ভাঙার গান কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা। এটি নবম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কবিতাটি ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়।
কবিতাটিতে কবি সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের গান গেয়েছেন। তিনি যুবকদেরকে জাগরিত করে তুলে তাদেরকে এই অসঙ্গতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উৎসাহিত করেছেন।
কারার ওই লৌহ-কপাট/ভেঙে ফেল, কররে লোপাট —এই আহ্বানের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করো।
প্রেক্ষাপট – পরাধীন ভারতকে বিদেশি শক্তির বাঁধন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কবি তরুণ বিপ্লবী শক্তিকে আহ্বান জানিয়েছেন। অত্যাচারী ইংরেজ শাসক দেশপ্রেমী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যে কারাগারে আটকে রেখেছে বা রাখতে চায় সেই সমস্ত কারাগারের লৌহকপাট ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন কবি।
রক্ত-জমাট শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী। — পঙ্ক্তিটির অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝিয়ে দাও।
অন্তর্নিহিত অর্থ – পরাধীন ভারতবর্ষে অত্যাচারী ইংরেজ শাসক স্বাধীনতা সংগ্রামী ভারতীয়দের কারাগারে বন্দি করে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এইভাবে তারা দমন করতে চেয়েছিল সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামকে। শোষক ইংরেজদের অত্যাচারে বিপ্লবীদের অনেক রক্ত ঝরেছে। কারাগারে লেগেছে সেই রক্ত। আর বিপ্লবীদের রক্ত লেগে থাকা সেই কারাগারই কবির কাছে হয়েছে দেশমাতার পূজার পাষাণ বেদি, যাতে শহিদের রক্ত জমাট হয়ে আছে।
ওরে ও তরুণ ঈশান! /বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ — তরুণ ঈশান কে? সে প্রলয় বিষাণ বাজাবে কেন?
তরুণ ঈশান – এর পরিচয় – ঈশান হলেন ধ্বংস ও সৃষ্টির দেবতা শিব। কিন্তু এখানে তরুণ ঈশান বলতে দেশের নবীন বিপ্লবীদের বোঝানো হয়েছে।
প্রলয় বিষাণ বাজানোর কারণ – জরাজীর্ণকে, অশুভকে বিনাশ করার জন্য তিনি যখন প্রলয় নৃত্য করেছিলেন, তার আগে বাজিয়েছিলেন বিষাণ অর্থাৎ শিঙা। কবি নবীন বিপ্লবীদের ঈশানের সঙ্গে তুলনা করে ইংরেজ শাসন ধ্বংসের বিষাণ বাজাতে বলেছেন। এই বিষাণ – এর অবসানের লক্ষ্যে যুদ্ধঘোষণা। যা স্বাধীনতার আবহনকে নিশ্চিত করবে।
কে দেয় সাজা/মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে? — মুক্ত স্বাধীন সত্যকে কেউ সাজা দিতে পারে না কেন?
অথবা, কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে। – উদ্ধৃতাংশটির মূল বক্তব্য লেখো।
সাজা দিতে না পারার কারণ – যা মানবতার পক্ষে, তা-ই সত্য। সত্য সর্বদা মুক্ত এবং স্বাধীন। মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ তাকে কলুষিত করতে চাইলেও শেষপর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। সত্যকে জগতের কোনো কারাগারে বন্দি করা যায় না। সেই সত্যমন্ত্রে দীক্ষিত দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা তরুণদের ইংরেজ শাসক কারাগারের বন্দি রাখতে পারবে না। বিপ্লবী বীরদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতেও পারবে না। ব্যক্তিকে ফাঁসি দেওয়া যায় বা সাজা দেওয়া যায় কিন্তু তার সত্য-আদর্শ সমস্ত শাস্তির ঊর্ধ্বে।
ধ্বংস-নিশান,/উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি। — ধ্বংস নিশান ওড়াতে কবি এত উৎসাহ দিয়েছেন কেন?
উৎসাহ দেওয়ার কারণ – পরাধীন ভারতবর্ষ ইংরেজদের শাসন-শোষণ-অত্যাচারে জর্জরিত। তাই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা তরুণরা দেশকে স্বাধীন করার ব্রত নিয়েছেন। আর বিদ্রোহী বিপ্লবী তরুণদের কারাগারে বন্দি করছে অত্যাচারী শাসক। কবির মতে, কারাগারের লৌহকপাট ভাঙতে ইংরেজদের অধীনতা অস্বীকার করতে হবে এবং সে জন্যই ধ্বংস নিশান ওড়াতে হবে। আর তাহলেই সত্য, মানবতা ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তাই কবি ধ্বংসের নিশান ওড়াতে এত উৎসাহ দিয়েছেন।
গাজনের বাজনা বাজা! — গাজনের বাজনা বাজা কথাটির তাৎপর্য লেখো।
তাৎপর্য – বাংলা বছরের শেষ মাসের শেষ দিনে অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তিতে দেবাদিদেব শিবের পূজাকে কেন্দ্র করে গাজন উৎসব হয়। এটি একটি লৌকিক উৎসব। একে চড়কপূজাও বলা হয়। এই পার্বন উপলক্ষ্যে গ্রামবাংলায় মেলাও বসে। গাজনের উৎসবে ঢাক, ঢোল, কাঁসি, বাঁশি ইত্যাদি দেশি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে প্রলয়ের দেবতা শিবকে বন্দনা করা হয়।
গাজনের বাজনা বাজা! — কবি কেন গাজনের বাজনা বাজাতে বলছেন?
গাজনের বাজনা বাজাতে বলার কারণ – চৈত্রসংক্রান্তিতে প্রলয়ের দেবতা শিবের পুজো হয়, যা গ্রামবাংলায় গাজন নামে পরিচিত। এই গাজনের বাজনা বাজিয়েই কবি চেয়েছেন বিপ্লবী যুবশক্তি ইংরেজের কারাগারের প্রাচীরকে ভেঙে দিক, প্রতিষ্ঠা করুক মুক্ত স্বাধীন সত্য – এর। গাজনের বাজনার মধ্যে প্রলয়ের যে ইঙ্গিত আছে তাকেই স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের জন্য কবি ব্যবহার করেছেন।
ভগবান পরবে ফাঁসি?/সর্বনাশী/শিখায় এ হীন তথ্য কে রে? — এই অংশটি ব্যাখ্যা করো।
ব্যাখ্যা – ভগবান মৃতুঞ্জয়ী এবং সত্যের রক্ষক। তাঁকে ফাঁসির দড়ি পরানো যায় না, নিঃশেষ করা যায় না। তরুণ বিপ্লবীরা দেশের ভগবান, তাঁরা মৃত্যুহীন। ফাঁসির মঞ্চে তাঁরা জীবনের জয়গান গাইতে পারেন। ফাঁসিতে তাঁদের প্রাণ স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে কিন্তু তাঁদের সত্যের আদর্শ, মানবতা, স্বাধীনতার স্বপ্নের মৃত্যু নেই। কারারুদ্ধ করে, ফাঁসি দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করা যায়—এমন ধারণা ভুল ও অসত্য।
ওরে ও পাগলা ভোলা — পাগলা ভোলা কে? কবি তাঁকে কী করতে বলেছেন?
পাগলা ভোলার পরিচয় – পাগলা ভোলা কথাটির আক্ষরিক অর্থ প্রলয়ংকর মহাদেব, কিন্তু এখানে স্বাধীনতার স্বপ্নে চল তরুণদের কথা বলা হয়েছে।
কবির পরামর্শ – উদ্যম, স্পর্ধা এবং সাহসের কারণে দেশের তরুণদের কবি পাগলা ভোলা বলেছেন। শিব তাঁর প্রলয়রূপে যেরকম অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে, কবি প্রত্যাশা করেছেন দেশপ্রেমিক তরুণরা ঠিক সেভাবেই শক্তি ও সাহসের উন্মত্ত প্রকাশে কারাগারের গারগুলোকে হ্যাঁচকা টান দেবে, লৌহকপাট ভেঙে ফেলবে।
যত সব বন্দিশালায়—/আগুন জ্বালা — কবি কার উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছেন? বন্দিশালায় আগুন জ্বালাতে বলেছেন কেন?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি – কবি স্বদেশ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ স্বাধীনতাকামী তরুণ সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলেছেন।
বন্দিশালায় আগুন জ্বালতে বলার কারণ – বন্দিশালা হল সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের শোষণ-অত্যাচারের প্রতীক। বিপ্লবীদের কারাগারে বন্দি করে তারা দমন করতে চেয়েছিল ভারতবাসীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে। তাই সেই বন্দি – শালা-য় আগুন জ্বালিয়ে কবি সাম্রাজ্যবাদীদের দুর্গে আঘাত করতে চেয়েছেন। দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছেন কবি।
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে। কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
অথবা, ডাক ওরে ডাক/মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে – কবি মৃত্যুকে আহ্বান জানিয়েছেন কেন?
তাৎপর্য – ভাঙার গান কবিতায় কবি দেশের তরুণ প্রাণদের সাম্রাজ্যবাদীদের দুর্গে আঘাত হানার কথা বলেছেন। ইংরেজদের জেলখানার গারদগুলোকে উপড়ে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু দেশের জন্য এই চেষ্টা কখনোই রক্তপাতহীন হতে পারে না। আত্মদানের মধ্য দিয়েই হয়তো সাফল্য আসবে। কিন্তু মৃত্যু সেখানে আসলে জীবনকেই প্রতিষ্ঠা করবে। শহীদের আত্মদান স্বাধীনতার স্বপ্নকে সার্থক করে তুলবে।
ভাঙার গান কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী চেতনার এক অনন্য নিদর্শন। এই কবিতায় কবি সমাজের সকল অনিয়ম, অবিচার, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বার্তা উচ্চারণ করেছেন। তিনি সমাজের পুরনো ধ্যান-ধারণা, প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন।