নবম শ্রেণী ইতিহাস – উনবিংশ শতকের ইউরোপ: রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংঘাত – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন উত্তর

Diptesh Khamaru

আজকে আমরা এই আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায় উনবিংশ শতকের ইউরোপ: রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংঘাত অধ্যায়ের প্রশ্ন কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

Table of Contents

রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংঘাত – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

জাতি (Nation) ও রাষ্ট্রের (State) মধ্যে সম্পর্ক কী? এদের মধ্যে কী ধরনের পার্থক্য লক্ষ করা যায়?

জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক

আধুনিক যুগে অনেকে জাতি ও রাষ্ট্র এই দুটি শব্দকে পরস্পরের পরিপূরক বলে মনে করেন। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেছেন যে, রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাসকারী অথবা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য সক্রিয় জনসমাজকে জাতি বলা হয়। অর্থাৎ জাতি হলো এমন একটি জনসমাজ যারা নিজেরা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি রাষ্ট্র গঠন করেছে বা গঠনের জন্য সক্রিয় আন্দোলনে যুক্ত। অপরদিকে রাষ্ট্র হলো একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারের অধীনে বসবাসকারী জনসমষ্টি। আসলে একটি রাষ্ট্র গঠনের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হলো জাতীয়তাবাদ এবং এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী জনসমষ্টি হলো জাতি।

রাষ্ট্রের ও জাতির মধ্যে পার্থক্য

রাষ্ট্রজাতি
রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকে।জাতির ক্ষেত্রে ভূখণ্ড অপরিহার্য নয়।
রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হলো তার সার্বভৌম ক্ষমতা।জাতির এরকম কোনো ক্ষমতা নেই।
রাষ্ট্রের গঠন ও কাজ আইনের নির্দেশ অনুসারে হয়।জাতি গঠনে আইন নয়, ঐক্য ও মানসিক অনুভূতি হলো প্রধান উপাদান।
রাষ্ট্র হলো মূলত একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।অন্যদিকে জাতীয় জনসমাজ হলো এক সাংস্কৃতিক সত্তা।

জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝায়? এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লেখো।

জাতীয়তাবাদ

কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে বসবাসকারী জনসমষ্টির মধ্যে ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি কোনো একটি কারণে গভীর একাত্মবোধের জন্ম হলে এবং এই জনগণের প্রতিটি অংশ যখন নিজেদের একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী বলে মনে করে, তখন সেই গণ-অনুভূতিকেই জাতীয়তাবাদ বলা হয়। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ হল একটি রাজনৈতিক আদর্শ, আর তার ধারক হল রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃত একটি জাতি।

জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য

  1. ভাবগত ধারণা – একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা তথা জনগণের একই ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও স্বদেশপ্রেম জনগণের মধ্যে এক গভীর ঐক্যবোধ গড়ে তোলে।
  2. পুঁজিবাদের উত্থান – জাতীয়তাবাদ ইউরোপে মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সূচনার পথ প্রশস্ত করে।
  3. জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববোধ – জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রত্যেক জাতি তার জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব প্রচার করেছে, যা অহংবোধের সঙ্গে জাতিবৈরিতাও সৃষ্টি করেছে। যেমন — জার্মানরা টিউটনিক জাতি, রুশরা স্লাভ জাতি এবং ইংরেজরা অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেছিল।
  4. স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা – জাতীয়তাবাদী আদর্শ এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করলে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে স্বদেশি শক্তির উত্থান ঘটে।
  5. ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসার – জাতীয়তাবাদ ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সূচনা হয়।

তাই বলা যায়, আধুনিক জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণভাবে পরিপুষ্ট হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে। এই বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শে ইউরোপের জনজীবন দীর্ঘ শোষণ, বঞ্চনা, স্বৈরাচার ও নিপীড়নের অন্ধকার থেকে মুক্তির আশায় জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগ্রামী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত জনসমাজ, জাতীয় জনসমাজ ও জাতি বলতে কী বোঝায়?

জাতীয়তাবাদ এমন একটি ধারণা যা যুগ যুগ ধরে মানুষের রাজনৈতিক চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে আসছে। জাতীয়তাবাদ কথাটির সঙ্গে যেসব ধারণা সম্পর্কযুক্ত সেগুলি হল—জনসমাজ, জাতীয় জনসমাজ এবং জাতি।

জনসমাজ: নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী একটি জনসমষ্টি যাদের মধ্যে উদ্ভব, ধর্ম, ভাষা, আচার-আচরণ, ঐতিহ্য এবং অভিযোগ ও অধিকার প্রভৃতি ব্যাপারে যখন ঐক্য লক্ষ করা যায়, তখন তাকে জনসমাজ বলা হয়।

জাতীয় জনসমাজ: নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী এমন একটি জনসমষ্টি যাদের মধ্যে উদ্ভব, ধর্ম, ভাষা, আচার-আচরণ, ঐতিহ্য প্রভৃতি ব্যাপারে ঐক্যের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ লক্ষ করা যায়, তখন তাকে জাতীয় জনসমাজ বলা হয়।

জনসমাজ = ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি – রাজনৈতিক চেতনা

জাতীয় জনসমাজ = ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি + রাজনৈতিক চেতনা।

অন্যভাবে বলা যায়, যখন কোনো জনসমাজের মধ্যে ঐক্যবোধ এবং রাষ্ট্রগঠনের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তখন তাকে জাতীয় জনসমাজ বলা হয়।

জাতি: যখন কোনো জাতীয় জনসমাজ নিজেদের রাষ্ট্র গঠন করে বা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সচেষ্ট হয়, তখন তাকে জাতি বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইস বলেছেন যে, যখন কোনো জনসমাজ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত এবং বিদেশি শাসন থেকে সর্বপ্রকারে মুক্ত অথবা মুক্তিলাভের জন্য সচেষ্ট হয়, তখন সেই ধরনের জনসমাজকে জাতি বলা হয়।

জাতি = জাতীয় জনসমাজ + জাতীয়তাবোধ/রাষ্ট্র।

ভিয়েনা সম্মেলন (Congress of Vienna, 1815 খ্রি.) – টীকা লেখো

নেপোলিয়নের পতনের পর 1815 খ্রিস্টাব্দে বিক্ষিপ্ত ইউরোপের পুনর্গঠনের জন্য ইউরোপের রাষ্ট্রনেতাগণ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে সমবেত হয়েছিলেন। এটি ইতিহাসে ভিয়েনা সম্মেলন (1815 খ্রি.) নামে খ্যাত।

সম্মেলনের প্রধান নেতৃবৃন্দ

ভিয়েনা সম্মেলনে ইউরোপের সমস্ত রাষ্ট্রের প্রতিনিধি (পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া) অংশগ্রহণ করলেও অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, রাশিয়া ও ইংল্যান্ড – এই চারটি রাষ্ট্র প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। চার প্রধান (Big Four) নামে পরিচিত এই চারটি দেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর মেটারনিখ, প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডরিক উইলিয়াম তৃতীয়, রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার এবং ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রী লর্ড ক্যাসলরে।

উদ্দেশ্য

ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল – 1. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব স্থাপন করা। 2. ইউরোপে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তবে এই সম্মেলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করা ও ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনা।

সম্মেলনে গৃহীত নীতি

দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর এই সম্মেলনে তিনটি নীতি গৃহীত হয়েছিল — 1. ন্যায্য অধিকার নীতি, 2. ক্ষতিপূরণ নীতি ও 3. শক্তিসাম্য নীতি।

পরবর্তী প্রায় 40 বছর ইউরোপে শান্তি বজায় রাখতে ভিয়েনা সম্মেলন সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছিল। এই সম্মেলনে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি নেপোলিয়নকে পরাজিত করার পর ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল — যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

ভিয়েনা সম্মেলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য কী ছিল?

ভিয়েনা সম্মেলনের আদর্শ

ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পতনের পর ইউরোপের পুনর্গঠনের জন্য বিজয়ী মিত্রশক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে এক সম্মেলন আহ্বান করেন। নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপের সব শক্তিশালী দেশ এতে যোগ দেয়। ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারাকে নস্যাৎ করে বিপ্লবের পূর্ববর্তী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের প্রবণতা ভিয়েনা বৈঠকে প্রবল হয়।

সম্মেলনের উদ্দেশ্য

এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল –

  1. ইউরোপের সমাজব্যবস্থার পুনর্গঠন ও পুনর্বণ্টন।
  2. ইউরোপের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন।
  3. ইউরোপে নিরবচ্ছিন্ন ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা।

তবে সম্মেলনের নেতৃবৃন্দের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত উদারনৈতিক ভাবধারা দমন করে ইউরোপে পুরাতনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রক্ষণশীলতার পরিবেশ বজায় রাখা।

ভিয়েনা সম্মেলনের মূল নীতিগুলি কী কী?

ভিয়েনা সম্মেলনের নীতি – নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির পুনর্গঠন, সীমানার পুনর্বিন্যাস এবং শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে 1815 খ্রিস্টাব্দের 20 নভেম্বর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়, যা ভিয়েনা সম্মেলন নামে খ্যাত।

এই সম্মেলনে তিনটি মূল নীতি গৃহীত হয়েছিল। এগুলি হল – 1. ন্যায্য অধিকার নীতি, 2. ক্ষতিপূরণ নীতি এবং 3. শক্তিসাম্য নীতি।

ন্যায্য অধিকার নীতি (Principle of Legitimacy)

এই নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ফরাসি বিপ্লবের পূর্বেকার স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। এই নীতি অনুসারে ফ্রান্সে বুরবোঁ (Bourbon) রাজবংশ, হল্যান্ডে অরেঞ্জ (Orange) রাজবংশ প্রভৃতি পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল।

ক্ষতিপূরণ নীতি (Principle of Compensation)

ক্ষতিপূরণ নীতি অনুসারে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলিকে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের অংশ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই নীতি অনুসারে ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, সুইডেন প্রভৃতি রাষ্ট্র লাভবান হয়েছিল।

শক্তিসাম্য নীতি (Principle of Balance of Power)

এই নীতিটি শক্তির ক্ষেত্রে সমতা আনার জন্য রচিত হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের সামরিক শক্তি ভেঙে তাকে দুর্বল করে দেওয়া, যাতে ফ্রান্স ভবিষ্যতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে। ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত এই তিনটি নীতিকে বাস্তবায়িত করার মধ্য দিয়ে প্রাক্-ফরাসি বিপ্লব অবস্থাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল।

ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ন্যায্য অধিকার নীতি (Principle of Legitimacy) কোন কোন দেশে প্রযুক্ত হয়েছিল? এই নীতি কি সবক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযুক্ত হয়েছিল?

নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে এক সম্মেলনে (1814-15 খ্রি.) সমবেত হন। এই সম্মেলনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর তিনটি নীতি গৃহীত হয় – 1. ন্যায্য অধিকার নীতি, 2. শক্তিসাম্য নীতি ও 3. ক্ষতিপূরণ নীতি। এর মধ্যে ন্যায্য অধিকার নীতি বিভিন্ন দেশে প্রযুক্ত হলেও সব দেশকে তা সমানভাবে প্রভাবিত করেনি।

ন্যায্য অধিকার নীতির প্রয়োগ

ভিয়েনা সম্মেলনে বলা হয় যে, ফরাসি বিপ্লবের আগে যে রাজা বা রাজবংশ যেখানে রাজত্ব করতেন, সেখানে তাঁর বা ওই রাজবংশের রাজত্ব করার অধিকার আছে। ভিয়েনা সম্মেলনের এই নীতি ন্যায্য অধিকার নীতি নামে পরিচিত। এই নীতি অনুসারে —

  • ফ্রান্সে বুরবোঁ বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বুরবোঁ বংশীয় শাসক অষ্টাদশ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন।
  • স্পেন, সিসিলি, নেপলসে বুরবোঁ বংশীয় শাসকেরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। সিসিলি ও নেপলসে ফার্দিনান্দের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • অস্ট্রিয়ায় হ্যাপসবার্গ বংশকে তাঁদের আগের রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অস্ট্রিয়া উত্তর ইতালির আধিপত্য ফিরে পায়।
  • মহামান্য পোপ মধ্য ইতালিতে তাঁর রাজ্য ফিরে পান।
  • হল্যান্ডে অরেঞ্জ বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • স্যাভয়, জেনোয়া, পিডমন্ট ও সার্ডিনিয়ায় স্যাভয় বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ভিক্টর ইমান্যুয়েল শাসক পদে প্রতিষ্ঠিত হন। ইতালি আবার ‘ভৌগোলিক সংজ্ঞায়’ পরিণত হয়।

ন্যায্য অধিকার নীতি প্রয়োগে বৈষম্য

তবে ন্যায্য অধিকার নীতি সবক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হয়নি।

  • ভেনিস ও জেনোয়ায় প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়নি।
  • জার্মান রাজ্যগুলিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি। নবগঠিত 39টি জার্মান রাজ্য নিয়ে একটি ‘বুন্ড’ (Bund) বা সমবায় গঠন করা হয়। এর উপর অস্ট্রিয়ার সভাপতিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে এবং নরওয়েকে ডেনমার্কের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সুইডেনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

ন্যায্য অধিকারের কথা বলা হলেও আসলে ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ তাদের স্বার্থেই এই নীতিকে ব্যবহার করেছিলেন।

ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ক্ষতিপূরণ নীতি (Principle of Compensation) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে এক সম্মেলনে সমবেত হন (1814-15 খ্রি.)। এই সম্মেলনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর যে তিনটি মূল নীতি গৃহীত হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ক্ষতিপূরণ নীতি।

ক্ষতিপূরণ নীতি

ক্ষতিপূরণ নীতি (Principle of Compensation) – নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভিয়েনা সম্মেলনে তারা নিজেদের ক্ষতিপূরণ করে নেওয়ার জন্য যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ক্ষতিপূরণ নীতি নামে পরিচিত। যেসব দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেগুলি হল — ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, সুইডেন প্রভৃতি। ক্ষতিপূরণ নীতি অনুসারে এই দেশগুলি যেভাবে উপকৃত হয়, তা নিম্নরূপ —

  • অস্ট্রিয়া – অস্ট্রিয়া উত্তর ইতালিতে পায় লম্বার্ডি, ভেনেসিয়া, টাইরল প্রভৃতি প্রদেশ। মধ্য ইতালিতে পার্মা, মডেনা ও টাসকানির উপর অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অস্ট্রিয়া নবগঠিত জার্মান কনফেডারেশনের সভাপতির পদ লাভ করে।
  • রাশিয়া – রাশিয়া পায় পোল্যান্ডের বৃহদাংশ, ফিনল্যান্ড ও তুরস্কের বেসারাভিয়া।
  • প্রাশিয়া – প্রাশিয়া পায় স্যাক্সনির উত্তরাংশ, পোজেন, থর্ন, ডানজিগ, পশ্চিম পোমেরানিয়া ও রাইন নদীর বাম তীরবর্তী অঞ্চল।
  • ইংল্যান্ড – ইংল্যান্ড ঔপনিবেশিক স্বার্থে ক্ষতিপূরণ হিসেবে নেয় ভূমধ্যসাগরের মাল্টা দ্বীপ, মরিশাস, হেলিগোল্যান্ড, সিংহল প্রভৃতি।

ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত শক্তিসাম্য নীতি (Principle of Balance of Power) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে সম্মেলনে সমবেত হন (1814-15 খ্রি.)। এই সম্মেলনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর যে তিনটি নীতি গৃহীত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল শক্তিসাম্য নীতি।

শক্তিসাম্য নীতি

ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত শক্তিসাম্য নীতি বলতে বোঝায় ফ্রান্সের শক্তি খর্ব করে সমতা তৈরি করা, ফ্রান্স যাতে শক্তিশালী হয়ে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। এই নীতি অনুসারে —

  • ফ্রান্সকে বিপ্লব পূর্ববর্তী সীমানায় ফিরিয়ে আনা হয়।
  • ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। 5 বছরের জন্য ফ্রান্সে মিত্রপক্ষের সেনা মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
  • মিত্রপক্ষের এই সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার ফ্রান্সকে বহন করতে হয়।
  • মিত্রপক্ষকে 70 কোটি ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ দিতে ফ্রান্সকে বাধ্য করা হয়।
  • ফ্রান্সের চারপাশে শক্তিশালী রাষ্ট্রবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়।
  • ফ্রান্সের পূর্বসীমান্তে রাইন অঞ্চলকে প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
  • ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বে লুক্সেমবুর্গ ও বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
  • ফ্রান্সের দক্ষিণে স্যাভয় ও জেনোয়াকে সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
  • ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে কয়েকটি অঞ্চল যুক্ত করা হয়। সুইজারল্যান্ডকে ‘নিরপেক্ষ দেশ’ বলে ঘোষণা করা হয়।

ভিয়েনা সম্মেলনের সাফল্য সম্বন্ধে কী জানা যায়?

নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে যে সম্মেলনে সমবেত হয় (1814-15 খ্রি.) তা ইতিহাসে ভিয়েনা সম্মেলন বা ভিয়েনা কংগ্রেস নামে পরিচিত। ইউরোপের ইতিহাসে এই সম্মেলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

ইউরোপের পুনর্গঠন

ফরাসি বিপ্লব (1789 খ্রি.) এবং নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যবিস্তার নীতির ফলে ইউরোপের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, ভিয়েনা সম্মেলন ন্যায্য অধিকার নীতি ও ক্ষতিপূরণ নীতির মাধ্যমে ইউরোপের পুনর্গঠন করে সেই সমস্যার আপাত সমাধান করেছিল।

ইউরোপে শান্তিস্থাপন

ভিয়েনা সম্মেলনের নীতিগুলি বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে ইউরোপে বেশ কয়েক দশক শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল এবং ভয়াবহ ধ্বংসলীলা থেকে ইউরোপ রক্ষা পেয়েছিল।

উদারতা প্রদর্শন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে স্বাক্ষরিত ভার্সাই সন্ধিতে (1919 খ্রি.) জার্মানির প্রতি মিত্রপক্ষ যে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল, ভিয়েনা কংগ্রেসে বিজয়ী পক্ষ ফ্রান্সের প্রতি সেই কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করেনি। তাই বলা যায়, ভার্সাই সন্ধির তুলনায় এই ব্যবস্থা ছিল উদার।

আন্তর্জাতিকতাবাদের ভিত্তিস্থাপন

ভিয়েনা সম্মেলন ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন। যে-কোনো বৃহৎ সমস্যার সমাধানের জন্য সমস্ত রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গের মিলিত সিদ্ধান্তই যে শ্রেষ্ঠ উপায় তা এই সম্মেলন থেকেই বোঝা যায়। ভিয়েনা সম্মেলনের এই সিদ্ধান্তই পরবর্তীকালে জাতিপুঞ্জ (League of Nations) এবং রাষ্ট্রসংঘের (UNO) ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

পরিশেষে

বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell)-কে অনুসরণ করে বলা যায়, ভিয়েনা চুক্তির শর্তাবলি ভার্সাই চুক্তির থেকে বেশি কার্যকর হয়েছিল। 1815 থেকে 1848 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপে যে শান্তি বজায় ছিল তা মূলত ভিয়েনা সম্মেলনের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। তাই নানা ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও একথা বললে অনুচিত হবে না যে, ভিয়েনা ব্যবস্থা ছিল যুক্তিসংগত ও রাষ্ট্রপুঞ্জসুলভ ব্যবস্থা।

ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান ত্রুটিগুলি কী কী?

ভিয়েনা সম্মেলনের ত্রুটিসমূহ

নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির পুনর্গঠন, সীমানার পুনর্বিন্যাস এবং শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে 1815 খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে তিনটি নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে এই নীতিগুলির কার্যকারিতার বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনাগুলি হল —

জাতীয়তাবাদের অবমাননা

ভিয়েনা সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ন্যায্য অধিকার ও ক্ষতিপূরণ নীতি প্রয়োগ করে ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত জাতীয়তাবাদের চরম অবমাননা করেছিলেন। যেমন জার্মানি বা ইটালির রাজ্যগুলিকে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত না করে অস্ট্রিয়া বা প্রাশিয়ার অধীনে রেখে জাতীয়তাবাদের অবমাননা করা হয়েছিল।

ন্যায্য অধিকার নীতির অবমাননা

ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ন্যায্য অধিকার নীতিকেও সর্বদা মান্য করা হয়নি। যেমন — এই নীতি অনুযায়ী ভেনিস প্রজাতান্ত্রিক শাসনের দাবি জানালে তার দাবিকে অবমাননা করা হয়েছিল।

অযৌক্তিক ব্যবস্থা

ভিয়েনা সম্মেলনে পোল্যান্ডবাসীর আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে পোল্যান্ডকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়। আবার জাতি, ধর্ম ইত্যাদি উপেক্ষা করে বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের অধীনে আনা হয়। এই দুই ব্যবস্থাই ছিল অযৌক্তিক।

গণতন্ত্রের অবমাননা

ভিয়েনা সম্মেলনে গণতন্ত্রের অবমাননা করা হয়েছিল। এখানে নেপোলিয়নের উদারতান্ত্রিক সংবিধানকে অস্বীকার করে ইউরোপের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাকে স্বীকার করা হয়েছিল।

উপরোক্ত ত্রুটি সত্ত্বেও বলা যায়, ভিয়েনা সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলি একেবারে অর্থহীন ছিল না। কারণ এর ফলে একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপে বেশ কয়েক বছরের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; আবার অন্যদিকে তেমনি আন্তর্জাতিকতাবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

পবিত্র চুক্তি (Holy Alliance) – টীকা লেখো।

রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের খ্রিস্টীয় রাজধর্ম পালনের আহ্বান জানিয়ে 1815 খ্রিস্টাব্দের 26 সেপ্টেম্বর একটি চুক্তিপত্র ঘোষণা করেন।

পটভূমি

রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার ছিলেন একজন আদর্শবাদী ও ধর্মভীরু শাসক। তিনি মনে করতেন, ফরাসি বিপ্লব খ্রিস্টধর্ম বিরোধী। ফ্রান্স তথা ইউরোপের রাজারা খ্রিস্টধর্ম অনুসারে রাজ্যশাসন না করার জন্যই ইউরোপে বিদ্রোহ ও অশান্তি শুরু হয়েছে। ইউরোপে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে পবিত্রভাবে রাজ্যশাসন করা উচিত।

পৰিত্ৰ চুক্তি (Holy Alliance) সম্পর্কে টীকা লেখো।

রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার ভন ক্রুডেনার (Von Krüdener) নামে এক জার্মান সন্ন্যাসিনীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, তাঁর চিন্তাধারা অনুসারে জার পবিত্র চুক্তির খসড়াপত্র রচনা করেছিলেন।

শর্তাবলি

পবিত্র চুক্তির শর্ত ছিল –

  1. ইউরোপের রাজারা পরস্পরকে ভাই বলে মনে করবেন।
  2. রাজা হবেন পরিবারের পিতার মতো। তিনি প্রজাদের সন্তানের মতো মনে করবেন।
  3. রাজারা ‘ন্যায়-প্রেম ও শান্তি’ অবলম্বন করে রাজ্যশাসন করবেন।
  4. চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাজারা পরস্পরকে ভাই বলে মনে করবেন এবং উপরোক্ত আদর্শ মেনে রাজ্যশাসন করবেন।

স্বাক্ষরকারী

পোপ, তুরস্কের সুলতান এবং ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের সব দেশের রাজারা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়া হল এই চুক্তিতে প্রথমদিকে স্বাক্ষরকারী দেশ।

পবিত্র চুক্তি ব্যর্থ হয়েছিল কেন?

পবিত্র চুক্তি

রুশ জার প্রথম আলেকজান্ডার 1815 খ্রিস্টাব্দের 26 সেপ্টেম্বর পবিত্র চুক্তি ঘোষণা করেছিলেন। ইউরোপের সমস্ত রাজন্যবর্গকে তিনি ওই চুক্তি মেনে চলার জন্য আহ্বান জানান।

চুক্তির ব্যর্থতা

পবিত্র চুক্তির ব্যর্থতার পিছনে একাধিক কারণ ছিল —

  1. এই চুক্তিতে রাজন্যবর্গকে ব্যক্তিগত সংকীর্ণ স্বার্থ ত্যাগ করে খ্রিস্টীয় আদর্শে রাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে আহ্বান জানানো হয়। জারকে খুশি করার জন্য এতে স্বাক্ষর করলেও এই চুক্তিকে কোনো দেশই তেমন গুরুত্ব দেয়নি।
  2. তৎকালীন ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম শক্তি ইংল্যান্ড এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
  3. ইউরোপীয় রাজনীতিকরা পবিত্র চুক্তিকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখেন।
  4. এই চুক্তি সাধারণ জনগণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়।
  5. ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির যুগে ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী রাজ্যশাসন করার প্রচেষ্টা ছিল হাস্যকর এবং অবাস্তব।
  6. রাশিয়ার জার ছাড়া স্বাক্ষরকারী আর কোনো দেশই এই চুক্তির প্রতি আন্তরিক ছিলেন না।

আর তাই জার প্রথম আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই চুক্তির অবসান ঘটে।

বাস্তবে পবিত্র চুক্তি কার্যকর হয়নি। একমাত্র জার প্রথম আলেকজান্ডার ছাড়া এতে কারও আস্থা ছিল না। শুধুমাত্র জারকে খুশি করার জন্য অনেকে এতে স্বাক্ষর করেছিলেন। মেটারনিখ এই চুক্তিকে অর্থহীন উচ্চনাদ (High Sounding nothing) বলে বিদ্রুপ করেছিলেন।

চতুঃশক্তি চুক্তি (Quadruple Alliance) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

চতুঃশক্তি চুক্তি

1815 খ্রিস্টাব্দের 20 নভেম্বর অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, রাশিয়া ও ইংল্যান্ড এই চার শক্তি এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। একে চতুঃশক্তি চুক্তি (Quadruple Alliance) বলা হয়। চতুঃশক্তি চুক্তির রূপকার ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ। বাস্তবে এই চতুঃশক্তি চুক্তিই হল কনসার্ট অফ ইউরোপ (Concert of Europe)।

উদ্দেশ্য

চতুঃশক্তি চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল —

  1. ফ্রান্সের সিংহাসনে যাতে বোনাপার্ট বংশের কেউ বসতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।
  2. ইউরোপের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা।

শর্ত

চতুঃশক্তি চুক্তির শর্ত ছিল —

  1. ভিয়েনা সম্মেলন ও প্যারিসের সন্ধিতে গৃহীত ব্যবস্থা বজায় রাখা।
  2. ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা ও উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের জন্য নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে বৈঠক করা।

সম্মেলন

চতুঃশক্তি চুক্তির শর্ত অনুসারে আই-লা-শ্যাপেল (1818 খ্রি.), ট্রোপাও (1820 খ্রি.), লাইব্যাক (1821 খ্রি.) ও ভেরোনা (1822 খ্রি.) শহরে সম্মেলনে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ সমবেত হয়। সেন্ট পিটারসবার্গে (1824 খ্রি.) অনুষ্ঠিত পঞ্চম সম্মেলনে ইংল্যান্ড যোগদান করেনি। এরপর চতুঃশক্তি চুক্তি কার্যত ভেঙে যায়।

ব্যর্থতা

শুরু থেকেই চতুঃশক্তি চুক্তি বিভিন্ন কারণে দুর্বল ছিল। বিশেষত ইংল্যান্ডের সঙ্গে অস্ট্রিয়ার মতপার্থক্য ছিল বেশ প্রকট।

কারণ

  1. ইংল্যান্ড ছিল উদারতন্ত্রী এবং অস্ট্রিয়া ছিল রক্ষণশীল।
  2. ইংল্যান্ড ছিল কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার বিরোধী। কিন্তু অস্ট্রিয়া গণ আন্দোলন দমনের জন্য যে-কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের পক্ষপাতী ছিল।

ব্যর্থতা সত্ত্বেও চতুঃশক্তি চুক্তির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তাদের উদ্যোগে ইউরোপে কিছুদিনের জন্য হলেও শান্তি বজায় ছিল।

শক্তি সমবায়ের (Concert of Europe) পতনের কারণ কী?

ইউরোপে শক্তি সমবায়

1815 খ্রিস্টাব্দে মেটারনিখের উদ্যোগে অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যে চতুষ্কোণ শক্তি সমবায় গড়ে ওঠে তাকে শক্তি সমবায় বলা হয়।

শক্তি সমবায়ের পতনের কারণ

নানান কারণে ইউরোপের শক্তি সমবায়ের অস্তিত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। যেমন –

  1. এই সংগঠন গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদবিরোধী বলে জনসমর্থন হারায়।
  2. শক্তি সমবায়ের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন ও কার্যালয় ছিল না, এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল অস্পষ্ট।
  3. সদস্য রাষ্ট্রের পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঐক্যের অভাব শক্তি সমবায়কে দুর্বল করে তোলে।
  4. ইংল্যান্ডের অসহযোগিতা এবং
  5. সর্বোপরি জুলাই ও ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ধাক্কা শক্তি সমবায়কে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।

মেটারনিখ ব্যবস্থা (Metternich System) – টীকা লেখো

প্রিন্স মেটারনিখ ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তিনি নেপোলিয়নের পতনের পর ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকে অস্বীকার করে পুরাতন স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তা ইতিহাসে মেটারনিখ ব্যবস্থা (Metternich System) নামে পরিচিত। 1815 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1848 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইউরোপীয় রাজনীতির ভাগ্যনিয়ন্তা এবং তাঁর ইচ্ছানুসারে ইউরোপীয় রাজনীতি পরিচালিত হত। তাই এই সময়কে ঐতিহাসিক লুই ফিশার মেটারনিখের যুগ বলে অভিহিত করেছেন।

মেটারনিখ ব্যবস্থা

মেটারনিখ ছিলেন প্রতি বিপ্লব বা বিপ্লবের বিরোধিতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর নীতি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিবিরোধী। ন্যায্য অধিকার নীতি প্রয়োগ করে তিনি ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী যুগের রাজনৈতিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।

উদ্দেশ্য

মেটারনিখ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল –

  1. ইউরোপের রাজনীতিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।
  2. ইউরোপে প্রাক্-ফরাসি বিপ্লব যুগের রাজনৈতিক অবস্থাকে ফিরিয়ে আনা।

প্রয়োগ

মেটারনিখ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাঁর এই নীতি সফলভাবে প্রয়োগ করেছিলেন –

  1. নেপোলিয়ন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব রাজাদের সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন, সেই বংশের রাজাদের ওই দেশের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মেটারনিখ।
  2. জার্মানির জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করার জন্য তিনি সেদেশে 1819 খ্রিস্টাব্দে কার্লসবাড ডিক্রি জারি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছিলেন।

তবে মেটারনিখ ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ —

  1. তিনি পুরাতন রাজতন্ত্রকে সমর্থন করে ও প্রগতিশীলতার বিরোধিতা করে যুগবিরোধী কাজ করেছিলেন।
  2. তা ছাড়া শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপে যে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল সেখানে পুরাতন রাজতন্ত্র ছিল সম্পূর্ণ বেমানান। এ ছাড়াও তাঁর অদূরদর্শিতা ও ইংল্যান্ডের বিরোধিতা মেটারনিখ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছিল।

জুলাই অর্ডিন্যান্স (July Ordinance) – টীকা লেখো

ফ্রান্সে 1830 খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে উদারপন্থীরা জয়লাভ করে মন্ত্রী পলিগন্যাকের পদত্যাগের দাবি জানায়। এইরূপ পরিস্থিতিতে রাজা দশম চার্লস 1830 খ্রিস্টাব্দের 25 জুলাই সংবিধানের 14 নং ধারা অনুযায়ী যে চারটি দমনমূলক আইন জারি করেন, তা অর্ডিন্যান্স অফ সেন্ট ক্লাউড (Ordinance of St. Cloud) বা জুলাই অর্ডিন্যান্স নামে পরিচিত।

দমনমূলক আইনবিধি

এই অর্ডিন্যান্স অনুসারে –

  1. নবগঠিত আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়।
  2. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিলোপ করা হয়।
  3. বুর্জোয়া শ্রেণিকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে কেবলমাত্র বিত্তবান অভিজাতদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়।
  4. 1814 খ্রিস্টাব্দে অষ্টাদশ লুই কর্তৃক গৃহীত সনদকে বাতিল করা হয়।

প্রতিক্রিয়া

জুলাই অর্ডিন্যান্স জারি করার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সের সর্বত্র প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়। অ্যাডলফ থিয়ার্স-এর নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ক্রমশ সর্বস্তরের মানুষের যোগদানের ফলে এক বিপ্লবের চেহারা নেয়।

জুলাই বিপ্লব (July Revolution) কবে ও কোথায় হয়েছিল? এই বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ কী?

জুলাই বিপ্লব

ফ্রান্স তথা ইউরোপের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল 1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব। 1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ফরাসি রাজা দশম চার্লসের বিরুদ্ধে উদারপন্থী নেতা থিয়ার্সের নেতৃত্বে ফরাসি জনসাধারণ এই বিদ্রোহ করেছিল।

জুলাই বিপ্লব (July Revolution) কবে ও কোথায় হয়েছিল? এই বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ কী ?

বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ

দশম চার্লসের মন্ত্রীদের অত্যাচারে যখন সমগ্র ফ্রান্সে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয় তখন রাজা দশম চার্লস 1814 খ্রিস্টাব্দের সনদ বাতিল করে দেন এবং 26 জুলাই পলিগন্যাকের মাধ্যমে নিম্নলিখিত চারটি প্রতিক্রিয়াশীল আইন জারি করেন —

  1. প্রতিনিধি সভাকে ভেঙে দেওয়া হয়,
  2. ভোটদাতাদের সংখ্যা হ্রাস করা হয়,
  3. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং
  4. জাতীয় সভাকে নতুন করে নির্বাচনের আদেশ দেওয়া হয়।

এই অর্ডিন্যান্স জারির সঙ্গে সঙ্গে থিয়ার্সের নেতৃত্বে জনসাধারণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত (1830 খ্রিস্টাব্দের 30 জুলাই) দশম চার্লস সিংহাসনচ্যুত হন এবং অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ রাজপদে অধিষ্ঠিত হন।

ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব লেখো।

830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত জুলাই বিপ্লব ফ্রান্সের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব

রাজবংশের পরিবর্তন

জুলাই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের ঐতিহ্যবাহী বুরবোঁ রাজবংশের পতন হয় এবং ওরলিয়ান্স বংশের লুই ফিলিপের নেতৃত্বে নতুন রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। এর ফলে ফ্রান্সের সিংহাসনে রাজবংশের পরিবর্তন হয়।

জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা

জুলাই বিপ্লবের ফলে ফরাসি রাজাদের ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভোটাধিকার বৃদ্ধি

জুলাই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে ভোটাধিকার নীতির পরিবর্তন ঘটে। বাৎসরিক 200 ফ্রাঁ কর প্রদানকারী 25 বছর বয়স্ক সমস্ত পুরুষ নাগরিকের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়।

উচ্চ বুর্জোয়াদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা

জুলাই বিপ্লবের ফলে ধর্মযাজক, অভিজাত প্রমুখের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয় এবং উচ্চ বুর্জোয়াদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন

জুলাই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ শাসনক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাজার পরিবর্তে প্রতিনিধিসভার উপর অর্পিত হয়। শাসনক্ষেত্রে ধর্মযাজক ও ক্যাথলিক ধর্মের প্রাধান্য বিলুপ্ত করা হয়।

অন্যান্য প্রভাব

উপরোক্ত বিষয়গুলি ছাড়াও জুলাই বিপ্লবের ফলে ভিয়েনা কংগ্রেস প্রবর্তিত ন্যায্য অধিকার নীতি অস্বীকৃত হয়। এছাড়া ফ্রান্সের জাতীয় পতাকার পরিবর্তন, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের প্রভাব বেলজিয়ামকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব কেবলমাত্র ফ্রান্সের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না — ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে জাতীয়তাবাদী গণ আন্দোলন দেখা দেয়।

বেলজিয়ামে বিদ্রোহ

ভিয়েনা সম্মেলনে বেলজিয়ামবাসীর জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করা হয়। ফ্রান্সের সীমান্তে হল্যান্ডকে শক্তিশালী করার জন্য বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এর ফলস্বরূপ এখানকার অধিবাসীরা বিদ্রোহ করে।

বিদ্রোহী অস্থায়ী সরকার গঠন

বেলজিয়ানরা তাদের হল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করাকে কখনই মেনে নিতে পারেনি। 1830 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে বেলজিয়ানরা উৎসাহিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। বিদ্রোহী বেলজিয়ানরা ব্রাসেলস শহরে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করে (1830 খ্রিস্টাব্দের 4 অক্টোবর)।

বিভিন্ন দেশের বিরোধিতা ও সমর্থন

বেলজিয়ান বিপ্লবীদের অস্থায়ী সরকার বেলজিয়ামের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। রাশিয়া ও প্রুশিয়া অস্থায়ী সরকারের বিরোধিতা করলেও ইংল্যান্ড বেলজিয়ামের স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিল।

বেলজিয়ামের স্বাধীনতার স্বীকৃতি

1832 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বেলজিয়ামের স্বাধীনতাকে অনেক দেশ স্বীকৃতি জানায়। বেলজিয়ানরা স্যাক্স-কোবার্গ বংশের লিওপোল্ডকে (Leopold) তাদের রাজা নির্বাচন করে। শেষ পর্যন্ত 1839 খ্রিস্টাব্দের 22 জানুয়ারি হল্যান্ড সরকারিভাবে বেলজিয়ামের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়।

গুরুত্ব

বেলজিয়ামের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সাফল্য লাভ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

  1. প্রথমত, বেলজিয়ামের স্বাধীনতা অর্জন ভিয়েনা ব্যবস্থায় গৃহীত ন্যায্য অধিকার ও শক্তি সাম্য নীতির অবাস্তবতা প্রমাণ করে।
  2. দ্বিতীয়ত, বেলজিয়ামের স্বাধীনতা প্রমাণ করেছিল দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ কোনো জাতির জাতীয়তাবাদকে সামরিক শক্তি দিয়ে দমিয়ে রাখা যায় না।
  3. এককথায়, বেলজিয়ামের স্বাধীনতা ভিয়েনা সম্মেলনের অসারতা প্রমাণ করেছিল ও জাতীয়তাবাদের বিজয় ঘোষণা করেছিল।

ইউরোপে জুলাই বিপ্লবের কী প্রভাব পড়েছিল?

ফ্রান্স তথা ইউরোপের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল 1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব। এই বিপ্লবের প্রভাব শুধুমাত্র ফ্রান্সেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এর প্রভাব ইউরোপের অন্যান্য দেশেও পড়েছিল।

বেলজিয়াম

জুলাই বিপ্লবে ফরাসিদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে বেলজিয়ামের অধিবাসীরা হল্যান্ডের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে এবং সাফল্য লাভ করে। বেলজিয়ামবাসীর এই সাফল্যলাভের মধ্য দিয়ে ভিয়েনা সম্মেলনের ন্যায্য অধিকার নীতি লঙ্ঘিত হয়।

পোল্যান্ড

জুলাই বিপ্লবের প্রভাব পোল্যান্ডবাসীকেও উৎসাহিত করেছিল। তারা রাশিয়ার অধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে লিপ্ত হয় এবং রাষ্ট্রশাসনের জন্যে নিজেরা একটি সংবিধানও রচনা করে।

জার্মানি

জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে জার্মানিতে গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। হ্যানোভার, স্যাক্সনি প্রভৃতি রাজ্যে প্রজাদের দাবি মেনে নিয়ে উদারতান্ত্রিক সংবিধান প্রবর্তিত হয়।

ইতালি

জুলাই বিপ্লবের ঢেউ ইতালিবাসীকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। তারা জাতীয়তাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং অস্ট্রিয়ার অধীনতা থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলনে লিপ্ত হয়।

ইংল্যান্ড

জুলাই বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে উদারনৈতিক সংস্কার আরও ব্যাপকভাবে শুরু হয়। এই বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডবাসী চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু করে এবং ইংল্যান্ডে রিফর্ম বিল পাস হয়।

এইভাবে জুলাই বিপ্লবের ঢেউ ফ্রান্সের সীমা অতিক্রম করে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় আন্দোলন গঠনে সহায়তা করেছিল।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (February Revolution) কবে ও কোথায় হয়? এই বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (February Revolution)

ফ্রান্সে 1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অর্লেয়াঁ বংশীয় লুই ফিলিপের বিরুদ্ধে ফরাসি জনগণ বিদ্রোহের সূচনা করেছিল। এই বিদ্রোহ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব নামে খ্যাত।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (February Revolution) কবে ও কোথায় হয়? এই বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল ?

বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ

নানা কারণে ফরাসি জনগণ যখন লুই ফিলিপের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট, তখন 1848 খ্রিস্টাব্দের 22 ফেব্রুয়ারি ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবিতে প্যারিসের ময়দানে এক কেন্দ্রীয় সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী গিজো (Guizot) এই সমাবেশ নিষিদ্ধ করেন। ক্ষুব্ধ জনতা গিজোর বাসভবন আক্রমণ করে। কারারক্ষীর গুলিতে কিছু লোক হতাহত হলে বিক্ষুব্ধ জনতা 23 ফেব্রুয়ারি লুই ফিলিপের পদত্যাগ দাবি করে। উদারপন্থী, সমাজতন্ত্রী এবং প্রজাতন্ত্রীরাও একত্রে এই বিদ্রোহে যোগ দেয়। 24 ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে লুই ফিলিপ সিংহাসন ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন।

ফ্রান্সে 1848 খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত হয়েছিল বলে একে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব বলা হয়। এই বিপ্লবের পর 26 ফেব্রুয়ারি প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীরা যুগ্মভাবে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে।

ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব বা ফলাফল লেখো

ফ্রান্স তথা ইউরোপের যেসব বিপ্লবের জন্য বিশ্বখ্যাত, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 1848 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। ফ্রান্সের ইতিহাসে এই বিপ্লব নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ।

গুরুত্ব

  • ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা: ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে লুই ফিলিপ ও গিজো পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। দ্বিতীয় পর্যায়ে উদারপন্থীরা ফ্রান্সকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। এইভাবে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান এবং প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়।
  • জনসাধারণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা: ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ধনী বুর্জোয়াদের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় জনসাধারণের প্রাধান্য। এর ফলে আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটে।
  • সর্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতি: ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি স্বীকৃত হয় এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতেই আইনসভার সদস্যদের নির্বাচিত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
  • দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা: ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে লুই নেপোলিয়ন তৃতীয় নেপোলিয়ন (Napoleon III) নাম ধারণ করে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট ঘোষণা করেন ও দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
  • দাসপ্রথার উচ্ছেদ: ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক সরকার দাসপ্রথা উচ্ছেদ করে। এর ফলে বহু মানুষ স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের সুযোগ পায়।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কী প্রভাব পড়েছিল?

1848 খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবের অগ্নিশিখা ফ্রান্সের সীমা অতিক্রম করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে প্রভাবিত করেছিল। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে সেই সমস্ত দেশেও পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল।

অস্ট্রিয়া

1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা, হাঙ্গেরি প্রভৃতি স্থানে গণ আন্দোলন শুরু হয়। ভিয়েনায় প্রচণ্ড গণরোষের ফলে মেটারনিখ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর ফলে অস্ট্রিয়াতে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে।

জার্মানি

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে জার্মানির ব্যাভারিয়া, হ্যানোভার, স্যাক্সনি, প্রাশিয়াতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের চাপে জার্মানিতে মেটারনিখের রক্ষণশীল নীতির পরিবর্তন ঘটে এবং সেখানে পার্লামেন্টের শাসন প্রবর্তিত হয়।

হাঙ্গেরি

1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব হাঙ্গেরিকেও প্রভাবিত করে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সূত্র ধরে হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট অঞ্চলের অধিবাসীরা অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে লিপ্ত হয়। আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার সম্রাট হাবসবুর্গদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন।

ইতালি

1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সূত্র ধরে ইতালির বিভিন্ন রাজ্য, যেমন — সিসিলি, নেপলস, রোম, ভেনিস, টাসকানি প্রভৃতি অঞ্চলে গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। আন্দোলনের ফলে ভেনিস ও রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

বোহেমিয়া

সর্বোপরি ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সংগ্রামী চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বোহেমিয়ায় চেক ও স্লাভগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং চেকোস্লোভাকিয়া রাষ্ট্র গঠন করে।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণগুলি কী ছিল?

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (February Revolution) – ইউরোপের ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি অধ্যায়। 1848 খ্রিস্টাব্দের এই বিপ্লব সমগ্র ইউরোপকে প্রভাবিত করেছিল। এর ফলে অবসান হয় রাজতন্ত্রের, প্রতিষ্ঠিত হয় উদারতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। তবে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব যে শেষমেশ ব্যর্থ হয়েছিল, তার জন্য একাধিক কারণ দায়ী ছিল।

ব্যর্থতার কারণ

  • মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিরোধ: মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ছিল ইউরোপের সকল বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি। বিপ্লবের পিছনে তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্বতন স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা বিপ্লবকে দুর্বল করে দেয়।
  • বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিরোধিতা: বিভিন্ন জাতি এবং তাদের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার পরস্পরবিরোধিতা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকে পতনের মুখে ঠেলে দেয়।
  • নেতৃত্বের অভাব: ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবের ফলে শুরু থেকে সাধারণ জনগণই ছিল বিপ্লবের নেতা। ফ্রান্সের লা-মার্টিন ছিলেন দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং অদূরদর্শী।
  • বিপ্লবীদের মধ্যে ঐক্যবোধের অভাব: ফ্রান্স থেকে ইতালি, জার্মানি, হাঙ্গেরি, বোহেমিয়া ইত্যাদি দেশে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ছড়িয়ে পড়লেও সেইসব দেশের বিপ্লবীদের মধ্যে কোনো পারস্পরিক যোগাযোগ এবং ঐক্যবোধ ছিল না।
  • প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব: এইসব কারণ ছাড়াও ইউরোপে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের ফলেও ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

জুলাই বিপ্লব এবং ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যগুলি কী ছিল?

1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব এবং 1848 খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে নানান সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষণীয়।

সাদৃশ্য

  • ফ্রান্স থেকেই দুটি বিপ্লব জন্মলাভ করেছিল এবং
  • দুটি বিপ্লবই ইউরোপকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, যার ফলে ইউরোপে বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয় এবং শাসকবর্গ নিয়মতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।

বৈসাদৃশ্য

  • জুলাই বিপ্লবে শামিল ফরাসি জনগণের উদ্দেশ্য ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তারা রাজতন্ত্রের পরিবর্তে প্রজাতন্ত্র চায়নি। অন্যদিকে, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • জুলাই বিপ্লব ছিল বিত্তবান বুর্জোয়াদের বিপ্লব। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ছিল সাধারণ মানুষের ও বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লব।
  • জুলাই বিপ্লব অপেক্ষা 1848 খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব অনেকাংশে চরমপন্থী ছিল।
  • দুটি বিপ্লবই ব্যর্থ হয়, কিন্তু ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের তুলনায় জুলাই বিপ্লবের ফলাফল অনেক বেশিদিন স্থায়ী হয়েছিল।

ইটালির ঐক্য আন্দোলনের প্রথম পর্ব সম্পর্কে লেখো।

অথবা, কার্বোনারি (Carbonari) বিদ্রোহ সম্পর্কে কী জানো?

ইতালির ঐক্য আন্দোলনের প্রথম পর্ব (1815-32 খ্রি.)

1815 খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা কংগ্রেসে গৃহীত প্রতিক্রিয়াশীল বন্দোবস্ত ইতালিবাসীর পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিল। ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারায় উদ্দীপ্ত ইতালির দেশপ্রেমিকরা তখন বিদেশি শাসনের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবার উদ্দেশ্যে নানা স্থানে গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন। এই সমস্ত গুপ্ত সমিতিগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল কার্বোনারি (Carbonari)।

কার্বোনারিদের লক্ষ্য

কার্বোনারি কথার অর্থ জ্বলন্ত অঙ্গারবাহী। এর প্রধান কেন্দ্র ছিল নেপলস। কার্বোনারি দলের উদ্দেশ্য ছিল ইতালি থেকে বিদেশি শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জন করাও ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য।

বিদ্রোহ

কার্বোনারি এবং অন্যান্য গুপ্ত সমিতির পরিচালনায় নেপলস এবং পিডমন্টে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। 1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তারা সর্বত্র গণবিপ্লবের সূচনা করে। তাদের পরিচালিত এই বিদ্রোহগুলি অস্ট্রিয়া কঠিন হাতে দমন করেছিল। আসলে কার্বোনারিদের কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুনিয়ন্ত্রিত কর্মপন্থা ছিল না। তবে ইতালির ঐক্য আন্দোলনের প্রথম ধাপ হিসেবে কার্বোনারি দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ইতালির ঐক্যে জোসেফ ম্যাৎসিনির (Giuseppe Mazzini) অবদান কী ছিল? 

1815 খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা কংগ্রেসে ন্যায্য অধিকার নীতির ভিত্তিতে ইতালি সম্পর্কে যে ব্যবস্থা গৃহীত হয় তাতে ইতালি একটি ভৌগোলিক সংজ্ঞায় পরিণত হয়। ইতালিকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জোসেফ ম্যাৎসিনি (Giuseppe Mazzini)।

ম্যাৎসিনি

ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ম্যাৎসিনি 1805 খ্রিস্টাব্দে ইতালির জেনোয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। ইতালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে সফল করার জন্য তিনি প্রথম জীবনে কার্বোনারি নামক গুপ্ত সমিতিতে যোগদান করেন। কিন্তু কার্বোনারির হঠকারিতা ও অবাস্তব ভাবাবেগ তাঁর মনঃপুত হয়নি। তিনি উপলব্ধি করেন ইতালিকে স্বাধীন করার জন্য প্রয়োজন গণসংযোগ ও দেশবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান।

ইয়ং ইতালি (Young Italy)

নিজের উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থাকে সফল করার জন্য ম্যাৎসিনি 1832 খ্রিস্টাব্দে ইয়ং ইতালি বা নব্য ইতালি নামে একটি যুবসংগঠন তৈরি করেন। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল দেশের যুবসম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের মধ্যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করা এবং ভবিষ্যৎ আন্দোলনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া।

ম্যাৎসিনির প্রচেষ্টা

1848 খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সূত্র ধরে ইতালির লম্বার্ডি, ভেনিস ও পোপের রাজ্য রোমে বিদ্রোহ শুরু হয়। ম্যাৎসিনির উদ্যোগে এই সময় টাসকানি ও রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের দমননীতির ফলে ম্যাৎসিনির সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং তিনি ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন।

ইয়ং ইতালি (Young Italy) – টীকা লেখো

প্রথম জীবনে ইতালির মুক্তির উদ্দেশ্যে ম্যাৎসিনি কার্বোনারি দলে যোগদান করলেও এই দলের ধ্বংসাত্মক ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মপন্থা তাঁর পছন্দ ছিল না। ফলে তিনি 1832 খ্রিস্টাব্দে ইয়ং ইতালি বা নব্য ইতালি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন।

ইয়ং ইতালি

ম্যাৎসিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, দেশের যুবশক্তি এবং জনগণের সমবেত শক্তির মাধ্যমেই বহুবিভক্ত ইতালির জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত যে-কোনো ব্যক্তি এই দলের সদস্য হতে পারতেন।

আদর্শ

কার্বোনারির মতো গুপ্ত সমিতি হলেও ইয়ং ইতালি দল নাশকতামূলক কাজকর্মে বিশ্বাসী ছিল না। দলের আদর্শ ছিল শিক্ষাপ্রচার, আত্মত্যাগ ও জনসাধারণের মনে জাতীয়তাবাদের সঞ্চার করা। তাদের মূল মন্ত্র ছিল ‘ঈশ্বর, জনগণ ও ইতালি।’

জনপ্রিয়তা

খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইতালিতে ইয়ং ইতালি দল বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইতালির বিভিন্ন জায়গায় এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় 60 হাজারের মতো। এ দলের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গ্যারিবল্ডি।

ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ইয়ং ইতালি দলের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূলত ম্যাৎসিনি এবং নব্য ইতালি দলের প্রভাবেই ইতালির ঐক্য আন্দোলন আঞ্চলিক সংকীর্ণতা অতিক্রম করে জাতীয় আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছিল।

ইতালির ঐক্যে কাউন্ট ক্যাভুরের (Count Cavour) অবদান লেখো।

ইতালির ঐক্য আন্দোলনে যে সকল ব্যক্তি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কাউন্ট ক্যামিলো ক্যাভুর। ইতালির ঐক্য আন্দোলনে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল ধারার প্রবর্তক। ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি ম্যাৎসিনির নীতি পরিত্যাগ করে একটি স্বতন্ত্র নীতি গ্রহণ করেন।

ক্যাভুরের নীতি

ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ক্যাভুর বিদেশি শক্তির সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি মনে করতেন, একমাত্র বিদেশি শক্তির সাহায্যেই ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হবে। ইতালির এই ঐক্য সংগ্রামে পিডমন্ট রাজ্যের নেতৃত্বকে বাস্তব ও সঠিক পন্থা বলে মনে করতেন তিনি। এজন্য তিনি পিডমন্টকে জাতীয় আন্দোলনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন। এরপর তিনি ইউরোপীয় দেশগুলির সহানুভূতি লাভের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষে যোগদান করেন। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে তিনি ঐক্য আন্দোলনে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি লাভে সক্ষম হন।

প্লোমবিয়ার্সের চুক্তি (Plombieres Agreement)

ইতালি থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে ক্যাভুর ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সঙ্গে প্রোমবিয়ার্সের চুক্তি স্বাক্ষর করেন (1858 খ্রি.)। এর দ্বারা স্থির হয় অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফ্রান্স পিডমন্টকে সামরিক সাহায্য দেবে এবং বিনিময়ে স্যাভয় ও নিস পাবে। তৃতীয় নেপোলিয়নের সাহায্যেই তিনি অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে মধ্য ইতালিকে সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হন।

এইভাবে ক্যাভুরের প্রচেষ্টায় মধ্য ইতালির ঐক্য সফল হয়েছিল। উত্তর ও দক্ষিণ ইতালির সংযুক্তির ক্ষেত্রেও ক্যাভুরের অবদান ছিল। তাঁর নির্দেশে গ্যারিবল্ডি (Garibaldi) রাজা ইমান্যুয়েলের আনুগত্য স্বীকার করলে উত্তর ও দক্ষিণ ইতালির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়। এই কারণে ক্যাভুরকে ইতালির ঐক্য আন্দোলনের মস্তিষ্ক বলা হয়।

ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার পন্থা হিসেবে ম্যাৎসিনি ও ক্যাভুরের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য কোথায়?

ম্যাৎসিনি

ইতালির মুক্তি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন ম্যাৎসিনি। তাঁর আদর্শ, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ ইতালিবাসীকে স্বদেশচেতনায় উদ্দীপ্ত করে।

ক্যাভুর

পিডমন্ট সার্ডিনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কাউন্ট ক্যাভুর। অত্যন্ত দক্ষ, বুদ্ধিমান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ক্যাভুরের লক্ষ্য ছিল পিডমন্ট রাজবংশের অধীনে সমগ্র ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করা।

উভয়ের মধ্যেকার আদর্শগত পার্থক্য

ম্যাৎসিনি এবং ক্যাভুর উভয়েরই লক্ষ্য ছিল বৈদেশিক প্রভাব থেকে ইতালিকে মুক্ত করা। তবুও উভয়ের মধ্যে বেশ কিছু আদর্শগত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন –

  • ম্যাৎসিনি ছিলেন আদর্শবাদী আর ক্যাভুর ছিলেন বাস্তববাদী।
  • ম্যাৎসিনি বিশ্বাস করতেন যুবশক্তির দ্বারা ইতালির মুক্তি সম্ভব; ক্যাভুর ইতালির মুক্তির জন্য বৈদেশিক সহায়তার উপর জোর দেন।
  • ম্যাৎসিনি ছিলেন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, আর ক্যাভুর সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন।

ইটালির ঐক্য আন্দোলনে জোসেফ গ্যারিবল্ডির অবদান কী ছিল?

নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ ভিয়েনা সম্মেলনের ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে ইটালির বিষয়ে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাতে ইটালির বিভিন্ন অংশ বিদেশিদের কাছে হস্তান্তরিত হয়। এই বিদেশিদের বিতাড়িত করে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ইটালি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যেসব ব্যক্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জোসেফ গ্যারিবল্ডি (Giuseppe Garibaldi)।

ইটালির ঐক্যে গ্যারিবল্ডির অবদান

ম্যাৎসিনির শিষ্য গ্যারিবল্ডি ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একটি বাহিনী গঠন করেছিলেন। এই বাহিনীর সদস্যরা লাল রঙের পোশাক পরতেন বলে এদের লালকোর্তা (Red Shirts) বলা হত। এই বাহিনীর সাহায্যে তিনি সিসিলি ও নেপলস জয় করে রোম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু ক্যাভুর এতে বিব্রত বোধ করেন। তাই গ্যারিবল্ডি তাঁর একনায়কত্ব ত্যাগ করে রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েলের আনুগত্য স্বীকার করলে দক্ষিণ ইটালি ও উত্তর ইটালি সংযুক্ত হয়। 1861 সালে ক্যাভুরের মৃত্যুর পর অবশিষ্ট ইটালি (ভেনিস) ইটালির সঙ্গে যুক্ত হলে ইটালির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়।

ইটালির ঐক্য আন্দোলনে গ্যারিবল্ডির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ম্যাৎসিনি ও ক্যাভুরের পাশাপাশি তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন।

জার্মানির ঐক্যের পথে প্রধান বাধাগুলি কী ছিল?

ফরাসি বিপ্লবকালে ইটালির মতো জার্মানিও ছিল ‘ভৌগোলিক সংজ্ঞা’ মাত্র। এই সময় জার্মানি 300টি ছোট-বড় রাজ্যে বিভক্ত ছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ‘কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন’ গঠনের মাধ্যমে 300টি রাজ্যের পরিবর্তে 39টি রাজ্যে জার্মানিকে বিভক্ত করেন। কিন্তু নেপোলিয়নের পতনের পর পুনরায় জার্মান রাষ্ট্র সমবায়ের (Bund) ঐক্য শিথিল হয়ে যায়। ঐতিহাসিক ম্যারিয়টের (Marriott) ভাষায় – জার্মানিতে বহু রাষ্ট্র ছিল, কিন্তু কোনো অখণ্ড রাষ্ট্র ছিল না (States there were in Germany but there was no state)।

ঐক্যের পক্ষে প্রধান প্রতিবন্ধকতা

জার্মানির ঐক্যের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলি ছিল –

  1. জার্মানির ঐক্যের পথে প্রধান বাধা ছিল ভিয়েনা চুক্তি। কারণ এই চুক্তির মাধ্যমে যে জার্মান রাষ্ট্র সমবায় গঠিত হয়, তার বিলোপ না ঘটলে জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না।
  2. সংস্কৃতি, ভাষা ও জাতিগত ঐতিহ্য এক ধরনের হলেও বিভিন্ন জার্মান রাষ্ট্রগুলির মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য ও বিদ্বেষ ছিল।
  3. জার্মানির উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলি ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট এবং দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলি ছিল ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী। ফলে, এই দুটি অঞ্চলের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধও ঐক্যকে বিঘ্নিত করত।
  4. জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল অস্ট্রিয়ার উপর। আর অস্ট্রিয়া ক্রমাগত এই ঐক্য প্রচেষ্টায় বাধা দিত। আবার অস্ট্রিয়া-সহ জার্মানির ঐক্যে মেটারনিখের আপত্তি ছিল। তিনি এই আদর্শকে বলতেন — অপবিত্র আদর্শ।

জার্মানির ঐক্য আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

জার্মানির ঐক্য আন্দোলন

নেপোলিয়নের জার্মানি জয়ের পূর্বে জার্মানি 300টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। নেপোলিয়ন জার্মানির পুনর্গঠন করে 39টি রাজ্যে বিভক্ত করেন এবং কনফেডারেশন অফ দ্য রাইন নামে এক রাষ্ট্রসংঘ গঠন করেন। এরপর ভিয়েনা বৈঠকে (1815) জার্মানির উপর অস্ট্রিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশেষে প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিসমার্কের নেতৃত্বে জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়।

জোলভেরেইন (Zollverein) ও অর্থনৈতিক ঐক্য

1819 সালে জার্মানিতে জোলভেরেইন নামে শুল্কসংঘ স্থাপিত হয়। সকল জার্মান রাজ্য এর সদস্য হতে পারে বলে ঘোষণা করা হয় এবং সদস্য দেশগুলির মধ্যে একই শুল্কব্যবস্থা স্থাপিত হয়। জার্মানিতে জোলভেরেইনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ঐক্য স্থাপিত হয়।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (February Revolution) ও ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট (Frankfurt Parliament)

মেটারনিখ কার্লসবাড ডিক্রি জারি করে জার্মানির জাতীয়তাবাদীদের দমনের চেষ্টা করেন। 1848 সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে জার্মান জাতীয়তাবাদীরা ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট গঠন করে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প করে, কিন্তু তারও পতন ঘটে।

বিসমার্কের ভূমিকা

1862 সালে বিসমার্ক প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন। তিনি বলেন, একমাত্র রক্ত ও লোহা (Blood and Iron policy) নীতির দ্বারাই জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হবে। কূটনীতির জাদুকর বিসমার্ক ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সকে পরাজিত করে জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ করেন। তাঁর রণকৌশল ছিল প্রতিপক্ষকে মিত্রহীন করে পরাজিত করা।

প্রাশিয়া ডেনমার্ক যুদ্ধ (1864)

জার্মান অধ্যুষিত এবং ডেনমার্কের অধীন স্লেজউইগ ও হলস্টিন প্রদেশ দুটি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে বিসমার্ক ডেনমার্ককে যুদ্ধে পরাজিত করেন। প্রদেশ দুটির ভবিষ্যতের প্রশ্নে তিনি অস্ট্রিয়ার সঙ্গে গ্যাস্টিনের সন্ধি স্বাক্ষর করেন।

প্রাশিয়া অস্ট্রিয়া যুদ্ধ (1866)

গ্যাস্টিনের চুক্তি ভঙ্গ করার অজুহাতে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। স্যাডোয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। পরাজিত অস্ট্রিয়া 1866 সালে প্রাশিয়ার সঙ্গে প্রাগের সন্ধি (Peace of Prague) স্বাক্ষর করে জার্মানি ত্যাগ করে। প্রাশিয়া জার্মানির নেতৃত্ব লাভ করে।

প্রাশিয়া-ফ্রান্স যুদ্ধ (1870)

ফ্রান্সের অধীন আলসাস ও লোরেন প্রদেশ জার্মানির সঙ্গে যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জার্মানির ঐক্য অসম্পূর্ণ ছিল। তাই প্রাশিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের যুদ্ধ ছিল অনিবার্য। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে বিসমার্ক ইটালি, রাশিয়া, অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে ফ্রান্সকে মিত্রহীন করেন। এমতাবস্থায় স্পেনের সিংহাসন-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে এমস টেলিগ্রাম-এর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বিসমার্ক যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটান। 1870 সালে সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হয় ও ফ্রাঙ্কফোর্টের সন্ধি (Peace of Frankfurt, 1871) স্বাক্ষরের মাধ্যমে জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়।

জোলভেরেইন (Zollverein) প্রতিষ্ঠার কারণ ও গুরুত্ব আলোচনা করো।

জোলভেরেইন (Zollverein) হল প্রাশিয়ার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত একটি শুল্কসংঘ। জার্মান অর্থনীতিবিদ মাজেন (Massen)-এর উদ্যোগে 1819 খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।

প্রতিষ্ঠার পটভূমি

জোলভেরেইন প্রতিষ্ঠার কারণ হল –

  1. এর আগে জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক চালু ছিল।
  2. জার্মানির এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ব্যবসা ও মালপত্র যাতায়াতের শুল্ক সংক্রান্ত নানা রকমের অসুবিধা ছিল। এর মধ্যে প্রাশিয়াতেই 67 রকমের শুল্ক চালু ছিল।
  3. শুল্ক সংক্রান্ত এই সকল অসুবিধা দূর করার জন্য প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জোলভেরেইন নামক শুল্কসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রসার

1819 খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়া এই শুল্কসংঘ গঠন করলেও 1833 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উত্তর ও মধ্য জার্মানির সব রাজ্য এবং 1850 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মানির সব রাজ্যই এই শুল্কসংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়।

নিয়মাবলি

  • বছরে একবার এই শুল্কসংঘের বৈঠক বসত।
  • এই সংঘে যোগদানকারী রাজ্যগুলি বিনাশুল্কে অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত।

গুরুত্ব

মূলত অর্থনৈতিক কারণে এই শুল্কসংঘ গঠিত হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

  1. বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত জার্মানরা প্রথম এক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
  2. প্রাশিয়া শুল্কসংঘ প্রতিষ্ঠা করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ম্যারিয়ট বলেছেন ‘জার্মানদের জার্মানিকরণের প্রথম ধাপ হল জোলভেরেইন।’ (… Zollverein… is the first step towards Germanisation of the people.) পরে এর হাত ধরেই 1870 খ্রিস্টাব্দে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

বিসমার্ক-এর রক্ত ও লৌহ নীতি (Blood and Iron Policy) বলতে কী বোঝায়?

অটো লিওপোল্ড ভন বিসমার্ক (Otto Leopold Von Bismarck) ইতিহাসে বিসমার্ক নামে অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন সমকালীন ইউরোপীয় রাজনীতির প্রধান পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। তিনি প্রথম 8 বছর (1862-1870 খ্রি.) প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তী 20 বছর (1870-1890 খ্রি.) জার্মানির প্রধানমন্ত্রী পদে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি রক্ত ও লৌহ (Blood and Iron) নীতির দ্বারা জার্মানিকে একটি ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন।

বিসমার্কের পূর্ব পরিচয়

বিসমার্ক 1815 খ্রিস্টাব্দে ব্যান্ডেনবার্গের অন্তর্গত শ্যেনহাউজেন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। বিসমার্ক ছিলেন জুংকার (Junker) বা জমিদার পরিবারের সন্তান। তিনি বার্লিন ও গোটিংজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

বিসমার্ক-এর 'রক্ত ও লৌহ' নীতি (Blood and Iron Policy) বলতে কী বোঝায় ?

বিসমার্কের উত্থান

প্রাশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রেডরিক উইলিয়মের মৃত্যুর পর তার ভাই প্রথম উইলিয়ম প্রাশিয়ার রাজা হন। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী ও সামরিক শক্তিতে বিশ্বাসী রাজা। তিনি 1862 খ্রিস্টাব্দে বাস্তববাদী ও রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ বিসমার্ককে তাঁর প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।

বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি (Blood and Iron Policy)

বিসমার্ক বাস্তববাদী রাজনীতিতে (Real Politik) বিশ্বাস করতেন। তিনি প্রাশিয়ার আইনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ কাজ বক্তৃতা বা ভোটের দ্বারা হবে না, তা করতে হবে রক্ত ও লৌহ নীতি দিয়ে। রক্ত ও লৌহ নীতি বলতে বোঝায় যুদ্ধ ও কঠোর শৃঙ্খলাবোধকে।

রক্ত ও লৌহ নীতির প্রয়োগ

বিসমার্ক রক্ত ও লৌহ নীতি অনুসরণ করে প্রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করেন। 1864 থেকে 1870 খ্রিস্টাব্দ – এই 6 বছরের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ করে জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ করেন। এই তিনটি যুদ্ধ হল-

  1. ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (1864 খ্রি.)।
  2. প্রাশিয়া-অস্ট্রিয়া যুদ্ধ, (1866 খ্রি.) সাত সপ্তাহের যুদ্ধ বা কোনিগ্রাস-এর যুদ্ধ।
  3. ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সেডানের যুদ্ধ। বিসমার্কের কূটনৈতিক দক্ষতার ফলে প্রাশিয়ার রাজা প্রথম উইলিয়ম জার্মানির সম্রাট বা কাইজার বলে ঘোষিত হন (1871 খ্রি.)।

বিসমার্ক কীভাবে তাঁর রক্ত ও লৌহনীতিকে প্রয়োগ করেছিলেন?

রক্ত ও লৌহনীতির প্রয়োগ

অটো ভন বিসমার্ক ছিলেন জার্মান রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তাকে বলা হয় রক্ত ও লৌহ নীতি। এই নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ জার্মানির জন্ম দেন বিসমার্ক। 1862 খ্রিস্টাব্দে জার্মানির এক বিশেষ পরিস্থিতিতে বিসমার্ক প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি বুঝেছিলেন, জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে গেলে কোনো আন্দোলনের দ্বারা হবে না। এর জন্য দরকার যুদ্ধ। তাই তিনি তাঁর রক্ত ও লৌহনীতির প্রয়োগ ঘটান। তিনি বোঝেন, জার্মানির ঐক্যতে প্রধান বাধা যে-সমস্ত দেশ, সেগুলি সহজে জার্মানির ঐক্য হতে দেবে না। তাই যুদ্ধ ছাড়া কোনো পথ তিনি আর পেলেন না।

বিসমার্ক তিনটি যুদ্ধের মাধ্যমে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন –

  • ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ – ডেন জাতি অধ্যুষিত শ্লেজউইগ এবং জার্মান জাতি অধ্যুষিত হলস্টাইন প্রদেশ দুটিকে ডেনমার্কের রাজা এক নতুন শাসনতন্ত্রের দ্বারা ডেনমার্কভুক্ত করার উদ্যোগ নেন। লন্ডনের সন্ধি বলে এই দুটি জাতির উপর ডেনমার্কের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন (1864 খ্রি.)। যুদ্ধে ডেনমার্ক পরাজিত হয়। গ্যাস্টিনের চুক্তিতে অস্ট্রিয়া হলস্টাইন পায় এবং প্রাশিয়া শ্লেজউইগ লাভ করে।
  • অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ – হলস্টাইন সমস্যাকে অজুহাত করে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। অস্ট্রিয়া স্যাডোয়ার যুদ্ধে (1866 খ্রিস্টাব্দ) পরাজিত হয়ে প্রাগের সন্ধি (1866 খ্রিস্টাব্দ) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধির দ্বারা – 1. অস্ট্রিয়া জার্মানির নেতৃত্ব ত্যাগ করে, 2. শ্লেজউইগ ও হলস্টাইন প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়।
  • ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ – জার্মান রাজ্যগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। অবশেষে এমস টেলিগ্রামের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়া বা সেডানের যুদ্ধ (1870 খ্রিস্টাব্দ) শুরু হয়। সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হয়ে ফ্রাঙ্কফোর্টের সন্ধি স্বাক্ষর করে। ওই সন্ধি দ্বারা — 1. আলসাস ও লোরেন প্রদেশ দুটি ফ্রান্স জার্মানিকে ছেড়ে দেয়। 2. দক্ষিণ ও উত্তর জার্মানি প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। এইভাবে রক্ত ও লৌহনীতির প্রয়োগ দ্বারা জার্মানির ঐক্যকরণ সম্পূর্ণ হয়।

বিশ্ব ইতিহাসে 1870 খ্রিস্টাব্দের গুরুত্ব বা তাৎপর্য নিরূপণ করো।

1870 খ্রিস্টাব্দ আধুনিক বিশ্ব তথা ইউরোপের ইতিহাসে বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই বছর বিশ্ব ইতিহাসে নানান গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় ঐতিহাসিকরা এই বছরটিকে আধুনিক ইতিহাসের জলবিভাজিকা বলে মন্তব্য করেছেন।

গুরুত্ব:

  1. নতুন শক্তিসাম্যের উদ্ভব – 1870 খ্রিস্টাব্দে ঐক্যবদ্ধ জার্মানি ও ইতালির উত্থান এবং ফ্রান্সের পরাজয়ে ইউরোপে এতদিনের শক্তির ভারসাম্য বিনষ্ট হয় — গড়ে ওঠে নতুন শক্তিসাম্য।
  2. জাতীয়তাবাদী আন্দোলন – প্রতিক্রিয়াশীল মেটারনিখতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইউরোপে বারবার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংঘটিত হওয়ায় এবং দমননীতির মাধ্যমে সেই জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা বারবার ব্যর্থ হলেও 1870 খ্রিস্টাব্দে তা সফল হয়।
  3. সামরিক শক্তিবৃদ্ধি – 1870 খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ জার্মানির উদ্ভব হওয়ায় ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলি তাদের সামরিক শক্তির দ্রুত বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়ে ওঠে তথা ইউরোপে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়।
  4. অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ – 1870 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে অবাধ বাণিজ্য নীতির অবসান ঘটায় ইউরোপে এতদিনের প্রচলিত অর্থনৈতিক উদারতাবাদ অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়।
  5. রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের বিরোধ – 1856 খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধিতে রাশিয়ার উপর চাপিয়ে দেওয়া সামুদ্রিক শর্তাবলি সেডানের যুদ্ধের সুযোগে ভাঙতে শুরু করে তথা কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে সামরিকীকরণ শুরু হয়। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়।

1870 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে ইউরোপে প্রযুক্তি ও অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটে এবং জাতীয়তাবাদের জয় ঘোষিত হয়। শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

এমস টেলিগ্রাম (Ems Telegram) – টীকা লেখো

এমস টেলিগ্রাম

প্রাশিয়ার রাজা প্রথম উইলিয়াম এমস (Ems) নামক স্থান থেকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ককে টেলিগ্রামের মাধ্যমে একটি খবর পাঠান (13 জুলাই, 1870 খ্রিস্টাব্দ)। এর বিষয় ছিল ফরাসি দূত বেনেদিতির (Benedetti) সঙ্গে রাজা প্রথম উইলিয়ামের আলোচনার সারসংক্ষেপ। এটি ইতিহাসে এমস টেলিগ্রাম (Ems Telegram) নামে পরিচিত।

এমস টেলিগ্রাম এবং পরিবর্তিত বিষয় প্রকাশ

প্রাশিয়ার রাজা আলোচনার বিষয়টি টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাঁর প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ককে জানালে সুচতুর কূটনীতিবিদ বিসমার্ক সেই টেলিগ্রামের কিছু শব্দ বাদ দিয়ে টেলিগ্রামটি এমনভাবে সাজান, যাতে মনে হয় প্রাশিয়ার রাজা ফরাসি দূত বেনেদিতিকে অপমান করেছেন। পরের দিন বিসমার্ক এটি নর্থ জার্মান গেজেট (North German Gazette) ও অন্যান্য সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেন (14 জুলাই, 1870 খ্রিস্টাব্দ)।

ফলাফল

এই ঘটনায় ফরাসি জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং বাধ্য হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন প্রাশিয়ার কাছে পরাজিত হন। বিসমার্ক ব্যঙ্গ করে বলেন- ‘লাল কাপড় দেখিয়ে তিনি গলদেশের (ফ্রান্স) ষাঁড়কে ক্ষেপিয়ে দিয়েছেন’ (Bismarck showed the red rag to Galic (France bull))।

বলকান জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের কারণ আলোচনা করো।

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে গড়ে ওঠা অটোমান বা তুর্কি সাম্রাজ্য ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া মাইনর, ইরাক, সিরিয়া, আরব, প্যালেস্টাইন ও বলকান অঞ্চল নিয়ে এক বিশাল আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতক থেকেই মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী তুরস্ক আধুনিক যুগোপযোগী সংস্কারের অভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক সবদিক দিয়েই ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে পরিচিত হয় ‘ইউরোপের রুগ্‌ণ মানুষ’ হিসেবে। এই পরিস্থিতিতে উনিশ শতকে এই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বলকান জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে।

উদ্ভবের কারণ:

  1. স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা – ফরাসি বিপ্লব ও পরবর্তীকালে জুলাই ও ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে বলকান অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জাতিগুলি অত্যাচারী অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
  2. তুর্কি শাসকদের পশ্চাৎপদতা – সমগ্র ইউরোপে আধুনিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হলেও তুর্কি শাসকদের মধ্যযুগীয় সংস্কারবিমুখ মানসিকতা বলকান অঞ্চলের অধিবাসীদের মনে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে।
  3. গুপ্ত সমিতির প্রভাব – বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গুপ্ত সমিতি এখানকার জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করেছিল। যেমন — গ্রিসের ‘হেটাইরিয়া ফিলিকে বা ‘বান্ধবসভা’ গ্রিসের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট রচনা করে।
  4. বুদ্ধিজীবীদের প্রভাব – এই সময় গ্রিক পণ্ডিত কোরায়েস, কবি রিগাস প্রমুখ তাঁদের রচনার দ্বারা বলকান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী ধারণার বিকাশ ঘটান।
  5. সর্বশাভবাদ বা প্যান-শ্লাভ আন্দোলন – বলকান অঞ্চলে বসবাসকারী অধিকাংশ জনগণই ছিল শ্লাভ জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। আবার রাশিয়াও ছিল শ্লাভ গোষ্ঠীভুক্ত। তাই এই অঞ্চলের বিশাল সংখ্যক মানুষের সঙ্গে রাশিয়ার এক ধরনের ঐক্যবোধ গড়ে ওঠায় রাশিয়াও নানাভাবে শ্লাভ ঐক্যের আদর্শ প্রচার করতে থাকে। আবার তুরস্ক সাম্রাজ্যের দুর্বলতায় রাশিয়া বলকান অঞ্চলে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়- যা বলকান জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

বলকান অঞ্চলের এই নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদ ও তার সাফল্য বলকান জাতীয়তাবাদকে তীব্র করে তুলেছিল। এই অঞ্চলে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার প্রবেশ এবং সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ বলকান অঞ্চলে এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছিল; যা শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করে।

অটোমান সাম্রাজ্যের (Ottoman Empire) বলকান অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

1453 খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিরা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে। এরপর অটোমান তুর্কিরা পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে এশিয়া ও ইউরোপ জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। সমগ্র বলকান অঞ্চল তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। আঠারো ও উনিশ শতকে তুর্কি সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে বলকান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের দ্রুত প্রসার ঘটে।

অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি –

অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বলকান অঞ্চলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করত। যেমন — গ্রিক, সার্ব, বুলগেরীয়, রোমানীয়, আলবেনীয় প্রভৃতি।

শাসক তুর্কিদের সঙ্গে শাসিত জাতিগোষ্ঠীর পার্থক্য –

বলকান অঞ্চলে শাসক তুর্কিদের সঙ্গে শাসিত ইউরোপীয় জাতিগুলির বিভিন্ন বিষয়ে পার্থক্য ছিল। তাদের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল ভিন্ন ভিন্ন।

শাসক তুর্কিশাসিত ইউরোপীয় জাতি
তুর্কিরা ছিল এশিয়াবাসী।গ্রিক, সার্ব, বুলগেরীয় প্রভৃতি জাতিগুলি ছিল ইউরোপীয়।
তুর্কিরা ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী।ইউরোপীয় জাতিগুলি ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
তুর্কিরা ছিল অ-শ্বেতাঙ্গ।ইউরোপীয় জাতিগুলি ছিল শ্বেতাঙ্গ।

বলকান জাতীয়তাবাদের বিকাশ –

বলকান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার বিকাশের প্রধান কারণ ছিল –

  • তুর্কি সাম্রাজ্যের দুর্বলতা এবং
  • ফরাসি বিপ্লবের জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রভাব।

এর ফলস্বরূপ বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তুরস্কের অধীনতাপাশ ছিন্ন করার জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করে। 1829 খ্রিস্টাব্দে গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করে। ক্রিট, রোমানিয়া, বসনিয়া, বুলগেরিয়া, মন্টিনিগ্রো, সেরাজেভো সহ সমগ্র বলকান অঞ্চল জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভে শামিল হয়।

গ্রিক ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের উপর ফ্রান্স ও রাশিয়ার অধিকার নিয়ে কীভাবে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (Crimean War) শুরু হয়েছিল?

1854 খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়। তুরস্ক সাম্রাজ্যের জেরুজালেমের প্রোটোর গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ল্যাটিন ও গ্রিক ধর্মযাজকদের বিরোধকে কেন্দ্র করে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধে গ্রিক খ্রিস্টানদের সমর্থক রাশিয়া ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের সমর্থক ফ্রান্স পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল হয়।

গ্রিক ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্ব –

তুরস্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত যীশুখ্রিস্টের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র জেরুজালেমের প্রোটোর গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ল্যাটিন ও গ্রিক ধর্মযাজকদের মধ্যে বিরোধ ছিল। ল্যাটিন ধর্মযাজকদের সমর্থক ছিল ফ্রান্স এবং গ্রিক ধর্মযাজকদের সমর্থক ছিল রাশিয়া।

ফ্রান্সের অধিকার –

ফ্রান্স তুরস্কের সঙ্গে ক্যাপিচুলেশন সন্ধি (Treaty of Capitulation, 1740 খ্রি.) স্বাক্ষর করে ধর্মযাজকদের উপর ল্যাটিন চার্চ ও অনুগামীদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করার অধিকার লাভ করে।

রাশিয়ার অধিকার –

রাশিয়া কুসুক-কাইনার্ডজির সন্ধি (Treaty of Kuchuk-Kainardji, 1774 খ্রি.) স্বাক্ষর করে উক্ত স্থান ও গ্রিক চার্চ ও অনুগামীদের অভিভাবকত্ব করার অধিকার পায়।

ফ্রান্স ও রাশিয়ার দাবি –

1852 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন ফ্রান্সের ক্যাথলিকদের সমর্থন লাভের জন্য তুরস্কের সুলতানের কাছে জেরুজালেমের অধিকার দাবি করেন। তুরস্কের সুলতান ফ্রান্সের পুরোনো অধিকার স্বীকার করেন।

এই অবস্থায় 1853 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার জার নিকোলাস তুরস্কের সুলতানের কাছে তাঁর অধিকার দাবি করেন। তুরস্কের সুলতান গ্রিক খ্রিস্টানদের উপর রাশিয়ার অধিকাংশ দাবি মানতে অস্বীকার করেন।

রাশিয়ার আক্রমণ ও তুরস্কের যুদ্ধ ঘোষণা

তুরস্কের সুলতান রাশিয়ার দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করায় জার নিকোলাস ক্ষুব্ধ হন। তিনি তুরস্কের মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া অঞ্চল দুটি অধিকার করে নেন। এর ফলে তুরস্কের সুলতানও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে (অক্টোবর, 1853 খ্রি.)। এই যুদ্ধে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া তুরস্কের পক্ষে যোগ দিলে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (Crimean War) শুরু হয় (মার্চ, 1854 খ্রি.)।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ কবে ও কাদের মধ্যে হয়? এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ কী?

1854 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1856 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে দুটি পক্ষ ছিল। একপক্ষে ছিল রাশিয়া এবং অপরপক্ষে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, তুরস্ক এবং পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ

রাশিয়া 1774 খ্রিস্টাব্দে কুসুক কাইনাউজি (Treaty of Kuchuk-Kainardji)-র সন্ধি অনুসারে তুরস্কের গ্রিক খ্রিস্টান ধর্মপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মানুরাগীদের উপর কর্তৃত্ব দাবি করে। তুরস্ক সেই দাবি অগ্রাহ্য করলে রাশিয়া তুরস্কের অধীনস্থ মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া প্রদেশ দুটি দখল করে নেয়। রাশিয়ার এইরূপ আগ্রাসী কার্যকলাপে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া বিব্রত বোধ করে এবং তারা সম্মিলিতভাবে রাশিয়াকে ওই দুটি স্থান ত্যাগ করতে অনুরোধ করে। রাশিয়া সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। শুরু হয় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (Crimean War, 1854 খ্রি.)। দু-বছর যুদ্ধ চলার পর 1856 খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধির দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান হয়।

কোন্ সন্ধির দ্বারা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটে? এই সন্ধির শর্ত কী ছিল?

1856 খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধির দ্বারা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটে। যদিও এই সন্ধির মাধ্যমে পূর্বাঞ্চল সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি।

সন্ধির শর্ত –

  1. রাশিয়া তুরস্ককে মোলদাভিয়া, ওয়ালাচিয়া ফিরিয়ে দেয়। এখানে তুরস্কের অধীনে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
  2. বৃহৎ শক্তিবর্গ তুরস্ক সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।
  3. রাশিয়া গ্রিক চার্চ ও খ্রিস্টান প্রজাদের ওপর দাবি ত্যাগ করে।
  4. তুর্কি সুলতান তুরস্কের আধুনিকীকরণ নীতি গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন।

কত খ্রিস্টাব্দে বার্লিন চুক্তি (Treaty of Berlin) সম্পাদিত হয়? এই চুক্তির শর্তাবলি কী ছিল?

1878 খ্রিস্টাব্দে সান-স্তেফানো সন্ধি (Treaty of San Stefano) সংশোধন করে বার্লিন চুক্তি (Treaty of Berlin) সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি, বরং এর ফলে সমস্যা আরও জটিল রূপ ধারণ করেছিল।

বার্লিন চুক্তির শর্তাবলি

বার্লিন সন্ধির শর্তানুসারে বলা হয়:

  • সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো ও রোমানিয়া স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে।
  • বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার উপর অস্ট্রিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
  • সান-স্তেফানো সন্ধিতে সৃষ্ট বৃহৎ বুলগেরিয়াকে ম্যাসিডোনিয়া, পূর্ব রুমেলিয়া এবং বুলগেরিয়া—এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়।
  • ম্যাসিডোনিয়া তুরস্ককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, পূর্ব রুমেলিয়ায় একজন খ্রিস্টান শাসক নিয়োগ করে তুরস্কের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বুলগেরিয়াকে নামমাত্র তুর্কি শাসনাধীনে রাখা হয়।
  • রাশিয়া বেসারাবিয়া, কার্স ও আর্মেনিয়ার কিছু অংশ লাভ করে।
  • ইংল্যান্ড পায় সাইপ্রাস এবং ফ্রান্স পায় টিউনিস।

রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের উদ্যোগে ভূমিদাস প্রথার অবসানের কারণ কী ছিল?

ভূমিদাস প্রথা ছিল রাশিয়ার একটি প্রাচীন প্রথা এবং রাশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি। 1861 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় ভূমিদাসের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ কোটি। তারা বিভিন্নভাবে মালিকদের দ্বারা শোষিত ও নিপীড়িত হত। রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার 1861 খ্রিস্টাব্দের 19 ফেব্রুয়ারি মুক্তির ঘোষণাপত্র (Edict of Emancipation) দ্বারা রাশিয়া থেকে ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদ ঘটান। এ জন্য জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে মুক্তিদাতা জার (Tsar Liberator) বলা হয়। এই ভূমিদাস প্রথা অবসানের অনেক কারণ ছিল।

ভূমিদাস প্রথা অবসানের কারণ

রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটানো কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এর পিছনের কারণগুলি হল:

  1. ভূমিদাসের অপ্রয়োজনীয়তা: উনিশ শতকের শুরু থেকেই রাশিয়ায় শিল্পায়ন ঘটতে থাকে। দেশের নতুন নতুন কলকারখানার জন্য দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন বেড়েছিল। পাশাপাশি ভূমিদাসদের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাচ্ছিল।
  2. ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পরাজয়: ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (1854-56 খ্রি.) পরাজয়ের পর ভূমিদাস প্রথার অপ্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কারণ রুশ সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছিল মূলত ভূমিদাসদের দিয়েই। এরা ছিল শারীরিক দিক থেকে দুর্বল ও জয়পরাজয় সম্পর্কে উদাসীন।
  3. কৃষক বিদ্রোহ: ভূমিদাস প্রথা অবসানের ক্ষেত্রে জার শাসনের বিরুদ্ধে ভূমিদাসদের বিদ্রোহ একটি বড়ো কারণ ছিল। সরকারি নথির ভিত্তিতে সেমেভস্কি বলেছেন যে, 1862 খ্রিস্টাব্দের আগে গত ৬০ বছরে রাশিয়াতে ৫৫০টি কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছিল।
  4. বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন: ভূমিদাস প্রথার অবসানে রুশ বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা এই কুপ্রথার অবসানের জন্য বিভিন্নভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন—পুশকিন (Pushkin), টলস্টয় (Tolstoy), গোগোল (Gogol), তুর্গেনেভ (Turgenev) প্রমুখ।
  5. জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সদিচ্ছা: জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভূমিদাস প্রথা যুগের অনুপযোগী এবং তা উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। তিনি 1856 খ্রিস্টাব্দে মস্কোর এক সভায় বলেছিলেন, ‘নীচুতলা থেকে কবে দাসত্ব বিলোপের চেষ্টা হবে তার জন্য অপেক্ষা না করে উপরতলা থেকে বিলোপ করাই ভালো।’

কীভাবে রাশিয়ার ভূমিদাসরা মুক্তিলাভ করেছিল?

ভূমিদাস প্রথা ছিল রাশিয়ার একটি প্রাচীন প্রথা এবং রাশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি। 1861 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার ভূমিদাসের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ কোটি। তারা মালিকদের দ্বারা বিভিন্নভাবে শোষিত ও নিপীড়িত হত। রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার 1861 খ্রিস্টাব্দের 19 ফেব্রুয়ারি মুক্তির ঘোষণাপত্র দ্বারা রাশিয়া থেকে ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদ ঘটান। এজন্য তাঁকে মুক্তিদাতা জার (Tsar Liberator) বলা হয়। তাদের মুক্তি ও পরবর্তী জীবনের জন্য তিনি বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।

মুক্তির ঘোষণা

রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার 1861 খ্রিস্টাব্দের 19 ফেব্রুয়ারি মুক্তির ঘোষণাপত্র (Edict of Emancipation) স্বাক্ষর করে রাশিয়া থেকে ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটান। এই ঘোষণাপত্রে ২২টি ধারা ছিল।

মুক্ত ভূমিদাসদের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা

  1. মুক্ত ভূমিদাসদের উপর তার মালিকের আর কোনো অধিকার থাকবে না। তারা রাশিয়ার স্বাধীন নাগরিকের মতো জীবনযাপন করতে পারবে।
  2. ভূমিদাসরা পূর্বে প্রভুর যে জমি চাষ করত এখন থেকে তারা ওই জমির অর্ধেক লাভ করবে। জমির মালিককে অর্ধেক জমির ক্ষতিপূরণ সরকার দিয়ে দেবে।
  3. ল্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেট নামক সরকারি কর্মচারি এবং মির নামক গ্রাম্য সমিতিকে জমি বণ্টন, ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
  4. মুক্ত ভূমিদাসদের ৪৯ বছর ধরে কিস্তিতে ৬.৫% হার সুদে প্রাপ্য জমির অর্থ শোধ করার সুযোগ দেওয়া হয়। ভূমিদাসদের মুক্তি জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় অবদান। এর ফলে রাশিয়ায় আধুনিক যুগের সূচনা হয়।

ঊনবিংশ শতকে গ্রিক জাতীয়তাবাদ গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করো

প্রাচীন গ্রিস

গ্রিস ছিল প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। প্রাচীন ইউরোপীয় সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে গ্রিসের নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কালক্রমে সামাজিক গৌরবে গরীয়ান গ্রিস তার পূর্বের গৌরব হারিয়ে ফেলে এবং তুরস্কের অধীনতাবদ্ধ হয়। তবে কয়েকটি বিশেষ ঘটনা পরাধীনতার গ্লানি ভুলে গ্রিকদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

সাহিত্যের প্রভাব

অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে গ্রিসে কোয়ারেস (Koares) নামক জনৈক গ্রিক পণ্ডিতের নেতৃত্বে দেশাত্মবোধক বা মননশীল সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। এর ফলে গ্রিসে প্রাচীন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগরিত হয়।

যোদ্ধা মনোভাব

প্রাচীনকাল থেকেই গ্রিকরা সুনিপুণ যোদ্ধা ও কঠোর পরিশ্রমী হিসেবে খ্যাত। এই ঐতিহ্যগত যোদ্ধা মনোভাব তাদের তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে।

ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব

1789 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবে ফ্রান্সবাসীর সাফল্য ও জাতীয়তাবোধ গ্রিকদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। হেটাইরিয়া ফিলিকে নামক গুপ্ত সমিতি গ্রিক জাতীয়তাবাদের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। এই সমিতির মাধ্যমে গ্রিসের সমস্ত অঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলনের গোপন প্রস্তুতি শুরু হয়।

তুর্কিদের অত্যাচার

তুর্কি শাসক ও রাজকর্মচারীদের কুশাসন ও অত্যাচার গ্রিকদের মনে তুর্কি শাসনের প্রতি ঘৃণার সঞ্চার করে।

স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা

তুরস্কের অধীন হলেও গ্রিকরা বহুলাংশে স্বায়ত্তশাসন ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত। স্বাধীনভাবে ব্যবসাবাণিজ্য ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কাজ করে গ্রিকরা প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে। এরূপ পরিস্থিতিতে সংকীর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে তুরস্কের অধীনতা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতালাভে সচেষ্ট হয় তারা।

অর্থাৎ বলা যায়, কোনো একটি নির্দিষ্ট উপাদান নয় বরং একাধিক উপাদানের সংমিশ্রণই গ্রিক জাতীয়তাবাদ গঠনে সাহায্য করেছিল।

গ্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হেটাইরিয়া ফিলিকের (Hetairia Philike) অবদান কী ছিল?

হেটাইরিয়া ফিলিকে (Hetairia Philike) হল একটি বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি। 1814 খ্রিস্টাব্দে স্কুপাস নামে একজন গ্রিক ব্যবসায়ী কৃষ্ণসাগরের উপকূলে ওডেসা বন্দরে এর প্রতিষ্ঠা করেন। হেটাইরিয়া ফিলিকে-র অর্থ হল স্বাধীনতার অনুরাগী।

প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য

হেটাইরিয়া ফিলিকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল:

  • সমগ্র ইউরোপ থেকে তুর্কি শাসনের অবসান ঘটানো।
  • পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
  • গ্রিসের স্বাধীনতা অর্জন করা।

হেটাইরিয়া ফিলিকে-র কার্যকলাপ

1814 খ্রিস্টাব্দে ৪ জন বণিককে নিয়ে এই গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠলেও 1821 খ্রিস্টাব্দে এর সদস্যসংখ্যা হয় প্রায় ২ লক্ষ। সমগ্র গ্রিসে এই সমিতির ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ে। এই সমিতি রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে গ্রিসের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর সমর্থন আদায় করে।

1821 খ্রিস্টাব্দে মোলদাভিয়া প্রদেশের শাসক ও হেটাইরিয়া ফিলিকের সভাপতি প্রিন্স আলেকজান্ডার ইপসিল্যান্টি-র (Alexander Ypsilanti) নেতৃত্বে মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া অঞ্চল তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।

বিদ্রোহ দমন

এই বিদ্রোহে তারা মেটারনিখের বিরোধিতায় রাশিয়ার সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তুরস্কের সেনাবাহিনী সহজেই হেটাইরিয়া ফিলিকের বিদ্রোহ দমন করে দেয়।

হেটাইরিয়া ফিলিকের এই বিদ্রোহ প্রশমিত হলেও গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়।

আজকে এই আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায় উনবিংশ শতকের ইউরোপ: রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংঘাত অধ্যায়ের প্রশ্ন কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাকে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।

JOIN US ON WHATSAPP

JOIN US ON TELEGRAM

Please Share This Article

About The Author

Related Posts

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Tom Loses a Tooth

Class 9 – English Reference – Tom Loses a Tooth – Question and Answer

The North Ship

Class 9 – English Reference – The North Ship – Question and Answer

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

Trending Now

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Class 9 – English Reference – Tom Loses a Tooth – Question and Answer

Class 9 – English Reference – The North Ship – Question and Answer

Class 9 – English – His First Flight – Question and Answer

Class 9 – English – A Shipwrecked Sailor – Question and Answer