ্যরচনাংশটির পূর্ণরূপ কুপমণ্ডুকের হিমালয় দর্শন রচনাটি মহিলা পত্রিকার ১০ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, কার্তিক ১৩১১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।

রচনাপ্রসঙ্গ

বেগম রোকেয়া নবনুর, সওগাত, মোহম্মদী এবং The Mussalman পত্রিকা ছাড়াও মহিলা পত্রিকাতেও বেশ কিছু গদ্য ও কবিতা লিখেছেন। মহিলা পত্রিকার বৈশাখ ১৩১০ থেকে ভাদ্র ১৩১৪ পর্যন্ত ১৪টি সংখ্যায় তাঁর ১০টি রচনা প্রকাশিত হয়। মহিলা পত্রিকায় বেগম রোকেয়ার পাঁচটি গদ্য এবং পাঁচটি পদ্য প্রকাশিত হয়। রচনাগুলি হল — অলঙ্কার না Badge of Slavery (প্রবন্ধ), প্রভাতের শশী (কবিতা), পরিতৃপ্তি (কবিতা), স্বার্থপরতা (কবিতা), কুপমণ্ডুকের হিমালয় দর্শন (ভ্রমণকাহিনি), কাঞ্চনজঙ্ঘা (কবিতা), প্রবাসী রবিন ও তাহার জন্মভূমি (কবিতা), নারী-পূজা (সংলাপ-নিবন্ধ), মোসলমান কন্যার পুস্তক সমালোচনা (গ্রন্থ-আলোচনা) এবং দজ্জাল (নিবন্ধ)। হিমালয় দর্শন রচনাংশেও মহিলা পত্রিকার প্রসঙ্গ একবার এসেছে – মহিলা – র সম্পাদক মহাশয় আমাদের সম্বন্ধে একবার লিখিয়াছিলেন যে, রমণীজাতি দুর্বল বলিয়া তাহাদের নাম অবলা। জিজ্ঞাসা করি, এই ভুটিয়ানিরাও ঐ অবলা জাতির অন্তর্গত না কি? ইহারা উদরান্নের জন্য পুরুষের প্রত্যাশী নহে, সমভাবে উপার্জন করে। অধিকাংশ স্ত্রীলোকদিগকেই পাথর বহিতে দেখি অবলারা প্রস্তর বহিয়া লইয়া যায়। সবলেরা পথে পাথর বিছাইয়া রাস্তা প্রস্তুত করে, সে কাজে বালক বালিকারাও যোগদান করে। এখানে সবলেরা বালক বালিকার দলভুক্ত বলিয়া বোধ হয়।

বিষয়সংক্ষেপ

হিমালয় পর্বতের কোল ঘেঁষে চলে গেছে হিমালয় রেল রোড। ছোটো আকারের হিমালয়ান রেলগাড়িতে চেপে শিলিগুড়ি থেকে কার্সিয়াং যাত্রা করেছেন লেখিকা বেগম রোকেয়া। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, পর্বতচূড়া ডিঙিয়ে কিংবা গহন অরণ্যের বুক চিরে উঠে যাওয়া রেলপথে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছে বিশালকায় জলপ্রপাত কিংবা সবুজ চা বাগান। পর্বতের পেছনে মেঘ-বায়ুর লুকোচুরি খেলা, পাহাড়ের ঢালকে সোনার রঙে রাঙিয়ে দিয়ে সূর্যের অস্ত যাওয়া লেখিকার মনকে খুশিতে ভরিয়ে তুলেছে। হিমালয় দর্শন প্রবন্ধটিতে সৃষ্টিকর্তার তুলিতে আঁকা এই নৈসর্গিক প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন লেখিকা। সঙ্গে ঝরে পড়েছে স্রষ্টার প্রতি তাঁর আন্তরিক শ্রদ্ধা।

কার্সিয়াং যাবার পথে অপরূপ সুন্দর কতগুলি জলপ্রপাত লেখিকার মন ভরিয়ে দেয়। ওইরকম একটি জলপ্রপাতই যে জাহ্নবীর উৎস তা ভেবে লেখিকা অবাক হয়ে যান। জল পরিবর্তনের জন্য একটি বড়ো জলপ্রপাতের কাছে ট্রেন থামলে প্রাণভরে তার সৌন্দর্য উপভোগ করেন লেখিকা।

৪৮৬৪ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত কার্সিয়াং স্টেশনের কাছে লেখিকাদের বাসা ছিল। লেখিকা যে সময় কার্সিয়াং পৌঁছোন তখন শীত বা গ্রীষ্মের প্রকোপ ছিল না। পর্বতের বসন্তকাল বলেই আবহাওয়া ছিল মনোরম। লেখিকার সৌন্দর্যপ্রিয় মন পর্বতের মাঝে যেন ব্যাপ্তি খুঁজে পায়। প্রবন্ধটিতে লেখিকা জলপ্রপাতের স্বচ্ছ, সুন্দর জল দেখে ও স্পর্শ করে এবং তাকে ঘিরে থাকা কুয়াশার সান্নিধ্যে নিজের আনন্দ ও অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন। বায়ু ও মেঘ অস্তগামী সূর্যের আলোয় প্রকৃতির বুকে যে সৌন্দর্যের জগৎ তৈরি করত তা দেখতে-দেখতেই লেখিকার সময় কেটে যেত।

পার্বত্য অঞ্চলে এসে প্রকৃতির ছোটো ছোটো সৌন্দর্যও তাঁর মন ভরিয়ে তোলে। ক্ষুদ্র গুল্ম ঢেঁকিশাকের পরিবর্তে ভূতত্ত্ব বইতে পড়া ২০-২৫ ফিট উঁচু ঢেঁকি গাছ দেখে আত্মহারা হয়ে ওঠেন লেখিকা।

নিবিড় অরণ্যের পথে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে লেখিকার সঙ্গে সাপের সাক্ষাৎ না হলেও, দু-তিনবার জোঁকের কবলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। জোঁকের আলোচনাপ্রসঙ্গে লেখিকা উল্লেখ করেছেন তাঁর ভুটিয়া চাকরানি ভালুর কথা। পার্বত্যপ্রদেশের এই স্ত্রীলোকেরা কোনো কিছুতেই সহজে ভয় পায় না। নারী স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া অসম্ভব পরিশ্রমী এই স্ত্রীলোকদের পুরুষের থেকেও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এদের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি শ্রমশীলা, কার্যপ্রিয়, সাহসী ও সত্যবাদী – র মতো বিশেষণগুলি ব্যবহার করেছেন। যদিও সমতলবাসী বা নীচেকা আদমির সংস্পর্শে এদের সদ্‌গুণ হারিয়ে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্যে লেখিকার প্রকৃতিপ্রেমী হৃদয় তৃপ্ত এবং ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। বঙ্গোপসাগর দেখে তাঁর সমুদ্র দেখার সাধ মিটেছিল। পর্বত এবং পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক শোভা দেখে তাঁর দেখার ইচ্ছা বেড়েছে। ঈশ্বরের সৃষ্ট জগৎ ও জগতের বিপুল বৈচিত্র্যকে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করেছেন এবং স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধায় তিনি বিনম্র চিত্তে বারবার ঈশ্বরের গুণগান গেয়েছেন।

নামকরণ

হিমালয় দর্শন লেখিকার শিলিগুড়ি থেকে কার্সিয়াং যাওয়ার পথে এবং কার্সিয়াং – এ পৌঁছে হিমালয়ের সৌন্দর্যের যে উপলব্ধি ও উপভোগ তারই বর্ণনা। হিমালয়ান রেলগাড়িতে করে যাওয়ার সময়ে পাহাড়চূড়া আর অরণ্যের মিলিত মনোরম দৃশ্য লেখিকা উপভোগ করেছিলেন। মেঘের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে নীচে সাদা কুয়াশার আড়ালে লতা ঘাস পাতা সবই মনোহর লাগছিল। চায়ের বাগানগুলি সেই সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝেই তাঁর চোখে পড়ছিল বর্ণনার অতীত সৌন্দর্যের জলপ্রপাতগুলি। এভাবে কার্সিয়াং পৌঁছোনোর পরে সেখানকার স্বচ্ছ বায়ু, মেঘের সঙ্গে সূর্যের লুকোচুরি খেলা, পশ্চিম আকাশে পাহাড়ের গায়ে ঢেলে দেওয়া তরল সোনার মতো সূর্যের আলো লেখিকাকে আত্মহারা করে দেয়। উপলব্ধির সঙ্গে জুড়ে থাকে অভিজ্ঞতাও। সে অভিজ্ঞতা যেমন ঢেঁকিতরুর, তেমনি জোঁকের রক্তশোষণের। পরিশ্রমী ভুটিয়া মহিলাদের সাহস, সততা এবং কাজের উদ্যমকেও তিনি লক্ষ করেন। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য লেখিকার মনে হয় যেন ঈশ্বরেরই সৃষ্টি। এইভাবে হিমালয়কে নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুভবের সাহায্যে যেভাবে দেখেছিলেন লেখিকা তারই অনবদ্য বর্ণনা থাকায় রচনার নাম হিমালয় দর্শন অত্যন্ত যথার্থ হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক নামকরণের সার্থক দৃষ্টান্ত এটি।

হিমালয় দর্শন গদ্যটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম। এটি হিমালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, এবং নারী সমাজের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের জানার সুযোগ করে দেয়।

Share via:

মন্তব্য করুন