আজকের এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক বাংলার দ্বিতীয় পাঠের প্রথম অংশ “অসুখী একজন” এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পরীক্ষায় এ ধরনের প্রশ্ন প্রায়শই দেখা যায়। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য সহায়ক হবে।
কবি পরিচিতি
জন্ম –
চিলির বিখ্যাত কবি এবং দক্ষ রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। পাবলো নেরুদা তাঁর ছদ্মনাম। তাঁর ‘পাবলো’ নামের সম্ভাব্য উৎস পল ভারলেইন, আর ‘ নেরুদা’ – র উৎস চেক লেখক জান নেরুদা
কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন –
মাত্র দশ বছর বয়সেই নেরুদার কবিতা লেখার সূচনা। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর প্রথম বই Twilight প্রকাশ করার জন্য নিজের যাবতীয় জিনিস বিক্রি করে দেন। Twenty Love Poems and a Song of Despair কাব্যগ্রন্থটি তাঁকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে লেখালেখির জন্য পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নেরুদা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। চিলিতে দক্ষিণপন্থী সরকার এলে নেরুদাকে আত্মগোপন করতে হয়। এই সময়েই নেরুদা লেখেন – Canto General
নেরুদা জীবনের নানা পর্বে একাধিক কূটনৈতিক পদে থেকে যোগ্যতার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব সামলেছেন। একসময় চিলির কমিউনিস্ট পার্টির সেনেটর ছিলেন তিনি। কনজারভেটিভ চিলিয়ান রাষ্ট্রপতি গঞ্জালেস ভিদেলা চিলি থেকে কমিউনিজমকে উচ্ছেদ করার পর নেরুদার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। নেরুদার বন্ধুরা এই সময় তাঁকে চিলির বন্দর ভালপারাইসোর একটি বাড়িতে কয়েক মাসের জন্য লুকিয়ে রাখেন। গ্রেফতারি এড়িয়ে নেরুদা মাইহু হ্রদের গিরিপথ ধরে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান। এর কয়েক বছর পর নেরুদা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দের এক ঘনিষ্ঠ সহকারীতে পরিণত হন। প্রতিবাদী কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন পরাবাস্তববাদী কবিতা, ঐতিহাসিক মহাকাব্য, এমনকি রাজনৈতিক ইস্তাহার।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে নেরুদা পান আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে দেওয়া হয় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – Extravagaria, The Captain’s Verses, Still Another Day, The Yellow Heart, World’s End ইত্যাদি। কলম্বিয়ার বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ নেরুদাকে বিংশ শতাব্দীর ‘সকল ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি’ আখ্যায় অভিহিত করেন।
জীবনাবসান –
চিলিতে যখন অগস্তো পিনোচেটের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান চলছে, সেই সময়েই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে নেরুদা হাসপাতালে ভরতি হন। মাত্র তিন দিন পরেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর।
অনুবাদক পরিচিতি
প্রাথমিক পরিচিতি –
অন্য ধারার কবি ও সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন, মৃত্যু হয় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই। পাঠ্য ‘অসুখী একজন’ কবিতাটি নবারুণ ভট্টাচার্যের বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত। এটি একটি অনুবাদ সাহিত্যের সংকলন। প্রকাশকাল ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ। নবারুণ ভট্টাচার্য রচিত অন্য বইগুলির মধ্যে রয়েছে –
কাব্যগ্রন্থ –
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, মুখে মেঘের রুমাল বাঁধা, পুরন্দর ভাটের কবিতা, পুলিশ করে মানুষ শিকার, রাতের সার্কাস।
উপন্যাস –
হারবার্ট, যুদ্ধ পরিস্থিতি, কাঙাল মালসাট, অটো ও ভোগী, খেলনানগর, মসোলিয়াম।
গল্পগ্রন্থ –
হালাল ঝান্ডা ও অন্যান্য, অন্ধবেড়াল ও অন্যান্য গল্প, ফ্যাতাডুর কুন্তীপাক, ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ও অন্যান্য, প্রেম ও পাগল, মহাযানের আয়না, পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট।
গদ্যগ্রন্থ –
অ্যাকোয়ারিয়াম, আনাড়ির নাড়িজ্ঞান।
বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে প্রসঙ্গে গ্রন্থের ভূমিকায় অনুবাদক-কবি ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২-য় লিখেছেন- আমার প্রিয় কবিতা, গদ্য ও নাটকের কিছু অনুবাদ এখানে, এই এক মলাটে বন্দী হল বন্ধু রাজীব চৌধুরির উৎসাহে। আগে বা সম্প্রতিকালেও এর প্রায় সবকটি লেখাই অনুবাদ করেছি সুমন্ত্র ভট্টাচার্য নামে। এই বইতে লোকটির অন্তরালের লেখকটি অন্তত স্বনামে উপস্থিত। লেখাগুলো বাছাই করার মধ্যে আমার রাজনৈতিক অবস্থান আশা করি পাঠকদের চোখ এড়াবে না। আরও কিছু অনুবাদের কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে।
উৎস
পাবলো নেরুদার Extravagaria গ্রন্থের ‘La Desdichada’ কবিতাটি নবারুণ ভট্টাচার্য ‘অসুখী একজন’ নামে অনুবাদ করেন। নবারুণ ভট্টাচার্যের অনূদিত বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘অসুখী একজন’ কবিতাটি নেওয়া হয়েছে।
সারসংক্ষেপ
কবিতার কথক নিজের ফিরে আসার অপেক্ষায় তাঁর প্রিয়তমাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেলেন। দেশ ছেড়ে তিনি চলে গেলেন বহু দূরে। কথক যে আর কখনও দেশে ফিরে আসবেন না, তা তাঁর অপেক্ষারত প্রিয়তমা জানতেন না। রাস্তা দিয়ে কুকুর চলে গেল, গির্জার নান হেঁটে গেল-অর্থাৎ, সংসারের কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকল। কেটে গেল সপ্তাহ, বছর-অনেকটা সময়। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেল কথকের পায়ের দাগ, সেখানে ঘাস জন্মাল। আর প্রতীক্ষারত মেয়েটির মাথার ওপর ভারী পাথরের মতো একটার পর একটা বছর নেমে এসে তাকে বিচ্ছেদের বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তুলল। এরপর অনেক হত্যা আর ধ্বংসলীলা চলল। সমতলে ছড়িয়ে পড়ল যুদ্ধের আগুন। এই পরিস্থিতিতে দেবতার প্রতি ভক্তি আর বিশ্বাস টলে গেল, মন্দির থেকে টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়ল দেবতার মূর্তি। কথকের ফেলে আসা বাড়ি, বারান্দা, ঝুলন্ত বিছানা, গোলাপি গাছ, চিমনি, জলতরঙ্গ অর্থাৎ যা কিছু ছিল সব যুদ্ধের তাণ্ডবে চূর্ণ হয়ে গেল। সেখানে পড়ে রইল শুধু কাঠকয়লা, দোমড়ানো লোহা, পাথরের মূর্তির মাথা। কিন্তু এত ধ্বংসের মধ্যেও মেয়েটি থেকে যায় অপেক্ষায়। এ অপেক্ষা অন্তহীন। কারণ, প্রেম শাশ্বত, তার মৃত্যু নেই, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও তা জেগে থাকে।
নামকরণ
নামকরণের মধ্য দিয়ে কোনো সাহিত্যের ভাববস্তু বা মর্মার্থের পরিচয় পাওয়া যায়। কবিতাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। এখানে পাঠ্য কবিতাটির ‘অসুখী একজন’ নামকরণ তার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনাকেই প্রকাশ করেছে। ‘অসুখী একজন’ কবিতার কথক তাঁর প্রিয়জনকে দরজায় অপেক্ষায় রেখে চলে যান দূরে। প্রিয় মানুষটির ফিরে আসার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং একসময় বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হয়। বিপ্লবী যে পথে তাঁর স্বভূমি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সেই পথে জন্মায় ঘাস। কবির স্মৃতি চিরকালের জন্য বিবর্ণ হয়ে যায়। তারপর আসে ভয়ানক যুদ্ধ। ধ্বংস হয়ে যায় সবকিছু। শুধু মৃত্যু হয় না অপেক্ষারত মেয়েটির। এত বিপর্যয়ের পরও সে কবির প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। যুদ্ধ সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে, কিন্তু স্বজন ও স্বদেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে না। যুদ্ধের আগুনে বাড়িঘর পোড়ে, ছাই হয়ে যায় প্রাসাদ, উদ্যান, সবকিছু। কিন্তু ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জেগে থাকে ভালোবাসা। দীর্ঘ অপেক্ষা তার হৃদয়কে বেদনায় ভারী করে রেখেছে বলে মেয়েটি অসুখী। আর এইজন্যই কবিতার শিরোনাম ‘অসুখী একজন’ সার্থকতা লাভ করেছে।
মনে রেখো
অসুখী একজন কবিতায় ‘যুদ্ধ’ – এর কথা আছে। কিন্তু পাবলো নেরুদার ব্যক্তিগত জীবন ও আদর্শকে মনে রাখলে এ ভাবনা সংগত যে ‘যুদ্ধ’ এখানে নিছক দুটি রাজশক্তির লড়াই নয়। সমাজ পরিবর্তনে আস্থাশীল কবি বিপ্লবের আদর্শে বিশ্বাস করতেন। তাই তাঁর কবিতায় ‘যুদ্ধ’ আর ‘বিপ্লব’ সমার্থক। কবিও ‘বিপ্লবী’ এবং ‘যোদ্ধা’। এভাবেই কবিতার আলোচনা করা হয়েছে।
আজকের আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক বাংলার দ্বিতীয় পাঠের প্রথম অংশ ‘অসুখী একজন’ – এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। যদি কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকে, তাহলে আপনারা আমাকে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন; আমি যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করব। এছাড়া, পোস্টটি আপনার পরিচিতদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাদের এটির প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ!