দশম শ্রেণি – বাংলা – বহুরূপী – সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

এই গল্পে একজন বহুরূপী ব্যক্তির জীবনের নানা ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গল্পটিতে বহুরূপীর জীবনের নাটকীয়তা, তার অভিনয় দক্ষতা এবং তার দরিদ্র জীবনের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

দশম শ্রেণি – বাংলা – বহুরূপী – সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

বহুরূপী গল্প অবলম্বনে হরিদার জীবনযাত্রার পরিচয় দাও।

  • দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই – হরিদা ছিলেন গরিব মানুষ। শহরের সবচেয়ে ছোট্ট একটা গলির মধ্যে তাঁর ছোটো ঘরটি ছিল। এই ঘরে বসত কথকদের চায়ের আড্ডা। যদিও চা, চিনি, দুধ কথকরা নিজেরাই আনতেন। হরিদা শুধু তাঁর উনুনের আগুনের আঁচে জল ফুটিয়ে দিতেন। ঘড়ির কাঁটা ধরে কোনো ধরাবাঁধা কাজ করার ক্ষেত্রে হরিদার প্রাণের মধ্যেই যেন বাধা আছে। অভাব সহ্য করতে আপত্তি না থাকলেও একঘেয়ে কাজ করতে তাঁর ভীষণ আপত্তি ছিল।
  • নাটকীয় বৈচিত্র্য – হরিদার জীবনের একটা নাটকীয় বৈচিত্র্য ছিল। হরিদা মাঝে মাঝেই বহুরুপী সেজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। কখনও পাগল, কখনও পুলিশ, কাবুলিওয়ালা, ফিরিঙ্গি সাহেব, আবার কখনও বাইজি সেজে তাঁকে দেখা যেত বিভিন্ন জায়গায়। যারা তাঁকে চিনতে পারত তারা এক-দু- আনা বকশিশ দিত। আর যারা চিনতে পারত না তারা হয় কিছুই দিত না কিংব কিংবা বিরক্ত হয়ে দুটো-একটা পয়সা দিত। কোনোদিন-বা তাঁর বেশিই রোজগার হত। এই বহুরূপী সাজই একরকম তাঁর জীবনের পেশা হয়ে গিয়েছিল।
  • অবশেষে – এইভাবে শহরের জীবনে মাঝে মাঝেই চমৎকার সব ঘটনা ঘটিয়ে, বহুরুপী বেশে কিছু রোজগার করে হরিদার জীবন চলত।

বহুরূপী গল্প অবলম্বনে জগদীশবাবুর চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

  • কথামুখ – ‘বহুরূপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা হলেও গল্পের মূল ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা দিতে জগদীশবাবুর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
  • ব্যক্তি জগদীশবাবু – ব্যক্তি জগদীশবাবু ধনী, ঐশ্বর্যশালী। কৃপণ হলেও তিনি সৌম্য, শান্ত এবং জ্ঞানী।
  • ভক্তির আতিশয্য – জগদীশবাবু ঈশ্বরবিশ্বাসী, তাই তিনি সাধুসন্ন্যাসীর সেবা করা পছন্দ করতেন। বাড়িতে আগত হিমালয়বাসী সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো নেওয়ার জন্য তিনি কাঠের খড়মে সোনার বোল লাগিয়ে দিয়েছেন। বিরাগী হরিদার কাছেও দুই হাত জোড় করে তাঁকে তাঁর বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করেছেন। এমনকি তীর্থভ্রমণের জন্য একশো এক টাকার একটি থলি বিরাগীর পায়ের কাছে নিবেদন করেছেন। আন্তরিক বিনয়ের সঙ্গে জগদীশবাবু বিরাগীর কাছে উপদেশও প্রার্থনা করেছেন। এই সমস্ত দিক থেকে জগদীশবাবু চরিত্রের মধ্যে ভক্তির আতিশয্যও বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।
  • কাহিনির গতি নিয়ন্ত্রক – বহুরুপী হরিদা বিরাগী সেজে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বিষয়-আসক্তিকে ত্যাগ করার মধ্যেই প্রকৃত ঈশ্বরসন্ধান সম্ভব। জগদীশবাবুর বিত্ত-নির্ভর ভক্তিভাবনা হরিদার মতাদর্শকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। জগদীশবাবুর প্রলোভন বিরাগীর চরিত্রাদর্শকে কষ্টিপাথরে যাচাই করে সত্যে পরিণত করেছে। জগদীশবাবু এখানে উপলক্ষ্যের ভূমিকা পালন করেছেন। এককথায় বলা যায় জগদীশবাবু ‘বহুরূপী’ গল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র, যাঁর দ্বারা-কাহিনির গতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।

বহুরূপী গল্পের নামকরণ কতদূর সার্থক বিচার করো।

যে-কোনো সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। আর এই নামকরণ সাধারণত বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক, ভাবকেন্দ্রিক বা ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে থাকে। যে-কোনো সাহিত্যের অন্তর্নিহিত ভাবও এই নামকরণের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা হয়।
শহরের সবচেয়ে সরু গলিটার ভিতরের ছোট্ট ঘরটাই হরিদার জীবনের একমাত্র আশ্রয়। কোনো ছকে বাঁধা কাজ করতে তাঁর ভালো লাগে না। তবে তাঁর জীবনের নাটকীয় বৈচিত্র্য হল এই যে, তিনি মাঝে মাঝে বহুরুপী সাজেন। এতে সামান্য কিছু রোজগারও হয় বটে। বহুরুপী সেজে তিনি কখনও বাসস্ট্যান্ডে, কখনও বাজারে, কখনও আবার অন্য উপায় তাঁর সাজ দেখিয়ে পয়সা রোজগার করেন। বহুরুপী সাজাটাই তাঁর পেশা। এই পেশাগত বিচারে গল্পের নামকরণ যথাযথ। কিন্তু সুবোধ ঘোষ গল্প কাহিনিতে একটু বাঁক ফেরালেন জগদীশবাবুর বাড়িতে হরিদাকে এনে। হরিদা চেয়েছিলেন কৃপণ, ধনী জগদীশবাবুর কাছ থেকে বেশি করে টাকা আদায় করবেন। সেইমতো তিনি বিরাগীর বেশে সেজেও ছিলেন ভালো। জগদীশবাবু হরিদাকে বিরাগীর বেশে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। জগদীশবাবু বুঝতেই পারেন না যে, তাঁর বাড়িতে বিরাগী বেশে আসা লোকটা আসলে একজন বহুরূপী। উপরন্তু তিনি বিরাগী হরিদাকে একশো এক টাকার একটি থলি দিতে গেলে হরিদা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান, বিরাগীর কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। ত্যাগই তাঁর জীবনের ধর্ম। অর্থাৎ বহুরুপী সাজলেও হরিদা অনুকরণীয়। চরিত্রের ঢং নষ্ট করেননি। এখানেই হরিদার বহুরূপী পেশা পাঠকদের কাছে গৌরবের হয়ে উঠেছে। তাই বলা যায় গল্পের নামকরণ কিছুটা বিষয়কেন্দ্রিক হলেও ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে। সেদিক থেকে গল্পের নামকরণ ‘বহুরূপী’ সার্থক হয়েছে।

বহুরূপী গল্পে হরিদার চরিত্রটি আলোচনা করো।

  • কথামুখ – সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পটির কাহিনিই বিকাশ লাভ করেছে হরিদার চরিত্রকে কেন্দ্র করে। তাঁর চরিত্রের মধ্যে যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, তা হল-
  • বৈচিত্র্যসন্ধানী – জীবনে কোনো ধরাবাঁধা কাজ হরিদার পছন্দ ছিল না। কাজের মধ্যে একঘেয়েমি থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার আনন্দ খুঁজে নিতে চান হরিদা। আর একারণেই অন্য নিশ্চিত পেশায় না গিয়ে বহুরুপীর পেশা গ্রহণ করেছিলেন হরিদা।
  • সামাজিকতা – হরিদার চরিত্রের মধ্যে সামাজিকতার দিকটি লক্ষণীয়। শহরের সবথেকে সরু গলিটার ভিতরে তার ছোট্ট ঘরটিই কথকদের চার বন্ধুর সকাল-সন্ধ্যার আড্ডার ঘর। চা, চিনি, দুধ কথকরা নিয়ে আসেন আর হরিদা উনানের আঁচে জল ফুটিয়ে দেন।
  • পেশাগত দক্ষতা – কখনও বাসস্ট্যান্ডের পাগল, কখনও রাজপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া বাইজি, বাউল, কাপালিক, বুড়ো কাবুলিওয়ালা, ফিরিঙ্গি সাহেব-এরকম অজস্র রূপে হরিদাকে দেখা গেছে। শুধু সাজ নয়, চরিত্রের সঙ্গে মানানসই ছিল তাঁর আচরণ।
  • সততা – হরিদার চরিত্রটি পরিণতির শীর্ষ ছুঁয়েছে কাহিনির শেষে। বিরাগীর বেশে জগদীশবাবুকে মুগ্ধ করে দিলেও তাঁর আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ কিংবা প্রণামি হরিদা প্রত্যাখ্যান করেন। এভাবেই পেশাগত সততায় অর্থলোভকে তিনি ত্যাগ করেন। বকশিশ ছাড়া বহুরুপীর জীবন আর কিছু আশা করতে পারে না-হরিদার এ কথা দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনালেও তা আসলে তাকে সততার আলোয় আলোকিত করে।

ছোটোগল্প হিসেবে ‘বহুরূপী’ কতদূর সার্থক বিচার করো।

ছোটোগল্প হল একটি একমুখী নিটোল গদ্যকাহিনি, যার বক্তব্য একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। সূচনায় থাকে আকস্মিকতা এবং উপসংহারে থাকে কৌতূহলবোধ। এই বেশিষ্ট্যের আলোকে সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পটি বিচার্য।

বহুরূপী’আসলে হরিদা নামে এক হতদরিদ্র মানুষের বাস্তব রাখবনযাপনের কাহিনি। ঘড়ির কাঁটার সামনে সময় বেঁধে দিয়ে আর নিয়ম করে একই ধরনের কাজ করা হরিদার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি মাঝে মাঝে বহুরূপী সেজে যেটুকু রোজগার করেন, তাতেই তাঁর কি কোনোরকমে দিন চলে যায়। পেশা হিসেবে বহুরুপী সাজাকে বেছে জন্য গল্পের নাম ‘বহুরূপী’। ব্যঞ্জনাসূচক বিশেষ ভাবসত্যও পাওয়া যায়। হরিদা যখন বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর যাবতীয় প্রলোভন এবং অর্থ তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন, তখনই কাহিনিটি ছোটোগল্পের মর্যাদা পেয়ে যায়। বিভিন্ন চরিত্রের বেশ ধারণ করে পয়সা উপার্জন করাই হরিদার পেশা। তবু তিনি জগদীশবাবুর টাকার থলি স্পর্শ করেননি। করলে ছোটোগল্পের ব্যঞ্জনা নষ্ট হত। করেননি বলেই পাঠকমন গল্পের উপসংহারে এসে অতৃপ্তি আর কৌতূহলে ঘুরপাক খেতে থাকে। এই ধরনের পরিণতিই আধুনিক ছোটোগল্পের বিশেষত্ব। তাই বলা যায়, ছোটোগল্পের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে ‘বহুরূপী’ সার্থক।

বহুরূপী গল্পটি একটি শিক্ষামূলক গল্প। এই গল্পে দেখানো হয়েছে যে, প্রতিভাকে কখনো অবহেলা করা উচিত নয়। প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারলে অনেক ভালো কাজ করা যায়। এই গল্পটি আমাদেরকে শেখায় যে, সত্যকে সবসময় জয়ী হতে হয়। ভন্ডামি কখনোই সত্যকে পরাজিত করতে পারে না।

Share via:

মন্তব্য করুন