জীবের বৈশিষ্ট্যগুলি প্রজননের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বংশগতি বলে। বংশগতির মাধ্যমে জীবের বৈশিষ্ট্যগুলির স্থায়িত্ব ও পরিবর্তনের নিয়মগুলি জানা যায়। এই অধ্যায়ে, আমরা বংশগতির মৌলিক ধারণা, মেন্ডেলের বংশগতি নিয়ম, জিনগত রোগ ইত্যাদি সম্পর্কে জানব।
মেন্ডেল কর্তৃক নির্বাচিত সাত জোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য কী কী?
মেন্ডেল কর্তৃক নির্বাচিত সাত জোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য মেন্ডেল তাঁর পরীক্ষার জন্য মটর গাছের যে সাত জোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করেছিলেন তা নীচে সারণির আকারে দেখানো হল।
মেন্ডেলের সাফল্য লাভের কারণগুলি লেখো। পৃথিবীতে স্ত্রী ও পুরুষের স্বাভাবিক অনুপাত কী হওয়া উচিত?
মেন্ডেলের সাফল্য লাভের কারণ
সংকরায়ণ পরীক্ষায় মেন্ডেলের সাফল্য লাভের কারণগুলি হল — 1. মেন্ডেল তাঁর সংকরায়ণ পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট চরিত্রের খাঁটি মটর গাছ নির্বাচন করেছিলেন, যা তিনি দুই বছর ধরে অনবরত মটর গাছ চাষ ও নির্বাচন দ্বারা তৈরি করেন। 2. মেন্ডেল কর্তৃক নির্বাচিত সাত জোড়া বিপরীতধর্মী চরিত্রের জিনগুলি পৃথক পৃথক ক্রোমোজোমে বিন্যস্ত থাকায় তিনি স্বাধীন বিন্যাসের সঠিক অনুপাত পেতে সক্ষম হন। 3. মটর গাছ সহজে চাষযোগ্য, দ্রুত প্রজননক্ষম, উভলিঙ্গ ফুলবিশিষ্ট, স্বপরাগযোগ ও ইতর পরাগযোগে সক্ষম ও অনেকগুলি বিপরীতধর্মী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ায়, পরীক্ষা সম্পন্ন করতে সুবিধা হয়েছিল। 4. মেন্ডেল সাত জোড়া বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করলেও একসঙ্গে তিনি কেবল এক বা দুই জোড়া বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরীক্ষা করেন। ফলে তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণে সুবিধা হয়। 5. মেন্ডেল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষাগুলি করেন। যেমন — তিনি রেসিপ্রোকাল ক্রস দ্বারা প্রচুর অপত্য তৈরি করেন যা সঠিক অনুপাত নির্ণয়ে সাহায্য করে। তিনি সমস্ত পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেন ও তা সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে বিশ্লেষণ করেন। তিনি পরীক্ষাক্ষেত্রে বহিরাগত অবাঞ্ছিত পরাগ দ্বারা নিষেক প্রতিরোধে সম্যক ব্যবস্থা নেন।
স্ত্রী ও পুরুষের অনুপাত
মানুষের লিঙ্গ নির্ধারিত হয় পুরুষের শুক্রাণুতে অবস্থিত X ও Y ক্রোমোজোমের দ্বারা। ডিম্বাণু যদি X ক্রোমোজোমযুক্ত শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয় তাহলে স্ত্রী এবং যদি Y ক্রোমোজোমযুক্ত শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয় তাহলে পুরুষ ভ্রুণ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পুরুষদেহে উৎপাদিত শুক্রাণুর মধ্যে X ও Y ক্রোমোজোমযুক্ত শুক্রাণুর অনুপাত 1:1 তাই পৃথিবীতে স্ত্রী ও পুরুষের স্বাভাবিক অনুপাত হওয়া উচিত 1:1।
সংকর জীব কী? একটি সংকর কালো লোমযুক্ত গিনিপিগের সঙ্গে বিশুদ্ধ সাদা লোমযুক্ত গিনিপিগের সংকরায়ণ ঘটালে প্রথম অপত্য (F1) জনুর গিনিপিগগুলির ফিনোটাইপ কী হবে ও কেন—যুক্তিসহ ব্যাখ্যা করো।
সংকর জীব
দুটি বিশুদ্ধ বিপরীতধর্মী জীবের মধ্যে যৌন জনন বা পরনিষেকের ফলে উৎপন্ন জীবকে বলে সংকর জীব।
গিনিপিগের সংকরায়ণ পরীক্ষা
একটি সংকর কালো লোমযুক্ত (Bb) গিনিপিগের সঙ্গে একটি বিশুদ্ধ সাদা লোমযুক্ত (bb) গিনিপিগের সংকরায়ণ ঘটালে প্রথম অপত্য জনু (F1)-তে সৃষ্ট গিনিপিগগুলির ফিনোটাইপিক অনুপাত হবে — সংকর কালো লোম : বিশুদ্ধ সাদা লোম = 1:1।
ক্রস ও চেকার বোর্ডের সাহায্যে পরীক্ষাটি (সংকরায়ণ) নীচে দেখানো হল।
P জনুর সংকর কালো লোমযুক্ত গিনিপিগের (2n) জিনোটাইপ হল Bb। অর্থাৎ, সংকর কালো গিনিপিগের থেকে দুই প্রকার গ্যামেট (n) সৃষ্টি হবে। এগুলি হল কালো অ্যালিলযুক্ত (B) এবং সাদা অ্যালিলযুক্ত (b)। পক্ষান্তরে বিশুদ্ধ সাদা লোমযুক্ত P জনুর বিপরীত লিঙ্গের গিনিপিগটির (2n) জিনোটাইপ হল bb। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র একপ্রকার অ্যালিল থাকায় উৎপন্ন গ্যামেট (n) একরকমই হবে। এটি হল সাদা অ্যালিলযুক্ত (b)। চেকারবোর্ডে সংকর কালো গিনিপিগের B এবং b গ্যামেটের বিপরীতে সাদা লোমের গিনিপিগের (b) গ্যামেট স্থাপিত করলে দেখা যায় (চেকার বোর্ড লক্ষণীয়) কেবল দুই প্রকার গিনিপিগ F1 জনুতে উৎপন্ন হবে। কালো অ্যালিলযুক্ত (B) গ্যামেট এবং সাদা অ্যালিলযুক্ত (b) গ্যামেটের মিলনে F1 জনুতে 50% গিনিপিগ কালো ফিনোটাইপযুক্ত হবে (যদিও তা সংকর কালো বা Bb জিনোটাইপবিশিষ্ট)। P জনুর সংকর কালো গিনিপিগের সাদা অ্যালিলযুক্ত (b) গ্যামেটটি P জনুর সাদা গিনিপিগের থেকে উৎপন্ন b গ্যামেটের সঙ্গে মিলিত হলে F2 জনুতে বাকি 50% গিনিপিগ সাদা ফিনোটাইপযুক্ত হবে (বিশুদ্ধ সাদা বা bb জিনোটাইপযুক্ত)।
গিনিপিগের কালো লোম প্রকট ও সাদা লোম প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য। দুটি সংকর কালো গিনিপিগের সংকরায়ণের ফলাফল চেকার বোর্ডের সাহায্যে দেখাও। মানুষের ক্ষেত্রে কন্যাসন্তান সৃষ্টিতে কীপ্রকার জননকোশের মিলন ঘটে?
সংকর কালো গিনিপিগের সংকরায়ণ
ধরা যাক, গিনিপিগের কালো লোমের অ্যালিল = B ; সাদা লোমের অ্যালিল = b।
সংকর কালো লোমযুক্ত গিনিপিগ থেকে কালো (B) ও সাদা (b)এই দুই প্রকার অ্যালিলযুক্ত গ্যামেট উৎপন্ন হয়। সংকর কালো লোমযুক্ত দুটি গিনিপিগের মধ্যে জনন ঘটানো হলে F1 জনুতে সৃষ্ট গিনিপিগের তিনভাগ কালো ও একভাগ সাদা হয়। আবার তিনভাগ কালো গিনিপিগের মধ্যে একভাগ বিশুদ্ধ কালো (BB) ও দুইভাগ সংকর কালো (Bb) হয়।
নীচে ক্রস ও চেকার বোর্ডের সাহায্যে সংকর কালো গিনিপিগের সংকরায়ণ দেখানো হল। দুটি সংকর কালো গিনিপিগের সংকরায়ণের ফলাফল — জিনোটাইপিক অনুপাত হল — বিশুদ্ধ কালো : সংকর কালো : বিশুদ্ধ সাদা = 1 : 2 : 1 এবং ফিনোটাইপিক অনুপাত হল কালো সাদা = 3 : 1
কন্যাসন্তান সৃষ্টি
মানুষের ক্ষেত্রে স্ত্রীদেহের ডিম্বাণুর 22টি অটোজোম ও একটি যৌন (X) ক্রোমোজোম এবং পুরুষের শুক্রাণুর 22টি অটোজোম ও একটি যৌন (X) ক্রোমোজোমের মিলনে কন্যাসন্তান সৃষ্টি হয়। কন্যাসন্তানের জিনোটাইপ হল – 44A + XX।
প্রাণীদের ক্ষেত্রে (গিনিপিগের) দ্বিসংকর জননের পরীক্ষা ও তা থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত বর্ণনা করো।
গিনিপিগের দ্বিসংকর জনন পরীক্ষা
একসংকর জনন পরীক্ষার মতো দ্বিসংকর জনন পরীক্ষার ক্ষেত্রেও, প্রাণীর ওপরে তা করা হলে মেন্ডেলের সূত্রের সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে গিনিপিগের ওপর দ্বিসংকর জনন পরীক্ষাটি আলোচনা করা হল। এক্ষেত্রে বিবেচ্য চরিত্র দুটি হল গায়ের লোমের বর্ণ ও লোমের দৈর্ঘ্য। গায়ের লোমের বর্ণ চরিত্রটির অন্তর্গত ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্য দুটি হল কালো ও সাদা বর্ণ। অপরদিকে লোমের দৈর্ঘ্য চরিত্রটির অন্তর্গত ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্য দুটি হল খর্ব লোম ও দীর্ঘ লোম।
প্রথম অপত্য জনু – একটি হোমোজাইগাস তথা বিশুদ্ধ কালো ও খর্ব লোমযুক্ত গিনিপিগের সঙ্গে একটি হোমোজাইগাস তথা বিশুদ্ধ সাদা ও দীর্ঘ লোমযুক্ত গিনিপিগের মধ্যে যৌন জনন ঘটানো হলে প্রথম অপত্য জনুতে (F1 জনু) যেসব গিনিপিগ জন্ম নেয় সেগুলি সবই কালো ও খর্ব লোমযুক্ত (সংকর) হয়, যেহেতু এই বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকট।
দ্বিতীয় অপত্য জনু – F1 জনুর এই সংকর কালো খর্ব লোমযুক্ত একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী গিনিপিগের মধ্যে যৌন জনন ঘটানো হলে দ্বিতীয় অপত্য জনু বা F2 জনুতে যতগুলি (16 প্রকার) গিনিপিগ জন্ম নেয় সেগুলি চার প্রকার ফিনোটাইপযুক্ত হয়। এগুলি হল — কালো ও খর্ব = 9, কালো ও দীর্ঘ = 3, সাদা ও খর্ব = 3 এবং সাদা ও দীর্ঘ = 1। অর্থাৎ, F2 জনুর ফিনোটাইপিক অনুপাত – 9 : 3 : 3 : 1। 9 প্রকার জিনোটাইপযুক্ত গিনিপিগ 1 : 2 : 2 : 4 : 1 : 2 : 1 : 2 : 1 অনুপাতে সৃষ্টি হয়।
ব্যাখ্যা – F1 জনুতে সৃষ্ট গিনিপিগগুলির প্রতিটিতে গ্যামেট সৃষ্টির সময়ে মিয়োসিস কোশ বিভাজন ঘটে। এর ফলে চার প্রকার জিনোটাইপবিশিষ্ট পুংগ্যামেট ও স্ত্রীগ্যামেট উৎপন্ন হয় (BS, Bs, bS, bs)। এই চার প্রকারের পুংগ্যামেট চার প্রকারের স্ত্রীগ্যামেটের সঙ্গে স্বাধীনভাবে মিলিত হতে পারে। ফলে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের সমন্বয় সৃষ্টি হয়। এই সমন্বয়গুলি চেকার বোর্ডের মাধ্যমে দেখানো হল।
সিদ্ধান্ত
মেন্ডেল মটর গাছের ক্ষেত্রে দ্বিসংকর জননের পরীক্ষায় যে ফলাফল পেয়েছিলেন, গিনিপিগের ক্ষেত্রেও একই ফলাফল পাওয়া যায়, অর্থাৎ স্বাধীন বিন্যাসের সূত্র গিনিপিগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
মানুষের লিঙ্গ নির্ধারণ কীভাবে হয়?
মানুষের লিঙ্গ নির্ধারণ
মানুষের লিঙ্গ নির্ধারণ দুটি স্তরে নিয়ন্ত্রিত হয়, যথা — প্রাথমিক লিঙ্গ নির্ধারণ ও গৌণ লিঙ্গ নির্ধারণ। প্রাথমিক লিঙ্গ নির্ধারণ নির্ভর করে যৌন ক্রোমোজোমের প্রকৃতির ওপর। পক্ষান্তরে, যৌন হরমোনের দ্বারা গৌণ লিঙ্গ নির্ধারিত হয়।
প্রাথমিক লিঙ্গ নির্ধারণ – মানুষের দেহকোশে 23 জোড়া হোমোলোগাস ক্রোমোজোম বা 46টি ক্রোমোজোম থাকে। এর মধ্যে ২টি ক্রোমোজোম লিঙ্গ নির্ধারণ করে বলে তাদের যৌন ক্রোমোজোম বা সেক্স ক্রোমোজোম বা অ্যালোজোম বলা হয়। অন্যান্য ক্রোমোজোমগুলি বিভিন্ন দেহজ বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে বলে তাদের অটোজোম বলে। স্ত্রীদেহে যৌন ক্রোমোজোম দুটি অঙ্গসংস্থানগতভাবে একই প্রকারের হয়, এদেরকে X ক্রোমোজোম বলা হয়। কিন্তু পুরুষদের যৌন ক্রোমোজোম-দুটি ভিন্ন প্রকৃতির হয়। এদের একটিকে X ক্রোমোজোম, অপরটিকে Y ক্রোমোজোম বলা হয়। স্ত্রীদেহের ক্রোমোজোম বিন্যাস — 44A + XX এবং পুরুষদেহের ক্রোমোজোম বিন্যাস — 44A + XY পুরুষের দেহে শুক্রাশয় থেকে উৎপন্ন শুক্রাণুগুলি দুই প্রকারের-22A + Y (অ্যান্ড্রোস্পার্ম) এবং 22A + X (গাইনোস্পার্ম)। কিন্তু স্ত্রীদেহের ডিম্বাশয় থেকে উৎপন্ন ডিম্বাণু একপ্রকারের-22A + X। এই কারণে পুরুষকে হেটেরোগ্যামেটিক এবং স্ত্রীকে হোমোগ্যামেটিক লিঙ্গ বলা হয়। ডিম্বাণু যদি অ্যান্ড্রোস্পার্ম দ্বারা নিষিক্ত হয়। তাহলে সেই ভ্রূণ পুরুষরূপে (44A + XY) বিকাশ লাভ করে। অপরপক্ষে কোনো ডিম্বাণু যদি গাইনোস্পার্ম দ্বারা নিষিক্ত হয় তাহলে সেই ভ্রূণ স্ত্রী-রূপে (44A + XX) বিকাশ লাভ করে।
গৌণ লিঙ্গ নির্ধারণ – প্রাথমিকভাবে লিঙ্গ নির্ধারিত হওয়ার পরে বিভিন্ন প্রকার পুরুষ ও স্ত্রী যৌন হরমোনের প্রভাবে যথাক্রমে পুরুষ ও স্ত্রী গৌণ যৌন লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়।
বংশগতি হলো একটি জটিল প্রক্রিয়া যা আমাদের জীবনকে অনেক উপায়ে প্রভাবিত করে। এই বিষয়টি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যাতে আমরা আমাদের নিজেদের এবং আমাদের পরিবারের স্বাস্থ্যের জন্য সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারি।