নবম শ্রেণী – ইতিহাস – বিংশ শতকে ইউরোপ – রুশ বিপ্লব – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

নবম শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম হল বিশ শতকে ইউরোপ। এই অধ্যায়ে বিশ শতকের ইউরোপের ইতিহাসের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। অধ্যায়ের শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ, ঘটনাপ্রবাহ, এবং ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ, ঘটনাপ্রবাহ, এবং ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা, এবং শীতল যুদ্ধের ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছে।

Table of Contents

এই অধ্যায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিশ শতকের ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। এই অধ্যায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে যে, বিশ শতক ছিল ইউরোপের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই শতাব্দীতে ইউরোপে একাধিক বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল, যার প্রভাব এখনও ইউরোপের উপর পড়ছে।

নবম শ্রেণী – ইতিহাস – বিংশ শতকে ইউরোপ – রুশ বিপ্লব

রুশ বিপ্লবের পিছনে জারদের স্বৈরাচারী শাসনের কী ভূমিকা ছিল?

অথবা, রুশ বিপ্লবের পটভূমিতে জার -এর ভূমিকা তৃতীয় আলেকজান্ডার ও দ্বিতীয় নিকোলাস – এ ছিল?

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের পটভূমি রচনায় রাশিয়ার তৃতীয় আলেকজান্ডার ও দ্বিতীয় নিকোলাসের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যাবলি বিশেষভাবে দায়ী ছিল।

জার তৃতীয় আলেকজান্ডার – জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র তৃতীয় আলেকজান্ডার রাশিয়ার জার হন। তিনি ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক।

  • তিনি রাশিয়ার অধিবাসীদের ব্যক্তিস্বাধীনতা নাকচ করে রাশিয়াকে একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
  • তাঁর সাম্রাজ্যে বহু জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির লোক বসবাস করতেন। তিনি রাশিয়ায় — এক জার, এক চার্চ, এক রাশিয়া (One Czar, One Church, One Russia) – র আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অ-রুশ ও ইহুদিদের চাকুরি, শিক্ষা ও সমস্ত সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছিলেন।
  • তিনি সংবাদপত্র, বিদ্যালয় ও বিচারালয়ের উপর কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন।
  • তিনি ভূমিদাসদের মুক্তির আইন নাকচ করে দিয়েছিলেন।

জার দ্বিতীয় নিকোলাস – জার তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নিকোলাস রাশিয়ার জার হন।

  • তিনিও তাঁর পিতার মতো স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন। তিনি বলতেন, আমি আমার পিতার মতো স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা বজায় রাখব।
  • তিনিও এক জার, এক চার্চ, এক রাশিয়া নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।
  • তিনি সংবাদপত্র, অনেক পুস্তক-পুস্তিকা, রাজনৈতিক দলের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন।
  • রুশ সাম্রাজ্যে বসবাসকারী অ-রুশ প্রজা, যেমন — পোল, ইহুদি, জার্মান প্রভৃতিদের উপর রুশ ভাষা ও সংস্কৃতি জোরপূর্বক আরোপ করেছিলেন।
  • জার দ্বিতীয় নিকোলাসের রাজত্বে রানি আলেকজান্দ্রা, কয়েকজন মন্ত্রী ও ভণ্ড সন্ন্যাসী রাসপুটিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

জার দ্বিতীয় নিকোলাসের আমলে রাশিয়ার জারতন্ত্রের অবসান ঘটে। তাঁর স্বৈরাচারী শাসনে রাশিয়ার সর্বস্তরের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছিল। এবং ১৯০৫ ও ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে দুটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের ফলে ৩০০ বছরের রোমানভ বংশের জার শাসনের অবসান ঘটে।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের সামাজিক পটভূমি কী ছিল?

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। রুশ বিপ্লব ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ। ঐতিহাসিক লিপসন (Lipson) বলেছেন যে, রুশ বিপ্লবের কারণ রাশিয়ার ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই বিপ্লবের জন্য রাশিয়ার দীর্ঘদিনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচার দায়ী ছিল।

সামাজিক পটভূমি – ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের সামাজিক পটভূমি কী ছিল

শ্রেণিবিভক্ত সমাজ – রাশিয়ার সমাজব্যবস্থা মূলত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল –

  • অভিজাত
  • কৃষক-শ্রমিক শ্রেণি
  • মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়
  • সমাজে মদ্যপানের কু-অভ্যাস
  • শিক্ষার অভাব
  1. অভিজাত – রুশ সমাজে অভিজাতরা ছিলেন সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। কিন্তু তারা জার সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট ছিলেন বলে দেশের শাসনব্যবস্থায় তারা ছিলেন প্রধান স্তম্ভ। দেশের বেশিরভাগ জমিরও মালিক ছিলেন তারা।
  2. কৃষক ও শ্রমিক – রুশ সমাজে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণি ছিল জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ। ভূমিদাস মুক্তির আইন অনুসারে ভূমিদাসরা কৃষকের মর্যাদা পেয়েছিল। আবার কৃষকেরা জমি বিক্রি করে অনেকে ভূমিদাসের পর্যায়ে নেমে যায়। এদের অবস্থা দুর্বিষহ ছিল, সারা বছর তারা খেতে পেত না।
  3. মধ্যবিত্ত – রুশ সমাজে মধ্যবিত্ত লোক ছিল প্রায় নগণ্য। সমাজে এদের ভূমিকা ছিল না বললেই চলে।
  4. সমাজে মদ্যপানের কু-অভ্যাস – দরিদ্র ও অশিক্ষিত কৃষক ও শ্রমিকরা নানারকম কু – অভ্যাসের শিকার হয়েছিল। তারা ভদকা (Vodka) নামে এক ধরনের মদ পান করত।
  5. শিক্ষার অভাব – জার আমলে রাশিয়ায় তেমন শিক্ষার ঘটেনি। কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের বেশিরভাগই ছিল নিরক্ষর। রুশ সরকারও শিক্ষাবিস্তারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণে জর্জরিত আধা মধ্যযুগীয় রাশিয়ার সমাজ ছিল গতিহীন ও পশ্চাদপদ। এই দুরবস্থা রুশ বিপ্লবের সামাজিক পটভূমি রচনা করেছিল।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের অর্থনৈতিক পটভূমি কী ছিল?

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। রুশ বিপ্লব ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ। ঐতিহাসিক লিপসন বলেছেন যে, রুশ বিপ্লবের (১৯১৭ খ্রি.) কারণ রাশিয়ার ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই বিপ্লবের জন্য রাশিয়ার অর্থনৈতিক পটভূমি যথেষ্ট দায়ী ছিল।

  1. অর্থনৈতিক পটভূমি – ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।
  2. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা – রাশিয়ায় ভূমিদাস মুক্তি আইন পাস হলেও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় ছিল। চার্চ ও জমিদারদের জমি অধিগ্রহণ করা হলেও কুলাক (জোতদার) শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। আগের মতোই আধা-সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক ও শোষণ বজায় থাকে সমাজে। ফসলের অর্ধেক অংশ জমির মালিক আদায় করত।
  3. প্রযুক্তির অভাব – সমসাময়িক পশ্চিম ইউরোপে কৃষি বিপ্লব ঘটলেও রাশিয়ায় তা ঘটেনি। রাশিয়ায় তখনও পুরোনো দিনের মতো লাঙল-বলদের ব্যবহার ছিল। সেচব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। ফলে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত কম।
  4. বিদেশি মূলধননির্ভর শিল্প – শিল্পের ক্ষেত্রেও রাশিয়া অনেক পিছিয়ে ছিল। রাশিয়ায় যা শিল্প হয়েছিল তাতেও বিদেশি পুঁজির আধিপত্য ছিল। রাশিয়ায় মূলধন বিনিয়োগ করেছিল মূলত তৈল শিল্পে ব্রিটেন, কয়লা ও ধাতু শিল্পে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে জার্মানি। রাশিয়ার শিল্পায়নের জন্য বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হয়েছিল ৫,৪০০ মিলিয়ন রুবল।
  5. মধ্যবিত্তশ্রেণির অভাব – রাশিয়ায় ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো ধনী বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান ঘটেনি। মুষ্টিমেয় ধনী অভিজাতদের হাতে সম্পদ সঞ্চিত থাকলেও তা ব্যাবসাবাণিজ্যে মূলধন হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি।
  6. সমুদ্রপথের অভাব – রাশিয়ায় সমুদ্রপথে গমনাগমনের সুযোগ ছিল না। ফলে রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেনি।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের রাজনৈতিক পটভূমি কী ছিল?

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। রুশ বিপ্লব ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ঐতিহাসিক লিপসন বলেছেন যে, রুশ বিপ্লবের বৃদ্ধি (১৯১৭ খ্রি.) কারণ রাশিয়ার ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই বিপ্লবের জন্য রাশিয়ার রাজনৈতিক পটভূমি যথেষ্ট দায়ী ছিল।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের রাজনৈতিক পটভূমি –

  1. জারের স্বৈরাচারী শাসন – বিংশ শতকের শুরুতে রাশিয়া ছিল। হা একটি মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র। তখন রাশিয়ায় ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় তা বিশ্বাসী রোমানভ বংশীয় জারদের স্বৈরাচারী শাসন বজায় ছিল। জারের অনুগ্রহপুষ্ট অভিজাতরা দেশের শাসন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। দেশের শাসন পরিচালনায় সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকা ছিল না।
  2. বৈদেশিক যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় – ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের আগে রুশ জারতন্ত্র হীনবল হয়ে পড়েছিল — ১৯০৪-১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয়। ফলে রুশ জারের মর্যাদা নষ্ট হয়। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হতে থাকলে রুশ জনগণ জারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়।
  3. জার শাসনে অবৈধ হস্তক্ষেপ – ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে রাশিয়ার জার ছিলেন দ্বিতীয় নিকোলাস। তিনি ছিলেন তাঁর রানি জারিনা আলেকজান্দ্রা-র প্রভাবাধীন। আবার রানি আলেকজান্দ্রা ছিলেন জর্জিয়া থেকে আগত ভণ্ড সন্ন্যাসী রাসপুটিনের দ্বারা প্রভাবিত। রাসপুটিন আলেকজান্দ্রার মাধ্যমে রাশিয়ার আমলা, মন্ত্রী ও সেনাপতি নিয়োগ, রাজ্যশাসন, যুদ্ধ পরিচালনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতেন।
  4. রুশিকরণ নীতি – রাশিয়ায় পোল, ফিন, ইউক্রেনীয়, তুর্কি, জর্জীয়, আর্মেনীয় প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোক বসবাস করত। রাশিয়ার জনসংখ্যার ২০% ছিল ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের পর জার সরকার এদের উপর বলপূর্বক রুশ ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়। তা ছাড়া তাদের উপর তিন গুণ বেশি কর আরোপ করে। ফলে অ-রুশ জনগণ জারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শামিল হয়।
  5. রাজনৈতিক দল – ইতিমধ্যে রাশিয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের প্রধান শাখা। বলশেভিক দল ও তার নেতা লেনিন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই দল শাখা সংগঠনের মাধ্যমে জারতন্ত্রের প্রতি বিক্ষুব্ধ জনগণকে সংগঠিত করে। লেনিন তাঁর বিখ্যাত এপ্রিল থিসিস ঘোষণা করেন এবং শান্তি, জমি ও রুটি-র স্লোগান দেন। এর ফলে রুশ জনগণ জারবিরোধী হয়ে ওঠে ও বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের অর্থনৈতিক পটভূমি কী ছিল

সময়সারণির মাধ্যমে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের রুশ বিপ্লবের বা মার্চ বিপ্লবের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা নির্ণয় করো।

রাশিয়ার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান, যুদ্ধে পরাজয়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য সংকট প্রভৃতি কারণে রাশিয়ার সাধারণ জনগণ জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।

সময়সারণির মাধ্যমে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের রুশ বিপ্লবের বা মার্চ বিপ্লবের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা নির্ণয় করো

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের রুশ বিপ্লবের সময়সারণি –

  • ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ – পেট্রোগ্রাড শহরে ৮০-৯০ হাজার শ্রমিক বলশেভিক দলের নেতৃত্বে আন্দোলনে শামিল হয়। আন্দোলনকারীদের স্লোগান ছিল স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’, ‘শান্তি চাই, জমি চাই, রুটি চাই।’ রাশিয়ার ধর্মঘটি শ্রমিকরা লাল পতাকা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় অবরোধ গড়ে তোলে।
  • ১১ মার্চ – ধর্মঘটিদের শায়েস্তা করার জন্য জার সেনাবাহিনী পাঠান। জার এক ঘোষণাপত্র জারি করে বলেন যে, পেট্রোগ্রাড – এ যেসব শ্রমিক ধর্মঘট করেছে তারা যেন কাজে ফিরে যায়। এর সঙ্গে নবনির্বাচিত ‘ডুমা’-ও তিনি ভেঙে দেন এবং সদস্যদের নং পদস্যদের অনুরোধ জানান যে, তারা যেন ডুমা ছেড়ে চলে যান।
  • ১২ মার্চ – জারের পাভলোভস্কি রেজিমেন্ট (Pavlovsky Regiment) ও ভলিনস্কি রেজিমেন্ট (Volinsky Regiment) আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করতে অস্বীকার করে এবং বিদ্রোহীদের দলে যোগদান করে। আসলে সৈন্যরা ছিল কৃষক ও শ্রমিক পরিবারের সন্তান। পেট্রোগ্রাড শহর বিপ্লবীদের দখলে চলে আসে।
  • বিপ্লবীরা পেট্রোগ্রাড ও রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে সোভিয়েত (Soviet) বা পরিষদ গঠন করে।
  • ১৩ মার্চ – সোভিয়েত সদস্যরা ঘোষণা করেন, এখন থেকে তারাই সরকার পরিচালনা করবে।
  • ১৫ মার্চ – পেট্রোগ্রাড, সোভিয়েত ও ডুমা জোটবদ্ধ হয়। আন্দোলকারীরা ডেমোক্র্যাট দলের প্রিন্স জর্জ লুভভ্-এর নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠন করে। এটি ‘মার্চ বিপ্লব নামে পরিচিত।
  • ১৬ মার্চ – পেট্রোগ্রাড এর দিকে জার দ্বিতীয় নিকোলাসের রেলযাত্রার সময় রেলশ্রমিকেরা পথ অবরোধ করে। জার পদত্যাগের দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।

এইভাবে জার দ্বিতীয় নিকোলাস ও রোমানভ বংশের পতন ঘটে। এবং রাশিয়ায় বুর্জোয়া সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

রুশ বিপ্লবে বলশেভিকদের সাফল্যের কারণগুলি কী ছিল?

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবে বলশেভিকরা সাফল্যলাভ করায় রাশিয়ায় তাদের আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল। রাশিয়ার বিপ্লবে বলশেভিক দলের সাফল্যের পিছনে একাধিক কারণের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

রুশ বিপ্লবে বলশেভিকদের সাফল্যের কারণ –

  1. জার শাসনের দুর্বলতা – রাশিয়ার জার শাসন রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে চরম সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। রাশিয়ার জাররা ছিলেন দুর্বল, অপদার্থ ও স্বৈরাচারী। ফলে জনগণ এই শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, যা বলশেভিকদের পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছিল।
  2. সমকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি – ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লব যখন শুরু হয় তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার দরুন তারা রাশিয়ার বিপ্লবে জারকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে পারেনি।
  3. দুর্বল প্রতিবিপ্লব – রাশিয়ায় বিপ্লববিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে ঐক্যবোধের পরিবর্তে মতবিরোধই বেশি লক্ষ করা গিয়েছিল। তাদের এই মতবিরোধ বলশেভিকদের সাহায্য করেছিল।
  4. সামরিক বিপর্যয় – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার সামরিক বিপর্যয় ঘটে। প্রশিক্ষণহীন রুশ কৃষক-শ্রমিকদের সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে পাঠানো হলে জার্মানবাহিনীর হাতে তারা নিহত হয়। এর ফলে জনগণের সমস্ত ক্ষোভ জারতন্ত্রের উপর গিয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বলশেভিকরা প্রচার চালিয়ে জনগণের সহানুভূতি লাভ করে।
  5. লেনিনের নেতৃত্ব – বলশেভিক দলের নেতা লেনিন ছিলেন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন। তিনি রাশিয়ার বাস্তব পরিস্থিতিকে কাজে লাগান। যুদ্ধের বদলে শান্তির আশায় সেনাবাহিনী, রুটির আশায় অভুক্ত জনগণ এবং জমির আশায় কৃষকেরা লেনিনের আহ্বানে সাড়া দেয়।

রুশ বিপ্লব কবে হয়? এ বিপ্লব রাশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে কী প্রভাব ফেলেছিল?

পৃথিবীর যুগান্তকারী ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম হল ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত রুশ বিপ্লব। রাশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে এই বিপ্লবের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য।

রুশ বিপ্লব রাশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে প্রভাব –

  1. রাজনৈতিক প্রভাব – রুশ বিপ্লব রাশিয়ায় জারের স্বৈরতন্ত্র, অভিজাতবর্গের বিশেষ অধিকার এবং যাজকদের প্রাধান্যের বিলোপ ঘটিয়ে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে রাশিয়াতেই সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
  2. শ্বেত সন্ত্রাস (White Terror) – বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়ায় শ্বেত সন্ত্রাস চালু হয়েছিল। কারণ রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার জনসাধারণ বলশেভিক সরকারের সপক্ষে এলেও অভিজাত, যাজক ও বিত্তশালী শ্রেণিগুলি বলশেভিক সরকারের বিরোধী হয়ে ওঠে। এর ফলে রাশিয়ায় প্রতিবিপ্লবের শ্বেত সন্ত্রাস শুরু হয়।
  3. অর্থনৈতিক প্রভাব – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ব্যক্তিগত মালিকানা ও মুনাফার নীতি পরিত্যক্ত হয় এবং বিনা ক্ষতিপূরণে কলকারখানা, ও ব্যক্তিগত শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করে শ্রমিকদের হাতেই পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কৃষিক্ষেত্রে জমিদারদের থেকে জমি কেড়ে নিয়ে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এইভাবে রুশ বিপ্লবের প্রভাবে ন্যায্য বণ্টন ব্যবস্থার প্রচলন করে রুশবাসীর অর্থনৈতিক উন্নতির চেষ্টা করা হয়।
  4. সামাজিক প্রভাব – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়ায় বসবাসকারী অ-রুশ জাতিগুলিকে সমমর্যাদা ও সমান অধিকার প্রদান করে রুশ জীবনের অংশীদার করে তোলা হয়।

মার্কস-এঙ্গেলসের সাম্যবাদের বাস্তব প্রয়োগ ঘটে রাশিয়ায়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব প্রচলিত সমাজকাঠামোয় আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল।আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রুশ বিপ্লবের কয়েকটি প্রভাব লেখো।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বা বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য শুধুমাত্র রাশিয়াতেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের প্রভাব –

  1. ঔপনিবেশিক আন্দোলনে প্রভাব – ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবে বলশেভিক দলের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশবিরোধী মুক্তি আন্দোলন শুরু হয় এবং চিন ও ভারত-সহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
  2. সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা হয়। বিশ্বব্যাপী এই আন্দোলনের মধ্যে সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে লেনিনের উদ্যোগে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মস্কোতে তৃতীয় আন্তর্জাতিক (Third International) বা কমিন্টার্ন (Comintern) প্রতিষ্ঠিত হয়।
  3. বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্র চ্যালেঞ্জ জানায়। এর ফলে বিশ্ব রাজনীতি পুঁজিপতি ও সমাজতান্ত্রিক এই দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
  4. বিভিন্ন রাজবংশের পতন – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়া রোমানভ রাজবংশ, জার্মানিতে হোহেনজোলার্ন রাজবংশ অস্ট্রিয়ায় হ্যাপসবার্গ রাজবংশের পতন ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
  5. শ্রমিক শোষণে অব্যাহতি – ইউরোপে সাম্যবাদী ভাবধারার গতিরোধ করার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন প্রবর্তন করে শ্রমিক শোষণ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়।

সমকালীন বিশ্বের সমাজে রুশ বিপ্লবের কী প্রভাব পড়েছিল?

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব সমকালীন সমগ্র বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ঐতিহাসিক ই এইচ কার (E H Carr) বলেছেন 1. সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বলশেভিক আন্দোলন একটি বিশ্ব আন্দোলনে পরিণত হয়।

সমকালীন বিশ্বের সমাজব্যবস্থায় প্রভাব –

  1. সাম্যবাদী ভাবধারার বিস্তার – রুশ বিপ্লব সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার প্রভাবে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাম্যবাদী ভাবধারার বিস্তার ঘটে।
  2. সমাজে শ্রমিকশ্রেণির মর্যাদা বৃদ্ধি – রুশ বিপ্লবের ফলে সমাজে শ্রমিক শ্রেণির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। রাশিয়ার সাম্যবাদী ভাবধারার গতিরোধ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি শ্রমিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে।
  3. নাগরিকের সমানাধিকার – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় সকল নাগরিকের সমান অধিকারের নীতি ঘোষিত হয়েছিল। নাগরিকের সমানাধিকারের নীতি বিশ্বের অনেক দেশ গ্রহণ করেছিল।
  4. নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রদান – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় রাষ্ট্রকে গির্জা থেকে পৃথক করে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। রাশিয়ার এই আদর্শ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে প্রভাবিত করেছে বলে সেইসব দেশে এই আদর্শ অনুসৃত হয়েছে।

সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রুশ বিপ্লবের কী প্রভাব পড়েছিল?

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব সমকালীন সমগ্র বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ঐতিহাসিক ই এইচ কার (E H Carr) বলেছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বলশেভিক আন্দোলন একটি বিশ্ব আন্দোলনে পরিণত হয়।

সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক প্রভাব –

  1. সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা – বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সর্বপ্রথম শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণির সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপে ও এশিয়ার কোনো কোনো দেশে সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
  2. উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বৃদ্ধি – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ভারত, চিন-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পরাধীন জাতিগুলি নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে মুক্তি সংগ্রাম শুরু করে।
  3. ট্রেড ইউনিয়ন গঠন – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ফলে বিভিন্ন দেশের শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে এবং তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করে।
  4. বিশ্বে আদর্শগত গোষ্ঠীবিভাজন – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সমাজতন্ত্র হল ধনতন্ত্রের বিরোধী আদর্শ। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র – এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই-এর সূত্রপাত হয়।

রুশ বিপ্লব পৃথিবীর রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সাম্যবাদী আতঙ্ক পুঁজিবাদী দেশগুলিকে গ্রাস করে এবং দুই শিবিরে পারস্পরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

সমকালীন বিশ্বের অর্থনীতিতে রুশ বিপ্লবের কী প্রভাব পড়েছিল?

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব সমকালীন সমগ্র বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ঐতিহাসিক ই এইচ কার (E H Carr) বলেছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বলশেভিক আন্দোলন একটি বিশ্ব আন্দোলনে পরিণত হয়।

সমকালীন বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রভাব –

  1. ব্যক্তিমালিকানার অবসান – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিগত মুনাফার নীতি পরিত্যক্ত হয়। কলকারখানার উৎপাদন ও বণ্টন রাষ্ট্রের অধীনে আনা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশ এই নীতির দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে প্রভাবিত হয়।
  2. জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ – রাশিয়ায় জমিদারের জমি বাজেয়াপ্ত করে তা কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
  3. কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার কৃষকরা উদ্‌বৃত্ত ফসল নিজেরা বাজারে বিক্রি করতে পারত। কৃষকরা নগদ মূল্যে কর দিত। কৃষির উন্নতির জন্য কৃষি ব্যাংক ও সমবায় ব্যবস্থা গঠন করা হয়। রাষ্ট্রীয় খামার গড়ে ওঠে। এই কৃষিনীতির দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রভাবিত হয়েছে।
  4. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময়সীমা ৮ ঘণ্টা নির্দিষ্ট করা হয়। শ্রমিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা, দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে উপযুক্ত মজুরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শ্রমিকদের উন্নয়নের এই নীতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গৃহীত হয়েছে।
  5. পুঁজিবাদের বিকল্প – সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ছিল পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকল্প ব্যবস্থা। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় আর্থিক মহামন্দা শুরু হলে বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব পড়লেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই মন্দার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। এর ফলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করে।

রুশ বিপ্লব বিশ্ব অর্থনীতিতেও আলোড়ন সৃষ্টি করে। কৃষি-শিল্পের জাতীয়করণ, গণবন্টন ব্যবস্থার গণমুখীকরণ, শোষণহীন সমাজ সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে এবং বহু দেশ তার অনুকরণ করে।

বিংশ শতকে ইউরোপের ইতিহাস ছিল একটি জটিল ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাস। এই সময়ে ইউরোপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল। এই ঘটনাগুলি ইউরোপের ভবিষ্যতকে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

Share via:

মন্তব্য করুন