দশম শ্রেণি – বাংলা – পথের দাবী – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Gopi

আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক বাংলার পঞ্চম পাঠের চতুর্থ অংশ ‘পথের দাবী’ থেকে কিছু বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো পরীক্ষায় প্রায়শই আসতে দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য খুবই উপকারী হবে।

পথের দাবী – বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
পথের দাবী – বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর
Contents Show

পলিটিক্যাল সাসপেক্ট সব্যসাচী মল্লিককে নিমাইবাবুর সম্মুখে হাজির করা হইল – পলিটিক্যাল সাসপেক্ট কথাটির অর্থ কী? এরপরে পুলিশ স্টেশনে কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা পাঠ্যাংশ অনুসরণে আলোচনা করো।

পলিটিক্যাল সাসপেক্ট কথাটির অর্থ – পলিটিক্যাল সাসপেক্ট কথাটির অর্থ রাজনৈতিকভাবে সন্দেহভাজন।

পরিস্থিতির বর্ণনা –

  • পুলিশ স্টেশনে হাজির করা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে পলিটিক্যাল সাসপেক্ট সব্যসাচী মল্লিককে পুলিশ স্টেশনে পুলিশের বড়কর্তার সামনে হাজির করা হয়েছিল।
  • চেহারার বিবরণ – তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তার আয়ু আর বেশিদিন নেই। তার ফরসা রং রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গিয়েছিল। অল্প কাশির পরেই সে হাঁপাতে শুরু করেছিল। পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে সে নিজের নাম গিরীশ মহাপাত্র বলেছিল। সে তেলের খনিতে কাজ করত বলে জানায়। বর্মা থেকে সে রেঙ্গুনে এসেছিল।
  • সাজসরঞ্জাম – তার পকেট থেকে একটি টাকা, লোহার কম্পাস, মাপার জন্য কাঠের ফুটরুল, কয়েকটি বিড়ি, একটি দেশলাই এবং একটি গাঁজার কলকে বার করা হয়।
  • নিমাইবাবুর প্রশ্ন – পুলিশের কর্তা নিমাইবাবু তাকে জিজ্ঞাসা করেন, সে গাঁজা খায় কি না। তার উত্তরে গিরীশ মহাপাত্র বলে, গাঁজার কলকেটা সে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে। কারোর যদি কাজে লাগে, সে দিয়ে দেবে।
  • পরিণতি – গিরীশ মহাপাত্রের কথাবার্তা, তার সাজপোশাক এবং আচার-ব্যবহার দেখে সকলেই নিশ্চিত হয়েছিল যে, এই গিরীশ মহাপাত্র কখনোই সব্যসাচী মল্লিক হতে পারে না। তাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, কিছুক্ষণ তামাশা করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

কাকাবাবু এ লোকটিকে আপনি কোনো কথা জিজ্ঞেস না করেই ছেড়ে দিন, যাকে খুঁজছেন সে যে এ নয়, তার আমি জামিন হতে পারি। – বক্তা কে? তার সম্পর্কে এ কথা কেন বলা হয়েছে?

বক্তা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে উল্লিখিত মন্তব্যের বক্তা অপূর্ব।

এ কথা বলার কারণ –

  • আটক করা ব্যক্তি – রেঙ্গুন পুলিশ স্টেশনে বর্মা অয়েল কোম্পানির তেলের খনির কারখানার কয়েকজন মিস্ত্রিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আটক করেছিল। তাদের মধ্যে বিপ্লবী সব্যসাচী মল্লিক সন্দেহে একটি লোককে রেখে অন্যদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
  • চেহারার বিবরণ – 30-32 বছর বয়সি লোকটি কাশতে কাশতে আসে। লোকটি ছিল ভীষণ রোগা। একটু কাশির পরিশ্রমেই সে হাঁপিয়ে উঠছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, সংসারে তার বেঁচে থাকার সময় বোধহয় আর বেশি নেই। কোনো দুরারোগ্য অসুখ তার শরীরে যেন বাসা বেঁধেছে।
  • বেশভূষা – এ ছাড়াও তার পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল অদ্ভুত ধরনের। গায়ে জাপানি সিল্কের রামধনু রঙের চুড়িদার-পাঞ্জাবি, তার বুক-পকেট থেকে একটা রুমালের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। তার পরনে বিলিতি মিলের কালো মখমল পাড়ের সূক্ষ্ম শাড়ি, পায়ে সবুজ রঙের ফুল মোজা, হাঁটুর ওপরে লাল ফিতা বাঁধা।
  • অপূর্বর মানসিকতা – হয়তো সব্যসাচী বলে সন্দেহ হলেও অপূর্ব মন থেকে চাইছিল যে, ওই লোকটি যেন পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে।
  • শেষের কথা – এই কারণেই অপূর্ব নিমাইবাবুকে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল।

বাবুটির স্বাস্থ্য গেছে, কিন্তু শখ ষোলোআনাই বজায় গছে। — বাবুটি কে? তার সাজসজ্জার পরিচয় দাও।

অথবা, বাবুটির স্বাস্থ্য গেছে, কিন্তু শখ ষোলো আনাই বজায় আছে। – বাবুটি কে? তাঁর স্বাস্থ্য ও শখের পরিচয় দাও।

বাবুটির পরিচয় – এখানে বাবুটি বলতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ রচনাংশের অন্যতম চরিত্র গিরীশ মহাপাত্রের কথা বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য ও শখের পরিচয় – গিরীশ মহাপাত্রের বয়স ৩০-৩২ বছরের বেশি নয়। বিপ্লবী সব্যসাচী মল্লিক সন্দেহে তাকে থানায় ধরে আনা হয়। রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যাওয়া লোকটি কাশতে কাশতে ভিতরে প্রবেশ করে। কাশির দমক দেখে মনে হয়েছিল তার আয়ু আর বেশিদিন নেই। মাথার সামনে বড় বড় চুল থাকলেও ঘাড় ও কানের কাছে চুল প্রায় ছিল না। চুল থেকে বেরোচ্ছিল লেবুর তেলের উগ্র গন্ধ। এর সঙ্গে মানানসই ছিল তার পোশাকও। গায়ে ছিল জাপানি সিল্কের রামধনু রঙের চুড়িদার পাঞ্জাবি। তার বুকপকেট থেকে বাঘ-আঁকা একটি রুমালের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। পরনে ছিল বিলাতি মিলের কালো মখমল পাড়ের সূক্ষ্ম ধুতি। পায়ে সবুজ রঙের ফুলমোজা, যা হাঁটুর ওপরে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা। পায়ে ছিল বার্নিশ করা পাম্পশু, যার তলাটা আগাগোড়া লোহার নাল বাঁধানো। আর হাতে ছিল হরিণের শিঙের হাতল দেওয়া একগাছি বেতের ছড়ি।

মহা হুঁশিয়ার পুলিশের দলকে আজকের মতো নির্বোধ আহম্মক হতে বোধ করি কেউ কখনো দেখেনি। – পুলিশের দলকে নির্বোধ আহম্মক বলা হয়েছে কেন? পুলিশ সম্পর্কে বক্তার এমন উক্তির পিছনে তার কোন্ মানসিকতা সক্রিয় লেখো।

পুলিশের দলকে নির্বোধ আহম্মক বলার কারণ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের একটি অংশে, গিরীশ মহাপাত্র নামে এক ব্যক্তিকে বিপ্লবী সব্যসাচী মল্লিক ভেবে পুলিশ নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি চালায়। শেষপর্যন্ত তার চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং কথাবার্তায় বিভ্রান্ত হয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাংলা দেশের অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার নিমাইবাবুও ব্যর্থ হন সব্যসাচীকে খুঁজে বের করতে। কিন্তু অপূর্ব বুঝেছিল যে গিরীশ মহাপাত্রই আসলে ছদ্মবেশী সব্যসাচী। এই কারণেই সে পুলিশের দলকে ‘নির্বোধ আহম্মক’ বলেছে।

বক্তার মানসিকতা – পুলিশের দল সম্পর্কে অপূর্বর এই মন্তব্যের পেছনে তার সুপ্ত দেশপ্রেম সক্রিয় ছিল। কারণ, সে মনেপ্রাণে চাইছিল সব্যসাচী যেন ধরা না পড়েন। তার মনে এই বিশ্বাসও ছিল যে, সব্যসাচী কোনো সাধারণ বিদ্রোহী নন। তার ছদ্মবেশ এতটাই নিখুঁত ছিল যে, বোঝাই মুশকিল ছিল তিনি কোন দেশের মানুষ। সব্যসাচী দশ-বারোটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। ফলে তাকে ধরা সহজ কাজ ছিল না। অপূর্ব নিজেই বিস্মিত হয়েছিল সব্যসাচীর পোশাক ও চেহারা দেখে। পুলিশকে ‘নির্বোধ আহম্মক’ বলার মাধ্যমে অপূর্ব যেমন পুলিশের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছে, তেমনি পরোক্ষে সব্যসাচীর দক্ষতা ও কৌশলকে নীরবে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।

পৃথিবীর যে – কোনো দেশে, যে – কোনো যুগে যে – কেউ জন্মভূমিকে তার স্বাধীন করবার চেষ্টা করেচে, তাকে আপনার নয় বলবার সাধ্য আর যার থাক, আমার নেই। – এই উক্তির আলোকে বক্তার মনোভাব ব্যক্ত করো।

  • কথামুখ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের অংশে অপূর্বই মন্তব্যটি করেছে। অপূর্ব বাংলার ছেলে।
  • স্বদেশি ভাবধারা – অপূর্ব স্বদেশি ভাবধারায় বিশ্বাস করত। তাই সব্যসাচীর মতো দেশভক্তরা তার কাছে পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। এঁরা শুধু দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। জীবন-মৃত্যু এঁদের কাছে তুচ্ছ। দেশের মুক্তিপথের অগ্রদূত এই বীর নায়কদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের ছিল দমনমূলক মনোভাব। যে – কোনো উপায়ে এঁদের গ্রেপ্তার করাই ছিল ব্রিটিশ পুলিশের লক্ষ্য। সেই উদ্দেশ্যেই পুলিশ অফিসার নিমাইবাবু রেঙ্গুনে এসেছেন। তাঁর শিকার হলেন সব্যসাচী মল্লিক। অপূর্ব নিমাইবাবুকে কাকা বলে ডাকে, কিন্তু নিমাইবাবুর কার্যকলাপকে অপূর্ব সমর্থন করে না।
  • স্বদেশপ্রেম – স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীকে গ্রেপ্তার করা মানেই দেশদ্রোহ করা। অপূর্ব চায় না যে, সব্যসাচী মল্লিক গ্রেপ্তার হোক। এই মনোভাব অপূর্বর দেশপ্রেমকেই তুলে ধরে। নিমাইবাবু তাঁর কর্তব্য পালন করতে এলেও অপূর্বর কাছে কর্তব্যের চেয়ে স্বদেশ বড়ো। পরের দাসত্ব করে আপন জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জনে বাধাদানকে অপূর্ব সমর্থন করতে পারে না। তাই যত বিপদই আসুক, অপূর্ব সব্যসাচীকে একান্ত নিজের বলে স্বীকার করতে পিছপা হয় না।
  • শেষের কথা – আলোচ্য উক্তির মধ্য দিয়ে অপূর্বর এই স্বদেশপ্রেমই বড়ো হয়ে উঠেছে।

তিনি ঢের বেশি আমার আপনার – অপূর্ব কেন এ কথা বলেছিল?

  • প্রেক্ষাপট – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবী উপন্যাসটি মূলত স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিল।
  • দেশপ্রাণ – পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য, ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য অনেকেই লড়াই করছিলেন, সব্যসাচী তাঁদেরই একজন। দেশের জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন। পথের দাবী পাঠ্যাংশে দেখা যায় সব্যসাচী গিরীশ মহাপাত্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
  • স্বদেশি ভাবধারায় বিশ্বাস – সব্যসাচী এমন ছদ্মবেশ ধারণ করতেন যাতে পুলিশ তাঁকে ধরতে না পারে। স্বদেশি ভাবধারায় বিশ্বাসী অপূর্ব সব্যসাচীকে মনেপ্রাণে সমর্থন করত। অপূর্ব জানত যে সব্যসাচী দেশকে ভালোবাসেন, আর সেই দেশকে স্বাধীন করার জন্যই তিনি লড়াই করছেন।
  • সব্যসাচীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা – পুলিশরা সব্যসাচীকে ধরার জন্য অনেক চেষ্টা করছিল। দেশের টাকায় দেশের লোক দিয়েই শিকারের মতো তারা সব্যসাচীকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। আবার, পুলিশকর্তা নিমাইবাবু ছিলেন অপূর্বর আত্মীয়; অপূর্ব তাঁকে কাকা বলে ডাকত। অপূর্ব এই কারণে নিজেও যথেষ্ট লজ্জিত ছিল। তাই সে বলেছে, দেশকে তথা দেশবাসীকে এই লজ্জা, অপমান, লাঞ্ছনা থেকে যে মুক্তি দিতে চায়, সেই সব্যসাচী অপূর্বর কাছে আত্মীয় পুলিশকর্তার থেকেও অনেক বেশি আপনার এবং নিকটজন

আমি ভীরু, কিন্তু তাই বলে অবিচারে দণ্ডভোগ করার অপমান আমাকে কম বাজে না, রামদাস। – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

প্রসঙ্গ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ রচনাংশ থেকে উদ্ধৃতিটি গৃহীত। বাংলা দেশের ছেলে অপূর্ব রেঙ্গুনে থাকার সময় ফিরিঙ্গি ও অন্যদের দ্বারা অত্যাচারিত ও অপমানিত হয়েছিল। সেই লাঞ্ছনার কথা বলতে গিয়েই আলোচ্য উক্তিটি করা হয়েছে।

তাৎপর্য বিশ্লেষণ – সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের বাঙালি সন্তান অপূর্ব চাকরির সূত্রে রেঙ্গুনে এসেছিল। কিন্তু রেল স্টেশনে একদিন বিনা দোষে কিছু ফিরিঙ্গি ছেলে তাকে লাথি মেরে প্ল্যাটফর্ম থেকে বের করে দেয়। স্টেশনে থাকা কোনো ভারতীয়ই এই ঘটনার প্রতিবাদ করেনি; বরং অপূর্বর হাড়-পাঁজর খুব একটা ভাঙেনি জেনে তারা খুশি হয়েছে। এর প্রতিবাদ জানাতে গেলে স্টেশনমাস্টার তাকে ভারতীয় বলে কুকুরের মতো বের করে দিয়েছিল। বিনা দোষে এই অত্যাচার সহ্য করায় তার বুকের মধ্যে এক অদৃশ্য কষ্ট গুমরে ওঠে। তাই রামদাসের কাছে সে বলেছে, তার লাঞ্ছনা এই কালো চামড়ার নীচে কম জ্বলে না, রামদাস। অপূর্ব শিক্ষিত, সভ্য, বিচক্ষণ যুবক। শাসকের এই অকারণ অত্যাচারকে সে কখনোই মেনে নিতে পারে না। ইংরেজদের এই নিষ্ঠুর আচরণ সমস্ত দেশবাসীকেই সহ্য করতে হচ্ছে বুঝে অপূর্ব যন্ত্রণা অনুভব করেছে। আলোচ্য উক্তিটি তার সেই বেদনাকেই প্রকাশ করছে।

বাস্তবিক, এমন তৎপর, এতবড়ো কার্যকুশলা মেয়ে আর যে কেহ আছে মনে হয় না, হে তলওয়ারকর! তা-ছাড়া এত বড়ো বন্ধু! – মেয়েটির সম্পর্কে অপূর্বর এই মন্তব্যের কারণ বিশ্লেষণ করো।

  • কথামুখ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ গল্পাংশে অপূর্ব এই মন্তব্যটি করেছে। অপূর্বর বাড়ির ওপরের তলায় যে খ্রিস্টান মেয়েটি থাকত, তার সম্পর্কে এই কথাটি বলা হয়েছে।
  • দায়িত্ববোধ – অপূর্বর অনুপস্থিতিতে তার ঘরে একদিন চুরি হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টান মেয়েটির জন্যই টাকাকড়ি ছাড়া বাকি সমস্ত কিছু চুরি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। খ্রিস্টান মেয়েটি নিজেই চোরকে তাড়িয়ে অপূর্বর ঘর তালাবদ্ধ করে দেয়। অপূর্বর না-ফেরা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। অপূর্বর ফেরার পর সে নিজেই চাবি দিয়ে সেই ঘর খুলে যা কিছু ছড়ানো জিনিসপত্র ছিল, সেগুলো সব নিজের হাতে গুছিয়ে দেয়। যা চুরি গেছে আর যা যা চুরি যায়নি, তার একটি নিখুঁত হিসাব সে বানিয়েছিল। সেই হিসাব দেখে অপূর্বর মনে হয়েছিল, একজন পাস করা অ্যাকাউন্ট্যান্টের পক্ষেও এমনটা করা সম্ভব নয়।
  • প্রকৃত বন্ধুভাবাপন্ন – অন্যের জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে কীভাবে সাহায্য করা যায়, তা এই মেয়েটিকে না দেখলে অপূর্বর বুঝতে পারত না। সবকিছু দেখে অপূর্বর তাকে একজন প্রকৃত বন্ধু বলেই মনে হয়েছিল।
  • বুদ্ধিমত্তা – মেয়েটির প্রখর বুদ্ধি আর সবদিকে অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে অপূর্ব আশ্চর্য হয়ে আলোচ্য মন্তব্যটি করেছিল।

আমার মা, আমার ভাই-বোনকে যারা এই-সব সহস্র কোটি অত্যাচার থেকে উদ্ধার করতে চায় তাদের আপনার বলে ডাকবার যে দুঃখই থাক আমি আজ থেকে মাথায় তুলে নিলাম। – কে, কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন? এর মধ্যে বক্তার কোন্ মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে?

উৎস ও প্রসঙ্গ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃত এই উক্তিটি অপূর্ব করেছিল। ফিরিঙ্গিদের হাতে অপূর্ব কীভাবে একদিন অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছিল সেই যন্ত্রণার কথা বর্মা অফিসের সহকর্মী রামদাস তলওয়ারকরের কাছে বলতে গিয়ে সে এই উদ্ধৃত বাক্যগুলি বলেছিল।

বক্তার মানসিকতা – অপূর্বকে বিনা দোষেই ফিরিঙ্গি যুবকেরা লাথি মেরে প্ল্যাটফর্ম থেকে বের করে দিয়েছিল। অপূর্ব এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে সাহেব স্টেশনমাস্টার তাকে কেবল ‘দেশি লোক’ এই অজুহাতে কুকুরের মতো দূর করে দিয়েছিল। এই অপমান পরাধীন দেশে প্রতিদিনই ঘটছে। অপূর্ব এই ঘটনায় খুব কষ্ট পায়; তার খুব রাগও হয়। সেই সঙ্গে সে স্থির সিদ্ধান্ত নেয় যে, দেশের মা-ভাই-বোনদের যারা সমস্ত অত্যাচার থেকে উদ্ধার করতে চায়, তারাই তার সত্যিকারের আপনজন। আর সেই মানুষগুলোকে কাছের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার সমস্ত দুঃখই সে মাথা পেতে নিতে চায়।

এই কথায় অপূর্বর দেশপ্রেমিক সত্তাটি যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনই সাহস এবং সহমর্মিতার প্রকাশ ঘটেছে। সে কেবল নিজের সুখের জন্য ব্যস্ত নয়। বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার এক প্রবল ইচ্ছা ধরা পড়েছে তার কথায়। পাশাপাশি, এক অনিশ্চিত জীবনকে গ্রহণ করার কঠিন প্রতিজ্ঞাও অপূর্বর কথায় ফুটে উঠেছে।

আমাদের তিনি আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষী, কিন্তু তাই বলে আমার দেশের চেয়ে তো তিনি আপনার নন। – কে, কার সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছে? এই উক্তির আলোকে বক্তার মনোভাবটি ব্যক্ত করো।

বক্তা ও উদ্দেশ্য ব্যক্তি – অপূর্ব, নিমাইবাবু সম্পর্কে এই মন্তব্যটি করেছে।

বক্তার মনোভাব – নিমাইবাবুর সঙ্গে অপূর্ব যখন পুলিশ স্টেশনে যায়, তখন তার দেখা হয় রাজনৈতিক সন্দেহভাজন সব্যসাচী মল্লিক ওরফে গিরীশ মহাপাত্রের সঙ্গে। পুলিশ গিরীশ মহাপাত্র এবং তার সাথে থাকা জিনিসপত্র তদন্ত করতে গেলে একটি হাস্যকর ঘটনার সৃষ্টি হয়। এই সময়ে তলওয়ারকরের সঙ্গে কথোপকথনে অপূর্বর মনোভাবের কয়েকটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে –

  • দেশপ্রেমিক – অপূর্ব সাধারণ চাকরিজীবী হলেও, সে চায় দেশ বিদেশি শাসনমুক্ত হোক। সে আন্তরিকভাবে আশা করে যে সব্যসাচী মল্লিক যেন পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে। যদিও নিমাইবাবু অপূর্বর বাবার বন্ধু এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, সব্যসাচী মল্লিক একজন মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক, যাকে অপূর্ব তার আত্মার কাছের মনে করে। তাই নিমাইবাবুর চেয়ে সব্যসাচী মল্লিকই অপূর্বর কাছে বেশি আপন।
  • স্পষ্টভাষী – অপূর্ব তার সহকর্মী রামদাসের কাছে তার আত্মীয় সম্পর্কে যে মতামত প্রকাশ করেছে, তা প্রমাণ করে যে সে স্পষ্টভাষী। সে যা বিশ্বাস করে, তা সরাসরি বলার সাহস রাখে।
  • আবেগপ্রবণ – অপূর্ব আবেগপ্রবণ ব্যক্তি। যখন রামদাস তাকে নিমাইবাবুর কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তের ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা দেয়, তখন অপূর্ব আবেগের বশে জোর দিয়ে প্রশ্নে উল্লেখিত কথাগুলো বলে।

ভামো নগরের উদ্দেশে যাত্রাকালে অপূর্বর কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বর্ণনা করো।

  • শুরুর কথা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ গল্পাংশে অপূর্ব রেঙ্গুন থেকে ভামো নগরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল।
  • নিয়মমাফিক কাজ – অপূর্ব প্রথম শ্রেণির যাত্রী ছিল। সন্ধ্যা হলে সে প্রতিদিনের মতো নিয়মমাফিক যা করে, সেই সবই করেছিল।
  • ভ্রান্ত ধারণা – রাতের খাবারের পর অপূর্ব যখন শুতে যায়, তখন সে ভেবেছিল প্রথম শ্রেণির যাত্রী হওয়ায় নিশ্চিন্ত মনে বাকি পথটা পাড়ি দিতে পারবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে বুঝতে পারে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
  • অপূর্বর বিরক্তি – সেই রাতে পুলিশের লোক এসে বার তিনেক তার ঘুম ভাঙিয়ে নাম, ঠিকানা লিখে নেয়। এতে অপূর্বর বিরক্তি চরমে পৌঁছে।
  • সাব-ইনস্পেকটরের সঙ্গে বচসা – অপূর্ব এই ঘটনার প্রতিবাদ করলে বর্মার সাব-ইনস্পেকটর কটুকণ্ঠে তাকে জানায় যে, সে ইউরোপীয় নয়, তাই এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। অপূর্ব তাকে জানায়, সে প্রথম শ্রেণির যাত্রী, তাই তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো অন্যায়। সাব-ইনস্পেকটর হাসতে হাসতে জবাব দেয়, এইসব নিয়ম শুধু রেলওয়ে কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য। পুলিশ ইচ্ছে করলে তাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে পারে, এবং তার কোনো প্রতিবাদ করার অধিকার নেই।
  • ইতিকথা – এভাবে অপূর্বর অভিজ্ঞতায় পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজদের হাতে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার আরেকটি ঘটনা যুক্ত হয়।

কিন্তু ইহা যে কত বড়ো ভ্রম তা কয়েকটা স্টেশন পরেই সে অনুভব করিল। – সে কে? উদ্ধৃত অংশটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

সে – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের উল্লিখিত অংশে ‘সে’ বলতে অপূর্বর কথা বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গ – অফিসের গোলমাল থামানোর জন্য বড় সাহেব অপূর্বকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রেঙ্গুন থেকে ভামোর অফিসে যাওয়ার জন্য। এই ট্রেন যাত্রায় অপূর্বর যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা তার কল্পনায় ছিল না। সেখানে সে যে বিরক্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তা উল্লেখ করতে গিয়েই এই মন্তব্যটি করেছে।

তাৎপর্য বিশ্লেষণ – অপূর্ব ছিল ট্রেনের প্রথম শ্রেণির যাত্রী। তার কামরায় অন্য কোনো লোক ছিল না। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হলে অপূর্ব ঈশ্বর উপাসনা শেষ করে। তারপর সে রাতের খাবার খেয়ে হাত-মুখ ধুয়ে শান্ত মনে শয্যা গ্রহণ করে। অপূর্ব আশা করেছিল যে, প্রথম শ্রেণির যাত্রী হওয়ায় সকাল পর্যন্ত কেউ তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে না। কিন্তু পুলিশের লোকেরা রাতে তিনবার ঘুম ভেঙে তার নাম-ঠিকানা লিখে নেয়। এইভাবে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোয় অপূর্ব প্রতিবাদ করে। তখন সাব-ইনস্পেকটরের কাছে শুনতে হয়, যখন অপূর্ব নিজেকে প্রথম শ্রেণির যাত্রী বলে দাবি করে এবং তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না বলে মন্তব্য করে, তখন পুলিশ অফিসারটি তাকে বলে যে ইচ্ছা করলে তাকে ট্রেন থেকে নামিয়েও দিতে পারে। ভারতীয়দের প্রতি এই অবমাননা অপূর্বর অভিজ্ঞতায় আরেকটি যোগ হয়।

পথের দাবী রচনাংশ অবলম্বনে অপূর্বর চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

  • কথামুখ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে অপূর্বর অনুভূতিই হয়ে উঠেছে কাহিনির মূল বিষয়। তার চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, তা হলো:
  • দেশপ্রেম – অপূর্ব বাংলার ছেলে এবং সে স্বদেশী ভাবধারায় বিশ্বাসী। নিমাইবাবুর মুখে সব্যসাচীর বর্ণনা শুনে অপূর্বর মনে এই মহান দেশপ্রেমিক সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও ভক্তি জেগে ওঠে। তবে সে রাগান্বিত হয় নিমাইবাবুর ওপর, কারণ বাঙালি হয়েও তিনি নিজের দেশের এত বড় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করতে উদ্যোগী। সব্যসাচী সন্দেহে আটক গিরীশ মহাপাত্রই যে আসলে সব্যসাচী, তা অনুমান করতে অপূর্বর বেশি সময় লাগেনি। তাই সে নিমাইবাবুকে বলেছে, “এ লোকটিকে কোনো কথা জিজ্ঞেস না করেই ছেড়ে দিন, যাকে খুঁজছেন সে যে এ নয়, তার আমি জামিন হতে পারি।” পুলিশের কাছে এরকম বক্তব্য অপূর্বর চরিত্রের দৃঢ়তা এবং দেশপ্রেমকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
  • সাহসী ও প্রতিবাদী স্বভাব – শান্তশিষ্ট হলেও অপূর্ব প্রতিবাদী। সে রামদাসের কাছে পুলিশের সমালোচনা করেছে, যা তাকে রাজদ্রোহিতার অপরাধে শাস্তির মুখে ফেলতে পারে। তবুও বর্মা সাব-ইনস্পেক্টরের অনুচিত আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি।
  • ইতিকথা – সবদিক দিয়ে বিচার করে বলা যায়, ‘Doing and Suffering’ – এর ভিত্তিতে অপূর্ব এই কাহিনির মুখ্য চরিত্র হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছে।

পথের দাবী রচনাংশ অবলম্বনে নিমাইবাবুর চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

  • কথামুখ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে সব্যসাচীকে কেন্দ্র করে কাহিনি বিস্তার লাভ করলেও, নিমাইবাবুর চরিত্র সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • পেশাগত দায়বদ্ধতা – নিমাইবাবু পেশায় পুলিশ অফিসার। তিনি একজন বাঙালি এবং একইসঙ্গে ভারতীয়, কিন্তু পেশাগত দায়িত্বের খাতিরে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের নায়ক সব্যসাচী মল্লিককে ধরার জন্য তিনি সুদূর রেঙ্গুনে এসে পৌঁছেছেন। কোনো ব্যক্তিগত মোহ বা আবেগই তাঁকে তাঁর কর্তব্য থেকে বিরত করতে পারেনি।
  • মানবিকতা – নিমাইবাবু পুলিশের বড়ো পদে থাকা সত্ত্বেও একজন কঠোর বা নিষ্ঠুর ব্যক্তি নন। সব্যসাচী মল্লিকের সন্দেহে ধৃত গিরীশ মহাপাত্রকে নিয়ে তিনি যে রসিকতা করেছেন, তা নিছক হাস্যরস নয়; এর মধ্য দিয়ে তাঁর চরিত্রের মানবিক দিকটিও প্রকাশিত হয়েছে। গিরীশ মহাপাত্রের স্বাস্থ্য খারাপ দেখে তিনি তাঁকে গাঁজা না খেতে অনুরোধ করেন – “ক’দিনই বা বাঁচবে, এই তো তোমার দেহ, আর খেয়ো না, বুড়ো মানুষটার কথা শোনো।” নিমাইবাবুর এই ভদ্র, শান্ত এবং অল্পভাষী স্বভাব তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় করে তুলেছে। তাঁর এই সমস্ত গুণাবলিই কাহিনিতে তাঁকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় উন্নীত করেছে।
  • ইতিকথা – অপূর্ব তাঁর নিকটাত্মীয় এই মানুষটিকে সরাসরি শ্রদ্ধা না করলেও, নিমাইবাবু তাঁর নিজস্ব চরিত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে আছেন।

স্বল্প পরিসরে হলেও পথের দাবী রচনাংশে রামদাস তলওয়ারকর চরিত্রটি কীভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে লেখো।

  • কথামুখ – রামদাসের চরিত্রটি ‘পথের দাবী’ রচনাংশে অতি অল্প পরিসর জুড়ে থাকলেও, চরিত্রবৈশিষ্ট্যে সে উল্লেখযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
  • বিচক্ষণতা ও বন্ধুপ্রীতি – রামদাস তলওয়ারকর একজন শিক্ষিত মারাঠি যুবক। অপূর্বর অন্যমনস্কতা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সে ভেবেছিল, বাড়ি থেকে কোনো দুঃসংবাদের চিঠি পেয়েছে সে। পরে অবশ্য তার ভুল ভেঙে যায়। সে বুঝতে পারে সব্যসাচীর প্রতি অগাধ ভক্তিই অপূর্বকে অন্যমনস্ক করে তুলেছে। তবে সেই ভক্তির প্রত্যক্ষ প্রকাশ বিপদ ডেকে আনতে পারে, ভেবে সে অপূর্বকে সাবধান করে দিয়েছিল।
  • সহমর্মিতা – গল্পে রামদাস ছিল অপূর্বর সহমর্মী। ফিরিঙ্গি ছেলেদের অত্যাচার, স্টেশনমাস্টারের অমানবিক আচরণের কথা যখন অপূর্ব বলছিল, তখন সমবেদনায় রামদাসের ফরসা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। তারও দু-চোখ ছলছল করে উঠেছিল।
  • স্বদেশিকতা – গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে, অপূর্ব যখন গিরীশ মহাপাত্ররূপী সব্যসাচীর পিছনে পুলিশের ঘুরে বেড়ানোর কথা বলে, তখন রামদাসকে শঙ্কিত হয়ে উঠতে দেখা যায়। লেখকের বর্ণনায় সেই ছবি ধরা পড়েছে এইভাবে – এই মুহূর্তকালের মধ্যে রামদাসের প্রশস্ত উজ্জ্বল ললাটের উপরে যেন কোনো এক অদৃশ্য মেঘের ছায়া এসে পড়েছে, এবং সেই সুদূর দুর্নিরীক্ষ্য লোকেই তার সমস্ত মনশ্চক্ষু একেবারে উধাও হয়ে গেছে।
  • ইতিকথা – ‘পথের দাবী’ রচনাংশে খুব স্বল্প পরিসরেও মার্জিত, মানবিক চরিত্রের আলোয় রামদাস ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

তোমাদের পাঠ্যাংশ পথের দাবী – তে গিরীশ মহাপাত্র যদি সত্যিই সব্যসাচী হন, তবে তাঁর সম্পর্কে তোমার মনোভাব ব্যক্ত করো।

  • প্রাককথন – ‘পথের দাবী’ রচনায় উল্লিখিত গিরীশ মহাপাত্রই সব্যসাচী কি না, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সমগ্র উপন্যাসের কাহিনি অনুযায়ী গিরীশ মহাপাত্রই সব্যসাচী। তবে আলোচ্য আংশিক কাহিনিতে বোঝার কোনো উপায় নেই যে উক্ত ব্যক্তিই সব্যসাচী। এমনকি, অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার নিমাইবাবু বা জগদীশবাবুও তা বুঝতে পারেননি। গিরীশ মহাপাত্রকে ‘পলিটিক্যাল সাসপেক্ট’ সব্যসাচী মল্লিক হিসেবে আটক করা হলেও, তিনি বুদ্ধিবলে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পেরেছিলেন। অবশ্য অপূর্ব তার দূরদৃষ্টির সাহায্যে বুঝেছিল যে গিরীশ মহাপাত্রই সব্যসাচী। ইংরেজ পুলিশ তাকে ধরতে না পারায় অপূর্ব উল্লসিত হয়েছিল।
  • গিরীশ মহাপাত্ররূপী সব্যসাচী – গিরীশ মহাপাত্রের বেশভূষা নিমাইবাবুসহ সমগ্র পুলিশ দলকে বিভ্রান্ত করেছিল। সদা সতর্ক ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার এমন কৌশল ছদ্মবেশ ধারণ তাঁর দক্ষতারই পরিচয় দেয়। সেই কারণেই তিনি মাথার চুল অদ্ভুতভাবে ছেঁটেছিলেন। কালচার বা আচার-ব্যবহার পরিবর্তন করলে পুলিশ তাঁকে চিনতে পারবে না — এই ধারণা থেকেই সব্যসাচী তাঁর সমগ্র কালচারটাই পাল্টে ফেলেছিলেন। তাঁর রোগা, জীর্ণ শরীর তাঁকে সাহায্য করেছে। স্বদেশের মুক্তির জন্য দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর কারণে শরীরের দিকে নজর দেওয়ার কোনো অবকাশ তাঁর ছিল না। তবে অমর প্রাণশক্তির কারণে সব্যসাচীকে মৃত্যু অথবা ইংরেজ পুলিশের স্পর্শ করতে পারে না।

পথের দাবী রচনাংশটির নামকরণ কতদূর সার্থক হয়েছে বিচার করো।

নামকরণের মাধ্যমেই যে কোনো সাহিত্যের অন্তর্নিহিত বিষয় বা ভাব তার পাঠকের কাছে ফুটে ওঠে। সাহিত্যকর্মের নামকরণ সাধারণত বিষয়বস্তু, চরিত্র বা ভাব অনুযায়ী হয়, আবার কখনও-বা তা ব্যঞ্জনাধর্মীও হয়ে থাকে।

এখানে শরৎচন্দ্রের লেখা “পথের দাবী” উপন্যাসের একটি নির্বাচিত অংশ আমাদের পাঠ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। পাঠ্যাংশে আমরা গিরীশ মহাপাত্র চরিত্রটি পাই, যিনি আসলে একজন বিপ্লবী এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন। তার আসল নাম সব্যসাচী মল্লিক, যিনি বিভিন্ন ছদ্মবেশে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে চলাফেরা করেন। দেশকে স্বাধীন করাই সব্যসাচীর জীবনের মূল লক্ষ্য। মূল উপন্যাসে সব্যসাচী মল্লিকের একটি সংগঠন ছিল, যার নাম ছিল “পথের দাবী”। এই সংগঠনে সব্যসাচী ছাড়াও আরও কয়েকজন সদস্য ছিলেন, যারা একত্রিত হয়ে দেশকে কীভাবে স্বাধীন করা যায় এবং এই স্বাধীনতা লাভের জন্য কোন পথে আন্দোলন করা যায়, সেইসব বিষয়ে আলোচনা করতেন। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্যই ছিল দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করা এবং স্বাধীনতার জন্য একজোট হয়ে আন্দোলন করা। এই সংগঠনের কার্যকলাপকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসটি এগিয়েছে। আর এই সংগঠনের মূল কাণ্ডারি ছিলেন সব্যসাচী মল্লিক। সংগঠনটির নাম অনুযায়ী মূল উপন্যাসের নামকরণ করা হয়েছে, এবং আমাদের পাঠ্যাংশটি মূল উপন্যাসেরই একটি নির্বাচিত অংশ। মূল উপন্যাসটিতেও স্বাধীনতা এবং বিদেশি শাসকের অত্যাচার থেকে মুক্তির দাবি প্রাধান্য পেয়েছে। তাই মূল উপন্যাসের নাম অনুযায়ী আমাদের পাঠ্যাংশের এই নির্বাচিত অংশটির নামও “পথের দাবী” রাখা হয়েছে। সেদিক থেকে “পথের দাবী” নামকরণটি সার্থক ও যথাযথ হয়েছে বলা যায়।

পথের দাবী রচনাংশে অপূর্বর স্বদেশপ্রেমের যে পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়েছে, তা নিজের ভাষায় লেখো।

অথবা, আমার মা, আমার ভাই-বোনকে যারা এই – সব সহস্র কোটি অত্যাচার থেকে উদ্ধার করতে চায় তাদের আপনার বলে ডাকবার যে দুঃখই থাক আমি আজ থেকে মাথায় তুলে নিলাম। – এই উক্তির আলোকে বক্তার দেশপ্রেমের পরিচয় দাও।

  • শুরুর কথা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ রচনাংশে অপূর্বর হৃদয়ে স্বদেশ ও স্বজনের প্রতি অনুরাগ থেকেই বোঝা যায় তার স্বদেশপ্রেম কতখানি অকৃত্রিম।
  • স্বদেশ ও স্বজনের প্রতি অনুরাগ – নিজের বাড়িতে চুরির সংবাদ জানাতে থানায় এসে অপূর্ব দেখেছিল সব্যসাচী সন্দেহে ধৃত গিরীশ মহাপাত্রের খানাতল্লাশির ঘটনা। ‘সব্যসাচী’ নামটি শুনেই অপূর্বর মন বিচলিত হয়েছিল। গিরীশ মহাপাত্রকে সব্যসাচী ভেবেই সে মনে মনে প্রার্থনা করেছিল, পুলিশ যেন ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার না করে। তাই তাকে বলতে শুনি – “কাকাবাবু, এ লোকটিকে আপনি কোনো কথা জিজ্ঞেস না করেই ছেড়ে দিন, যাকে খুঁজছেন সে যে এ নয়, তার আমি জামিন হতে পারি।” আবার, নিমাইবাবুর কার্যকলাপকেও সে সমর্থন করেনি। “আমার বড়ো লজ্জা এই যে, এদের যিনি কর্তা, তিনি আমার আত্মীয়, আমার পিতার বন্ধু।”
  • দেশপ্রেম – অপূর্বর দেশপ্রেমের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় রামদাসের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যে। সব্যসাচী সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা-ভক্তি চেপে রাখতে না পেরে সে বলেছিল – “যাঁকে তিনি দেশের টাকায়, দেশের লোক দিয়ে শিকারের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছেন, তিনি ঢের বেশি আমার আপনার।”
  • আবেগপ্রবণতা – কোনো কোনো সময় অপূর্ব খুব আবেগময় হয়ে পড়েছে। রাজরোষে পড়তে হবে জেনেও সে মনের ক্ষোভ ও বেদনাকে চেপে রাখতে পারেনি।

বিদেশি সাহেবের কাছে অপূর্বর অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার যে দুটি ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, তা লেখো।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে দুটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে ইংরেজরা অপূর্বকে অপমান করেছে।

  • প্রথম ঘটনা – একবার অপূর্বর বিনা দোষে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল। স্টেশনে কিছু ফিরিঙ্গি ছেলে কোনো কারণ ছাড়াই তাকে লাথি মেরে প্ল্যাটফর্ম থেকে বার করে দেয়। অপূর্ব যখন সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যায়, তখন সাহেব স্টেশনমাস্টার তাকে ভারতীয় বলে অপমান করে এবং কুকুরের মতো দূর করে দেয়। নিজের দেশে এভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার যন্ত্রণা অপূর্ব কোনোদিন ভুলতে পারেনি।
  • দ্বিতীয় ঘটনা – আরেকবার রেলপথে অপূর্ব রেঙ্গুন থেকে ভামো নগরের উদ্দেশে প্রথম শ্রেণির যাত্রী হিসেবে যাত্রা করছিল। সারাদিনের কাজকর্ম শেষ করে অপূর্ব ভেবেছিল, সে শান্তিতে ঘুমাবে। কিন্তু বারবার পুলিশের লোক এসে তার ঘুম ভেঙে নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে যায়। একবার বিরক্ত হয়ে সে প্রতিবাদ করলে সাব-ইনস্পেকটর কটুকণ্ঠে বলে যে, এসব তাকে সহ্য করতে হবে কারণ সে ইউরোপীয় নয়। অপূর্ব যখন বলে সে প্রথম শ্রেণির যাত্রী, তার সঙ্গে এইরকম আচরণ করা অনুচিত, তখন ইনস্পেকটর উত্তর দেয়, এই নিয়ম রেলের কর্মচারীদের জন্য, তার জন্য নয়। শুধুমাত্র ভারতীয় বলেই তাকে এইভাবে অপমানিত হতে হয়েছিল।

আজকের আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক বাংলা পাঠ্যবইয়ের পঞ্চম পাঠের চতুর্থ অংশ ‘পথের দাবী’ থেকে বিশ্লেষণধর্মী এবং রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ ধরনের প্রশ্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রায়ই আসতে দেখা যাই। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় টেলিগ্রামে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। এছাড়া, পোস্টটি আপনার প্রিয়জনদের সঙ্গে শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।

Please Share This Article

Related Posts

মাধ্যমিক ইতিহাস - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিষয়সংক্ষেপ

About The Author

Gopi

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিষয়সংক্ষেপ

তেভাগা আন্দোলন কাকে বলে এবং এর মূল দাবি কী ছিল? তেভাগা আন্দোলনের নাম ‘তেভাগা’ কেন হয়েছিল?

‘একা’ আন্দোলন শুরু হয় কেন? ‘একা’ আন্দালনে আন্দোলনকারীদের শপথ কী ছিল?