নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি কবি। তাঁর কবিতাগুলিতে প্রকৃতি, মানবতা, প্রেম-প্রীতি, দেশপ্রেম প্রভৃতি নানা বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। নবম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যপুস্তকে তাঁর আবহমান কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই কবিতায় কবি গ্রাম-বাংলার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন।
ফুরয় না, তার কিছুই ফুরয় না — এখানে কী না ফুরোনোর কথা বলা হয়েছে? কেন কিছুই ফুরোয় না?
না ফুরোনো বিষয় – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আবহমান কবিতায় প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য মানুষের যে চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা, তা না ফুরোনোর কথা এখানে বলা হয়েছে।
মানুষের গ্রাম্যসভ্যতার পত্তন – অনেক বছর আগে মানুষ যখন গ্রামবাংলায় এসেছিল এবং ঘর বেঁধেছিল, তখন তার সেই চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ছিল গভীর ভালোবাসা। এ দেশের মাটি, বাতাসের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেছিল সে।
ক্লান্ত নাগরিক জীবন – কিন্তু পরবর্তীকালে মানুষ ক্রমশ শহরমুখী হয়েছে। নগরসভ্যতার সুযোগসুবিধা, স্বাচ্ছন্দ্য তাকে আকৃষ্ট করেছে। শহরজীবনে মানুষ সমৃদ্ধি পেলেও শান্তি পায়নি, বরং যন্ত্রসভ্যতার ক্রমাগত চাপে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
ক্লান্তিযুক্তির জন্য প্রকৃতি – তার আশ্রয় হয়ে ওঠে বাংলার প্রকৃতি আর সেই প্রকৃতির ছন্দে গাঁথা জীবন। সে যেন যখনই সুযোগ পায় আবার ফিরে আসে এই প্রকৃতিলালিত জীবনে। তার আসার পটভূমি তৈরি করে রাখে উঠোনের লাউমাচা, সন্ধ্যার বাতাসে দুলতে থাকা ছোট্ট ফুল। প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া – পুরোনো জীবনের চেনা ছন্দে ফিরে আসার পরিপ্রেক্ষিতেই কবির মনে হয়েছে, কোনো কিছুই শেষ হয়ে যায় না। বাগানের কুন্দফুলের হাসি থেকে শুরু করে সূর্য ওঠা, ধীরে ধীরে ছায়া নামা, সন্ধ্যাবেলা নদীর বাতাসের বয়ে চলা—কিছুই শেষ হয় না, যেমন শেষ হয় না সেই প্রকৃতির কাছে ফিরে আসার জন্য মানুষের আকুলতা।
এই মাটিকে এই হাওয়াকে আবার ভালোবাসে। — এই মাটি হাওয়াকে আবার ভালোবাসার কারণ কী?
গ্রাম্যসভ্যতার পত্তন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আবহমান কবিতাটি নিজের শিকড়ের খোঁজে মানুষের অনিঃশেষ পথ চলার কাহিনি। সভ্যতার শুরুতে অরণ্যবাসী মানুষ বন কেটে বসতি গড়েছিল, তৈরি করেছিল তার গ্রামসভ্যতা। ঘর বেঁধেছিল নিবিড় অনুরাগে। সেই মানুষই ধীরে ধীরে নাগরিক হয়েছে।
বিচ্ছেদ সত্ত্বেও প্রকৃতির প্রতি টান – প্রকৃতি এবং গ্রামজীবনের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটেছে। কিন্তু শহরজীবনের ব্যস্ততা এবং কৃত্রিমতায় ক্লান্ত মানুষ নিজের মনের মধ্যে ধরে রাখতে চেয়েছে ঘাসের গন্ধ, তারায় ভরা আকাশে সে নিজের স্বপ্ন এঁকে রেখেছে। বাগান থেকে কুন্দফুলের হাসিকে মানুষ কখনও হারিয়ে যেতে দেয়নি
প্রকৃতিই উজ্জীবক – প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে সেই দুরন্ত জীবন পিপাসা। চাকচিক্য বা আড়ম্বরের কৃত্রিমতায় নয়, মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য জীবনকে তার সহজভাবে রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-সহ উপলব্ধি করতে চেয়েছে। তাই প্রকৃতির কাছে, তার ফেলে আসা গ্রামজীবনের কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ উপলব্ধি করেছে সে। সেখানে লাউমাচায় সন্ধ্যার বাতাসে ছোট্ট একটা ফুল আজও দোল খায়। সেই মাটিকে আর হাওয়াকে ভালোবেসে ফিরে যাওয়াটা যেন জীবনকে সুন্দরভাবে উপলব্ধি করার ও বেঁচে থাকার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
নেভে না তার যন্ত্রণা যে, দুঃখ হয় না বাসি – এখানে যার যন্ত্রণার কথা বলা হয়েছে তার যন্ত্রণা কেন নেভে না? দুঃখ হয় না বাসি বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
যন্ত্রণার না নেভা – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আবহমান কবিতায় গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষের যন্ত্রণার কথা বলা হয়েছে। দরিদ্র মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তার দারিদ্র্যের যন্ত্রণা আর দুঃখ বয়ে চলে, তাই তা কখনোই নেভে না বা শেষ হয় না।
দুঃখ হয় না বাসি – গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের জীবনসংগ্রাম অত্যন্ত কঠোর। অভাব-অনটন তাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। মোটা ভাত – কাপড়টুকুর সংস্থান করতেও তাদের উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। যুগ যুগ ধরে গ্রামবাংলার মানুষের এই জীবনছবির কোনো পরিবর্তন হয় না। দরিদ্র মানুষকে যে শুধু দারিদ্র্যের সঙ্গেই লড়াই করতে হয় তা নয়, তাদের ওপর bhসামাজিক শোষণ এবং অত্যাচারও চলে সীমাহীনভাবে। তাই তাদের জীবনে দুঃখদুর্দশা কখনও পুরোনো অর্থাৎ বাসি হয় না। তাদের বাগানে কুন্দফুলের হাসি যেমন সত্য তেমনি সত্য এই যন্ত্রণা আর রোজকার দুঃখের জীবন। প্রতিদিন তাদের জীবনে নিত্যনতুন বা টাটকা দুঃখের অফুরন্ত জোগান থাকে। এক দুঃখের রাত ভোর হলে তারা আর-একটি দুঃখের দিনকে প্রত্যক্ষ করে। এই দুঃখময় জীবনের পথ চলা তাই তাদের কখনোই শেষ হয় না।
ফুরয় না সেই একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা — এখানে একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা বলতে কী বোঝানো হয়েছে? পিপাসা ফুরোয় না বলতে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা -র পরিচয় – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আবহমান কবিতায় প্রকৃতির জন্য যে মানুষের মধ্যে আকুলতা দেখা যায়, তাকেই একগুঁয়ে বলা হয়েছে। একগুঁয়ে মানুষটির মধ্যে রয়েছে প্রকৃতি এবং গ্রামজীবনের কাছে ফিরে আসার প্রবল আকর্ষণ, যাকে কবি দুরন্ত পিপাসা বলেছেন।
শহুরে জীবনের ক্লান্তি – একসময় গ্রামজীবনকে নিবিড়ভাবে ভালোবেসে মানুষ তার বসতি তৈরি করেছিল। বাংলার মাটিকে, হাওয়াকে ভালোবেসে তারা ঘর বেঁধেছিল। উঠোনের লাউমাচায় ছোট ফুল ছিল সেই সযত্নে লালিত জীবনের প্রতীক। পরবর্তীকালে নগরসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য এবং সুখের সন্ধানে মানুষ শহরমুখী হয়। কিন্তু শহরজীবন তাকে অর্থসম্পদের অধিকারী করলেও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সন্ধান দিতে পারে না।
গ্রাম ও প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ – ক্লান্তি আর অবসন্নতা ঘিরে ধরে মানুষকে। যন্ত্রসভ্যতার দমবন্ধ করা চাপে হাঁপিয়ে ওঠে মানুষ। ফলে তার মধ্যে তীব্র হয় ফিরে আসার আর্তি। গ্রামজীবনের সরলতা আর প্রকৃতির সহজতা তার মধ্যে এই ফিরে আসার আকর্ষণ তৈরি করে। মাটিকে, হাওয়াকে ভালোবেসে ফিরে আসা তাই চলতেই থাকে। সারাদিন আপন মনে ঘাসের গন্ধ মেখে আর সারারাত তারায় তারায় স্বপ্ন এঁকে প্রকৃতির কাছে ফিরে আসার যে আকাঙ্ক্ষা, তা মানুষের মনে চিরকালীন—তা কখনোই ফুরোয় না।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “আবহমান” কবিতাটি গ্রাম বাংলার প্রতি কবির গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে। কবি শহরের জীবন থেকেও গ্রাম বাংলার প্রতি মানুষের আকর্ষণ তুলে ধরেছেন। কবিতাটিতে কবি গ্রাম বাংলার প্রকৃতির সৌন্দর্য, মানুষের সহজ সরল জীবনযাত্রা, পারিবারিক বন্ধন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা বলেছেন। কবি মনে করেন, গ্রাম বাংলার এই আবহমান সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য চিরদিন অম্লান থাকবে।