আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ, মাধ্যমিক ভূগোল, ভারতের জলবায়ু এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।
ভারতের জলবায়ুকে মৌসুমি জলবায়ু বলে কেন?
অথবা, ভারতকে মৌসুমী জলবায়ুর দেশ বলা হয় কেন?
- “মৌসুমি” শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ “মৌসিম” থেকে, যার অর্থ ঋতু। ঋতু অনুসারে প্রবাহিত বায়ুকে মৌসুমি বায়ু বলা হয়।
- ভারতের জলবায়ুতে গ্রীষ্মকালে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এবং শীতকালে শীতল ও শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে দুটি প্রধান ঋতুর সৃষ্টি হয়: আর্দ্র গ্রীষ্মকাল এবং শুষ্ক শীতকাল।
- এই দুটি মৌসুমি বায়ুর চক্রাকারে পরিবর্তনের ফলে ভারতের জলবায়ুতে ঋতুচক্র সৃষ্টি হয়, যেমন:
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন-পূর্ব সময়কাল বা গ্রীষ্মকাল,
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল বা বর্ষাকাল,
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাগমনকাল বা শরৎকাল, এবং
- উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল বা শীতকাল।
এই কারণেই ভারতের জলবায়ুতে মৌসুমি জলবায়ুর প্রধান প্রভাব থাকায় ভারতকে ‘মৌসুমি জলবায়ুর দেশ’ বলা হয়। ভারতের মোট বৃষ্টিপাতের 67 থেকে 72 শতাংশই মৌসুমি বায়ুর ফলেই ঘটে।
ভারতের জলবায়ুকে কী কী ঋতুতে ভাগ করা যায়?
মৌসুমি বায়ুর আগমন এবং প্রত্যাগমন, সারাবছরের বৃষ্টিপাত, উষ্ণতা, এবং বায়ুর চাপ ইত্যাদি লক্ষ্য করে ভারত সরকারের আবহাওয়া বিভাগ ভারতের জলবায়ুকে চারটি ঋতুতে ভাগ করেছে। এগুলি হল:
ঋতুর নাম | মাসের নাম |
---|---|
শীতকাল বা উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল | ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি |
গ্রীষ্মকাল বা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন-পূর্ব সময়কাল | মার্চ থেকে মে |
বর্ষাকাল বা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল বা আর্দ্র গ্রীষ্মকাল | জুন থেকে সেপ্টেম্বর |
শরৎকাল বা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাগমনকাল | অক্টোবর থেকে নভেম্বর |
শীতকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৃষ্টিপাত হয় কেন?
- শীতকালে ভারতের ওপর দিয়ে শীতল শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় বলে প্রায় সমগ্র দেশেই শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে, অর্থাৎ বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না।
- তবে শীতকালে মাঝে মাঝে সুদূর ভূমধ্যসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণবাত মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে পৌঁছায় এবং অদূরবর্তী আরব সাগর থেকে জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে নতুন করে শক্তিশালী হয় ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত ঘটায়।
- পশ্চিমদিক থেকে আসা এই ঘূর্ণবাতগুলি শীতের শান্ত আবহাওয়াকে নষ্ট করে বলে একে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা বা ওয়েস্টার্ন ডিস্টার্বেন্স বলা হয়। এর প্রভাবে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে বৃষ্টির পরিমাণও ক্রমশ কমে যায়।
ভারতে প্রায়ই খরা ও বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় কেন?
মৌসুমি বায়ুর কারণেই মূলত খরা বা বন্যা দেখা যায়।
খরার কারণ:
- স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হলে,
- স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দেরিতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে প্রবেশ করলে,
- স্বাভাবিক সময়ের আগে মৌসুমি বায়ু প্রত্যাবর্তন করলে,
- বর্ষাকালে দীর্ঘ সময় বৃষ্টিহীন অবস্থার সৃষ্টি হলে,
- এল নিনো প্রভাবের কারণেও ভারতে খরার পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
বন্যার কারণ:
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অতিবর্ষণের কারণে,
- প্রত্যাবর্তনের স্বাভাবিক সময়ের পরেও দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে থেকে গেলে,
- নির্ধারিত সময়ের আগে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে প্রবেশ করলে,
- দীর্ঘ সময় ধরে একটানা প্রবল বৃষ্টিপাত হলে,
- বর্ষাকালে জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়ার কারণেও বন্যা দেখা দিতে পারে।
করমণ্ডল উপকূল তথা তামিলনাডুতে বছরে দুবার বৃষ্টিপাত হয় কেন?
অথবা, করমণ্ডল উপকূলে শীতকালে বৃষ্টিপাতের কারণ কী?
করমণ্ডল উপকূল তথা তামিলনাডুর বিস্তীর্ণ অংশে বছরে দু-বার বৃষ্টিপাত হয়।
- প্রথমবার, জুন-সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সারাদেশের সঙ্গে এবং
- দ্বিতীয়বার, প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে তামিলনাডুর উপকূলে বৃষ্টিপাত হয়।
কারণ, প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ু যখন বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে ফিরে আসে, তখন তা প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প শোষণ করে এবং করমণ্ডল উপকূলে বৃষ্টিপাত ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ, তামিলনাডুর থাঞ্জাভুর ও সংলগ্ন জেলায় জুন-সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় 35 সেমি বৃষ্টিপাত হয়, কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বরে প্রায় 67 সেমি বৃষ্টিপাত হয়।
ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাত হয় কেন?
ভারতে প্রধানত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের কারণে বৃষ্টিপাত হয়। তবে, এই বৃষ্টিপাত দেশের সর্বত্র সমানভাবে বণ্টিত নয়। বৃষ্টিপাতের বার্ষিক বণ্টন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশের দুটি অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়, যথা:
- পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢাল বা পশ্চিম উপকূলভূমি
- পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত
পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢাল: আরব সাগরের ওপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর যে শাখা ভারতে প্রবেশ করে, তা পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে প্রথম বাধা পায়। এর ফলে পশ্চিমঘাটের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।
পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত: এই অঞ্চলটি পূর্বাচল পর্বত এবং পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখা যখন এই অঞ্চলে প্রবেশ করে, তখন পূর্বাচল পর্বত ও পূর্ব হিমালয়ে বাধা পেয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিকাংশ এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় (অসম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত)।র অধিকাংশ এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় (অসম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত)।
ভারতে মোট কয়টি বৃষ্টিপাত অঞ্চল এবং কী কী? এই অঞ্চলগুলির পরিচয় দাও।
বৃষ্টিপাত অঞ্চল বলতে এমন একটি অঞ্চলকে বোঝায় যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মোটামুটি একরকম হয়। ভারতের বিভিন্ন অংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের তারতম্য অনুসারে ভারতকে পাঁচটি বৃষ্টিপাত অঞ্চলে ভাগ এই অঞ্চলগুলোকে ভাগ করা হয়েছে। সংক্ষেপে এই অঞ্চলগুলির পরিচয় নিচে দেওয়া হলো:
বৃষ্টিপাত অঞ্চল | প্রভাবিত এলাকা | বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ |
---|---|---|
অত্যধিক বৃষ্টিপাত অঞ্চল | পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢাল, পূর্ব হিমালয়, মিজোরাম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। | ২০০ সেমি (200 cm) বেশি |
অধিক বৃষ্টিপাত অঞ্চল | বিহার, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চল, ওডিশা, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশ। | ১০০ থেকে ২০০ সেমি (100–200 cm) |
মাঝারি বৃষ্টিপাত অঞ্চল | পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পূর্ব রাজস্থান, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র। | ৬০ থেকে ১০০ সেমি (60–100 cm) |
স্বল্প বৃষ্টিপাত অঞ্চল | পশ্চিমঘাট পর্বতের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল, পাঞ্জাব ও হরিয়ানার পশ্চিমাংশ, মধ্য রাজস্থান। | ২০ থেকে ৬০ সেমি (20–60 cm) |
অতি স্বল্প বৃষ্টিপাত অঞ্চল | রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চল, জম্মু ও কাশ্মীরের লাদাখ মালভূমি। | ২০ সেমি (20 cm) কম |
ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত হয় কেন?
ভারতে প্রধানত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে বৃষ্টিপাত হলেও দেশের সর্বত্র সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। ভারতের তিনটি অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত হয়, যথা –
- রাজস্থানের পশ্চিমাংশ ও গুজরাতের উত্তর-পশ্চিমাংশ,
- জম্মু ও কাশ্মীরের লাদাখ মালভূমি এবং
- পশ্চিমঘাট পর্বত ও পূর্বঘাট পর্বতের মধ্যবর্তী বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল।
রাজস্থানের পশ্চিমাংশ ও গুজরাতের উত্তর-পশ্চিমাংশ
- আরব সাগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর একটি শাখা গুজরাতের কাথিয়াওয়াড় হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের দিকে প্রবাহিত হলেও সেখানে প্রতিহত করার মতো কোনো পর্বতশ্রেণি নেই, তাই বৃষ্টিপাত হয় না। আবার,
- আরাবল্লি পর্বত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর গতিপথের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত হওয়ায় আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ওই পর্বতের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরও উত্তরে চলে যায়। এর ফলে রাজস্থানের পশ্চিমাংশ ও গুজরাতের উত্তর-পশ্চিমাংশ প্রায় বৃষ্টিহীন অবস্থাতেই থাকে।
লাদাখ মালভূমি
এটি একটি পর্বতবেষ্টিত মালভূমি। তাই জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে লাদাখ মালভূমিতে প্রবেশ করতে পারে না, বলেই ওই অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত হয়।
পশ্চিমঘাট ও পূর্বঘাট পর্বতের মধ্যবর্তী অঞ্চল
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু পশ্চিমঘাট পর্বতের অনুবাত ঢালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটানোর পর যখন ওই পর্বতের অনুবাত ঢালে পৌঁছোয় তখন তার জলীয়বাষ্পের পরিমাণ হ্রাস পায় বলে বৃষ্টিপাত হয় না।
ভারতে শীতকাল শুষ্ক হওয়ার কারণ কী?
শীতকালে ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু, যা শুষ্ক এবং শীতল প্রকৃতির। এই বায়ু স্থলভাগের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, ফলে এটি জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করতে পারে না। শীতলতার কারণে এই বায়ুর জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতাও কমে যায়। এর ফলে শীতকালে ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয় না। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে—যেমন প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে তামিলনাড়ু উপকূলে এবং পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতে কিছুটা বৃষ্টিপাত হয়।
থর মরুভূমি সৃষ্টির কারণ কী?
ভারতের অধিকাংশ স্থানে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়, কিন্তু রাজস্থানের পশ্চিমাংশে বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না। এর প্রধান কারণ হলো, আরব সাগর থেকে আসা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর একটি শাখা গুজরাটের কাথিয়াওয়াড় উপকূল দিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের দিকে প্রবাহিত হলেও, সেখানে বায়ুকে প্রতিহত করার জন্য কোনো পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত পর্বতশ্রেণি নেই। এখানকার একমাত্র পর্বতশ্রেণি আরাবল্লি, যা মৌসুমি বায়ুর প্রবাহের সমান্তরালে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্বে বিস্তৃত। ফলে এই বায়ুতে থাকা জলীয়বাষ্প পর্বত দ্বারা প্রতিহত হয়ে ঘনীভূত হতে পারে না, যার ফলে বৃষ্টিপাত হয় না। এছাড়া, এই অঞ্চলের তীব্র উষ্ণতার কারণে বায়ুর জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে বৃষ্টিপাত হয় না। এই কারণেই উত্তর-পশ্চিম ভারতে থর মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে।
মরু অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মের উষ্ণতার পার্থক্য বেশি কেন?
মরু অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মের উষ্ণতার পার্থক্য বেশি, কারণ:
- মরু অঞ্চলের ভূমি প্রধানত বালি বা পাথর দিয়ে আবৃত থাকে। বালি ও পাথর দ্রুত তাপ শোষণ করে, কিন্তু তাপ ধরে রাখতে পারে না। তাই রাতের দিকে ভূমি দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। এজন্য মরু অঞ্চলে দিনের বেলায়, বিশেষত গ্রীষ্মকালে, প্রচণ্ড গরম অনুভূত হয়।
- মরু অঞ্চলের আকাশ বছরের অধিকাংশ সময় মেঘমুক্ত থাকে। মেঘমুক্ত আকাশে তাপ বিকিরণ খুব বেশি হয়, যার ফলে ভূমি দ্রুত তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে যায়।
- জলীয়বাষ্প তাপ ধরে রাখে। কিন্তু মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয় না বা খুব কম হয়, ফলে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণও কম থাকে। এই কারণে বায়ু দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। এর ফলে গ্রীষ্মকালে সূর্যের প্রখর তাপের কারণে মরুভূমি অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, ও উষ্ণতা খুব বেশি বেড়ে যায় এবং শীতকালে মৃদু সূর্যরশ্মিতে প্রচণ্ড ঠান্ডা অনুভূত হয়। এই অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মের মধ্যে উষ্ণতার পার্থক্য 30 থেকে 40 °সে পর্যন্ত হয়ে যায়।
বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল বলতে কী বোঝ? উদাহরণ দাও।
অথবা, বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল ভারতের কোথায় দেখা যায়?
বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল: পর্বতের যে ঢালে এসে আর্দ্র বায়ু আঘাত করে, সেই ঢালে বা প্রতিবাত ঢালে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। কিন্তু পর্বত অতিক্রম করে ওই বায়ু যখন বিপরীত ঢালে বা অনুবাত ঢালে পৌঁছায়, তখন তার মধ্যকার জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে বিপরীত ঢালে বৃষ্টিপাত বেশ কম হয়। এই অল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত বা প্রায় বৃষ্টিহীন এলাকাকে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল বলে।
উদাহরণ: দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আরব সাগরীয় শাখা পশ্চিমঘাটের পশ্চিম ঢালে এসে প্রচুর শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু পশ্চিমঘাটের পূর্ব ঢালে অবস্থিত অঞ্চলসমূহে অর্থাৎ দাক্ষিণাত্যের অভ্যন্তরে বৃষ্টিপাত খুব কম হওয়ায় তা বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল নামে পরিচিত।
একইভাবে, মেঘালয়ের খাসি পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখা প্রতিহত হয় বলে চেরাপুঞ্জি এবং এর নিকটবর্তী মৌসিনরাম এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত (1187 সেমি) হয়। কিন্তু ওই পাহাড়ের বিপরীত ঢালে বা উত্তর ঢালে অবস্থিত শিলং-এ বৃষ্টিপাত (159 সেমি) কম হয়, তাই এটি একটি বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে কেন বৃষ্টিপাত ঘটায়?
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণ হলো –
- গ্রীষ্মকালের শেষে, বিশেষত মে মাসে, উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওপর একটি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। এই নিম্নচাপের আকর্ষণে ভারত মহাসাগরের উচ্চচাপ এলাকা থেকে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে প্রবাহিত হয়।
- এই বায়ু ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়, তাই এ বায়ুতে প্রচুর পরিমাণ জলীয়বাষ্প থাকে। ওই আর্দ্র বায়ু ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় সমগ্র দেশ জুড়ে কমবেশি বৃষ্টিপাত ঘটায়।
ভারতে বন্যা ও খরার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হতে পারে?
বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায়:
- নদীর পাড়ে মজবুত বাঁধ নির্মাণ করা।
- বৃষ্টিপাত ও নদীতে জলপ্রবাহের পরিমাণ সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করা।
- নদীখাতের সঠিক গভীরতা বজায় রাখা।
- উঁচু জায়গায় ঘরবাড়ি নির্মাণ করা।
- বন্যার আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার সুব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- নদীর উচ্চপ্রবাহে জলাধার নির্মাণ করা।
- পলি জমে যাতে নদীখাত দ্রুত ভরাট না হয়, সেজন্য উপযুক্ত মৃত্তিকা সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
খরা নিয়ন্ত্রণের উপায়:
- বৃষ্টিপাতের জল এবং ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ জলের অপচয় রোধ করে সেগুলির বিজ্ঞানসম্মত ও সুষ্ঠু ব্যবহার করা।
- বৃষ্টিপাতের জল ধরে রেখে তার মাধ্যমে চাষ করা (Rainwater Harvesting)।
- খরা সহিষ্ণু ফসলের চাষে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
- জলসেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, বিশেষত জলের অপচয় রোধ করার জন্য শুষ্ক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পাইপের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার বিকাশসাধন।
ভারতে বন্যার কারণগুলি আলোচনা করো।
ভারতে বন্যা হয় বিভিন্ন কারণে, যেমন –
খামখেয়ালি দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অনিশ্চিত আচরণে —
- কখনও একটানা কয়েক ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি হলে বন্যা হয়।
- দীর্ঘক্ষণ ধরে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হলেও বন্যা হয়।
- যদি নির্দিষ্ট সময়ের আগে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন ঘটে এবং তার প্রত্যাগমনেও বিলম্ব হয়, তাহলে বর্ষাকাল দীর্ঘায়িত হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়।
- পলি জমে নদীর ধারণ ও বহন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে মাঝারি মাপের বৃষ্টিপাতেও নদীতে বন্যা সৃষ্টি হতে পারে।
- বর্ষাকালে জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়ার ফলে বন্যা হতে পারে।
- প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস হলে উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে বন্যা হয়।
- পার্বত্য অঞ্চলে বর্ষাকালে ধস নেমে নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয়ে গেলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জলমগ্ন হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়।
- মরু অঞ্চলে ছোটো ছোটো নালা বা শুষ্ক খালগুলি বালিতে ক্রমাগত ভরাট হয়ে যায় বলে জলনিকাশি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে থাকে। এজন্য অল্প বৃষ্টিতেই মরু অঞ্চলে বন্যা হয়ে যায়। এ ছাড়া,
- ভূ-আলোড়নের ফলে নদীর গতিপথের পরিবর্তন,
- নদীতে হঠাৎ জলের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণেও বন্যা হতে পারে।
ভারতে খরার কারণ কী?
প্রধানত দুটি কারণে ভারতে খরার আবির্ভাব ঘটে:
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অনিয়মিত ও অনিশ্চিত আচরণ এবং
- দ্রুত অরণ্য বিনাশ।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অনিয়মিত ও অনিশ্চিত আচরণ:
- ভারতে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় 67-72 শতাংশ বর্ষাকালের (জুন-সেপ্টেম্বর) মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু
- কোনো কোনো বছরে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমনে বিলম্ব ঘটে, আবার কোনো কোনো বছর তা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ফিরে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে মাটিতে জলাভাব দেখা দেয় এবং মাটি শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে ওঠে। এভাবে খরা বা খরাজনিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং ফসল উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে। তাছাড়া,
- বর্ষাকালে সবসময় বৃষ্টিপাতও নিয়মিত হয় না, মাঝে মাঝে বিরতি থাকে। এই বিরতির স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
দ্রুত অরণ্য বিনাশ:
- মাটির ওপর গাছপালার আচ্ছাদন না থাকলে রোদের তেজে মাটির জলকণা বাষ্পীভূত হয়। এর ফলে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায় এবং ভৌমজলস্তরও নেমে যায়। এইভাবে খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আবার,
- প্রয়োজনমতো গাছপালা না থাকলে সবুজ পাতার মাধ্যমে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বাতাসে জলীয় বাষ্প আসে না। ফলে বায়ুর আর্দ্রতা কমে যায়। তখন শুষ্ক বায়ু মাটির জলকণা শোষণ করে বলে ভূমিতে খরার সৃষ্টি হয়।
ভারতের জলবায়ুতে অরণ্যের অবদান উল্লেখ করো।
ভারতের জলবায়ুতে অরণ্যের যথেষ্ট অবদান লক্ষ করা যায়, যেমন:
- অরণ্যভূমির গাছপালা থেকে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় জলীয়বাষ্প নির্গত হয়, তাই অরণ্যভূমির জলবায়ু আর্দ্র হয়, যা বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে।
- গভীর অরণ্যভূমি আচ্ছাদনের কাজ করে বলে মাটিতে রোদ বা সূর্যালোকের প্রখরতা অনুভূত হয় না।
এছাড়াও অরণ্যের আচ্ছাদন থাকায় মৃত্তিকাস্থিত জলও সূর্যালোকে বাষ্পীভূত হতে পারে না। অপরদিকে উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং দাক্ষিণাত্য মালভূমির অভ্যন্তরভাগে অরণ্যভূমি বিশেষ না থাকায় ওইসব অঞ্চলের উষ্ণতা যথেষ্ট বেশি থাকে।
ভারতকে বৈচিত্র্যময় জলবায়ুর দেশ বলে কেন?
ভারত আয়তনে বিশাল এবং এর ভূপ্রকৃতিতে ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে। এই বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু বৈচিত্র্য দেখা যায়। এর মূল কারণগুলো হলো:
- উষ্ণতার পার্থক্য: গ্রীষ্মকালে রাজস্থানের থর মরুভূমিতে তাপমাত্রা 50 °সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, যেখানে কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলে শীতকালে তাপমাত্রা কমে -40 °সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে আসে। এই ধরনের উষ্ণতার বিশাল পার্থক্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ুর ভিন্নতাকে নির্দেশ করে।
- উষ্ণতার প্রসর: দক্ষিণ ভারতে বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর 4-6 °সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, যেখানে উত্তর ভারতে প্রসর প্রায় 20-25 °সেলসিয়াস।
- বৃষ্টিপাতের তারতম্য: মেঘালয় মালভূমির দক্ষিণে যেমন অতি বর্ষণে পৃথিবীর সর্বাধিক বর্ষণসিক্ত অঞ্চল তৈরি হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমে থর মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার জন্য মরুভূমি সৃষ্টি হয়েছে।
- বায়ুপ্রবাহের ভিন্নতা: ভারতে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় এবং গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। এই মৌসুমি বায়ু ভারতবর্ষের জলবায়ুকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এছাড়াও স্থানীয় বায়ুর প্রভাব যেমন গ্রীষ্মকালে লু (গরম বাতাস), আঁধি, কালবৈশাখী, শরৎকালে আশ্বিনের ঝড়, এবং শীতে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আবহাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে।
ভারতে মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য লেখো।
ভারতের জলবায়ু বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যের অন্যতম কারণ হল মৌসুমি বায়ু। মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
- শীতকালে মৌসুমি বায়ু উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়, আর বর্ষাকালে ঠিক তার বিপরীত দিক অর্থাৎ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়।
- শীতকালে ভারতের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত শীতল ও শুষ্ক মৌসুমি বায়ুর কারণে তাপমাত্রা কমে যায় এবং শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে।
- গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সমুদ্র থেকে প্রচুর জলীয়বাষ্প বয়ে আনে এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে বৃষ্টিপাত ঘটায়, যার ফলে ভারতে বর্ষাকালের সূচনা হয়।
- ভারতে মোট বৃষ্টিপাতের বেশিরভাগই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর ফলে ঘটে।
- মৌসুমি বায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তার অনিশ্চয়তা।
- মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টনের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাভাবিক উদ্ভিদের বৈচিত্র্য দেখা যায় এবং
- ভারতের শস্যবর্ষও মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাবর্তনের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে।
ভারতের বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
ভারতের বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
- বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন: ভারতের সর্বত্র বৃষ্টিপাত সমান নয়। পূর্ব হিমালয়, পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম দিক, এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রবল বৃষ্টিপাত হলেও রাজস্থান, জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম।
- ঋতু অনুযায়ী বৃষ্টিপাত: ভারতে সারাবছর সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় 72% বর্ষাকালে, 10% গ্রীষ্মকালে, প্রায় 15% শরৎকালে এবং 3% শীতকালে হয়ে থাকে।
- বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা: মৌসুমি বৃষ্টিপাত সারাবছর সমানভাবে হয় না। প্রতিবছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণও সমান নয়। কখনও অতিবৃষ্টিতে বন্যা দেখা দেয়, আবার কখনও কম বৃষ্টিতে খরা হয়, যা ভারতের বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য।
- বৃষ্টিপাতের সাময়িক বিরতি: ভারতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হলেও স্থানভেদে বায়ুচাপের পরিবর্তন ঘটলে বৃষ্টিপাতের সাময়িক বিরতি ঘটে।
ভারতের অর্থনীতির ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব লেখো।
ভারতের অর্থনীতির ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব:
- কৃষির ওপর প্রভাব: ভারতীয় অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো বৃষ্টিপাত। যেহেতু ভারত মৌসুমি জলবায়ুর একটি দেশ, তাই ভারতীয় কৃষিতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মৌসুমি বায়ু নির্ধারিত সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত করলে ভারতীয় কৃষি লাভবান হয়। অন্যদিকে, বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা বা সময়মতো না হলে তা কৃষিতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর। এখানে মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমনের ওপর নির্ভর করে শস্যবর্ষ তৈরি করা হয়।
- শিল্পের ওপর প্রভাব: কৃষিভিত্তিক শিল্পের ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব রয়েছে। পাটশিল্প, চাশিল্প, বস্ত্রবয়ন শিল্প, চিনি শিল্প প্রভৃতি শিল্পগুলি কৃষির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে বলে মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাবর্তন শিল্পে প্রভাব ফেলে। অতিবৃষ্টি বা খরা কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করে। তাই শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন কম হয়, এতে শিল্প উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর প্রভাব: দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে বন্যার সৃষ্টি হয়, যার ফলে কৃষি জমির ক্ষতি হয় এবং অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়। অন্যদিকে, মৌসুমি বায়ুর সময়ে কম বৃষ্টিপাত হলে খরার সৃষ্টি হয়, যা ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বন্যা ও খরা উভয়ই দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে যে বছর মৌসুমি বায়ুর আগমন এবং বৃষ্টিপাত সঠিকভাবে হয়, সে বছর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্পে কাঁচামালের সংকট থাকে না, এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
মৌসুমি বায়ুর ওপর জেট বায়ুর প্রভাব ব্যাখ্যা করো।
ভারতে মৌসুমি বায়ুর ওপর জেট বায়ুর প্রভাবগুলি হলো:
- মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি অনেকাংশে জেট বায়ুর দ্বারা প্রভাবিত হয়।
- জেট বায়ুর অবস্থান এবং গতি মৌসুমি বায়ুর আগমন এবং প্রস্থানের সময় নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
- জেট বায়ু কখনো কখনো মৌসুমি বায়ুর আগমন নির্ধারিত সময়ের আগেই ঘটায়, আবার কখনো বিলম্বিত করে।
- ভারতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর উত্তরাভিমুখী গমন জেট বায়ুর দ্বারা ব্যাহত হয়। উত্তর ভারতের সমভূমিতে অবস্থান করা জেট বায়ু যখন সরে যায়, তখনই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ নিশ্চিত হয়।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ও উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর পার্থক্য লেখো।
ভিত্তি | দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু | উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু |
---|---|---|
প্রবাহকাল | প্রধানত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ চার মাস ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। | প্রধানত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ তিন মাস ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। |
প্রবাহের দিক | এই বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। | এই বায়ু উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। |
প্রকৃতি | দক্ষিণের উষ্ণ জলভাগের ওপর দিয়ে আসে বলে এই বায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। | উত্তরের শীতল স্থলভাগের ওপর দিয়ে আসে বলে এই বায়ু শীতল ও শুষ্ক। |
প্রভাব | এই বায়ুর প্রভাবে সারা ভারতেই বৃষ্টিপাত হয়। | এই বায়ুর প্রভাবে কিছু অঞ্চলে সামান্য বৃষ্টি হলেও, অধিকাংশ অঞ্চলের আবহাওয়া শুষ্ক থাকে। |
বৈশিষ্ট্য | এই বায়ু অত্যন্ত অনিয়মিত, অনিশ্চিত ও খামখেয়ালি, তাই এর মাধ্যমে প্রায়ই খরা বা বন্যা হয়। | মাঝে মাঝে শীতের তীব্রতায় কিছু কম-বেশি হলেও এই বায়ু নিয়মিত এবং পূর্বাভাসযোগ্য। |
অন্যান্য | দেশে খরিফ ফসলের উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে এই বায়ুর ওপর নির্ভরশীল। | দেশে রবি ফসলের উৎপাদন মূলত এই বায়ুর ওপর নির্ভরশীল। |
ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতের পূর্বদিকে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণ লেখো।
ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতের পূর্বদিকে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণ: ভারতের আরব সাগরীয় উপকূলভূমির পূর্ব সীমায় উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রাচীরের মতো বিস্তৃত রয়েছে পশ্চিমঘাট পর্বতশ্রেণি। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু, যা আরব সাগরের ওপর দিয়ে আসে, তা জলীয়বাষ্পপূর্ণ থাকে এবং পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে এসে আঘাত করে। এর ফলে পশ্চিম ঢালে প্রচুর শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি হয়। তবে, পর্বতশ্রেণিটি অতিক্রম করার পর, ওই বায়ু পূর্ব ঢালে (অনুবাত ঢালে) পৌঁছানোর সময় বায়ুর জলীয়বাষ্পের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। এই সময় বায়ু পর্বতের ঢাল বরাবর ওপর থেকে নীচে নামে এবং তা আরও শুষ্ক হয়ে ওঠে। এর ফলে পূর্ব ঢালে বায়ুর জলীয়বাষ্প গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যার কারণে ওই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়। এই কারণেই পশ্চিমঘাটের পূর্ব দিকে বৃষ্টিপাত কম হয় এবং এলাকাটি বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় ‘ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ’ এর ‘ভারতের জলবায়ু’ বিভাগের কিছু সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নাবলি আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন তাহলে আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাকে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জন যার এটি প্রয়োজন হবে তার সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।