আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায় উনবিংশ শতকের ইউরোপ: রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংঘাত অধ্যায়ের প্রশ্ন কিছু সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।
জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝায়?
মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে জাতীয়তাবাদ একটি মহান আদর্শরূপে পরিচিত। জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয় নিজের দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা থেকে। জাতীয়তাবাদ একটি ভাবগত ধারণা। কোনো একটি জনসমাজের মধ্যে বংশ, ভাষা, ধর্ম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি কারণে ঐক্যবোধ সৃষ্টি হওয়ার ফলে যখন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে ওঠে, তখন সেই আদর্শকে জাতীয়তাবাদ বলা হয়।
আদর্শ জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝো?
আদর্শ জাতীয়তাবাদ – আদর্শ জাতীয়তাবাদের মূল কথা হল “নিজে বাঁচো, অপরকে বাঁচতে দাও” (Live and Let Live)। আদর্শ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে একটি জাতি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে পারে, মানুষ পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে শেখে। আদর্শ জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সহায়ক হয়।
বিকৃত জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝো?
বিকৃত জাতীয়তাবাদ – অনেক সময় জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। যে জাতীয়তাবাদ নিজের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সচেষ্ট হয় এবং এর পাশাপাশি অন্য জাতিকে নিকৃষ্ট বলে বা ঘৃণা করে, তখন তাকে বিকৃত জাতীয়তাবাদ বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জার্মানির রাষ্ট্রনেতা হিটলারের (Hitler) জাতীয়তাবাদ ছিল বিকৃত জাতীয়তাবাদ। কারণ তিনি জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের পাশাপাশি অন্যান্য জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন।
জাতি কাকে বলে?
স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাসকারী অথবা রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার জন্য সচেষ্ট জনসমাজকে জাতি বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্রাইস বলেছেন যে, রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত এবং বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত অথবা মুক্তিলাভের জন্য সচেষ্ট জাতীয় জনসমাজকে জাতি বলা হয়।
জাতি-রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায়?
জাতি-রাষ্ট্র কথাটির মধ্যে রয়েছে জাতি ও রাষ্ট্র নামে দুটি বিষয়। সাংস্কৃতিক ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্যযুক্ত একটি জাতির সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃত্বযুক্ত ভৌগোলিক এলাকাই জাতি-রাষ্ট্র নামে পরিচিত।
কী পরিস্থিতিতে ভিয়েনা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল?
এলবা দ্বীপে নেপোলিয়নের নির্বাসনের পর ইউরোপীয় রাজ্যগুলির পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস এবং উদ্ভূত অপরাপর সমস্যার সমাধানের জন্য ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে এক সম্মেলনে সমবেত হন (1814 খ্রি., 1 সেপ্টেম্বর)। নেপোলিয়ন আকস্মিকভাবে ফ্রান্সে ফিরে আসায় কিছুদিন সম্মেলনের কাজকর্ম বন্ধ থাকে। ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর আবার সম্মেলন শুরু হয় এবং দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর 1815 খ্রিস্টাব্দের 9 জুন ভিয়েনা চুক্তি সম্পাদিত হয়।
ভিয়েনা সম্মেলন কবে, কোথায় ও কী উদ্দেশ্যে আহ্বান করা হয়?
নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপের বিজয়ী শক্তিগুলি 1815 খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে মিলিত হয়। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপকে প্রাক্-ফরাসি বিপ্লব অবস্থায় ফিরিয়ে আনা, ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনর্গঠন ও পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করা, ফ্রান্সের শক্তি নিয়ন্ত্রণ ও যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায় করা এবং ইউরোপের শান্তি বজায় রাখা।
ভিয়েনা সম্মেলনে কোন্ কোন্ রাষ্ট্রের প্রাধান্য ছিল?
ভিয়েনা সম্মেলনে যেসব রাষ্ট্রের প্রাধান্য ছিল সেগুলি হল –
1. অস্ট্রিয়া
2. রাশিয়া
3. প্রাশিয়া
4. ইংল্যান্ড
অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ ছিলেন এই সম্মেলনের সভাপতি। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অস্ট্রিয়ার রাজা প্রথম ফ্রান্সিস, রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার, প্রাশিয়ার রাজা তৃতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়াম, ইংল্যান্ডের মন্ত্রী ক্যাসেলরি প্রমুখ। এই সম্মেলনে পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধি ছিলেন টেলির্যান্ড (তালেরাঁ)।
ভিয়েনা সম্মেলনে চার প্রধান (Big Four) নামে কারা পরিচিত?
ভিয়েনা সম্মেলনে ইউরোপের সব দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলেও চারটি রাষ্ট্র প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এরা মনে করত নেপোলিয়নের পতনে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই চারটি রাষ্ট্র হল –
1. অস্ট্রিয়া
2. রাশিয়া
3. প্রাশিয়া
4. ইংল্যান্ড
এরাই চার প্রধান নামে পরিচিত।
ভিয়েনা সম্মেলনে কোন্ কোন্ রাষ্ট্রপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন?
অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ ছিলেন ভিয়েনা সম্মেলনের সভাপতি। এই সম্মেলনে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্যাসেলরি ও ডিউক অফ ওয়েলিংটন; প্রাশিয়ার রাজা তৃতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়াম; রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার, অস্ট্রিয়ার রাজা প্রথম ফ্রান্সিস এবং ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী তালেরাঁ প্রমুখ তাদের প্রাধান্য স্থাপনের মাধ্যমে সম্মেলনকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
ভিয়েনা সম্মেলনে তালেরাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দাও।
ভিয়েনা সম্মেলনে পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধি তালেরাঁ কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। এই সম্মেলনে ফ্রান্সের স্বার্থ অবহেলিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তালেরাঁ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিকে একত্রিত করে এবং তাদের মুখপাত্র মনোনীত হয়ে ফ্রান্সের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেন।
ভিয়েনা সম্মেলনের প্রকৃত লক্ষ্য কী ছিল?
ভিয়েনা সম্মেলনের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল –
1. ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত উদারনৈতিক ভাবধারা দমন করা এবং পুরাতনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
2. ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে ভাগ করে নেওয়া।
ভিয়েনা সম্মেলনে কোন সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়?
ভিয়েনা সম্মেলনে উত্থাপিত প্রধান সমস্যাগুলি হল –
1. নেপোলিয়ন কর্তৃক বিজিত রাষ্ট্রগুলিকে নতুন করে সংগঠিত করা।
2. ফ্রান্স যাতে ভবিষ্যতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে তার ব্যবস্থা করা।
3. নেপোলিয়ন কর্তৃক বিতাড়িত রাজবংশগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা ইত্যাদি।
ভিয়েনা সম্মেলনে কী কী নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল?
ভিয়েনা সম্মেলনে তিনটি নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনটি নীতি হল –
1. ন্যায্য অধিকার নীতি।
2. ক্ষতিপূরণ নীতি।
3. শক্তিসাম্য নীতি।
ভিয়েনা সম্মেলনের ন্যায্য অধিকার নীতি বলতে কী বোঝায়?
ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ন্যায্য অধিকার নীতি বলতে বোঝায় ফরাসি বিপ্লবের আগে যে রাজা বা রাজবংশ যেখানে রাজত্ব করতেন সেখানে আবার তাদের রাজত্ব করার অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। অর্থাৎ ইউরোপে প্রাক-বিপ্লব যুগের পুনঃপ্রবর্তন করা। এই নীতি অনুসারে ফ্রান্সে বুরবোঁ বংশ, হল্যান্ডে অরেঞ্জ বংশ এবং ইতালিতে পোপের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ক্ষতিপূরণ নীতি বলতে কী বোঝায়?
নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেসব রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের সেই ক্ষতি পূরণ করার জন্য যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তাকে ক্ষতিপূরণ নীতি বলা হয়। এই নীতি অনুসারে অস্ট্রিয়া উত্তর ইতালিতে লম্বার্ডি, ভেনেসিয়া, টাইরল প্রভৃতি লাভ করে। ইংল্যান্ড তার বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য ইউরোপের বাইরে মাল্টা, সিংহল, মরিসাস প্রভৃতি পায়। অর্থাৎ নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যভুক্ত অংশগুলি থেকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত শক্তিসাম্য নীতি বলতে কী বোঝায়?
ভিয়েনা সম্মেলনে প্রধান তিনটি নীতির অন্যতম ছিল শক্তিসাম্য নীতি। এই নীতির মূল কথা হল আগামী দিনে ফ্রান্স যাতে শক্তিশালী হয়ে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই নীতি অনুসারে ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে এবং রাইন প্রদেশগুলিকে প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনে শক্তিসাম্য নীতি কীভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল?
ভিয়েনা সম্মেলনে শক্তিসাম্য নীতিটি ফ্রান্স যাতে পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য প্রয়োগ করা হয়েছিল। ফ্রান্সের চারপাশে রাষ্ট্রীয় বেষ্টনী দেওয়ার পাশাপাশি ফ্রান্সের সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেওয়া হয় এবং ফরাসি ভূখণ্ডে মিত্রসেনা মোতায়েন করা হয়। এ ছাড়া ফ্রান্সের থেকে প্রচুর আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনে ফ্রান্সের প্রতি কীরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল?
ভিয়েনা সম্মেলনে –
1. ফ্রান্স যাতে ভবিষ্যতে ইউরোপে শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে সেজন্য তার সীমানাকে সংকুচিত করা হয়,
2. ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে সেখানে 5 বছরের জন্য মিত্রসেনা মোতায়েন রাখা হয়,
3. ফ্রান্সের চারপাশে বেষ্টনী গড়ে তোলা হয় ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনের ক্ষতিপূরণ নীতি অনুসারে ইংল্যান্ড ও রাশিয়া কোন্ কোন্ অঞ্চল লাভ করে?
ভিয়েনা সম্মেলনের ক্ষতিপূরণ নীতি অনুসারে ইংল্যান্ড পায় সিংহল, কেপ কলোনি, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, হেলিগোল্যান্ড, আয়োনীয় দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল। আর রাশিয়া পায় ফিনল্যান্ড, বেসারাভিয়া ও পোল্যান্ড প্রভৃতি অঞ্চল।
ভিয়েনা সম্মেলন কেন স্থায়ী হয়নি?
ভিয়েনা সম্মেলন স্থায়ী হয়নি, কারণ –
1. এর সিদ্ধান্তগুলি ছিল যুগবিরোধী,
2. এই সম্মেলনে উদারতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের আদর্শ উপেক্ষিত হয়েছিল,
3. অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, প্রাশিয়া প্রভৃতি দেশগুলি নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থপূরণের উদ্দেশ্যে অস্ট্রিয়াকে অন্ধের মতো অনুসরণ করেছিল।
ভিয়েনা ব্যবস্থা কি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করেছিল?
ভিয়েনা ব্যবস্থায় শক্তিবর্গ এমন কিছু পদক্ষেপ নেন যার মাধ্যমে তাদের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধ আচরণ প্রকটিত হয়। জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে নরওয়ের সঙ্গে সুইডেন এবং হল্যান্ডের সঙ্গে বেলজিয়ামকে সংযুক্ত করা হয়। ইতালিকে অস্ট্রিয়ার নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। সমগ্র ইতালিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত করা হয় ও রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করা হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনের গুরুত্ব কী?
ভিয়েনা ব্যবস্থা ব্যর্থ হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপকে প্রায় 40 বছর শান্তি দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই সম্মেলনই প্রথম সম্মেলন যেখানে ইউরোপীয় সমস্যার সমাধান সমবেতভাবে হয়েছিল। এই সম্মেলনের আদর্শ দ্বারাই পরবর্তীকালে বার্লিন সম্মেলন, ভার্সাই সন্ধি প্রভৃতি অনুপ্রাণিত হয়। এই সম্মেলনে বিশ্বশান্তি রক্ষার প্রয়াসে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতিসংঘ ও জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়। এই সম্মেলনে জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করা হলেও আন্তর্জাতিকতাবাদকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কনসার্ট অফ ইউরোপ বা ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বলতে কী বোঝায়?
ভিয়েনা সম্মেলনের পরবর্তীকালে এই সম্মেলনে গৃহীত বন্দোবস্তকে স্থায়ী করার চেষ্টা করা হয়। এজন্য ইউরোপীয় শক্তিবর্গ একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। একে কনসার্ট অফ ইউরোপ বা ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বলা হয়। কনসার্ট অফ ইউরোপ গড়ে উঠেছিল –
1. পবিত্র চুক্তি
2. চতুঃশক্তি চুক্তির মাধ্যমে।
ওয়ার্টবার্গ উৎসব কাকে বলে?
1815 খ্রিস্টাব্দের পর জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বুরসেনসাফট নামে একটি জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলে। জার্মানির 13টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র ও অধ্যাপক এর সদস্য হয়। 1817 খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের 300তম জন্মজয়ন্তী পালনের জন্য ছাত্র ও অধ্যাপকরা ওয়ার্টবার্গে সমবেত হয়ে জার্মানির জাতীয়তাবাদ ও ঐক্যের সমর্থনে বক্তৃতা দেন। একেই বলে ওয়ার্টবার্গ উৎসব।
বুরসেনসাফট কী?
ভিয়েনা সম্মেলনোত্তরকালে জার্মানির জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে 13টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপকদের নিয়ে যে জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছিল তা বুরসেনসাফট নামে খ্যাত। এই সংস্থার মূল কর্মসূচি ছিল জার্মানির যুবশক্তির মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রচার করা। প্রকৃতপক্ষে জার্মানিতে উদারনৈতিক আন্দোলনকালে (1815-48 খ্রি.) এই সংস্থা জার্মানির ঐক্যের মানসিক প্রস্তুতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
চতুঃশক্তি চুক্তি কবে স্বাক্ষরিত হয়? এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি কী কী?
চতুঃশক্তি চুক্তি 1815 খ্রিস্টাব্দের 20 নভেম্বর স্বাক্ষরিত হয়। চতুঃশক্তি চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি হল – অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, প্রাশিয়া।
চতুঃশক্তি চুক্তির উদ্দেশ্য কী ছিল?
চতুঃশক্তি চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল –
1. ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রাখা।
2. ফ্রান্সের সিংহাসনে বোনাপার্ট বংশের কেউ যাতে বসতে না পারে সেদিকে নজর রাখা।
3. বিপ্লবের হাত থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা এবং
4. নিজেদের স্বার্থবিজড়িত বিষয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা করা
ইউরোপীয় শক্তি সমবায় কী ও তা কেন গঠিত হয়?
1815 খ্রিস্টাব্দে মেটারনিখের উদ্যোগে অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যে চতুঃশক্তি সমবায় গড়ে ওঠে, তাকে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বলা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল –
1. ইউরোপে শান্তি বজায় রাখা এবং ফরাসি বিপ্লবের হাত থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা।
2. ভিয়েনায় স্বীকৃত ইউরোপের রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখা।
3. ভবিষ্যতে ফরাসি আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।
ট্রোপোর ঘোষণা বলতে কী বোঝো?
স্পেন, পর্তুগাল, ইতালির নেপলস প্রভৃতি স্থানের গণবিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে মেটারনিখ ট্রোপোর বৈঠক আহ্বান করেন 1820 খ্রিস্টাব্দে। এই বৈঠকে মেটারনিখ ট্রোপোর ঘোষণা জারি করেন। এই ঘোষণায় বলা হয় –
1. যদি কোনো সদস্য রাষ্ট্র অপর কোনো সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক কোনো সংস্কার প্রবর্তন করে, তবে শক্তি সমবায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
2. শক্তি সমবায় বিপ্লবকে বলপূর্বক দমন করে সেই দেশের শান্তি ও স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনবে। ট্রোপোর ঘোষণার দ্বারা শক্তি সমবায় কার্যত ইউরোপে সকল প্রকার অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রগুলিকে স্থায়ী করার সিদ্ধান্ত নেয়।
মেটারনিখ কে ছিলেন?
মেটারনিখ ছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর বা প্রধানমন্ত্রী। তিনি ছিলেন সমকালীন ইউরোপের সর্বাপেক্ষা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন কূটনীতিবিদ এবং ইউরোপীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। তাঁকে কূটনীতির রাজকুমার বলা হত। 1815 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1848 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে ইউরোপের ইতিহাসে মেটারনিখের যুগ বলা হয়।
ইউরোপের ইতিহাসে কোন্ সময়কে মেটারনিখের যুগ বলা হয়? মেটারনিখের যুগ কেন বলা হয়?
ইউরোপের ইতিহাসে 1815 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1848 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে মেটারনিখের যুগ বলা হয়। ভিয়েনা সম্মেলন বা 1815 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1848 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে মেটারনিখ ইউরোপীয় রাজনীতির উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। এই সময়কালে তাঁর ইচ্ছা অনুসারে ইউরোপীয় রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে — তিনিই ছিলেন ইউরোপের ভাগ্যনিয়ন্তা। তাই ঐতিহাসিক লুই ফিশার এই সময়কালকে মেটারনিখের যুগ বলে অভিহিত করেছেন।
স্ট্যাটাস কুয়ো (Status Quo) বা স্থিতাবস্থা নীতি কী?
কূটনীতির রাজপুত্র অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর প্রিন্স মেটারনিখ ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত জাতীয়তাবাদ, উদারতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে ইউরোপে প্রাক্-ফরাসি বিপ্লব যুগের আদর্শ, যথা — স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও ক্যাথলিক চার্চকে স্থায়ী রাখার চেষ্টা চালান। তাঁর এই পরিবর্তনবিরোধী রক্ষণশীল নীতির অপর নামই ছিল স্থিতাবস্থা নীতি বা স্ট্যাটাস কুয়ো (Status Quo)।
মেটারনিখের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি কী ছিল?
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মেটারনিখ –
1. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করেন;
2. ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পঠন-পাঠন বন্ধ করেন;
3. রাজনৈতিক দলগুলির সভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করেন;
4. জাতীয়তাবাদকে প্রতিরোধ করার জন্য বিভাজন ও শাসননীতি (Divide and Rule) চালু করেন।
পররাষ্ট্রনীতিতে:
1. বিশেষ অনুমতি ছাড়া বিদেশি পত্রপত্রিকা ও অধ্যাপকদের অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন।
মেটারনিখ পদ্ধতি কী?
প্রিন্স মেটারনিখ ছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর বা প্রধানমন্ত্রী। তিনি ছিলেন বিপ্লববিরোধী ও ঘোরতর রক্ষণশীল। তিনি প্রাক্-ফরাসি বিপ্লব যুগের রাজনৈতিক অবস্থার পুনঃপ্রবর্তন ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার গতিরোধ করার জন্য যে দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তাকে মেটারনিখ পদ্ধতি বলা হয়।
মেটারনিখতন্ত্রের দুটি মূল বৈশিষ্ট্য লেখো।
মেটারনিখতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল —
1. অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ;
2. বিপ্লবের কণ্ঠরোধ করার জন্য দমনমূলক নীতি গ্রহণ এবং সমগ্র ইউরোপে উদারনীতি ও জাতীয়তাবাদকে প্রতিহত করার জন্য প্রতিরক্ষাবলয় গঠন।
মেটারনিখ নীতির উদ্দেশ্য কী ছিল?
মেটারনিখের নীতির উদ্দেশ্য ছিল —
1. ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী যুগের রাজনীতি ফিরিয়ে আনা।
2. ইউরোপে জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার গতিরোধ করা।
3. ইউরোপের রাজনীতিতে অস্ট্রিয়ার নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বজায় রাখা।
মেটারনিখ পদ্ধতির সাফল্যের দুটি কারণ লেখো।
মেটারনিখ পদ্ধতির সাফল্যের উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হল —
1. তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অস্ট্রিয়া নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে সমর্থ হয় এবং
2. তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপকে অন্তত 33 বছর শান্তি দিয়েছিলেন।
মেটারনিখ পদ্ধতি কেন ব্যর্থ হয়?
মেটারনিখ জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক প্রভাব থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলির যথাযথ সমাধানের চেষ্টা না করে শক্তির দ্বারা দমন করতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হন। 1848-এর বিপ্লবে যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। মেটারনিখ পদ্ধতি ছিল রক্ষণশীলতার সমর্থক ও যুগধর্ম বিরোধী। ইতিহাসের নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করে তিনি সমুদ্রের ঢেউকে বালির বাঁধ দিয়ে আটকাতে চেয়েছিলেন।
কার্লসবাড ডিক্রি কী?
কার্লসবাড হল জার্মানির একটি শহর। 1819 খ্রিস্টাব্দে মেটারনিখ কার্লসবাড থেকে যে হুকুমনামা জারি করেন, তা কার্লসবাড ডিক্রি নামে পরিচিত। এই ডিক্রি অনুসারে:
1. জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়।
2. জার্মানির প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক মতবাদের কণ্ঠরোধ করা হয়।
মনরো নীতি কী?
দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনীয় উপনিবেশগুলিতে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে শক্তি সমবায় ওই উপনিবেশগুলির আন্দোলন দমনে উদ্যোগী হয়। এই অবস্থায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি জেমস মনরো 1823 খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত মনরো নীতি ঘোষণা করেন। এতে বলা হয় —
1. আমেরিকা সম্পূর্ণভাবে আমেরিকাবাসীর জন্য
2. আমেরিকায় ইউরোপীয় হস্তক্ষেপ মার্কিন দেশ সহ্য করবে না
3. আমেরিকায় উপনিবেশ বিস্তারের সমস্ত প্রচেষ্টায় বাধা দেওয়া হবে।
1815 খ্রিস্টাব্দের ইউরোপে পরিবর্তনের ধারাগুলি (Forces of Changes) এবং পরিবর্তনবিরোধী বা ঐতিহ্যবাহী ধারাগুলি (Forces of Continuity) কী ছিল?
1815 খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে পরিবর্তনের ধারাগুলি ছিল — জাতীয়তাবাদ, উদারনীতি, গণতন্ত্র, শিল্পায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। অন্যদিকে পরিবর্তনবিরোধী ধারাগুলি ছিল — স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও ক্যাথলিক চার্চ ইত্যাদি।
পুনঃপ্রতিষ্ঠিত রাজবংশ বলতে কী বোঝায়?
ফরাসি রাজ ষোড়শ লুই-এর মৃত্যুর পর ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজবংশের সমাপ্তি ঘটেছিল। কিন্তু 1815 খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা কংগ্রেসের ন্যায্য অধিকার নীতির ভিত্তিতে বুরবোঁ বংশের অষ্টাদশ লুইকে পুনরায় ফ্রান্সের সিংহাসনে বসানো হয়। এই ঘটনাকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত রাজবংশ বলা হয়।
ভিলিল কে ছিলেন?
অষ্টাদশ লুই প্রধানমন্ত্রীর পদ দেন ভিলিল নামে এক রাজতন্ত্রীকে। ভিলিল দেকাজের পর 1821 খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন এবং 1828 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ওই পদে আসীন ছিলেন। তাঁকে অর্থনীতির জাদুকর বলা হত। তিনি অর্থনৈতিক সংস্কার করে ফরাসিদের আর্থিক স্বাচ্ছল্য বাড়ান।
পলিগন্যাক কোন্ চারটি প্রতিক্রিয়াশীল আইন জারি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন দশম চার্লসকে?
জনসাধারণের স্বার্থ ও অধিকার খর্ব করার উদ্দেশ্যে পলিগন্যাক নিম্নলিখিত চারটি আইন জারি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন দশম চার্লসকে —
1. প্রতিনিধি সভা ভেঙে দেওয়া
2. ভোটদাতাদের সংখ্যা কমানো
3. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা এবং
4. জাতীয় সভার নতুন নির্বাচনের আদেশ দেওয়া।
জুলাই বিপ্লবের গুরুত্ব কী ছিল?
জুলাই বিপ্লবের গুরুত্ব —
1. ভিয়েনা সম্মেলনের ন্যায্য অধিকার নীতি অনুসারে ফ্রান্সে যে বুরবোঁ বংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জুলাই বিপ্লবের ফলে তার অবসান ঘটেছিল।
2. জুলাই বিপ্লবের ফলে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের ভাবধারা ফ্রান্সের সীমা ছাড়িয়ে বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবে রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
রাজা রামমোহন রায় ফরাসি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ভলতেয়ার, রুশো ও মন্তেস্কুর চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। 1830 খ্রিস্টাব্দের 27-29 জুলাই মাত্র তিন দিন আন্দোলন করে 30 জুলাই বিপ্লবী জনসাধারণ ফরাসি সম্রাট দশম চার্লসকে সিংহাসনচ্যুত করেন। ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে ভারতে রাজা রামমোহন রায় অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। তাঁর আনন্দের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ তিনি বন্দরে দুটি ফরাসি জাহাজে গিয়ে ফরাসি যাত্রীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘glory, glory, glory to France’।
জুলাই রাজতন্ত্র বলতে কী বোঝো?
1830 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের ফলে বুরবোঁ বংশের শাসনের অবসান হয়। ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন অর্লিয়েন্স বংশের লুই ফিলিপ। তিনি বিপ্লবী সংবিধান মেনে শাসন পরিচালনার শপথ গ্রহণ করেন। জুলাই বিপ্লবের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সম্রাট লুই ফিলিপের শাসনকালকে (1830-1848 খ্রি.) জুলাই রাজতন্ত্র বলা হয়।
জুলাই রাজতন্ত্র কত বছর স্থায়ী হয়েছিল? এই সময় ফ্রান্সের রাজা কে ছিলেন?
জুলাই রাজতন্ত্র 18 বছর (1830-48 খ্রি.) স্থায়ী হয়েছিল। এই সময়ে ফ্রান্সের রাজা ছিলেন অর্লিয়েন্স বংশের লুই ফিলিপ।
সংস্কারের ভোজসভা (Reform Banquet) কী?
জুলাই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে 1847 খ্রিস্টাব্দ থেকে ভোটাধিকার সংস্কার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে প্রধানমন্ত্রী গিজো রাজনৈতিক জনসভা নিষিদ্ধ করেন। এমতাবস্থায় সংস্কারপন্থীরা সভাসমিতির আয়োজন করে সংস্কারের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তাই এগুলি সংস্কারের ভোজসভা নামে পরিচিত।
নাগরিক রাজা কাকে বলা হত? তাঁর রাজত্বকাল কেন বিখ্যাত?
ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপকে নাগরিক রাজা বলা হত। কারণ — লুই ফিলিপ উত্তরাধিকারসূত্রে সিংহাসনে বসেননি, ফ্রান্সের নাগরিকদের ইচ্ছানুসারে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেছিলেন। লুই ফিলিপের রাজত্বকাল 1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের জন্য বিখ্যাত।
ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ কী ছিল?
1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব হয়েছিল। এই বিপ্লবের কারণ ছিল —
1. লুই ফিলিপের সরকার ফ্রান্সের শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
2. 1844 খ্রিস্টাব্দ থেকে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। খরা, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, বেকার সমস্যা প্রভৃতি কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
লুই ফিলিপের বিরুদ্ধে জনগণ কেন ক্ষুব্ধ হয়েছিল?
1830 খ্রিস্টাব্দে জনগণ লুই ফিলিপকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসিয়েছিল। কিন্তু তিনি বিভিন্ন শ্রেণির দাবিদাওয়া, গৌরবময় পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ সংস্কারসাধনে ব্যর্থ হওয়ায় জনগণ তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?
1848 খ্রিস্টাব্দের 22 ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের রাজনৈতিক দলগুলি মিলিত হয়ে প্যারিসে এক বিশাল জনসভা আহ্বান করে। সরকারের পুলিশবাহিনী এই জনসভা ভেঙে দেয়। ফলে জনগণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং 23 ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী গিজোর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। এই সময় পুলিশবাহিনীর গুলিতে 23 জন নিহত ও 30 জন আহত হয়। এই ঘটনায় জনগণ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে সম্রাট লুই ফিলিপের পদত্যাগের দাবিতে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। এর ফলে রাজা লুই ফিলিপ সিংহাসন ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য কী ছিল?
1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য হল –
1. ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে আন্দোলনের মেয়াদ ছিল মাত্র ৩ দিন (22-24 ফেব্রুয়ারি)।
2. ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল প্যারিস শহরে। প্যারিস ছিল এই বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র। ফ্রান্সের অন্যান্য শহর বা গ্রামে এর কোনো প্রভাব ছিল না।
1848 খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবকে বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লব কেন বলা হয়?
1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মস্তিষ্ক হিসেবে অনেক জায়গায় বুদ্ধিজীবীরাই প্রধান ভূমিকা নেন। ফ্রান্সে লা-মার্টিন, বোহেমিয়াতে প্যালাকি, ইতালিতে আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক ম্যাৎসিনি এই বিপ্লবকে প্রেরণা ও নেতৃত্ব দেন। বুদ্ধিজীবী শ্রেণি 1815 খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনার স্থিতাবস্থাকে ভেঙে ইউরোপকে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র, উদারতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনের অধীনে আনার উদ্যোগ নেন। তাই ঐতিহাসিক নেমিয়ার এই বিপ্লবকে বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন।
1848 খ্রিস্টাব্দকে বিপ্লবের বছর কেন বলা হয়?
1848 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে তার প্রভাবে সমগ্র ইউরোপে বিপ্লবের ঢেউ ওঠে। স্বৈরাচারী শাসনতন্ত্র এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, জার্মানি এমনকি ইংল্যান্ড-এও ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে এবং একই বছর অনেকগুলি আন্দোলন সংঘটিত হয়। ইতিপূর্বে ইউরোপে কখনই এরকম স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয়তাবাদী গণ আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। এজন্য 1848 খ্রিস্টাব্দকে বিপ্লবের বছর বলা হয়।
কবে ও কীভাবে ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ও দ্বিতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়?
1848 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে লুই ফিলিপ ক্ষমতাচ্যুত হলে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কিছুদিন পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নেপোলিয়নের ভ্রাতুষ্পুত্র লুই নেপোলিয়ন ক্ষমতা লাভ করেন। 1852 খ্রিস্টাব্দে লুই নেপোলিয়ন প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দ্বিতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
উদ্যানপথ বা বুলেভার্ড-এর হত্যাকাণ্ড কাকে বলে?
1851 খ্রিস্টাব্দের 2 ডিসেম্বর লুই নেপোলিয়ন সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আইনসভা ভেঙে দেন। সেই সময় ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দিলে চরম দমননীতির দ্বারা সেই বিদ্রোহ তিনি দমন করেন। লক্ষাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে কারাগারে অথবা নির্বাসনে পাঠানো হয়। এই দমননীতিই উদ্যানপথ বা বুলেভার্ড হত্যাকাণ্ড নামে খ্যাত (4 ডিসেম্বর, 1851 খ্রিস্টাব্দ)।
কে, কাকে এবং কেন ক্ষুদে নেপোলিয়ন বলে উপহাস করেন?
1851 খ্রিস্টাব্দের 2 ডিসেম্বর ফরাসি আইনসভাকে ক্ষমতাচ্যুত করে লুই নেপোলিয়ন এক নতুন সংবিধান প্রবর্তন করেন এবং এক বছরের মধ্যে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন তথা তৃতীয় নেপোলিয়ন নামধারণ করেন। তিনি নিঃসন্দেহে গুণী ব্যক্তি ছিলেন, অবশ্য যোগ্যতার মাপকাঠিতে তিনি তাঁর মহান পিতৃব্যের তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র ছিলেন বলে বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো তাঁকে ক্ষুদে নেপোলিয়ন বলে অভিহিত করেছেন।
ফ্রান্সকে বিপ্লব নগরী বলা হয় কেন?
ফ্রান্সে 1789 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব, 1830 খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লব এবং 1848 খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এর ফলে ফ্রান্সে বহুবার রাজতন্ত্রের উত্থান ও পতন ঘটে। সেইজন্য অনেক ঐতিহাসিক ফ্রান্সকে বিপ্লব নগরী বলেছেন।
জাতীয় কর্মশালা কী?
1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হলে প্রজাতান্ত্রিক সরকার বেকার মানুষদের কর্মসংস্থানের জন্য জাতীয় কর্মশালা বা ন্যাশনাল ওয়ার্কশপ স্থাপন করে।
ইটালির ঐক্যের পথে প্রধান বাধাগুলি কী ছিল?
আটটি খণ্ডিত রাজ্য স্থাপনের ফলে ইটালির রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়। ইটালির উপর বিদেশিদের প্রভাব, পোপের আধিপত্য, ফ্রান্সের আধিপত্য, সর্বোপরি ঐক্যবদ্ধ ইটালির জাতীয়তাবোধের অভাব দেশের ঐক্যসাধনের পথে প্রধান বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
রিসঅর্গিমেন্টো কী?
রিসঅর্গিমেন্টো কথাটির অর্থ নবজাগরণ। বৈদেশিক শাসন ও শোষণে অতিষ্ঠ ইটালিবাসী 1830-48 খ্রিস্টাব্দে এক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন যার লক্ষ্য ছিল বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি ও সংস্কারমূলক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা। এর ফলে ইটালির ভাবজগতে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এই আলোড়নই ইটালির ইতিহাসে রিসঅর্গিমেন্টো নামে পরিচিত।
কার্বোনারি কী?
কার্বোনারি হল ইটালির এক গুপ্ত সমিতি। ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থার অবসানের জন্য ইটালিতে যেসব গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিল সেগুলির মধ্যে কার্বোনারি (1815 খ্রি.) অন্যতম। কার্বোনারি কথার অর্থ জলন্ত অঙ্গারবাহী। নেপলস ছিল এর প্রধান কেন্দ্র। ইটালি থেকে বিদেশি শাসনের অবসান, ঐক্যবদ্ধ ইটালি গঠন ও উদার গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তনই ছিল কার্বোনারিদের প্রধান লক্ষ্য। এরা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষপাতী ছিলেন।
কার্বোনারি আন্দোলনের ব্যর্থতার দুটি কারণ লেখো।
কার্বোনারি আন্দোলনের ব্যর্থতার দুটি কারণ হল —
1. কার্বোনারি দল পরিচালিত বিদ্রোহগুলি ছিল আঞ্চলিক, বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন এবং অপরিকল্পিত।
2. যোগ্য নেতৃত্বের অভাব আন্দোলনগুলির সফলতার পথে প্রধান বাধাস্বরূপ ছিল।
ম্যাৎসিনি কে ছিলেন? তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ কী ছিল?
ইটালির মুক্তি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন ম্যাৎসিনি। তাঁর আদর্শ, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ ইটালিবাসীকে স্বদেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর মতে, অস্ট্রিয়ার প্রভাব থেকে ইটালিকে মুক্ত করার জন্য বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন নেই। ইটালির যুবশক্তির উপর তাঁর অগাধ আস্থা ছিল। তাই তিনি যুবশক্তিকে নিয়ে ইয়ং ইটালি নামে এক দল গঠন করেন এবং পোপ নবম পায়াসকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রজাতন্ত্র স্থাপন করেন।
ইয়ং ইটালি কী?
ইটালির যুবসমাজকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য জোসেফ ম্যাৎসিনি 1832 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের মার্সাই শহরে ইয়ং ইটালি নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এই দলের উদ্দেশ্য ছিল — শিক্ষাপ্রসার, চরিত্র গঠন ও আত্মত্যাগের দ্বারা ইতালীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করা। ম্যাৎসিনি এই দলের আদর্শ প্রচার করার জন্য ইয়ং ইটালি নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন।
ক্যাভুর কে ছিলেন?
পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কাউন্ট ক্যাভুর। অত্যন্ত দক্ষ, বুদ্ধিমান ও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন তিনি। তাঁর লক্ষ্য ছিল পিডমন্ট রাজবংশের অধীন সমগ্র ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করা। ক্যাভুর বুঝেছিলেন যে, অস্ট্রিয়ার প্রভাব থেকে ইটালিকে মুক্ত করতে হলে বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন।
ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ক্যাভুর কী নীতি নিয়েছিলেন?
ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ক্যাভুর বিদেশি শক্তির সাহায্য গ্রহণ করেন। তাঁর মতে, বিদেশি শক্তির সাহায্য ছাড়া ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। 1854 খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হন।
প্লোমবিয়ার্সের চুক্তি কবে, কারা স্বাক্ষর করেছিল? এর শর্তগুলি লেখো।
1858 খ্রিস্টাব্দে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্যাভুর এবং ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের মধ্যে প্লোমবিয়ার্সের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে তৃতীয় নেপোলিয়ন ইটালির ঐক্য আন্দোলনে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে সামরিক সাহায্য দিতে স্বীকৃত হন এবং এর পরিবর্তে নেপোলিয়ন স্যাভয় ও নিস পাবেন বলে স্থির করা হয়।
ভিন্নাফ্রাঙ্কার সন্ধি কবে, কাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়?
1859 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের তৃতীয় নেপোলিয়ন ও অস্ট্রিয়ার জোসেফ পিডমন্টের সম্মতির অপেক্ষা না রেখেই একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদন করেন, যা ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি নামে পরিচিত। এই সন্ধি দ্বারা লম্বার্ডি ও মিলান পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত হলেও ভেনেসিয়া অস্ট্রিয়ার অধীনে থেকে যায়। ক্যাভুর এই চুক্তিকে নেপোলিয়নের বিশ্বাসঘাতকতা বলে বর্ণনা করেছেন।
জুরিখের সন্ধির (1859 খ্রি.) শর্ত কী ছিল?
জুরিখের সন্ধির শর্ত ছিল –
1. সার্ডিনিয়ার সঙ্গে লম্বার্ডিকে যুক্ত করা হবে।
2. ভেনিস অস্ট্রিয়ার অধিকারে থাকবে।
3. পার্মা, মডেনা, টাসকানি, রোমানা প্রভৃতি রাজ্যের শাসকরা নিজেদের রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন।
1859 খ্রিস্টাব্দে ক্যাভুর কেন পদত্যাগ করেন?
তৃতীয় নেপোলিয়নের চাপে পিডমন্টের রাজা ইমান্যুয়েল অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জুরিখের সন্ধি স্বাক্ষর করেছিলেন। ক্যাভুর এই সন্ধি অপমানজনক এবং তৃতীয় নেপোলিয়নের বিশ্বাসঘাতকতার ফল। তাই তিনি ভিক্টর ইমান্যুয়েলকে এই চুক্তি বর্জন করতে অনুরোধ করেন। ইমান্যুয়েল এতে সম্মত না হওয়ায় ক্যাভুর 1859 খ্রিস্টাব্দে পদত্যাগ করেন।
গ্যারিবল্ডি কে ছিলেন?
ইটালির জাতীয় আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ ছিলেন গ্যারিবল্ডি। ম্যাৎসিনির দ্বারা রোমে প্রজাতন্ত্র স্থাপনকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটলে তিনি দেশান্তরিত হন। পরে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ইটালির মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু গৃহযুদ্ধে ইটালির ঐক্য আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনায় গ্যারিবল্ডি পিডমন্টের রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েলের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এক স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ইটালি গঠনের আশায়। ফলে ইটালির ঐক্য আন্দোলন সংকটের হাত থেকে রক্ষা পায়।
গ্যারিবল্ডির বাহিনীর নাম কী? এই বাহিনীর সাহায্যে তিনি কোন্ অঞ্চল জয় করেন?
ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গ্যারিবল্ডি লালকোর্ট বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনীর সাহায্যে তিনি 1860 খ্রিস্টাব্দে সিসিলি ও নেপলস জয় করে সেখানে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
স্যাডোয়ার যুদ্ধ বা কোনিগ্রাৎস-এর যুদ্ধ কবে, কাদের মধ্যে সংঘটিত হয়? এর ফলাফল কী হয়েছিল?
1866 খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে স্যাডোয়ার যুদ্ধ বা কোনিগ্রাস-এর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হয় এবং প্রাগের সন্ধির দ্বারা এর পরিসমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধের ফলে অস্ট্রিয়া জার্মানির নেতৃত্ব ত্যাগ করে। প্রাশিয়া উত্তর জার্মানি লাভ করে এবং তার ঐক্য আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়। অন্যদিকে ভেনেসিয়া লাভ করায় ইটালির ঐক্য লাভের পথ ত্বরান্বিত হয়।
কোন্ যুদ্ধ সাত সপ্তাহের যুদ্ধ নামে পরিচিত এবং কেন?
1866 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত স্যাডোয়ার যুদ্ধ সাত সপ্তাহের যুদ্ধ নামে পরিচিত। 1866 খ্রিস্টাব্দের জুন-জুলাই মাসে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়, তা সাত সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। এই যুদ্ধকে ইংরেজ ঐতিহাসিকরা স্যাডোয়া ও জার্মান ঐতিহাসিকরা কোনিগ্রাস নাম দেন। এই যুদ্ধে অস্ট্রিয়া শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
ভিক্টর ইমান্যুয়েল কে ছিলেন? তিনি কেন বিখ্যাত?
ভিক্টর ইমান্যুয়েল ছিলেন পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার শাসক। তিনি 1866 খ্রিস্টাব্দে স্যাডোয়ার যুদ্ধে প্রাশিয়ার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে ভেনেসিয়াকে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেন। আবার 1870 খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়া যুদ্ধ চলাকালীন রোম দখল করে ইটালির ঐক্য আন্দোলন সম্পন্ন করেন।
ইটালির ঐক্যে বিদেশিরা কীভাবে সাহায্য করেছিল?
ইতালীয়রা প্রথম ঐক্যের স্বাদ পেয়েছিল নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অধীনে। অতঃপর তৃতীয় নেপোলিয়ন প্লোমবিয়ার্সের চুক্তি দ্বারা এবং বিসমার্ক ভেনেসিয়া ও রোম ইটালির হাতে তুলে দিয়ে ইটালির ঐক্যকে ত্বরান্বিত করেছিলেন।
সর্বজার্মানবাদ বা প্যান-জার্মানিজম (Pan-Germanism) কী?
সর্বজার্মানবাদ বা প্যান-জার্মানিজম বলতে বোঝায় সব জার্মানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বিভিন্ন জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অধ্যাপকগণ, কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সাংবাদিকরা অখণ্ড জার্মান জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রচার করেন। এর ফলস্বরূপ জার্মানদের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে এবং এর ফলে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা আলোচনা করো।
জার্মানির বুদ্ধিজীবীরা জার্মান জনগণকে রাজনৈতিক ও ভাবগত দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সর্বজার্মানবাদ প্রচার করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সাহিত্যে লেসিং, হার্ডার, গ্যেটে প্রমুখ; দর্শনে শিলার ফিচে, কান্ট, হেগেল এবং সংগীতে বাখ ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ডালমন্ট, লিস্ট প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ভিয়েনা কর্মসূচি বা ভিয়েনা প্রোগ্রাম কী?
1819 খ্রিস্টাব্দে কার্লসবাড ডিক্রি জারির পর মেটারনিখের উদ্যোগে জার্মানির শাসকরা উদারনীতি ধ্বংসের জন্য যে কর্মসূচি নেন, তা ভিয়েনা কর্মসূচি নামে খ্যাত। ভিয়েনা কর্মসূচিকে ট্রপোর ঘোষণাপত্রের পূর্বাভাস বলা যায়।
জোলভেরেইন কী?
জোলভেরেইন হল একটি শুল্কসংঘ। এটি 1819 খ্রিস্টাব্দে জার্মান অর্থনীতিবিদ মাজেন-এর উদ্যোগে এবং প্রাশিয়ার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন জার্মান রাজ্যগুলিতে যে বিভিন্ন ধরনের আমদানি-রপ্তানি শুল্ক চালু ছিল তা দূর করার জন্য এই শুল্কসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 1850 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সব জার্মান রাজ্য এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। জোলভেরেইন জার্মানির ঐক্য আন্দোলনের পটভূমি রচনা করেছিল।
ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট বলতে কী বোঝায়?
1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে জার্মান জাতীয়তাবাদীরা উৎসাহিত হন। তাঁরা 1848 খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্কফোর্ট শহরে জার্মান রাজ্যগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা আহ্বান করেন। একে ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট বলা হয়। এখানে 586 জন নির্বাচিত জার্মান প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্টের উদ্দেশ্য কী ছিল?
1848 খ্রিস্টাব্দে 18 মে ফ্রাঙ্কফোর্ট শহরে 586 জন নির্বাচিত জার্মান প্রতিনিধিদের নিয়ে ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট আহৃত হয়েছিল। ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্টের উদ্দেশ্য ছিল —
1. সমগ্র জার্মান রাজ্যগুলিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জার্মানি গঠন করা।
2. জার্মানির জন্য একটি সংবিধান রচনা করা।
3. জার্মানিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
Real Politic বলতে কী বোঝো? কোন্ বিখ্যাত রাজনীতিক এই নীতি মেনে চলতেন?
যে রাজনীতিতে নীতিবোধ, আদর্শ এবং তত্ত্বের পরিবর্তে ক্ষমতা এবং বাস্তববাদ বেশি গুরুত্ব পায়, তাকে Real Politic নামে অভিহিত করা যায়। অটো ভন বিসমার্ক Real Politic নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তা মেনে চলতেন।
বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি বলতে কী বোঝায়?
প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মান রাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীন জার্মানি গড়ে তোলার জন্য রক্ত ও লৌহ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। রক্ত ও লৌহ নীতি বলতে বোঝায় যুদ্ধ ও কঠোর শৃঙ্খলা। বিসমার্ক একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করে ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাঁর রক্ত ও লৌহ নীতির ফলে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন জার্মানি গড়ে ওঠে।
বিসমার্কীয় যুগ কী? কর্ণধারের বিদায় (Dropping of the pilot) কী?
1870-1890 সময়কালে ইউরোপীয় রাজনীতিতে জার্মানির বিসমার্কের অসাধারণ প্রভাবের জন্য ওই সময়কালকে বিসমার্কীয় যুগ বলা হয়।
জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়াম ও বিসমার্ক উভয়েই ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতালোভী। তাই এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আপসের কোনো সম্ভাবনা না থাকায় কাইজার বিসমার্ককে পদচ্যুত করেন, যাকে পাঞ্চ পত্রিকা কর্ণধারের বিদায় বলে অভিহিত করে।
ওয়েল্ট পলিটিক (Welt Politik) কী? এর প্রবক্তা কে?
জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়াম বিসমার্কের পরিতৃপ্তির আদর্শ ত্যাগ করে বিশ্ব রাজনীতিতে জার্মানির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা ওয়েল্ট পলিটিক নামে খ্যাত। এই নীতির মূল কথা হল — বিশ্ব রাজনীতিতে প্রাধান্য স্থাপন, সাম্রাজ্য বিস্তৃতি ও শক্তিশালী নৌবহর স্থাপন।
আউসগ্লাইস বা অসলীচ্ (Augsleich) বা 1867-এর আপস-মীমাংসা বলতে কী বোঝায়?
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হাঙ্গেরির সঙ্গে অস্ট্রিয়ার দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলছিল। অবশেষে 1867 সালে একটি আপসরফার মাধ্যমে স্থির হয় যে, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হাঙ্গেরি সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে এবং অস্ট্রিয়ার সম্রাট হাঙ্গেরির রাজা হিসেবে গণ্য হবেন। এই আপসরফারই আউসগ্লাইস বা অসলীচ্ বা 1867 সালের আপসমীমাংসা নামে খ্যাত।
ভিয়েনা চুক্তি (1864) কাদের মধ্যে হয়? এই চুক্তির শর্তাবলি উল্লেখ করো।
1864 সালে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরাজিত ডেনমার্ক ভিয়েনা চুক্তির দ্বারা শ্লেজউইগ ও হলস্টাইনের উপর থেকে সব দাবি ত্যাগ করে।
গ্যাস্টিনের সন্ধি (1865) কাদের মধ্যে হয়? এই সন্ধির শর্তাবলি উল্লেখ করো।
গ্যাস্টিনের সন্ধি দ্বারা প্রাশিয়া শ্লেজউইগ ও অস্ট্রিয়া হলস্টাইনের প্রদেশ লাভ করে। এ ছাড়া চুক্তি অনুসারে প্রাশিয়া হলস্টাইনের অন্তর্ভুক্ত কিয়েল বন্দর এবং একটি খাল খননের অধিকারসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা লাভ করে।
বিয়ারিটৎস (Biarritz)-এর সন্ধি (1865) কাদের মধ্যে হয়? এর শর্তগুলি কী ছিল?
ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধের পর বিসমার্ক বিয়ারিটৎস নামক স্থানে তৃতীয় নেপোলিয়নের সঙ্গে গোপনে এক চুক্তি করেন। এই চুক্তিতে ঠিক হয় যে, অস্ট্রিয়া-প্রাশিয়ার যুদ্ধে তৃতীয় নেপোলিয়ন নিরপেক্ষ থাকবেন এবং পরিবর্তে জার্মানি থেকে কিছু ভূখণ্ড ফ্রান্স পাবে।
এমস টেলিগ্রাম কী?
1870 সালের জুলাই মাসে এমস নামক স্থানে প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডরিক উইলিয়ামের সঙ্গে ফরাসি রাষ্ট্রদূত কাউন্ট বেনেদিতির মধ্যে স্পেনের সিংহাসনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। এই আলোচনার বিষয়বস্তু প্রাশিয়ার রাজা বিসমার্ককে টেলিগ্রামের মাধ্যমে জানান। এটি এমস টেলিগ্রাম নামে পরিচিত।
এমস টেলিগ্রামের মাধ্যমে কীভাবে সেডানের যুদ্ধ শুরু হয়?
এমস টেলিগ্রামের বিষয়বস্তু জানার পর বিসমার্ক ইচ্ছাকৃতভাবে টেলিগ্রামের কতগুলি শব্দ বাদ দিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশ করলে বিকৃত এই টেলিগ্রাম ফরাসি জনগণের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ফলে ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে সেডানের যুদ্ধ শুরু হয়।
সেডানের যুদ্ধ কবে, কাদের মধ্যে সংঘটিত হয়? এর ফলাফল কী ছিল?
1870 সালে প্রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে সেডানের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হয়। ফ্রান্সের পরাজয়ের পর তৃতীয় নেপোলিয়নের পতন ঘটে। ফ্রান্সে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়। পরাজিত ফ্রান্স বাধ্য হয় প্রাশিয়াকে দক্ষিণ জার্মানি ও ইতালিকে রোম ফিরিয়ে দিতে। ফলে জার্মানি ও ইতালির ঐক্য আন্দোলন সম্পূর্ণ হয়।
সেডানের যুদ্ধের গুরুত্ব কী ছিল?
সেডানের যুদ্ধের গুরুত্ব –
1. জার্মানি ও ইতালির রাজনৈতিক ঐক্য সম্পূর্ণ হয়েছিল।
2. ফ্রান্সকে পরাজিত করায় ইউরোপের ইতিহাসে জার্মানির মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। অপরদিকে ফরাসি পার্লামেন্ট তৃতীয় নেপোলিয়নকে পদচ্যুত করে। ফলে ফ্রান্সে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে ও তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের সূচনা হয়।
কুলটুর ক্যাম্ফ কী?
বিসমার্কের সঙ্গে জার্মানির ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের সংগ্রাম ইতিহাসে কুলটুর ক্যাম্ফ বা সভ্যতার সংগ্রাম নামে পরিচিত। বিসমার্ক একাধিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ক্যাথলিকদের সম্পূর্ণভাবে দমন করতে প্রয়াসী হলে ক্যাথলিকগণ শ্রমিক ও সমাজতন্ত্রীদের সমর্থন ও সহযোগিতায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিসমার্ক রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে ক্যাথলিকদের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করেন।
লুই কসুথ কে?
লুই কসুথ ছিলেন হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা। 1848 সালে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে কসুথের নেতৃত্বে হাঙ্গেরিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। তাঁর প্রচেষ্টায় কিছুদিনের জন্য হাঙ্গেরি অস্ট্রিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার চাপে কসুথ দেশত্যাগী হন। তাঁকে হাঙ্গেরির ম্যাৎসিনি বলে অভিহিত করা হয়।
অটোমান সাম্রাজ্যের সূচনা কীভাবে হয়?
ত্রয়োদশ শতকে দুধর্ষ মঙ্গোলরা যখন আনাতোলিয়া থেকে ইরানের দিকে সরে গেল তখন আনাতোলিয়ায় এক রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সেখানে নানা তুর্কমান (Turcoman) রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এই তুর্কমান গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে ওসমান (Osman) 1281 সালে আত্মপ্রকাশ করে। এই ওসমানের (Osman) আমল থেকেই অটোমান রাজবংশের সূচনা হয়।
ইউরোপের রুগ্ণ ব্যক্তি কোন দেশকে এবং কেন বলা হয়?
তুরস্ককে রাশিয়া তার সামরিক দুর্বলতার জন্য ইউরোপের রুগ্ণ দেশ বলে অভিহিত করেছিল। মধ্যযুগীয় অন্ধকারাচ্ছন্ন তুরস্ককে ঊনবিংশ শতকের সভ্যতার আলো স্পর্শ করেনি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শাসনতান্ত্রিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে তুরস্ক ছিল অন্যান্য দেশের তুলনায় অনগ্রসর। ফলে বিভিন্ন জাতি অধ্যুষিত তুরস্কে নানান জাতি তাদের জাতিগত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণ আন্দোলন গড়ে তোলে। এই অস্থিরতার জন্যই তুরস্ককে রুগ্ণ ব্যক্তি বলা হয়েছিল।
পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা বা বলকান সমস্যা কী?
ঊনবিংশ শতকে রাশিয়ার তুরস্ক গ্রাসের প্রবল আকাঙ্ক্ষা, তাতে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও জার্মানির বিরোধিতা, দানিয়ুব ও ইজিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলের খ্রিস্টান জাতিসমূহের জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা, তুরস্কের দুর্বলতা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে যে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাকে বলকান বা পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা বলা হয়।
বলকান জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝো?
স্বাধীনতা লাভের পর গ্রিসের লক্ষ্য ছিল বলকান অঞ্চলে গ্রিক ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চলগুলোকে নিজের অধীনে আনা। সার্বিয়া, মোলদাভিয়া, ওয়ালাচিয়া অর্ধ-স্বাধীন রাজ্য হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। বলকান অঞ্চলে অধিকাংশ অ-তুর্কি জনগণই ছিল শ্লাভ জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। রাশিয়াও ছিল শ্লাভ জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। সুতরাং রাশিয়ার সঙ্গে এদের এক ধরনের ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে, ফলে রাশিয়ার সাহায্যে প্যান-শ্লাভ আন্দোলন এবং মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়ার নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদ বলকান অঞ্চলের সমস্যাকে জটিলতর করে তোলে।
বলকান লিগ কবে ও কেন গঠিত হয়েছিল?
তুরস্কের সুলতানের অত্যাচার থেকে জাতীয়তাবাদী বলকানবাসীকে সাহায্য করার জন্য 1912 সালে গ্রিস, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো এবং বুলগেরিয়া মিলিতভাবে বলকান লিগ গঠন করে।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ কত সালে শুরু হয় এবং কত সালে এর অবসান ঘটে?
1854 সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়। 1856 সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটে।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে দুপক্ষে কোন্ কোন্ দেশ ছিল? অথবা, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ কাদের মধ্যে হয়েছিল?
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মূলত রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে। কিন্তু রাশিয়ার প্রাধান্য খর্ব করা এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্কের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া প্রভৃতি দেশ।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ কী?
রাশিয়া 1774 সালে তুরস্কের মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া নামক স্থান দুটি দখল করে নিলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া মিলিতভাবে ওই স্থান দুটি ত্যাগ করতে রাশিয়াকে অনুরোধ করে। রাশিয়া সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, যা ক্রিমিয়ার যুদ্ধ নামে খ্যাত (1854)।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব বা ফলাফল লেখো।
1854 সালে অনুষ্ঠিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলে-
1. তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষিত হয়।
2. নিকট প্রাচ্য অঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতি সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হয়।
3. ব্রিটেনের রুশ ভীতি দূর হয়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ কীভাবে ইতালির ঐক্য আন্দোলনে সাহায্য করেছিল?
ইতালির রাজ্য পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষে যোগদান করেছিল। সেই সূত্রে পিডমন্টের প্রধানমন্ত্রী ক্যাভুর প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন এবং ইতালির সমস্যাগুলোকে ইউরোপের বৃহৎ শক্তিবর্গের সামনে তুলে ধরেন। ফ্রান্সের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পায় ইতালি। ফলে ইতালির ঐক্য আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধকে ইউরোপের জলবিভাজিকা কেন বলা হয়?
জলবিভাজিকা বা ঝরনার জলধারা যেমন চারিদিকে প্রবাহিত হয়ে আশেপাশের বহু অঞ্চলকে সুজলা-সুফলা ও উর্বর করে তোলে, তেমনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত নানা প্রবণতা, যেমন — ইউরোপে রুশ বিস্তারনীতি প্রতিহত হওয়া, জার্মানি ও ইতালি প্রভৃতি দেশের জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করা, জারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা প্রভৃতি পরবর্তীকালের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই লর্ড ক্রোমার এই যুদ্ধকে ইউরোপের জলবিভাজিকা বলেছেন।
মুক্তিদাতা জার কাকে বলা হয়? কেন বলা হয়?
রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে মুক্তিদাতা জার বলা হয়।
রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা বর্তমান ছিল। ভূমিদাসের জীবন ছিল অত্যন্ত কষ্টের। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার শোষণ ও অত্যাচারের জীবন থেকে ভূমিদাসদের মুক্তি দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি 1861 সালে এক মুক্তির ঘোষণাপত্র জারি করে ভূমিদাসদের মুক্তি দেন। তাই তাঁকে মুক্তিদাতা জার বলা হয়।
ডিসেমব্রিস্ট (Decembrist) বা ডেকাব্রিস্ট (Decabrist) কাদের বলা হয়?
জার প্রথম আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রথম নিকোলাস সিংহাসনে বসেন। সেই সময় তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কনস্টানটাইনের সিংহাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে রাশিয়ায় জারবিরোধী কয়েকটি গুপ্ত সমিতি বিদ্রোহের চেষ্টা করে 1825 সালে। ডিসেম্বর মাসে এই বিদ্রোহ হয়েছিল বলে বিদ্রোহীগণ ডিসেমব্রিস্ট (Decembrist) বা ডেকাব্রিস্ট (Decabrist) নামে পরিচিত।
ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী ছিল?
ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদে রুশ বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগীতজ্ঞদের ভূমিকা ছিল স্মরণীয়। পুশকিন, লারমন্টভ-এর কবিতা, টলস্টয় ও তুর্গেনেভের উপন্যাস, গোগোল-এর গল্প ও গ্রিনকারের সংগীতে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠে এসেছে।
ডুমা ও মির কী?
রাশিয়ার জাতীয় পরিষদকে বলা হয় ডুমা। 1905 সালের পর জার দ্বিতীয় নিকোলাস ডুমা গঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন।
মির বলা হয় রাশিয়ার গ্রাম্য সমিতিগুলোকে। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার 1861 সালে ভূমিদাসদের মুক্ত করে তাদের যে জমি দিয়েছিলেন, তাতে কৃষকদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত হয়নি, মির নামক গ্রাম্য সমিতির দ্বারা জমির স্বত্ব প্রদান করা হয়েছিল। এর ফলে কৃষকরা মির-এর দ্বারা নির্যাতিত হতে থাকে।
জেমস্টভো (Zemstvo) কী?
জেমস্টভো (Zemstvo) ছিল রাশিয়ার স্বায়ত্তশাসন বিষয়ক সংস্থা। দ্বিতীয় আলেকজান্ডার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সারা দেশে জেমস্টভো নামক প্রতিনিধিসভার হাতে নিজ নিজ এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, জনস্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, চিকিৎসা, শান্তিরক্ষা ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তবে কেন্দ্রীয় গভর্নর এদের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন এবং জেলাস্তরের নিচে এই ব্যবস্থা চালু হয়নি।
নিহিলিস্ট আন্দোলন (Nihilist Movement) কী?
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের রাজত্বকালের শেষদিকে রাশিয়াতে নিহিলিজম (Nihilism) নামক মতবাদ দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। এই মতবাদের সমর্থকদের উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন এবং পুরাতনতন্ত্র অর্থাৎ জারতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করে নতুনভাবে দেশকে গঠন করা। নিহিলিজম কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন রুশ ঔপন্যাসিক তুর্গেনেভ, তাঁর “ফাদার অ্যান্ড সন্স” গ্রন্থে।
নারদনিক আন্দোলন (Narodnik Movement) কী?
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের রাজত্বের শেষদিকে যে সব গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হয়েছিল নারদনিক আন্দোলন তার মধ্যে অন্যতম। রুশ শব্দ নারদ বা জনগণ থেকে নারদনিক শব্দটি এসেছে। জনতাদের সংগঠিত করে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা স্থাপনই ছিল এই আন্দোলনের লক্ষ্য। হাজার হাজার তরুণ এই আন্দোলনে যোগদান করলে এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।
নাভারিনোর নৌযুদ্ধ (Battle of Navarino) কাদের মধ্যে ও কবে হয়েছিল?
1827 খ্রিস্টাব্দে লন্ডন চুক্তির দ্বারা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া গ্রিসের স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়। কিন্তু তুর্কি সুলতান এই প্রস্তাব মানতে অস্বীকার করলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া যুগ্মভাবে তুরস্ক আক্রমণ করে। 1827 খ্রিস্টাব্দে নাভারিনোর নৌযুদ্ধে তুরস্ক ও মিশরের যুগ্মবাহিনীকে পরাজিত করে।
আড্রিয়ানোপলের সন্ধি (Treaty of Adrianople) কত খ্রিস্টাব্দে, কাদের মধ্যে হয়?
ইংল্যান্ড সেনা প্রত্যাহার করলেও রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে এককভাবে নাভারিনোর যুদ্ধ চালিয়ে যায় এবং পরাজিত তুরস্ককে 1829 খ্রিস্টাব্দে আড্রিয়ানোপলের সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করে। এই সন্ধির ফলে রুশ রক্ষণাধীনে গ্রিস স্বাধীনতা পায়। মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া স্বায়ত্তশাসন লাভ করে এবং দানিয়ুব উপত্যকা রুশ-আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়।
হেটাইরিয়া ফিলিকে (Hetairia Philike) কী?
গ্রিস দেশের একটি গুপ্ত সমিতির নাম হেটাইরিয়া ফিলিকে। 1814 খ্রিস্টাব্দে ওডেসায় ৪ জন গ্রিক বণিক দ্বারা এই সমিতি গড়ে উঠলেও 1820 খ্রিস্টাব্দে সদস্যসংখ্যা বেড়ে প্রায় ১ লক্ষাধিক হয়েছিল। এই সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কের প্রভাব থেকে গ্রিসকে উদ্ধার করা ও গ্রিসবাসীকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করা।
আলেকজান্ডার ইপ্সিল্যান্টি (Alexander Ypsilanti) কে ছিলেন?
গ্রিসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন আলেকজান্ডার ইপ্সিল্যান্টি। তাঁর লক্ষ্য ছিল তুরস্কের প্রভাব থেকে গ্রিসকে স্বাধীন করা। তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সংকটের সুযোগে তিনি ওয়ালাচিয়া ও মোলদাভিয়াতে গণআন্দোলন শুরু করলে গ্রিসবাসীর মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাশিয়ার অসহযোগিতার ফলে তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্যর্থতা সত্ত্বেও গ্রিসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর অবদান অপরিসীম।
কোরায়েস (Koraes) কে ছিলেন?
গ্রিসের নবজাগরণের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ ছিলেন কোরায়েস। তাঁর আন্তরিক প্রয়াসে ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগে গ্রিক সাহিত্য, ধর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে নবজাগরণের সূচনা হয়। এর ফলে গ্রিসবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ তীব্র আকার ধারণ করে। 1832 খ্রিস্টাব্দে গ্রিকরা লাভ করে তাদের বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
1815-1850 খ্রিস্টাব্দকে ইউরোপে “পরস্পরবিরোধী স্বার্থ সংঘাতের যুগ” বলা হয় কেন?
ফরাসি বিপ্লবের ফলে ইউরোপে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের বীজ রোপিত হয়েছিল। ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ স্বৈরতন্ত্র স্থাপনের জন্য গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বিলোপ করতে প্রয়াসী হন। ইউরোপে উদারনৈতিক গণতন্ত্রবাদ ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীলতা – এই দুটি পরস্পরবিরোধী ধারা চলতেই থাকে এবং একে অপরের অস্তিত্ব বিলোপের প্রয়াস চালায়। তাই 1815-1850 খ্রিস্টাব্দ সময়কালকে “পরস্পরবিরোধী স্বার্থ সংঘাতের যুগ” বলা হয়।
ইউরোপের ইতিহাসে 1815 থেকে 1850 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে কেন “আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার যুগ” বলা হয়?
ভিয়েনা সম্মেলনের সময় ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপে উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রসার ঘটেছিল। বিভিন্ন দেশের মানুষ স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে নানা আন্দোলন শুরু করে। তবে, প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের চাপে এইসব আন্দোলন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হতে পারেনি এবং বহুক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রবল থাকলেও বাস্তবে তা সফল হয়নি। তাই 1815 থেকে 1850 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে ইউরোপের ইতিহাসে “আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার যুগ” বলা হয়।
1815 থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে ইউরোপের পুনর্গঠনের যুগ বলা হয় কেন?
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পতনের পর ১৮১৫ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপের ইতিহাসের প্রধান বিষয় ছিল ইউরোপের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক কাটামোর পুনর্নির্মাণের জন্য সংঘাত। নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপে রাজতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। একদিকে ভিয়েনা কংগ্রেসের মাধ্যমে ইউরোপে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে উদারনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। তাই এই সময়কালকে ইউরোপের পুনর্গঠনের যুগ বলা হয়।
আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায় উনবিংশ শতকের ইউরোপ : রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংঘাত অধ্যায়ের প্রশ্ন কিছু সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাকে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।