দশম শ্রেণি – বাংলা – জ্ঞানচক্ষু – সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

জ্ঞানচক্ষু গল্পে আশাপূর্ণা দেবী একজন বালকের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় চিত্রিত করেছেন। তপন নামের এই বালক সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী। সে স্বপ্ন দেখে যে একদিন সে একজন লেখক হবে। তার এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তার ছোটো মেসো তাকে সাহায্য করেন। মেসোর কাছ থেকে সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করে তপন তার লেখনীর দক্ষতায় উন্নতি করতে থাকে। অবশেষে, তার লেখা একটি গল্প একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই ঘটনা তপনের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘটায়। সে বুঝতে পারে যে তার স্বপ্ন সত্যি হতে পারে।

দশম শ্রেণি – বাংলা – জ্ঞানচক্ষু -

তপন কৃতার্থ হয়ে বসে বসে দিন গোনে। — কী কারণে তপন দিন গুনছিল? তার দিন গোনার ফল কী হয়েছিল?

তপনের দিন গোনার কারণ – আশাপূর্ণা দেবীর ‘জ্ঞানচক্ষু’ গল্পে তপনের লেখা গল্পটি পড়েন তার লেখক ছোটোমেসোমশাই। সবার সামনে তিনি তপনের লেখার বিষয় নির্বাচনের প্রশাংসা করেন। সব শেষে তিনি লেখাটি ছাপানোর আশ্বাস দিয়ে সেটি নিয়ে চলে গেলে তপনের আহ্লাদের অন্ত থাকে না। মেসোর ক্ষমতার প্রতি অগাধ আস্থাবান তপন পত্রিকায় নিজের লেখা দেখার আশায় অধীর হয়ে দিন গুনতে থাকে।

দিন গোনার ফল – একসময় তপনের প্রতীক্ষার অবসান হয়। সে সন্ধ্যাতারা পত্রিকাটি হাতে পায়। লেখকসূচিতে নিজের নাম এবং গল্পের শিরোনাম দেখে তপন শিহরিত হয়। কিন্তু মায়ের কথায় গল্পটি পড়ে শোনাতে গিয়ে দেখে, তার মেসোমশাই একটু-আধটু কারেকশান করার নামে লেখাটার আদ্যোপান্তই বদলে ফেলেছেন। গোটা গল্পের একটি বাক্যও সে নিজের লেখা বলে চিনতে পারে না এবং ক্রমশ উপলব্ধি করে মেসোমশাই শুধু গল্পটি প্রকাশের ব্যবস্থাই করেননি, শেষপর্যন্ত গোটা গল্পটিই তাঁর লেখা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কৃতিত্বের কোনো অংশই তপনের নিজের প্রাপ্য নয়। গভীর দুঃখে ভেঙে পড়লেও তপন সেই মুহূর্তেই প্রতিজ্ঞা করে যে, এরপর নিজের লেখা সে নিজে গিয়েই প্রকাশকের দফতরে ছাপতে দিয়ে আসবে। তাতে ছাপা হয় হবে, না হয় না হবে।

নিথর দুপুরবেলায় তপন কী করেছিল আর তারপর কী ঘটনা ঘটেছিল সংক্ষেপে লেখো।

নিথর দুপুরবেলায় তপনের কৃতকাজ –

  • গল্প লেখা – আশাপূর্ণা দেবীর ‘জ্ঞানচক্ষু’ গল্পে তপন এক নির্জন দুপুরবেলায় তার হোমটাস্কের খাতায় একটা গোটা গল্প লিখে ফেলে।
  • রোমাঞ্চিত হওয়া – গল্প লেখার পর আনন্দে আর রোমাঞ্চে তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে তার গল্প লেখার কথা প্রথম বলে তার ছোটোমাসিকে। ছোটোমাসি তার গল্পটা পড়ে একপ্রকার জোর করেই ছোটোমেসোর হাতে সেটি দিয়ে দেয় এবং গল্পটি প্রকাশের অনুরোধও জানায়।
  • ছোটোমেসোর বক্তব্য – ছোটোমেসো গল্পটা পড়ে কিছু সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। পাশাপাশি তিনি তপনকে কথা দেন যে তার লেখা গল্প সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থাও করে দেবেন।

পরবর্তী ঘটনা – মেসোমশাই তাঁর কথা রাখেন। তিনি সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় লেখাটি ছাপান এবং সেটা তপনকে দেখানোর জন্য নিয়ে আসেন। কিন্তু তপন সেই লেখা সবাইকে পড়ে শোনাতে গিয়ে দেখে, তার হাতে – লেখা গল্পের সঙ্গে ছাপার অক্ষরে লেখার কোনো মিল নেই। তা পুরোপুরি মেসোমশাইয়ের পাকা হাতের লেখা। নিজের নামে অন্যের লেখা পড়তে গিয়ে লজ্জায়, অপমানে সে ভেঙে পড়ে। সে দৃঢ় সংকল্প করে, যদি কখনও নিজের লেখা ছাপতেই হয় তাহলে নিজে গিয়ে সেটা ছাপতে দেবে, অন্যের দয়া গ্রহণ করবে না।

জ্ঞানচক্ষু গল্পে তপনের জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন কীভাবে হয়েছে তা বর্ণনা করো।

  • লেখক সম্পর্কে ধারণা – তপনের নিজস্ব ভাবনায় লেখকরা ছিল অন্য জগতের মানুষ। কিন্তু তার লেখক ছোটোমেসোকে দেখে এবং তাঁর আচার-ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করে তপন বোঝে, লেখকরা সাধারণ মানুষের মতোই। সেই মুহূর্তে তার জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়। যদিও তপনের জ্ঞানচক্ষু প্রকৃতপক্ষে আরও অনেক পরে খুলেছিল।
  • ছোটোমাসির ভূমিকা – তপনের সারাদুপুর ধরে লেখা গল্পটা তার ছোটোমাসি একরকম জোর করেই তার মেসোকে দেখায়। ছোটোমেসো সেই লেখার প্রশংসাও করেন। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও বলেন যে, গল্পটার একটু সংশোধনের দরকার।
  • ছোটোমেসোর বক্তব্য – ছোটোমেসো সেই লেখা ছাপানোর ব্যবস্থাও করে দেবেন বলে কথা দেন। তপন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখবে বলে।

গল্পপ্রকাশ – সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় সত্যিই তার লেখা একসময় প্রকাশিত হয়। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে তপন এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করে।

  • নিজস্বতা খুঁজে না-পাওয়া – কিন্তু সবাইকে লেখাটা পড়ে শোনাতে গিয়ে সে ছাপার অক্ষরে লেখার সঙ্গে নিজের লেখাটির কোনো মিল খুঁজে পায় না। পুরো লেখাটা আগাগোড়াই তার মেসোমশাইয়ের সংশোধন করা।
  • গভীর দুঃখ ও জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন – দুঃখে, লজ্জায়, অপমানে তপন ভেঙে পড়ে। এবার যেন প্রকৃতই তার অন্তদৃষ্টি জেগে ওঠে। নিজের সৃষ্টির প্রতি অধিকারবোধ জন্মায় তপনের মনে। সে দৃঢ় সংকল্প করে, নিজের লেখা সে নিজেই ছাপতে দেবে, অন্যের দয়া গ্রহণ করবে না।

তপনের লেখক হওয়ার পিছনে তার ছোটোমাসির ভূমিকা কতখানি ছিল আলোচনা করো।

  • সূচনাপর্বে ভূমিকা – ছোটোমাসির বিয়ে হওয়ার পর নতুন মেসোমশাইকে দেখে লেখক সম্পর্কে তপনের ধারণা সম্পূর্ণ পালটে যায়। কেন-না নতুন মেসো একজন লেখক এবং তিনিও আর পাঁচজন মানুষের মতোই। এবার তপন নিশ্চিত হয়, তার পক্ষে লেখক হওয়ার পথে আর কোনো বাধা নেই। সুতরাং তপনের লেখক হওয়ার সূচনাপর্বটি তৈরি করে দিয়েছে তার মাসি। তপনের লেখা নিয়ে তার মাসিই তাকে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন।
  • গল্প লেখা ও গল্পপ্রকাশে ভূমিকা – দুপুরবেলা হোমটাস্কের খাতায় তপন একটি গল্প লিখে প্রথমে তার ছোটোমাসিকেই দেখায়। এরপর তপনের লেখা গল্পটা তার মাসিই নতুন মেসোকে পড়তে দিয়ে বলেছেন – তা হলে বাপু তুমি ওর গল্পটা ছাপিয়ে দিও।
  • মূল্যায়ন – ছোটোমাসিই তপনের চিরকালের বন্ধু ‘বয়সে বছর আষ্টেকের বড়ো হলেও সমবয়সি, কাজেই মামার বাড়ি এলে সব কিছুই – ছোটোমাসির কাছে।’ সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় মেসোর উদ্যোগে গল্প ছাপা হলে ছোটোমাসির মধ্যে আত্মতুষ্টির আনন্দ লক্ষ করা যায়। তাই বলা যায়, তপনের লেখক হওয়ার পিছনে তার ছোটোমাসির উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা ছিল অপরিসীম।

আশাপূর্ণা দেবীর জ্ঞানচক্ষু গল্পের নামকরণ কতদূর সার্থক হয়েছে লেখো।

যে-কোনো সাহিত্যকর্মের নামকরণ করা হয় বিষয়বস্তু, চরিত্র বা ভাব অনুযায়ী, আবার কখনও তা হয় ব্যঞ্জনাধর্মী। যে-কোনো সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রেই নামকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

জ্ঞানচক্ষু গল্পের নামকরণটি মূলত ব্যঞ্জনাধর্মী। ‘জ্ঞানচক্ষু’ কথাটির অর্থ হল অন্তর্দৃষ্টি বা জ্ঞানরূপ দৃষ্টি। এই গল্পের একেবারে শেষ পর্যায়ে দেখা যায় তপন চরিত্রটির প্রকৃত জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হয়েছে।

এই গল্পে প্রাথমিকভাবে তপনের জ্ঞানচক্ষুর উন্মোচন ঘটেছে যখন প্রথমবার সে তার লেখক ছোটোমেসোকে দেখেছে। লেখকরা যে অন্য জগতের বাসিন্দা নন, বাস্তবের চেনা মানুষদের মতোই তাঁদের জীবনযাপন-এই সত্য উপলব্ধি করেছে তপন। তপনের লেখা প্রথম গল্পটি নতুন মেসোমশাই অর্থাৎ ছোটোমেসো কিছু সংশোধন করে সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় ছাপিয়ে, দেন। কিন্তু ছাপার অক্ষরে নিজের লেখাটি সকলের সামনে পড়তে গিয়ে তপন মনে খুব আঘাত পায়। কারণ সে বুঝতে পারে, মেসোমশাই সংশোধনের নামে পুরো লেখাটাই বদলে দিয়েছেন। সেটাকে আর নিজের বলে চিনতেই পারে না তপন। লজ্জায়, অপমানে, দুঃখে সে যেন মাটিতে মিশে যায়। নিজের গল্প পড়তে বসে, অন্যের লেখা লাইন পড়তে গিয়ে তপনের ভিতরে গ্লানিবোধ জেগে ওঠে। সে সংকল্প করে, লেখা যদি ছাপতেই হয় তাহলে পত্রিকা দফতরে নিজে গিয়ে তা দিয়ে আসবে। নিজের সেই লেখাটি না ছাপলেও দুঃখ থাকবে না তার। সেখানে তপনেরই নিজস্বতা থাকবে, অন্য কেউ সেই কৃতিত্বের ভাগীদার হবে না। এভাবেই আত্মমর্যাদা ও নিজের লেখার প্রতি অধিকারবোধ তপনের জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটিয়েছে। তাই বলা যায়, গল্পের ‘জ্ঞানচক্ষু’ নামকরণটি যথাযথ হয়েছে।

জ্ঞানচক্ষু গল্প অবলম্বনে তপন চরিত্রটির পরিচয় দাও।

  • কথামুখ – আশাপূর্ণা দেবীর ‘জ্ঞানচক্ষু’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তপন। তার চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যগুলি গল্পে দেখতে পাওয়া যায়, তা হল –
  • কল্পনাপ্রবণতা – লেখক সম্পর্কে তপনের মনে এক বিস্ময় বাসা বেঁধেছিল। সে ভাবত, লেখকরা অন্য জগতের বাসিন্দা, আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের কোনো মিলই নেই।
  • সৃজনশীলতা – ছোটোমাসির বিয়ের পর তপনের ধারণা সম্পূর্ণ বদলে। যায়। কারণ তার নতুন মেসো ছিলেন একজন লেখক, যাঁর অনেক বই ছাপা হয়েছে। একজন লেখককে খুব কাছ থেকে দেখে লেখক হওয়ার প্রেরণায় তপন লিখে ফেলে সম্পূর্ণ একটা গল্প। নতুন মেসো সেই গল্পের প্রশংসা করায় তপন লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
  • আবেগপ্রবণতা ও সংবেদনশীলতা – সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় তপনের গল্পটা ছেপে বেরোলে সে অবাক হয়ে যায়। এর কারণ, মেসো সংশোধন করতে গিয়ে তার লেখা গল্পটা আগাগোড়া পালটে দিয়েছেন। তপন সেই গল্পের মধ্যে নিজেকেই খুঁজে পায় না। তাই সে হতাশ হয়ে পড়ে।
  • আত্মাভিমান – মেসোর সংশোধনের ফলে তার নিজের লেখার পালটে যাওয়া তপন মেনে নিতে পারে না। তাই সে সংকল্প করে, ছাপা হোক বা না হোক, এবার থেকে নিজের লেখা নিজেই পত্রিকা সম্পাদকের কাছে জমা দেবে। এই আত্মসম্মানবোধই তপনকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ করেছে।

ছোটোগল্প হিসেবে জ্ঞানচক্ষু গল্পটির সার্থকতা আলোচনা করো।

আশাপূর্ণা দেবীর ‘জ্ঞানচক্ষু’ গল্পটির সূচনা হয়েছে ছোটোগল্পের প্রত্যাশিত আকস্মিকতা দিয়ে – ‘কথাটা শুনে তপনের চোখ মার্বেল হয়ে গেল।’ তপন নামের একটি কিশোর চরিত্রকে গল্পের কেন্দ্রে রেখে লেখিকা তার স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি রচনা করেছেন। তপনের লেখক মেসোমশাই তার লেখাকে আপাদমস্তক পালটে দিয়ে সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘটনায় তপনের লেখকসত্তা প্রবল আঘাত পায়। ছাপার অক্ষরে শুধুই নিজের নামের প্রকাশ নয়, নিজের সৃজনশীলতার প্রতি স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা এবং তা না হওয়ার যন্ত্রণা তপন চরিত্রটিকে অন্য মাত্রা দেয়। কাহিনির পরিণতি যতই গুরুগম্ভীর হোক, তাকে অসামান্য ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন লেখিকা। গল্পে তপনের লেখক মেসোমশাইয়ের চরিত্রটি বর্ণনার গুণে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে – ‘ঠিক ছোটো মামাদের মতোই খবরের কাগজের সব কথা নিয়ে প্রবলভাবে গল্প করেন, তর্ক করেন, আর শেষ পর্যন্ত ‘এ দেশের কিছু হবে না’ বলে সিনেমা দেখতে চলে যা।’ -এই অনবদ্য রচনাশৈলী কাহিনিকে গতিশীল করেছে। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ‘জ্ঞানচক্ষু’ গল্পটি সার্থকতা পেয়েছে তার পরিণতিতে। মৌলিকতায় বিশ্বাসী এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কিশোর লেখকের যন্ত্রণা শুধু চরিত্রটিকে নয়, গল্পটিকেও অসামান্যতা দিয়েছে।

এই গল্পটি আমাদের সকলের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। এটি আমাদের শিখিয়েছে যে, যদি আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করি, তাহলে আমরা অবশ্যই সফল হব।

Share via:

মন্তব্য করুন