এখনই আমাদের Telegram Community গ্রুপে যোগ দিন।। এখানে WBBSE বোর্ডের পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির যেকোনো বিষয়ভিত্তিক সমস্যা শেয়ার করতে পারেন এবং একে অপরের সাহায্য করতে পারবেন। এছাড়া, কোনও সমস্যা হলে আমাদের শিক্ষকরা তা সমাধান করে দেবেন।

Telegram Logo Join Our Telegram Community

নবম শ্রেণী ইতিহাস – শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন উত্তর

আজকের আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায়, “শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ” থেকে কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলি প্রায়ই এসব পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।

Table of Contents

নবম শ্রেণী ইতিহাস শিল্পবিপ্লব উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন উত্তর

শিল্পবিপ্লব কী? শিল্পবিপ্লবের সময়কাল নিরূপণ করো।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কার এবং শিল্পক্ষেত্রে তার সফল প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও গুণগত মানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নতি হয়, তা ‘শিল্পবিপ্লব’ নামে পরিচিত।

ফরাসি দার্শনিক অগুস্ত ব্লঁকি সর্বপ্রথম 1837 খ্রিস্টাব্দে ‘শিল্পবিপ্লব’ কথাটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে ইংরেজ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি ‘শিল্পবিপ্লব’ কথাটিকে জনপ্রিয় করেন। তিনি ‘শিল্পবিপ্লব’ নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। ব্লঁকির মতে, ফরাসি বিপ্লবের মতো শিল্পবিপ্লবও এক নতুন সভ্যতার ভিত তৈরি করে। এরপর ইউরোপ জুড়ে শিল্পবিপ্লব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

ঐতিহাসিক হেজ-এর মতে, শিল্পের এই বিরাট পরিবর্তনকে ‘শিল্পবিপ্লব’ না বলে ‘শিল্পবিবর্তন’ বলা উচিত। কারণ ‘বিপ্লব’ কথাটির অর্থ হলো অকস্মাৎ এক আমূল পরিবর্তন এবং তার ফলশ্রুতিও হয় তাৎক্ষণিক। যেমন — আমেরিকার বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব ইত্যাদি। এক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির আবিষ্কার, উন্নততর কারখানা স্থাপন ও শিল্পজাত উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি — এইসব ক্রমোন্নয়ন দীর্ঘদিন ধরে হওয়ায় একে শিল্পবিপ্লব না বলে শিল্পবিবর্তন বলাই যুক্তিসংগত।

শিল্পবিপ্লবের সময়কাল

শিল্পবিপ্লব সর্বত্র একই সময়ে শুরু হয়নি। ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লবের সূচনা ঘটে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটার নির্দিষ্ট সময় চিহ্নিত করা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কারণ –

  • অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহার এবং পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও অনেকদিন ধরে এর ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল।
  • পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে বাণিজ্যের প্রসারের ফলে ইউরোপে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর চাহিদা অন্যান্য মহাদেশে অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করার দরকার পড়ে। ভারতবর্ষ, চীন প্রভৃতি দেশ ছাড়াও আমেরিকা আবিষ্কারের ফলে সেখান থেকেও প্রচুর কাঁচামাল সংগ্রহের সুযোগ হয়। সেইসঙ্গে নানা ধরনের যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হতে থাকলে সংগৃহীত কাঁচামাল ও যন্ত্রের সাহায্যে পণ্য উৎপাদনে ব্যাপক গতির সঞ্চার হয়।
  • আর্নল্ড টয়েনবির মতে, 1760 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, কারণ এই সময় কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উৎপাদন ক্ষেত্রে তার যথাযথ প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়।
  • ফিলিস ডিন, হবসবম প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ 1760-1780 খ্রিস্টাব্দকে শিল্পবিপ্লবের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা এই সময়কালকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ‘উড্ডয়নকাল’ বা ‘গতিশীলতার যুগ’ বলা উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
  • মার্কিন ঐতিহাসিক নেফ-এর মতে, ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ও শিল্পায়নের যে ধারা ছিল, তাকেও ‘শিল্পবিপ্লব’ বলা যায়। সেক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতকের এই উত্থানকে সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিক রূপ বলা চলে।
  • অন্যদিকে ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব শুরু হয় 1850 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। তেমনি জার্মানিতে এই বিপ্লব শুরু হয় 1815 খ্রিস্টাব্দে। আবার রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লব শুরু হয় উনিশ শতকের গোড়ায়।

এইভাবে শিল্পবিপ্লবের সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক বর্তমান। তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে শিল্পে ক্রমোন্নয়ন ঘটেছিল এবং অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে তা সফলভাবে শিল্পবিপ্লবের রূপ পরিগ্রহণ করেছিল।

শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি কী কী?

শিল্পবিপ্লব – অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে প্রথমে ইংল্যান্ডে ও পরে ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিতে দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রের দ্বারা শিল্পদ্রব্যের ব্যাপক উৎপাদনকে ‘শিল্পবিপ্লব’ বলা হয়। শিল্পবিপ্লবের পশ্চাতে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি ছিল —

  1. পুঁজিবাদী শিল্পের বিকাশ – শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন কুটিরশিল্পের পরিবর্তে যন্ত্রচালিত পুঁজিবাদী শিল্পের বিকাশ। অর্থাৎ, পুঁজি বিনিয়োগ করে যন্ত্রের মাধ্যমে কলকারখানায় পণ্যদ্রব্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করা।
  2. আমদানি ও রপ্তানির সুবিধা – শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় দ্বিতীয় উপাদান হল শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানি ও রপ্তানির সুবিধা। তা না হলে শিল্পস্থাপন দুরূহ হয়ে উঠবে।
  3. উপযুক্ত বাজার গঠন – শিল্পবিপ্লবের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান হল উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির জন্য উপযুক্ত বাজার গঠন। বাজার না থাকলে ব্যাপক উৎপাদন লাভজনক হবে না। কারণ তাতে পুঁজির বিকাশ ঘটবে না।
  4. শ্রমিকের প্রাচুর্য – শ্রমিক না থাকলে কলকারখানায় যন্ত্রের সাহায্যে পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। তাই শিল্পবিপ্লবের জন্য শ্রমিকের উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন।
  5. মূলধনের প্রাচুর্য – শিল্পবিপ্লবের জন্য মূলধন হল একান্ত অপরিহার্য উপাদান। কারণ মূলধন না থাকলে ভূমি ক্রয়, কলকারখানা স্থাপন, যন্ত্রপাতি ক্রয়, শ্রমিকের বেতন দেওয়া ইত্যাদি সম্ভব হবে না।
  6. বিস্তীর্ণ ভূমিভাগ – শিল্পবিপ্লবের জন্য বিস্তীর্ণ সমতলভূমি দরকার। কারণ বিস্তীর্ণ সমতলভূমি ছাড়া কলকারখানা স্থাপন এবং তার সম্প্রসারণ সম্ভব হবে না। আর তা না হলে শিল্পের প্রসারও ঘটবে না।
  7. প্রযুক্তির ব্যবহার – অল্প সময়ে অধিক পণ্যদ্রব্য উৎপাদনের জন্য উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্য প্রয়োজন।

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কোনো একটি নির্দিষ্ট উপাদান নয় বরং নানাবিধ উপাদানের সংমিশ্রণই শিল্পবিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করে।

শিল্পবিপ্লবের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।

শিল্পবিপ্লবের বৈশিষ্ট্য

শিল্পবিপ্লবের বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষভাবে লক্ষণীয় —

1. আকস্মিক ঘটনা নয় – শিল্পবিপ্লব অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বহু মানুষের যৌথ প্রচেষ্টায় অত্যন্ত ধীরগতিতে সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের মতো এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়।

2. একই সময়ে সর্বত্র শুরু হয়নি – অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লব প্রথম দেখা যায় ইংল্যান্ডে। কিন্তু ইউরোপের বাকি দেশগুলিতে এই একই সময়ে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়নি, অনেক দেরিতে হয়েছিল।

3. চিরাচরিত অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন – শিল্পবিপ্লবের পূর্বে ইউরোপের অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক। শিল্পবিপ্লবের ফলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়।

4. শহরের উত্থান – শহরগুলি ছিল শিল্প উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। তাই কলকারখানায় জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে গ্রাম থেকে বহু মানুষ শহরে চলে আসতে শুরু করে। এর ফলে শিল্পকেন্দ্রিক নগর-সভ্যতা গড়ে ওঠে।

5. প্রযুক্তি ও কৌশলগত উন্নতি – শিল্পবিপ্লবের ফলে সবক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও কৌশলগত উন্নতি পরিলক্ষিত হয়।

6. ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক বিপ্লব নয় – শিল্পবিপ্লব মানুষের বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার ফল, তাই এটি কোনো ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক বিপ্লব নয়।

ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ কী?

ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব –

ইউরোপের মধ্যে ইংল্যান্ডেই প্রথম শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, রাশিয়ার তুলনায় ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত নন। তাঁদের মতে, শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন উপাদানের প্রয়োজন হয়। আর ইংল্যান্ডে সেই উপাদানগুলির সবকটিই উপস্থিত থাকায় শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত হয়েছিল।

ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের কারণ –

ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটার পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল –

  • ইংল্যান্ডের ভৌগোলিক পরিবেশ এবং জলবায়ু শিল্পবিপ্লবের অনুকূল ছিল।
  • ইংল্যান্ডের সমকালীন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইংল্যান্ডকে ফ্রান্স ও জার্মানির থেকে এগিয়ে রেখেছিল।
  • ইংল্যান্ডে প্রচলিত বেষ্টনী প্রথা (Enclosure System)-এর ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যা শহরের কলকারখানাগুলিতে শ্রমিকের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছিল।
  • কৃষিতে ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধি শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি প্রস্তুত করে দিয়েছিল।
  • এশিয়া, আফ্রিকা এবং উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত ব্রিটিশ উপনিবেশগুলি একদিকে যেমন কাঁচামাল এবং মূলধনের জোগান দিয়েছিল, তেমনি উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির বাজার হিসেবেও ইংল্যান্ডকে সুবিধা প্রদান করেছিল।
  • ইংল্যান্ডের উদার সমাজ এবং বহির্বাণিজ্যের ব্যাপক প্রবণতা শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্রে অনুকূল ছিল।
  • উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নত সমন্বয় শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল।

ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের স্বরূপ সম্পর্কে লেখ।

ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের স্বরূপ –

ইংল্যান্ডে প্রথম পর্যায়ের শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি ছিল বস্ত্রশিল্প, দ্বিতীয় পর্যায়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয় কয়লা, লোহা ও ইস্পাতশিল্প। এই সময় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি ছিল মূলধন, তাই একে ‘মূলধনি শিল্পসম্ভারের যুগ’ (Age of Capital Goods Industries) বলা হয়।

  • শিল্পের বিকাশ – শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে বয়নশিল্প, লৌহ-ইস্পাত শিল্প, রেল ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইত্যাদির বিকাশ ঘটে। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
  • যন্ত্রপাতির ব্যবহার – চিরাচরিত কাঠের তৈরি যন্ত্রপাতির পরিবর্তে লোহার যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। শিল্পের সহায়ক বিভিন্ন যন্ত্রের আবিষ্কারও শিল্পবিপ্লবের পথকে সুগম করেছিল।
  • পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি – শিল্পের তাগিদে ইংল্যান্ডের পরিবহণ ব্যবস্থাও উন্নত হয়। রেলপথের বিস্তার এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অগ্রগতি দেখা যায়। সমুদ্রপথেও পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
  • উপনিবেশ বিস্তার – শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা প্রভৃতি স্থানে ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে।

শিল্পবিপ্লবে সহায়ক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

শিল্পবিপ্লবে সহায়ক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহ – শিল্পবিপ্লবে সহায়ক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল –

বস্ত্রশিল্পে আবিষ্কার –

  1. জন কে 1733 খ্রিস্টাব্দে ‘উড়ন্ত মাকু’ বা Flying shuttle নামে উন্নত মানের কাপড় বোনার যন্ত্র আবিষ্কার করেন।
  2. উন্নত সুতো কাটার যন্ত্র ‘স্পিনিং জেনি’ আবিষ্কার করেন হারগ্রিভস, 1765 খ্রিস্টাব্দে।
  3. রিচার্ড আর্করাইট 1769 খ্রিস্টাব্দে ‘ওয়াটার ফ্রেম’ এবং 1779 খ্রিস্টাব্দে ক্রম্পটন ‘মিউল’ আবিষ্কার করেন।
  4. 1785 খ্রিস্টাব্দে ‘পাওয়ার লুম’ আবিষ্কার করেন কার্টরাইট।

অন্যান্য আবিষ্কার –

  1. লোহা গলাবার চুল্লি ব্লাস্ট ফার্নেস-এর আবিষ্কর্তা ছিলেন জন স্মিটন। তিনি এটি 1760 খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করেন।
  2. বাষ্পশক্তিকে কাজে লাগিয়ে 1769 খ্রিস্টাব্দে জেমস ওয়াট আবিষ্কার করেন বাষ্পীয় ইঞ্জিন।
  3. পাথর ও পিচ দিয়ে মজবুত রাস্তা তৈরির কৌশল আবিষ্কার করেন টেলফোর্ড ও ম্যাক অ্যাডাম, 1811 খ্রিস্টাব্দে।
  4. 1814 খ্রিস্টাব্দের বাষ্পচালিত রেলইঞ্জিনের আবিষ্কারক ছিলেন জর্জ স্টিফেনসন।
  5. 1815 খ্রিস্টাব্দে হামফ্রে ডেভি আবিষ্কার করেন ‘সেফটি ল্যাম্প’।

ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলি কী ছিল?

ইউরোপে শিল্পায়নের পথে বাধাসমূহ –

ইউরোপে শিল্পায়নের পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ছিল। যেমন –

  • সামন্ততন্ত্রের প্রভাব – ইংল্যান্ড ব্যতীত ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলি সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারায় আচ্ছন্ন ছিল। ফলে সেইসব দেশে ব্যবসাবাণিজ্য ও শিল্পোৎপাদনের থেকে কৃষিকাজকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হত। এই কারণে ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের বাকি দেশে দেরিতে শিল্পায়ন হয়েছিল।
  • রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব – ইউরোপের মধ্যে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবকালীন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ঐক্য ছিল। ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি ইত্যাদি দেশগুলি নানান রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত থাকায় প্রথমদিকে শিল্পে মনোনিবেশ করতে পারেনি।
  • অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা – ইংল্যান্ড ছাড়া সেই সময়ে ইউরোপের বাকি দেশগুলির যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত এবং অপ্রতুল।
  • উপনিবেশের গুরুত্ব – ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে একমাত্র ইংল্যান্ডই তার উপনিবেশগুলিকে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির বাজারে পরিণত করতে পেরেছিল। অন্যান্য দেশ এ ব্যাপারে বেশ কিছুটা পিছিয়ে ছিল।
  • শ্রমিকের জোগান – ইংল্যান্ড তার জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশকে শ্রমিক হিসেবে পেয়েছিল, যা শিল্পবিপ্লবকে বাস্তবায়িত করে। কিন্তু ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি ইত্যাদি দেশের জনসংখ্যা ইংল্যান্ডের তুলনায় কম থাকায় সেসব দেশে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকের অভাব ছিল।

ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব কখন ও কীভাবে হয়েছিল?

ইউরোপ মহাদেশের অন্যতম শক্তিশালী দেশ ফ্রান্স। ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছিল 1830 খ্রিস্টাব্দের পরে, সম্রাট লুই ফিলিপের রাজত্বকালে (1830 – 1848 খ্রিস্টাব্দ)। তবে ফ্রান্সে প্রকৃত শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সময়ে।

ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব

লুই ফিলিপের আমলে ফ্রান্সে শিল্পায়ন

লুই ফিলিপের রাজত্বকালে ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়। তিনি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নানারকম সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছিলেন। তাঁর আমলে 1837 খ্রিস্টাব্দে প্যারিস থেকে সেন্ট জার্মেইন পর্যন্ত ফ্রান্সে প্রথম রেলপথ তৈরি হয়েছিল। তাঁর উদ্যোগে ফ্রান্সে প্রায় 1800 কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়। এই সময় ফ্রান্সে ঢালাই লোহা উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

তৃতীয় নেপোলিয়নের রাজত্বকালে ফ্রান্সে শিল্পায়ন

সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন শিল্পায়নে মনোযোগী হয়েছিলেন। তাঁর আমলে ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নতি হয় এবং ব্যাংক অফ ফ্রান্স শিল্পে ঋণদানের কর্মসূচি গ্রহণ করে। তিনি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (Joint stock company) গঠন করে সরকারি সহায়তায় শিল্পে অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। রেলপথ নির্মাণেও বিশেষ গুরুত্ব দেন তিনি।

সময় ও রেলপথের বিস্তার

সময়রেলপথের বিস্তার
1850 খ্রিস্টাব্দ2300 কিলোমিটার
1870 খ্রিস্টাব্দ17000 কিলোমিটার

এই সময় ফ্রান্সে অনেক বস্ত্র কারখানা, রাসায়নিক কারখানা এবং ধাতুশিল্পের কারখানা গড়ে ওঠে। তিনি শ্রমিকদের দাবিদাওয়া পূরণে সচেষ্ট হন এবং ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দেন। তবে ফ্রান্সে শিল্পায়নের গতি ছিল খুব ধীর।

ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব ধীরগতিতে ঘটেছিল কেন?

অথবা, ফ্রান্সে শিল্পায়নের পথে প্রধান বাধাগুলি কী ছিল?

ফ্রান্সে শিল্পায়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ

ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ডের মতো দ্রুত গতিতে ঘটেনি। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটার বেশ কিছুদিন পরে ফ্রান্সে শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব ধীরগতিতে ঘটার পিছনে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দায়ী ছিল। যেমন —

  1. রাজনৈতিক অস্থিরতা – ফ্রান্সে ধীরগতিতে শিল্পবিপ্লব ঘটার অন্যতম কারণ ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিপ্লবকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শিল্প উৎপাদনের উপযুক্ত পরিবেশ, সময় এবং সুযোগ আসতে বিলম্ব হয়।
  2. শিল্প-সহায়ক উপাদানের অভাব – সুলভ শ্রমিক, কাঁচামালের জোগান, পণ্য বিক্রির বাজার, পরিবহণ ব্যবস্থা ইত্যাদি শিল্পের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির ফ্রান্সে যথেষ্ট অভাব ছিল। ফলে সেখানে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ধীরগতি লক্ষ করা যায়।
  3. পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে তারতম্য – ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব মূলত বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হওয়ার ফলে তার গতি ছিল দ্রুত। ইংল্যান্ড সরকারের শিল্পপতিদের অনুকূলে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। ফ্রান্সে সরকারি উদ্যোগে শিল্পায়ন হলেও তা ইংল্যান্ডের তুলনায় ছিল নগণ্য।
  4. সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা – ফ্রান্সের জমিদার ও অভিজাত শ্রেণি শিল্পের কাজকে ঘৃণার চোখে দেখত। তারা জমি ও কৃষি থেকে উপার্জন করতেই বেশি আগ্রহী ছিল।
  5. উন্নত পরিসেবার অভাব – ইংল্যান্ডের মতো ফ্রান্সে প্রচুর মূলধন, যন্ত্রপাতি এবং কয়লার প্রাচুর্য ছিল না। ফলে এই সমস্যাগুলি সেই দেশের শিল্পবিপ্লবকে বিলম্বিত করে দেয়।

ফ্রান্সের শিল্পায়নে তৃতীয় নেপোলিয়নের ভূমিকা আলোচনা করো।

লুই ফিলিপের আমলে ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হলেও তার বিস্তার ঘটে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের রাজত্বকালে। তৃতীয় নেপোলিয়ন বুঝেছিলেন শিল্পের অগ্রগতি ছাড়া ফ্রান্সের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই শিল্পের উন্নয়নের জন্য তিনি অনেক পদক্ষেপ নেন। যেমন —

ফ্রান্সের শিল্পায়নে তৃতীয় নেপোলিয়নের ভূমিকা
  • তাঁর আমলে প্রায় 10,000 মাইল রেলপথের বিস্তার ঘটে, ফলে লৌহ-ইস্পাত ও কয়লা শিল্পের উন্নতি হয়।
  • তৃতীয় নেপোলিয়ন ‘ক্রেডিট মোবিলিয়ার’ ও ‘ক্রেডিট ফঁসিয়ার’ নামে দুটি আধা-সরকারি ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে শিল্পে মূলধন যোগান দেন।
  • ব্যাংক অফ ফ্রান্স পুনর্গঠন করেন।
  • শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

ফলে ফ্রান্স শিল্পজাত দ্রব্যের রপ্তানিতে সমগ্র ইউরোপে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। তবে ফ্রান্সে শিল্পায়নের গতি ছিল খুব মন্থর, ইংল্যান্ডের মতো শিল্পবিপ্লব এখানে দেখা যায়নি।

জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব দেরিতে হওয়ার কারণ কী?

জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব –

1830 খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়। 1850 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তা গতিশীল হয় এবং জার্মানির ঐক্যবদ্ধকরণের পর বিসমার্কের সময় তা চরম সীমায় পৌঁছায়। 1850 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জার্মানিতে শিল্পায়নের গতি মন্থর হওয়ার পিছনে একাধিক কারণ ছিল।

জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব দেরিতে হওয়ার কারণ –

কয়লা ও লোহার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব দেরিতে হওয়ার কারণগুলি হল —

  1. 1870 খ্রিস্টাব্দের আগে জার্মানিতে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। 39টি রাজ্যে বিভক্ত জার্মানিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্য পরিবহন করতে হলে প্রত্যেকটি রাজ্যকে আলাদা আলাদাভাবে শুল্ক প্রদান করতে হত, ফলে ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  2. কৃষিপ্রধান জার্মানিতে শিল্পদ্রব্যের খুব বেশি চাহিদা না থাকায় এবং বিদেশে জার্মানির কোনো উপনিবেশ না থাকার ফলে শিল্পদ্রব্য বিক্রির বাজার ছিল না। তাই জার্মানিবাসী শিল্পবিকাশে ততটা আগ্রহ দেখায়নি।
  3. জার্মানির অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাও শিল্পবিকাশের পথে একটি বড় বাধাস্বরূপ ছিল।
  4. মূলধন ও শ্রমিকের অভাবও একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছিল।

জার্মানিতে শিল্পায়নে বিসমার্কের ভূমিকা আলোচনা করো।

জার্মানির শিল্পায়নে জার্মান চ্যান্সেলার বিসমার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, জার্মানিকে অভ্যন্তরীণ শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। তাই তিনি ‘রক্ত ও লৌহনীতি’ (Blood and Iron)-র পরিবর্তে ‘কয়লা ও লৌহনীতি’ (Coal and Iron)-র উপর জার্মান সাম্রাজ্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়েছিলেন।

জার্মানির শিল্পবিকাশে বিসমার্কের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলি হল —

  1. বিসমার্ক জার্মানির সর্বত্র এক ধরনের মুদ্রা, ওজন, শুল্কব্যবস্থা চালু করেন। এর ফলে ব্যবসাবাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেন সুবিধাজনক হয়।
  2. জার্মান শিল্পকে রক্ষা করার জন্য তিনি শিল্প সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করেন।
  3. তিনি কার্টেল, ট্রাস্ট প্রভৃতি একচেটিয়া যৌথ সংগঠনের মাধ্যমে দেশে বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটান।
  4. উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার ও শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন প্রণয়ন করেন।
  5. শিল্পে মূলধন সরবরাহের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থার পুনর্গঠন করেন ইত্যাদি।

রাশিয়ায় শিল্পায়নে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ভূমিকা আলোচনা করো।

রাশিয়ায় শিল্পায়নের সূচনা হয় অনেক বিলম্বে। তবে রুশ জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার-এর আমলে রুশ শিল্পায়নে নতুন গতির সঞ্চার হয়েছিল। রাশিয়ার শিল্পায়নে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য —

রাশিয়ায় শিল্পায়নে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ভূমিকা
  1. 1861 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথার বিলোপ ঘটান। ফলে মুক্তিপ্রাপ্ত ভূমিদাসরা শ্রমিক হিসেবে শিল্পক্ষেত্রে যোগদান করলে শিল্পের বিকাশ ঘটে।
  2. রাশিয়া সরকারের উদ্যোগে বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ থেকে ঋণগ্রহণ করে রাশিয়ায় শিল্পায়ন ঘটানো হয়।
  3. দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আমলে রেলপথের সম্প্রসারণ ঘটলে শিল্পের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়।
  4. জার দ্বিতীয় নিকোলাসের অর্থমন্ত্রী সের্গেই, সরকারি বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা ও স্বর্ণমান চালু প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রুশ শিল্পকে আরও মজবুত ভিত্তি প্রদান করেন।

বেলজিয়ামে শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, বেলজিয়ামের শিল্পবিপ্লব কখন হয়েছিল? বেলজিয়ামে শিল্পবিপ্লবের পটভূমি বা কারণ কী ছিল?

ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হলেও তার প্রভাব ব্রিটেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপ মহাদেশের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটে।

বেলজিয়ামে শিল্পবিপ্লব –

ইউরোপ মহাদেশে ব্রিটেনের পরে প্রথম শিল্পায়ন হয় বেলজিয়ামে। ব্রিটেনের বয়নশিল্পের উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ হয়ে উইলিয়াম ককরিল (William Cockerill) 1799 খ্রিস্টাব্দে যন্ত্রের সাহায্যে পশম উৎপাদন করলে বেলজিয়ামে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়। তবে বেলজিয়ামে শিল্পবিপ্লবের জোয়ার আসে 1830 খ্রিস্টাব্দের পর।

বেলজিয়ামে শিল্পবিপ্লবের কারণ –

বেলজিয়ামে শিল্পবিপ্লব ঘটার উপযুক্ত পরিবেশ ছিল।

  1. মানসিকতা – বেলজিয়ামের অধিবাসীরা ব্যবসাবাণিজ্যের প্রতি আগ্রহী ছিল।
  2. সম্পদ – বেলজিয়ামে খনিজ সম্পদ, কয়লা ও কাঁচামাল ছিল প্রচুর। জনসম্পদেও বেলজিয়াম ছিল সমৃদ্ধ।
  3. ব্রিটেনের সহযোগিতা – ব্রিটেনের সহযোগিতায় বেলজিয়ামে লৌহ, কয়লা ও বস্ত্রশিল্প গড়ে উঠেছিল। ব্রিটেনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় 1835 খ্রিস্টাব্দে বেলজিয়ামে রেলপথ গড়ে উঠেছিল।

শিল্পবিপ্লব কী? এর সুফলগুলি লেখো।

শিল্পবিপ্লব – অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে এবং ক্রমে ইউরোপের অন্যান্য অংশে দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থায় যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, তাকে ‘শিল্পবিপ্লব’ বলা হয়।

শিল্পবিপ্লবের সুফল –

শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

শিল্পবিপ্লবকালে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরের জনসংখ্যা –

শহর1801 খ্রিস্টাব্দ1841 খ্রিস্টাব্দ
ম্যানচেস্টার35,000353,000
লিডস53,000153,000
বার্মিংহাম23,000183,000
শেফিল্ড46,000111,000
  1. নগরকেন্দ্রিক সমাজ সৃষ্টি – শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্প বা কলকারখানা ও ব্যবসাস্থলকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন নগরের সৃষ্টি হয়। গ্রামের কৃষক ও সাধারণ মানুষ অর্থ উপার্জন ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য দলে দলে শহরে আসতে থাকে। এর ফলে নগরকেন্দ্রিক সমাজ ও সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়।
  2. বিলাসবহুল জীবনযাপন – শিল্পবিপ্লবের ফলে পরিধেয় থেকে পরিবহন সর্বক্ষেত্রে আরাম ও বিলাসের অজস্র উপকরণ নির্মিত হতে থাকে। অর্থের বিনিময়ে সেইসব দ্রব্য ক্রয় করে মানুষ নিজেদের জীবনকে বিলাসবহুল করে তোলে।
  3. প্রকৃতিকে জয় – শিল্পবিপ্লবের ফলে আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির দ্বারা মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে জয় করার কাজে লিপ্ত হয়। কয়লা, খনিজ তেল, জল প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিদ্যুৎ তৈরিতে মানুষ সক্ষম হয়।
  4. সময়ের সাশ্রয় – শিল্পবিপ্লবের ফলে কায়িক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রের দ্বারা অল্প সময়ে অধিক দ্রব্য উৎপাদনে মানুষ সক্ষম হয়। এর ফলে সময়ের অনেক সাশ্রয় হয়।
  5. শ্রমবিভাজন নীতির উদ্ভব – শিল্পবিপ্লবের পূর্বে একজন শ্রমিক নিজে সম্পূর্ণ একটি দ্রব্য তৈরি করত। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের ফলে একটি দ্রব্য বিভিন্ন শ্রমিকের মিলিত শ্রমে তৈরি হয়। অর্থাৎ একজন শ্রমিক একটি দ্রব্যের একটি অংশ তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয়, পুরো দ্রব্যের সঙ্গে নয়। ফলে বিশেষীকরণের (Specialization) উদ্ভব হয় এবং দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।
  6. ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার – শিল্পবিপ্লবের ফলে দ্রব্যের উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ইংল্যান্ডের উৎপাদিত সামগ্রী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাজারে ছেয়ে গিয়েছিল।
  7. কর্মক্ষেত্রের প্রসার – কর্মক্ষেত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটে শিল্পবিপ্লবের ফলে। শিল্পবিপ্লবের পূর্বে বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজ ও হস্তচালিত তাঁতশিল্পে নিযুক্ত থাকত। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর মানুষ কলকারখানায় বিভিন্ন শিল্পকর্মে নিযুক্ত হয়।
  8. সাম্যবাদের উদ্ভব – শিল্পবিপ্লবের পরোক্ষ ফল ছিল সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের উদ্ভব। কারণ শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজে শ্রমিক ও মালিকশ্রেণির মধ্যে অসাম্য সৃষ্টি হয়েছিল। এই অসাম্য দূর করার জন্য পরবর্তীকালে সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়।

শিল্পবিপ্লবের কুফলগুলি লেখো।

শিল্পবিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। শিল্পবিপ্লব সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। মানবসভ্যতার প্রগতির পথে শিল্পবিপ্লব ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু এই শিল্পবিপ্লব আশীর্বাদের সঙ্গে কিছু কিছু অভিশাপও বয়ে নিয়ে আসে।

শিল্পবিপ্লবের কুফল –

  1. জনশূন্য গ্রাম – শিল্পবিপ্লবের ফলে গ্রামের মানুষ কাজের আশায় শহরে এসে ভিড় জমালে গ্রামগুলি জনশূন্য হয়ে পড়ে। লোকসংখ্যার অভাবে গ্রামগুলি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
  2. কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন – শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন নতুন যন্ত্রের আবিষ্কার হয়। এইসব যন্ত্রের সাহায্যে কলকারখানায় অল্প সময়ে ব্যাপক উৎপাদন হলে কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংসের মুখে পড়ে।
  3. শোষক শ্রেণির আবির্ভাব – শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজে মালিক ও শ্রমিক — এই দুই নতুন শ্রেণির আবির্ভাব হয়। মালিকশ্রেণি শ্রমিকদের শোষণ করে মূলধনের পাহাড় জমা করে। এই কারণে মালিকশ্রেণি শোষক শ্রেণি হিসেবে বিবেচিত হয়।
  4. মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির সংঘাত – কলকারখানার মালিকরা শ্রমিকদের শোষণ করে অধিক অর্থ উপার্জনে সচেষ্ট হয়। ফলে অত্যধিক কাজের চাপ, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, অমানবিক আচরণ শ্রমিকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এর ফলস্বরূপ শ্রমিক ও মালিকশ্রেণির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়।
  5. ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা – শিল্পবিপ্লবের ফলে পণ্যের উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির জন্য ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য কয়েকটি দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়। ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে উপনিবেশ দখলের লড়াই শুরু হয়।
  6. ঔপনিবেশিক শোষণ – শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পমালিকেরা কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ বিস্তার করে। উপনিবেশের কাঁচামাল, ভূখণ্ড, জনসংখ্যা প্রভৃতির উপর শিল্পমালিকেরা আধিপত্য স্থাপন করে শোষণ চালাতে থাকে।
  7. শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি – শিল্পবিপ্লবের ফলে শ্রমিক ও মালিকশ্রেণির মধ্যে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ মালিকরা সর্বদা শ্রমিকদের শোষণ করে ধনী হয় এবং শ্রমিকরা শোষিত হতে হতে শোষণের শেষপ্রান্তে পৌঁছায়।
  8. সামাজিক জীবনে অস্থিরতা – অভাবের তাড়নায় নারী ও শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কলকারখানায় নিযুক্ত হলে পারিবারিক জীবন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এর ফলে সামাজিক জীবনে অস্থিরতা দেখা দেয়।

শিল্পবিপ্লবের রাজনৈতিক প্রভাব কী ছিল?

শিল্পবিপ্লব ইউরোপ মহাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা।

শিল্পবিপ্লবের রাজনৈতিক প্রভাব –

শিল্পবিপ্লব রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গভীর ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।

  1. মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির দ্বন্দ্ব – শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজে মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির সৃষ্টি হয়। এরা শোষক ও শোষিত শ্রেণি নামে পরিচিত হয়। এরা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় এবং নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করে।
  2. ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সৃষ্টি – শ্রমিকশ্রেণি তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও আন্দোলন শুরু করে।
  3. সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব – মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে বিস্তর অর্থনৈতিক পার্থক্য ও মালিকদের শ্রমিক শোষণের ফলে সমাজতন্ত্রবাদ বা সাম্যবাদের উদ্ভব হয়।
  4. ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা – ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপাদিত অতিরিক্ত পণ্যের বিক্রির বাজারের সন্ধান করতে থাকে। এজন্য তারা এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয় এবং নিজেদের মধ্যে ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়।
  5. আন্তর্জাতিকতাবাদের সৃষ্টি – শিল্পবিপ্লবের ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে আন্তর্জাতিকতাবাদের উত্থান ঘটে।

শিল্পবিপ্লবের সামাজিক প্রভাব কী ছিল?

অথবা, শিল্পবিপ্লবের সামাজিক ফলাফল সম্পর্কে লেখো।
অথবা, শিল্পবিপ্লবের ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে কী কী পরিবর্তন দেখা দেয়?

শিল্পবিপ্লব ইউরোপ মহাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ছিল অপরিসীম।

সামাজিক প্রভাব

সামাজিক জীবনে শিল্পবিপ্লবের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

  • দুটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব – মালিক ও শ্রমিক – শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে — পুঁজিপতি মালিকশ্রেণি এবং শ্রমজীবী শ্রেণি। যারা শিল্পোৎপাদনে মূলধন বিনিয়োগ করে তা থেকে মুনাফা লাভ করত, তারা হল পুঁজিবাদী শ্রেণি বা Capitalist Class। আর যারা কারখানায় শ্রমদান করে পণ্য উৎপাদন করত, বিনিময়ে পণ্যের উপর কোনো দাবি না করে শুধু মজুরি পেত, তারা শ্রমজীবী শ্রেণি বা Working Class নামে পরিচিত ছিল।
  • নতুন নতুন নগরের সৃষ্টি – বিভিন্ন স্থানে কলকারখানার প্রতিষ্ঠার ফলে অনেক নতুন নতুন শিল্পনগরী গড়ে ওঠে। শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার, নিউক্যাসেল, ব্রিস্টল, বার্মিংহাম, লিভারপুল প্রভৃতি স্থানে নতুন নতুন শিল্পনগরীর সৃষ্টি হয়।
  • নগরকেন্দ্রিক সমাজের সৃষ্টি – কলকারখানায় কাজ করার জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষ দলে দলে শহরে এসে বসবাস শুরু করে। ফলে একদিকে জনবহুল নগর সমাজের সৃষ্টি হয়, কিন্তু অপরদিকে গ্রামগুলি শ্রীহীন হয়ে পড়ে।
  • বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব ও প্রভাব বৃদ্ধি – শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, মহাজন ইত্যাদি পেশাদার শ্রেণির মানুষের উদ্ভব হয়। এরা ‘বুর্জোয়া শ্রেণি’ বা ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি’ নামে পরিচিত। কালক্রমে এই নতুন বুর্জোয়া শ্রেণি সমাজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং পূর্বতন সামন্তশ্রেণির অবলুপ্তি ঘটে।
  • শ্রমিকদের দুর্দশা এবং শ্রমিক সংঘ – শ্রমিকশ্রেণির ব্যাপক কর্মসংস্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এক সংঘবদ্ধ সামাজিক শ্রেণি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে নানা সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যার অন্তর্ভুক্ত ছিল খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি প্রায় সবকিছু। নারী ও শিশুদেরও বেশি করে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ফলে শ্রমিক শ্রেণির সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য শ্রমিক সংঘ গড়ে ওঠে ও শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হয়।
শিল্পবিপ্লবের সামাজিক প্রভাব

শিল্পবিপ্লব ও নারীদের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করো।

আধুনিক যুগে শিল্পবিপ্লবের সূচনা ইংল্যান্ডে হলেও পরবর্তীকালে তা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিল্পের প্রসারের সঙ্গে শিল্পশ্রমিক হিসেবে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষত দারিদ্র্যের কারণে তারা কলকারখানায় কাজে নিযুক্ত হয়। তবে শিল্পবিপ্লবের ফলে ধনী পরিবারের নারীদের জীবনে যেমন সুখস্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছিল, অপরদিকে নারী শ্রমিকদের জীবন দুঃখদুর্দশায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। শিল্পবিপ্লবের ফলাফল প্রসঙ্গে অধ্যাপক বার্নি বলেছেন, “শিল্পবিপ্লবের পরিবর্তন ছিল সুদূরপ্রসারী এবং ভালো ও মন্দের সংমিশ্রণ।”

শিল্পবিপ্লব ও নারীদের অবস্থান

শিল্পবিপ্লব ও নারীদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি

  • শিল্পবিপ্লবের ফলে ধনী পরিবারের নারীদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছিল। কারণ, শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ক্রেতা ছিল ধনী ও অবস্থাপন্ন পরিবারের নারীরা।
  • ধনী নারীরা উন্নত পরিসেবার সুফলও ভোগ করত।
  • শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী পরিবারের নারীদের আর্থিক অবস্থা ও সামাজিক সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছিল।

শিল্পবিপ্লব ও নারীদের দুঃখদুর্দশা বৃদ্ধি

শিল্পবিপ্লবে কলকারখানার কাজে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও যোগদান করেছিল। তবে—

  • কলকারখানায় নিযুক্ত নারী শ্রমিকদের মালিকরা বিভিন্নভাবে অত্যাচার করত।
  • বেশি সময় কাজ করাত এবং পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারীদের মজুরি কম দিত।
  • তা ছাড়া নারীশ্রমিকরা তাদের পরিবার ও শিশুদের জন্য সময় দিতে পারত না। তবে নারী শ্রমিকরা শ্রমিক সমাজের সংহতি আনয়নে সাহায্য করেছিল।

শিল্পবিপ্লবের ফলে গ্রাম থেকে শহরে মানুষের অভিপ্রয়াণ (Migration) ঘটেছিল কেন?

শিল্পবিপ্লবের যুগে বড়ো বড়ো কলকারখানাকে কেন্দ্র করে শিল্প শহর গড়ে ওঠে। নগর জীবনের নানারকম সুযোগসুবিধার জন্য গ্রাম থেকে শহরে মানুষের অভিপ্রয়াণ ঘটেছিল।

গ্রাম থেকে শহরে আসার কারণ

শিল্পবিপ্লবের সময়ে মানুষের গ্রাম থেকে শহরে এসে বসবাসের প্রবণতা বেড়েছিল। কারণ—

  • আরামপ্রদ জীবন – গ্রাম থেকে শহরের জীবন ছিল বিলাসবহুল ও আরামপ্রদ। কারণ শহরে প্রয়োজনীয় বিলাসসামগ্রী সহজে পাওয়া যেত।
  • চাকরির সুবিধা – গ্রামের মানুষ শহরের কলকারখানায় লাভের আশায় আসতে থাকে। তারা চাকরির সুবিধার জন্য প্রতিদিন গ্রাম থেকে আসা-যাওয়ার পরিবর্তে শহরে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে থাকে।
  • গ্রামীণ অর্থনীতির অবনতি – গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি। গ্রামের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়, শিল্প অর্থনীতির বিকাশ ইত্যাদির ফলে গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অবনতি ঘটে।
  • শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবহনের সুবিধা – শহরের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যের জন্য হাসপাতাল ও যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধা পাওয়া যেত।

ঘেটো (Ghetto) বলতে কী বোঝায়?

ঘেটো (Ghetto) বলতে বোঝায় শহরের একটি নির্দিষ্ট অংশে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা, বস্তি এলাকা বা মহল্লা। এগুলিতে সাধারণত একই ধর্ম, বর্ণ ও একই অর্থনৈতিক অবস্থাসম্পন্ন দরিদ্র মানুষ বসবাস করত। অবস্থাপন্ন বা ধনী শহরবাসীরা ঘেটো বা মহল্লাবাসীদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখত। অনেক জায়গায় শহর থেকে ঘেটোগুলিকে পৃথক করার জন্য দেয়াল তৈরি করা ও দরজা লাগানো হত।

ঘেটো

শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজ ও কুটিরশিল্পে নিযুক্ত বহু মানুষ কলকারখানায় কাজের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসতে থাকে। এইসব বহিরাগত মানুষদের অনেকে স্বল্প বেতনে শহরের কলকারখানায় কাজ করতে থাকে এবং ‘ঘেটো’ অর্থাৎ শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। শিল্পশ্রমিকরা বাধ্য হত এইসব বস্তিতে বাস করতে। এই বস্তির পরিবেশ ছিল নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। শ্রমিক জীবন ছিল নিরানন্দময়, ধীরে ধীরে শ্রমিক বস্তিগুলি নৈতিক অবক্ষয়ের পথে চলে যায়।

শিল্পবিপ্লবের অর্থনৈতিক প্রভাব কী ছিল?

অথবা, শিল্পবিপ্লবের অর্থনৈতিক ফলাফল সম্পর্কে লেখো।

শিল্পবিপ্লব ইউরোপ মহাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ছিল অপরিসীম।

অর্থনৈতিক প্রভাব

  • পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভব – শিল্পবিপ্লবের ফলে এক নতুন পুঁজিপতি শ্রেণির উদ্ভব হয়। এই পুঁজিপতি শ্রেণি সমাজ ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
  • যৌথ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব – পুঁজিপতিরা পণ্যদ্রব্য উৎপাদনের জন্য শিল্পকারখানায় প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করে। আবার অনেক ধনী ব্যক্তি একসঙ্গে একটি শিল্পেও অর্থ বিনিয়োগ করার ফলে যৌথ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়।
  • শিল্প-বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির সূচনা – শিল্পবিপ্লবের ফলে কৃষিনির্ভর ও কুটিরশিল্পভিত্তিক অর্থনীতি পরিবর্তিত হয়ে শিল্প ও বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির সূচনা হয়। যন্ত্রের দ্বারা উৎপাদনের ফলে দ্রুত প্রচুর পরিমাণ শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত হলে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
শিল্পবিপ্লবের অর্থনৈতিক প্রভাব
  • বিশ্বের কারখানা – ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল। ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ইংল্যান্ড বিশ্বের কারখানায় পরিণত হয়।
  • শিল্প মূলধন – শিল্পবিপ্লবের ফলে পরিবহন ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। এর ফলে বাণিজ্যিক মূলধন (Commercial Capital) ক্রমশ শিল্প মূলধন (Industrial Capital)-এ পরিণত হয়। এইভাবে যৌথ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান (Joint Stock Company)-এর উদ্ভব হয়।
  • ফ্যাক্টরি প্রথা – শিল্পবিপ্লবের ফলে কাজের সন্ধানে ও বেশি রোজগারের আশায় গ্রাম থেকে শ্রমিকরা ফ্যাক্টরিতে ভিড় করতে থাকে। ফ্যাক্টরিগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বড়ো বড়ো শিল্পাশ্রয়ী শহর। ফ্যাক্টরি প্রথার (Factory System) উদ্ভবের ফলে কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংস হয়।
  • শ্রমের বিভাজন – শিল্পবিপ্লবের আগে একজন কারিগর একটি দ্রব্যের পুরো অংশটাই নিজে বানাত। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের দরুন উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে একটি দ্রব্যের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন কারিগরকে বানাতে দেওয়া হয়।
  • ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা – শিল্পবিপ্লব উৎপাদন ব্যবস্থা অভূতপূর্ব গতির সঞ্চার করেছিল। অতি অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণে শিল্পদ্রব্যের উৎপাদন হওয়ায় উদ্বৃত্তের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। ফলে অবশিষ্ট শিল্পদ্রব্য বিক্রির উদ্দেশ্যে অনুন্নত দেশ দখলের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলি প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। উপনিবেশগুলিকে তারা কাঁচামাল সংগ্রহ এবং নিজ দেশে উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ের বাজার হিসেবে শাসন করতে থাকে।

শিল্পসমাজে পুঁজিবাদী মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করো।

সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব হয়েছে আধুনিক যুগের শিল্পবিপ্লবজনিত কারণে সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা থেকে।

মালিকশ্রেণি – শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পপতি ও পুঁজিপতিদের হাতে প্রচুর সম্পদ জমা হয়। শিল্পপতিরা কলকারখানায় উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও আরও বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য শ্রমিকদের কম মজুরি দেয় ও নানাভাবে শোষণ করে। এভাবে সমাজে ধনবান পুঁজিপতি শ্রেণির সৃষ্টি হয়।

শ্রমিকশ্রেণি – শিল্পবিপ্লবের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকশ্রেণি শোষণের শিকার হয়। যাদের শ্রমে শিল্পবিপ্লব সম্ভব এবং পুঁজিপতি শ্রেণি প্রচুর সম্পদের অধিকারী হয়েছে সেই শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হয়। শিল্পবিপ্লবের ফলে পুঁজিপতি বা মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। সমাজতন্ত্রবাদ হল সেই মালিকশ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির প্রতিবাদ।

শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীকালে ইউরোপে রাজনৈতিকভাবে বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ সম্পর্কে ধারণা দাও।

বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ –

শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজে অভিজাত সামন্তশ্রেণির বিলোপ ঘটে এবং বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক দিক থেকে শুরু হয় বুর্জোয়া যুগের এবং তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ভোটাধিকার নিজেদের হাতে রেখে আইন রচনা করে। এভাবে ইউরোপের বহুদেশে বুর্জোয়াতন্ত্র তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পত্তন হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণিস্বার্থ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকায় বুর্জোয়ারা সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার রাজনৈতিক স্লোগান তুলে জনসমর্থন নিয়ে সামন্তদের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে সফল করতে চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত ভূমিদাস, হস্তশিল্পী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থনে রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রামে সামন্তশ্রেণির পরাজয় ও বুর্জোয়া পুঁজিবাদী শ্রেণির বিকাশ নিশ্চিত হয়। এর ফলে সমাজে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যথা—

  • সমাজে দুটি পরস্পরবিরোধী শ্রেণিরূপে – বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত অর্থাৎ শোষক ও শোষিত শ্রেণির উদ্ভব হয়।
  • পুঁজিপতিরা উৎপাদনের উপকরণের মালিক, কিন্তু সর্বহারা শ্রেণি উৎপাদনে শ্রমশক্তি দিলেও কোনো মালিকানা পায়নি।
  • শ্রমিকের শ্রমশক্তিতে যে উদ্বৃত্ত তৈরি হয়, তা প্রধানত পুঁজিপতিদের মুনাফার উৎস ও সুখসমৃদ্ধির কারণ।
  • বুর্জোয়া পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে নারীদের উপর পুরুষের প্রাধান্য স্থাপিত হয়।
  • ভোটাধিকার সম্প্রসারণ ও নির্বাচন প্রথার মাধ্যমে সরকার গঠন ছিল এই প্রথার বিশেষ দিক।
  • সর্বোপরি অবাধ বাণিজ্য ও উপনিবেশ সম্প্রসারণের উৎসাহ দেওয়া হয়।

ভারতবর্ষে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব আলোচনা করো।

ভারতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ডে ও পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে শিল্পায়ন ঘটে, তা ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

  1. প্রথমত, ইংল্যান্ডে কারখানাজাত সস্তা পণ্যের অবাধ আমদানিতে ভারতীয় বাজার ছেয়ে গেলে ভারতের কুটিরশিল্প ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
  2. দ্বিতীয়ত, পূর্বে ঢাকার মসলিন ও ভারতীয় সুতিবস্ত্রের চাহিদা থাকলেও ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে ভারতীয় পরিবর্তে ভারত থেকে তুলো ও অন্যান্য কাঁচামাল রপ্তানি হতে থাকে। ফলে ভারত পণদ্রব্যের রপ্তানিকারক দেশ থেকে আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়।
  3. তৃতীয়ত, ভারতীয় কুটিরশিল্প ধ্বংস হলে ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, সুরাট, তাঞ্জোর প্রভৃতি একদা সমৃদ্ধিশালী নগর প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।
  4. চতুর্থত, ভারতীয় শিল্পগুলি ধ্বংস হলে শিল্পের সঙ্গে জড়িত বহু ভারতীয় কর্মহীন হয়ে পড়ে কৃষিকাজে নিযুক্ত হলে জমির উপর চাপ বৃদ্ধি পায়।
  5. সর্বোপরি, খাদ্যশস্যের পরিবর্তে চা, পাট, নীল প্রভৃতি বাণিজ্যিক পণ্যের চাষ বাড়ে। ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে শিল্পনির্ভরতা হ্রাস এবং কৃষিনির্ভরতা বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ অবশিল্পায়নের সূচনা হয়।

সাঁ সিমোঁ (Saint Simon) কে ছিলেন? তাঁর মতবাদ কী ছিল?

সাঁ সিমোঁ (Saint Simon) ছিলেন ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত দার্শনিক। তাঁর দর্শনচিন্তার মধ্যে সমাজতন্ত্রবাদের পূর্বাভাস দেখা যায়। তাই তাঁকে ‘ফরাসি সমাজতন্ত্রের জনক’ ও ‘ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রবাদের আদি গুরু’ বলা হয়। বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তাঁকে মহান ফরাসি বিপ্লবের সন্তান বলে অভিহিত করেছেন। সাঁ সিমোঁ-র মতবাদ ‘নব খ্রিস্টবাদ’ নামক গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে।

  • জন্ম – 1760 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর ফ্রান্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সাঁ সিমোঁর জন্ম হয়।

সাঁ সিমোঁর মতবাদ

  • সাঁ সিমোঁ উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতবাদের মূল কথা হল অর্থনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতাহীন সমাজ গঠন করা।
  • তিনি মনে করতেন, খ্রিস্টধর্ম সামাজিক অসাম্য ও শোষণ রদ করতে সক্ষম। তাই তাঁর মতবাদকে নব খ্রিস্টবাদও বলা হয়।
  • তিনি মনে করতেন, সম্পদ বণ্টনের অসাম্যের জন্যই সমাজে ধনী ও দরিদ্র রয়েছে। মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটলে শিক্ষিত মানুষ দরিদ্র মানুষের উন্নতির চেষ্টা করবে।
  • সাঁ সিমোঁর মতে, সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন বাতিল করা উচিত। তা না হলে কিছু মানুষ বিনা পরিশ্রমে পৈতৃক সম্পত্তি পেয়ে আরামে জীবন কাটাবে আর উত্তরাধিকারহীন ব্যক্তিরা চিরকাল বঞ্চিত হবে।
  • প্রত্যেক মানুষ তার ক্ষমতা অনুসারে কাজ করবে এবং রাষ্ট্র তার প্রয়োজন মেটাবে।
  • মৃত্যু – সাঁ সিমোঁ 1825 খ্রিস্টাব্দের 19 মে প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।

চার্লস ফ্যুরিয়ের বা শার্ল ফ্যুরিয়ের (Charles Fourier) কে ছিলেন? তাঁর মতবাদ কী ছিল?

ফরাসি সমাজতন্ত্রী চার্লস ফ্যুরিয়ের ছিলেন সাঁ সিমোঁর মন্ত্রশিষ্য। যাঁদের ইউটোপিয়ান সোশ্যালিস্ট বা কল্পনাবিলাসী সমাজতন্ত্রী বলা হত, চার্লস ফ্যুরিয়ের ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধী ও সাম্যের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে বিখ্যাত হল ‘নতুন শিল্পজগৎ’ ও ‘ঐক্যবদ্ধ জগতের তত্ত্ব’।

চার্লস ফ্যুরিয়েরের জন্ম –

চার্লস ফ্যুরিয়ের 1772 খ্রিস্টাব্দের 7 এপ্রিল পূর্ব ফ্রান্সের বেজাঁ শহরে এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

চার্লস ফ্যুরিয়ের বা শার্ল ফ্যুরিয়ের (Charles Fourier)

চার্লস ফ্যুরিয়েরের মতবাদ –

চার্লস ফ্যুরিয়ের তাঁর কল্পিত সমাজ গঠন করার জন্য ফ্যালাঞ্জ (Phalange) গঠনের কথা বলেছিলেন।

  • তিনি বলেছেন, কতকগুলি পরিবার নিয়ে এক-একটি ফ্যালাঞ্জ গঠন করতে হবে। প্রত্যেক ফ্যালাঞ্জের সদস্যসংখ্যা হবে প্রায় 1600-1700 জন।
  • একটি ফ্যালাঞ্জের সদস্যরা এক জায়গায় বসবাস করবে। তারা তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য চাষ, পশুপালন, কাপড় বোনা ও অন্যান্য উৎপাদনশীল কাজ করবে। তাদের উৎপাদনে তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটে যাবে।
  • ফলে সমাজে মজুরি, মুনাফা, প্রতিযোগিতা বলে কিছু থাকবে না।
  • রাষ্ট্রীয় দমনমূলক সংস্থা – পুলিশ, কারাগার কোনোকিছুরই প্রয়োজন হবে না। ফলে শোষণ, বঞ্চনা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে।

চার্লস ফ্যুরিয়েরের মৃত্যু –

তিনি 1837 খ্রিস্টাব্দের 10 অক্টোবর 65 বছর বয়সে মারা যান।

সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী ভাবধারার উদ্ভব ও প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।

সমাজতন্ত্রবাদ বা সাম্যবাদ

সমাজতন্ত্রবাদ হল একটি দার্শনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ। ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সমষ্টিগত উৎপাদন, আয় ও বণ্টনের দ্বারা সমাজে অর্থনৈতিক সমতা, পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ ধ্বংসসাধন এবং শ্রমিকশ্রেণির কল্যাণসাধনই হল সমাজতন্ত্রবাদের মূল কথা।

প্রেক্ষাপট

শিল্পবিপ্লবের পর শোষিত শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী ভাবধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পপতিদের হাতে প্রচুর অর্থসম্পদ সঞ্চিত হয়। তারা স্বল্প মজুরির বিনিময়ে শ্রমিকদের দিয়ে বেশি সময় কাজ করাত। এর ফলে শ্রমিকদের জীবনে চরম দুর্দশা দেখা দেয়। শ্রমিকদের জীবনের এই সীমাহীন দুর্দশা এবং অভাব-অনটনের অবসানের উদ্দেশ্যে কিছু চিন্তাবিদ অষ্টাদশ শতকের শেষ ও ঊনবিংশ শতকের শুরুতে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রচার করতে শুরু করেন।

মূলনীতি

সমাজতন্ত্রবাদের মূলনীতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ —

  1. সম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানার অবসান।
  2. উৎপাদনের প্রক্রিয়া ও উপাদানের উপর সমাজ ও রাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
  3. অর্থের সমবণ্টন।
  4. শ্রমিক তথা দরিদ্রশ্রেণির কল্যাণসাধন প্রভৃতি।

আদি সমাজতন্ত্রবাদীগণ

সমাজতন্ত্রবাদের সূচনালগ্নে রবার্ট আওয়েন, সাঁ সিমোঁ, চার্লস ফ্যুরিয়ের, লুই ব্ল্যাঙ্ক প্রমুখ সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করেন। এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীগণ যে আদর্শের কথা বলেন তা ছিল পুরোপুরি তত্ত্বগত। বাস্তবে তার সফল প্রয়োগ কখনোই সম্ভব নয়। সেইজন্য এই আদি সমাজতন্ত্রবাদীগণ ইউটোপিয়ান’ বা ‘কল্পনাবিলাসী সমাজতন্ত্রী’ নামে পরিচিত।

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীগণ

আদি সমাজতন্ত্রবাদীগণ অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসানের সঠিক দিশা দেখাতে পারেননি। পরবর্তীকালে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসানের বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় ব্যাখ্যা করেন, যা ছিল বাস্তবসম্মত। তাঁরা এর নাম দেন ‘সাম্যবাদ’। এঁরাই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদী নামে পরিচিত।

এইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শোষিত শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী ভাবধারা শীঘ্রই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং বিংশ শতকে রাশিয়া ও চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাম্যবাদী ভাবধারা শীঘ্রই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং বিংশ শতকে রাশিয়া ও চিনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের প্রধান বক্তা হলেন কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। আদি সমাজতন্ত্রবাদীরা সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সঠিক পথ দেখাতে ব্যর্থ হলে মার্কস এবং এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের মূল বক্তব্য

কতকগুলি নির্দিষ্ট মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের মূল বক্তব্যগুলি হল-

সর্বহারার একনায়কত্ব – বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীরা সকলপ্রকার শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তাঁদের বিশ্বাস এরূপ সমাজের নেতৃত্ব দেবে শ্রমিকশ্রেণি। এর ফলে রাষ্ট্রে ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠা হবে।

প্রাকৃতিক সম্পদে সকলের সমান অধিকার – বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের মতে সমাজের প্রাকৃতিক সম্পদগুলি, যেমন — জমি, জল, জঙ্গল প্রভৃতি কোনো ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্ট নয়। ফলে এগুলির উপর কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা থাকা উচিত নয়। বরং এই সম্পদের উপর সকলের সমান অধিকার থাকা উচিত।

উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ – বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীদের লক্ষ্য ছিল উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সমাজে পুঁজিবাদীদের প্রভাব হ্রাস করা যায়।

সম্পদ বণ্টনে সাম্য প্রতিষ্ঠা – পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্বল্পসংখ্যক পুঁজিপতিদের হাতে বিপুল সম্পদ জমা হলেও শ্রমিকরা থাকে নিঃস্ব ও রিক্ত। সমাজে সম্পদ বণ্টনে অসাম্যের কারণে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীরা চিন্তিত ছিলেন। সম্পদ বণ্টনে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যেকার বৈষম্য দূর হবে বলে তারা মনে করতেন

সর্বোপরি, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীগণ প্রত্যেকের কাজের অধিকার দাবি করেন। তাঁরা মনে করতেন, বেকারদের কাজের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।

শিল্পসমাজের সমালোচনায় সমাজতন্ত্রবাদের বিভিন্ন ধরনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

শিল্পসমাজের সমালোচনায় সমাজতন্ত্রবাদ অত্যন্ত মুখর। তবে এই সমাজতন্ত্রবাদের বিভিন্ন ধরন লক্ষ করা যায়। তাই বলা হয়, সমাজতন্ত্রী যত, মতও তত।

সমাজতন্ত্রবাদের ধরন

  • নরমপন্থী সমাজতন্ত্রী (Moderate Socialists) – যে সমাজতন্ত্রীরা ধর্মঘট ও বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিজেদের মতবাদ বাস্তবায়িত করার পক্ষপাতী, তাদের নরমপন্থী সমাজতন্ত্রী বলা হয়। তারা মনে করেন উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত। তাদের এই মতবাদ ‘সমষ্টিবাদ’ বা ‘কালেকটিভিজম’ (Collectivism) নামে পরিচিত।
  • নৈরাজ্যবাদী (Anarchist) – যে সমাজতন্ত্রীরা মনে করেন রাষ্ট্র হল অত্যাচারের হাতিয়ার এবং যারা রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থা ও সর্বপ্রকার আইনের বিলোপসাধন ও ‘প্রাকৃতিক’ রাষ্ট্রের পক্ষপাতী, তাদের নৈরাজ্যবাদী বলা হয়। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা বাকুনিন (Bakunin), ক্রোপট্‌কিন (Kropotkin) -এর চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
  • কমিউনিস্ট (Communist) – যে সমাজতন্ত্রীরা বিপ্লবী পন্থায় বিশ্বাস করেন, তাদের কমিউনিস্ট বলা হয়। তাদের মতবাদ ‘কমিউনিজম’ (Communism) নামে পরিচিত। তারা বলত, সমস্ত সম্পদ ও জনগণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সকল নাগরিক শ্রম দেবে এবং সরকারের কাছ থেকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবে।
  • সিন্ডিক্যালিস্ট (Syndicalists) – যে সমাজতন্ত্রীরা মনে করতেন প্রত্যেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা সেই প্রতিষ্ঠানের সংঘের হাতে থাকা উচিত তারা সিন্ডিক্যালিস্ট নামে পরিচিত। তারা শ্রমিকশ্রেণির কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পক্ষপাতি ছিলেন। এ ছাড়া খ্রিস্টীয় সমাজবাদ (Christian Socialism), রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদ (State Socialism), ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রবাদ (Fabian Socialism), গিল্ড সমাজতন্ত্রবাদ (Guild Socialism) প্রভৃতি নানা ধরনের সমাজতন্ত্রবাদের কথা জানা যায়।

কার্ল মার্কস (Karl Marx) – টীকা লেখো

কার্ল মার্কস (1818-1883 খ্রিস্টাব্দ) হলেন জার্মানির একজন বিখ্যাত দার্শনিক। তাঁকে আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের জনক বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর মতবাদ মার্কসবাদ নামে অধিক পরিচিত। রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল — ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, ‘দাস ক্যাপিটাল’ প্রভৃতি। ‘দাস ক্যাপিটাল’ গ্রন্থটিকে ‘সমাজতন্ত্রবাদের বাইবেল’ বলা হয়।

কার্ল মার্কসের পূর্বজীবন –

কার্ল মার্কস 1818 খ্রিস্টাব্দের 5 মে জার্মানির ট্রিয়ার শহরে এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মার্কস ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল আইন, ইতিহাস ও দর্শন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রখ্যাত দার্শনিক হেগেলের মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমাজতন্ত্রী ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। 1841 খ্রিস্টাব্দে তিনি ইয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন।

মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস সহযোগিতা –

কার্ল মার্কস ‘রেইনিকো জাইঙ্গ’ নামে একটি উগ্রপন্থী সংবাদপত্রের সম্পাদনার কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হন এবং ফ্রান্সের প্যারিস শহরে আশ্রয়গ্রহণ করেন। এখানেই তাঁর ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তাঁদের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়। পরে ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত হয়ে তাঁরা বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

কার্ল মার্কসের কার্যাবলি –

  1. কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস 1847 খ্রিস্টাব্দে ব্রাসেলসে শ্রমজীবীদের নিয়ে কমিউনিস্ট লিগ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
  2. 1848 খ্রিস্টাব্দে তাঁরা রচনা করেন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’।
  3. 1867 খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন ‘দাস ক্যাপিটাল’।
  4. পরবর্তীকালে তিনি জার্মানিতে প্রত্যাবর্তন করে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পুনরায় দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। 1883 খ্রিস্টাব্দের 14 মার্চ মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস পরলোকগমন করেন।

শিল্পসমাজ কী? মার্কস কীভাবে শিল্পসমাজের সমালোচনা করেছেন?

শিল্পসমাজ –

শিল্পবিপ্লবের ফলে গ্রামের মানুষ কাজের আশায় শহরে এসে কলকারখানার বিভিন্ন কাজে যোগ দেয় এবং এর ফলে নতুন বসতি গড়ে ওঠে। এই বসতিগুলি শিল্পসমাজ হিসেবে পরিচিত হয়।

মার্কসের শিল্পসমাজের সমালোচনা –

মার্কসের মতে, উৎপাদন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে শিল্পসমাজে মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব হয়। শ্রমিক তার শ্রমের দ্বারা যন্ত্রের সাহায্যে কাঁচামাল থেকে পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করে। এই পণ্যদ্রব্যের দাম কাঁচামাল ও যন্ত্রের জন্য ব্যয়িত দামের থেকে বেশি হয়। এই বর্ধিত মূল্য সৃষ্টি করে শ্রম। কিন্তু শ্রমিক এই মুল্যের খুব কম অংশই পায়। যে অংশ থেকে শ্রমিক বঞ্চিত হয় তাকে উদ্‌বৃত্ত মূল্য বলে। এই উদ্‌বৃত্ত মূল্যের পুরোটাই মালিকশ্রেণি ভোগ করে শ্রমিকশ্রেণিকে শোষণ করে। এই শোষিত শ্রমিকশ্রেণির কোনো জাতিগত বা দেশগত পার্থক্য নেই। দুনিয়ার সকল শ্রমিকের একমাত্র শত্রু হল মুনাফালোভী বুর্জোয়া শ্রেণি। বুর্জোয়া শ্রেণির অবসান ফলে সাম্যবাদী সমাজ গড়ে উঠবে এবং শ্রমিকশ্রেণির উপর শোষণ বন্ধ হবে।

শিল্পসমাজ সম্পর্কে মার্কসের সমালোচনা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। কারণ- শ্রমিকের শ্রমই উৎপাদনের একমাত্র উপাদান নয়। যন্ত্র ও মূলধন ছাড়াও পণ্য উৎপাদনে নানা উপাদানের প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া মার্কসের শ্রেণিহীন সমাজের কথাও অবাস্তব। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও শিল্প পরিচালক, প্রযুক্তিবিদ প্রমুখ কিছু সুবিধাভোগী শ্রেণির অস্তিত্ব দেখা যায়।

তবে ত্রুটি সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, সামাজিক শোষণের প্রেক্ষাপট ও শোষণমুক্তির সম্ভাবনার পথনির্দেশিকা হিসেবে মার্কসের মতবাদ নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর কর্মজীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ছিলেন একজন বিখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী, লেখক, দার্শনিক এবং কার্ল মার্কসের সহযোগী।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর শৈশব –

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস জার্মানির বারমানে 1820 খ্রিস্টাব্দের 28 নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন জার্মানির একজন বড়ো শিল্পপতি।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর কর্মজীবন –

বড়ো হয়ে তিনিও পারিবারিক ব্যবসাতে যুক্ত হয়েছিলেন।

  1. 1842 খ্রিস্টাব্দে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে এক বছর কাজ করেছিলেন।
  2. সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এসে তিনি পারিবারিক ব্যবসার কাজে ব্রিটেনে যান।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর সাম্যবাদী দার্শনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ –

ব্রিটেনে থাকার সময় তিনি কলকারখানার শ্রমিকদের দুর্দশা দেখে বিচলিত হন। ‘শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। এঙ্গেলস বলেন যে, মালিকরা শ্রমিকদের শোষণ করে। এই ব্যবস্থা বেশিদিন চলতে পারে না, চলা সংগতও নয় — এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর মার্কসের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা –

দার্শনিক কার্ল মার্কস যখন ব্রিটেনে নির্বাসিত হন তখন এঙ্গেলসও সেখানে চলে আসেন। মার্কসের সহযোগিতায় তিনি দর্শনচর্চায় মনোযোগ দেন।

  1. 1848 খ্রিস্টাব্দে মার্কস ও এঙ্গেলস রচনা করেন বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার’ (কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো)। এই ইস্তাহারে প্রকাশিত সমাজতন্ত্রী তত্ত্বই ‘দাস ক্যাপিটাল’ নামে পরিচিত।
  2. 1883 খ্রিস্টাব্দে কার্ল মার্কসের মৃত্যুর পর তিনি মার্কসের অপ্রকাশিত ‘পুঁজি’-র দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর মৃত্যু –

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস 1895 খ্রিস্টাব্দের 5 আগস্ট 74 বছর বয়সে লন্ডনে মারা যান।নে মারা যান।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ও কার্ল মার্কস-এর তত্ত্বের সমালোচনা কীভাবে করা হয়?

বর্তমান পৃথিবীতে মার্কসবাদ হল সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মতবাদ। সারা পৃথিবীতে এই মতবাদের অনেক সমর্থক আছেন, আবার অনেক সমালোচকও আছেন। সমালোচকগণ মার্কসবাদকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার জন্য অনেক যুক্তি দিয়েছেন।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ও কার্ল মার্কস-এর বিরুদ্ধ যুক্তি –

  • মধ্যবিত্তশ্রেণির অবদানকে অস্বীকার – মার্কসবাদে বলা হয়েছে, সমাজে দুটি শ্রেণি আছে — শোষক ও শোষিত। মার্কসের মতে, এই দুটি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের ফলে সমাজে পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু সমস্ত সমাজেই মধ্যবিত্তশ্রেণির অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়, যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
  • মার্কসবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ভুল ও অসম্পূর্ণ – সমালোচকরা বলেন, ইতিহাসের গতি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না। ইতিহাসের গতি নির্ভর করে দেশপ্রেম, ধর্ম, বিভিন্ন ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা, রাজনীতি প্রভৃতির উপরেও।

শিল্পবিপ্লব কীভাবে উপনিবেশের জন্ম দিয়েছিল?

আধুনিক যুগে ব্রিটেনে প্রথম শিল্পবিপ্লব হয়েছিল। তারপর সমগ্র ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটে। শিল্পবিপ্লব ইউরোপ তথা বিশ্বের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলেও শিল্পবিপ্লবের ফলেই উপনিবেশের জন্ম হয়েছিল।

শিল্পবিপ্লব ও উপনিবেশের সৃষ্টি –

শিল্পবিপ্লবের ফলে উপনিবেশের জন্মের কারণগুলি হল —

  • উৎপাদন বৃদ্ধি – শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পজাত পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। নিজের দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি পণ্যসামগ্রীর উপযুক্ত ব্যবস্থার জন্য উপনিবেশের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
  • বাড়তি পণ্য বিক্রির বাজার সৃষ্টি – শিল্পবিপ্লবের ফলে বাড়তি পণ্যের বাজার সৃষ্টি করার জন্য উপনিবেশ সৃষ্টি করা হয়।
  • কাঁচামাল সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি – শিল্পের জন্য কাঁচামাল প্রয়োজন। শিল্পবিপ্লবের ফলে বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল সংগ্রহের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলি বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ সৃষ্টি করে।
  • মূলধনের প্রাচুর্য – শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পপতি ও পুঁজিপতিদের হাতে প্রচুর অর্থ বা মূলধন সঞ্চিত হয়। শিল্পোন্নত দেশগুলির শিল্পপতি ও পুঁজিপতিরা মূলধন বিনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে।

ইউরোপে রেলপথের সম্প্রসারণ সম্পর্কে লেখো। রেলপথ সম্প্রসারণের ফলাফল লেখো।

উপনিবেশবাদের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিশেষত রেলপথ নির্মাণ এবং সম্প্রসারণের উদ্যোগ গৃহীত হয়। শিল্পবিপ্লব উন্নত প্রযুক্তির জন্ম দেয় যা রেলপথ নির্মাণে সহায়তা করেছিল। ইংল্যান্ডে রেলপরিবহণ শিল্পবিপ্লবকে গতি প্রদান করেছিল।

ইউরোপে রেলপথ সম্প্রসারণ

ফ্রান্স, জার্মানি, প্রাশিয়া ইত্যাদি দেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রেলপথ নির্মাণের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল।

ইউরোপে রেলপথের সম্প্রসারণ

ফ্রান্স – ফ্রান্সে রেলপথ বিস্তারের উদ্যোগ নেওয়া হয় লুই ফিলিপের আমল থেকে। 1842 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় 900 কিলোমিটার রেলপথ তৈরি করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগেই রেলপথ নির্মাণ চলতে থাকে।

জার্মানি – 1860 খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে 11,800 কিমি রেলপথ সম্প্রসারিত হয়। 1910 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যা হয়ে দাঁড়ায় 61,000 কিমি। জার্মানি, রাশিয়া ও তুরস্ক রেলপথ দ্বারা যুক্ত হয়।

রাশিয়া – 1880 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1890 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাশিয়া 5,000 মাইল দীর্ঘ ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।

রেলপথ সম্প্রসারণের ফলাফল –

রেলপথ সম্প্রসারণের সুফল –

  1. রেলপথ সম্প্রসারণের ফলে পরিবহণ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে।
  2. রেলপথের বিস্তারের ফলে শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতি হয়।

রেলপথ সম্প্রসারণের কুফল –

  1. রেলপথের নির্মাণ এবং বিস্তার প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল।
  2. ইউরোপের উপনিবেশগুলিতে রেলপথকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুয়েজ খালের ভূমিকা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

সুয়েজ খাল হল মিশরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত একটি কৃত্রিম সামুদ্রিক খাল। সুয়েজ খালের মাধ্যমে লোহিত সাগর ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। 1869 খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ খাল সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুয়েজ খাল এর ভূমিকা

যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুয়েজ খালের প্রয়োজনীয়তা –

সুয়েজ খাল পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে জলপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সুয়েজ খাল খননের আগে ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত স্থলপথে পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাওয়া হত। এটি ছিল সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।

সুয়েজ খাল খনন –

সুয়েজ খাল খননের কাজে প্রধান ফরাসি প্রকৌশলী ছিলেন ফার্দিনান্দ দ্য লেসেপস (Ferdinand de Lesseps)। 1859 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে সুয়েজ খাল খননের কাজ শুরু হয়। সুয়েজ খাল খননের কাজ শেষ হয় 1869 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে।

আধুনিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে টেলিগ্রাফ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় টেলিগ্রাফের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেলিযোগাযোগের প্রথম নিদর্শন হল টেলিগ্রাফ, যার সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে দূর-দূরান্তে খবর পাঠানো যায়। এই বার্তা পাঠানোর পদ্ধতিকে টেলিগ্রাফ এবং গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো বার্তাকে টেলিগ্রাম বলা হয়।

আধুনিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে টেলিগ্রাম

টেলিগ্রাফের ব্যবহার পদ্ধতি –

টেলিগ্রাফ বলতে বোঝায় মূলত বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফকে, যার সাহায্যে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ সংকেত ব্যবহার করে তার বা বেতার চ্যানেলের মাধ্যমে লিখিত বার্তা দূর-দূরান্তে পাঠানো যায়। টেলিগ্রাফের বার্তাকে প্রথমে মোর্স কোডে রূপান্তর করা হয়। তারপর ওই কোডটি প্রেরক যন্ত্রে নির্দিষ্ট প্রান্তে পাঠানো হয়।

টেলিগ্রাফের গুরুত্ব –

আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা বিশ্বব্যাপী টেলিগ্রাফ লাইন শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজে ব্যবহৃত হত। জাহাজের ও ট্রেনের সময়সূচি নির্ধারণে, দূরবর্তী স্থান বা উপনিবেশের সঙ্গে আর্থ-সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন, ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য উপনিবেশে যুদ্ধকালে নির্দেশদানের ক্ষেত্রেও টেলিগ্রাফ শক্তিশালী মাধ্যমরূপে বিশ্বব্যাপী কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।

ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রত্ন বলা হয় কেন?

ভারত ছিল ব্রিটিশদের উপনিবেশগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান উপনিবেশ। অষ্টাদশ শতকের শেষদিক থেকে পরবর্তী দেড় শতকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ প্রশাসন ভারতের অর্থসম্পদকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হয়।

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সময়ে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যাবতীয় খরচ ভারত থেকেই আদায় করার কথা বলা হয়।
  • ভারতের বাজারকে ব্রিটেনে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করা হয়। 1914 খ্রিস্টাব্দের হিসাব অনুসারে ব্রিটেনের ল্যাঙ্কাশায়ারে তৈরি সুতির কাপড়ের 85% ভারতে বিক্রি হত।
  • ভারতে রেলপথ ও রেলগাড়ি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত লৌহ-ইস্পাতের 17% ব্রিটেন থেকে আনা হত। ভারতীয় উপনিবেশের শিল্প-বাণিজ্যের অভিমুখ ব্রিটেনের স্বার্থে পরিচালিত হত। অর্থাৎ সবদিক থেকে ভারত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম লাভজনক উপনিবেশ। তাই ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে দামি ‘রত্ন’ বলা হত।

নব সাম্রাজ্যবাদ (New Colonialism) বলতে কী বোঝো? নব সাম্রাজ্যবাদের উন্মেষের কারণগুলি লেখো।

নব সাম্রাজ্যবাদ (New Colonialism) –

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি ইউরোপের বাইরে বিশেষত আফ্রিকা এবং এশিয়ার দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। এই প্রবণতাই ‘নব সাম্রাজ্যবাদ’ নামে পরিচিত।

নব সাম্রাজ্যবাদের উন্মেষের কারণ –

নব সাম্রাজ্যবাদের উন্মেষের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

  • শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলি কাঁচামাল সংগ্রহ ও শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রির জন্য বাজার দখল এবং বাড়তি জনসংখ্যার স্থান সংকুলানের জন্য উপনিবেশ দখল করতে গেলে নব সাম্রাজ্যবাদ ত্বরান্বিত হয়।
  • ভৌগোলিক আবিষ্কারের প্রচেষ্টা নয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রেরণা জোগায়।
  • ইউরোপীয় দেশগুলির কাছে সেই সময় সাম্রাজ্যবিস্তার ছিল মর্যাদা বৃদ্ধি এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মাপকাঠি।
  • খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের ধর্মপ্রচারের প্রয়াস ছিল নয়া সাম্রাজ্যবাদের পিছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অর্থনৈতিক কারণ কী ছিল?

অথবা, সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে হবসন ও লেনিনের তত্ত্বটি লেখো।

ঊনবিংশ শতকে ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের কারণ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক জে. এ. হবসন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ’ (Imperialism – A Study) গ্রন্থে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, সেই সময় পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় কিছু মানুষ মূলধনের পাহাড় জমা করে। এই মূলধন বিনিয়োগ করে আরও মুনাফা লাভের আশায় পুঁজিপতিরা নিজ নিজ দেশের সরকারকে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে।

হবসনের তত্ত্বের দুর্বলতা –

সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব সম্পর্কে হবসন যে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনেক ঐতিহাসিক তার সমালোচনা করেছেন। সমালোচকদের মতে, শিল্পবিপ্লবের পর মূলধনি শিল্পপতিরা উপনিবেশে অর্থ বিনিয়োগ করে শিল্প গড়েছিল ঠিকই, কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পূর্বে কেন উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা হবসন দেননি।

গুরুত্ব –

সমালোচনা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হবসনের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ মূলধনের স্ফীতি এবং বাজার দখলের ইচ্ছা সাম্রাজ্যবাদকে জোরদার করে এবং শিল্পবিপ্লব ও ধনতন্ত্রবাদ সাম্রাজ্যবাদের পথ প্রশস্ত করে। তাই হবসনের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা অনেকাংশে সত্য।

লেনিনের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা –

রুশ কমিউনিস্ট নেতা লেনিন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ, ধনতন্ত্রবাদের সর্বোচ্চ স্তর’ (Imperialism, the Highest Stage of Capitalism) নামক গ্রন্থে বলেছেন, অধিক মুনাফার আশায় শিল্পমালিকেরা প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি দ্রব্য উৎপাদন করে। এই বাড়তি দ্রব্য বিক্রি এবং সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য তারা উপনিবেশ দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। তাঁর মতে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিণামই হল সাম্রাজ্যবাদ।

লেনিনের মতের সমালোচনা –

কোনো কোনো ঐতিহাসিক লেনিনের মতের সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মূলধন লগ্নির ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখলে লেনিনের মতও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। যেমন ফ্রান্স দক্ষিণ আমেরিকা বা রাশিয়ায় মূলধনের প্রধান অংশ বিনিয়োগ করেছিল, অথচ আমেরিকা বা রাশিয়া কোনোদিনই ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল না।

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্থনৈতিক স্বার্থ অন্যতম কারণ হলেও একমাত্র কারণ ছিল না।

ঔপনিবেশিকতাবাদ কী? ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদের কী সম্বন্ধ?

ঔপনিবেশিকতাবাদ –

ঔপনিবেশিকতাবাদ বলতে বোঝায় কোনো দেশকে জয় করে সেই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করে তাকে উপনিবেশে পরিণত করা। ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করেছিল।

ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের সম্বন্ধ –

ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদের সম্বন্ধ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন বলেছেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের যুগ। তাঁর মতে, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর জার্মানি ও ইটালিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল। তারা এই দেশগুলি মনে করত যে, উপনিবেশে আধিপত্য স্থাপন না করলে তাদের শক্তিবৃদ্ধি হবে না; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের সম্মান থাকবে না। সেজন্য এই দেশগুলি উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল।

ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি চিনকে কীভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছিল সংক্ষেপে লেখো।

ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে প্রায় সব ইউরোপীয় শক্তিই চিনের উপর আগ্রাসী নীতি প্রয়োগ করে। তাই ঐতিহাসিক হ্যারল্ড ভিনাক (Harold Vinacke) যথার্থই বলেছেন যে, ‘তরমুজকে লোকে যেমন খণ্ড খণ্ড করে খায়, সেইভাবে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি Chinese Melon বা চিনা তরমুজকে খণ্ড খণ্ড করে খেতে উদ্যত হয়।’

চিনের ব্যবচ্ছেদ –

রাশিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স চিনের ব্যবচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

  • রাশিয়া চিনের লিয়াও টুং উপদ্বীপ এবং পোর্ট আর্থার দখল করে নেয়।
  • জার্মানি দখল করে কিয়াওচাও বন্দর ও শানটুং প্রদেশের অংশবিশেষ।
  • ইংল্যান্ড ওয়াইহ্যাওয়ে অধিকারের মধ্যে দিয়ে ইয়াংসি উপত্যকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
  • ফ্রান্স ইন্দোচিন বা আনাম থেকে চিনের ভিতর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের অধিকার পায়। এর ফলে ফ্রান্স ইউনান, কোয়াংশি ইত্যাদি অঞ্চলের খনিজ সম্পদ রেলপথের মাধ্যমে নিয়ে যাবার সুযোগ পায়।
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি চিনকে কীভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছিল সংক্ষেপে লেখো।

আমেরিকার আগ্রাসন – এইভাবে ইউরোপীয় শক্তিগুলি নিজের মধ্যে চিনকে ভাগাভাগি করে নিলে আমেরিকা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। চিনে নিজের বাণিজ্যিক অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকা যে মুক্তদ্বার নীতি’ (Open Door Policy)-র ঘোষণা করে তা নগ্ন অর্থনৈতি সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম দৃষ্টান্ত।

চিন ও আফ্রিকার ঔপনিবেশিক ব্যবচ্ছেদ সমন্ধে কী জানো?

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি চিন ও আফ্রিকা উপনিবেশ বিস্তার করে, ফলে আফ্রিকা ও চিন বিভিন্ন ইউরোপীয়। রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।

চিনের ব্যবচ্ছেদ – ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক আধিপত্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে চিন বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। যেমন-

  • চিনের লিয়াও টুং উপদ্বীপ ও পোর্ট আর্থার বন্দর দখল করে রাশিয়া।
  • জার্মানি দখল করে কিয়াওচাও বন্দর এবং শানটুং প্রদেশ।
  • ব্রিটেন দখল করে ওয়াইহ্যাওয়ে বন্দর। এ ছাড়া
  • ফ্রান্স ইন্দোচিনের আনাম থেকে চিনের ভিতর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের অধিকার পায়।

আমেরিকার আগ্রাসন –

এইভাবে ইউরোপীয় শক্তিগুলি নিজের মধ্যে চিনকে ভাগাভাগি করে নিলে আমেরিকা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। চিনে নিজের বাণিজ্যিক অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকা যে মুক্তদ্বার নীতি’ (Open Door Policy)-র ঘোষণা করে তা নগ্ন অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম দৃষ্টান্ত।

চিন ও আফ্রিকার ঔপনিবেশিক ব্যবচ্ছেদ সমন্ধে কী জানো ?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কত দূর দায়ী ছিল?

1914 খ্রিস্টাব্দে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

  • ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, কোনো রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও গুরুত্বের মাপকাঠি হলো তার সাম্রাজ্যের বিশালতা। তাই ইউরোপীয় বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি উপনিবেশ বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় এবং এর পরিণামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
  • ঔপনিবেশিক বাজার দখলের লড়াই – ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি সহ ইউরোপের দেশগুলি তাদের উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির জন্য উপনিবেশ দখলে রাখতে সচেষ্ট হয়। কারণ তখন উপনিবেশগুলি ছিল তাদের উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির লাভজনক বাজার।
  • কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা – ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি তাদের শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও খনিজ সম্পদ সংগ্রহের লক্ষ্যে এশিয়া ও আফ্রিকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল।
  • প্রতিষ্ঠিত ও নতুন রাষ্ট্রের উপনিবেশ দখলের চেষ্টা – উনিশ শতকে জার্মানি যখন সাম্রাজ্যবিস্তারে অবতীর্ণ হল তখন তারা লক্ষ করে যে, ইংরেজ ও ফরাসিরা এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলি দখল করে রেখেছে। জার্মানি সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্য আত্মনিয়োগ করলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে জোট গড়ে ওঠে। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এই পরস্পরবিরোধী জোটই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী ছিল।

পরিশেষে, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়াকে নিয়ে গঠিত ত্রিশক্তি আঁতাত ও অপরদিকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইতালিকে নিয়ে গঠিত ত্রিশক্তি মৈত্রী 1914 খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে কীভাবে ত্রিশক্তি মৈত্রী (Triple Alliance) এবং ত্রিশক্তি আঁতাত (Triple Entente) গড়ে উঠেছিল?

870 খ্রিস্টাব্দে সেডানের যুদ্ধ ও 1914 খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি দুটি পরস্পরবিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার একদিকে ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইতালিকে নিয়ে গড়ে ওঠা ‘ত্রিশক্তি মৈত্রী’ (Triple Alliance) এবং অন্যদিকে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়াকে নিয়ে গঠিত ‘ত্রিশক্তি আঁতাত’ (Triple Entente)।

ত্রিশক্তি মৈত্রী গঠন

  • তিন সম্রাটের চুক্তি – জার্মানিকে শক্তিশালী এবং প্রতিপক্ষ ফ্রান্সকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে নিঃসঙ্গ করে রাখার জন্য বিসমার্ক 1873 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার ‘তিন সম্রাটের চুক্তি’ বা ‘ড্রেইকাইজারবুন্ড’ গঠন করেন।
  • দ্বিশক্তি চুক্তি – 1878 খ্রিস্টাব্দে বার্লিন কংগ্রেসে জার্মানির বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে রাশিয়া তিন সম্রাটের চুক্তি তথা ড্রেইকাইজারবুন্ড ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ফলে ‘তিন সম্রাটের চুক্তি’ ভেঙে যায় এবং জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে 1879 খ্রিস্টাব্দে দ্বিশক্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
  • তিন সম্রাটের লিগ – ফ্রান্সের সঙ্গে রাশিয়ার যাতে কোনো জোট গঠিত না হতে পারে সেইজন্য বিসমার্কের উদ্যোগে 1881 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে ‘তিন সম্রাটের লিগ’ বা ‘ড্রেইকাইজারবুন্ডনিস’ গঠিত হয়।
  • ত্রিশক্তি মৈত্রী – বিসমার্ক তিন সম্রাটের লিগে ইতালিকে যুক্ত করার প্রচেষ্টা চালান। বিসমার্কের উদ্যোগেই 1882 খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় জার্মানি, ইতালি ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ‘ত্রিশক্তি মৈত্রী’ (Triple Alliance) স্বাক্ষরিত হয়। পরে রোমানিয়া এবং তুরস্ক এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

ত্ৰিশক্তি আঁতাত গঠন –

  • রি-ইনস্যুরেন্স চুক্তি বাতিল – জার্মানির প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক 1887 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সঙ্গে অনাক্রমণমূলক রি-ইনস্যুরেন্স চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু বিসমার্কের পতনের পর কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম 1890 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সঙ্গে রি-ইনস্যুরেন্স চুক্তি বাতিল করেন। এর ফলে জার্মানির প্রতি রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয়।
  • ফ্রান্স-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি – জার্মানির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ রাশিয়া এবং ফ্রান্স পরস্পরের কাছে আসতে শুরু করে এবং উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। 1893 খ্রিস্টাব্দে তাদের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর পরের বছরই অর্থাৎ 1894 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ও রাশিয়া পরস্পর মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
  • ফ্রান্স ও রাশিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের চুক্তি – এই পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ড সমস্ত বিরোধ ভুলে ফ্রান্স ও রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে। ফলস্বরূপ 1904 খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ইঙ্গ-ফরাসি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় 1907 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে ইঙ্গ-রুশ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
  • ত্ৰিশক্তি আঁতাত – 1894 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি, 1904 খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি এবং 1907 খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-রুশ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া পরস্পরের খুব কাছে চলে আসে। এমতাবস্থায় এই তিনটি দেশের মধ্যে ‘ত্রিশক্তি আঁতাত’ (Triple Entente) গঠিত হয়।

ত্রিশক্তি মৈত্রী এবং ত্ৰিশক্তি আঁতাত গঠনের ফলে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপ প্রকৃতপক্ষে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দুই বিরোধী শিবিরের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে।ত্রিশক্তি মৈত্রী এবং ‘ত্রিশক্তি আঁতাত’ গঠনের ফলে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপ প্রকৃতপক্ষে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দুই বিরোধী শিবিরের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে।

ত্রিশক্তি মৈত্রী (Triple Alliance) ও ত্রিশক্তি আঁতাত (Triple Entente) – টীকা লেখো

ঊনবিংশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের শুরুতে ইউরোপীয় রাজনীতিতে তীব্র ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। সমগ্র ইউরোপ এর ফলে দুটি পরস্পর বিবদমান সশস্ত্র শিবিরে ভাগ হয়ে যায় — 1. ত্রিশক্তি মৈত্রী (Triple Alliance) এবং 2. ত্রিশক্তি আঁতাত (Triple Entente)।

ত্রিশক্তি মৈত্রী –

1871 খ্রিস্টাব্দের পর বিসমার্কের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইউরোপের শক্তিসাম্য বজায় রাখা এবং ফ্রান্সকে দুর্বল করে রাখা। 1873 খ্রিস্টাব্দে তিনি জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে তিন সম্রাটের সংঘ বা ড্রেইকাইজারবুন্ড স্থাপন করেন। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ফলে 1879 খ্রিস্টাব্দে বিসমার্ক গোপনে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে দ্বিশক্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরে ফ্রান্স ও ইতালির দ্বন্দ্বের সুযোগে তিনি 1882 খ্রিস্টাব্দে ইতালিকেও চুক্তিতে যুক্ত করেন। ফলে দ্বিশক্তি চুক্তি ত্রিশক্তি মৈত্রীতে পরিণত হয়। এইভাবে 1882 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং ইতালির মধ্যে ত্রিশক্তি মৈত্রী গড়ে ওঠে।

ত্ৰিশক্তি আঁতাত –

ত্রিশক্তি মৈত্রী গঠনের 25 বছর পর ত্রিশক্তি আঁতাত গঠিত হয়। 1887 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে জার্মানবিরোধী শক্তিজোট আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কের অবনতি হয় এবং রুশ-ফরাসি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটাই ছিল ত্রিশক্তি মৈত্রীর বিরুদ্ধে গঠিত প্রথম ইউরোপীয় শক্তিজোট। এই পরিস্থিতিতে 1904 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে এবং 1907 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এইভাবে 1907 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে ত্রিশক্তি আঁতাত গঠিত হয়। ত্রিশক্তি মৈত্রী এবং ত্রিশক্তি আঁতাতের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল।ত্রিশক্তি মৈত্রী এবং ত্রিশক্তি আঁতাতের মধ্যে পারস্পরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে টীকা লেখো।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যেসব বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ 1914 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1918 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। 1914 খ্রিস্টাব্দের সেরাজেভো হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন বলেছেন যে, 1871 খ্রিস্টাব্দ থেকে যে ঘটনাবলির সূচনা হয়, তার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।

কারণ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলিকে আমরা দু-ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি — প্রত্যক্ষ কারণ ও পরোক্ষ কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড।

প্রত্যক্ষ কারণ: সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড – সেরাজেভো হল বসনিয়ার রাজধানী। অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ ও তাঁর পত্নী সোফিয়া সেরাজেভো শহরে পরিভ্রমণে এসেছিলেন। এখানে 1914 খ্রিস্টাব্দের 28 জুন স্লাভ বিপ্লবী সংগঠন ‘ব্ল্যাক হ্যান্ড’ (Black Hand)-এর সদস্য গাভ্রিলো প্রিন্সিপ (Gavrilo Princip) যুবরাজ ও যুবরানিকে হত্যা করে। এই ঘটনা ‘সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত।

এই ঘটনার জন্য অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং এক চরমপত্র দিয়ে 48 ঘণ্টার মধ্যে তার শর্তপূরণ করতে বলে। কিন্তু সার্বিয়ার পক্ষে সব দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এতে অস্ট্রিয়া ক্ষুব্ধ হয়ে 1914 খ্রিস্টাব্দের 28 জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সার্বিয়ার পক্ষে রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ার পক্ষে জার্মানি, তুরস্ক, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশ যোগদান করলে উক্ত যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়।

আজকের আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায়, “শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ” এর কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষার এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলি প্রায়ই এসব পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকে, আপনি টেলিগ্রামে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। এছাড়া, এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।

Share via:

মন্তব্য করুন