পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের দশম শ্রেণীর জীবন বিজ্ঞানের চতুর্থ অধ্যায়ের অভিব্যক্তি ও অভিযোজন থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেওয়া হলো। এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিবর্তনের সপক্ষে ডারউইনের মতবাদ সম্বন্ধে আলোচনা করো। অথবা প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্বের সাহায্যে নতুন প্রজাতির উদ্ভব কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
বিবর্তন সম্পর্কিত ডারউইনের মতবাদ অনুযায়ী, বিশ্বের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদগুলি স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং মানুষের ব্যবহারের ফলে তা অস্থায়ী হয়ে যায়। এটি ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠান এবং কার্যকর বিধানগুলির জন্য আহ্বান জারি করে।
বিবর্তন সম্পর্কিত ডারউইনের মতবাদ
ডারউইন 1859 খ্রিস্টাব্দে ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ (On the Origin of Species by means of Natural Selection) গ্রন্থে জৈব অভিব্যক্তি বা বিবর্তনের ব্যাখ্যা করে যে মতবাদ প্রকাশ করেন, তাকেই ডারউইনবাদ বা ডারউইনিজম বা প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ বলা হয়। ডারউইনের মতবাদের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল —
- অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি – ডারউইনের মতে জীবের সহজাত বৈশিষ্ট্য হল অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি করা। ডারউইন লক্ষ করেন জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে ঘটে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় — একটি স্ত্রী স্যামন মাছ একটি প্রজনন ঋতুতে প্রায় তিন কোটি ডিম পাড়ে। একটি ঝিনুক এক বছরে প্রায় 6 মিলিয়ন ডিম্বাণু উৎপাদন করে।
- সীমিত খাদ্য ও বাসস্থান – জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্যের উৎপাদন ও পৃথিবীর আয়তন বৃদ্ধি পায় না। জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও তার বসবাসের স্থান এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের সংকট দেখা দেবে।
- অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম – একদিকে অত্যধিক জন্মের বা বংশবৃদ্ধির হার অন্যদিকে খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত হওয়ায় প্রতি মুহূর্তে জীবকে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। একে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম বলা হয়। এই সংগ্রাম মূলত তিন প্রকার — 1. অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম – খাদ্য, বাসস্থান প্রভৃতির জন্য একই প্রজাতির জীবগোষ্ঠীর মধ্যে সংগ্রাম হয় কারণ তারা একই প্রকৃতির খাদ্য ও বাসস্থান ব্যবহার করে। 2. আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম – খাদ্য, বাসস্থান প্রভৃতির জন্য বিভিন্ন প্রজাতির জীবগোষ্ঠীর মধ্যেও সংগ্রাম হয়ে থাকে। 3. পরিবেশগত সংগ্রাম – প্রতিটি জীবকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরিবেশগত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। অত্যধিক বা কম আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং বন্যা, খরা, ভূমিকম্প প্রভৃতি দুর্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিটি জীবকে সংগ্রাম করতে হয়।
- প্রকরণ বা ভ্যারিয়েশন – ডারউইনের মতে, পৃথিবীতে যে-কোনো দুটি জীব কখনোই অবিকল একই রকমের হতে পারে না, কিছু-না-কিছু পার্থক্য অবশ্যই থাকবে। এই পার্থক্যকেই ভ্যারিয়েশন বা প্রকরণ বা ভেদ বলে। অনুকূল প্রকরণ (favourable variation) জীবনসংগ্রামে জীবকে সাহায্য করে। অপরদিকে প্রতিকূল প্রকরণ জীবের বিলুপ্তির কারণ হয়।
- যোগ্যতমের উদ্বর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন – ডারউইনের মতে, জীবনসংগ্রামের ফলে উদ্ভূত প্রকরণগুলির মধ্যে কিছু অনুকূল ও কিছু প্রকরণ প্রতিকূল হয়। অনুকূল প্রকরণগুলি জীবকে অভিযোজনে সহায়তা করে কিন্তু প্রতিকূল প্রকরণগুলি অভিযোজনে সহায়তা করতে পারে না। ফলে প্রতিকূল প্রকরণযুক্ত জীব ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয় এবং অনুকূল প্রকরণযুক্ত জীব পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য নির্বাচিত হয়। একে যোগ্যতমের উদ্বর্তন বলে। প্রকৃতি উপযুক্ত প্রকরণযুক্ত জীবকে টিকে থাকার জন্য নির্বাচন করে। একে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলা হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিজ্ঞানী হারবার্ট স্পেনসার সর্বপ্রথম যোগ্যতমের উদ্বর্তন কথাটি প্রস্তাব করেন। ডারউইন পরবর্তীকালে তাঁর তত্ত্বের মধ্যে কথাটি অত্যন্ত সংগতভাবে ব্যবহার করেন।
- নতুন প্রজাতির উৎপত্তি – একটি বিশেষ জীবগোষ্ঠীর মধ্যে অনুকূল প্রকরণগুলি পুঞ্জীভূত হওয়ায় বেশকিছু প্রজন্ম পরে পূর্বপুরুষ ও উত্তরপুরুষের মধ্যে অনেক বেশি বৈসাদৃশ্য দেখা দেয়। এর ফলে কালক্রমে একটি নতুন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে।
[পরীক্ষায় সবকটি প্রতিপাদ্য বিষয় একসাথে নাও আসতে পারে। এখানে শিক্ষার্থীদের বোঝার সুবিধার্থে সব বিষয়গুলি একসাথে দেওয়া হল।]
জীবনসংগ্রাম বলতে কী বোঝো? এটি কার মতবাদ? যোগ্যতমের উদ্বর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন কীভাবে ঘটে?
জীবনসংগ্রাম বলতে বুঝায় মানুষের জীবনে সম্প্রদায়, সামাজিক ও আর্থিক লড়াইয়ে প্রতিষ্ঠিত সংগঠিত প্রচেষ্টাগুলি, যা তাকে নিজের সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নে আগ্রহী করে।
জীবনসংগ্রাম
জীব তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। সীমিত খাদ্য ও বাসস্থানের কারণে তাদের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে হয় এবং এর ফলে সৃষ্ট সংগ্রামকে জীবনসংগ্রাম বলা হয়।
মতবাদের প্রবক্তা
এই মতবাদের প্রবক্তা হলেন চার্লস ডারউইন।
যোগ্যতমের উদ্বর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন
ডারউইনের মতে, জীবনসংগ্রামের ফলে উদ্ভূত প্রকরণগুলির মধ্যে কিছু অনুকূল ও কিছু প্রকরণ প্রতিকূল হয়। অনুকূল প্রকরণগুলি জীবকে অভিযোজনে সহায়তা করে কিন্তু প্রতিকূল প্রকরণগুলি অভিযোজনে সহায়তা করতে পারে না। ফলে প্রতিকূল প্রকরণযুক্ত জীব ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয় এবং অনুকূল প্রকরণযুক্ত জীব পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য নির্বাচিত হয়। একে যোগ্যতমের উদ্বর্তন বলে। প্রকৃতি উপযুক্ত প্রকরণযুক্ত জীবকে টিকে থাকার জন্য নির্বাচন করে। একে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলা হয়।
ব্যবহার ও অব্যবহার তত্ত্ব বলতে কী বোঝ? এটি কার মতবাদ? অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ বলতে কী বোঝ?
ব্যবহার ও অব্যবহার তত্ত্ব সম্পর্কে বলতে বুঝায় যে সম্পদগুলির উপযোগ বা ব্যবহার সঠিক ও সময়েই প্রয়োজনীয়, কিন্তু অতিরিক্ত অব্যবহার তা নিঃসরণীয়। এটি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং বিচারের প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন করে।
ব্যবহার ও অব্যবহার তত্ত্ব
ল্যামার্কের মতে, জীবদেহের কোনো অঙ্গ ক্রমাগত ব্যবহৃত হতে থাকলে অঙ্গটি শক্তিশালী, সুগঠিত ও সবল হয়। পক্ষান্তরে, জীবদেহের কোনো অঙ্গ দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে অবশেষে অবলুপ্ত হয়ে যায়। যেমন — মানুষ যে হাতটি বিভিন্ন কাজে বেশি ব্যবহার করে সেটি অন্য হাতের তুলনায় বেশি সক্রিয় এবং সবল হয়।
মতবাদের প্রবক্তা
এই মতবাদের প্রবক্তা হলেন ল্যামার্ক।
অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ
পরিবেশের প্রভাবে অভিযোজনগতভাবে জীব যেসব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে সেইসব বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে সন্তানসন্ততির দেহে সঞ্চারিত হয়। এইভাবে কোনো জীবের পর্যায়ক্রমিক বংশগুলিতে নতুন বৈশিষ্ট্যগুলির অর্জন ও বংশানুসরণ হওয়ার ফলে অনেকগুলি প্রজন্ম বাদে সৃষ্ট জীবটি পূর্বপুরুষ থেকে পৃথক হয়ে যায়। এইভাবেই নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়। ল্যামার্কের এই মতবাদকে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ বলা হয়।
জীবাশ্ম বা ফসিল কাকে বলে? ঘোড়ার বিবর্তনঘটিত প্রমাণের ক্ষেত্রে জীবাশ্মের গুরুত্ব আলোচনা করো।
জীবাশ্ম হল মৃত্যুর পর থাকা জীব সংস্কার যা পর্যায়ক্রমে অস্থায়ী হয় এবং প্রকৃতির অবলম্বনে সৃষ্টি ও পুনরুত্থানে গুরুত্ব পায়।
জীবাশ্ম
পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রাচীন পাললিক শিলাস্তরে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত অধুনালুপ্ত উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীদেহের সামগ্রিক বা আংশিক প্রস্তরীভূত রূপ বা ছাপকে জীবাশ্ম বা ফসিল বলে। যেমন — আরকিওপটেরিক্স-এর জীবাশ্ম।
ঘোড়ার বিবর্তনঘটিত প্রমাণের ক্ষেত্রে জীবাশ্মের গুরুত্ব
জীবাশ্ম অভিব্যক্তি বা বিবর্তনের সপক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। বিশেষত ঘোড়ার জীবাশ্মের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এক্ষেত্রে প্রতিটি যুগের ঘোড়ার জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই কারণে ঘোড়ার উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তন সম্পূর্ণরূপে জানা সম্ভব হয়েছে। এই জীবাশ্মগুলি থেকে জানা যায় যে আজ থেকে প্রায় 55 মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রথম ঘোড়ার আবির্ভাব হয়। এর নাম ছিল ইওহিপ্পাস। একে ঊষাকালের ঘোড়া বলা হয়। এরা আকারে ছোটো ছিল এবং এদের পা ক্ষুদ্র ও আঙুলযুক্ত ছিল। তৎকালীন বনজ পরিবেশে অভিযোজনের জন্য তাদের আকৃতি এরূপ ছিল। এরপর, ধীরে ধীরে তৃণভূমি সৃষ্টি হয় ও ঘোড়ার বাসস্থান পরিবর্তিত হয়। এর সাথে সাথে ঘোড়ার বিবর্তন হতে থাকে। তারা ক্রমশ আকারে বড়ো ও সবল পা-যুক্ত হয়ে ওঠে। ঘোড়ার বিবর্তনের ক্রম হল —
ইওহিপ্পাস → মেসোহিপ্পাস→ মেরিচিপ্পাস→ প্লিওহিপ্পাস→ ইকুয়াস
জীবাশ্ম পর্যবেক্ষণ করে ঘোড়ার বিবর্তনঘটিত যে বৈশিষ্ট্যগুলি পাওয়া যায় তা এখানে আলোচনা করা হল — 1. দেহ আকৃতির ক্রমিক বৃদ্ধির মাধ্যমে মাত্র 11 ইঞির ইওহিপ্পাস থেকে প্রায় 60 ইঞ্চির ইকুয়াস-এর উৎপত্তি হয়েছে। 2. দৌড়ের জন্য অগ্রপদ এবং পশ্চাদ্পদের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি হয়েছে। 3. উভয় পদেরই আঙুলের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ও একটি আঙুলের দৈর্ঘ্য ও গ্রন্থ বৃদ্ধি পেয়ে তা ক্ষুরে পরিণত হয়েছে। 4. গ্রীবার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি হয়েছে। 5. মস্তিষ্কের সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার অংশের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে ও প্রাণীটি বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। দাঁতের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হল – নিম্নচূড় (low crowned) পেষকদন্তের (molar teeth) উচ্চচূড়ে রূপান্তর (high crowned) হয়ে ঘাস খাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠেছে।
এইভাবে জীবাশ্ম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘোড়ার বিবর্তন সম্পর্কিত প্রমাণ পাওয়া যায়। এর থেকে আরও জানা যায়, কীভাবে আদিকালের ঘোড়া থেকে আধুনিক ঘোড়ার উৎপত্তি হল এবং কীভাবে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে তাদের বিবর্তন ঘটল।
প্রাকৃতিক নির্বাচন বলতে কী বোঝ? এটি কার মতবাদ? ডারউইন-এর তত্ত্বের ত্রুটিগুলি উল্লেখ করো।
প্রাকৃতিক নির্বাচন হল প্রাকৃতিক উপাদানগুলির সঠিক পরিবর্তন ও বিকাশের মাধ্যমে পরিবেশের স্বাভাবিক সমন্বয় এবং সংঘটিত প্রক্রিয়াগুলির পরিপূর্ণ সমর্থন। এটি প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন করে।
প্রাকৃতিক নির্বাচন
প্রকৃতির দ্বারা জীবজগতের মধ্যে উপযুক্ত জীবের নির্বাচনকেই প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে। জীবনসংগ্রামে জয়ী যোগ্যতম জীবে উদ্বর্তিত হবার মাধ্যমেই এটি ঘটে থাকে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়ে জীবনসংগ্রামে জয়ী হতে হলে জীবকে কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হয়। জীবের এই অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলি পরিবেশের সাপেক্ষে অনুকূল ও প্রতিকূল দুই-ই হতে পারে। অনুকূল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবগুলির পৃথিবীতে টিকে থাকে ও প্রকৃতিতে তাদেরই নির্বাচন ঘটে। প্রতিটি জীবের বৈশিষ্ট্যগত এই পার্থক্যকেই ডারউইন প্রকরণ বলেন। এই প্রসঙ্গে ডারউইন বলেন যে, অনুকূল প্রকরণ-সমন্বিত জীবেরা প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত হয়ে জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকে। পক্ষান্তরে, প্রতিকূল প্রকরণ-সমন্বিত জীবেরা অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়।
মতবাদের প্রবর্তক
প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদটির প্রবর্তক হলেন চার্লস রবার্ট ডারউইন।
ডারউইনতত্ত্বের ত্রুটি
1. নতুন প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ডারউইন প্রকরণের কথা বলেছেন কিন্তু প্রকরণের উৎপত্তি সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেননি। 2. ডারউইন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকরণের ওপর গুরুত্ব দেন। অথচ নতুন প্রজাতির উৎপত্তির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র প্রকরণের বিশেষ ভূমিকা নেই। ডারউইন মিউটেশনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। মিউটেশনকে তিনি নিছকই প্রকৃতির খেলা বলে উপেক্ষা করেছেন। 3. প্রাকৃতিক নির্বাচনের থেকে প্রকরণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রকরণ সৃষ্টির কারণগুলিই প্রধানত অভিব্যক্তির জন্য দায়ী, কিন্তু ডারউইন এ সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেননি। তিনি যোগ্যতমের উদ্বর্তন নিয়ে ভেবেছিলেন কিন্তু যোগ্যতমের আবির্ভাব নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। 4. ডারউইনের ধারণা অনুযায়ী কোনো জীবের বা জীবের কোনো অঙ্গের অতিবৃদ্ধি বিবর্তনের সহায়ক। কিন্তু বাস্তবে কোনো কোনো জীবে এরূপ অতিবৃদ্ধিযুক্ত অঙ্গ জীবের বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 5. ডারউইন দেহজ প্রকরণ এবং জননগত প্রকরণের সম্পর্কে কোনো ধারণা দেননি। 6. অনেক সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বা অন্য কোনো কারণে অনুপযুক্ত জীবের সাথে সাথে যোগ্যতমেরাও মারা যায়, সুতরাং জীবের মৃত্যু বা বিলুপ্তিতে অনেক সময় প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হয় না।
আরও পড়ুন,
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – অভিব্যাক্তি ও অভিযোজন – বেঁচে থাকার কৌশল-অভিযোজন – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – প্রাণীদেহে সাড়া প্রদানের একটি প্রকার হিসেবে গমন – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – বংশগতি এবং কয়েকটি সাধারণ জিনগত রোগ – বংশগতি – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
যোগ্যতমের উদ্বর্তন বলতে কী বোঝ? লুপ্তপ্রায় অঙ্গ কীভাবে উৎপন্ন হয়, তা উদাহরণ সহযোগে লেখো।
যোগ্যতমের উদ্বর্তন এর মাধ্যমে একটি ব্যক্তি তার দক্ষতা, জ্ঞান এবং দক্ষতার স্তর উন্নত করে এবং নিজেকে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে গড়ে উঠায়। এটি উন্নত পেশাদারী এবং সামাজিক অবস্থানে উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যোগ্যতমের উদ্বর্তন
যোগ্যতম হল বহুর মধ্যে যে যোগ্য, আর উদ্বর্তন হল জীবনসংগ্রামে বা প্রাকৃতিক নির্বাচনে টিকে থাকা। প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশে অবিরাম সংগ্রামের মাধ্যমে অভিযোজিত হয়ে অনুকূল প্রকরণ সৃষ্টির মাধ্যমে কিছু জীব নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। আবার কিছু জীব প্রতিকূল প্রকরণের জন্য পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ, জীবনসংগ্রামে জয়ী যোগ্যতম জীবই বেঁচে থাকে। ডারউইন একেই বলেছেন, যোগ্যতমের উদ্বর্তন (survival of the fittest)। (যদিও এই কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন হারবার্ট স্পেনসার)।
যোগ্যতমের উদ্বর্তনের উদাহরণ – উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনুকূল প্রকরণ সৃষ্টির জন্য লম্বা গলাযুক্ত জিরাফ আজও টিকে রয়েছে। অন্যদিকে প্রতিকূল প্রকরণের জন্য খর্ব গলাযুক্ত জিরাফ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উৎপত্তি
পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবদেহের সুগঠিত এবং একদা সক্রিয় থাকা কোনো কোনো অঙ্গের কর্মক্ষমতা লোপ পেয়ে দুর্বল ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উৎপত্তি ঘটায়।
প্রাণীর লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উদহারণ – মানুষের বহিঃকর্ণ নাড়ানোর পেশি, চোখের উপপল্লব,অ্যাপেনডিক্স ইত্যাদি, তিমির শ্রোণিচক্রের অস্থি, উটপাখির ডানা ইত্যাদি।
উদ্ভিদের লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উদহারণ – ভূনিম্নস্থ কাণ্ডের শল্কপত্র, বেনেবউ ও স্বর্ণলতার দেহে অবস্থিত আঁশের মতো পাতা, শতমূলী গাছের গর্ভকেশর, নারকেল গাছের তিনটি গর্ভকেশরের মধ্যে দুটি বন্ধ্যা গর্ভকেশর, কালকাসুন্দার বন্ধ্যা পুংকেশর বা স্ট্যামিনোড ইত্যাদি।
জিরাফের লম্বা গ্রীবা সম্পর্কে ল্যামার্ক ও ডারউইনের মতবাদ সংক্ষেপে আলোচনা করো।
জিরাফের লম্বা গ্রীবা ল্যামার্কের মতে উচ্চতা দেয় এবং এটি সাধারণত মার্কিন প্রাণীদের মধ্যে সর্বাধিক উচ্চতা ধারণ করে। এটি জিরাফের প্রকৃতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
জিরাফের লম্বা গ্রীবা সম্পর্কে ল্যামার্কের মত
ল্যামার্কের মতে, বহুকাল আগে জিরাফের গলা ছোটো ছিল। কিন্তু কালক্রমে উঁচু গাছের পাতা আহরণের চেষ্টার ফলে গলাটি ক্রমশ লম্বা হয়ে গেছে। এক প্রজন্মের জিরাফের অর্জিত বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। আবার এই প্রজন্মের অর্জিত বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। এইভাবে এই লম্বা গলার বৈশিষ্ট্যটি বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে আজকের লম্বা গলাযুক্ত জিরাফের আবির্ভাব ঘটেছে।
জিরাফের লম্বা গ্রীবা সম্পর্কে ডারউইনের মত
লম্বা গ্রীবাযুক্ত জিরাফরা অধিক খাদ্যগ্রহণ করতে সক্ষম হওয়ায় অধিক প্রজননের সুযোগ পায় ফলে অনেক বেশি সংখ্যক অপত্য সৃষ্টি করে। অন্যদিকে ছোটো গ্রীবাযুক্ত জিরাফরা খেতে না পেয়ে মারা যাওয়ায় বংশবিস্তারে সক্ষম হয় না। ফলে ক্রমশ লম্বা গ্রীবাযুক্ত জিরাফের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও ছোটো গ্রীবার জিরাফরা সংখ্যায় কমতে থাকে। এইভাবে সুঅভি- যোজিত, যোগ্যতম লম্বা গ্রীবাযুক্ত জিরাফরা প্রকৃতি দ্বারা নির্বাচিত হয় এবং লম্বা গ্রীবাযুক্ত জিরাফ প্রজাতি সৃষ্টি করে।
অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ উদাহরণসহ বোঝাও। ল্যামার্কের মতবাদের প্রধান ত্রুটিগুলি কী?
অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ মানে পিতা-মাতার সাথে সংযুক্ত গুণাবলিগুলি তাদের সন্তানদের মাধ্যমে পরিবর্তন করে এবং অনুসরণ করে যে গুণাবলি সামরিক ও মস্তিষ্কিক সম্পদে আবিষ্কৃত হয়। এটি প্রাকৃতিক বাস্তবে জীবিত প্রক্রিয়ার একটি মৌলিক মাধ্যম।
অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ
যে কয়েকটি প্রধান প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে ল্যামার্কবাদ গঠিত সেগুলির একটি হল অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ। পরিবেশের প্রভাবে অভিযোজনের মাধ্যমে জীব যেসব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে সেইসব বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে সন্তানসন্ততির দেহে সঞ্চারিত হয়। অর্জিত লক্ষণের বংশপরম্পরায় সারণকেই বলা হয় অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ।
উদাহরণ – বহুকাল আগে জিরাফের গলা ছোটো ছিল। কিন্তু কালক্রমে উঁচু গাছের পাতা আহরণের চেষ্টার ফলে গলাটি ক্রমশ লম্বা হতে থাকে। এই লম্বা গলার বৈশিষ্ট্যটি বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে আজকের লম্বা গলাযুক্ত জিরাফের আবির্ভাব হয়েছে।
ল্যামার্কের মতবাদের প্রধান ত্রুটি
1. ল্যামার্কের মতবাদের প্রথম প্রতিপাদ্যটি সার্বজনীন নয়। কারণ অনেকক্ষেত্রেই অভিব্যক্তির ধারায় অঙ্গের ক্ষুদ্র হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, বড়ো হয় না। 2. দ্বিতীয় প্রতিপাদ্যটিও সত্য নয়, কারণ, পরিবেশের কিছুটা প্রভাব থাকলেও জীবের অন্তর্নিহিত চাহিদার দ্বারা কোনো নতুন অঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে না। যেমন — একটি স্থলজ জীব খুব ভালোভাবে চাইলেও জলে বসবাসকারী জীবের অঙ্গ তাতে সৃষ্টি হয় না। 3. ল্যামার্কের তৃতীয় প্রতিপাদ্যের কিছুটা সত্যতা রয়েছে, যদিও আমরা জানি যে, কোনো জীবের হৃৎপিণ্ড সবসময় সচল থাকলেও তা বড়ো ও সুগঠিত হয় না। 4. ল্যামার্কের তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বা অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ সর্বৈবভাবে সত্য নয়। অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ তখনই ঘটে যখন তা জননকোশের দ্বারা সঞ্চারিত হয়। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী ওয়াইসম্যানের পরীক্ষা উল্লেখ্য।
বিজ্ঞানী ওয়াইসম্যান তাঁর জার্মপ্লাজমবাদে বলেন, জীবদ্দশায় অর্জিত গুণাবলি বংশপরম্পায় সঞ্চারিত হয় না। বংশগত বৈশিষ্ট্য কেবল জননকোশের মাধ্যমেই সঞ্চারিত হয়। তিনি এক জোড়া পুরুষ ও স্ত্রী ইঁদুরের ল্যাজ পরপর 22 জনু ধরে কেটে তাদের মধ্যে জনন ঘটিয়ে প্রমাণ করেন, কোনো ক্ষেত্রেই ল্যাজহীন ইঁদুর জন্মায় না। ড্রসোফিলা মাছিকে অন্ধকার ঘরে রেখে 60 জনু ধরে তাদের ভিতর জনন ঘটানো হলেও দেখা যায়, কোনো ক্ষেত্রেই দৃষ্টিশক্তিহীন মাছি জন্মায় না। এইসব প্রমাণ থেকে ল্যামার্কের অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ সূত্রটি বাতিল বলে বিবেচিত হয়। এটি ল্যামার্কের মতবাদের প্রধান দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত।
অভিব্যক্তি ও অভিযোজন হল জীবন বিজ্ঞানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। অভিব্যক্তি হল জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলির প্রকাশ, যখন অভিযোজন হল একটি জীবের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক নির্বাচন অভিযোজনকে প্রভাবিত করে কারণ এটি এমন জীবগুলিকে বেছে নেয় যা তাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।