জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জীবদেহে বিভিন্ন অঙ্গ, তন্ত্র ও অণু একসঙ্গে কাজ করে একটি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। এই নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের জন্য বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্রের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান হয়। এই তথ্য আদান-প্রদানের জন্য বিভিন্ন সংকেত ও প্রক্রিয়া কাজ করে।
ইনসুলিন-এর নিঃসরণ-স্থান ও কাজ উল্লেখ করো।
ইনসুলিন হল হরমোন যা প্রধানত প্যানক্রিযাসে উৎপাদিত হয়। এটি রক্তচাপের মাধ্যমে শরীরের অন্য অংশে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে।
ইনসুলিন-এর নিঃসরণ-স্থান
অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস্ অফ ল্যাঙ্গারহ্যান্স নামক কোশগুচ্ছের বিটা কোশ (B cell) থেকে ইনসুলিন হরমোন নিঃসৃত হয়।
ইনসুলিন-এর কাজ
ইনসুলিন হরমোনের প্রধান কাজগুলি এখানে আলোচিত হল —
- ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- গ্লাইকোজেনেসিসের মাধ্যমে যকৃৎ ও পেশিতে গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনরূপে সঞ্চয় করা এবং প্রয়োজন অনুসারে গ্লুকোজের আরণ প্রভাবিত করা ইনসুলিনের অন্যতম কাজ।
- গ্লাইকোজেন থেকে গ্লুকোজ উৎপাদনে (গ্লাইকোজেনোলাইসিস) ইনসুলিন বাধা দেয়।
- কোশকে গ্লুকোজ গ্রহণে সহায়তা করে।
- কোশে গ্লুকোজকে জারিত করে পাইরুভিক অ্যাসিডে পরিণত করতে সাহায্য করে।
- প্রোটিন এবং ফ্যাট থেকে গ্লুকোজ উৎপাদন (গ্লুকোনিওজেনেসিস) ব্যাহত করে।
ইস্ট্রোজেন-এর উৎস এবং কাজ উল্লেখ করো।
ইস্ট্রোজেন হল মহিলাদের প্রধান লিঙ্গ হরমোন। এটি মহিলাদের বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে এবং গর্ভাবস্থার সময় শিশুর উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ইস্ট্রোজেন-এর উৎস
ডিম্বাশয়ের পরিণত ডিম্বথলি বা গ্রাফিয়ান ফলিকল, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির কর্টেক্স অঞ্চল ও অনা (placenta) নামক স্ত্রী-হরমোনটি নিঃসৃত হয়।
ইস্ট্রোজেন-এর কাজ
স্ত্রীদেহে ইস্ট্রোজেন নিম্নলিখিত ভূমিকাগুলি পালন করে।
- গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ – এই হরমোন বিভিন্ন গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন — স্তন গঠন, বাহুমূল (axilla), শ্রোণিদেশ (pubis) প্রভৃতি স্থানে যৌন কেশোদ্গম ও যৌন কেশের স্ত্রী-সুলভ বিন্যাস নিয়ন্ত্রণ করে ইস্ট্রোজেন। এ ছাড়া, স্ত্রী-সুলভ সরু কণ্ঠস্বর, মসৃণ ও স্বল্পলোমবিশিষ্ট ত্বক প্রভৃতি অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলিও ইস্ট্রোজেন নিয়ন্ত্রণ করে।
- আনুষঙ্গিক যৌনাঙ্গের বৃদ্ধি ও পরিস্ফুরণ – নারীদেহে আনুষঙ্গিক যৌনাঙ্গ অর্থাৎ জরায়ু, ফ্যালোপিয়ান নালী, যোনি প্রভৃতির বৃদ্ধি ও পূর্ণতাপ্রাপ্তি নিয়ন্ত্রণ করে এবং শ্রোণিচক্র প্রসারিত করে।
- ডিম্বাশয়ের গঠন ও ডিম্বাণু নিঃসরণ – ইস্ট্রোজেন ডিম্বাশয়ের গ্রাফিয়ান ফলিক্ল-এর পরিণতিতে ও ডিম্বাণু নিঃসরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- মাসিক রজঃচক্র নিয়ন্ত্রণ – এই হরমোন মাসিক রজঃচক্রের আবর্তন নিয়মিত করে।
- অস্থি গঠন – ইস্ট্রোজেন মহিলাদের হাড় গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই রজঃনিবৃত্তির (menopause) পর ইস্ট্রোজেন নিঃসরণ কমে গেলে অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে (osteoporosis)।
- বিপাক ক্রিয়া – এই হরমোন নারীদেহে প্রোটিন ও চর্বি সংশ্লেষ বাড়ায় এবং কাঁধ, নিতম্ব, ঊরু ইত্যাদি অঙ্গে চর্বির স্ত্রী-সুলভ সঞ্চয় ঘটায়। ফলে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বা লাবণ্য বৃদ্ধি পায়।
প্রোজেস্টেরন-এর উৎস এবং কাজ উল্লেখ করো।
প্রোজেস্টেরন হল মহিলাদের একটি প্রধান লিঙ্গ হরমোন। এটি গর্ভনিরোধে সহায়তা করে এবং গর্ভধারণে অস্বাভাবিক ব্লিডিং এর সময় বিশেষ করে ব্যবহৃত হয়।
প্রোজেস্টেরনের উৎস
ডিম্বাশয়ের করপাস লুটিয়াম বা পীতগ্রন্থি প্রোজেস্টেরনের প্রধান উৎসস্থল। এ ছাড়া অমরা ও অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির কর্টেক্স অঞ্চ থেকেও এই হরমোন নিঃসৃত হয়।
প্রোজেস্টেরনের কাজ
স্ত্রীদেহে প্রোজেস্টেরনের প্রধান কাজগুলি নীচে আলোচিত হল।
- জরায়ুর বৃদ্ধিতে – গর্ভাবস্থায় জরায়ুর বৃদ্ধিতে প্রোজেস্টেরন এবং ইস্ট্রোজেন যৌথভাবে সাহায্য করে।
- ডিম্বাণু রোপণ ও গডস্যার – নিষিক্ত ডিম্বাণুকে জরায়ুগারে রোপণে ও গর্ভস্যারে প্রোজেস্টেরনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
- অমরা গঠন – জরায়ুগারে ডিম্বাণুর রোপণের পর প্রোজেস্টেরনের প্রভাবে অমরা গঠিত হয় ও তার বৃদ্ধি ঘটে।
- গর্ভাবস্থায় – স্ত্রীদেহে গর্ভাবস্থা বজায় রাখতে, স্তূণের বৃদ্ধি ও পুষ্টিতে প্রোজেস্টেরন প্রধান ভূমিকা পালন করে।
- স্তনগ্রন্থির বৃদ্ধি – প্রোজেস্টেরন এবং ইস্ট্রোজেন মিলিতভাবে গর্ভাবস্থায় স্তনগ্রন্থির বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করে।প্রোজেস্টেরন স্তনগ্রন্থিতে নালিকা সৃষ্টি ও বিকাশে সাহায্য করে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে দুগ্ধ নিঃসরণেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ডিম্বাশয়ের উপর প্রভাব – এই হরমোন গর্ভাবস্থায় অমরা বা গ্ল্যাসেন্টা থেকে বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয়ে FSH বা LH নিঃসরণ কমায়, ফলে গর্ভাবস্থায় ডিম্বাণু উৎপাদন এবং রজঃচক্র বন্ধ থাকে।
আরও পড়ুন,
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – প্রাণীদেহে সাড়াপ্রদানের একটি প্রকার হিসেবে গমন – উড্ডয়ন,অস্থিসন্ধি ও কঙ্কাল পেশি – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – প্রাণীদের সাড়া প্রদান ও ভৌত সমন্বয়-স্নায়ুতন্ত্র – মধ্যমস্তিষ্ক ও চোখ- রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
টেস্টোস্টেরন-এর উৎস এবং কাজ উল্লেখ করো।
টেস্টোস্টেরন হল পুরুষদের প্রধান লিঙ্গ হরমোন। এটি পুরুষদের লিঙ্গ উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করে এবং পুরুষের শরীরে শিশ্নকে উন্নয়ন এবং স্পেরম উৎসাহ প্রদান করে।
টেস্টোস্টেরন-এর উৎস
টেস্টোস্টেরন প্রধানত পুরুষদেহে বয়ঃসন্ধিকাল ও পরবর্তী সময়ে শুক্রাশয়ে অবস্থিত লেডিগের আন্তরকোশ থেকে ক্ষরিত হয়। এ ছাড়া অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির কর্টেক্স অঞ্চল থেকেও এই হরমোনটি নিঃসৃত হয়।
টেস্টোস্টেরন-এর কাজ
পুরুষদেহে টেস্টোস্টেরনের কাজগুলি নিম্নরূপ।
- শুক্রাণু উৎপাদন – এটি বয়ঃসন্ধিকালে ও তার পরবর্তী সময়ে শুক্রাশয়ের সেমিনিফেরাস নালিকাতে (শুক্রোৎপাদী নালিকা) শুক্রাণু উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।
- আনুষম্পিক যৌন গ্রন্থি ও অম্লের বিকাশ – এই হরমোন পুরুষদেহে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক যৌন গ্রন্থি ও অঙ্গের বৃদ্ধি ও বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে।
- গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য – পুরুষদের বিভিন্ন গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য, যেমন — গোঁফ-দাড়ি গজানো, বাহুমূল (axilla), শ্রোণি (pubis) প্রভৃতি অঞ্চলে কেশোদ্গম এবং যৌন কেশের পুরুষ-সুলভ বিন্যাস নিয়ন্ত্রণ করে। ভারী পুরুষালি কণ্ঠস্বর সৃষ্টিতেও এই হরমোনের ভূমিকা আছে।
- পেশি ও অস্থির বৃদ্ধি – এই হরমোনের প্রভাবে বয়ঃসন্ধিকাল ও তার পরে পুরুষদেহে অস্থি, পেশি ও অন্যান্য কলাকোশে প্রোটিন সংশ্লেষ ত্বরান্বিত করে। এ ছাড়া এই হরমোনের প্রভাবে পুরুষদেহে অস্থি এবং অস্থিপেশি সুগঠিত হয়।
- বিপাক ক্রিয়া- টেস্টোস্টেরন পুরুষদেহে মৌল বিপাক হার বাড়ায়।
হরমোন হল জৈব রাসায়নিক পদার্থ যা শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। হরমোনের উৎস, কাজ এবং রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। এটি শিক্ষার্থীদের জীববিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করবে।