এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের পঞ্চম পাঠের তৃতীয় অধ্যায়, ‘আমরা’ -এর বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করবো। এখানে কবির পরিচিতি, কবিতার উৎস, কবিতার পাঠপ্রসঙ্গ, কবিতার সারসংক্ষেপ, কবিতার নামকরণ এবং এর প্রধান বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এই আর্টিকেলটি আপনাদের ‘আমরা’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দেবে এবং কবিতাটি ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এছাড়া, নবম শ্রেণীর পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে কবি ও কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কিত প্রশ্ন আসতে পারে, তাই এই তথ্যগুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

‘আমরা’ কবিতার কবি পরিচিতি
ভূমিকা –
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য এবং রবীন্দ্রানুসারী কবিদের মধ্যে অন্যতম হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কবি মোহিতলাল মজুমদার তাঁর সম্পর্কে বলেছেন – “সত্যেন্দ্রনাথ সংস্কারমুক্ত ছিলেন, তিনি মানুষের ভাগ্য, শক্তি ও প্রতিভাকে সর্বদেশ ও সর্বকালে সমান গৌরবের অধিকারী বলিয়া মনে করতেন। এজন্য তাঁহার জাতীয়তাবোধ যেমন উদারতার ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তেমনই বর্তমানের প্রতি শ্রদ্ধা ও বৃহত্তর ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা ছিল।” সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন যুগসচেতন কবি।
জন্ম –
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 1882 খ্রিস্টাব্দের 12 ফেব্রুয়ারি বর্তমান উত্তর 24 পরগনা জেলার নিমতা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রজনীনাথ দত্ত এবং মাতা মহামায়া দেবী। তাঁর পিতামহ ছিলেন উনিশ শতকীয় নবজাগরণের আলোকস্নাত প্রখর বুদ্ধিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক প্রাবন্ধিক অক্ষয়কুমার দত্ত।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের শিক্ষা, বিবাহ ও কর্মজীবনের সূচনা –
বালক সত্যেন্দ্রনাথের শিক্ষারম্ভ হয় কলকাতায়। তিনি মাত্র 12 বছর বয়সে (1894 খ্রিস্টাব্দে) ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ নামক একটি কবিতা রচনা করেন। এরপর 1896 খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভ্রমণ সংক্রান্ত একটি লেখা প্রকাশ পায় সাপ্তাহিক ‘হিতৈষী’ পত্রিকাতে। সেই সময় থেকে শুরু হয়ে যায় সত্যেন্দ্রনাথের সাহিত্যিক-কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত হয়ে ওঠার প্রয়াস। 1899 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পাস করেন। 1901 খ্রিস্টাব্দে জেনারেল এসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশন (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে তিনি তৃতীয় বিভাগে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। বিএ পড়ার সময়ে 1903 খ্রিস্টাব্দের 17 এপ্রিল হাবড়ার ঈশানচন্দ্র বসুর কন্যা কনকলতার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তিনি বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ইতিমধ্যে সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় তাঁর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। 1900 খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘সবিতা’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। তিনি ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। 1919 খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত ‘রবিমণ্ডলী’ নামক রবীন্দ্র অনুগামী সমিতির নামকরণ করেন তিনি। সত্যেন্দ্রনাথ সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – নবকুমার, অশীতিপর, কলমগীর প্রভৃতি।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের রচনাসম্ভার –
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মাত্র চল্লিশ বছরের জীবনে বহু কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ও সংকলনগুলি হল – ‘সবিতা’ (1900 খ্রিস্টাব্দ), ‘সন্ধিক্ষণ’ (1905 খ্রিস্টাব্দ), ‘বেণু ও বীণা’ (1906 খ্রিস্টাব্দ) – পরবর্তীকালে ‘সন্ধিক্ষণ’ এই সংকলনে যুক্ত হয়েছে। ‘হোমশিখা’ (1907 খ্রিস্টাব্দ) – এই গ্রন্থে ‘সবিতা’ যুক্ত হয়। এ ছাড়াও রয়েছে ‘তীর্থসলিল’ (1908 খ্রিস্টাব্দ), ‘তীর্থরেণু’ (1910 খ্রিস্টাব্দ), ‘ফুলের ফসল’ (1911 খ্রিস্টাব্দ), ‘কুহু ও কেকা’ (1912 খ্রিস্টাব্দ), ‘তুলির লিখন’ (1914 খ্রিস্টাব্দ), ‘মণিমঞ্জুষা’ (1915 খ্রিস্টাব্দ), ‘অভ্র-আবীর’ (1916 খ্রিস্টাব্দ), ‘হসন্তিকা’ (1917 খ্রিস্টাব্দ)। কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ‘বেলা শেষের গান’ (1923 খ্রিস্টাব্দ) এবং ‘বিদায়-আরতি’ (1924 খ্রিস্টাব্দ)। তা ছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আরও কিছু কবিতা থাকাও অসম্ভব নয়। সত্যেন্দ্রনাথ ‘বারোয়ারি’ উপন্যাসের 29 থেকে 32 পরিচ্ছেদ পর্যন্ত লিখেছেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘ডঙ্কানিশান’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস আরম্ভ করেন, তবে শেষ করেননি। ‘ধূপের ধোঁয়ায়’ নামক নাটকটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন পরে। একসময় ‘নবকুমার কবিরত্ন’ ছদ্মনামে তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলি ও ব্যক্তিদের সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক গদ্য-নিবন্ধ ও ক্ষুদ্রাকার কবিতা রচনা করেন। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বাধীনতার চারণকবি। তৎকালীন চরমপন্থী দলের প্রতিই তাঁর সহানুভূতি ছিল। নব্যপন্থীদের তিনি অজস্র বিদ্রূপ উপহাস করেছেন তাঁর ‘নরম-গরম সংবাদ’ শীর্ষক কবিতায়। তিনি ‘জন্মদুঃখী’ নামে একটা নরওয়েজিয়ান উপন্যাসের ভাষান্তর এবং কিছু বিদেশি নাটকের আংশিক অনুবাদ করেছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের রচনা বৈশিষ্ট্য –
বাংলা শ্বাসাঘাতপ্রধান ছন্দের বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে সত্যেন্দ্রনাথ সিদ্ধহস্ত। পয়ার ত্রিপদীতে কবির বৈচিত্র্য কম। তিনি ধ্বনিপ্রধান বা মাত্রাবৃত্ত বা কলাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেছেন বেশ কয়েকটি কবিতায়, বিশেষ করে সংস্কৃত ছন্দের বাংলায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে। কবির ছন্দের বৈচিত্র্য আছে চার মাত্রার পর্বে। শব্দব্যবহারের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা গ্রহণ করেও তিনি ছন্দের আশ্চর্য স্পন্দন এনেছেন। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ‘ছন্দের জাদুকর’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি শুধুমাত্র ছন্দ সচেতনই নয়। হরপ্রসাদ মিত্রের কবিতা ও কাব্যরূপ থেকে জানা যায় রাষ্ট্র ও সামাজিক তৎকালীন চিত্র তাঁর কবিতায় রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘শূদ্র’, ‘মেথর’, দুর্ভিক্ষ, ‘হাহাকার’, ‘গান্ধীজি’, ‘ফরিয়াদ’ এবং পাঠ্যাংশের অন্তর্গত আলোচ্য ‘আমরা’ কবিতাটি। অতএব শুধুমাত্র কোনো একদিন থেকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যবৈশিষ্ট্য বিচার করা সম্ভব নয়। যথার্থ সমাজসচেতন, রোমান্টিক কবি সত্যেন্দ্রনাথের কৃতিত্ব স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘পূরবী’ কাব্যে উল্লেখ করেছেন।
‘আমরা’ কবিতার উৎস
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ‘কুহু ও কেকা’ কাব্যগ্রন্থ (প্রথম প্রকাশ 1319 বঙ্গাব্দ অর্থাৎ 1912 খ্রিস্টাব্দ) থেকে পাঠ্য ‘আমরা’ কবিতাটি গৃহীত হয়েছে। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বাণী’ পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ, 1318 বঙ্গাব্দে।
‘আমরা’ কবিতার পাঠপ্রসঙ্গ
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের স্বদেশের প্রতি প্রবল ও সুতীক্ষ্ণ অনুরাগ ছিল। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি অসীম মমতায় আশাবাদী কবি বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন। ‘কুহু ও কেকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘ঝোড়ো হাওয়া’, ‘বন্দরে’, ‘ছেলের দল’ এবং ‘আমরা’ কবিতায় জাতীয় উৎসাহ এবং উদ্যমের নতুন সুর দেখা গেল। ‘আমরা’ কবিতাটি তেমনই এক দেশাত্মবোধক কবিতা। কবি বঙ্গদেশের মহীয়সী রূপ এ কবিতায় প্রকাশ করেছেন। ভাষা, সংস্কৃতি এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি কবির প্রগাঢ় অনুরাগ সহজেই এই কবিতাপাঠে উপলব্ধি করা যায়। পরাধীন দেশবাসীর কাছে অতীতের গৌরব এবং ঐতিহ্য প্রকাশ করে তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলাই এ কবিতার মূল লক্ষ্য।
‘আমরা’ কবিতার বিষয়সংক্ষেপ
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতায় ভাষা, ছন্দ ও চিত্রকল্প ব্যবহারে এক অভিনবত্ব এনেছিলেন। মাত্র চল্লিশ বছরের জীবনপরিসীমার মধ্যেই তিনি আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। পাঠ্য কবিতা ‘আমরা’ তাঁর সেই উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর।
এ কবিতায় কবি গর্বিত বাঙালি জীবনের মাহাত্ম্যকথা প্রচার করেছেন। সাতটি স্তবকে যথাক্রমে বাংলা ও বাঙালির ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, সাম্য এবং গৌরবময় ভবিষ্যতের কথা তুলে ধরেছেন কবি। প্রথম স্তবকে তিনি বলেছেন, প্রশস্ত গঙ্গাতীরে তীর্থস্বরূপ অবস্থিত এই বঙ্গভূমি। বাঁদিকে পদ্ম যা বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় ফুল, ডানদিকে মহুয়াফুল শোভিত বিহার, ঊর্ধ্বদেশে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত, আর পাদদেশে বঙ্গোপসাগর। এই বাঞ্ছিত বঙ্গভূমি সোনার ধানে ভরা; স্নেহময়ী বঙ্গ যার দেহ পদ্ম, অতসী, অপরাজিতায় অলংকৃত।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে হিংস্র বাঘ এবং বিষধর সাপে ভরা বঙ্গভূমিকে বাসযোগ্য করে বাঙালি বিস্তার করেছে তার সভ্যতা। বাঙালি সৈনিক চতুরঙ্গ সাজে রামচন্দ্রের প্রপিতামহ রঘুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, কখনও বীর বাঙালি বিজয়সিংহের লঙ্কাদেশ জয় করার চিহ্নস্বরূপ লঙ্কার নাম হয়েছে সিংহল। কখনও মগ, কখনও মোগলের আক্রমণ সামাল দিয়ে ওঠা বাঙালি দিল্লিনাথকেও পরাজিত করেছে।
কপিলমুনি বাংলার মাটিতেই জন্ম দিয়েছেন তাঁর সাংখ্যদর্শনের অমূল্য সূত্রাবলির। বঙ্গ সন্তান অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ভারতবর্ষ থেকে হিমালয় পর্বত পার হয়ে সুদূর তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রচার করেছিলেন। পক্ষধর মিশ্রকে পরাজিত করে যশ পান বাঙালি কিশোর রঘুনাথ ভট্ট। কবি জয়দেবের অনবদ্য রচনাগুলোর ভিত্তিভূমিও এই বাংলা।
বঙ্গস্থাপত্যের নিদর্শন বরভূধর, ওঙ্কারধাম। বাঙালি স্থপতি ধীমান ও তার সন্তান বিটপাল বাঙালির প্রাচীন গৌরবগাথা রচনা করেছেন। অজন্তায় বুদ্ধজীবনচিত্রও বঙ্গদেশের প্রভাবজাত। বাংলার নিজস্ব লোকজ সংগীতধারা, কীর্তন, বাউলগানও আজ বিশ্বখ্যাত।
মন্বন্তর, মহামারি বঙ্গভূমিকে বারবার দীর্ণ ও জীর্ণ করলেও বঙ্গবাসী তাকে জয় করে বাঙালি জীবনধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। দেবতাকে আত্মীয় মনে করা বাঙালি আকাশপ্রদীপ জ্বালে, নিজের কুটিরে মানুষের ভিতরে দেবলীলা সন্ধান করে। বাঙালির ঘরের ছেলে আজ বিশ্বমানবের মূর্তরূপ, বাঙালির বীর বিবেকানন্দ পাশ্চাত্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গভূমির বাণী প্রচার করেছেন। বাঙালি বৈপরীত্যে ঐক্য আনতে সক্ষম বলেই কবির প্রত্যয়।
বিজ্ঞানের অগ্রগতিও হয়েছে বঙ্গসন্তানদের হাত ধরে। বাঙালি রসায়নবিদ প্রফুল্লচন্দ্র নতুন যৌগ তৈরি করে বিজ্ঞান মহলে সাড়া ফেলেছেন। বাঙালি জীববিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র গাছের উত্তেজনায় সাড়া দেওয়া লক্ষ করেছেন। ধাতার আশীর্বাদে বিধাতার কাজ বাঙালি করতে পারবে বলে কবি তাই প্রত্যয়ী হয়েছেন।
ভবিষ্যৎসংক্রান্ত অনিশ্চয়তার জবাব আজ বাঙালি দিতে পেরেছে। সত্যনিষ্ঠ বাঙালি সে ভাবনা ও ভীতিমুক্ত হয়ে জগৎপ্রাণের সভায় নিজেকে প্রকাশ করেছে। অসাড় ভারতীয় জীবন-ধারায় পঞ্চবটীর মতো প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছে বাঙালি। কবি আশা করেছেন বাঙালি জাতি ‘সৃজনের শতদলে’ থাকা অমরত্বের বীজ নিজগুণে একদিন অর্জন করবে। তিনি বলেছেন, সুদূর অতীতে যেমন তারা গৌরবের অধিকারী ছিল, দেবতার আশীষে পুনরায় সেই উৎকর্ষের আসনে তারা অধিষ্ঠান করবে। এর জন্য তাদের অক্লান্ত সাধনাই যথেষ্ট। তারাই রচনা করবে নতুন ভারতের। মিলনের মহামন্ত্রে বিশ্বমানবকে দীক্ষিত করে দেবঋণ থেকে মুক্ত হবে বাঙালি এই মুক্তবেণীর তীরেই।
‘আমরা’ কবিতার নামকরণ
ভূমিকা –
সাহিত্যক্ষেত্রে তার ভাববস্তুর পরিচয় নামকরণেই পাওয়া যায়। তাই সাহিত্যক্ষেত্রে নামকরণ হয়ে ওঠে বিষয়ের প্রতিবিম্ব, ভাবের প্রতিফলিত রূপ।
ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘আমরা’ কবিতাতে বাঙালি জীবনের জয়গাথা রচনা করেছেন। উত্তম পুরুষের বহুবচন ‘আমরা’ শব্দটিকে শিরোনামে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘আমরা’ বলতে কবি বঙ্গবাসী বা বাঙালিদের বুঝিয়েছেন। সাতটি স্তবক জুড়ে 64 পঙক্তির এ কবিতায় তিনি বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-শিল্প-বিজ্ঞানের ঔজ্জ্বল্য এবং সফল বাঙালি জীবনের জয়গান গেয়েছেন।
বিষয়বস্তু –
বাংলার অবস্থান তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনার মধ্যে দিয়ে কবি শুরু করেছেন আলোচ্য কবিতাটি। বাঙালি জাতির ইতিহাস, তাদের বীরত্ব, স্বভূমিকে রক্ষার জন্য আত্মবলিদান বর্ণিত হয়েছে এখানে। অবদমিত ও তথাকথিত অনার্য জাতি বাঙালি কীভাবে নিজের সাধনায় ও প্রতিভায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল কবি তা ব্যক্ত করেছেন কবিতার প্রতিটি ছত্রে।
বাঙালির ঐতিহ্যে, শিল্প সংস্কৃতি, স্থাপত্য আজও ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে উজ্জ্বল। ধমচর্চায়, জ্ঞানচর্চায়, বিজ্ঞান সাধনায় লোকজ সংগীত রচনায় বাঙালির অস্তিত্ব বিশ্বপ্রাঙ্গণে গৌরবোজ্জ্বল। মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরের করাল ছায়াকে উপেক্ষা করে তারা জীবনীশক্তি জ্বালিয়ে রেখেছে। দেবতা তাদের সখ্য, বাঙালি তার কুটিরে মানবলীলায় দেবলীলা উপলব্ধি করেছে।
কবি আশা করেছেন অতীতের ঐতিহ্যকে বাঙালি ভবিষ্যতেও বজায় রাখবে। তারা আবার হৃত গৌরব অর্জন করবে নিজের প্রচেষ্টায়, বাহুবল বা বিদ্বেষ দিয়ে নয়। মহামিলনের গানে তারাই বিশ্বমানবকে একসূত্রে বেঁধে রাখবে।
নামকরণের সার্থকতা
কবির বিশ্বাস অতীত থেকে আজ এবং আগামীতেও বাঙালির এই সাফল্য চিরপ্রবহমান। তিনি তাই বলেছেন – ‘বিধাতার বরে ভরিবে ভুবন বাঙালির গৌরবে।’ বঙ্গবাসীর এই গৌরব গাথা কবিতার বিষয়বস্তুর মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই কবিতার শিরোনাম ‘আমরা’ হওয়া তাই সঙ্গত হয়েছে। সাহিত্যশিল্পের নামকরণ স্রষ্টার অভিপ্রায়ের প্রকাশক। স্বজাতির মাহাত্ম্যকথা প্রচার করতে গিয়ে কবি বাঙালিয়ানা ও বাঙালির ঐক্যবদ্ধতায় আস্থা রেখেছেন। সেই আস্থা প্রকাশে তিনি কবিতায় মোট 21 বার ‘আমরা’, ‘আমাদের’, ‘মোরা’, ‘মোদের’ ইত্যাদি সর্বনাম ধ্রুবপদের মতো ব্যবহার করেছেন। বাঙালি জাতির সর্বাঙ্গীণ আত্মকথনের প্রকাশে তাই নামকরণটিও উপযুক্ত হয়ে উঠেছে।
এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের পঞ্চম পাঠের তৃতীয় অধ্যায়, ‘আমরা’ -এর বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করবো। এখানে কবির পরিচিতি, কবিতার উৎস, কবিতার পাঠপ্রসঙ্গ, কবিতার সারসংক্ষেপ, কবিতার নামকরণ এবং এর প্রধান বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই আর্টিকেলটি আপনাদের ‘আমরা’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়েছে এবং কবিতাটি ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এছাড়া, নবম শ্রেণীর পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে কবি পরিচিতি, কবিতার নামকরণ ও কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কিত প্রশ্ন আসতে পারে, তাই এই তথ্যগুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মন্তব্য করুন