মাধ্যমিক ইতিহাস – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ – বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

Mrinmoy Rajmalla

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতীয় সমাজে বিভিন্ন কারণে প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছিল। এই অধ্যায়ে আমরা সেই প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ করব।

প্রতিরোধ-ও-বিদ্রোহ-–-বৈশিষ্ট্য-ও-বিশ্লেষণ

ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর

ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন উপ বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত ইতিহস আলোচনা করো।

ভূমিকা – ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম একপর বৎসরে নানা প্রতিবাদ প্রতিরোধ ও বিদ্রে হয়েছে কোম্পানির সরকারকে। কোম্পানির শাসনের বিরু, কোল, ভীল, মুন্ডা, ওঁর প্র উপজাতিদের বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহগুলি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

কারণ – উপজাতিদের বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল –

  1. ঔপনিবেশিক ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা।
  2. পরদেশি মহাজন বণিক, জমিদার ও মধ্যস্বভূভোগী গোষ্ঠীর শোষণ।
  3. কোম্পানি কর্তৃক সমস্ত বনা লোকে খাস জমিতে পরিণত করে বনসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করলে উপজাতিদের মধ্যে গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি হয় যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিদ্রোহের মাধ্যমে।

বিদ্রোহ – উপজাতি বিদ্রোহগুলির মধ্যে চুয়াড় কোল, সাঁওতাল ও মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল উল্লেখযোগ্য যেগুলি অতিসংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

চূয়াড় বিদ্রোহ – ব্রিটিশ কোম্পানির সীমাহীন অর্থনৈতিক, শোষণ-অত্যচার ও নিপীড়নে অতিষ্ঠ হলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম জেলার চুয়াড়রা যে বিদ্রোহের সূচনা করে তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলে। বিভিন্ন সময়ে এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব প্রদান করেন জগন্নাথ ধল, বাদশার শ্যামগঞ্জন মাধব সিংহ, দুর্বল সিংহ (দুর্বল সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ সবচেয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করে), কোম্পানির সেনাবাহিনী নির্মম দমননীতির দ্বারা এই বিদ্রোহ মন করে।

কোলবিদ্রোহ – ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ। শাসনের বিরুদ্ধে যেসব আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটে তার অন্যতম| কোলবিদ্রোহ (১৮৩১-৩২ খ্রি:)। রাচি, হাজারিবাগ, সিংভূম, পালামৌ প্রভৃতি অঞ্চলে বুদ্ধ ভগৎ, জোয়া ভগৎ, ঝিন্দরাই মানদি সুইমুভার নেতৃত্বে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করলে ক্যাপ্টেন উইলকিনের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশবাহিনী বহু কোল উপজাতির নরনারীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এই বিদ্রোহ দমন করেন।

সাঁওতাল বিদ্রোহ – কোম্পানির শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য আদিবাসী ও উপজাতিদের দ্বারা সংঘটিত বিদ্রোহ গুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপজাতি বিদ্রোহ হল ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ৩০ জুন প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে জমায়েত হয়ে সিধু-কানহুর নেতৃত্বে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা করে ক্রমশ এই বিদ্রোহ ব্যপ্তি লাভ করে।

মুন্ডা বিদ্রোহ – ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডারা যে বিদ্রোহ করেছিল তা মুন্ডা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এটিই ছিল শেষ গুরুত্বপূর্ণ উপজাতি বিদ্রোহ।

১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা বিদ্রোহ, রাচি, হাজারিবাগ, সিংভূমের পার্বত্য অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। ব্রিটিশ সরকার তীব্র দমননীতি চালিয়ে বিরসা মুন্ডাকে গ্রেপ্তার করে এই বিদ্রোহ দমন করেন।

মূল্যায়ণ – চূয়াড়, কোল, সাঁওতাল, মুন্ডা এবং অন্যান্য উপজাতি বিদ্রোহগুলি ব্যর্থ হয়ে গেলেও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের জমি তৈরির ক্ষেত্রে এইসব আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। পরাধীন ভারতবর্ষে উপজাতি বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ, বীরত্ব পরবর্তী প্রজন্মের বিপ্লবীদের কাছে আলোর দিশারি হায়ে উঠেছিল।

চুয়াড় বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমিকা – ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কোম্পানির সীমাহীন অর্থনৈতিক শোষণ, অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে মেদিনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া, ঘাটশিলায় চু য়াড় উপজাতির কৃষককেরা ১৭৬৮ থেকে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় সাতবার যে বিদ্রোহ করেছিল তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরে শুরু হওয়া চুয়াড় বিদ্রোহ, দ্বিতীয় চূয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ – চুয়াড় বিদ্রোহের কারণগুলি হল –

জমি দখল – কৃষিকাজ ও পশুপালন চূয়াড়দের প্রধান জীবিকা ছিল। বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলের জমিদারদের ওপর অত্যন্ত চড়া হারে ভূমিরাজস্ব ধার্য করে। এর বিরুদ্ধে জমিদাররা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাদের পাইক চুয়াড়রাও সমগ্র জঙ্গলমহল জুড়ে বিদ্রোহ করে।

জীবিকা সমস্যা – সরকার কর্তৃক নিষ্কর জমি দখল চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। কেননা চুয়াড়দের অধিকাংশ জমি ছিল দখলিকৃত জমি। কোম্পানি জমি দখল করে নিলে তাঁরা জীবিকাহীন হয়ে পড়ে।

রাজস্ববৃদ্ধি – চুয়াড়দের অধিনে থাকা জমিতে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধি করলে চুয়াড়রা ক্ষিপ্ত হয়। কোম্পানি নিযুক্ত রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের সীমাহীন অত্যাচার এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

চুয়াড় বিদ্রোহের নানা পর্যায় ও নেতৃত্ব – চূয়াড় সম্প্রদায়ের মানুষেরা ১৭৬৮ থেকে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে সাতবার বিদ্রোহ করেছিল তার মধ্যে ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহ ও অচল সিংহের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ বড় আকার ধারণ করে।

বিদ্রোহের দমন – ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে ফলে মেদিনীপুরের শান্তি বিঘ্নিত হলে লর্ড ওয়েলেসলি দুটি সেনাদলের সাহায্যে সাড়াশি অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। বহু চূড়ায় বিদ্রোহীকে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। বিদ্রোহীদের গ্রেপ্তার করে তাদের ঘাঁটিগুলি জ্বালিয়ে, সেনাবাহিনী তাণ্ডব চালিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে এই বিদ্রোহ দমন করে।

অন্যদিকে বিভাজন নীতির আশ্রয় নিয়ে চুয়াড় ও পাইকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং জমিদারদের নানাভাবে আশ্বস্ত করে কৌশলে চুয়াড় বিদ্রোহের অবসান ঘটায়।

গুরুত্ব – চুয়াড় বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জমিদার ও তার অনুচরবর্গ এবং কৃষকদের বিদ্রোহ হলেও এই বিদ্রোহের প্রাণশক্তি ছিল নিপীড়িত কৃষক যাঁরা সমাজের নিম্ন বর্গের মানুষ। তাঁরা বুঝেছিল যে, জমিদারদের নিপীড়িতদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া অপেক্ষা ব্রিটিশ শাসনের অবসান বেশি জরুরি।

উপসংহার – জমিদার ও কৃষকরা মিলিত হয়ে এই বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিল যা অত্যন্ত বিরল ঘটনা। বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ ও ন্যায্য অধিকার রক্ষার সংগ্রাম পরবর্তীকালে য়া আরো বৃহত্তর সংগ্রামের দিশারি ছিল। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ বলেছেন যে চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল নিম্নশ্রেণির মানুষদের লি স্বতঃস্ফূর্ত অথচ ব্যাপক বিদ্রোহ।

সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ভূমিকা – ব্রিটিশ অনুসৃত ভূমি ব্যবস্থায় বিশেষত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কয়েক শতাব্দীর অধিকারভুক্ত জমি কোম্পানির হাতে চলে যায়। তখন সাঁওতালরা হাজারিবাগ মানভূম থেকে রাজমহলের পার্বত্য সমতল ভূমিতে এসে সেখান জঙ্গলাবৃত অঞ্চল পরিষ্কার করে বসবাস ও কৃষিকাজ শুরু করে। অঞ্চলটির নাম হয় দামিন-ই কোহ বা মুক্ত অঞ্চল। স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এখানে তারা মুক্ত জীবন ভোগ করবে। সেখানে তারা জমিদার, মহাজন, বহিরাগত ব্যবসায়ী ও ইংরেজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিহারের রাজমহল থেকে বাংলার মুরশিদাবাদ অবধি অঞ্চলে সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়।

লক্ষ্য – সাঁওতাল বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল সাঁওতাল রাজ প্রতিষ্ঠা। বহিরাগত দিকুদের উচ্ছেদ, জমিদারি অত্যাচার ও ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদই ছিল সাঁওতালদের লক্ষ্য।

বিদ্রোহের শুরু – ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন সিধু কানহুর নেতৃত্বে প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল নরনারী ভাগনাডিহির মাঠে জমায়েত হয়ে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা নেন। অত্যাচারী দারগা মহেশলাল দত্তকে হত্যার মাধ্যমে এই বিদ্রোহ শুরু হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিধু
সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিধু

বিদ্রোহের নেতৃত্ব ও ব্যাপ্তি – বিদ্রোহীরা সিধু, কানই ডোমনমাঝি, চাদ, ভৈরব, কালো প্রামাণিকের নেতৃত্বে মহাজনদের আড়ৎ, বণিকদের বাড়ি, নীলকুঠি ও জমিদারের কাছারী আক্রমণ করে। রেলস্টেশন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে। এভাবে রাজমহল থেকে মুরশিদাবাদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সবশেষে বিদ্রোহীরা তীর, ধনুক, বল্লম সম্বল করে কলকাতা দখলের উদ্দেশ্যে দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়ে। মুরশিদাবাদ, বীরভূমে প্রাদুড় ও সাঁওতাল পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজবাহিনী পর্যদস্তু হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানী প্রচন্ড দমন পীড়নের মাধ্যমে এই বিদ্রোহ দমন করে (১৮৫৬ খ্রি.)।

সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি – প্রশাসনের সমর্থক ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা একে নিছক বর্বরদের স্থানীয় বিদ্রোহ ও আদিম ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ বলেছেন। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা একে দেশীয় শোষণ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক গণসংগ্রাম তথা শ্রমজীবীদের প্রতিরোধ হিসেবে দেখেছেন।

ফলাফল – এই বিদ্রোহের ফলে –

  • সরকার সাঁওতাল পরগণা নামে একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি করে সেখানে সাঁওতালদের আইন-কানুন চালু করে।
  • সাঁওতালদের উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং মিশনারি ছাড়া সমতলের লোকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়।
  • সাঁওতাল মোড়লদের ক্ষমতা স্বীকার করা হয়। সর্বত্র একই ধরনের ওজন বিধি চালু হয়।

উপসংহার – শোষণ, নিপীড়ন অত্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাঁওতাল বিদ্রোহের মধ্যে ছিল সুসংঘবদ্ধ রাজনৈতিক চেতনার উপকরণ। একইসঙ্গে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক মহাজন, বণিকদের যৌথ শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে সাঁওতাল সমাজ যে সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল তা অভূতপূর্ব। ব্যাপ্তিতে ক্ষুদ্র ও বিক্ষিপ্ত হলেও সাঁওতাল বিদ্রোহের মধ্যে শোনা গিয়েছিল প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পদধ্বনি। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় তাই সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত’ বলেছেন।

মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

ভূমিকা – বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা উপজাতির মানুষদের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ ও অসন্তোষের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হল মুন্ডা বিদ্রোহ। মুন্ডারা ছিল অত্যন্ত সহজ, সরল কৃষিজীবি মানুষ। তাঁরা বিশ্বাস করতেন তারাই হল জমির সত্যিকারের মালিক। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হলে মুন্ডা উপজাতিদের জমি থেকে উৎখাত করতে থাকলে (১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে) মুন্ডারা বিদ্রোহের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

মুক্তা বিদ্রোহের কারণ – মুন্ডা বিদ্রোহের কারণগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে –

জমির ওপর অধিকার হারানো – মুন্ডা উপজাতির মানুষেরা প্রায় সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী ও নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে বাইরের থেকে লোভী মানুষেরা মুন্ডাদের জমি জায়গা কুক্ষিগত করে নিতে থাকে এবং মুন্ডাদের বিতাড়িত করে সেই জমিগুলি দখল করে নিলে মুন্ডারা বিক্ষুব্ধ হয়।

খুঁৎকাঠি প্রথার অবসান – ভারতের আদিমতম মুন্ডাদের ঐতিহ্যবাহি একটি প্রথা ছিল খুঁৎকাঠি প্রথা; যার অর্থ হল জমির তরঙ্গ ওপর যৌথ মালিকানা। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হলে মুন্ডাদের খুঁৎশক্তি প্রথার অবসান ঘটিয়ে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করলে মুন্ডারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

নতুন আইনবিধি – অতি প্রাচীনকাল থেকেই মুন্ডারা ছিলেন তাদের ঐতিহ্যবাহী মুন্ডারি, আইন, বিচার ও সামাজিক ব্যবস্থার ধারক ও বাহক। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হলে মুন্ডাদের সেই চিরাচরিত ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে নতুন ধরনের আইন প্রবর্তন করলে মুন্ডারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

ধর্মান্তরিতকরণ – ভারতে ইংরেজদের আগমনের সাথে সাথে খ্রিস্টান মিশনারিরাও এদেশে এসেছিলেন। তাঁরা হলে, বলে, কৌশলে, লোভ দেখিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মভীরু মুন্ডাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে থাকলে মুন্ডা সমাজ বিদেশিদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়।

বেগার শ্রম – নিরীহ মুন্ডাদের দিয়ে সরকারি কর্মচারী, জমিদার, মহাজন বিনা মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করত। দিনের পর দিন তারা মুখ বুঝে বেট বেগারি অর্থাৎ বেগার খেটে অবশেষে বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।

বিরসামুণ্ডার ভূমিকা – ধর্মপ্রচারক হিসেবে জীবন শুরু করলেও বিরসা মুন্ডার সংস্কারমূলক বিবিধ ব্যবস্থা, হীনমন্যতাকে দূর করে মুন্ডাদের মাথা উঁচু করে বাঁচার শিক্ষা মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

এছাড়াও মহাজন, জমিদার, জায়গিরদার, ঠিকাদার, চা ব্যবসায়ীদের মিথ্যা প্রলোভন ও শোষণ এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

ফলাফল – মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী কারণ –

  • এর ফলে মুন্ডাদের জমিতে খুঁংকাঠি স্বত্ব পুনঃপ্রবর্তিত হয়।
  • ব্রিটিশ ছোটোনাগপুর অঞ্চলের জন্য ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ত্ব আইন পাস করে। এবং এখানের জন্য আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বেট বেগারি নিষিদ্ধ হয়।
  • বিরসা সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

উপসংহার – পরাধীন ভারতবর্ষে মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং মুন্ডাজাতির সার্বিক মুক্তির জন্য বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডারা যে আত্মত্যাগ ও বীরত্ব দেখিয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনায় মুন্ডা বিদ্রোহ তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও পরাধীন ভারতে বিশেষত ছোটোনাগপুরে মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বিরসার নেতৃত্বে মুন্ডারা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নমুনা রেখেছেন।

সন্ন্যাসী – ফকির বিদ্রোহের (১৭৬৩-১৮০০) কারণ ও ব্যর্থতার কারণগুলি আলোচনা করো।

অথবা, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ভূমিকা – কোম্পানির শাসনের প্রথম দিকে কৃষিজীবী হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলমান ফকিরদের নেতৃত্বে বাংলা-বিহারের কিছু অঞ্চল জুড়ে যে বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল, তা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের ব্যাপ্তি ছিল দীর্ঘ চল্লিশ বছর (১৭৬০-১৮০০ খ্র.)। এটি ছিল কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ বিদ্রোহ। বাংলা-বিহারের দরিদ্র কৃষকেরা অন্ন ও বস্ত্রের জন্য সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের ধ্বজা তোলে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ – সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের প্রধান প্রধান কারণগুলি হল –

কোম্পানির উচ্চহারে রাজস্ব বৃদ্ধি – ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধার্য করা অত্যধিক রাজস্ব বৃদ্ধি কৃষিজীবি সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ক্ষুদ্ধ করে তোলে।

তীর্থকর – সন্ন্যাসী ও ফকিররা মাঝে মাঝে ইচ্ছেমতো দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে গেলে সরকার থেকে তাদের ওপর তীর্ণকর আদায় করা হয়। এতে সন্ন্যাসী ও ফকিররা ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে।

কোম্পানির কর্মচারীদের জুলুম – ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে অনেকেই রেশম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কোম্পানির কর্মচারিরা তাদের এই ব্যবসাতে নানাভাবে জুলুম ও বাধা প্রদান করত।

মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ ও অত্যাচার – কোম্পানির কর্মচারী ছাড়াও ইজারাদার, পত্তনিদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের শোষণ-অত্যাচার সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

নেতৃত্ব ও ব্যাপ্তি – এইসব অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সর্বপ্রথম সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়। ক্রমশ তা দাবানলের মতো মালদহ, রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। অত্যাচারিত ও নির্যাতিত দরিদ্র কৃষক, মুষল সেনাবাহিনীর বেকার সৈন্য এবং সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বিভিন্ন সম্প্রদায় এই বিদ্রোহে অংশ নেয়। ভবানী পাঠক, মজনু শাহ, দেবী চৌধুরানি, চিরাগ আলি, মুসশাহ প্রমুখরা ছিলেন এই বিদ্রোহের নায়ক। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এই বিদ্রোহে অংশ নেয়।

মূল্যায়ণ – সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ছিল কোম্পানির শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রথম বিদ্রোহ। বিদ্রোহীরা হিন্দু ও মুসলমানদের এক ছাতার তলায় এনে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিল। ওয়ারেন হেস্টিংস এই বিদ্রোহার যতই ‘পেশাদার ডাকাতের উপদ্রব’ বলে অভিহিত করুক না কেন, এডওয়ার্ড উইলিয়াম হান্টারের মতে, এটি ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ।

ওয়াহাবি আন্দোলনের ওপর একটি প্রবন্ধ লেখো।

ভূমিকা – উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও আজিজ কুসংস্কার দূর করে মহম্মদ প্রদর্শিত পথে ইসলামকে নতুন রূপে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। এরপর। রায়বেরিলীর সৈয়দ আহম্মদ ভারতে প্রকৃত অর্থে ওয়াহাবি আদর্শে শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেন। শীঘ্রই তা ব্রিটিশ বিরোধী। হয়ে ওঠে। বাংলার তিতুমিরের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ধর্মীয় আর্থ-সামাজিক ও শেষে ব্রিটিশ বিরোধী চেহারা পায়।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য – ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও ইসলামধর্মের কুসংস্কার দূর করে তারিখ-ই-মহম্মদিয়া প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। ক্রমেই তা ব্রিটিশ বিরোধী। # রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এছাড়াও এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল অত্যাচারী সামন্তদের শোষণ থেকে কৃষকদের মুক্ত করা, নিম্নবর্গের মানুষদের আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত করা এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন ও সরকারি উচ্চপদ। গুলিতে ইংরেজদের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরোধিতা করা।

ওয়াহাবি আন্দোলনে সৈয়দ আহমদের ভূমিকা – শাহ ওয়ালিউল্লাহ ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করলেও এই আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলীর সৈয়দ আহম্মদ (১৭৬৬-১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ভারতের নানা স্থানে বিশেষ করে কলকাতায় আবদুল ওয়াহাবের বাণী প্রচার করেন। পাটনায় ওয়াহাবিদের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেন। চার খলিফা বা আঞ্চলিক শাসকদের মাধ্যমে ভারতে এর সংগঠন বিস্তৃত হয়। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জেহাদের মাধ্যমে তিনি ভারতকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করতে চান। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে তার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে শিখদের বিরুদ্ধে বালা কোটার যুদ্ধে তার মৃত্যু হয়।

বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিতুমির। মহাজন, জমিদার, নীলকর ও তাদের সহযোগী ইংরেজদের অত্যাচার ও দমননীতির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। নারকেলবেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লায় সদর দপ্তর স্থাপন করে। আশপাশের জমিদারদের কাছে কর দাবি করেন। ইংরেজ শাসনের অবসানের কথা ঘোষণা করে নিজেকে বাদশাহ রূপে তুলে ধরেন। শেষপর্যন্ত ইংরেজ সেনাবাহিনীর দমনের আঘাতে বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয় ও তিনি বীরের মতো প্রাণ বিসর্জন দেন যা ইতিহাসে বারাসত বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত।

আন্দোলনের প্রসার – ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল বিহারের পাটনা। এনায়েৎ আলি ফরিদপুর, নদিয়া, রাজশাহী ও পাটনায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। বারাসত, যশোহর, ঢাকা, ফরিদপুর, রাঘবগঞ্জ, নদিয়া, পাবনা, রংপুর, নোয়াখালি, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা ও শ্রীহট্টে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।

ব্যর্থতার কারণ – এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ব্যর্থতার কারণগুলি হল –

গঠনমূলক কর্মসূচীর অভাব, উপযুক্ত সংগঠনের অভাব, ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও ক্রমশ এই আন্দোলনের রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করা, হিন্দু সমাজে যোগদান না করা। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব, অভিজাত শ্রেণির সাহায্য না পাওয়া, সরকারের দমননীতি ও বিভেদ নীতি।

প্রকৃতি বা চরিত্র – তিতুমিরের জীবনীকার বিহারীলাল সরকারের মতে, বহু হিন্দু তিতুমিরের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। আবার বহু মুসলিম ভূস্বামীরাও ওয়াহাবিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুতরাং তিতুমিরের সংগ্রাম ধর্মকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও ক্রমশ তা সংকীর্ণ ধর্মীয় সীমারেখা অতিক্রম করে দরিদ্র মানুষের জমিদার ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদী সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে।

গুরুত্ব – পরবর্তী আন্দোলন গুলির উপর ওয়াহাবি আন্দোলনের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। এই আন্দোলনের হাত ধরেই সর্বপ্রথম মুসলিম সমাজের সংস্কার শুরু হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মতাদর্শ গড়ে তুলে এটি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে, যা আগামী দিনের নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল।

ফরাজি আন্দোলনের ওপর একটি প্রবন্ধ রচনা করো।

ভূমিকা – ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরাজি আন্দোলন হল এই রকমই একটি কৃষক বিদ্রোহ।

আন্দোলনের উৎপত্তি – পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর নিবাসী হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ ছিলেন ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক। তিনি মুসলিম ধর্ম সংস্কার রূপে এই আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষকে দার-উল-হারব বলে অভিহিত করেন। তিনি ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম আদর্শের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে বাংলাদেশকে ‘দার-উল-ইসলাম’-এ পরিণত করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই বিদ্রোহ কৃষক বিদ্রোহের চরিত্র নেয়।

আদর্শ – এই আন্দোলনের মূল আদর্শ ছিল

  1. ইসলাম আদর্শ বিরোধী সকল আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ও কুসংস্কার বর্জন করা
  2. ইসলামের সাম্যের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করা
  3. ভারতবর্ষকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করা।

উদ্দেশ্য – কোরানের পবিত্র আদর্শ অনুসরণ করে চলা, ইসলামীয় ভাবধারার পুনরুজ্জীবন করা, জমিদারদের শোষণের হাত থেকে কৃষকদের মুক্ত করা, ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা, জমিদার মহাজনের বিরোধিতা করা, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই আন্দোলনের লক্ষ্য। ‘শরিয়ৎ উল্লাহের প্রভাবে শুধুমাত্র মুসলিম কৃষকেরাই নয় বহু হিন্দুরাও ফরাজি আন্দোলনকে সমর্থন করে। এভাবে ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা প্রভৃতি জেলায় এই আন্দোলন বিস্তার লাভ করে।

দুদু মিঞার ভূমিকা – ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে শরিয়ৎ উল্লাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা (মহম্মদ মহসীন) ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি বাহাদুরপুরে প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে, লাঠিয়াল ও গুপ্তচর বাহিনী গঠন করেন। তাঁর প্রভাবাধীন এলাকাকে কয়েকটি হল্কায় বিভক্ত করে খলিফা নিয়োগ করে, জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে ফরাজি আন্দোলনকে ধর্মীয় আন্দোলন থেকে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে উন্নীত করেন।

আতঙ্কিত জমিদার, মহাজন, নীলকরদের চাপে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে, ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞাকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রমাণাভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হলে ফরাজি আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। দুদু মিঞার মৃত্যুর পর তার পুত্র নোয়ামিঞা এই আন্দোলনে ধর্মীয় আদর্শকে গুরুত্ব প্রদান করলে এর গুরুত্ব কমে যায়।

প্রকৃতি – ফরাজি আন্দোলন ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও ক্রমশ তা জমিদার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। অধিকাংশ জমিদাররাই ছিল হিন্দু। তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ফরাজি আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে ই হিন্দু বিরোধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল না, কারণ এই আন্দোলনে মুসলমান কৃষকদের পাশাপাশি বহু হিন্দু কৃষকও শামিল হয়েছিল। তাই এই আন্দোলনকে হিন্দু বিরোধী আন্দোলন না বলে নিপীড়িত কৃষকদের শোষণের হাত থেকে মুক্তির আন্দোলন বলাই শ্রেয়।

ব্যর্থতার কারণ – দুদু মিঞার মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া সাধারণ লোককে জোর করে দলভুক্ত করা, অর্থ আদায়, সরকারি দমননীতি প্রভৃতি কারণে ফরাজি আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়।

গুরুত্ব – ফরাজি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক আন্দোলন হিসেবে এই আন্দোলন ছিল। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনে কেবল মুসলমানরাই নয় হিন্দু, কৃষকরাও যুক্ত হয়েছিলেন। ড. অভিজিৎ দত্ত বলেছেন, ফরাজিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ করতে না পারলেও বাংলা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ কামনা করেছিল।

নীলবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

ভূমিকা – ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নীলচাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অমানুষিক অত্যাচার ও নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে নীলচাষিদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনকে নীলবিদ্রোহ বলা হয়।

নীলচাষ ও নীলকুঠির খন্ডচিত্র
নীলচাষ ও নীলকুঠির খন্ডচিত্র

নীলবিদ্রোহের কারণ –

নীলচাষের পদ্ধতি – নীলকররা জমিদারদের মোটা টাকা নি দিয়ে দীর্ঘদিনের জন্য জমি ভাড়া নিয়ে ভাড়াটিয়া শ্রমিকদের ড দিয়ে নীলচাষ করাত তাকে বলা হয় ‘এলাকা চাষ’। এই চাষে সমস্যা ছিল গরীব চাষিদের নিরক্ষতার সুযোগ নিয়ে য কম টাকা দাদন দিয়ে বেশি টাকার চুক্তি করে তাদের দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত।

নীলকর সাহেবদের অত্যাচার – নীলকররাই ছিল ক কৃষকদের প্রতিপক্ষ। নীলকরদের অত্যাচার, লুণ্ঠন, শোষণ, দৌরাত্ম, ব্যভিচার লাম্পট্য ছিল এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

নীলকরদের সরকারি সমর্থন – ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে শ্বেতাঙ্গদের জমি কেনার অধিকার দেওয়া হয়। তারও আগে সরকার দাদনি প্রথাকে সমর্থন জানালে তীব্র জনরোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একাদশ আইনে দাদন গ্রহণকারী কৃষকদের যে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হয়।

দস্তুরি প্রথা ও নীলের কম দাম প্রদান – নীলর দেওয়ার সময় দাদনের কিস্তি ও সুদের টাকা নীলকররা কে রাখত। একে বলা হত দস্তুরি প্রথা। রায়তদের উৎপাদিত নীলের দাম দেওয়া হত ২ টাকা ৮ আনা অথচ সেই নীলের বাজার দর ছিল ১০ টাকা অর্থাৎ প্রতি কেজি নীলে কৃষকদের ৭ টাকা ৮ আনা ঠকানো হত।

পঞ্চম আইন – লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম আইন পাস করেন। এই আইনে বলা হয় দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তা বে-আইনি বলে গণ্য হবে এবং অপরাধির জেল হবে।

পক্ষপাতদুষ্ট বিচারব্যবস্থা – নীলকরদের বিরুদ্ধে সরকারি আছালনে নালিশ করার উপায় ছিল না। নালিশ করলেও শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটরা স্ব-জাতীয় শ্বেতাঙ্গ নীলকরদের প্রতি পক্ষপাত দেখাতেন। মফসসলে ভারতীয় বিচারকরা শ্বেতাশ নীলকরদের বিচার করতে পারত না।

এছাড়াও নীলকরদের নিষ্ঠুরতা, তাদের তৈরি লাঠিয়াল, পাইক বরকন্দাজ বাহিনীর অত্যাচার, নীলচাষিদের বন্দি করে। খাদ্যজল বন্ধ করে দেওয়া, এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

দ্বিতীয় অংশ –

নীল বিদ্রোহের ফলাফল – নীল বিদ্রোহের ফলে —

নীল কমিশন গঠন – ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠিত হয়। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে অষ্টম আইন দ্বারা ‘নীলচুক্তি আইন’ রদ করে নীলচাষকে চাষিদের ইচ্ছাধীন করা হয়। নীলকররা নীলচাষ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। কৃষকদের জয় প্রতিষ্ঠা হয়, বাঙালি জাতির মনোবল বৃদ্ধি পায়, পরোক্ষভাবে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়।

মহাজনদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা – Blaim Kling তাঁর Blue Mutiny গ্রন্থে দেখান যে, নীলকর সাহেবদের পতনের ফলে নিম্নবঙ্গের কর্তৃত্ব সুদখোর মহাজনদের হাতে চলে যায়। ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরি এই মতের অসারতা প্রমাণ করেছেন।

কৃষক ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ঐক্য – নীল বিদ্রোহের ফলেই বাংলায় কৃষক জমিদার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল — এই বিদ্রোহ বাঙালির শিরায় স্বাধীনতার উয় শোণিত প্রবাহিত করে। লর্ড ক্যানিং মহাবিদ্রোহের থেকেও নীলবিদ্রোহকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।

নীলবিদ্রোহের সাফল্যে বাংলার কৃষককুল অসাধারণ নৈতিক শক্তিলাভ করে। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির শাসনের অবসানের পর নীলবিদ্রোহ ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ গণবিদ্রোহ। অমৃতবাজার পত্রিকায় শিশির কুমার ঘোষ লেখেন যে, নীলবিদ্রোহই সর্বপ্রথম ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল।

মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় উপজাতিদের প্রথম সংগঠিত প্রতিরোধ। এই বিদ্রোহের ফলে মুন্ডাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও ঐক্যবদ্ধতার উন্মেষ ঘটে। এই বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে প্রস্তুত করে।

JOIN US ON WHATSAPP

JOIN US ON TELEGRAM

Please Share This Article

About The Author

Related Posts

মাধ্যমিক - ভূগোল - বারিমন্ডল - জোয়ার ভাটা - রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর

মাধ্যমিক – ভূগোল – বারিমন্ডল – জোয়ার ভাটা – রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর

Class 10 English – The Passing Away of Bapu – About Author and Story

Class 10 English – The Passing Away of Bapu – About Author and Story

The Passing Away of Bapu

Class 10 English – The Passing Away of Bapu – Question and Answer

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

Trending Now

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Class 9 – English Reference – Tom Loses a Tooth – Question and Answer

Class 9 – English Reference – The North Ship – Question and Answer

Class 9 – English – His First Flight – Question and Answer

Class 9 – English – A Shipwrecked Sailor – Question and Answer