অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

অষ্টম শ্রেণির বাংলা বিষয়ের হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যায়ের রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর গুলি পরীক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইভাবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যায়ের রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর গুলি যদি তোমরা প্রস্তুত করে না যাও তাহলে পরীক্ষায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যায়ের রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর গুলোর উত্তর দিতে পারবে না। তাই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যায়ের রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর গুলি ভালো করে মুখস্ত করে গেলে তোমরা পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল পাবে।

Table of Contents

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন শান্তিনিকেতনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে শুরু করেন, তখন তিনি একজন যোগ্য সংস্কৃত শিক্ষকের খোঁজ করছিলেন। সেই সময়েই তিনি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হন, যিনি তখন রবীন্দ্রনাথের পতিসরের জমিদারিতে আমিনের সহযোগী পদে কর্মরত ছিলেন।

হরিচরণের জ্ঞান ও মেধায় মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে শান্তিনিকেতনে সংস্কৃতের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। হরিচরণ রাজি হন এবং ১৩০৯ সালে শান্তিনিকেতনে যোগদান করেন।

শান্তিনিকেতনে আসার পর হরিচরণ কেবল একজন শিক্ষক হিসেবেই নয়, বরং রবীন্দ্রনাথের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীও হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় হরিচরণ ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচনার কাজ শুরু করেন। এই অভিধান রচনায় তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে নিরলসভাবে পরিশ্রম করেন।

‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ বাংলা ভাষার একটি বিশাল ও ব্যাপক অভিধান। এতে বাংলা ভাষার প্রায় দুই লক্ষ শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। হরিচরণের এই অভিধান বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি অমূল্য সম্পদ।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা ছিল বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ এই বন্ধুত্বের একটি স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে আজও টিকে আছে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় – অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে প্রথম যুগে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে বিদ্যালয়ের কাজে এসে যোগ দিয়েছিলেন, এমন কয়েকজনের কথা আলোচনা করো।

শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রথম যুগে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে বিদ্যালয়ের কাজে এসে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায়, শিবধন বিদ্যার্ণব, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীমোহন ঘোষ প্রমুখ।

  • বিধুশেখর শাস্ত্রী – মালদহের হরিশচন্দ্রপুর গ্রামে ১২৮৫ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বিধুশেখর শাস্ত্রী জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি ‘কাব্যতীর্থ’ হন। কাশীতে গিয়ে তিনি দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এ ছাড়াও সেখানে ন্যায়শাস্ত্র, বেদান্তশাস্ত্র অধ্যয়ন করে ‘শাস্ত্রী’ উপাধি লাভ করেন। ১৩১১ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল – ‘মিলিন্দ প্রশ্ন’, ‘ন্যায়প্রবেশ’, ‘মধ্যান্তবিভাগসূত্রভাষ্যটিকা’ ইত্যাদি। ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দেহাবসান ঘটে।
  • ক্ষিতিমোহন সেন – পৈতৃক নিবাস ঢাকাতে হলেও ক্ষিতিমোহনের জন্ম কাশীতে ৩০ নভেম্বর, ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। কাশীর কুইন্স কলেজ থেকে সংস্কৃতে তিনি এমএ পাস করেন। ওই সময়েই তিনি চম্বা রাজ্যের শিক্ষাবিভাগে যোগ দেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্ষিতিমোহন শান্তিনিকেতনে চলে আসেন এবং ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগদান করেন। কর্মজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিশ্বভারতী বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ পদে যুক্ত ছিলেন।
  • জগদানন্দ রায় – ইনি প্রথমে শিলাইদহ জমিদারিতে স্থাপিত কুঠিতে রবীন্দ্রনাথের সন্তানদের গৃহশিক্ষক ছিলেন। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে তিনি যোগ দেন। জগদানন্দ ‘সাধনা’ পত্রিকায় বেশ কিছু বিজ্ঞানমূলক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তা দেখেই জগদানন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ জন্মায়। তাই জমিদারির সেরেস্তার কাজ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত করেন। জগদানন্দ রায় আজীবন আশ্রম বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
  • শিবধন বিদ্যার্ণব শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রথমদিন শিবধনকে রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত বিষয়ের অধ্যাপকরূপে নিযুক্ত করেন। অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক এই শিক্ষক অবশ্য খুব বেশি দিন বিদ্যালয়ে থাকেননি।
  • কালীমোহন ঘোষ – বিদ্যালয় স্থাপনার কিছু পরে ইনি যোগ দেন। পল্লীপ্রাণ এই মানুষটি রবীন্দ্রনাথের পল্লি-উন্নয়ন কর্মের মুখ্য সহযোগী ছিল। বাংলা ও ইতিহাস পড়াতেন কালীমোহন। শিশুবিভাগের গৃহাধ্যক্ষ হিসেবে ছাত্রদের প্রতি তাঁর অসম ভালোবাসা ছিল। স্বদেশপ্রাণ এই মানুষটি ছাত্রদের মধ্যে স্বাদেশিকতার মন্ত্র প্রচার করতেন।

এর কৃতিত্ব অনেকাংশে শান্তিনিকেতনের প্রাপ্য – কোন্ কৃতিত্বের কথা বলা হয়েছে? তার বহুলাংশ ‘শান্তিনিকেতনের প্রাপ্য’ বলে লেখক মনে করেছেন কেন?

প্রথম যুগে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে যাঁরা যোগদান করেছিলেন তাঁরা হয়তো বাহ্যিক দিক দিয়ে গুণের আকর ছিলেন না, কিন্তু তাঁদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা ছিল। নিষ্ঠা এবং অভিনিবেশের যৌথ মিলনে তাঁরা কর্ম ও কীর্তিস্থাপনের মাধ্যমে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারা তাঁরা মহৎ কর্ম সম্পাদনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের অনুকূল পরিবেশ তাঁদের প্রতিভা স্ফুরণের সহায়ক হয়েছিল। নিজেকে উজাড় করে লোকহিতে নিযুক্ত হতে তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের মতো সাধারণ মানুষেরাও যে বৃহৎ ও মহৎ কাজে সফল হয়েছেন, সেই কৃতিত্বের কথাই এখানে বলা হয়েছে।

এ কৃতিত্ব আদায়ের বড়ো দাবিদার শান্তিনিকেতন তথা এর স্থানমাহাত্ম্য। শান্তিনিকেতনের যে মাহাত্ম্য, তাতে সে মানুষের কাছে বড়ো কিছু দাবি জানাতে পারে। আপন দানশক্তির দ্বারা সে-স্থান এই অধিকার অর্জন করেছে। শান্তিনিকেতনের জল ও হাওয়ায়, সেখানকার প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশে মানুষেরা তাঁদের গুণাবলি স্ফুরণের সুযোগ পেয়েছে। শান্তিনিকেতন ছাড়া অন্যত্র তা সম্ভব হত না বলে এই কৃতিত্ব ‘শান্তিনিকেতনের প্রাপ্য’ বলে লেখক মনে করেছেন।

আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে শান্তিনিকেতনের দান অপরিসীম। – লেখক এ প্রসঙ্গে শান্তিনিকেতনের কোন্ কোন্ গুরুত্বপূর্ণ অবদানের উল্লেখ করেছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, ছিলেন দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ। তাঁর শিক্ষাদর্শের বাস্তবরূপ শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়। এটির শুভ সূচনা হয় ৭ পৌষ ১৩০৮ (২২ ডিসেম্বর, ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে) বঙ্গাব্দে। শান্তিনিকেতন শিক্ষাপ্রসারের এক আদর্শস্থল। তা শুধু বিদ্যাদানের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বিদ্যা বিকিরণের মাধ্যমে তা সকলকে আলোকিত করেছে। সূর্যরশ্মি যেমন সর্বত্র প্রসারিত হয়, তেমনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষা বিকিরিত হয়েছে সর্বস্তরে। বিদ্যার্জন যাতে আনন্দদায়ক ও সুগম হয়ে ওঠে সেদিকেও শান্তিনিকেতনের লক্ষ ছিল। বিদ্যাদানের প্রারম্ভলগ্নেই শান্তিনিকেতন শিক্ষার উদার ও মানবিক দিকের আদর্শ আত্মস্থ করেছে। রবীন্দ্রনাথের দূরদৃষ্টি এ কাজের প্রধান সহায়ক। যোগ্য মানুষেরা যেমন উপযুক্ত শিক্ষক হয়ে উঠতে পেরেছেন, এর পাশাপাশি গুণধর শিশুরাও তাদের প্রতিভা বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছে এখানে।

আপাতদৃষ্টিতে যে মানুষ সাধারণ তাঁরও প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা রবীন্দ্রনাথের সর্বদর্শী দৃষ্টিতে এড়াতে পারেনি। – লেখক এ প্রসঙ্গে কাদের কথা স্মরণ করেছেন? জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় তাঁদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো।

লেখক এ প্রসঙ্গে জগদানন্দ রায়, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধুশেখর শাস্ত্রী এবং ক্ষিতিমোহন সেনের কথা স্মরণ করেছেন।

জগদানন্দ রায় শিলাইদহ জমিদারিতে রবীন্দ্রনাথের শিশুদের গৃহশিক্ষক ছিলেন। সেকালের বিখ্যাত ‘সাধনা’ পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আর তাতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে তাঁর উৎসাহ ছিল অদম্য। তিনি একজন সত্যিকারের প্রকৃতিবাদী মানুষ ছিলেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্বীকার্য।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের পতিসরের জমিদারিতে কর্মসূত্রে যোগ দেন। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতের পণ্ডিতের পদ অলংকৃত করেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচনা তাঁর বিশিষ্ট অবদান।

বিধুশেখর শাস্ত্রী বৌদ্ধশাস্ত্র ও পালিভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগ দেন। তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। ‘মিলিন্দপঞ্চহ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্ষিতিমোহন সেন শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগদান করেন। কর্মজীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি বিশ্বভারতী বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষপদে ব্রতী ছিলেন। বাউল সংগীত বিষয়ে তিনি বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘কবীর’, ‘বাংলার বাউল’ ইত্যাদি। বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

এঁরা প্রাণপণে সেই দাবি পূরণ করেছেন। – কাদের কথা বলা হয়েছে? কী-ই বা সেই দাবি? সেই দাবিপূরণে প্রাণপণে তাঁদের নিয়োজিত হওয়ারই বা কারণ কী বলে তোমার মনে হয়?

শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় স্থাপনের প্রথম যুগে যে কয়েকজন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে এসেছিলেন এখানে তাঁদের কথা বলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে জগদানন্দ রায়, বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখরা উল্লেখযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয় স্থাপনের পর শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য গ্রন্থ প্রণয়ন, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাচর্চার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনে তাই তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথের দাবি ছিল জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে মহৎ কর্মে আত্মনিয়োগ করা। বিশ্বকবির সে দাবি তাঁরা পূরণ করতে তৎপর হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে যোগ্য কাজ করিয়ে নিতেন। রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি যাঁদের ভিতর প্রতিভা বিচ্ছুরণের ক্ষমতা দেখেছেন তাঁদেরই কাজে আহ্বান জানিয়েছেন। দৈনন্দিনের চাহিদা মিটিয়ে এঁরা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রকে পুষ্ট করেছেন। কাছারির কাজ অপেক্ষা এদের অনেকেই পছন্দ করেছেন বিদ্যাচর্চা সংক্রান্ত কাজ। শিক্ষার নব নব দিগন্ত খুলে দিতে তাই তাঁরা অন্তরের প্রেরণা লাভ করেছেন; সঙ্গে ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা, উৎসাহ ও নির্দেশনা। আপন শ্রম, অভিনিবেশ, নিষ্ঠা, মেধা এসবের মেলবন্ধনে তাঁরা কবির দাবিপুরণে প্রাণপাত করেছিলেন।

শান্তিনিকেতনের সঙ্গে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠেছিল? প্রবন্ধ অনুসরণে তাঁর সারাজীবনব্যাপী সারস্বত-সাধনার পরিচয় দাও।

রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ৭ পৌষ, ১৩০৮ (২২ ডিসেম্বর, ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ) শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সূচনা হয়।

হরিচরণ রবীন্দ্রনাথের পতিসরের জমিদারিতে আমিনের সহযোগী পদে কর্মসূত্রে যোগ দেন। ইতিমধ্যে শান্তিনিকেতনে সংস্কৃতের পণ্ডিত ছিলেন শিবধন বিদ্যার্ণব। তিনি চলে যাওয়ায় সে পদ শূন্য পড়ে ছিল। অথচ রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন – ‘ভারতবর্ষের চিরকালের যে চিত্ত সেটার আশ্রয় সংস্কৃত ভাষায়। এই ভাষার তীর্থপথ দিয়ে আমরা দেশের চিন্ময় প্রকৃতির স্পর্শ পাব, তাকে অন্তরে গ্রহণ করব, শিক্ষার এই লক্ষ্য মনে আমার দৃঢ় ছিল।’ স্বাভাবিকভাবেই তাই রবীন্দ্রনাথ তখন সুযোগ্য সংস্কৃত শিক্ষকের সন্ধানে ছিলেন। ঠিক এই সময়ে জমিদারির কাজ দেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ ও কালিগ্রামে বোটে যান। ইতিমধ্যে ১৩০৯ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে হরিচরণ পতিসরের কাছারিতে কাজে যোগ দিয়েছেন। সেখানেই হরিচরণকে রবীন্দ্রনাথ নতুন করে পেলেন।

কাছারির ম্যানেজারকে রবীন্দ্রনাথ অনতিবিলম্বে পত্রে জানালেন হরিচরণকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দিতে শিক্ষকতার পেশাগ্রহণ করার জন্য। আপ্লুত হরিচরণ ওই নিবন্ধে লিখেছেন – বিদ্যালোচনা ও অধ্যাপনা আমার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য, আমি যাব। মণিকাঞ্চনের সংযোগ সাধিত হল এবং এরপর থেকেই হরিচরণ ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগ দিলেন ১৩০৯ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩১২ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৩০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত অভিধান রচনায় ব্যাপৃত ছিলেন। আর্থিক অনটন থাকা সত্ত্বেও অভিধানের কাজে কখনও তিনি বিরত হননি। ১০৫ খণ্ডে সুবৃহৎ অভিধান রচনা যে কত দুরূহ ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আপন উৎসাহ ও উদ্দীপনার বশবর্তী হয়ে তিনি অভিধান রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। বিবিধ ভাষার নানা বিষয়ের গ্রন্থ অধ্যয়ন করে তিনি ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ প্রণয়ন করেন। নিবিষ্ট চিত্তে এ কাজে তিনি মগ্ন ছিলেন। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে মূল পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ হলেও অর্থাভাবে পরবর্তী দশ বছর তা মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করেনি। তবুও নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে না থেকে এই দশ বছর হরিচরণ অভিধান পরিমার্জনা-পরিবর্ধনে ব্যস্ত ছিলেন। ১৩১২ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৫২ বঙ্গাব্দ রচনাকার্য শুরু থেকে মুদ্রণকার্য সমাপ্ত-এই সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর একনিষ্ঠ সাধনায় হরিচরণ অভিধান রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উৎসাহ ফুরিয়ে যায়নি বরং শেষদিন পর্যন্ত রচনাকার্য ত্রুটিমুক্ত রাখার প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হরিচরণ বন্দ্যোপাধায়ের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের পরিচয় প্রবন্ধটিতে কীভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জীবনের মনীষী। মানব অনুভূতির নানা দিক তাঁর সাহিত্যে সূক্ষ্ম আঁচড়ে প্রতিফলিত হয়েছে। স্বভাবতই তাঁকে আমরা শ্রদ্ধাবশত উচ্চ আসনে বসিয়েছি। কিন্তু তাঁর দুর্লভ সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের মনোজগতের ভিন্ন এক দিকের সন্ধান পেয়ে যাই আমরা।

অতি সাধারণ মানুষের মধ্যেও যে সুপ্ত প্রতিভা থাকতে পারে, রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি তা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিল। নিছক কাছারির কাজে একজন সংস্কৃতজ্ঞ মানুষ আজীবন কাটিয়ে দেবেন রবীন্দ্রনাথ তা মেনে নিতে পারেননি। তাই হরিচরণকে ডেকে এনেছিলেন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার জন্য। আর দু-বছর যেতে না যেতেই তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন বৃহৎ অভিধান রচনায় আত্মনিয়োগ করতে। প্রভু-কর্মচারীর সুপরিচিত সম্পর্কের বাইরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রতিভাধর হরিচরণকে সম্মান দিয়েছেন। তাঁকে দিয়ে যোগ্য কাজ করিয়ে নিয়েছেন। আর তার ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতি লাভ করেছে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর মতো মহৎ অভিধান। সাহিত্যিক সত্তার বাইরে রবীন্দ্রনাথের এই গুণের কথা, তাঁর মহত্ত্বের কথা এ গদ্যে উপস্থাপিত হয়েছে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত অভিধানটির নাম কী? গ্রন্থটির রচনা, মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে নানাবিধ ঘটনার প্রসঙ্গ প্রাবন্ধিক কীভাবে স্মরণ করেছেন?

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত অভিধানটির নাম ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।

শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই হরিচরণ শিক্ষকরূপে সেখানে যোগ দেন, কর্মনিষ্ঠা লক্ষ করে হরিচরণকে রবীন্দ্রনাথ অভিধান রচনায় আত্মনিয়োগ করতে বলেন। রবীন্দ্রনাথের এই নির্দেশকে তিনি দেবতার আশীর্বাদ বলেই মনে করেছেন। কবির আদেশকে শিরোধার্য করে ১৩১২ বঙ্গাব্দে হরিচরণ অভিধান রচনা শুরু করেন। বাংলাভাষায় অভিধান রচনার অভাব দূর করতে রবীন্দ্রনাথ এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আর্থিক অনটনের কারণে মাঝে কিছুদিন রচনাকার্য বন্ধ থাকলেও বিদ্যোৎসাহী মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর আর্থিক সহায়তায় অভিধান রচনার কাজ পুনরায় শুরু হয়। ১৩১৮ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৩০ বঙ্গাব্দ-এই তেরো বছর তিনি মহারাজের কাছ থেকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বৃত্তি পেয়ে এসেছেন। এই মহৎ পৃষ্ঠপোষকতা হরিচরণকে মানসিক প্রশান্তিতে কর্মে নিযুক্ত থাকতে উৎসাহ দিয়েছে। ১৩১২ থেকে ১৩৩০ পর্যন্ত অভিধান রচনার কাজ চলেছিল।

অভিধান রচনাকার্য সমাপ্তির পর লোকসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন ছিল মুদ্রণের। আপ্রাণ সামান্য সামর্থ্য নিয়ে হরিচরণ খণ্ডে খণ্ডে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। মোট ১০৫ খণ্ডে মুদ্রণকার্য শেষ হওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ ঘটে। প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু মুদ্রণ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। পরে অবশ্য ‘সাহিত্য আকাদেমি’ থেকে দুটি খণ্ডে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়। ১৩৩০-১৩৪০ রচনাকার্য সমাপ্তি থেকে মুদ্রণকার্য সূচনা-এই দশটি বছরও হরিচরণ অভিধান পরিমার্জনায় ব্যস্ত ছিলেন।

প্রাবন্ধিকের সঙ্গে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতির প্রসঙ্গ প্রবন্ধে কীরূপ অনন্যতার স্বাদ এনে দিয়েছে তা আলোচনা করো।

প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। ফলে আশ্রমিক হরিচরণকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। প্রাবন্ধিক যখন অধ্যাপনা কাজে শান্তিনিকেতনে যুক্ত হন তখনও অভিধানের মুদ্রণকার্য শেষ হয়নি। গ্রন্থাগারের সংকীর্ণ এক ঘরে হরিচরণকে তিনি মনোযোগী হয়ে রচনাকার্যে ব্যাপৃত থাকতে দেখেছেন। বিদ্যাচর্চায় নিবিষ্ট হরিচরণকে দেখে হীরেন্দ্রনাথের মনে পড়ে যেত রবীন্দ্র জ্যেষ্ঠ দ্বিজেন্দ্রনাথের লেখা একটি শ্লোক –

‘কোথা গো ডুব মেরে রয়েছ তলে
হরিচরণ! কোন্ গরতে?
বুঝেছি। শবদ-অবধি-জলে
মুঠাচ্ছ খুব অরথে!’

অভিধান রচনার জন্য কোনো এক নিরিবিলি স্থানে বসে হরিচরণ শব্দসমুদ্র থেকে এক-একটি শব্দ চয়ন করে তার বিশ্লেষণে মগ্ন রয়েছেন।

হীরেন্দ্রনাথ দেখেছেন পঁচাত্তর বছর বয়স উত্তীর্ণ হরিচরণ অবসরের পরেও আগের মতো কর্মক্ষম ছিলেন। মাসমাহিনার প্রতি লক্ষ না রেখে তাঁরা আপন আপন দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকতেন। হরিচরণ এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। অভিধান মুদ্রণ সমাপ্ত হওয়ার পরেও প্রাবন্ধিকের সঙ্গে রোজই তাঁর সাক্ষাৎ হত। সকাল এবং সন্ধ্যায় ভ্রমণ তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ক্ষীণ দৃষ্টির জন্য সকলকে হয়তো চিনতে পারতেন না, কিন্তু চিনে নিতে পারলে সস্নেহ কুশলবার্তায় তাকে আপ্লুত করে দিতেন। অভিধান সংক্রান্ত কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি প্রসন্ন চিত্তে থাকতেন। সুবৃহৎ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর এক গভীর প্রশান্তি তাঁর মনে কাজ করত। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশমতো তাঁর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারার এক অদ্ভুত তৃপ্তি তাঁকে পূর্ণ করে দিয়েছিল। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিরানব্বই বছর বয়সে এমন একজন সাধক মানুষ লোকান্তরিত হন।

তিনি অভিধান ছাড়াও কয়েকখানা গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন। – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত অন্যান্য কয়েকটি গ্রন্থের নাম ও বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

বঙ্গীয় শব্দকোষ নামক অভিধান ছাড়া হরিচরণ প্রণয়ন করেছেন তিনখণ্ডে ‘সংস্কৃত প্রবেশ’। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হরিচরণ রবীন্দ্রনাথের আরব্ধ কাজ এই গ্রন্থে সমাপ্ত করেছেন। সংস্কৃত শিক্ষার সহজপন্থা, ভাষার খুঁটিনাটি ব্যাকরণগত দিক এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে।

তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল – ‘কবির কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথের কথা’, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, ‘পালিপ্রবেশ’ ইত্যাদি। প্রথম দুটি গ্রন্থে হরিচরণ রবীন্দ্রনাথের জীবনের নানা কথা স্মরণ করেছেন। দীর্ঘ রবীন্দ্রসান্নিধ্য তাঁকে রবীন্দ্রজীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছিল। প্রথম দুই গ্রন্থ তারই ফলশ্রুতি। ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’-তে বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। ‘পালিপ্রবেশ’ গ্রন্থে পালি ভাষার নানাবিধ বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অনুরাগ কীভাবে ব্যক্ত করেছেন, তা বিশদভাবে আলোচনা করো।

আলোচ্য প্রবন্ধটিকে বলা যেতে পারে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি হীরেন্দ্রনাথের শ্রদ্ধার্ঘ্য। একনিষ্ঠ সাধনায়, শ্রমসাধ্য প্রয়াসে হরিচরণ যেভাবে বৃহৎ অভিধান রচনা সমাপ্ত করেছেন, তা বিরল দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ সময় ধরে স্বীয় ক্ষমতার যথাযথ প্রতিফলন ঘটিয়ে অধ্যবসায় ও অভিনিবেশ সহকারে হরিচরণ যেভাবে এ কাজ সম্পন্ন করেছেন, তা স্মরণীয়।

রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ শিরোধার্য করে হরিচরণ যখন অভিধান রচনায় হাত দেন তখন তিনি অপ্রবীণ, অনভিজ্ঞ ৩৭-৩৮ বছরের এক শিক্ষক। তবুও শান্তিনিকেতনের স্থানমাহাত্ম্যকে স্বীকার করে তিনি এ কাজে আত্মনিয়োগ করেন। অবসর সময়ে দৈনন্দিনের দাবি মিটিয়ে উদ্‌বৃত্ত সময় তিনি অভিধান রচনায় মন দিয়েছেন। আর্থিক সংশয়, মুদ্রণ অনিশ্চয়তা বারে বারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, কিন্তু হরিচরণ হতোদ্যম হননি। প্রত্যাশা, সম্মানপ্রাপ্তির অপেক্ষা না করে জীবনের চল্লিশটি বছর উৎসর্গ করেছেন অভিধান রচনায়। একক সাধকরূপে তাঁর এই কর্মপ্রয়াস শ্রদ্ধাবনত হয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন হীরেন্দ্রনাথ। ব্যক্তিগত জীবনেও হরিচরণ ছিলেন মৃদুভাষী, স্নেহশীল মানুষ। মেধা, অভিনিবেশ, নিষ্ঠা এসব গুণের সমাহারে হরিচরণের সুবৃহৎ অভিধান বাঙালি জীবনে অমর হয়ে থাকবে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামক পাঠ্যে গিবনের প্রসঙ্গ কেন ব্যবহৃত হয়েছে?

১৭৭৬-১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ – এই দীর্ঘ বারো বছর ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন ব্যস্ত ছিলেন ছ-টি খণ্ডে সুবৃহৎ গবেষণা কার্য ‘দি ডিক্লাইন অ্যান্ড ইল অফ দি রোমান এম্পায়ার’ গ্রন্থ রচনায়। গ্রন্থ সমাপ্ত করে গিবনের মনে হয়েছিল সব কাজ ফুরিয়ে গেছে, কিছুই যেন আর করার নেই। আর হরিচরণ ১৩১২ থেকে ১৩৫২ বঙ্গাব্দ-এই দীর্ঘ চল্লিশ বছর ব্যস্ত ছিলেন অভিধান প্রণয়ন ও মুদ্রণের কাজে। তবুও মুদ্রণকার্য সমাপ্তির পর হরিচরণের মনে এক গভীর প্রশান্তি বিরাজমান ছিল। রবীন্দ্রনাথের বাসনা চরিতার্থ করতে পেরে তিনি তৃপ্ত হয়েছিলেন। দুই দেশের দুই মহাত্মার দীর্ঘ পরিশ্রমলব্ধ ফসলের মাহাত্ম্যের কথা তুলনা করতে গিয়ে পাঠ্যে গিবনের প্রসঙ্গ এসেছে।

অভিধান কার্য মুদ্রিত হওয়ার পরে হরিচরণের কোন্ কোন্ বিষয়ে আক্ষেপ ছিল?

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর মুদ্রণকার্য সমাপ্ত হয়। তার আগেই পরলোকগমন করেন অভিধানের আর্থিক পৃষ্ঠপোষক মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। তিনি মারা যান ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ মুদ্রণকার্য আরম্ভ হওয়ার গৌরব তিনি দেখে যেতে পারেননি। হরিচরণের দুঃখ ছিল মণীন্দ্রচন্দ্রের হাতে তিনি একখণ্ডও মুদ্রিত অভিধান তুলে দিতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। প্রেরণাদাতা বিশ্বকবি মুদ্রণকার্যের পরিসমাপ্তি দেখে যেতে পারেননি। শেষ খণ্ডটি হরিচরণ তাঁর হাতে তুলে দিতে পারলেন না। এই দুই আক্ষেপ হরিচরণকে বিষাদাচ্ছন্ন করেছিল।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানসিকতার পরিচয় দাও।

রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে যোগদান করাকে হরিচরণ আপন জীবনের আশীর্বাদ ও পরম কাঙ্ক্ষিত বলে মনে করেছিলেন। কেবলমাত্র বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে না থেকে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে অভিধান প্রণয়নের মতো দুরুহ ও শ্রমসাধ্য কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর অভিধানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কখনও কোনো ক্লান্তি বা অবসাদ তাঁকে গ্রাস করেনি। পরম উৎসাহে তিনি অভিধান প্রণয়নে মগ্ন ছিলেন। আর্থিক অনটন একসময়ে বিঘ্নরূপে উপস্থিত হলেও অচিরেই তাকে তিনি জয় করেছেন।

সম্পূর্ণ একক প্রয়াসে এই দুরূহ কাজ তিনি সুসম্পন্ন করেছেন। একধ্যান একজ্ঞানে তিনি অভিধানের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে রেখেছিলেন। প্রাবন্ধিক সঠিক বলেছেন – ‘এ কাজ মহাযোগীর জীবন’। বাঙালি চরিত্রে নিষ্ঠার অভাব যেরকম সুলভ হরিচরণ আপন জীবন দিয়ে তা মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। হরিচরণের শ্রম ও জ্ঞান অতুলনীয়। বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষার উপর দখল, দুই ভাষার শব্দের অর্থ, ব্যুৎপত্তি ইত্যাদি সন্ধানে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আপন সীমিত সামর্থ্যে জনসমক্ষে অভিধান পৌঁছে দিতে তিনি মুদ্রণকার্যেও সহায়তা করেছেন। একাধারে রচনা, মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজে তিনি আশাতীত দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। পুরস্কার ও সম্মানের প্রত্যাশা তিনি কখনও করেননি। লোকহিতে উৎসর্গ করেছেন তাঁর কাজকে। হরিচরণের মতো সারস্বত সাধক নমস্য, প্রাতঃস্মরণীয় এবং আমাদের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্বরূপ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন্ গুণের পরিচয় এখানে পাওয়া যায়?

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গুণগ্রাহী। গুণের কদর করতে তিনি জানতেন। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপনের পর যোগ্য শিক্ষকের সন্ধানে ছিলেন তিনি। তাঁর জহুরির চোখ রত্নতুল্য ব্যক্তিত্বকে চিনে নিয়ে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রাঙ্গণে। অতিসাধারণ মানুষের মধ্যেও যে প্রতিভা সুপ্ত থাকতে পারে রবীন্দ্রনাথের সর্বদর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার সন্ধান পেয়েছে। ক্ষিতিমোহন সেন তো বলেইছেন রবীন্দ্রনাথ আপন হাতে তাঁদের গড়ে না নিলে তাঁরা এত বড়ো হতে পারতেন না। কবির অনুসন্ধানী দৃষ্টি তাঁদের ভিতরকার কৃতিত্বটুকু সন্ধান করে নিতে পেরেছিল, তাই শান্তিনিকেতন বিদ্যোৎসাহী মানুষের স্পর্শে বিদ্যাসমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পেরেছিল।

অভিধান রচনাকালে হরিচরণের আর্থিক সংকট দূর করতে রবীন্দ্রনাথ সনির্বন্ধ অনুরোধে মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী হরিচরণকে মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন। হরিচরণকে শঙ্কামুক্ত করে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন ‘অভিধানের সমাপ্তির পূর্বে তোমার জীবননাশের শঙ্কা নাই।’ তাঁর এ ভবিষ্যদবাণী ফলপ্রসূ হয়েছিল। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ, প্রেরণায় নানাবিধ কাজের পাশাপাশি এই অভিধান রচনা সুসম্পন্ন হয়েছিল। শান্তিনিকেতনের স্থানমাহাত্ম্যের বিষয়টিও রবীন্দ্রনাথের এই মানসিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন জ্ঞানপিপাসু, অক্লান্ত পরিশ্রমী এবং সুখ-দুঃখে সমান থাকার মতো গুণাবলী সমৃদ্ধ একজন ব্যক্তি। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচনার মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষার অমূল্য সম্পদ তৈরি করেছেন। ৭৫ বছর বয়সের পরেও তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

এই বিবরণ থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, জ্ঞান অর্জনে কখনোই বয়স বাধা নয়। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করতে পারে।

এই গদ্যের শিরোনাম “হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়” দেখে মনে হলেও, এটি কেবল তাঁর জীবনী ছাড়িয়ে অনেক বেশি কিছু। লেখক শুধু কালানুক্রমিক তথ্যই উপস্থাপন করেননি, বরং হরিচরণের একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার পরিচয় তুলে ধরেছেন।

হরিচরণের জীবনের সাথে জড়িত অন্যান্য ব্যক্তি ও ঘটনাও এখানে উঠে এসেছে। তবে গদ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে সর্বদা রয়েছেন হরিচরণই। রবীন্দ্রনাথের হাতেই হরিচরণের আবিষ্কার ঘটেছিল, এবং এই গদ্যে রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের প্রসঙ্গও এসেছে।

হরিচরণের অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও একনিষ্ঠতার প্রতি লেখক গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচনার মাধ্যমে বাঙালি সমাজের কাছে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। চল্লিশ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর এই অভিধান রচনা সম্পন্ন হলে, বাংলার বিদ্বজ্জন এর মূল্য উপলব্ধি করতে পারেন।

পর্বতপ্রমাণ কাজকে হরিচরণ যেভাবে সহজে সম্পন্ন করেছিলেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। এই গদ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাই এর শিরোনাম যথাযথ ও সার্থক।

Share via:

মন্তব্য করুন