মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার – বৈশিষ্ট ও পর্যালোচনা – ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ও সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। এই যুগকে “নবজাগরণ” বা “আধুনিক যুগ” বলেও অভিহিত করা হয়। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, আইন, এবং সমাজব্যবস্থায় সংস্কারের দাবী ওঠে। এই সংস্কার আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য এবং প্রভাবগুলি বোঝার জন্য, নিম্নলিখিত ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নগুলি বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ

Table of Contents

উনিশ শতকের নারীকল্যাণে বামাবোধিনী পত্রিকার অবদান আলোচনা করো।

ভূমিকা –

উনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলা তথা ভারতবর্ষের সমাজজীবনে শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্থবিরতা ছিল। বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশিরা কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও তা ছিল শুধুমাত্র বালকদের জন্য। সামাজিক ও পারিবারিক কারণে বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটজনক। এই দুরবস্থা থেকে নারীদের উদ্ধারের কাজে বামাবোধিনী পত্রিকা প্রচার চালায়। এই পত্রিকাই হল নারীদের জন্য বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম মাসিক পত্রিকা।

প্রকাশকাল – ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে বামাবোধিনী পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়।

প্রকাশক – বামাবোধিনী পত্রিকা – র প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত।

বামাবোধিনী পত্রিকা'-র একটি পৃষ্ঠা

অবদান –

নারীশিক্ষা –

বামাবোধিনী পত্রিকা নারীশিক্ষার উপর জোর দিয়েছিল। কারণ পত্রিকাটি ছিল ব্রাহ্মসমাজের। ব্রাহ্মসমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিরা ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে নারীকল্যাণের বিষয়টি চিন্তা করেছিলেন। তারা মনে করতেন, সমাজের অর্ধেক অংশ যে নারীরা, তাদের অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে বাকি অর্ধেক অংশের উন্নতি হতে পারে না।

বাড়িতে লেখাপড়া – বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম থাকায় এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বাড়ির মধ্যে লেখাপড়া করার জন্য বামাবোধিনী পত্রিকা – য় পরামর্শ দেওয়া হয়। এই পত্রিকা নারীশিক্ষার জন্য সংক্ষিপ্ত পাঠ্যক্রমের প্রস্তাব করে। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষদের দায়িত্ব গ্রহণেরও প্রস্তাব দেয়। পত্রিকার প্রথম পাতায় তাই কন্যায়েব পালনীয়া – এই সংস্কৃত শ্লোকটি লেখা থাকত।

বিদ্যালয়ে লেখাপড়া – এসময় বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ে সংকট দেখা দিলে পত্রিকাটি সমবেদনা প্রকাশ করে। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের একটি সংখ্যায় পত্রিকাটি লিখেছিল, আমরা শুনিয়া দুঃখিত হইলাম যে এ দেশের সর্বপ্রধান বেথুন বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৩০টি মাত্র ছাত্রী অধ্যয়ন করিতেছে। ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার তথ্য উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থের অপচয় ও ছাত্রীসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ঘটনায় পত্রিকা দুঃখ প্রকাশ করে।
মিশনারিদের উদ্যোগে যেসব বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে প্রতি মাসে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা – র প্রকাশিত সংখ্যা পাঠানো হত। এভাবে শিক্ষাপ্রসারে এই পত্রিকা উৎসাহ দেয় এবং নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করে।

নারীসমাজের সংস্কার –

বামাবোধিনী পত্রিকা তৎকালীন সমাজের কুসংস্কার দূর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই পত্রিকা সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অসম বা বার্ধক্য বিবাহের বিরোধিতা করেছিল। পাশাপাশি অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ প্রভৃতি প্রগতিশীল সংস্কারের সমর্থক ছিল।

আদর্শ অনুসরণ – বামাবোধিনী পত্রিকা বাঙালি নারীদের সামনে গার্গী, মৈত্রেয়ীর মতো বিদুষী নারীদের আদর্শ তুলে ধরে। পত্রিকায় লেখা হয়, সেই সুদূর অতীতে নিজ নিজ চেষ্টায় এইসব নারীরা জ্ঞান অর্জনে ব্রতী ছিলেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁরা যেভাবে পারদর্শিতা লাভ করেন, তাঁদের অনুসরণ করেই বাঙালি নারীদেরও শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে আসা দরকার।

আচার-অনুষ্ঠান পালন – বাংলা হিন্দুসমাজে যেসব মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল সেগুলি পালনের কথা পত্রিকায় লেখা হত। যেমন- ভাইফোঁটা, রাখিবন্ধন, বিভিন্ন ব্রত প্রভৃতি। নারীদের এই অনুষ্ঠান পালন করতে বলার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠান বিষয়ক বিভিন্ন কথা ও কাহিনি লেখা হত। এগুলির উৎপত্তি ও গুরুত্বের কথাও থাকত সেই লেখায়।

বামাবোধিনী পত্রিকায় রোগ নিরাময় সংক্রান্ত লেখা।

বামাবোধিনী পত্রিকার সীমাবদ্ধতা –

এই পত্রিকা উনিশ শতকে বাংলার নারীসমাজের উন্নতির চেষ্টা করলেও তার বহু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন –

  • এই পত্রিকা প্রচারিত হয় মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দু নারীদের মধ্যে।
  • পত্রিকা প্রচারিত হত কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে। ফলে গ্রামাঞ্চলের নারীদের কল্যাণ পত্রিকায় স্থান পায়নি।
  • পত্রিকার পাঠিকাসংখ্যা সীমিত ছিল।

মূল্যায়ন –

সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয়, ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ বাংলা নারীকল্যাণে যে উদ্যোগ নিয়েছিল সমকালে আর কোনও পত্রিকা অনুরূপ উদ্যোগ নেয়নি। শিক্ষাপ্রসারে নারীসমাজকে সচেতন করার ক্ষেত্রে তাই এই পত্রিকার অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

বামাবোধিনী পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের নারী সমাজ সম্পর্কে কী জানা যায়?

ভূমিকা – রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক উভয় গোষ্ঠীর লেখক-লেখিকা বামাবোধিনী পত্রিকায় ধর্ম, নীতিবিজ্ঞান, ইতিহাস, গৃহচিকিৎসা, শিশুপালন, স্ত্রী শিক্ষা, প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা করেন। এই পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল নারী উন্নয়ন।

নারী সমাজের অবস্থা : বামাবোধিনী থেকে নারী সমাজের অবস্থা যেভাবে জানা যায় তা হল-

কুপ্রথার অস্তিত্ব : নারী সমাজে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। সতীদাহ প্রথার চল না থাকলেও বিধবা বিবাহ প্রথার প্রসার তেমন ঘটেনি। সমাজে নারীর মর্যাদাও খুব বৃদ্ধি পায়নি।

বামাবোধিনী পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের নারী সমাজ সম্পর্কে কী জানা যায়?

সম্পত্তির অধিকারহীনতা – অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নারীরা ছিল পরাধীন। বিবাহকালে পিতৃদত্ত’ ও ‘ভ্রাতৃদত্ত যৌতুক এবং মাতৃদত্ত ‘স্ত্রীধন’ (মূলত অলংকার) ব্যতীত সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ছিল না।

শিক্ষার দাবি – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নারী সমাজে শিক্ষার প্রসার ঘটতে শুরু করে। অনেকেই যুক্তি দিয়েছিলেন যে, নারী সুশিক্ষিতা হলেই সুগৃহিনী, সুপত্নী ও সুমাতা হওয়া সম্ভব। বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কন্যার প্রতি মাতার উপদেশ’ বা ‘স্ত্রীলোকদিগের বিদ্যাশিক্ষার আবশ্যিকতা’ নামক রচনা থেকে একথা জানা যায়।

পেশাজীবী নারী – বালিকা বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের একাংশ শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষকতা বা ডাক্তারির পেশায় যোগ দেয়। উদাহরণরূপে চন্দ্ৰমুখী বসু, কুমুদিনী খাস্তগীর, কামিনী সেন এবং কাদম্বিনী গাঙ্গুলির কথা বলা যায়।

উপসংহার – বামাবোধিনী পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত নারী সমাজের চিত্র ছিল কলকাতা ও বাংলার বিভিন্ন শহরকেন্দ্রিক। উপরন্তু নারী সমাজ সংক্রান্ত রচনায় হিন্দু সমাজ অধিক গুরুত্বলাভ করেছিল।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলার কী ধরনের সমাজচিত্র পাওয়া যায়?

ভূমিকা –

যেসব সংবাদপত্র থেকে উনিশ শতকের বাংলা সমাজের প্রতিফলন পাওয়া যায় সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা। এই পত্রিকা থেকে সামাজিক শোষণ, সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীলকর সাহেবদের অত্যাচার প্রভৃতি বিষয়ে জানা যায়।

প্রকাশকাল ও প্রকাশক –

১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি কলকাতার জনৈক ব্যাংকার মধুসূদন রায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশ করেন। তখন গিরীশচন্দ্র ঘোষ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটি প্রথমে ইংরেজি সাপ্তাহিক ছিল, পরে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ তা দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হয়।

সামাজিক প্রতিফলন –

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার সমাজজীবনে ঘটা গুরুত্বপূর্ণ সকল ঘটনার প্রতিফলন দেখা যায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়। উদীয়মান মধ্যবিত্তশ্রেণির চরিত্র, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে এই পত্রিকায়। পত্রিকাটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হত এবং পত্রিকার পাঠকরা ইংরেজি – শিক্ষিত ছিলেন – যা সমাজের একটি আলোকিত গোষ্ঠীর (elite)অস্তিত্বের পরিচয় দেয়। গিরীশচন্দ্র ঘোষ এ পত্রিকাটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র ছিল। জমিদার শ্রেণির এই সমিতিটি সর্বদাই মধ্যবিত্তশ্রেণির স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট ছিল।

গিরীশচন্দ্র ঘোষ

অর্থনৈতিক প্রতিফলন –

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। চিরস্থায়ী ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, রাজস্বের চড়া হার, জমিদারি শোষণ ও অত্যাচার, কৃষিজীবীদের অভাব-অভিযোগ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

রাজনৈতিক প্রতিফলন –

আন্দোলনে সমর্থন – এই পত্রিকার মাধ্যমে ভারতবাসীর রাজনৈতিক মতামত প্রতিফলিত হয়। যথা – এই পত্রিকা প্রকাশের কিছুদিন পরেই সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটে (১৮৫৫ খ্রি.)। বিদ্রোহের খবর এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়। এর অল্পকাল পর সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) ঘটে। এই বিষয়ে পত্রিকায় বিভিন্ন নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তারপর বাংলায় নীলচাষিদের আন্দোলন দেখা দেয়। তখন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর চেষ্টায় নীলচাষিদের আন্দোলনের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকা এই ঘটনাগুলিকে সমর্থন জানায়।

সরকারি নীতির বিরোধিতা ও সমর্থন – এই পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসী সরকারি নীতির বিরোধিতা করে। বড়োলাট লর্ড লিটন ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক। তিনি সরকারের সমালোচনা বন্ধ করার জন্য ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন (Vernacular Press Act) জারি করেন। এর দ্বারা সরকারি নীতির সমালোচক, দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদক, মুদ্রাকর ও ছাপাখানার মালিকের কারাবাসের ব্যবস্থা করা হয়। হিন্দু প্যাট্রিয়ট এর প্রতিবাদ জানায়। • সরকার ইমিগ্রেশন বিল পাস করে আসামের চা-বাগানে বিহার থেকে শ্রমিক সরবরাহের ব্যবস্থা করে। পত্রিকা এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে। • উদারবাদী বড়োলাট লর্ড রিপন বিচারব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করার জন্য ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইলবার্ট বিল তৈরি করেন। এর প্রতিবাদে ইংরেজরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা বিলকে সমর্থন জানিয়ে পালটা আন্দোলন করে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা জাতীয়তাবাদী মতকে সমর্থন জানায়।

সীমাবদ্ধতা –

তবে এই পত্রিকাটির কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। যেমন – বাংলার নারীসমাজের কথা পত্রিকায় থাকত না। পত্রিকা বাংলার বৃহত্তর সমাজের কাছে পৌঁছোতে পারেনি, একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। জনগণের মধ্যে শিক্ষার অভাব, কুসংস্কারের প্রভাব ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ নীরব ছিল।

মূল্যায়ন –

ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও এ কথা বলতে হয়, ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এই পত্রিকা বাংলায় ইংরেজি-শিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করত। পত্রিকাটি জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করে। এ ছাড়া, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহের কাহিনি প্রচার করে ভারতীয়দের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।

হুতোম প্যাঁচার নক্শা গ্রন্থ থেকে উনিশ শতকের বাংলা সমাজের কী প্রতিফলন পাওয়া যায়?

কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত হুতোম প্যাঁচার নক্শা গ্রন্থটি ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ এই গ্রন্থে তৎকালীন বাঙালি সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থটিতে ব্রিটিশ আমলের কলকাতা ও তার আশপাশে অর্থসম্পদে ফুলেফেঁপে ওঠা এক সমাজের বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।

কালীপ্রসন্ন সিংহ

হুতোম প্যাঁচার নক্শায় সমাজের ধ্বজাধারীদের শ্রেণিবিভাজন –

এই গ্রন্থে যাদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে, তারা হলেন সেই সময়ের অগ্রবর্তী বা ধ্বজাধারী মানুষজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লেখক নিজেও এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। লেখক তাদের তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন –

  • ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী।
  • ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কিন্তু অন্ধ অনুকরণকারী নয়।
  • ইংরেজি না জানা গোঁড়া হিন্দু।

তবে, এদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল – এরা সকলেই কমবেশি বিভিন্ন ফন্দিফিকির করে বা অসৎ উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করে।

জ্ঞাতব্য বিষয় –

এই গ্রন্থ থেকে – সমকালীন সমাজের বাস্তব জীবন, সমকালীন সমাজে ব্যবহৃত মুখের ভাষা এবং সমাজকে প্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।

সমাজের প্রতিফলন –

ধনী সমাজের হীনতা, কপটতা – কালীপ্রসন্ন সিংহ নিজেই ছিলেন উনিশ শতকের এক ধনী পরিবারের সন্তান। ফলে তিনি ধনী সম্প্রদায়ের মানুষজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর নক্শায় এদের হীনতা, কপটতা ও ভণ্ডামির কথা তুলে ধরেছেন ও তার বিরুদ্ধে শানিত বাণনিক্ষেপ করেছেন। তাঁর আক্রমণের ভাষা ছিল তীক্ষ্ণ, শ্লেষাত্মক ও ঝাঁঝালো।

হুতোম প্যাঁচার নকশা

সামাজিক সংস্কার ও সংস্কারক – হুতোম প্যাঁচার নক্শা গ্রন্থের প্রচ্ছন হুতোম প্যাঁচার নক্শায় উনিশ শতকের বাংলা সমাজের সতীদাহপ্রথা রোধ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি বিষয়ের নানান ঘটনার প্রতিফলন পাওয়া যায়। এইসব প্রথার বিরুদ্ধে ও প্রচলনের সপক্ষে যে আন্দোলন হয়েছিল, সে সম্পর্কেও কতিপয় নক্শা রচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেও ভোলেননি। নক্শায় যেসব মনীষীদের তিনি বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ।

সমকালীন লোকসংস্কৃতি – হুতোম প্যাঁচার নক্শায় লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদান সম্পর্কে জানতে পারা যায়। মূলত এই নক্শাগুলি লোকায়ত কাঠামোর উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর নক্শা গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- চড়ক পার্বণ, কলিকাতার বারোয়ারি পুজো, মাহেশের স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, দুর্গোৎসব, রাসলীলা প্রভৃতি। এ ছাড়াও তাঁর বিভিন্ন নক্শায় নীলের রাত্রির ব্রত, পাঁচালি, যাত্রাগান, পিঠেপার্বণ বা পৌষসংক্রান্তি, ষষ্ঠীর বাটা প্রভৃতি লোকসংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়। এই সময়ের বাবুচিত্র রচনায় পাঁচালি, টপ্পা, আখড়া ইত্যাদি লোকায়ত উপকরণকেও তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।

সমকালীন শিক্ষা ও সাহিত্য – উনিশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে হুতোম প্যাঁচার নক্শায় অনেক ভিন্নধর্মী চিত্র পাওয়া যায়। এই নক্শাগুলি থেকে একদিকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও অন্যদিকে বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষার নানান কথা জানা যায়। এই সময়ের বাংলা গ্রন্থের মধ্যে যেগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সেগুলি হল – চাণক্য শ্লোক, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়, সীতার বনবাস, টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল প্রভৃতি।

উপসংহার –

কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর হুতোম প্যাঁচার নক্শায় তৎকালীন সমাজজীবন ও ব্যক্তিজীবনের ক্ষতস্থানগুলিকে চিহ্নিত করে তার নিরাময়ের কথা বলে দেশের উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করেছেন। তিনি তৎকালীন বড়োলোকদের লাম্পট্য, মাদকাসক্তি ও নানান দুষ্কর্মের নক্শা রচনা করে তাঁর উদ্দেশ্যসাধন করতে চেয়েছেন। এই নক্শাগুলির দ্বারা তিনি স্বজাতির কল্যাণসাধনের কথা বলেছেন।

নীলদর্পণ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্রের বর্ণনা দাও।

ভূমিকা –

সাময়িক পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থের মতো নাটক থেকেও উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্র পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। নাটকটি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাংলার কৃষকদের উপর নীলকর সাহেবদের শোষণ-অত্যাচারের কাহিনি নিয়ে এই নাটকটি রচিত।

বিষয়বস্তু –

কৃষকদের অভাব, দারিদ্র্য, নীলকরদের শোষণ-অত্যাচার, জমিদার ও ইংরেজ শাসকদের দমনমূলক ব্যবস্থা, দরিদ্র কৃষকদের প্রতিরোধ, সংগ্রাম-এইসব নিয়ে তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন নীলদর্পণ নাটকে ফুটে উঠেছে। আর্থসামাজিক পটভূমিতে ঐক্যবদ্ধ কৃষকেরা সাম্প্রদায়িকতার উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। আবার ইংরেজ আনুগত্য দূর করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি নীলচাষিদের সমর্থনে যেভাবে এগিয়ে এসেছিল নাটকটিতে তাও সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।

নীলদর্পণ ও তার ইংরেজি অনুবাদের প্রচ্ছদ

উদ্দেশ্য –

এই নাটক রচনার উদ্দেশ্য ছিল –

  • ইংরেজদের শোষণ-অত্যাচার বন্ধ করা।
  • কৃষকদের মঙ্গলসাধন করা।
  • মাটির মানুষের কাছাকাছি পৌঁছোনো ইত্যাদি।

নীলচাষিদের দুর্দশা –

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের পেশা ছিল চাষবাস। ধান বা খাদ্যশস্য চাষ ছিল এর মধ্যে প্রধান।

1. ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের প্রয়োজনে নীলের প্রচুর চাহিদা ছিল। সেজন্য ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংরেজ খামার মালিকেরা দলে দলে ভারতে আসতে থাকে। এ ছাড়া ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতে ইউরোপীয়দের জমি কেনার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তারা বেশি লাভের আশায় এলাকা চাষের বদলে বে-এলাকা চাষে আগ্রহী হয়। 2. চাষিদের বিঘা প্রতি ২ টাকা দাদন দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত তারা। চাষিরা অসম্মত হলে নীলকররা চাষির গোরুবাছুর কেড়ে নিত, চাষির বাড়ি ভেঙে দিত, তাদের পরিবারের লোকজনকে মারধর করত। 3. ও পঞ্চম রেগুলেশন আইন থাকা সত্ত্বেও চাষিরা নীলচাষ করতে বাধ্য হত। নীলের তুলনায় ধান বা তামাক চাষ বেশি লাভজনক ছিল। কিন্তু চাষিরা তা চাষ করতে পারত না। ফলে তারা খাদ্যাভাব ও ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়ত।

চাষিদের প্রতিরোধ –

নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচার নীলচাষিরা নীরবে মেনে নেয়নি। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নীলচাষিরা প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। নাটকে নীলচাষি তোরাপের ভূমিকাতে তা স্পষ্ট। বাংলার হিন্দু-মুসলিম নীলচাষিদের ঐক্যবদ্ধ এই সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিল।

শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির ভূমিকা –

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে নীলচাষিদের আন্দোলন শুরু হয়। এর মাত্র ২ বছর আগে সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) ঘটে। বাংলাদেশে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা করে। কিন্তু নীলচাষিদের আন্দোলনে তারা সহানুভূতি ও সমর্থন জানায়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা, শিশিরকুমার ঘোষের অমৃতবাজার পত্রিকা, আলোচ্য নীলদর্পণ নাটক নীলচাষিদের দুঃখদুর্দশা ও নীলকর সাহেবদের শোষণ-অত্যাচারের কাহিনি প্রচার করে। এর ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি ইংরেজ শাসন ও নীলকরদের শোষণের স্বরূপ বুঝতে পারে। তখন তারা নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। এই নাটকের অন্তর্গত গোলক বসু, নবীন মাধব, বিন্দু মাধব, সৈরিন্ধ্রি ও সাবিত্রী প্রভৃতি চরিত্রগুলি ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ।

মূল্যায়ন –

উনিশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি ছিল নীলদর্পণ নাটক। পাশ্চাত্য ধারায় প্রভাবিত পঞ্চাঙ্ক নাটকের চরিত্রগুলি সংস্কৃত নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। বাংলার অসহায় নীলচাষিদের লাঞ্ছনার মর্মস্পর্শী চিত্র এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে নাটকটিকে ঐতিহাসিক বলা যায়। সমকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের খণ্ডচিত্র নাটকটির মধ্যে ফুটে উঠেছে।

হরিনাথ মজুমদারের গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার বৈশিষ্ট্য ও অবদান লেখো।

ভূমিকা –

বাংলা সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের ইতিহাসে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি গ্রাম থেকে প্রকাশিত কাঙাল হরিনাথ বা হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা একটি উজ্জ্বল নাম। এটি ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক হরিনাথ তাঁর পত্রিকায় গ্রামের নিপীড়িত, অবহেলিত মানুষের কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি মনে করতেন প্রজাস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন ঘটনা ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিগোচরে আনতে পারলে হয়তো তার প্রতিকার সম্ভব হবে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন। পরে অর্থের অভাবে পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দেন।

পত্রিকার বৈশিষ্ট্য –

গ্রামবার্তা প্রকাশিকার বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –

গ্রামীণ সমস্যার কথা প্রকাশ – জাতীয় জাগরণের সেইসকল দিনগুলিতে শহর কলকাতা নয়, হরিনাথ বেছে নিয়েছিলেন দারিদ্র্য ও সমস্যাজর্জরিত গ্রামবাংলাকে। তিনি নিজেই বলেছেন যে, তৎকালে সব সংবাদপত্রগুলিই প্রধান প্রধান শহর ও বিদেশের সংবাদে পূর্ণ ছিল। তাই তাঁর লক্ষ্য ছিল, গ্রামীণ সংবাদ পরিবেশন করা। সংবাদপত্র যদি সমসাময়িক যুগের দর্পণ হয়, তাহলে বলতে হয় এই পত্রিকা সত্যিই সমকালীন বাংলার গ্রামীণ জীবনের যথার্থ দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি ছিল। তৎকালীন বাংলার গ্রামগুলিতে জমিদারদের অত্যাচার, জলকষ্ট এবং পাঠশালাগুলির করুণ দশার কথা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

অত্যাচারের প্রতিবাদ – গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিবাদ করা। এই সময় ব্রিটিশ সরকার, জমিদার ও মহাজন শ্রেণি গ্রামের মানুষের উপর অত্যাচার করত। হরিনাথ তাঁর পত্রিকায় নায়েব গোমস্তাদের রাক্ষসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সাহায্যে কীভাবে কৃষকদেরকে তার নিজের জমি থেকে উচ্ছেদ করে তা তিনি তুলে ধরেন। তার উপর জমিদারদের নেওয়া বিভিন্ন উপকর গ্রামীণ মানুষকে কতটা অসুবিধায় ফেলে তিনি তার বর্ণনা দেন। কাঙাল হরিনাথের সমালোচনার হাত থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির জমিদাররাও রেহাই পায়নি।

অত্যাচারী নীলকরদের বিরোধিতা – নীলকর সাহেবরা গ্রামের চাষিদের জোর করে নীলচাষ করাত এবং উৎপাদিত নীল অল্প দামে কিনে নিত। চাষি নীলচাষ করতে না চাইলে নীলকর সাহেবরা বিভিন্নভাবে অত্যাচার করত। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা নীলকর সাহেবদের এই সব জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল।

পাবনার কৃষক বিদ্রোহকে সমর্থন – পাবনায় কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩ খ্রি.) শুরু হলে তৎকালীন সব প্রভাবশালী পত্রপত্রিকাই জমিদারদের সমর্থন করে। ব্যতিক্রম ছিল ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’। এই পত্রিকা জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা – গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা ব্রিটিশ সরকার ও তার তাঁবেদার জমিদার শ্রেণির নিরবচ্ছিন্ন সমালোচনা করেছে। করবৃদ্ধি, সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতি, বেআইনিভাবে চা-কুলিদের চালন করা, দেশীয় শিল্পের দুর্দশা প্রভৃতির বিরুদ্ধে এই পত্রিকা প্রতিবাদ জানায়।

সমাজসংস্কারমূলক লেখা প্রকাশ – গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জমিদার, মহাজন, নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের পাশাপাশি প্রজাদের প্রতি জমিদারদের কর্তব্য বিষয়েও প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। নদী ও জলনিকাশি ব্যবস্থা সংস্কার করে মানুষের জলকষ্ট নিবারণ, ডাক ও পুলিশ বিভাগের কাজের সুবন্দোবস্ত করা প্রভৃতি বিষয়ে পত্রিকা সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করে। এ ছাড়া গ্রামসমাজে প্রচলিত কৌলীন্য প্রথা, কন্যা বিক্রয়, বিকৃত জীবনচর্চা ও প্রথার বিরুদ্ধেও সরব ছিল ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’।

পত্রিকার অবদান –

গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকা সমকালীন সমাজের কথা তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। যথা –

গ্রামের মানুষের কথা প্রচার – গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারের কথা প্রকাশিত হত। এই পত্রিকা থেকে সমকালীন সময়ের গ্রামের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার কথা জানা যায়।

গ্রামে শোষণ ও অত্যাচার – গ্রামের মানুষের উপর জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচারের কথা গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হত। এই পত্রিকা শোষণ, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল।

নারীদের অবস্থার উন্নতি – নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ সচেষ্ট ছিল। পরিশেষে বলা যায়, ডাকঘরে ‘মানি-অর্ডার’ ব্যবস্থা প্রচলনের কথা এই পত্রিকাতেই প্রথম উত্থাপিত হয়। এককথায়, সমকালীন গ্রামবাংলার সার্বিক জনজীবনে এই পত্রিকার ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই পত্রিকাটিকে বাংলার গ্রামীণ সংবাদপত্রের জনক বলা হয়।

উনিশ শতকের বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে সমকালীন বাঙালি সমাজের কী প্রতিফলন লক্ষ করা যায়?

ভূমিকা –

বাংলা ভাষার আদি বিকাশ পাল যুগে চর্যাপদের মাধ্যমে দেখা যায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্য বলতে যা বোঝায়, তার বিকাশ উনিশ শতকের আগে দেখা যায়নি। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বাংলা ভাষাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজে উদ্যোগী হয়। বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে সমকালীন বাঙালি সমাজের প্রতিফলন কীভাবে ঘটে তা নীচে আলোচনা করা হল।

বাংলা সংবাদপত্রে সমকালীন সমাজের প্রতিফলন –

উনিশ শতকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল – বামাবোধিনী, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রভৃতি।

বামাবোধিনী পত্রিকা –

বামাবোধিনী পত্রিকা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত।

বাঙালি সমাজের প্রতিফলন – বামাবোধিনী পত্রিকা ছিল নারীদের জন্য প্রকাশিত বাংলা মাসিক পত্রিকা। এই পত্রিকা থেকে সমকালীন বাঙালি সমাজের নারীদের কথা বিশেষভাবে জানা যায়। 1. উনিশ শতকে বাংলার নারীশিক্ষা অবহেলিত ছিল। তখন রক্ষণশীল সমাজ মনে করত শিক্ষিত মহিলারা অশুভ। সমাজে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। 2. এই সময় সমাজে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত ছিল। এই পত্রিকা থেকে সমাজে প্রচলিত কুপ্রথা সম্পর্কে জানা যায়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা –

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হয়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

বাঙালি সমাজের প্রতিফলন – হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বাংলার হরিনাথের পৌত্র বিশ্বনাথ মজুমদারের ভাষায় বলা যায়, গ্রামের কল্যাণে দেশহিতৈষী শহুরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এটি সফল হয়। 1. উনিশ শতকের বাংলায় নীলকর সাহেবরা চাষিদের জোর করে নীলচাষ করাতো। তারা চাষিদের অগ্রিম অর্থ দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল। 2. এই সময় আদিবাসীদের জোর করে বেগার খাটানো-সহ বিভিন্নভাবে শোষণ ও অত্যাচার করা হত। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী সাঁওতালরা বিদ্রোহ করে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা সাঁওতাল বিদ্রোহকে সমর্থন করে।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা –

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। এর প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার।

বাঙালি সমাজের প্রতিফলন – গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকা থেকে তৎকালীন বাংলার গ্রামের মানুষের কথা জানা যায়। 1. গ্রামের মানুষের উপর জমিদার ও মহাজনরা বিভিন্নভাবে শোষণ চালাত। 2. সমাজে নারীরা ছিল অবহেলিত। পুরুষশাসিত সমাজে কন্যা বিক্রয়, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ-সহ বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথা প্রচলিত ছিল।

বাংলা সাময়িকপত্রে সমকালীন সমাজের প্রতিফলন –

১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত দিগদর্শন হল বাংলা ভাষার প্রথম সাময়িক পত্র। এটি ছিল শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন দ্বারা পরিচালিত। এরপর ওই মিশন থেকেই প্রকাশিত হয় মার্শম্যানের পরিচালনায় সমাচার দর্পণ। রামমোহন রায়ের সম্বাদ কৌমুদী প্রকাশিত হয় এই যুগেই। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ করেন সমাচার চন্দ্রিকা। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। সাময়িকপত্রের জগতে বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন – এর আবির্ভাব একটি সাড়া জাগানো ঘটনা। বঙ্গদর্শনই প্রথম পাঠকদের কাছে উন্নত রুচির সাহিত্য পরিবেশন করে। এই সকল সাময়িক পত্র ও সংবাদপত্রগুলিতে উনিশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের বিভিন্ন দিকগুলি ছাড়াও নবীন সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চার পরিচয় মেলে।

উপসংহার –

পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলি তাদের সমালোচনা ও সংবাদ পরিবেশন দ্বারা জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে। সৃজনশীল উদ্যম জাতীয়তাবাদের ভিত্তি নির্মাণে সহায়ক হয়। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ভাষাতত্ত্ব, সংগীত, সাহিত্য সমালোচনা, বাঙালির শক্তিসাধনা, কৃষক সমস্যা, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ক রচনা বাঙালির মননে বিপ্লব সৃষ্টি করে।

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার বিবরণ দাও।

ভূমিকা –

উনিশ শতকে ভারতীয়রা পাঠশালা, টোল, চতুষ্পাঠী, মক্তব ও মাদ্রাসায় সংস্কৃত, আরবি ও ফারসির মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করত। এর মধ্যে টোল ও মাদ্রাসা ছিল উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র। বাংলার নবদ্বীপ, বিক্রমপুর ছিল সংস্কৃত চর্চার ও মুর্শিদাবাদ ছিল আরবি-ফারসি চর্চার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র।

শিক্ষা –

উনিশ শতকের বাংলাদেশে দেশীয় শিক্ষার প্রসার ঘটে। এই শিক্ষা ছিল দুই ধরনের। যথা –

  • প্রচলিত দেশীয় শিক্ষা ও
  • ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশীয় শিক্ষা।

প্রচলিত দেশীয় শিক্ষা –

বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে চিরাচরিত দেশীয় শিক্ষা প্রচলিত ছিল। দেশীয় শিক্ষার মধ্যে ছিল –

  • সংস্কৃত।
  • আরবি।
  • ফারসি শিক্ষা।

সংস্কৃত শিক্ষা – ঐতিহ্যমন্ডিত সংস্কৃত শিক্ষা সরকারি সাহায্য-বঞ্চিত হয়েও এ যুগে অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। চতুষ্পাঠী ও টোল ছিল যথাক্রমে সংস্কৃত শিক্ষার প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র। পণ্ডিত ও অধ্যাপক ছিলেন এগুলির শিক্ষক। পাশাপাশি বাংলা শিক্ষার জন্য পাঠশালা ছিল। সাধারণত শিক্ষকের বাড়িতে, চণ্ডীমণ্ডপে বা গৃহস্থের বৈঠকখানায়, বারান্দায় সকাল ও সন্ধ্যায় আংশিক সময় পঠনপাঠন চলত। ছাত্রদের কাছ থেকে শিক্ষকরা বেতন নিতেন।

আরবি শিক্ষা – মুসলমান সমাজে শিশুদের মধ্যে আরবি শিক্ষার চল ছিল। চার বছর বয়সের পর শিক্ষাদান শুরু হত। এই ভাষা ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় মুসলিম শিশুরা আগ্রহের সঙ্গে তা শিখত। মসজিদের পাশে মক্তবে মৌলবি সাহেব শিক্ষা দিতেন। উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা তেমন ছিল না।

ফারসি শিক্ষা – মুসলমান সমাজের উচ্চস্তরে ফারসি শিক্ষার চল ছিল। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফারসি সরকারি ভাষা ছিল। তাই সরকারি কাজে আগ্রহী বহু হিন্দু ফারসি শিখত। ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার মাধ্যমে ফারসি শিক্ষাপ্রদান চলত।

শিক্ষাব্যবস্থার ধরন – এইসব শিক্ষাব্যবস্থার কোনো নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম ছিল না। পুরোনো কিছু পুথিপত্র সম্বল করে পণ্ডিতরা শিক্ষাদান করতেন। অবশ্য আরবি-ফারসি শিক্ষায় ব্যতিক্রম দেখা যায়। ইউক্লিড – এর জ্যামিতি, ইউনানি চিকিৎসা, আরব ও পারস্যের সাহিত্য, শরিয়তি বিধান – এর গ্রন্থ, হাদিস ইত্যাদি পাঠ্য ছিল।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশীয় শিক্ষা –

কোম্পানি সরকার এদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথমে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। কারণ এর ফলে তারা এদেশীয়দের মধ্যে বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করেছিল। অথচ দেশের শাসক হয়ে শিক্ষাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করাও সম্ভব ছিল না। ফলে কোম্পানি সরকার শুধুমাত্র দেশীয় শিক্ষার মান উন্নয়নেরই চেষ্টা করে। এজন্য ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মাদ্রাসা, ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে বেনারস সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসা সিভিলিয়ান ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ভারতীয় ভাষা, রীতিনীতি ও আইনকানুন সম্পর্কে অবহিত করা।

সেযুগের এশিয়াটিক সোসাইটি

শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ –

অ্যাডাম রিপোর্ট – ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারকে এদেশে শিক্ষাবিস্তারের জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা খরচের নির্দেশ দেয়। দেশীয় শিক্ষাবিস্তারের জন্য প্রাচ্যবাদীরা ওই টাকা দাবি করে। এই দাবির সমর্থনে পাদরি অ্যাডাম বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে অনুসন্ধান করেন (১৮৩৫ খ্রি.)। তাঁর তিনটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে এসময় প্রায় এক লক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (পাঠশালা, চতুষ্পাঠী, টোল, মক্তব ও মাদ্রাসা) ছিল। অর্থাৎ সমকালীন জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল যথেষ্ট।

মূল্যায়ন –

উনিশ শতকের বাংলায় দেশীয় শিক্ষার উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠলেও তার নীচে অন্ধকার ছিল। কারণ হিন্দুসমাজে তখন বর্ণভেদ প্রথা ছিল প্রবল। নীচুবর্ণের মানুষরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। নারীশিক্ষা সম্বন্ধে কুসংস্কার ছিল দৃঢ়। তাই শিক্ষা কেবল উচ্চবর্ণের পুরুষদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। আর মুসলিম সমাজে মোল্লা-মৌলবিদের প্রভাব থাকায় ধর্মীয় বাতাবরণের বাইরে শিক্ষা ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। মুসলিম নারীরাও ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে আসতে পারেনি এবং দরিদ্র মুসলমানরা শিক্ষা থেকে দূরে ছিল। এক্ষেত্রে দরিদ্র হিন্দু ও দরিদ্র মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিল না।

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী?

ভূমিকা –

আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশীয় শিক্ষার ধারাও (সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি) প্রচলিত ছিল সেসময়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে এদেশে শিক্ষার জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। দেশীয় শিক্ষার জন্য প্রাচ্যবাদীরা এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাশ্চাত্যবাদীরা এই টাকা দাবি করলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হয়।

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন –

বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজরা এদেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। পরে এদেশীয়দের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা দূর করার জন্য খ্রিস্টধর্ম ও জনহিতবাদের ভিত্তিতে শিক্ষাবিস্তারের দাবি ওঠে। ইংল্যান্ডের এই জনমতের দাবিতে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের ৪৩ নং অনুচ্ছেদে এদেশে শিক্ষাবিস্তারের জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও এর প্রতীকী গুরুত্ব ছিল অসীম। কারণ এই নির্দেশের দ্বারা কোম্পানি সরকারকে এদেশীয়দের জনশিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।

থমাস ব্যাবিটেন মেকলে

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব –

সরকার কর্তৃক বরাদ্দ ১ লক্ষ টাকা পাওয়ার জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সরকার শিক্ষাখাতে অর্থব্যয় বন্ধ করে দেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেয় একটি সমিতির উপর, যার নাম ছিল জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (GCPI)। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজ ছিল ব্যাপক পরিবর্তন ও সংস্কার আন্দোলনের যুগ। এই যুগকে “নবজাগরণ” বা “আধুনিক যুগ” বলে অভিহিত করা হয়। সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংস্কারের দাবী ওঠে। ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, আইন এবং সমাজব্যবস্থা – সকল ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়।

এই সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব ছিল দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক। বাংলা সমাজে আধুনিক চেতনা ও মূল্যবোধের প্রচার ঘটে। নারীর সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়। বাংলা সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা, এবং নাট্যকলার ক্ষেত্রে নবজাগরণের প্রভাব স্পষ্ট। উপরন্তু, নবজাগরণ ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকেও অনুপ্রাণিত করেছিল।

Share via:

মন্তব্য করুন