নবম শ্রেণী ইতিহাস – শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ – ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন উত্তর

আজকের আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায়, “শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ” থেকে কিছু ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলি প্রায়ই এসব পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।

Table of Contents

নবম শ্রেণী ইতিহাস - শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ - ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন উত্তর

শিল্পবিপ্লব (Industrial Revolution) কী? এই ঘটনাকে শিল্পবিপ্লব বলার যৌক্তিকতা কী?

ভূমিকা – অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি ও তার গুণগত মানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নতি হয়, তাকেই সাধারণভাবে শিল্পবিপ্লব (Industrial Revolution) বলা হয়। 1837 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সমাজতন্ত্রী নেতা লুই অগাস্ট ব্লাঁকি (Louis Auguste Blanqui) শিল্পবিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন। 1845 খ্রিস্টাব্দে পুনরায় শিল্পবিপ্লব কথাটি ব্যবহার করেন জার্মান সমাজতন্ত্রী দার্শনিক ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস (Friedrich Engels)। তবে 1880-81 খ্রিস্টাব্দে শিল্পবিপ্লব কথাটিকে জনপ্রিয় করেছিলেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি (Arnold Toynbee)।

শিল্পবিপ্লব (Industrial Revolution)

শিল্পবিপ্লবের সংজ্ঞা – বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদ শিল্পবিপ্লবের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

ফিশার (Fisher) প্রদত্ত সংজ্ঞা – ঐতিহাসিক ফিশার বলেছেন যে, দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রশক্তির ব্যবহার করে শিল্পসামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধিকে শিল্পবিপ্লব বলা হয়।

ফিলিস ডিন (Phyllis Deane) প্রদত্ত সংজ্ঞা – অধ্যাপিকা ফিলিস ডিন বলেছেন যে, কেবলমাত্র যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদন হলেই তাকে শিল্পবিপ্লব বলা যায় না। প্রচুর মূলধন, রাস্তাঘাটের উন্নতি, দক্ষ শ্রমিকের প্রাচুর্য ও উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির বাজার থাকলে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পসামগ্রী উৎপাদনে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, তাকে শিল্পবিপ্লব বলে। তাঁর মতে, শিল্পবিপ্লব ঘটার প্রাথমিক শর্ত হল –

  1. মূলধন – শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করলে বড়ো বড়ো কলকারখানার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।
  2. দক্ষ শ্রমিক – প্রচুর উৎপাদনের জন্য সহজলভ্য দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন।
  3. কাঁচামাল – ব্যাপকভাবে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল প্রচুর পরিমাণে থাকতে হবে।
  4. উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা – কাঁচামাল আনা ও উৎপাদিত সামগ্রী নিয়ে যাওয়ার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন।
  5. বিক্রির জন্য বাজার – উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির জন্য যথেষ্ট চাহিদা বা বাজার থাকতে হবে।

হবসবম (E. J. Hobsbawm) প্রদত্ত সংজ্ঞা – অধ্যাপক হবসবম বলেছেন যে, অনুকূল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শিল্প উৎপাদনে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে, তাকে শিল্পবিপ্লব বলা হয়।

হ্যাজেন (Hazen)-এর অভিমত – ঐতিহাসিক হ্যাজেন বলেছেন যে, শিল্পক্ষেত্রে এই পরিবর্তনকে ‘বিপ্লব’ না বলে ‘বিবর্তন’ বলা বেশি যুক্তিসংগত। তার মতে, ‘বিপ্লব’ বলতে বোঝায় আকস্মিক পরিবর্তন। যেমন — ফরাসি বিপ্লব। কিন্তু শিল্পক্ষেত্রে এই পরিবর্তন আকস্মিকভাবে ঘটেনি। সবার অলক্ষে এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং অষ্টাদশ শতকে তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। ঐতিহাসিক হেজ (Hayes)-ও এই মতের সমর্থক ছিলেন।

শিল্পবিপ্লব বলার যুক্তি – হঠাৎ কোনো পরিবর্তন হলেই তাকে বিপ্লব বলা যায় না। বিপ্লবের ফলে মানুষের আর্থ-সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও পরিবর্তন ঘটে। শিল্পের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন একটি ধারায় অগ্রসর হলেও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানুষের ব্যক্তিজীবনে মৌলিক ও আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। তাই একে বিপ্লব বলে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত। এই মত সমর্থন করেন অধ্যাপক বার্নি ও বেয়ার্ড।

ইংল্যান্ডে কেন প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল?

অথবা, শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ডে কেন প্রথম শুরু হয়, তার পক্ষে চারটি কারণ উল্লেখ করো।

শিল্পবিপ্লব বলতে বোঝায় শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি বা আমূল পরিবর্তন। ঐতিহাসিকদের মতে, 1760-1780 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। অর্থাৎ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছিল।

ইংল্যান্ডে কেন প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল

ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটার কারণ

ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব হওয়ার ক্ষেত্রে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল। শিল্পবিপ্লব তথা শিল্পের প্রসারের জন্য যেসব উপকরণ বা পরিবেশের প্রয়োজন ছিল, ইংল্যান্ডে সেগুলির অভাব ছিল না। মহাদেশের মধ্যে ইংল্যান্ডেই প্রথম শিল্পবিপ্লব হওয়ার কারণগুলি হল নিম্নরূপ —

  • অনুকূল পরিবেশ – ইংল্যান্ডের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সেখানকার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার নিরিখে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধা, বায়ুশক্তি ব্যবহারের সুযোগসহ কয়লা, লোহা প্রভৃতি খনিজ দ্রব্যের প্রাচুর্য সেখানে শিল্প বিকাশের সহায়ক হয়েছিল।
  • কাঁচামালের জোগান – অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে কৃষিবিপ্লবের ফলে শিল্পের প্রয়োজনীয় প্রচুর কাঁচামাল উৎপাদিত হতে থাকে। এছাড়া ইংল্যান্ড, ভারত ও আমেরিকা থেকে সস্তায় নিয়মিত শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, সমসাময়িক ইউরোপীয় দেশগুলির তুলনায় ইংল্যান্ডে আমদানিকৃত কাঁচামালের পরিমাণ ছিল অনেক গুণ বেশি।
  • সুলভ শ্রমিক – অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে জনসংখ্যার বৃদ্ধির দরুন শ্রমিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাছাড়া কারখানায় কাজ করার জন্য প্রচুর মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসতে থাকে। সেই কারণে সেই সময় ইংল্যান্ডে খুব সহজে এবং কম মজুরিতে শ্রমিকের জোগান ছিল, যা শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল।
  • মূলধনের প্রাচুর্য – ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা এই সময় নানা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে এবং ভারত, আমেরিকা ইত্যাদি দেশ থেকে নানাভাবে অর্থ শোষণ করে ইংল্যান্ডের অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ করেছিল, যার ফলে ইংল্যান্ডে শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনের কোনো অভাব হয়নি। সর্বোপরি ইংল্যান্ডের জাতীয় ব্যাংক ‘ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড’ (Bank of England) শিল্পক্ষেত্রে প্রচুর ঋণ দিয়ে শিল্পবিপ্লবে সাহায্য করেছিল।
  • বিশ্বব্যাপী বাজার – এই সময় ইংল্যান্ডের কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পেলে তাদের শিল্পপণ্য কেনার ক্ষমতা বাড়ে। তাছাড়া ইংল্যান্ড নিজের দেশে বিক্রির পর তার উদ্বৃত্ত শিল্পদ্রব্য বিভিন্ন উপনিবেশের বাজারগুলিতে বিক্রির সুযোগ পেয়েছিল। এই উপনিবেশগুলি পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে উৎপাদিত শিল্পদ্রব্যের একচেটিয়া বাজারে পরিণত হয়।
  • যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি – ইংল্যান্ডের ভৌগোলিক অবস্থান, শক্তিশালী নৌবহর ইত্যাদি কারণও সেদেশে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লবে সাহায্য করেছিল। ইংল্যান্ডের সুবিস্তৃত সমুদ্র উপকূল, উন্নত নৌশক্তি ও বন্দর প্রভৃতির ফলে শিল্প উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিভিন্ন দেশ থেকে জলপথে সহজেই ইংল্যান্ডে আনা হত। আবার শিল্পোৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বোঝাই ব্রিটিশ জাহাজগুলি অনায়াসে সব দেশে যাতায়াত করতে পারত। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে খাল ও নদীপথে যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহণের ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট উন্নত।
  • বাণিজ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি – সপ্তদশ শতকের মধ্যেই ইংল্যান্ড কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র থেকে বাণিজ্যনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনীতি খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠায় তারা শিল্প প্রতিষ্ঠায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পায়।
  • বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার – অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটার ক্ষেত্রে শিল্প সহায়ক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের আবিষ্কার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্পিনিং জেনি, উড়ন্ত মাকু, ওয়াটার ফ্রেম, মিউল, পাওয়ার লুম, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, নিরাপত্তা বাতি, ব্লাস্ট ফার্নেস প্রভৃতি আবিষ্কারের ফলে বস্ত্রশিল্পের উন্নতির পাশাপাশি ইংল্যান্ডের কারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থারও অগ্রগতি ঘটে।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারআবিষ্কর্তাআবিষ্কারের সময়কাল (খ্রি.)
উড়ন্ত মাকুজন কে1733
লোহা গলাবার চুল্লিজন স্মিটন1760
স্পিনিং জেনিহারগ্রিভস1765
ওয়াটার ফ্রেমআর্করাইট1761
মিউলস্যামুয়েল ক্রম্পটন1779
বাষ্পীয় ইঞ্জিনজেমস ওয়াট1769
পাওয়ার লুমকার্টরাইট1785
পিচ রাস্তাম্যাক অ্যাডাম ও টেলফোর্ড1811
বাষ্পচালিত রেলইঞ্জিনজর্জ স্টিফেনসন1814
সেফটি ল্যাম্পহামফ্রে ডেভি1815
  • রাজনৈতিক স্থিরতা – অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক স্থিরতা আসে, যা ইংল্যান্ডে শিল্প বিকাশে সহায়তা করে। সর্বোপরি ব্রিটিশ সরকার দেশে শিল্পের প্রসারে বণিক ও শিল্পপতিদের নানাভাবে সহায়তা করে।

উপসংহার – শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান ইংল্যান্ডে ছিল বলে সেদেশে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল। সুতরাং, সার্বিকভাবে বলা যায় যে, শিল্পসহায়ক বিভিন্ন পরিস্থিতিই ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটিয়েছিল।

ইংল্যান্ডের তুলনায় ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রে শিল্পায়ন দেরিতে শুরু হওয়ার কারণগুলি আলোচনা করো।

ভূমিকা – দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রের দ্বারা শিল্পদ্রব্যের ব্যাপক উৎপাদনকে ‘শিল্পবিপ্লব’ বলা হয়। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংল্যান্ডে প্রথম এই শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয় এবং তারপর ধীরে ধীরে তা ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তার করে। তবে ইংল্যান্ডের তুলনায় ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে শিল্পায়ন অনেক দেরিতে শুরু হয়েছিল। দেরিতে শিল্পায়ন শুরু হওয়ার কারণ এক এক দেশে এক এক রকম ছিল।

ইংল্যান্ডের তুলনায় ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রে শিল্পায়ন দেরিতে শুরু হওয়ার কারণগুলি আলোচনা করো।

ফ্রান্স – ইংল্যান্ডের তুলনায় ফ্রান্সে অনেক দেরিতে শিল্পায়ন শুরু হয়। শিল্পায়নের এই বিলম্বের পিছনে প্রধান কারণগুলি হল –

  1. ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের সামন্ত ও অভিজাতদের শিল্পের তুলনায় জমির প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি।
  2. নেপোলিয়নের পতনের পর ফ্রান্সের বৈদেশিক বাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছিল।
  3. ফ্রান্সে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না।
  4. শিল্পবিপ্লবের জন্য যে মূলধন ও পরিকাঠামোর প্রয়োজন ছিল, ফ্রান্সে তার অভাব পরিলক্ষিত হয়।
  5. একাধিক বিপ্লব ঘটায় রাজনৈতিক অস্থিরতাও শিল্পায়নে বাধার সৃষ্টি করে।

ফ্রান্সে শিল্পায়নের অগ্রদূত ছিলেন ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন। তাঁর আমলে ফ্রান্সে রেলপথের প্রসার ঘটে এবং কয়লা, লোহা ও বস্ত্রশিল্পেরও যথেষ্ট উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। ক্রমশ ইউরোপে শিল্পজাত দ্রব্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ফ্রান্স দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।

জার্মানি – ইংল্যান্ডের তুলনায় জার্মানিতে শিল্পায়নের গতি ছিল মন্থর। কারণ –

  1. 1870 খ্রিস্টাব্দের পূর্বে জার্মানি ৩৯টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই সকল রাজ্যগুলির মধ্যে কোনোপ্রকার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ঐক্য ছিল না।
  2. জার্মানির যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল অনুন্নত।
  3. কৃষিপ্রধান জার্মানিতে শিল্পদ্রব্যের চাহিদাও ছিল কম।
  4. জার্মানির কোনো উপনিবেশ না থাকায় শিল্প মানসিকতা গড়ে ওঠেনি।
  5. শিল্পায়নের অন্যতম উপাদান হল মূলধন। সেদিক থেকেও জার্মানি ছিল দুর্বল।

1871 খ্রিস্টাব্দে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর থেকে জার্মানিতে শিল্পায়নের গতি দ্রুত হয়। 1870 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1914 খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে জার্মানি শিল্পনির্ভর দেশে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে বিসমার্ক ও কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়মের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিসমার্ক সংরক্ষণ নীতির দ্বারা জার্মানিতে শিল্পায়নের যে সূচনা করেন, পরবর্তীকালে দ্বিতীয় উইলিয়ম শিল্পায়ন ও বহির্বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এর উন্নয়ন দ্রুততর করে তোলেন। কয়লা, লোহা, ইস্পাত, বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি ছিল জার্মানির শিল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

রাশিয়া – ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তুলনায় রাশিয়ায় শিল্পায়ন অনেক দেরিতে শুরু হয়। এর প্রধান কারণ ছিল রাশিয়ায় সামন্তপ্রথার ব্যাপকতা এবং ভূমিদাস প্রথার উপস্থিতি। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার 1861 খ্রিস্টাব্দে ভূমিদাস প্রথাকে উচ্ছেদ করে শিল্পায়নের দিকে অগ্রসর হন। মুক্তিপ্রাপ্ত ভূমিদাসরা শহরে এসে কলকারখানায় শ্রমিকের কাজে যোগ দেওয়ায় এবং ফ্রান্স ও জার্মানির সহায়তায় রাশিয়ায় রেলপথের সম্প্রসারণ ঘটলে মূলধনভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠে।

মূল্যায়ন – সুতরাং বলা যায় যে, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া প্রভৃতি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিতে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলি ছিল, ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে তা ছিল না। ইংল্যান্ডে শিল্পায়নের সমস্ত অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকায় ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ইংল্যান্ডে প্রথম এবং অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিতে পরে শিল্পায়ন হয়।

ইংল্যান্ড ব্যতীত ইউরোপের অন্যান্য দেশে শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

প্রথম শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ডে সংঘটিত হলেও ইউরোপের অন্যান্য দেশেও শিল্পায়ন পরিলক্ষিত হয়।

ফ্রান্স – ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব বিলম্বিত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফ্রান্সে শিল্পায়ন শুরু হয়। ঐতিহাসিক লুই ডানহাম (Louis Dunham) বলেন যে, 1814 খ্রিস্টাব্দে আধুনিক শিল্পায়ন শুরু হয় এবং 1848-এ তা বৈপ্লবিক রূপ পরিগ্রহ করে। রোস্টো (Rostow) এর মতে, 1830-1860 খ্রিস্টাব্দ ছিল ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের সময়কাল। ফরাসি বিপ্লবের পরে ফ্রান্সের অনেক উপনিবেশ হাতছাড়া হয়ে গেলেও ফ্রান্সে 1800-1815 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অত্যন্ত মন্থর গতিতে শিল্পায়ন শুরু হয়। তবে লুই ফিলিপের সময় ফ্রান্সে শিল্পায়নের প্রকৃত সূচনা ঘটে এবং তা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছোয় তৃতীয় নেপোলিয়নের রাজত্বকালে। লুই ফিলিপের সময় ফ্রান্সে রেলপথ ব্যবস্থার সূচনা হয় এবং তৃতীয় নেপোলিয়ন রেলপথ ব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণ করে শিল্পে গতি আনেন। এ ছাড়া তৃতীয় নেপোলিয়নের সময় আলসাসে সুতিবস্ত্রের কারখানা, লোরেনে ধাতুশিল্পের কারখানা, লায়ার উপত্যকায় রাসায়নিক কারখানা ও লিয়ঁতে রেশমশিল্পের কারখানা স্থাপিত হয়।

ইংল্যান্ড ব্যতীত ইউরোপের অন্যান্য দেশে শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

জার্মানি – 1830 খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়, 1850 খ্রিস্টাব্দে তা গতিলাভ করে এবং জার্মানির ঐক্যবদ্ধকরণ (1870 খ্রি.)-এর পর বিসমার্কের সময়ে তা চরম রূপ লাভ করে। কয়লা ও লোহার প্রাচুর্য থাকলেও জার্মানিতে আন্তঃশুল্কের ক্ষেত্রে নানা অসুবিধা, মূলধনের ও বাজারের অভাব, স্বল্প রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, কৃষি নির্ভরতা ইত্যাদি নানা কারণে দেরিতে শিল্পায়ন দেখা দেয়। জার্মানির শিল্পায়নকে 1815-1870 খ্রিস্টাব্দ এবং 1870-1914 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত — এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগে শিল্পায়নের গতি ছিল মন্থর এবং দ্বিতীয়ভাগে শিল্পে অগ্রগতি ছিল দ্রুত। বিসমার্ক জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার পর জোলভেরেইন শিল্পায়নের পথকে সুগম করে। এ ছাড়া রেলপথ ব্যবস্থা, শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন, শিল্পে মূলধন সরবরাহের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থার পুনর্গঠন ইত্যাদির ফলেও শিল্পায়নে গতি আসে।

রাশিয়া – 1860 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াতে শিল্পায়ন শুরু হয়। 1880-90 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াতে শিল্প সংগঠন ত্বরান্বিত হয় এবং 1917 বলশেভিক বিপ্লবের সময় শিল্পায়নে চরম গতি আসে। রাশিয়ায় ভূমিদাস ব্যবস্থা, মূলধনের অভাব, আন্তঃশুল্ক ব্যবস্থার কড়াকড়ি, সামন্ততান্ত্রিক কৃষি অর্থনীতি ইত্যাদির ফলে শিল্পায়ন বিলম্বিত হয়েছিল। ভূমিদাস বা সার্ফদের মুক্তি আইনের পর শিল্পশ্রমিক পাওয়া সহজতর হয় এবং তা সরকারের অর্থমন্ত্রী সার্জেই উইটের শিল্পস্থাপনায় উৎসাহ, রেলপথের বিস্তার, ভারী শিল্প, কয়লা, অস্ত্র ইত্যাদি শিল্পে উন্নতি এবং রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি রাশিয়ার শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করে।

বেলজিয়াম – বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডের পুঁজিপতিরা বিভিন্ন কলকারখানা, রেলপথ নির্মাণ ইত্যাদিতে সাহায্য করলে বেলজিয়ামের শিল্পায়নে গতি আসে। 1799 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কারিগর উইলিয়ম ককরিলের উদ্যোগে বেলজিয়ামে বস্ত্রশিল্পে উন্নয়ন দেখা দেয়।

ইতালি – 1860-78 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইতালিতে শিল্পোন্নয়ন তেমনভাবে হয়নি। 1889 থেকে 1895 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বস্ত্রশিল্প বিশেষত তুলার এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উন্নতি লক্ষ করা যায়। 1896–1913 খ্রিস্টাব্দ সময়কালে ইতালির শিল্পায়নে জোয়ার আসে। অনুকূল আন্তর্জাতিক পরিবেশ, জলবিদ্যুৎ শিল্পের উন্নতি, উন্নত যন্ত্রশিল্প, ক্রমবর্ধমান কৃষি উৎপাদন, রপ্তানিমুখী শিল্পগুলির উন্নতি ইত্যাদির ফলে সমৃদ্ধ হয়েছিল ইতালি।

স্পেন – অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে স্পেনের জনসংখ্যা বাড়লেও অর্থনৈতিক কাঠামোতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেয়নি। স্পেনে প্রকৃত অর্থে শিল্পের প্রসার শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে 1961 থেকে 1971 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

সুইজারল্যান্ড – 1780 খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যান্ড ছিল ব্রিটেনের তুলাবস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বাজার। 1798 থেকে 1830 খ্রিস্টাব্দ ছিল সুইজারল্যান্ডের শিল্পের উড়ানকাল। সুইজারল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ছিল ঘড়ি। সারা পৃথিবীর ঘড়ির বাজারের 90% সুইজারল্যান্ডে করায়ত্ত ছিল। ঘড়িশিল্প ছাড়াও তুলোশিল্প, এমব্রয়ডারি, সূক্ষ্ম বুননের কাজ, জালি বা লেসের কাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডের অগ্রগতি ছিল অসামান্য।

ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব ও মহাদেশের অন্যত্র শিল্পবিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য কী ছিল?

ভূমিকা – অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। ইউরোপীয় মহাদেশের সঙ্গে ইংল্যান্ডের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় ইংল্যান্ডের শিল্পায়নের প্রভাব ইউরোপ মহাদেশকেও স্পর্শ করে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপ মহাদেশে শিল্পায়ন সম্প্রসারিত হয়। তাই ইংল্যান্ড ও ইউরোপ মহাদেশে শিল্পায়নের মধ্যে বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য ছিল।

ব্রিটিশ শিল্পবিপ্লব ও মহাদেশের শিল্পবিপ্লবের পার্থক্য –

ব্রিটিশ শিল্পবিপ্লবমহাদেশের শিল্পবিপ্লব
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের সময়কাল ছিল 1760-1800 খ্রিস্টাব্দ।ইউরোপের ক্ষেত্রে যা ছিল ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ।
প্রাকৃতিক দিক থেকে ব্রিটেনের আবহাওয়া ও ভৌগোলিক পরিবেশ ছিল শিল্পবিপ্লবের অনুকূল।ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ ব্রিটেনের মতো শিল্পের অনুকূল ছিল না।
ব্রিটেন স্থলপথ ও জলপথে খুব উন্নত ছিল। সমুদ্রপথ ইংল্যান্ডের হাতের মুঠোয় ছিল বলে ইংল্যান্ডকে ‘সমুদ্রের রানি’ বলা হত।ইউরোপ মহাদেশের অন্যান্য দেশগুলি সড়কপথ ও জলপথে ইংল্যান্ডের মতো উন্নতি করতে পারেনি।
ব্রিটেনের রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতা শিল্পবিপ্লবের অনুকূল ছিল।মহাদেশের অধিকাংশ দেশে ঐক্যের অভাব ছিল। ফ্রান্সে বিপ্লবজনিত অস্থিরতা এবং ইতালি ও জার্মানির রাজনৈতিক অনৈক্য এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। দুটি দেশই অনেক ছোটো ছোটো রাজ্যে বিভক্ত ছিল।
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব মূলত বেসরকারি উদ্যোগেই পরিচালিত হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহ ইংল্যান্ডে শিল্পায়নে সহায়ক হয়।কিন্তু ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়াতে বেসরকারি উদ্যোগের চেয়ে সরকারি উদ্যোগের ভূমিকাই ছিল বেশি। এছাড়া ইংল্যান্ডের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই তারা শিল্পায়ন ঘটায়।
ব্রিটেনের আর্থ-সামাজিক স্থিতি ও ব্রিটিশদের মানসিকতা শিল্পবিপ্লবের অনুকূল ছিল।মহাদেশের অন্যান্য দেশে জনগণের মানসিকতা ছিল বিপরীত। তাদের আভিজাত্য ছিল জমিকেন্দ্রিক। তারা শিল্প ও বাণিজ্যকে অমর্যাদাকর বলে মনে করত।
ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক বাণিজ্য উৎপাদিত সামগ্রীর বিক্রির বাজার তৈরি করেছিল।মহাদেশের অন্যান্য দেশে উৎপাদিত সামগ্রীর বিক্রির বাজার ছিল সংকুচিত।
ব্রিটেনের অর্থনীতি ছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশের অর্থনীতি থেকে উন্নত ও স্বতন্ত্র। ঔপনিবেশিক অর্থনীতি ইংল্যান্ডের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছিল।মহাদেশের বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতিই ছিল কৃষিনির্ভর।
ব্রিটেনের উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদন হত।মহাদেশের অন্যান্য দেশে কৃষি উৎপাদন হত নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য।
ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ইংল্যান্ড পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই অগ্রসর হয়েছিল।মহাদেশের শিল্পবিপ্লব ছিল পরিকল্পিত। তারা ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছিল।

মূল্যায়ন – তাই বলা যায় যে, ইউরোপের শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ডের তুলনায় অন্য ধরনের ছিল। আবার বিভিন্ন দেশের শিল্পায়নের প্রকৃতি ও অবয়ব ছিল আলাদা। এ কারণেই ফলাফলের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়।

ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের পেছনে পরিবহণ ব্যবস্থার অবদান আলোচনা করো।

পরিবহণ ব্যবস্থা

ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। শিল্পবিপ্লবকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাদের উত্থান হয়, যা ঔপনিবেশিকতার প্রসারে সাহায্য করেছিল। কোনো দেশের শিল্পকাঠামোয় পরিবর্তন আনার জন্য সেই দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে শিল্পের উপযোগী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর একটি অন্যতম দিক হলো পরিবহণ ব্যবস্থা।

  • স্থল পরিবহণ – স্থলপথে পরিবহণই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পরিবহণ ব্যবস্থা। কিন্তু ক্রমশ দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই পরিবহণ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হয়। এই সময় ঘোড়াই ছিল যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। তাই যাতায়াত ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। শহরগুলির উন্নতি, ডাক পরিবহণের প্রসার, দেশের রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা, রেশমশিল্পের প্রসার ইত্যাদির জন্য রাস্তাঘাটের উন্নতি শুরু হয়।
    প্রথমদিকে টার্নপাইক ট্রাস্টগুলি রাস্তাঘাটের উন্নতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেও এই ট্রাস্টগুলির অব্যবস্থার ফলে রাস্তার উন্নতি লক্ষ করা যায়নি। 18 শতকের শেষে এবং 19 শতকের প্রথমে টেলফোর্ড ও ম্যাক অ্যাডাম নামে দুজন স্কটিশ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিটেনের রাস্তাঘাটের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হন। তাঁরা কঠিন ভিত্তির উপর রাস্তা তৈরি করার উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশে জলনিকাশি নর্দমা নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। ফলে রাস্তাঘাট নির্মাণ ব্যবস্থার উন্নতি হয়। পরবর্তীকালে মোটরগাড়ি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাগুলিকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করা হয়।
  • জলপথ পরিবহণ – শিল্পবিপ্লবের সময়ে কয়লাখনির সঙ্গে জলপথের সংযোগ ঘটানোর জন্য খাল কাটা শুরু হয়। ম্যানচেস্টার ও ওয়ারসলের মধ্যে প্রথম ব্রিজওয়াটার ক্যানেল কাটা হয়। এরপর থেকেই সারা ইংল্যান্ডে খাল কাটার কাজ দ্রুতবেগে চলতে থাকে। 19 শতকের প্রথম দিকে খালগুলি ব্রিটেনে জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল।
    ব্রিটেনের খালগুলি ছিল খুবই প্রয়োজনীয়। একদিকে খালপথে জিনিসপত্র পরিবহণ ছিল কম ব্যয়বহুল, আবার অন্যদিকে খালগুলি দেশের মধ্যে কৃষিকর্মের জন্য জলসেচের কাজ করত। ফলে কৃষিব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। কৃত্রিম খাল খননের ফলে শিল্পবিপ্লব আরও ত্বরান্বিত হয়। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিল সুতিবস্ত্রশিল্প। সুতিবস্ত্রশিল্পের কাঁচামালের জন্য ইংল্যান্ডকে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির উপর নির্ভর করতে হত, তেমনি এই শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্যও জলপথে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হত। 19 শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত যখন রেলপথের বিস্তার ঘটেনি, তখন পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে এবং সুতিবস্ত্রশিল্পগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে খালপথগুলির ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
  • রেলপথ পরিবহণ – শিল্পের ক্ষেত্রে দ্রুত সমৃদ্ধি ঘটলে পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রেও দ্রুততার প্রয়োজন হয় এবং রেলপথের সূচনা হলে খালগুলি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। 19 শতকের প্রথম থেকেই শিল্পবাণিজ্যের ব্যাপক অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। ফলে রাস্তাঘাট ও খালগুলি সেই চাপ বহন করতে ব্যর্থ হয়। দ্রুতগামী পরিবহণ ব্যবস্থা হিসেবে ব্রিটেনে চালু হয় রেল পরিবহণ ব্যবস্থা। প্রথমে ছিল ঘোড়ায় টানা রেল; কিন্তু রেলইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে রেল পরিবহণের কার্যকারিতা ও গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের পিছনে পরিবহণ ব্যবস্থার অবদান আলোচনা করো।

ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের পেছনে পরিবহণ ব্যবস্থার অবদান আলোচনা করো। শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্যবসাবাণিজ্যের চাপ বৃদ্ধি পায় এবং রেলপথের মাধ্যমে দ্রুত পণ্য পরিবহণের ফলে অধিক মুনাফা লাভ হতে থাকে। তাই বলা যায় যে, শিল্পবিপ্লবের ফলেই ব্রিটেনে রেলপথ ব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নতি লক্ষ করা যায়। রেলশিল্পের দ্রুত বিকাশ শিল্পবিপ্লবে গতি আনে।

বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার, বাজারের আয়তন বৃদ্ধি করা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও পরিবহণের অবদান ছিল অপরিসীম। পরিবহণ ব্যবস্থায় উন্নতি ব্রিটেনের সমাজজীবনে এক উন্নততর আধুনিকতা এনে দিয়েছিল। পরিবহণের স্বাচ্ছন্দ্যের ফলে গ্রাম থেকে শহরে মানুষ ভিড় করতে থাকে। তাই বলা যায়, পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি শিল্পবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে, যা আধুনিক ইংল্যান্ডের জন্ম দিয়েছিল।

ইউরোপের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে শিল্পবিপ্লব কীভাবে প্রভাবিত করেছিল? মানুষ গ্রাম থেকে শহরে কেন এসেছিল?

ইউরোপের রাজনীতিতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব

শিল্পবিপ্লব ইউরোপের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছিল।

  • ভূস্বামী ও অভিজাত শ্রেণির পরিবর্তে পুঁজিপতি শ্রেণির ক্ষমতা বৃদ্ধি – ভূস্বামী ও অভিজাত শ্রেণির পরিবর্তে মূলধনী মালিক শ্রেণি দেশের শাসনযন্ত্রকে কুক্ষিগত করেছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে তারা শ্রমিক শ্রেণির উপর শোষণ অব্যাহত রাখে। শ্রমিক সম্প্রদায় নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। পুঁজিপতি শ্রেণি সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে গণতান্ত্রিক নির্বাচন সংস্কারের দাবিতে মুখর হয়ে ওঠে।
  • জাতীয়তাবাদের জনপ্রিয়তা – শিল্পবিপ্লব ইউরোপে জাতীয়তাবাদের আদর্শকে জনপ্রিয় করে তোলে। শিল্পবিপ্লবের পূর্বে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শুল্কব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শিল্পবিপ্লবের ফলে একই শিল্পনির্ভর অর্থনীতি চালু হলে জাতীয়তাবাদের পথ আরও প্রশস্ত হয় এবং জাতীয়তাবাদের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
  • সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব – শ্রমিক শ্রেণির দারিদ্র্য ও দুর্দশা, সমাজে ধনবণ্টনের বৈষম্য ইত্যাদি প্রতিকারের উপায় হিসেবে এবং শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য উদ্ভব ঘটে এক নতুন দর্শনের, যা সমাজতন্ত্রবাদ নামে পরিচিত হয়।
  • ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা – শিল্পে উন্নত দেশগুলি তাদের উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রির বাজার তৈরি ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য জনবহুল ও শিল্পে অনগ্রসর এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির প্রতি দৃষ্টি প্রসারিত করে, যা শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দেয়। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি পায়।

ইউরোপের অর্থনীতিতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ছিল যুগান্তকারী।

  • শ্রমিকদের দুর্দশা – শিল্পবিপ্লবের ফলে পুঁজিপতি শ্রেণি প্রচুর মুনাফা লাভ করতে থাকে। আর অপরদিকে শ্রমিক শ্রেণির উপর শোষণের মাত্রা বাড়তে থাকে।
  • পুঁজিবাদী অর্থনীতি – শিল্পবিপ্লব পুঁজিবাদী অর্থনীতির সূচনা ঘটায়। পুঁজিপতি মালিকরা তাদের সঞ্চিত মূলধন নতুন শিল্পে লগ্নি করে প্রচুর মুনাফা লাভ করতে থাকে। তারা ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরে শিল্পজাত সামগ্রী বিক্রি করে প্রচুর লাভ করে। ফলে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ক্রমশ তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
  • চিরাচরিত শিল্পের ধ্বংসসাধন – শিল্পবিপ্লবের ফলে কৃষিনির্ভর ও কুটিরশিল্পভিত্তিক অর্থনীতি ধ্বংস হয় এবং শিল্প ও বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতির সূচনা হয়। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
  • নগরের উত্থান – শিল্পবিপ্লবের ফলে বেশি রোজগারের আশায় শ্রমিকরা গ্রাম থেকে শহরে আসে। ফ্যাক্টরিগুলিকে কেন্দ্র করে মানুষের বসতি স্থাপিত হয় যা শিল্পাশ্রয়ী নগরের উত্থান ঘটায়।

শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ

শিল্পবিপ্লবের ফলে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণগুলি হল –

  • প্রথমত, 18শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ব্রিটেনের এবং 19শ শতাব্দীর প্রথম থেকে ইউরোপের জনসংখ্যা দ্রুতবেগে বাড়তে থাকে। ফলে গ্রামে উদ্বৃত্ত লোকের কাজের অভাব দেখা দিলে কর্মসন্ধানে তারা গ্রাম থেকে শহরে আসে।
  • দ্বিতীয়ত, শিল্পবিপ্লবের ফলে কৃষিনির্ভরতা হ্রাস পেয়ে শিল্পনির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষিকাজ লাভজনক হচ্ছে না দেখে দরিদ্র কৃষকেরা গ্রাম ত্যাগ করে শহরের কলকারখানাগুলিতে কাজ করতে চলে আসে। এভাবে গ্রামগুলি জনবিরল হয়ে পড়ে।
  • তৃতীয়ত, পূর্বে গ্রামভিত্তিক যে অর্থনীতি ছিল তা কুটিরশিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের ফলে যন্ত্রশিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুটিরশিল্প টিকে থাকতে না পেরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে থাকে। তাই এই কুটিরশিল্পীরা জীবিকাচ্যুত হয়ে কর্মসংস্থানের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে প্রবেশ করে।
  • চতুর্থত, গ্রামাঞ্চলে এনক্লোজার প্রথার প্রসার ঘটলে ছোটো ছোটো জমিগুলি বড়ো জমির মালিকরা দখল করে নেয়। ফলে বহু চাষি ভূমিহীন হয়ে পড়ে। তারা কর্মসংস্থানের আশায় গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে।

উপরোক্ত কারণগুলির জন্য শিল্পবিপ্লবের ফলে গ্রামগুলি জনহীন হয়ে পড়ে এবং শহরগুলিতে জনস্ফীতি লক্ষ করা যায়।

ইউরোপের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে শিল্পবিপ্লব কীভাবে প্রভাবিত করেছিল? মানুষ গ্রাম থেকে শহরে কেন এসেছিল ?

সমাজতন্ত্রবাদ কী? ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ও কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে লেখো।

সমাজতন্ত্রবাদ –

ফরাসি বিপ্লব ও শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া উদারনীতিবাদের দুর্বলতা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের সংঘাত শুরু হয়। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্মম শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সঠিক পথের সন্ধান না পেলেও অত্যাচারিত শোষিত মানুষ শুনতে পায় নতুন সমাজের আশ্বাস। সকলের জন্য ন্যায্য অধিকার ও সাম্য লাভ করাই ছিল সেই সমাজের লক্ষ্য। এই নতুন সমাজ গঠনের প্রক্রিয়াই হল সমাজতন্ত্রবাদের মূল কথা। সমাজে সর্বশ্রেণির মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা ও দরিদ্র জনগণের কল্যাণসাধনই হল এর প্রধান উদ্দেশ্য।

কার্ল মার্কস (1818-1883 খ্রিস্টাব্দ)

আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের জনক ছিলেন কার্ল মার্কস। প্রাশিয়ার ট্রিয়ার শহরে 1818 খ্রিস্টাব্দে মার্কসবাদের প্রাণপুরুষ কার্ল মার্কসের জন্ম হয়। আইন বিষয়ে শিক্ষালাভ করলেও ইতিহাস ও দর্শনের প্রতি তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। হেগেলীয় দর্শনে প্রভাবিত হলেও জার্মান রক্ষণশীলতার প্রতি ও জার্মান সরকারের প্রতি হেগেলের সমর্থন তিনি মানতে পারেননি। মার্কস মনে করতেন যে, দেবতা মানুষের ভাগ্য গড়ে দেয় না, মানুষই আপন ভাগ্যবিধাতা। সে কারও বশবর্তী নয়, আপন ইচ্ছায় চালিত। তাঁর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হল মার্কসবাদের বস্তুবাদী ভাবনার প্রাথমিক সূত্র — কর্মের দর্শন।

সমাজতন্ত্রবাদ কী? ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ও কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে লেখো।

মার্কস 1843 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। তিনি ‘রেইনিশে জাইতুঙ্গ’ (Rheinische Zeitung) নামক এক পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত হন এবং কমিউনিস্ট লিগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সময় তিনি হেনরিক হাইন, প্রুধোঁ প্রমুখ সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদদের সংস্পর্শে আসেন। এরপর উভয়ের উদ্যোগে কমিউনিস্ট লিগ পুনর্গঠিত হয় এবং 1848 খ্রিস্টাব্দে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ নামে বিখ্যাত রচনা প্রকাশ পায়। এই গ্রন্থটি হল সমাজতন্ত্রবাদের প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা। 1867 খ্রিস্টাব্দে কালজয়ী গ্রন্থ ‘দাস ক্যাপিটাল’ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিশ্লেষণ এই গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়।

মার্কসীয় সমাজতন্ত্র

মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

  • ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা – মার্কস ইতিহাসের এক নতুন বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত পর্যালোচনা করে তিনি লক্ষ করেছেন যে, ইতিহাসের গতি উৎপাদন নীতিকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হচ্ছে। মানবসমাজের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ এবং সমস্যাকে কেন্দ্র করে সামগ্রিক মানবজাতির সমাজ ও সভ্যতা আবর্তিত হয়। মার্কসের মতে, মানবসভ্যতার যেসব অত্যাবশ্যক উপকরণ আছে সেসবকিছু হল গৌণ, মুখ্য উৎস হল অর্থনীতি। মানবসমাজের ইতিহাস আসলে শ্রেণিসংগ্রামের নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাস। প্রাচীনকাল থেকে এই শ্রেণিসংগ্রাম চলছে, আধুনিক যুগেও তা বর্তমান। মার্কসের মতে, শ্রমিক ও পুঁজিপতি শ্রেণির মধ্যে এই সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণি জয়ী হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বহারার একনায়কত্ব। পুঁজিপতি শ্রেণি বিলুপ্ত হবে, গড়ে উঠবে শ্রেণিহীন সমাজ, রাষ্ট্রের আর অস্তিত্ব থাকবে না।
  • দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ – মার্কসের মতে, প্রতিটি ঘটনা ও পরিস্থিতির মধ্যে আছে থিসিস, অ্যান্টিথিসিস ও সিন্থেসিস – এই তিনটি শক্তি। এই তিনটি শক্তি নিয়েই বিবর্তন চলছে। রক্ষণশীল শক্তি হচ্ছে থিসিস, পরিবর্তনকামী শক্তি হচ্ছে অ্যান্টিথিসিস এবং এই দুই পরস্পরবিরোধী শক্তির মধ্যে সামঞ্জস্যকারী শক্তিটি হচ্ছে সিন্থেসিস। কোনো সমাজব্যবস্থাই স্থায়ী হবে না যতক্ষণ তার মধ্যে স্ববিরোধিতা থাকবে। দৃষ্টান্তরূপে বর্তমান যুগের শোষক বুর্জোয়ারা হল থিসিস, শোষিত শ্রমিকশ্রেণি অ্যান্টিথিসিস ও উভয়ের সংঘাতের ফল হল সিন্থেসিস অর্থাৎ শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা।
  • উদ্‌বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব – মার্কসের মতে, পুঁজিবাদী সমাজে শোষণের চূড়ান্ত রূপ হল মালিকশ্রেণি দ্বারা উদ্‌বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করা। শ্রমিকের শ্রমের দ্বারা যে উৎপাদন হয় মালিক তুলনামূলকভাবে শ্রমিককে তার থেকে অনেক কম অর্থ প্রদান করে। ফলে মালিকশ্রেণির হাতে কুক্ষিগত হয় উদ্‌বৃত্ত মূল্য। মার্কস তাই বলেন যে, একমাত্র শ্রমের মাপকাঠিতেই আয় বণ্টিত হওয়া উচিত।
  • আন্তর্জাতিকতা – আন্তর্জাতিকতার ধারণা হল মার্কস-এর সমাজতন্ত্রবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মার্কসের মতে, শ্রমিকের কোনো দেশ, জাতি, ধর্ম নেই। সমস্ত দেশের শ্রমিকরা হল শোষিত ও নির্যাতিত। তাঁর বিশ্বাস, সর্বদেশের শ্রমিকরা সংঘবদ্ধভাবে শোষণমুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে আসবে।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (1820-1895 খ্রিস্টাব্দ)

কার্ল মার্কসের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন এঙ্গেলস। মার্কসের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন তাঁর সহযোগী। মার্কসের পর এঙ্গেলসই সারা বিশ্বে মার্কসীয় তত্ত্বের প্রতিপাদনে ও বিস্তারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাই মার্কসের সমাজতন্ত্রবাদ এঙ্গেলসকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়।

সমাজতন্ত্রবাদ কী? ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ও কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে লেখো।

প্রাশিয়ার বার্মেন শহরে 1820 খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম হয়। তিনিও হেগেলীয় দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। 1845 খ্রিস্টাব্দে তিনি শ্রমিকশ্রেণির দুর্দশাজনক অবস্থা সম্পর্কে বিখ্যাত বই ‘শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা’ প্রকাশ করেন।

এঙ্গেলসের বস্তুবাদী মানসিকতা ও বিজ্ঞানচিন্তার পরিচয় মেলে তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ, বস্তুবাদ, দর্শন ও রাষ্ট্রীয় অর্থশাস্ত্রের এক সুন্দর সংযোগ ঘটেছে তাঁর লেখায়। এঙ্গেলস মার্কসের সঙ্গে 1847 খ্রিস্টাব্দে ‘কমিউনিস্ট লিগ’ স্থাপন করেন এবং 1848 খ্রিস্টাব্দে মার্কসের সঙ্গে সমাজতন্ত্রবাদের প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার ইস্তাহার ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ প্রকাশ করেন।

সমাজতন্ত্রকে ইউটোপিয়া থেকে বিজ্ঞানে রূপায়িত করতে, শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রমিক আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠায়, ঐতিহাসিক বিকাশের নিয়মাবলি আবিষ্কারে এবং সমাজ পুনর্গঠনের জ্ঞান প্রসারে মার্কসের মতো এঙ্গেলস-এর অবদানও অবিস্মরণীয়।

মার্কসবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?

মার্কসবাদের বিভিন্ন সমালোচনা

মার্কসবাদী দর্শন নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে —

  1. অতিরিক্ত অর্থনীতিকেন্দ্রিক আলোচনা – কার্ল মার্কসের মতে, মানবসমাজের ইতিহাস হলো শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। এই শ্রেণিসংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি ছিল অর্থনৈতিক অবস্থা। কিন্তু ইতিহাসের গতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না। এর পেছনে যুগে যুগে মনীষীদের অবদান, সামাজিক রীতিনীতি, দেশাত্মবোধ, ধর্মীয় আদর্শ ইত্যাদি আরও নানা প্রভাব ক্রিয়াশীল থাকে।
  2. শ্রেণিসংগ্রামই একমাত্র পথ নয় – মার্কস শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বের গুরুত্বের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু ইতিহাসে লক্ষ করা যায় শ্রেণিসংগ্রামই একমাত্র পথ নয়। সর্বক্ষেত্রে হিংসাত্মক বিপ্লবের প্রয়োজন হয় না। পার্লামেন্টারি আইনের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজ গঠন সম্ভব। এছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তাদের অবস্থার পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
  3. বাস্তবসম্মত মতবাদ নয় – মার্কস যে শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের কথা বলেছেন, তা বর্তমানকালেও অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অর্থাৎ, তত্ত্বগত দিক থেকে সম্ভব হলেও এর বাস্তব রূপায়ণ অনেকাংশেই সম্ভব নয়।
  4. উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা – উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব সম্পর্কে মার্কসের বক্তব্য সঠিক নয়। তাঁর মতে, সকল উৎপাদনের মূল ভিত্তি শ্রম, কিন্তু শ্রম ছাড়াও আরও বেশ কিছু উপাদান উল্লেখযোগ্য। তাই শুধু শ্রমের মূল্য দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করতে গেলে উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে।
  5. ধনতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী রাষ্ট্রের বিরোধ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা – মার্কসের মতে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সাম্যবাদী রাষ্ট্র এরা পরস্পরের শত্রু এবং সর্বদা সংঘর্ষে লিপ্ত থাকবে। এই মত সঠিক নয়। বর্তমানে দু-ধরনের রাষ্ট্র পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে।
  6. আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কে মার্কসের তত্ত্ব সঠিক নয় – মার্কস জাতীয়তাবাদকে অবহেলা করে আন্তর্জাতিকতাবাদের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এবং ‘শ্রমিকের কোনো দেশ নেই’ — এই স্লোগানগুলির বাস্তবতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণি এবং চীন ও ভিয়েতনামের শ্রমিকদের মধ্যে নানা পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। মার্কস আন্তর্জাতিকতাবাদকে বেশি গুরুত্ব দিলেও চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভিয়েতনাম প্রভৃতির মতো দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রবল আকার ধারণ করে।

প্যারিস কমিউনের অভ্যুত্থানের কারণ ও তার কর্মসূচি কী ছিল?

1870 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন সেডানের যুদ্ধে প্রাশিয়ার কাছে পরাজিত ও বন্দি হন। ফলে দ্বিতীয় ফরাসি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ফ্রান্সে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রবীণ রাজনীতিবিদ থিয়ার্স অস্থায়ী প্রজাতান্ত্রিক সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। ফ্রান্সের সরকার জার্মানির সঙ্গে ফ্রাঙ্কফুর্টের চুক্তি স্বাক্ষর করে (10 মে, 1871 খ্রিস্টাব্দ)। অন্যদিকে এই চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই প্যারিসে কমিউনের বিদ্রোহ শুরু হয়।

প্যারিস কমিউনের অভ্যুত্থানের কারণ –

  1. প্যারিস-এর মর্যাদায় আঘাত – প্যারিসের জনগণ মনে করত যে, তৃতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্রের যোগ্যতম কেন্দ্র হল প্যারিস। কিন্তু অস্থায়ী সরকারের রাজধানী ভার্সাই নগরে স্থানান্তরিত হলে প্যারিসবাসী ক্ষুব্ধ হয়।
  2. ফরাসি সরকারের আত্মসমর্পণ – প্রাশিয়ার কাছে ফ্রান্সের পরাজয় ও সরকারের আত্মসমর্পণে প্যারিসবাসী মর্মাহত হয়েছিল।
  3. প্যারিসবাসীর দুর্দশা বৃদ্ধি – প্যারিসে বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়ে, বেকারত্ব বাড়ে। এই সময় সরকার বকেয়া কর আদায়ের নির্দেশ দিলে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ প্যারিস কমিউনে যোগদান করে।

প্যারিস কমিউনের অভ্যুত্থান –

প্যারিসের জ্যাকোবিনপন্থী, প্রুধোঁপন্থী, সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী জনতা অস্থায়ী জাতীয় সরকারকে আত্মসমর্পণ না করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। তাদের দীর্ঘ অবরোধের পরেও সরকার প্রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করে। প্যারিসে দর্পভরে জার্মান সৈন্য প্রবেশ করলে প্যারিসবাসী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রপতি থিয়ার্স প্যারিস কমিউনের তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্যারিসের রক্ষীবাহিনী ও শ্রমজীবী মানুষ জয়লাভ করে।

প্যারিস কমিউনের কার্যাবলি –

প্যারিসের জাতীয় রক্ষীবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমিটি প্যারিসে কমিউন বা শ্রমিকদের সরকার প্রতিষ্ঠা করে। 1871 খ্রিস্টাব্দের 26 মার্চ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্যারিস কমিউনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্যারিসের হোটেল দে ভিল থেকে কমিউনের প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা জারি করা হয়। প্যারিস কমিউনের অধিকাংশ সদস্যই ছিল শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধি।

প্যারিস কমিউনের কার্যাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –

  1. প্যারিস কমিউন শ্রমিকদের সঙ্গে সরকারি কর্মীদের বেতনের সমতাবিধান করে।
  2. কমিউনের শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে। যেমন –
    • ঠিকা মজুরদের রাত্রিকালীন কাজ নিষিদ্ধ হয়।
    • কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

প্যারিস কমিউনের বিদ্রোহ দমন –

প্যারিস কমিউনের বিপ্লবী সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। জার্মানি থেকে মুক্ত ফরাসি সৈন্যরা থিয়ার্সের সৈন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্যারিস কমিউনকে দমন করার কাজে লিপ্ত হয়। দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রায় 20 হাজার মানুষ নিহত হয়। আহত, বন্দি ও নির্বাসিত হন আরও অনেক বেশি মানুষ। শেষ পর্যন্ত ভার্সাই সেনাবাহিনীর কাছে প্যারিস কমিউনের পতন ঘটে।

প্যারিস কমিউনের পতন হলেও তাদের কার্যকলাপ পরবর্তীকালের শ্রমিক আন্দোলনের কাছে এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল।

ঔপনিবেশিকতাবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ কী? এর উদ্ভবের কারণগুলি আলোচনা করো।

ঔপনিবেশিকতাবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ

শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে সাম্রাজ্যবাদ বলতে বিজিত দেশে স্থানিক অধিকার (Territorial Domination) বলবৎ করাকেই বোঝাত। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর সাম্রাজ্যবাদ বলতে বিজিত দেশের কেবল ভৌগলিক অধিকারই নয়, তার জনশক্তি, সংস্কৃতিসহ সবকিছুকেই গ্রাস করে সাম্রাজ্যবাদী দেশের স্বার্থে ব্যবহার করাকে বোঝায়। এই ধরনের সাম্রাজ্যবাদকে নয়া সাম্রাজ্যবাদ (New Imperialism)ও বলা হয়।

সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণ –

1870 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে উপনিবেশ বিস্তারে আকস্মিক আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তবে এই উপনিবেশ বিস্তারের কারণগুলি সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত নন।

অর্থনৈতিক কারণ

  • হবসনের মতে – ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে. এ. হবসন তাঁর গ্রন্থ ‘Imperialism-A Study’-তে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেছেন যে, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ধনবণ্টনের বৈষম্যের জন্য পুঁজিবাদীদের হাতে মাত্রাতিরিক্ত সঞ্চয়ের ফলে মূলধনের প্রাচুর্য দেখা দেয়। এই মাত্রাতিরিক্ত মূলধনের লগ্নির ক্ষেত্র অনুসন্ধানের জন্য সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটে। মূলধন লগ্নির জন্যই পুঁজিপতিরা তাদের সরকারকে উপনিবেশ স্থাপনে বাধ্য করে তোলে।
  • হিলফারডিং-এর মতে – অস্ট্রিয়ার মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিলফারডিং বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্রিয়তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের কারণ খুঁজে পেয়েছেন।
  • লেনিনের মতে – লেনিন তাঁর গ্রন্থ ‘Imperialism – The Highest Stage of Capitalism’-এ সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাম্রাজ্যবাদের একটি অংশ। ইউরোপে শিল্পের অগ্রগতির সঙ্গে পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে মূলধন সঞ্চিত হয়। উদ্বৃত্ত মূলধন বিনিয়োগ, সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে অধিক মুনাফা লাভ এবং শিল্পজাত সামগ্রীর বাজারের অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের পেছনে।

রাজনৈতিক কারণ

আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের পেছনে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উপাদানই সক্রিয় ছিল না, এর সঙ্গে যুক্ত ছিল রাজনৈতিক উপাদানও। ইউরোপীয় জাতিগুলি মনে করত, যত বেশি উপনিবেশ তারা দখল করবে, তাদের শক্তি ততই বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদা বাড়বে। বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি উপনিবেশ দখল করে সেই উপনিবেশের জনগণকে সামরিক শিক্ষা দিয়ে নিজ দেশের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর ছিল। অন্যদিকে, কোনো কোনো রাষ্ট্র আবার উপনিবেশের সম্পদ আহরণ করে নিজ দেশের অর্থবল বৃদ্ধির চেষ্টা করত। বিশ্বে নৌশক্তিতে আধিপত্য স্থাপনের জন্য সামরিক ঘাঁটি দখল ও জলপথের উপর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যিক ছিল। এই সামরিক ঘাঁটিগুলি তাদের বাণিজ্য ও রাজনৈতিক আধিপত্যকে সুরক্ষিত করত।

অন্যান্য কারণ

খ্রিস্টান মিশনারি, ধর্মপ্রচারক, আবিষ্কারক ও অভিযাত্রীদের কর্মসূচিও উপনিবেশ বিস্তারের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ব্রিটিশ ধর্মপ্রচারক ডেভিড লিভিংস্টোন (David Livingstone), ফরাসি ধর্মপ্রচারক স্ট্যানলি (Stanley), লেভিজেরি (Levigerie) প্রমুখ ধর্মপ্রচার ও দাসব্যবসা বন্ধ করতে আফ্রিকায় গেলে এদের ধর্মপ্রচারের সূত্র ধরে ইউরোপীয় বণিকশ্রেণি আফ্রিকায় প্রবেশ করে। ডেভিড থমসন অবশ্য ভৌগোলিক কর্তৃত্ব বাড়াবার স্বাভাবিক স্পৃহা, বাণিজ্যের টান ইত্যাদি কারণগুলির উপরই জোর দিয়ে

ইউরোপীয় দেশগুলি কোথায় কোথায় উপনিবেশ গড়ে তোলে সংক্ষেপে লেখো। ব্রিটেন ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে কীভাবে পরিচালিত করেছিল?

ইউরোপীয় দেশগুলি ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে উপনিবেশ দখলে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, শিল্পবিপ্লবের ফলে উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিক্রির বাজার দখল, সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহের তাগিদ এবং পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র অনুসন্ধানের কারণে।

ডাচ বা ওলন্দাজ – ডাচরা ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ভারতবর্ষে ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগে তারা বিভিন্ন জায়গায় আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছিল। সিংহলে, জাভা, বাটাভিয়া, বোর্নিও, সুমাত্রা, সেলিবিস দ্বীপপুঞ্জ এবং নিউ গিনির একাংশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।

ইংল্যান্ড – ব্রিটেন আমেরিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ড, কানাডা, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড, হাডসন উপসাগর, জামাইকা, ত্রিনিদাদ-টোবাগো দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিউ সাউথ ওয়েলস, কুইন্সল্যান্ড, তাসমানিয়া, সাউথ ও ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর, মালাক্কা, হংকং, ফিজি দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ চিন, নিউ গিনি, টোঙ্গা, মালয় দ্বীপপুঞ্জ, সলোমান দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকায় মিশর ও সুদান, কেপ কলোনি, নাটাল, অরেঞ্জ, গাম্বিয়া, গোল্ড কোস্ট, নাইজেরিয়া, সোমালিল্যান্ড, রোডেশিয়া, উগান্ডা প্রভৃতি স্থানে উপনিবেশ ছিল।

ফ্রান্স – ভারতবর্ষে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষে পরাজয়ের ফলে তাদের ক্ষমতা চন্দননগর, পণ্ডিচেরি, কারিকল ও মাহেতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আনাম ও ইন্দোচিন, তাহিতি দ্বীপ, কাম্পুচিয়া, টনকিন, আলজিরিয়া, টিউনিস, মরক্কো, মাদাগাস্কার, সেনেগাল, সাহারা মরুভূমি প্রভৃতি অঞ্চলে তাদের উপনিবেশ ছিল।

ইটালি – আফ্রিকার ইরিত্রিয়া, সোমালিল্যান্ডের একাংশে ইটালির উপনিবেশ ছিল। মুসোলিনি আবিসিনিয়া এবং তুরস্কের থেকে ট্রিপোলি অধিকার করেন।

পোর্তুগাল – পোর্তুগাল কঙ্গোর দক্ষিণ উপকূলে, মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলাতে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।

জার্মানি – বিসমার্কের শাসনকালে উপনিবেশ বিস্তারে উদাসীন থাকলেও পরে জার্মানি আফ্রিকার ক্যামেরুন, তাঞ্জানিয়া, পূর্ব আফ্রিকা, চিনের শানটুং, সামোয়া দ্বীপ প্রভৃতি স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করে।

স্পেন – সপ্তদশ শতকে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল স্পেন।

রাশিয়া – ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পরাজিত রাশিয়া বলকান অঞ্চলে উপনিবেশ হারানোর পর এশিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। চিনের সঙ্গে সন্ধির দ্বারা আমুর নদী পর্যন্ত অঞ্চল এবং ভ্লাদিভস্তক বন্দর অধিকার করে।

ইউরোপীয় দেশগুলি কোথায় কোথায় উপনিবেশ গড়ে তোলে সংক্ষেপে লেখো। ব্রিটেন ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে কীভাবে পরিচালিত করেছিল?

ব্রিটেন ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে কীভাবে পরিচালিত করেছিল – ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে। তখন ভারতে ব্রিটিশ শক্তি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভারতের জাতীয় সম্পদের একটি প্রধান অংশ ইংল্যান্ডে রপ্তানি হচ্ছিল, আর বিনিময়ে ভারতবর্ষে আসা পণ্য ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ইংরেজরা যে রাজস্ব আদায় করত, তার এক-চতুর্থাংশ সম্পদ বৃদ্ধির জন্য ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হত। ফলে ভারতবর্ষ ক্রমাগত অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি, রেলপথের সম্প্রসারণ, সোনার দামের তুলনায় রূপোর দামের অবনমন ইত্যাদির ফলে করবৃদ্ধি ভারতবাসীকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। ব্রিটেনের যন্ত্রোৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হওয়ায় কুটির শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ভারত কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয় এবং এর ফলে ভারতের আর্থিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে। ভারত এক দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে পরিণত হয়।

চিন ও আফ্রিকার ব্যবচ্ছেদে ইউরোপীয় দেশগুলির ভূমিকা সংক্ষেপে লেখো।

চিনের ব্যবচ্ছেদ – উনবিংশ শতাব্দীতে চিনে মাঞ্চু রাজবংশের অপদার্থতার সুযোগে ইউরোপীয় দেশগুলি সেখানে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠে। জনৈক ঐতিহাসিক হ্যারল্ড ভিন্যাক (Harold Vinacke)-এর ভাষায় ‘তরমুজকে যেমন লোকে খণ্ড খণ্ড করে খায়, সেইভাবে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি চিনা তরমুজকে খণ্ড খণ্ড করে আহার করতে উদ্যত হয়।’

ব্রিটেন – প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধে (1839-42) চিনকে ব্রিটেন পরাজিত করে। নানকিং-এর সন্ধির দ্বারা হংকং বন্দর, কৌলুন দ্বীপ এবং দক্ষিণ চিনের ক্যান্টন-সহ পাঁচটি বন্দর ব্রিটেন হস্তগত করে। দ্বিতীয় ইঙ্গ-চিন যুদ্ধেও (1856-60) চিন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে তিয়েনসিনের সন্ধি (Treaty of Tientsin) স্বাক্ষর করলে প্রায় ১১টি বন্দর বিদেশি বণিকদের কাছে উন্মুক্ত হয়।

জার্মানি – জার্মানি চিনের কিয়াওচাও বন্দর দখলের পর শান্তুং প্রদেশে তার অধিকার কায়েম করে।

ফ্রান্স – ফ্রান্স ইন্দোচিন বা আনাম থেকে চিনের ভিতর পর্যন্ত নিজ নিয়ন্ত্রণে রেলপথ গঠনের অধিকার পায়। ফলে ইউনান, কোয়াংশি ইত্যাদি অঞ্চলের খনিজ সম্পদ রেলপথ দ্বারা ফ্রান্সে নিয়ে যাবার সুযোগ লাভ করে।

রাশিয়া – রাশিয়া পোর্ট আর্থার বন্দর ও লিয়াও টুং উপদ্বীপ দখল করে। এ ছাড়া রাশিয়া চিনে বক্সার বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করে মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র – এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করে যে, সব দেশ মিলে চিন দখল করে নিলে মার্কিন বাণিজ্যের আর কোনো সুযোগ থাকবে না। ফলে মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জন হে তাঁর ‘Open Door Policy’ বা ‘উন্মুক্ত দ্বার নীতি’ ঘোষণা করেন। এই নীতিতে চিনে ইউরোপীয়দের অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে আমেরিকাকে বাণিজ্যের সমান সুযোগসুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়।

আফ্রিকার ব্যবচ্ছেদ – উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ইউরোপের কাছে আফ্রিকা ছিল অন্ধকারময় মহাদেশ। এই সময় উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়া ছিল ফরাসি উপনিবেশ এবং দক্ষিণে উত্তমাশা অন্তরীপ, কেপ কলোনি ছিল ইংল্যান্ডের দখলে। টিউনিস ও ত্রিপোলি ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত আর বাকি আফ্রিকা ছিল অনাবিস্কৃত। আফ্রিকা সম্বন্ধে জানার পরেই ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে আফ্রিকা সম্পর্কে উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। অল্প সময়ের মধ্যেই ইউরোপ আফ্রিকার দেশগুলিতে নিজ অধিকার কায়েম করতে শুরু করে।

দ্বিতীয় লিওপোল্ড – আফ্রিকায় উপনিবেশ বিস্তারের ক্ষেত্রে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্ট্যানলি কঙ্গো আবিষ্কার করলে আফ্রিকা সম্বন্ধে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। 1876 খ্রিস্টাব্দে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড কঙ্গো উপত্যকার উন্নয়নের জন্য ব্রাসেলস শহরে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করেন। এখানে আফ্রিকা মহাদেশে ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। এই সম্মেলনে ‘International African Association’ নামে এক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। কিন্তু এই সংগঠনকে প্রতিটি দেশ অমান্য করে উপনিবেশ গড়তে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে।

বেলজিয়াম – কঙ্গো দেশের খনিজসমৃদ্ধ অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহী হলে ব্রিটেন ও পর্তুগাল তার বিরোধিতা করে। ফ্রান্স ও ব্রিটেন উভয়েরই কঙ্গো নদী দিয়ে চলাচল প্রয়োজন ছিল। ‘ইঙ্গ-পর্তুগাল কঙ্গো নদী কমিশন’ নামে এক যুগ্ম কমিশন গঠিত হয়। ব্রিটেন অ্যাঙ্গোলার উপর পর্তুগালের অধিকার স্বীকার করে নেয়। বেলজিয়াম জার্মানি ও ফ্রান্সের সাহায্য প্রার্থনা করে। ফ্রান্স কঙ্গো নদীর উত্তরে এবং জার্মানি টোগোল্যান্ড, সেন্ট লুসিয়া উপসাগরীয় অঞ্চল, ক্যামেরুন প্রভৃতি অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তারে আগ্রহী হয়। ইতালি ও আবিসিনিয়া উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করে।

1875 খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার ১/১০ অংশ ছিল ইউরোপীয় উপনিবেশ; মাত্র ২০ বছরের মধ্যে যা ৯/১০ অংশে পরিণত হয়।

চিন ও আফ্রিকার ব্যবচ্ছেদে ইউরোপীয় দেশগুলির ভূমিকা সংক্ষেপে লেখো।

বার্লিন সম্মেলন – এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি হলে সেই সংকট নিরসনের জন্য ইউরোপের নানা দেশের প্রতিনিধিগণ 1884-85 খ্রিস্টাব্দে বার্লিনে এক সম্মেলনে মিলিত হন। এই সম্মেলনে আফ্রিকায় ইউরোপীয় শক্তিগুলি উপনিবেশ স্থাপনে সবুজ সংকেত লাভ করে। বলা হয় যে, কোনো রাষ্ট্র আফ্রিকা দখল করতে চাইলে ইউরোপীয় শক্তিবর্গকে জানাতে হবে। 1885 খ্রিস্টাব্দের বার্লিন কংগ্রেসে আফ্রিকাকে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (The First World War) – এর কারণগুলি উল্লেখ করো।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যেসব বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ 1914 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1918 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। 1914 খ্রিস্টাব্দের সেরাজেভো হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।

কারণ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলিকে আমরা দু-ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি – পরোক্ষ কারণ ও প্রত্যক্ষ কারণ।

পরোক্ষ কারণ –

  1. বলকান জাতীয়তাবাদ – বলকান অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। সার্বিয়া ছিল বলকান অঞ্চলের ‘সর্ব শ্লাভ’ আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়। তাই সার্বিয়া চাইছিল তার নেতৃত্বে শ্লাভ রাষ্ট্রগুলি ঐক্যবদ্ধ হোক। কিন্তু অস্ট্রিয়া স্লাভ জাতি অধ্যুষিত বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে রেখেছিল। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার অধিবাসীরাও অস্ট্রিয়ার কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিল।
  2. ইউরোপের অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ – ইউরোপের অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করেছিল। জার্মানি 1870 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের কাছ থেকে আলসাস ও লোরেন দখল করেছিল। কিন্তু ফ্রান্স আলসাস ও লোরেন ফিরে পেতে উদগ্রীব ছিল। এছাড়া বুলগেরিয়া, রোমানিয়া এবং ম্যাসিডোনিয়া-ও বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ ছিল।
  3. উগ্র জাতীয়তাবাদ – উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্বযুদ্ধের পরিবেশ রচনা করেছিল। এই সময় ইউরোপের প্রায় সব জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত এবং একে অন্যের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইত। জার্মানরা টিউটন (Teuton) জাতির, ইংরেজরা ‘অ্যাংলো-স্যাক্সন’ (Anglo-Saxon) জাতির সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছিল।
  4. সাংবাদিক ও দার্শনিকদের ভূমিকা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নেপথ্যে সাংবাদিক ও দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সময় সংবাদপত্রগুলিতে মিথ্যা, বিকৃত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ পরিবেশিত হত। ফলে জনগণের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল। দার্শনিকরাও অনেক সময় তাদের মতবাদ দ্বারা জনগণকে প্রভাবিত করতেন।
  5. বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ দেশে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির বাজারের চাহিদায় এবং শিল্পের উপযোগী কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য এই সময় উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল।
  6. ফ্রান্স-জার্মান প্রতিদ্বন্দ্বিতা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল ফ্রান্স-জার্মান প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সেডানের যুদ্ধে (1870 খ্রিস্টাব্দে) বিসমার্ক ফ্রান্সের কাছ থেকে আলসাস ও লোরেন ছিনিয়ে নিয়ে জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু ফ্রান্স আলসাস ও লোরেন ফিরে পাওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিল বলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।
  7. সামরিক প্রস্তুতি – ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলির অস্ত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতা ও সামরিক প্রস্তুতির পরিণতি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম জার্মানিকে শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করার জন্য সামরিক প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। অন্যদিকে জার্মানির সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে বিচলিত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড নিজ নিজ সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছিল।
  8. আন্তর্জাতিক সংকট – সর্বোপরি কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংকট প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মরক্কো সংকট, আগাদি সংকট, বলকান সংকট প্রভৃতি।
  9. পরস্পরবিরোধী শক্তিজোট গঠন – সাম্রাজ্যবিস্তার, পারস্পরিক সন্দেহ, জাতিবিদ্বেষ প্রভৃতি কারণে ক্রমে ইউরোপে দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তিশিবির গড়ে ওঠে। এর একদিকে ছিল ট্রিপল অ্যালায়েন্স (Triple Alliance) বা ত্রিশক্তি চুক্তি-যা জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইতালিকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল এবং অন্যদিকে ছিল ট্রিপল আঁতাত (Triple Entente) বা ত্রিশক্তি মৈত্রী – যা ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও রাশিয়াকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এমতাবস্থায় সেরাজেভো হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (The First World War)-এর কারণগুলি উল্লেখ করো।

প্রত্যক্ষ কারণ

সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড (Assassination at Sarajevo) – সেরাজেভো ছিল বসনিয়ার রাজধানী। অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ (Archduke Francis Ferdinand) ও তাঁর পত্নী সোফিয়া (Sophie) সেরাজেভো শহরে পরিভ্রমণে এসেছিলেন। এখানে 1914 খ্রিস্টাব্দের 28 জুন সার্ব বিপ্লবী সংগঠন ‘ব্ল্যাক হ্যান্ড’ (Black Hand) বা ‘ইউনিয়ন অফ ডেথ’ (Union of Death) এর সদস্য গাভ্রিলো প্রিন্সিপ (Gavrilo Princip) যুবরাজ ও রানিকে হত্যা করে। এই ঘটনা ‘সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড’ (Assassination at Sarajevo) নামে পরিচিত।

এই ঘটনার জন্য অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং এক চরমপত্র দিয়ে 48 ঘন্টার মধ্যে তার শর্তগুলি পূরণ করতে বলে। কিন্তু সার্বিয়ার পক্ষে সব দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এতে অস্ট্রিয়া ক্ষুব্ধ হয়ে 1914 খ্রিস্টাব্দের 28 জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরে সার্বিয়ার পক্ষে রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ার পক্ষে জার্মানি, তুরস্ক, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশ যোগদান করলে এই যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়।

আজকের আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায়, “শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ” এর কিছু ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষার এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলি প্রায়ই এসব পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকে, আপনি টেলিগ্রামে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। এছাড়া, এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।

Share via:

“নবম শ্রেণী ইতিহাস – শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ – ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন উত্তর”-এ 1-টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন