পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের দশম শ্রেণীর জীবন বিজ্ঞান পরীক্ষার জন্য জীবনের প্রবাহমানতা অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর নিচে দেওয়া হল। এই প্রশ্নোত্তরগুলি পরীক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বৃদ্ধি কাকে বলে? প্রকৃতি অনুযায়ী জীবের বৃদ্ধির তিনটি ধরন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
বৃদ্ধি হল একটি প্রক্রিয়া যা কোন জীবন পদার্থ বা প্রক্রিয়ার আকার, আকার ও পরিমাণের বৃদ্ধি বা বাড়াতে সক্ষম হয়।
বৃদ্ধি
যে উপচিতি বিপাকক্রিয়ায় কোশ বিভাজনের মাধ্যমে জীবদেহের আকার, আয়তন ও শুষ্ক ওজন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে বেড়ে যায়, তাকে বৃদ্ধি বলে।
জীবের বৃদ্ধির ধরন
জীবদেহের বৃদ্ধি তিনটি ভিন্ন প্রকৃতিতে হতে পারে, নীচে এই তিন প্রকার বৃদ্ধির সংজ্ঞা দেওয়া হল।
- অঙ্গজ বৃদ্ধি বা দৈহিক বৃদ্ধি – এইপ্রকার বৃদ্ধির ফলে এককোশী ভ্রূণাণু থেকে বহুকোশী পূর্ণাঙ্গ জীবদেহ সৃষ্টি হয়। উদ্ভিদের জীবনচক্রে বীজের অঙ্কুরোদ্গম, চারাগাছের সৃষ্টি, পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদদেহ সৃষ্টি পর্যন্ত সময়কালকে অঙ্গজ বা দৈহিক বৃদ্ধি বলে।
- পুনরুৎপাদনমূলক বৃদ্ধি – এইপ্রকার বৃদ্ধির ফলে জীবদেহের জীর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত স্থানগুলির নিরাময় হয় এবং দেহ পুনর্গঠিত হয়ে স্বাভাবিক আকার ধারণ করে।
- জননগত বৃদ্ধি – এইপ্রকার বৃদ্ধির দ্বারা জীবদেহের জনন-অঙ্গসমূহের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে থাকে। পরিণত উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ফুল, ফল এবং বীজ গঠনকে এবং প্রাণীদের ক্ষেত্রে জননাঙ্গ গঠন ও তাদের বৃদ্ধিকে জননগত বৃদ্ধি বলা হয়।
বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রধান তিনটি দশার নাম লেখো। এদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
বৃদ্ধি ও বিকাশ হল একই ধারণা, পরিবেশ ও জীবনপদার্থের প্রবহমানতা এবং সংক্রমণের ফলে উন্নয়ন হয়।
বৃদ্ধির প্রধান তিনটি দশা
বহুকোশী জীবের বৃদ্ধিকে প্রধান তিনটি দশায় ভাগ করা যায়। এই দশাগুলি হল — 1. কোশ বিভাজন দশা, 2. কোশীয় আকার বৃদ্ধি দশা এবং 3. কোশীয় বিভেদন দশা।
বৃদ্ধির দশাগুলির বিবরণ
বৃদ্ধির তিনটি দশা সম্পর্কে নীচে বর্ণনা করা হল।
- কোশ বিভাজন দশা- এই দশায় কোশ মূলত মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়ে নতুন কোশ উৎপন্ন করে। কোশ ফলে কোশের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। উদ্ভিদে প্রধানত অগ্রস্থ ও পার্শ্বস্থ ভাজক কলার বিভাজনের দ্বারা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বৃদ্ধি ঘটে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে এককোশী ভূণাণু থেকে মাইটোসিস বিভাজনের দ্বারা মরুলা, রাস্টুলা, গ্যাস্টুলা দশার মাধ্যমে বহুকোশী প্রাণীদেহ গঠিত হয়।
- কোশীয় আকার বৃদ্ধিকরণ দশা – এই দশায় বিভাজিত কোশগুলি জল শোষণ করে ও প্রোটোপ্লাজম সংশ্লেষ করে। ফলে কোশের আকার অপরিবর্তনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। অনেকক্ষেত্রে আকারের এই বৃদ্ধি বহিঃকোশীয় প্রকৃতির হয়। যেমন — অস্থি ও তরুণাস্থি কলাকোশ ক্ষরিত ধাত্র এই কলার আয়তন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- কোশীয় বিভেদন দশা – এই দশায় অপত্য কোশগুলির বিশেষত্ব লাভ করে। কোশগুলি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত কোশ, কলা ও কলাতন্ত্র গঠন করে। পরিবর্ধন ও বিভেদনের মাধ্যমে কোশগুলি পরিণত হয় ও ভিন্ন ভিন্নভাবে বিন্যস্ত হয়ে পৃথক পৃথক অঙ্গ সৃষ্টি করে।
মানুষের বৃদ্ধি ও বিকাশের তুলনা করো।
মানুষের বৃদ্ধি ও বিকাশের তুলনা
বিষয় | বৃদ্ধি | বিকাশ |
1. বৈশিষ্ট্য | প্রোটোপ্লাজমের নিয়ন্ত্রণাধীনে দেহের আকার,আয়তন শুষ্ক ওজনের স্থায়ী অপরিবর্তনীয়ভাবে বেড়ে যাওয়াকে বৃদ্ধি বলে। | আকার, আয়তন ও শুষ্ক ওজন বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সক্রিয়তা ও কার্যসম্পাদনে উৎকর্ষ বিকাশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বিকাশ। |
2. সম্পর্ক | বৃদ্ধি হল কারণ। | বিকাশ বৃদ্ধির ফল। |
3. ধারণা | বৃদ্ধির ধারণা কেবল দৈহিক বা শরীরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। | বিকাশের ধারণায় দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক সবই অন্তর্ভুক্ত। |
4. প্রভাবক | বৃদ্ধি স্বতঃস্ফূর্ত, তবে অনুশীলনের প্রভাব এক্ষেত্রে দেখা যায়। | পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলেই বিকাশ ঘটে অর্থাৎ ব্যক্তির সক্রিয়তা ও অনুশীলন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। |
5. সময়কাল | বৃদ্ধি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঘটে। | বিকাশ আমৃত্যু ঘটে। |
6. পরিবর্তনের ধরন | বৃদ্ধি পরিমাণগত। | বিকাশ পরিমাণগত ও গুণগত। |
মানব বিকাশের প্রধান পাঁচটি দশার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
মানব বিকাশ হল মানবদেহের বৃদ্ধি এবং মানসিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথ যা তার সম্পূর্ণতা বিবেচনায় নেওয়া হয়।
মানব বিকাশের প্রধান পাঁচটি দশা
মানব বিকাশের প্রধান পাঁচটি দশা হল – সদ্যজাত, শৈশব, বয়ঃসন্ধি, পরিণত দশা ও অন্তিম পরিণতি দশা বা বার্ধক্য।
- সদ্যজাত – জন্মের সময় থেকে শুরু করে প্রথম মাস পর্যন্ত সময়কালকে সদ্যজাত দশা বলা হয়। এই দশায় শিশু অধিকাংশ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। এইসময়ে শিশুর দেহে বিপাকের হার খুব বেশি থাকে। শিশু মায়ের মুখ, প্রাথমিক বর্ণ, আলো প্রভৃতি চিনতে পারে। এইসময়ে ওজন সামান্য হ্রাস পেলেও কিছুদিন পরে তা পুনরায় বাড়তে থাকে। কান্না হল এদের একমাত্র মনের ভাবপ্রকাশের উপায়।
- শৈশব – সাধারণত জীবনের দ্বিতীয় মাস থেকে 10 বছর বয়স পর্যন্ত সময়কালকে শৈশব বলে। এইসময়ে সদ্যজাত শিশুর তুলনায় মাথার আকার দেহের সাপেক্ষে ছোটো হয়, তবে হাত ও পায়ের বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। ধীরে ধীরে চেষ্টীয় ক্রিয়াগুলি (যেমন — লেখা, দৌড়োনো) বিকশিত হয় ও শিশুদের বৃদ্ধি, স্মৃতি ও সমস্যাসমাধানের দক্ষতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তবে এইসময়ে ভয়, আনন্দ প্রভৃতি আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও বিভিন্ন সূক্ষ্ম অনুভূতির বিকাশ ধীরে হয়।
- বয়ঃসন্ধি বা কৈশোর – শৈশব ও পরিণত দশার মধ্যবর্তী পর্যায় হল বয়ঃসন্ধি বা কৈশোর। সাধারণত 10-19 বছর (WHO অনুয়ায়ী) বয়সকালকে বয়ঃসন্ধিকাল হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে সকলের ক্ষেত্রে এই সময়কাল নির্দিষ্ট নয়। ব্যক্তি, লিঙ্গ, পরিবেশ ও অঞ্চলভেদে বয়ঃসন্ধি আগমনের সময় ভিন্ন হয়। এই পর্যায়ে ছেলেমেয়েদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক এবং প্রাক্ষোভিক দিকের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। যেমন — এইসময়ে দৈহিক বৃদ্ধি দ্রুত ঘটে। সাধারণত এইসময়ে থেকে যৌন চেতনার উন্মেষ ঘটে ও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। মনোযোগ, চিন্তাশক্তি, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও বুদ্ধির বিকাশ দ্রুত ঘটে। বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এইসব কারণে বয়ঃসন্ধিকালকে ঝড়ঝঞ্ঝার কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
- পরিণত দশা বা প্রাপ্তবয়স্ককাল – 19-60 বছর বয়সিদের পরিণত দশার অন্তর্গত বলা হয়। এইসময় দৈহিক বৃদ্ধি ক্রমশ হ্রাস পায় ও ক্রমে একেবারে বন্ধ হয়। পরিণত দশার মানুষদের নিজের ও পরিবার সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও দায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। এই পর্যায়ে মানুষদের জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাও ক্রমশ বাড়তে থাকে।
- অন্তিম পরিণতি দশা বা বার্ধক্য দশা – 60 বছর বয়সের পরবর্তী সময়কালকে অন্তিম পরিণতি দশা বা বার্ধক্য দশা বলে। এই দশায় দেহের কোশসমূহের কার্যক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে এবং ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি ক্রমশ হ্রাস পায়। অস্থি ও অস্থিসন্ধির ক্ষয়ের ফলে এইসময় অস্থিজনিত বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। এইসময়ে চুলের বর্ণ ধূসর হয় ও ত্বক কুঞ্চিত হয়। বার্ধক্য দশায় ব্যক্তিরা স্মৃতি হ্রাস, অবসাদ ও হীনমন্যতা প্রভৃতি মানসিক সমস্যার শিকার হয়।
আরও পড়ুন,
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – প্রাণীদেহে সাড়া প্রদান ও রাসায়নিক সমন্বয়-হরমোন – অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – প্রাণীদেহে সাড়া প্রদানের একটি প্রকার হিসেবে গমন – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – বংশগতি এবং কয়েকটি সাধারণ জিনগত রোগ – বংশগতি – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
বয়ঃসন্ধিকাল কাকে বলে? বয়ঃসন্ধিকালে পুরুষ ও স্ত্রীদেহে কী কী পরিবর্তন ঘটে তা লেখো।
বয়ঃসন্ধিকাল হল একটি জীবনকাল যা মানব জীবনের পর্যায়কে বোঝায় যা বয়সের সাথে সম্পর্কিত।
বয়ঃসন্ধিকাল
যে বয়সে নারী ও পুরুষের দেহে গৌণ যৌন লক্ষণগুলি প্রকাশিত হয় এবং একই সঙ্গে মুখ্য যৌনাঙ্গের অন্তঃক্ষরণধর্মী কাজ ও জননকোশের উৎপাদন শুরু হয়, সেই বয়সকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। সাধারণত 10-19 বছর বয়স পর্যন্ত সময়কাল বয়ঃসন্ধিকালের অন্তর্ভুক্ত।
বয়ঃসন্ধিকালে পুরুষ ও স্ত্রীদেহে পরিবর্তন
- পুরুষের দেহে পরিবর্তন – বয়ঃসন্ধিকালে পুরুষদের দৈহিক পরিবর্তনগুলি হল — 1. দৈহিক ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। 2. তেল ও ঘর্মক্ষরণকারী গ্রন্থির সক্রিয়তার ফলে মুখমণ্ডলে ব্রণ হয়। 3. বক্ষ, বগল, মুখমণ্ডল এবং পিউবিক অঞ্চলে লোম ও চুল গঠিত হয়। 4. পেশি ও অস্থি শক্তিশালী ও কঠিন হয়। 5. দেহের অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলির পূর্ণ বিকাশ ঘটে। 6. কণ্ঠস্বর ভারী হয়। 7. পুরুষের জননাঙ্গের পরিণতিপ্রাপ্তি ঘটে।
- স্ত্রীদেহে পরিবর্তন – বয়ঃসন্ধিকালে নারীদের দৈহিক পরিবর্তনগুলি হল — 1. দৈহিক ওজন ও উচ্চতার বৃদ্ধি ঘটে। 2. ত্বকের নীচে মেদ জমায় দেহে নমনীয় ভাব দেখা যায়। 3. স্তনগ্রন্থির বৃদ্ধি ঘটে। 4. নারীত্বের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। 5. তেল ও ঘর্মগ্রন্থির সক্রিয়তার কারণে মুখে ব্রণ গঠিত হয়। 6. পিউবিক অঞ্চলে লোম ও চুল গঠিত হয়। 7. নারীদেহে জননাঙ্গের পরিণতিপ্রাপ্তি ঘটে। 8. রজঃচক্র শুরু হয়।
বৃদ্ধি ও বিকাশ জীবের জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। বৃদ্ধি হল জীবের আকার ও ভরের পরিবর্তন, যেখানে বিকাশ হল জীবের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন। বৃদ্ধি ও বিকাশের নিয়ন্ত্রক হল জিন, হরমোন, পরিবেশগত কারণ ইত্যাদি। বৃদ্ধি ও বিকাশের গুরুত্ব অপরিসীম।