নবম শ্রেণি – বাংলা – নোঙর (কবিতা) অজিত দত্ত

Gopi


অজিত দত্তের নোঙর কবিতাটি একটি রূপকধর্মী কবিতা। কবিতায় নোঙরকে জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। কবি মনে করেন, জীবনের কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য না থাকলে মানুষ দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। জীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝা তাকে সহজেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাই জীবনে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকা জরুরি।

দ্বিতীয় স্তবকে কবি বলেছেন, নোঙর ছাড়া নৌকা ঝড়-ঝঞ্ঝার মুখে সহজেই পরাজিত হয়। নোঙর নৌকাকে স্থির রাখে এবং তাকে ঝড়-ঝঞ্ঝার হাত থেকে রক্ষা করে। ঠিক তেমনি, জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষ জীবনের নানা চ্যালেঞ্জের মুখে সহজেই পরাজিত হয়।

তৃতীয় স্তবকে কবি বলেছেন, নোঙর ছাড়া নৌকা কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। নোঙর নৌকাকে সঠিক পথে চালিত করে এবং তাকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। ঠিক তেমনি, জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষ জীবনের কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না।

নবম শ্রেণি – বাংলা – নোঙর

কবি পরিচিতি

ভূমিকা – বিশ শতকের তিরিশ-চল্লিশ দশকের আধুনিক বাংলা কবিতার একজন প্রতিভাধর কবি অজিত দত্ত। কবিতা ছাড়াও সমসাময়িক বাংলা কবিতা, ছন্দ, রবীন্দ্র বিষয়ক ভাবনা, বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের রচনার মূল্যায়ন এবং শিশুসাহিত্য বিষয়ে তিনি বহু প্রবন্ধও রচনা করেছেন।

জন্ম ও শৈশব – ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার বিক্রমপুরে এক অভিজাত পরিবারে কবির জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম অতুলকুমার দত্ত এবং মায়ের নাম হেমনলিনী দেবী। অজিত দত্তের মা ছিলেন অত্যন্ত সাহিত্যপ্রেমী। অর্ঘ্য নামে তাঁর গান ও কবিতার একটি সংকলন – গ্রন্থ আছে। কবিদের পরিবার একসময়ে খুব বিত্তশালী ছিল। তাঁর পিতামহ চন্দ্রকুমার দত্ত ছিলেন সে যুগের রায়বাহাদুর। চার বছর বয়সে কবির বাবার মৃত্যু হয়। কিছুদিনের মধ্যেই পিতামহেরও মৃত্যু ঘটে। পিতামহের মৃত্যুর পর কবিদের পরিবারে আর্থিক অস্বচ্ছলতা দেখা দেয়। ফলে বেশ অনটনের মধ্যেই কবির শৈশব-কৈশোর কাটে।

ছাত্রজীবন – কবি অজিত দত্ত ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি অনার্স – সহ বিএ পড়তে শুরু করেন। কিন্তু দাদার মৃত্যু হলে পড়া অসম্পূর্ণ রেখে তাঁকে ঢাকা চলে যেতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে ভরতি হন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত এবং বাংলায় অনার্স – সহ তিনি বিএ পাস করেন এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে এমএ পাস করেন।

কর্মজীবন – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী অধ্যাপকরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুদিন পরে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং প্রথমে রিপন স্কুলে, পরে রিপন কলেজে (বর্তমান নাম সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) শিক্ষকতা করেন। এর মাঝে কিছুদিন সাপ্তাহিক নায়ক পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তারপর আবার রিপন কলেজে বাংলার অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি চার বছর অধ্যাপনা করেন। এরপর প্রায় দশ বছর টি-বোর্ডের প্রচার অধিকর্তার কাজ করেন। কিছুদিন তিনি প্রকাশনা ব্যাবসার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি নানা সময়ে অল্পদিনের জন্য নানারকম জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে তিনি আবার অধ্যাপনার কাজে ফেরেন। চন্দননগর, বারাসাত ও প্রেসিডেন্সি কলেজে বেশ কিছুদিন পড়ান তিনি। সবশেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করে সেখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন।

সাহিত্যজীবন – কবি অজিত দত্তের সতীর্থ – বন্ধু ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। এই দুই তরুণ যৌথভাবে প্রগতি নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ঢাকা থেকে এটি প্রকাশিত হত। অজিত ছিলেন কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠীর কবি। তিরিশের দশকের অন্যতম জনপ্রিয় এই বাংলা সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন কবি। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার সঙ্গে প্রথম থেকেই অজিত দত্ত যুক্ত ছিলেন। অজিত দত্ত ছিলেন আদ্যোপান্ত কবি। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা হল আট। তিনি কুসুমের মাস-এর কবি রূপেই বিখ্যাত। এটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশকাল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ। এরপর একে – একে প্রকাশিত হয় — পাতালকন্যা (১৯৩৮), নষ্ট চাঁদ (১৯৪৫), পুনর্নবা (১৯৪৬), ছড়ার বই (১৯৫০), ছায়ার আলপনা (১৯৫১), জানালা (১৯৫৯) এবং শেষ কাব্যগ্রন্থ শাদা মেঘ কালো পাহাড় (১৯৭০)। এ ছাড়া তাঁর কবিতাবলির সংকলন অজিত দত্তের কবিতা-সংগ্রহ এবং অজিত দত্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা বই দুটিও উল্লেখযোগ্য। রৈবতক ছদ্মনামে তিনি যেসব লঘু প্রবন্ধ লেখেন সেগুলি জনান্তিকে (১৯৪৯) ও মন পবনের নাও (১৯৫১) বইয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যে হাস্যরস তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। অজিত দত্ত প্রচুর সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা লিখে গেছেন। সনেট রচনায় তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল। জীবনাবসান – ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর কলকাতায় কবি অজিত দত্তের জীবনাবসান ঘটে।

উৎস

নোঙর কবিতাটি কবি অজিত দত্তের শাদা মেঘ কালো পাহাড় নামক কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থটি কবির সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ। অজিত দত্তের শ্রেষ্ঠ কবিতাগ্রন্থেও নোঙর কবিতাটি স্থান পেয়েছে।

রচনাপ্রসঙ্গ

কবি অজিত দত্তের লেখা নোঙর কবিতাটি তাঁর শাদা মেঘ কালো পাহাড় (১৯৭০) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটি অজিত দত্তের শ্রেষ্ঠ। কবিতা – তেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবি সেই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছেন —

আমার প্রথম কবিতার বই যখন প্রকাশিত হয়েছিল, তখনো আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার হইনি। তারপর আরো কয়েকখানি কবিতার বই বেরিয়েছে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভালো – লাগা, মন্দলাগা, পছন্দ – অপছন্দেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। নানা বয়সে নানা বিষয়ে লেখা কবিতাগুলি থেকে বেছে এ বইতে যা দেওয়া হলো, সেগুলি আমার এখনকার বিচারে, কোনো-না-কোনো দিক থেকে আমার প্রতিনিধি- স্থানীয় কবিতা বলে গণ্য করা চলে। এ বিষয়ে পাঠকদের সঙ্গে সবক্ষেত্রে আমার মতের মিল হবে এমন আশা করি না। তবু, আমার বিশ্বাস, এ – বই থেকে পাঠকেরা আমার কবিতা সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা পাবেন। তা হলেই এ বইয়ের উদ্দেশ্য সফল হবে।

সারসংক্ষেপ

নোঙর কবিতায় কবি অজিত দত্তের রোমান্টিক মন দূর সাতসমুদ্রে পাড়ি দিতে চায়। কিন্তু বাস্তবজীবনের তীরের ধারে নোঙর পড়ে গেছে অর্থাৎ কবিমন বাঁধা পড়ে আছে জীবনের দায়দায়িত্ব ও মায়ার বন্ধনে। সুদূরের হাতছানি কবিকে চঞ্চল করে তোলে। সারারাত তিনি দাঁড় টেনে নোঙরের বাঁধন ছিঁড়ে জীবনতরীকে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। নানা স্বপ্ন-কল্পনা-ইচ্ছে জোয়ারের ঢেউয়ের মতো কবির মনের দরজায় মাথা ঠুকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। তারপর আসে ভাটার শোষণ কবি নিরুৎসাহ, নিশ্চেষ্ট, হতাশ হয়ে পড়েন। জোয়ারভাটায় বাঁধা, উত্থানপতনময় এই জগৎসংসারে কবির বাণিজ্যতরি অর্থাৎ জীবন বাঁধা পড়ে আছে। কবি যতই চেষ্টা করুন সংসারের বাঁধন ছেড়ার যতই স্বপ্ন দেখুন বাঁধনমুক্ত জীবনের, গৃহী কবির জীবন বন্ধনময় হয়েই থেকে যায়। সময়ের স্রোত তাঁকে বিদ্রুপ করে। তবু কবির স্বপ্ন দেখা থামে না। স্থির গণ্ডিবদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং সেই আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকার বেদনা নোঙর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে।

নামকরণ

শিরোনামে কবিতার মূলভাব বা ব্যঞ্জনার আভাস পাওয়া যায়। অজিত দত্তের নোঙর কবিতাটির নামকরণও সেই দিক দিয়ে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
কবি নৌকা নিয়ে সুদূর সমুদ্রে পাড়ি দিতে চান, কিন্তু কখন যেন তাঁর নৌকার নোঙর পড়ে গেছে কূলের ধার —

পাড়ি দিতে দূর সিন্ধুপারে
নোঙর গিয়েছে পড়ে তটের কিনারে।

তাই মাস্তুলে পাল বেঁধে দাঁড় টানলেও নৌকা এগোয় না। মানুষের জীবনও নৌকার মতো — সৃষ্টিশীল মন সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে চলে যেতে চান বাস্তব থেকে অনেক দূরের জগতে। কিন্তু সম্পর্কের, কর্মের, দায়িত্ব – কর্তব্যবোধের নোঙরে তা বাঁধা পড়ে থাকে। কবির সৃষ্টিশীল মনেও এমন সংঘাত চলে আজীবন। তাঁর কবিসত্তা দৈনন্দিন জীবনযাপনের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিতে চায় না। তা সীমা থেকে বেরোনোর জন্য ছটফট করে। ফারসি শব্দ লঙ্গর থেকে আসা নোঙর শব্দটির অর্থ নৌকা বেঁধে রাখার ভারী বস্তুবিশেষ। আলোচ্য কবিতাতেও নোঙর হয়ে উঠেছে জীবনের বন্ধনের প্রতিশব্দ। তাই শিরোনামটি অত্যন্ত ব্যঞ্জনাধর্মী এবং যথাযথ।

অজিত দত্তের নোঙর কবিতাটি একটি রূপকধর্মী কবিতা। এই কবিতায় কবি নোঙরকে জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কবি মনে করেন, জীবনে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।

কবি নোঙরের মাধ্যমে এই বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করেছেন। নোঙর যেমন জাহাজকে এক জায়গায় ধরে রাখে, তেমনি জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আমাদের জীবনকে এক জায়গায় ধরে রাখে এবং আমাদেরকে জীবনের সমুদ্রে ভাসতে দেয় না।

JOIN US ON WHATSAPP

JOIN US ON TELEGRAM

Please Share This Article

About The Author

Related Posts

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Tom Loses a Tooth

Class 9 – English Reference – Tom Loses a Tooth – Question and Answer

The North Ship

Class 9 – English Reference – The North Ship – Question and Answer

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

Trending Now

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Class 9 – English Reference – Tom Loses a Tooth – Question and Answer

Class 9 – English Reference – The North Ship – Question and Answer

Class 9 – English – His First Flight – Question and Answer

Class 9 – English – A Shipwrecked Sailor – Question and Answer