আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ, মাধ্যমিক ভূগোল, ভারতের জলবায়ু এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।
মাধ্যমিক ভূগোল – ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ – ভারতের জলবায়ু – সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক উত্তরধর্মী প্রশ্নাবলি
ভারতের জলবায়ুকে মৌসুমি জলবায়ু বলে কেন?
মৌসুমি শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ “মৌসিম” থেকে, যার অর্থ ঋতু। ঋতু অনুসারে প্রবাহিত বায়ুকে মৌসুমি বায়ু বলা হয়। গ্রীষ্মকালে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এবং শীতকালে শীতল ও শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতের জলবায়ুতে দুটি প্রধান ঋতুর সৃষ্টি হয়: আর্দ্র গ্রীষ্মকাল এবং শুষ্ক শীতকাল। এই দুটি মৌসুমি বায়ুর চক্রাকারে পরিবর্তন ভারতের জলবায়ুতে ঋতুচক্র সৃষ্টি করে, যেমন:
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন-পূর্ব সময়কাল বা গ্রীষ্মকাল,
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল বা বর্ষাকাল,
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাগমনকাল বা শরৎকাল, এবং
- উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল বা শীতকাল।
এজন্যই ভারতের জলবায়ুতে মৌসুমি জলবায়ুর অধিক প্রভাব থাকায় ভারতকে ‘মৌসুমি জলবায়ুর দেশ’ বলা হয়। ভারতের 67 থেকে 72 শতাংশ বৃষ্টি মৌসুমি বায়ুর ফলেই হয়।
ভারতের জলবায়ুকে কী কী ঋতুতে ভাগ করা যায়?
মৌসুমি বায়ুর আগমন এবং প্রত্যাগমন, সারাবছরের বৃষ্টিপাত, উষ্ণতা, বায়ুর চাপ প্রভৃতি লক্ষ করে ভারত সরকারের আবহাওয়া বিভাগ ভারতের জলবায়ুকে চারটি ঋতুতে ভাগ করেছে। এগুলি হল:
ঋতুর নাম | মাসের নাম |
---|---|
শীতকাল বা উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল | ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি |
গ্রীষ্মকাল বা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন-পূর্ব সময়কাল | মার্চ থেকে মে |
বর্ষাকাল বা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল বা আর্দ্র গ্রীষ্মকাল | জুন থেকে সেপ্টেম্বর |
শরৎকাল বা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাগমনকাল | অক্টোবর থেকে নভেম্বর |
শীতকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৃষ্টিপাত হয় কেন?
শীতকালে ভারতের ওপর দিয়ে শীতল শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় বলে প্রায় সমগ্র দেশেই শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে, অর্থাৎ বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না। তবে শীতকালে মাঝে মাঝে সুদূর ভূমধ্যসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণবাত মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে পৌঁছায় এবং অদূরবর্তী আরব সাগর থেকে জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে নতুন করে শক্তিশালী হয় ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত ঘটায়। পশ্চিমদিক থেকে আসা এই ঘূর্ণবাতগুলি শীতের শান্ত আবহাওয়াকে নষ্ট করে বলে একে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা বা ওয়েস্টার্ন ডিস্টার্বেন্স বলা হয়। এর প্রভাবে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে বৃষ্টির পরিমাণও ক্রমশ কমে যায়।
শীতকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৃষ্টিপাতের কারণগুলি হল:
- শীতকালে ভারতের ওপর দিয়ে শীতল শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়, ফলে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে।
- মাঝে মাঝে সুদূর ভূমধ্যসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণবাত মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে পৌঁছায়।
- এই ঘূর্ণবাত আরব সাগর থেকে জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে নতুন করে শক্তিশালী হয়।
- এ কারণে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত ঘটে।
- পশ্চিমদিক থেকে আসা এই ঘূর্ণবাতগুলি শীতের শান্ত আবহাওয়াকে নষ্ট করে, ফলে একে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা বা ওয়েস্টার্ন ডিস্টার্বেন্স বলা হয়।
- এর প্রভাবে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে বৃষ্টির পরিমাণ ক্রমশ কমে যায়।
ভারতে প্রায়ই খরা ও বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় কেন?
মৌসুমি বায়ুর পরিবর্তন ও তার প্রভাবের কারণেই ভারতে প্রায়ই খরা ও বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
ভারতে প্রায়ই খরার কারণ:
- স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত: বর্ষাকালে স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হলে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায়, ফলে খরার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর দেরিতে প্রবেশ: স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দেরিতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে প্রবেশ করলে ফসলের সেচের জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে না, ফলে খরার পরিস্থিতি দেখা দেয়।
- মৌসুমি বায়ুর আগে প্রত্যাবর্তন: স্বাভাবিক সময়ের আগে মৌসুমি বায়ু প্রত্যাবর্তন করলে বর্ষার সময়কাল কমে যায় এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয় না, যা খরার সৃষ্টি করে।
- বর্ষাকালে বৃষ্টিহীন অবস্থা: বর্ষাকালে একটানা বেশ কিছুদিন বৃষ্টিহীন অবস্থার সৃষ্টি হলে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায় এবং খরা দেখা দেয়।
- এল নিনোর প্রভাব: এল নিনো একটি আবহাওয়াগত ঘটনা, যা প্রশান্ত মহাসাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, ফলে খরার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
ভারতে প্রায়ই বন্যার কারণ:
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অতিবর্ষণ: দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অতিবর্ষণের ফলে মাটির শোষণ ক্ষমতা অতিক্রম করে অতিরিক্ত জল জমে এবং বন্যা সৃষ্টি হয়।
- প্রত্যাবর্তনের স্বাভাবিক সময়ের পরেও মৌসুমি বায়ুর স্থায়িত্ব: প্রত্যাবর্তনের স্বাভাবিক সময়ের পরেও দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে থেকে গেলে দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত হয় এবং বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
- নির্ধারিত সময়ের আগে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ: নির্ধারিত সময়ের আগে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে প্রবেশ করলে একসঙ্গে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয় এবং বন্যা হয়।
- দীর্ঘ সময় ধরে একটানা প্রবল বৃষ্টিপাত: বহুদিন ধরে একটানা প্রবল বৃষ্টিপাত হলে নদী, জলাধার ও হ্রদের জলস্তর বৃদ্ধি পায় এবং আশেপাশের এলাকা প্লাবিত হয়।
- বর্ষাকালে জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়া: বর্ষাকালে জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়ার ফলে নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পায় এবং নদী তীরবর্তী অঞ্চল প্লাবিত হয়, ফলে বন্যা সৃষ্টি হয়।
করমণ্ডল উপকূল তথা তামিলনাডুতে বছরে দুবার বৃষ্টিপাত হয় কেন?
অথবা, করমণ্ডল উপকূলে শীতকালে বৃষ্টিপাতের কারণ কী?
করমণ্ডল উপকূল তথা তামিলনাডুর বিস্তীর্ণ অংশে বছরে দু-বার বৃষ্টিপাত হয়। প্রথমবার, জুন-সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সারাদেশের সঙ্গে এবং দ্বিতীয়বার, প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে তামিলনাডুর উপকূলে বৃষ্টিপাত হয়। কারণ, প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ু যখন বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে ফিরে যায় তখন প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প শোষণ করে ও করমণ্ডল উপকূলে বৃষ্টিপাত ঘটায়। যেমন – তামিলনাডুর থাঞ্জাভুর ও সংলগ্ন জেলায় জুন-সেপ্টেম্বর মাসে 35 সেমি বৃষ্টিপাত হলেও অক্টোবর-নভেম্বরে প্রায় 67 সেমি বৃষ্টি হয়।
ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাত হয় কেন?
ভারতে প্রধানত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের জন্য বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টিপাত দেশের সর্বত্র সমানভাবে বণ্টিত নয়। বৃষ্টিপাতের বার্ষিক বণ্টন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশের দুটি অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হয়, যথা – পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢাল বা পশ্চিম উপকূলভূমি এবং পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত।
পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে: আরব সাগরের ওপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর যে শাখা ভারতে প্রবেশ করে তা পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে প্রথম বাধা পায়। ফলে পশ্চিমঘাটের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে: সমগ্র অঞ্চলটি পূর্বাচল ও পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখা পূর্বাচল ও পূর্ব হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিকাংশ এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় (অসম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত)।
ভারতে মোট কয়টি বৃষ্টিপাত অঞ্চল এবং কী কী? এই অঞ্চলগুলির পরিচয় দাও।
বৃষ্টিপাত অঞ্চল বলতে এমন একটি অঞ্চলকে বোঝায় যার সর্বত্র বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মোটামুটি একই রকম। বিভিন্ন অংশে বৃষ্টিপাতের তারতম্য অনুসারে ভারতকে পাঁচটি বৃষ্টিপাত অঞ্চলে ভাগ করা যায়। সংক্ষেপে ওই ভাগগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
বৃষ্টিপাত অঞ্চল | প্রভাবিত এলাকা | বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ |
---|---|---|
অত্যধিক বৃষ্টিপাত অঞ্চল | পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢাল, পূর্ব হিমালয়, মিজোরাম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। | ২০০ সেমি-র বেশি |
অধিক বৃষ্টিপাত অঞ্চল | বিহার, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশের পার্বত্য অংশ, ওডিশা, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশ। | ১০০ সেমি থেকে ২০০ সেমি |
মাঝারি বৃষ্টিপাত অঞ্চল | পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পূর্ব রাজস্থান, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র। | ৬০ সেমি থেকে ১০০ সেমি |
স্বল্প বৃষ্টিপাত অঞ্চল | পশ্চিমঘাট পর্বতের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল, পাঞ্জাব ও হরিয়ানার পশ্চিমাংশ, মধ্য রাজস্থান। | ২০ সেমি থেকে ৬০ সেমি |
অতি স্বল্প বৃষ্টিপাত অঞ্চল | রাজস্থানের মরু অঞ্চল, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখ মালভূমি। | ২০ সেমি-র কম। |
ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত হয় কেন?
ভারতে প্রধানত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে বৃষ্টিপাত হলেও দেশের সর্বত্র সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। ভারতের তিনটি অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত হয়, যথা- রাজস্থানের পশ্চিমাংশ ও গুজরাতের উত্তর-পশ্চিমাংশ, জম্মু ও কাশ্মীরের লাদাখ মালভূমি এবং পশ্চিমঘাট পর্বত ও পূর্বঘাট পর্বতের মধ্যবর্তী বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল।
রাজস্থানের পশ্চিমাংশ ও গুজরাতের উত্তর-পশ্চিমাংশ
আরব সাগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর একটি শাখা গুজরাতের কাথিয়াওয়াড় হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের দিকে ছুটে গেলেও তাকে প্রতিহত করার মতো কোনো পর্বতশ্রেণি ওখানে নেই তাই বৃষ্টিপাত হয় না। আবার, আরাবল্লি পর্বত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর গতিপথের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত বলে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ওই পর্বতের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরও উত্তরে চলে যায়। এর ফলে রাজস্থানের পশ্চিমাংশ ও গুজরাতের উত্তর-পশ্চিমাংশ প্রায় বৃষ্টিহীন অবস্থাতেই থাকে।
লাদাখ মালভূমি
এটি একটি পর্বতবেষ্টিত মালভূমি। তাই জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে লাদাখ মালভূমিতে প্রবেশ করতে পারে না বলেই ওই অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত হয়।
পশ্চিমঘাট ও পূর্বঘাট পর্বতের মধ্যবর্তী অঞ্চল
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু পশ্চিমঘাট পর্বতের অনুবাত ঢালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটানোর পর যখন ওই পর্বতের অনুবাত ঢালে পৌঁছোয় তখন তার জলীয়বাষ্পের পরিমাণ হ্রাস পায় বলে বৃষ্টিপাত হয় না।
ভারতে শীতকাল শুষ্ক হওয়ার কারণ কী?
শীতকালে ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু। এই বায়ু অত্যন্ত শীতল ও শুষ্ক প্রকৃতির হয়। কারণ, এই বায়ু স্থলভাগের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করতে পারে না। এ ছাড়া খুব শীতল হয় বলে এই বায়ুর জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতাও হ্রাস পায়।
এর ফলে শীতকালে সমগ্র দেশের তাপমাত্রা যথেষ্ট হ্রাস পেলেও এসময় বৃষ্টিপাত হয় না (কেবলমাত্র প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে তামিলনাডু উপকূলে এবং পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতে কিছু বৃষ্টিপাত হয়)।
থর মরুভূমি সৃষ্টির কারণ কী?
ভারতের অধিকাংশ স্থানে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হলেও রাজস্থানের পশ্চিমাংশে বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না বললেই চলে। এর কারণ হল, আরব সাগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর একটি শাখা গুজরাতের কাথিয়াওয়াড় উপকূল হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের দিকে ছুটে গেলেও ওখানে তাকে প্রতিহত করার মতো পূর্ব-পশ্চিমে বা আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত কোনো পর্বতশ্রেণি নেই। এখানকার একমাত্র পর্বত আরাবল্লি মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের সাথে সমান্তরালে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্বে বিস্তৃত হওয়ায় এই বায়ুতে অবস্থিত অবশিষ্ট জলীয়বাষ্প কোনো উচ্চভূমি দ্বারা প্রতিহত হয়ে ও পরে ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে না। উপরন্তু, এই অঞ্চলের তীব্র উষ্ণতার প্রভাবে বায়ুর জলীয়বাষ্প ধারণ করার ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় বৃষ্টিপাত হতে পারে না। ফলে বৃষ্টিপাতের অভাবজনিত কারণে উত্তর-পশ্চিম ভারতে থর মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে।
মরু অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মের উষ্ণতার পার্থক্য বেশি কেন?
মরু অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মের উষ্ণতার পার্থক্য বেশি, কারণ মরু অঞ্চলের ভূমি বালি দ্বারা আবৃত বা পাথুরে। বালি বা পাথর যেমন দ্রুত গরম হয়, তেমনি তাপ ধরে রাখতে পারে না বলে ঠান্ডাও হয় তাড়াতাড়ি। এজন্য মরু অঞ্চলে দিনেরবেলা বিশেষত গ্রীষ্মকালে অত্যধিক গরম বোধ হয়। মরু অঞ্চলের আকাশ বছরের অধিকাংশ সময় মেঘমুক্ত থাকে। মেঘমুক্ত আকাশে তাপ বিকিরণ খুব বেশি হয় বলে বালি দ্বারা আবৃত বা পাথুরে ভূমি দ্রুত তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে যায়। জলীয়বাষ্প তাপ ধরে রাখে। কিন্তু মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয় না বা খুব কম হয় বলে বাতাসে জলীয়বাষ্প খুবই কম পরিমাণে থাকে। তাই বায়ু তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে যায়। এর ফলে গ্রীষ্মকালে প্রখর সূর্যরশ্মিতে মরুভূমি ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ও উষ্ণতা খুব বেশি বেড়ে যায় এবং শীতকালে মৃদু সূর্যরশ্মিতে প্রচণ্ড ঠান্ডা অনুভূত হয়। এই অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মের মধ্যে উষ্ণতার পার্থক্য 30 থেকে 40 °সে পর্যন্ত হয়ে যায়।
বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল বলতে কী বোঝ? উদাহরণ দাও।
অথবা, বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল ভারতের কোথায় দেখা যায়?
বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল: পর্বতের যে ঢালে এসে আর্দ্র বায়ু আঘাত করে, সেই ঢালে বা প্রতিবাত ঢালে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। কিন্তু পর্বত অতিক্রম করে ওই বায়ু যখন বিপরীত ঢালে বা অনুবাত ঢালে পৌঁছায়, তখন তার মধ্যকার জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে বিপরীত ঢালে বৃষ্টিপাত বেশ কম হয়। এই অল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত বা প্রায় বৃষ্টিহীন এলাকাকে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল বলে।
উদাহরণ: দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আরব সাগরীয় শাখা পশ্চিমঘাটের পশ্চিম ঢালে এসে প্রচুর শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু পশ্চিমঘাটের পূর্ব ঢালে অবস্থিত অঞ্চলসমূহে অর্থাৎ দাক্ষিণাত্যের অভ্যন্তরভাগে বৃষ্টিপাত খুব কম হওয়ায় তা বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল নামে পরিচিত।
একইভাবে, মেঘালয়ের খাসি পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখা প্রতিহত হয় বলে চেরাপুঞ্জি এবং এর নিকটবর্তী মৌসিনরাম এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত (১১৮৭ সেমি) হয়। কিন্তু ওই পাহাড়ের বিপরীত ঢালে বা উত্তর ঢালে অবস্থিত শিলং-এ বৃষ্টিপাত (১৫৯ সেমি) কম হয়, তাই এটি একটি বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে কেন বৃষ্টিপাত ঘটায়?
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণ:
- গ্রীষ্মকালের শেষের দিকে, বিশেষত মে মাসে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওপর যে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়, তার আকর্ষণে সুদূর ভারত মহাসাগরের উচ্চচাপ এলাকা থেকে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে ছুটে আসে।
- যেহেতু ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়, তাই এ বায়ুতে প্রচুর পরিমাণ জলীয়বাষ্প থাকে। ওই আর্দ্র বায়ু ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় সমগ্র দেশ জুড়ে কমবেশি বৃষ্টিপাত ঘটায়।
ভারতে বন্যা ও খরার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হতে পারে?
বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায়:
- নদীর পাড়ে মজবুত বাঁধ নির্মাণ।
- বৃষ্টিপাত ও নদীতে জলপ্রবাহের পরিমাণ সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ।
- নদীখাতের সঠিক গভীরতা বজায় রাখা।
- উঁচু জায়গায় ঘরবাড়ি নির্মাণ।
- বন্যার আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার সুব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- নদীর উচ্চপ্রবাহে জলাধার নির্মাণ।
- পলি জমে যাতে নদীখাত দ্রুত ভরাট না হয়, তাই উপযুক্ত মৃত্তিকা সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
খরা নিয়ন্ত্রণের উপায়:
- বৃষ্টিপাতের জল এবং ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ জলের অপচয় রোধ করে সেগুলির বিজ্ঞানসম্মত ও সুষ্ঠু ব্যবহার।
- বৃষ্টিপাতের জল ধরে রেখে তার মাধ্যমে চাষ করা (Rainwater Harvesting)।
- খরা সহিষ্ণু ফসলের চাষে বেশি গুরুত্ব আরোপ।
- জলসেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, বিশেষত জলের অপচয় রোধ করার জন্য শুষ্ক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পাইপের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার বিকাশসাধন।
ভারতে বন্যার কারণগুলি আলোচনা করো।
ভারতে বন্যা হয় বিভিন্ন কারণে:
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অনিশ্চিত আচরণে কখনও একটানা কয়েক ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি হলে বন্যা হয়। দীর্ঘক্ষণ ধরে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হলেও বন্যা হয়।
- পলি জমে নদীর ধারণ ও বহন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে মাঝারি মাপের বৃষ্টিপাতেও নদীতে বন্যা সৃষ্টি হতে পারে।
- বর্ষাকালে জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়ার ফলে বন্যা হতে পারে।
- প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস হলে উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে বন্যা হয়।
- পার্বত্য অঞ্চলে বর্ষাকালে ধস নেমে নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয়ে গেলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জলমগ্ন হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়।
- মরু অঞ্চলে ছোটো ছোটো নালা বা শুষ্ক খালগুলি বালিতে ক্রমাগত ভরাট হয়ে যায় বলে জলনিকাশি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে থাকে। এজন্য অল্প বৃষ্টিতেই মরু অঞ্চলে বন্যা হয়ে যায়।
- ভূ-আলোড়নের ফলে নদীর গতিপথের পরিবর্তন, নদীতে হঠাৎ জলের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণেও বন্যা হতে পারে।
ভারতে খরার কারণ কী?
প্রধানত দুটি কারণে ভারতে খরার আবির্ভাব ঘটে: দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অনিয়মিত ও অনিশ্চিত আচরণ এবং দ্রুত অরণ্য বিনাশ।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অনিয়মিত ও অনিশ্চিত আচরণ: ভারতে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় 67-72 শতাংশ বর্ষাকালের (জুন-সেপ্টেম্বর) মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু কোনো বছর দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমনে বিলম্ব ঘটে, আবার কোনো বছর তা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ফিরে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে মাটিতে জলাভাব দেখা যায় ও মাটি শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে ওঠে। এভাবে খরা বা খরাজনিত পরিস্থিতির সৃষ্টি ও ফসল উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে। তা ছাড়া, বর্ষাকালে সবসময় বৃষ্টিপাতও নিয়মিত হয় না, মাঝে মাঝে বিরতি থাকে। এই বিরতির স্থায়িত্ব খুব বেশি হলে খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
দ্রুত অরণ্য বিনাশ: মাটির ওপর গাছপালার আচ্ছাদন না থাকলে রোদের তেজে মাটির জলকণা বাষ্পীভূত হয়। এর ফলে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায়, ভৌমজলস্তরও নেমে যায়। এইভাবে খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আবার, প্রয়োজনমতো গাছপালা না থাকলে সবুজ পাতার মাধ্যমে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বাতাসে জলীয় বাষ্প আসে না। ফলে বায়ুর আর্দ্রতা কমে যায়। তখন শুষ্ক বায়ু মাটির জলকণা শোষণ করে বলে ভূমিতে খরার সৃষ্টি হয়।
ভারতের জলবায়ুতে অরণ্যের অবদান উল্লেখ করো।
ভারতের জলবায়ুতে অরণ্যের যথেষ্ট অবদান লক্ষ করা যায়, যেমন:
- অরণ্যভূমির গাছপালা থেকে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় জলীয়বাষ্প নির্গত হয়, তাই অরণ্যভূমির জলবায়ু আর্দ্র হয়, যা বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে।
- গভীর অরণ্যভূমি আচ্ছাদনের কাজ করে বলে মাটিতে রোদ বা সূর্যালোকের প্রখরতা অনুভূত হয় না।
- অরণ্যের আচ্ছাদন থাকায় মৃত্তিকাস্থিত জলও সূর্যালোকে বাষ্পীভূত হতে পারে না।
- উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং দাক্ষিণাত্য মালভূমির অভ্যন্তরভাগে অরণ্যভূমি বিশেষ না থাকায় ওইসব অঞ্চলের উষ্ণতা যথেষ্ট বেশি থাকে।
ভারতকে বৈচিত্র্যময় জলবায়ুর দেশ বলে কেন?
ভারত আয়তনে বিশাল, এর ভূপ্রকৃতিও বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতিতে জলবায়ুরও বৈচিত্র্য দেখা যায়, যেমন:
- উষ্ণতার পার্থক্য: গ্রীষ্মকালে যেখানে রাজস্থানের থর মরুভূমিতে উষ্ণতা বেড়ে 50 °সেলসিয়াস হয়ে যায়, তেমনি কাশ্মীরের লাদাখে শীতকালে তাপমাত্রা কমে গিয়ে -40 °সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়।
- উষ্ণতার প্রসর: যেখানে দক্ষিণ ভারতে বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর 4-6° সেলসিয়াস, সেখানে উত্তর ভারতে এই প্রসর প্রায় 20-25 °সেলসিয়াস।
- বৃষ্টিপাতের তারতম্য: মেঘালয় মালভূমির দক্ষিণে যেমন অতি বর্ষণে পৃথিবীর সর্বাধিক বর্ষণসিক্ত অঞ্চল তৈরি হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমে থর মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার জন্য মরুভূমি সৃষ্টি হয়েছে।
- বায়ুপ্রবাহ: ভারতে সাধারণভাবে শীতকালে উত্তর-পূর্ব এবং গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়, যা ভারতের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করলেও স্থানীয় বায়ুপ্রবাহের প্রভাবও রয়েছে। এদের মধ্যে গ্রীষ্মে লু, আঁধি, কালবৈশাখী, শরতে আশ্বিনের ঝড়, শীতে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা ভারতের জলবায়ুকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
ভারতে মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য লেখো।
ভারতের জলবায়ু বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যের অন্যতম কারণ হল মৌসুমি বায়ু। এর বৈশিষ্ট্য হল:
- শীতকালে যেদিক থেকে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় বর্ষাকালে তার বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত হয়।
- শীতকালে ভারতের উত্তর-পূর্বদিক থেকে প্রবাহিত শীতল-শুষ্ক মৌ
সুমি বায়ুর জন্য ভারতের তাপমাত্রা কমে যায়।
- গ্রীষ্মে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সাগর-মহাসাগর থেকে প্রচুর জলীয়বাষ্প বয়ে আনে এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে বৃষ্টিপাত ঘটায়, যার ফলে ভারতে বর্ষাকালের সূচনা হয়।
- ভারতের বেশিরভাগ বৃষ্টিই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু থেকেই হয়।
- অনিশ্চয়তা ভারতের মৌসুমি বায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টনের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাভাবিক উদ্ভিদের বৈচিত্র্য দেখা যায় এবং ভারতের শস্যবর্ষও মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাবর্তনের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে।
ভারতের বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
ভারতের বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
- বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন: ভারতের সর্বত্র বৃষ্টিপাত সমান নয়। পূর্ব হিমালয়, পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিমদিক, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রবল বৃষ্টিপাত হলেও রাজস্থান, জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম।
- ঋতু অনুযায়ী বৃষ্টিপাত: ভারতে সারাবছরই সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় 72% বর্ষাকালে, 10% গ্রীষ্মকালে, প্রায় 15% শরৎকালে এবং 3% শীতকালে হয়ে থাকে।
- বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা: মৌসুমি বৃষ্টিপাত সারাবছর সমানভাবে হয় না। তেমনি প্রতিবছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণও সমান নয়। কখনও অতিবৃষ্টিতে বন্যা আবার কখনও কম বৃষ্টিতে খরা ভারতের বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য।
- বৃষ্টিপাতের সাময়িক বিরতি: ভারতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হলেও স্থানভেদে বায়ুচাপ বলয়ের পরিবর্তন ঘটলে বৃষ্টিপাতের সাময়িক বিরতি ঘটে।
ভারতের অর্থনীতির ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব লেখো।
ভারতের অর্থনীতির ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব:
- কৃষির ওপর প্রভাব: ভারতীয় অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। এই কৃষিনির্ভর অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল বৃষ্টিপাত। ভারত যেহেতু মৌসুমি জলবায়ুর দেশ তাই ভারতীয় কৃষিতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। যথাসময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত হলে ভারতীয় কৃষি লাভবান হয়, আবার অন্যদিকে এই বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা ভারতীয় কৃষিতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে ভারতীয় অর্থনীতির ওপর। এখানে মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমনের ওপর নির্ভর করে শস্যবর্ষ তৈরি করা হয়।
- শিল্পের ওপর প্রভাব: কৃষিভিত্তিক শিল্পের ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব রয়েছে। পাটশিল্প, চাশিল্প, বস্ত্রবয়ন শিল্প, চিনি শিল্প প্রভৃতি শিল্পগুলি কৃষির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে বলে মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাবর্তন শিল্পে প্রভাব ফেলে। অতিবৃষ্টি বা খরা কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করে। তাই শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন কম হয়, এতে শিল্প উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর প্রভাব: দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুতে অধিক বৃষ্টিপাত হলে বন্যা দেখা যায়। আবার কোনো বছর স্বল্প পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলে খরা সৃষ্টি হয়। বন্যা বা খরা ফসল উৎপাদনে ও জীবনযাপনে অসুবিধা তৈরি করে যা আর্থিক উন্নতিতে বাধা দেয়। আবার যে বছর মৌসুমি বায়ু আগমন যথাযথ হয় সে বছর কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন ঘটে ও দেশের আর্থিক বিকাশ ঘটে।
মৌসুমি বায়ুর ওপর জেট বায়ুর প্রভাব ব্যাখ্যা করো।
ভারতে মৌসুমি বায়ুর ওপর জেট বায়ুর প্রভাবগুলি হল:
- মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি জেট বায়ুর দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত হয়।
- জেট বায়ুর কারণে ভারতে মৌসুমি বায়ুর আগমন অনিশ্চিত হয়।
- অনেক সময় এই আগমন নির্ধারিত সময়ের পূর্বে হয় এবং অনেক সময় বিলম্বিত হয়।
- ভারতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর উত্তরাভিমুখী গমন জেট বায়ুর দ্বারা ব্যাহত হয়।
- জেট বায়ু উত্তর ভারতের সমভূমি থেকে সম্পূর্ণ সরে গেলে তবেই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ সুনিশ্চিত হয়।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ও উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর পার্থক্য লেখো।
ভিত্তি | দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু | উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু |
---|---|---|
প্রবাহকাল | প্রধানত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অর্থাৎ চার মাস ভারতসহ দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। | প্রধানত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত অর্থাৎ তিন মাস ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। |
প্রবাহের দিক | এই বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। | এই বায়ু উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। |
প্রকৃতি | দক্ষিণের উষ্ণ জলভাগের ওপর দিয়ে আসে বলে এই বায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। | উত্তরের শীতল স্থলভাগের ওপর দিয়ে আসে বলে এই বায়ু শীতল ও শুষ্ক। |
প্রভাব | এই বায়ুর প্রভাবে সারা ভারতেই বৃষ্টিপাত হয়। | এই বায়ুর প্রভাবে দু-একটি অঞ্চল ছাড়া সারা দেশের আবহাওয়াই শুষ্ক থাকে। |
বৈশিষ্ট্য | এই বায়ু অত্যন্ত অনিয়মিত, অনিশ্চিত ও খামখেয়ালি, তাই এর মাধ্যমে প্রায়ই খরা বা বন্যা হয়। | মাঝে মাঝে শীতের তীব্রতায় কিছু কম-বেশি হলেও এই বায়ুকে যথেষ্ট নিয়মিত বলা যায়। |
অন্যান্য | দেশে খরিফ ফসলের উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে এই বায়ুর ওপর নির্ভরশীল। | দেশে রবি ফসলের উৎপাদন পুরোটাই এই বায়ুর ওপর নির্ভর করে। |
ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতের পূর্বদিকে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণ লেখো।
ভারতের আরব সাগরীয় উপকূলভূমির পূর্ব সীমায় উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রাচীরের মতো বিস্তৃত আছে পশ্চিমঘাট পর্বতশ্রেণি। আরব সাগরের ওপর দিয়ে আসা জলীয়বাষ্পপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এই পশ্চিমঘাট পর্বতশ্রেণির পশ্চিম ঢালে এসে সরাসরি আঘাত করে বলে পশ্চিম ঢালে প্রচুর পরিমাণে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি হয়। কিন্তু বৃষ্টি দেবার পর ওই বায়ু যখন পর্বত অতিক্রম করে পূর্ব ঢালে বা অনুবাত ঢালে পৌঁছোয় তখন বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ খুব কমে যায় এবং বায়ু পর্বতের ঢাল বরাবর ওপর থেকে নীচে নামে। ফলে তা ক্রমশ উন্নত হতে থাকে অর্থাৎ তার জলীয়বাষ্প গ্রহণ করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। এজন্য পশ্চিমঘাটের পূর্বদিকে বৃষ্টি কম হয়, এলাকাটি বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় ‘ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ’ এর ‘ভারতের জলবায়ু’ বিভাগের কিছু সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নাবলি আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন তাহলে আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাকে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জন যার এটি প্রয়োজন হবে তার সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।