এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “জাতীয়তাবাদ বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের ভূমিকা লেখো। ভারতের ধর্মীয় বিষয়ে গোরার কী উপলব্ধি হয়েছিল?” নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাস পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই “জাতীয়তাবাদ বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের ভূমিকা লেখো। ভারতের ধর্মীয় বিষয়ে গোরার কী উপলব্ধি হয়েছিল?“ প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা“ -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

জাতীয়তাবাদ বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের ভূমিকা লেখো।
জাতীয়তাবোধ বিকাশে ‘গোরা’-এর ভূমিকা
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ এবং স্বদেশপ্রেমের ভাবধারা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাসটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপন্যাসটি প্রথমে প্রবাসী (1907-1909) পত্রিকায় পরে 1910 খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
‘গোরা’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু –
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরা (গৌরমাহন) একজন আইরিশ দম্পতির পুত্র। সে বিদেশি, বিধর্মী। নিজের জন্ম পরিচয় না জেনে একটি হিন্দু পরিবারে সে মানুষ হয়। নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসাবে সে ক্রমশ ইংরেজ বিদ্বেষী ও খ্রিস্ট-বিরোধী হয়ে ওঠে। কিন্তু একসময়ে সে তার প্রকৃত পরিচয় জানতে পারে। কিন্তু এতো বড়ো আঘাতেও গোরা ভেঙে পড়েনি বা দূরে সরে যায়নি।
আত্মপরিচয় জানার পর তার সমস্ত সংকীর্ণতা নিমেষে ভেঙে যায়। পালিকা মাতা আনন্দময়ীকে প্রণাম করে সে বলে – “মা, তুমিই আমার মা, যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম, তিনি আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই, শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ।”
‘গোরা’ উপন্যাসে জাতীয়তাবোধের জাগরণ –
সুবিশাল গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরার বক্তব্য ও কার্যকলাপের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে গঠনমূলক ও সমন্বয়বাদী জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন।
- উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গোরা বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের সুখ-দুঃখের খোঁজখবর নিতে গিয়ে গ্রামীন ভারতবর্ষের সত্যিকারের রূপটি চিনতে পারেন।
- গোরা চরিত্রের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে সরব হন। তার গোরা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার উৎকর্ষতায় মুগ্ধ হয় এবং সে সংকল্প করে যে, স্বদেশের প্রতি স্বদেশবাসীর শ্রদ্ধা সে ফিরিয়ে আনবেই। এমনকি গোরা হিন্দু সভ্যতার বিরোধী জনৈক মিশনারির বিরুদ্ধে সম্মুখ বিতর্কে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।
- ভারতীয় সভ্যতার প্রতি ব্রিটিশদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ লক্ষ্য করে গোরা উগ্র হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু পরে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং সে উপলব্ধি করে যে ধর্মীয় পরিচয় একমাত্র বা সবথেকে বড় পরিচয় নয়। তার মুখে শোনা যায় “ আজ আমি ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রিষ্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের সকলে অন্নই আমার অন্ন”।
- ব্রাহ্মনেতা পরেশবাবুকে গোরা একদিন বলেছেন, ‘আপনি আমাকে আজ সেই দেবতার মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-ব্রাহ্মণ সকলেরই…. যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।’ এই উক্তির মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন গোরার অন্তরে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার নমুনা পাওয়া যায়, তেমনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার মনোভাবও সুস্পষ্ট হয়েছে।
- উপন্যাসের শেষ পর্বে গোরা তার আসল পরিচয় জানার পর হিন্দু লালন-পালনকারি মা আনন্দময়ীর উদ্দেশ্যে বলিয়েছিলেন, “মা, তুমিই আমার মা।’তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই…. তুমিই আমার ভারতবর্ষ।” এই উক্তির মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয়তাবদের মূল স্বরূপটি ফুটে উঠেছে।
- ভারতবর্ষে সহস্র বৈচিত্র্য আছে, কিন্তু কোন সংকীর্ণতার স্থান নেই এখানে। যারা সংকীর্ণ জাত-পাত-বর্ণের গণ্ডী যারা ভাঙতে পেরেছে, তারা সকলেই ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব লাভ করে ধন্য হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গোরা, সুচরিতা, আনন্দময়ী, বিনয়, ললিতা – এঁরা সকলেই সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে স্থান পেয়েছে ভারতমাতার অন্তরে। এভাবেই অসাম্প্রদায়িকতার বানী ছড়িয়ে জাতীয়তাবাদের মূল রূপ কি তা ভারতীয়দের সামনে তুলে ধরেছেন।
ভারতের ধর্মীয় বিষয়ে গোরার কী উপলব্ধি হয়েছিল?
কবিগুরুর ‘গোরা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরা প্রথম জীবনে নিষ্ঠাবান হিন্দুরূপে অন্যান্য সকল ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করলেও উপন্যাসের শেষ পর্বে তার আত্মোপলব্ধি ঘটে। সে অনুভব করে তার পালিকামাতা আনন্দময়ীর মতো ভারতমাতারও কোনো জাতিগত সংকীর্ণতা নেই। অপরিসীম সহনশীলতা ও সুগভীর স্নেহ দিয়ে ভারতমাতা বহুশতাব্দী ধরে বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠীকে ঠাঁই দিয়েছে তাঁর বুকে। গোরার এই আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক সর্বভারতীয় রূপটি তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
‘গোরা’ উপন্যাসটি কখন প্রকাশিত হয়?
‘গোরা’ উপন্যাসটি প্রথমে প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে (1907-1909) প্রকাশিত হয় এবং পরে 1910 খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়।
‘গোরা’ উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু কী?
‘গোরা’ উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো জাতীয়তাবোধ, স্বদেশপ্রেম, ধর্মীয় সংকীর্ণতা অতিক্রম করে সর্বজনীন মানবতা ও ভারতীয় ঐক্যের আদর্শ। গোরা নামক কেন্দ্রীয় চরিত্রের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও জাতীয় চেতনার বিকাশকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
গোরা চরিত্রের মাধ্যমে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে?
গোরা প্রথমে একজন সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদী হিসেবে আবির্ভূত হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে উপলব্ধি করে যে জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে ভারতীয় ঐক্যই প্রকৃত জাতীয়তাবাদ। তার বিখ্যাত উক্তি— “আজ আমি ভারতবর্ষীয়… আমার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই।”—এটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সার্বজনীন রূপ প্রকাশ করে।
আনন্দময়ীর চরিত্রটি ‘গোরা’ উপন্যাসে কীভাবে জাতীয়তাবোধকে প্রতীকায়িত করে?
আনন্দময়ী সর্বজনীন মাতৃরূপে চিত্রিত, যিনি জাত-পাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে। গোরা তার কাছে বলেছে— “তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই… তুমিই আমার ভারতবর্ষ।” এটি ভারতমাতার প্রতীক, যিনি সকলকে সমানভাবে গ্রহণ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে কীভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছেন?
রবীন্দ্রনাথ গোরার চরিত্রের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে সত্যিকারের জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় বিভেদের ঊর্ধ্বে। গোরা শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সকলকে একই সমাজের অংশ হিসেবে দেখে এবং ভারতীয় ঐক্যকে প্রাধান্য দেয়।
‘গোরা’ উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কী মনোভাব ফুটে উঠেছে?
গোরা প্রথমে ইংরেজ বিদ্বেষী এবং হিন্দু সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, কিন্তু পরে সে বুঝতে পারে যে সংকীর্ণ বিদ্বেষ নয়, গঠনমূলক জাতীয়তাবাদই ভারতের মুক্তির পথ। রবীন্দ্রনাথ এখানে অন্ধ জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেছেন।
‘গোরা’ উপন্যাসটি বর্তমান সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক?
‘গোরা’ উপন্যাসটি আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং জাতীয় ঐক্যের বার্তা দেয়। বর্তমান সময়ে ধর্মীয় বিভেদ ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে এই উপন্যাসের শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী দর্শন কী?
রবীন্দ্রনাথের মতে, সত্যিকারের জাতীয়তাবাদ হলো মানবতাবাদ ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা চেতনা। ‘গোরা’ উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন যে ভারতীয় সভ্যতা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে পারে, যা প্রকৃত জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি।
‘গোরা’ উপন্যাসের শেষে গোরার আত্মোপলব্ধি কী ছিল?
উপন্যাসের শেষে গোরা বুঝতে পারে যে জাতি-ধর্ম নয়, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসাই প্রকৃত পরিচয়। সে আনন্দময়ীকে বলেছে— “তুমিই আমার ভারতবর্ষ”, যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সার্বজনীন রূপ প্রকাশ করে।
‘গোরা’ উপন্যাসটি কেন জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা?
কারণ এটি ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয়দের আত্মপরিচয় ও জাতীয় চেতনা জাগরণে ভূমিকা রেখেছে। এটি শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রভাবিত করেনি, বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবিক মূল্যবোধের উপরও জোর দিয়েছে।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “জাতীয়তাবাদ বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের ভূমিকা লেখো। ভারতের ধর্মীয় বিষয়ে গোরার কী উপলব্ধি হয়েছিল?” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই “জাতীয়তাবাদ বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের ভূমিকা লেখো। ভারতের ধর্মীয় বিষয়ে গোরার কী উপলব্ধি হয়েছিল?” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা” -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন