জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় হলো জীবদেহে বিভিন্ন অঙ্গ, তন্ত্র ও কোষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের কার্যাবলীর নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়। জীবদেহে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমেই জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ, তন্ত্র ও কোষ সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।
মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায় জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়-এ জীবদেহে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের বিভিন্ন স্তর, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বহুবিকল্পভিত্তিক, সংক্ষিপ্ত, অতিসংক্ষিপ্ত ও রোচনাধর্মী প্রশ্ন আসতে পারে।
অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির অবস্থান লেখো। এই গ্রন্থি-নিঃসৃত হরমোনগুলির নাম লেখো। অ্যাড্রেনালিনকে জরুরিকালীন হরমোন বলা হয় কেন?
অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি হল প্রাণীদেহের পাচকতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা হরমোনের নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন শারীরিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির অবস্থান
মানুষের উদরগহবরে মেরুদণ্ডের দু-পাশে অবস্থিত দুটি বৃক্ষের অগ্র বা ওপরের প্রান্তের সঙ্গে সংলগ্ন অবস্থায় একটি করে মোট একজোড়া অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি অবস্থান করে।
অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোনসমূহ
অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিটির কর্টেক্স অঞ্চল থেকে তিন ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। এগুলি হল – 1. গ্লুকোকটি কয়েড, 2. মিনারালোকটিকয়েড, 3. সেক্স স্টেরয়েড। অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির মেডালা অংশ থেকে আরও দুটি হরমোন ক্ষরিত হয়, যথা – 1. অ্যাড্রেনালিন, 2. নর-অ্যাড্রেনালিন।
অ্যাড্রেনালিন হরমোনকে জরুরিকালীন হরমোন বলার কারণ
বিশ্রামকালে বা স্বাভাবিক অবস্থায় এই হরমোন কম ক্ষরিত হয়। তবে উত্তেজনা, আবেগ, ভয়, রাগ, দুশ্চিন্তা প্রভৃতি জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলে, অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অ্যাড্রেনালিন হরমোনটি বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ও বিপাকীয় কাজ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জরুরিকালীন বা সংকটকালীন অবস্থার দ্রুত মোকাবিলা করে। এইজন্য অ্যাড্রেনালিন হরমোনকে জরুরিকালীন হরমোন বলে। জরুরিকালীন পরিস্থিতিতে অ্যাড্রেনালিন দ্রুত ক্রিয়াশীল। তবে এর প্রভাব ক্ষণস্থায়ী। জরুরিকালীন পরিস্থিতি দূর হলে, হরমোনটির ক্ষরণ কমে যায়।
ফিডব্যাক নিয়ন্ত্রণ বলতে কী বোঝ? একটি উদাহরণের সাহায্যে ফিডব্যাক নিয়ন্ত্রণ বুঝিয়ে দাও।
ফিডব্যাক নিয়ন্ত্রণ হল এমন একটি পদ্ধতি যা ব্যবহার করে নিউরনের সমন্বয় নিয়ন্ত্রণ করে এবং শারীরিক প্রতিক্রিয়াগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
ফিডব্যাক নিয়ন্ত্রণ
যখন কোনো একটি হরমোনের ক্ষরণ অপর কোনো একটি গ্রন্থির ক্ষরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ফিডব্যাক নিয়ন্ত্রণ বলে। এক্ষেত্রে নিঃসৃত হরমোনের মাত্রার বৃদ্ধি বা হ্রাসে নিয়ন্ত্রক হরমোনের মাত্রার বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে।
ফিডব্যাক নিয়ন্ত্রণের ব্যাখ্যা
সাধারণত কোনো হরমোনের ক্ষরণমাত্রা অপর একটি হরমোনের ক্ষরণমাত্রার ওপর নির্ভর করে। একে ফিডব্যাক নিয়ন্ত্রণ করা হয়। একটি উদাহরণের সাহায্যে বোঝানো হল। মানুষের রক্তে T3 ও T4 এর মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বৃদ্ধি পেলে, এগুলি মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসকে ঋণাত্মক সংকেত (negative signal) পাঠায়। তার ফলে হাইপোথ্যালামাসের TSH- RH বা TRA হরমোনের সংশ্লেষ ও ক্ষরণ ব্যাহত হয়। এর ফলে অগ্র পিটুইটারি গ্রন্থির থাইরোট্রফ নামক কোশগুলি থেকে TSH নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস পায়। একে ঋণাত্মক ফিডব্যাক (negative feedback) বলে। রক্তে TSH এর মাত্রা হ্রাস পেলে, তা থাইরয়েড গ্রন্থির ফলিকলের কোশ- গুলিতে উদ্দীপনার মাত্রা হ্রাস করে অধিকমাত্রায় T3ওT4 সংশ্লেষে বাধা দেয়। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে T3 ও T4 সংশ্লেষ ও ক্ষরণের মাত্রা হ্রাস পেলে রক্তে T3 ও T4 এর মাত্রা হাস পায়।
রক্তে T3 ও T4, এর মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে হ্রাস পেলে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশে ধনাত্মক সংকেত (positive signal) প্রেরিত হয়। তার ফলে হাইপোথ্যালামাসে TRH এর সংশ্লেষ ও ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। TRH রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে অগ্র পিটুইটারি গ্রস্থির থাইরোট্রফ নামক কোশগুলিকে উদ্দীপ্ত করে। এর ফলে TSH-এর ক্ষরণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। একে ধনাত্মক ফিডব্যাক (positive) feedback) বলে। ফলস্বরূপ রত্ত্বেও TSH এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। রক্তে TSH এর মাত্রা বৃদ্ধি পেলে থাইরয়েড গ্রন্থির ফলিকলের কোশসমূহ উদ্দীপ্ত হয়। তার ফলে T3 ও T4 সংশ্লেষ ও নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। এভাবে রক্তে T3 ও T4 এর মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়।
মানবদেহে বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির অবস্থান চিত্ সহযোগে বর্ণনা করো।
মানবদেহে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি শরীরের সমস্ত শক্তি ও কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে এবং হরমোনাল সমন্বয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
মানবদেহে বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির অবস্থান
মানবদেহে বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলির অবস্থান নীচে আলোচনা করা হল।
- পিনিয়াল গ্রন্থির অবস্থান – মানুষের অগ্রমস্তিষ্কের ডায়েনসেফালন অঞ্চলে তৃতীয় মস্তিষ্ক নিলয়ের পৃষ্ঠদেশে পিনিয়াল গ্রন্থি অবস্থান করে।
- পিটুইটারি গ্রন্থির অবস্থান – মানুষের অগ্রমস্তিষ্কের ডায়েনসেফালন অঞ্চলে হাইপোথ্যালামাস অংশের সঙ্গে পিটুইটারি গ্রন্থি ইনফান্ডিবুলাম নামক দণ্ডাকার অংশের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই গ্রন্থিটি মাথার খুলির মোনয়েড অস্থির সেলাটারসিকা প্রকোষ্ঠের মধ্যে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে।
- প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থান – মানবদেহে গ্রীবা অংশের গোড়ায় সংলগ্ন থাইরয়েড গ্রন্থির দুটি খণ্ডের প্রতিটির পৃষ্ঠদেশে ওপরে ও নীচে দুটি করে মোট চারটি প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি প্রোথিত অবস্থায় থাকে।
- থাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থান – মানুষের গ্রীবা অংশে শ্বাসনালীর গোড়ায় ও অকদেশে পরস্পর সংযুক্ত দুটি খণ্ডক নিয়ে থাইরয়েড গ্রন্থি অবস্থিত।
- অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির অবস্থান – মানুষের উদরগহ্বরে মেরুদণ্ডের দু-পাশে অবস্থিত দুটি বৃক্কের অগ্র বা ওপরের প্রান্তে সংলগ্ন অবস্থায় একটি করে মোট একজোড়া অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি অবস্থিত।
- শুক্রাশয়ের অবস্থান – পরিণত পুরুষের দেহে উদরের নিম্নাংশে ও বাইরে স্ক্রোটাম নামক থলির মতো অংশে স্পার্মাটির কর্ডের মাধ্যমে দুটি শুক্রাশয় পাশাপাশি ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে।
- ডিম্বাশয়ের অবস্থান – স্ত্রীদেহের উদরগহ্বরে জরায়ুর উভয়পার্শ্বে দুটি ডিম্বাকৃতির ডিম্বাশয় অবস্থান করে।
ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস ও ডায়াবেটিস মেলিটাসের পার্থক্য কী? উভয় রোগের দুটি করে উপসর্গ লেখো।
ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস প্রাণীদেহে ইনসুলিন উৎপাদন করে না, যা ডায়াবেটিস ইনসুলিন প্রতিস্থাপক চিকিত্সার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডায়াবেটিস মেলিটাস হল একটি মধুমেহ রোগ যা শরীরে ইনসুলিন প্রোডিউস করতে অক্ষম।
ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস ও ডায়াবেটিস মেলিটাসের পার্থক্য
বিষয় | ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস | ডায়াবেটিস মেলিটাস |
1. কারণ | ADH হরমোনকে নিষ্ক্রিয়তা বা স্বল্প ক্ষরণের ফলে এই রোগ হয়। | ইনসুলিন হরমোনের নিষ্ক্রিয়তা বা স্বল্প ক্ষরণের দরুন এই রোগ হয়। |
2.প্রধান উপসর্গ | মূত্রের পরিমাণ বেড়ে যায় ও ঘনত্ব হ্রাস পায়। দেহ থেকে প্রচুর জল বেরিয়ে জলাভাব সৃষ্টি হয় ও জল তেষ্টা বেড়ে যায়। | রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। কোশ গ্লুকোজ ব্যবহার করতে না পারায় প্রোটিন ও ফ্যাটের বিপাক ঘটে। ফলস্বরূপ দেহের ওজন হ্রাস পায়। |
উপসর্গ
- ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – পরিবেশ তার সম্পদ এবং তাদের সংরক্ষণ – জীববৈচিত্র্য এবং সংরক্ষণ – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর(বিভাগ-খ) — https://solutionwbbse.com/wp-admin/post.php?post=3767&action=edit — Update এই রোগে — 1. মূত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও ঘনত্ব হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে 24 ঘন্টায় 28-30L পর্যন্ত মূত্র নির্গত হতে পারে। উল্লেখ্য এই বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করেই সংশ্লিষ্ট হরমোনটির নামকরণ করা হয়েছে অ্যান্টি- ডাইইউরেটিক হরমোন। 2. দেহ থেকে প্রচুর জল বেরিয়ে যাওয়ায় জলাভাব সৃষ্টি হয় ও অতিরিক্ত জলতেষ্টা পায়। বারবার জলপানের ইচ্ছাকে পলিডিপসিয়া বলে।
- ডায়াবেটিস মেলিটাস – এই রোগে — 1. রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিক (রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ — (প্রতি 100 ml রক্তে 80-120mg) তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পায়। একে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলে। 2. কোশ গ্লুকোজ ব্যবহার করতে পারে না ফলে কোশের প্রোটিন ও ফ্যাটের বিপাক ঘটে ও দেহের ওজন হ্রাস পায়। 3. প্রতি 100 ml রক্তে 180 mg অপেক্ষা বেশি গ্লুকোজ থাকলে মূত্রের মাধ্যমে গ্লুকোজ নির্গত হয়। একে গ্লাইকোসুরিয়া বলে। 4. আক্রান্ত রোগীদের ঘনঘন মূত্রত্যাগ, তৃয়া, ক্ষুধা, মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া, অবসাদ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
আরও পড়ুন,
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – পরিবেশ তার সম্পদ এবং তাদের সংরক্ষণ – জীববৈচিত্র্য এবং সংরক্ষণ – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর(‘বিভাগ-খ’)
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবনের প্রবহমানতা – কোশ বিভাজন এবং কোশচক্র – অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান-জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – প্রাণীদেহে সাড়া প্রদান ও রাসায়নিক সমন্বয়-হরমোন – পার্থক্য – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
হরমোন হল প্রাণীদেহে শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য। হরমোনের অভাব বা অতিরিক্ততা হলে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই হরমোনের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি।