এখনই আমাদের Telegram Community গ্রুপে যোগ দিন। এখানে WBBSE বোর্ডের পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির যেকোনো বিষয়ভিত্তিক সমস্যা শেয়ার করতে পারেন এবং একে অপরের সাহায্য করতে পারবেন। এছাড়া, কোনও সমস্যা হলে আমাদের শিক্ষকরা তা সমাধান করে দেবেন।

Telegram Logo Join Our Telegram Community

নবম শ্রেণী – ভূগোল – আবহবিকার – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

এই আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায়, ‘আবহবিকার’-এর রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করা হবে। এই প্রশ্নোত্তরগুলি নবম শ্রেণীর ভূগোলের পাঠ্যক্রমভিত্তিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই অধ্যায় থেকে প্রায়শই মূল ধারণাভিত্তিক প্রশ্ন আসে।

নবম শ্রেণী - ভূগোল - আবহবিকার - রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
নবম শ্রেণী – ভূগোল – আবহবিকার – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
Contents Show

আবহবিকার কাকে বলে? বিভিন্ন ধরনের আবহবিকার সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

আবহবিকার (Weathering) – আবহাওয়ার অন্তর্গত বিভিন্ন উপাদানের (উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুমণ্ডলীয় অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রভৃতি) দ্বারা যান্ত্রিকভাবে ভূপৃষ্ঠস্থ শিলার বিচূর্ণীকরণ কিংবা রাসায়নিকভাবে বিয়োজনকে আবহবিকার (Weathering) বলা হয়।

বিভিন্ন ধরনের আবহবিকার
বিভিন্ন ধরনের আবহবিকার

যান্ত্রিক আবহবিকার (Physical Weathering) –

ভূপৃষ্ঠস্থ যাবতীয় শিলা যখন উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, প্রবহমান জলধারা, বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহ প্রভৃতির দ্বারা বিচূর্ণীকৃত হয়, তাকেই যান্ত্রিক আবহবিকার (Physical Weathering) বলে।

প্রভাবিত অঞ্চল – পৃথিবীর উষ্ণ মরু অঞ্চল, শীতল মেরু অঞ্চল, কিংবা শুষ্ক ও শীতল নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে যান্ত্রিক আবহবিকার দেখা যায়।

পদ্ধতি – সূর্যতাপ, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত প্রভৃতির দ্বারা ক্ষুদ্রকণা বিসরণ, প্রস্তর চাঁই খণ্ডীকরণ, শল্কমোচন, কেলাস গঠন প্রভৃতি প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠস্থ শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আবহবিকারগ্রস্ত হয়।

রাসায়নিক আবহবিকার (Chemical Weathering) –

ভূপৃষ্ঠস্থ যাবতীয় শিলা বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাইঅক্সাইড, অক্সিজেন, জলীয় বাষ্প প্রভৃতির দ্বারা যখন বিয়োজিত হয়, তাকে রাসায়নিক আবহবিকার (Chemical Weathering) বলে।

প্রভাবিত অঞ্চল – পৃথিবীর উষ্ণ আর্দ্র নিরক্ষীয় জলবায়ু ও আর্দ্র নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে রাসায়নিক আবহবিকার দেখা যায়।

পদ্ধতি – এখানে বায়ুমণ্ডলীয় অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, জলীয় বাষ্প প্রভৃতির দ্বারা জারণ, অঙ্গারযোজন, আর্দ্রবিশ্লেষণ, দ্রবণ প্রভৃতি পদ্ধতিতে ভূপৃষ্ঠের যাবতীয় শিলা বিয়োজিত হয়ে রাসায়নিক আবহবিকারগ্রস্ত হয়।

জৈব আবহবিকার (Organic Weathering) –

বিভিন্ন জীবজন্তু কিংবা উদ্ভিদগোষ্ঠীর দ্বারা ভূপৃষ্ঠের যাবতীয় শিলা বিচূর্ণীকৃত কিংবা বিয়োজিত হলে, তাকে জৈব আবহবিকার (Organic Weathering) বলে।

প্রভাবিত অঞ্চল – পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জলবায়ু অঞ্চলেই (উষ্ণ মরু ও মেরু জলবায়ু বাদে) জৈব আবহবিকার দেখা যায়।

পদ্ধতি – কেঁচো, ইঁদুর, উই, খরগোশ প্রভৃতি প্রাণীরা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে কিংবা উদ্ভিদের পচন কিংবা উদ্ভিদের শিকড় কর্তৃক শিলা আবহবিকারগ্রস্ত হয়।

যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রক্রিয়াগুলি সংক্ষেপে লেখো।

অথবা, যান্ত্রিক আবহবিকারের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি আলোচনা করো।

যান্ত্রিক বা ভৌত আবহবিকার (Mechanical or Physical Weathering) – উষ্ণতার তারতম্য, আর্দ্রতা ও শুষ্কতার পার্থক্য, শিলাস্তরে চাপের প্রভেদ, তুষার ও লবণের কেলাস গঠন, জৈবিক কার্যকলাপ ইত্যাদির প্রভাবে শিলার আবহবিকার ঘটলে, তাকে যান্ত্রিক বা ভৌত আবহবিকার বলে। যান্ত্রিক আবহবিকারে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয় এবং পরিশেষে মৃত্তিকায় পরিণত হয়।

যান্ত্রিক আবহবিকারের পদ্ধতিসমূহ ও সৃষ্ট ভূমিরূপ –

তাপীয় প্রসারণ, কেলাসন প্রক্রিয়া, শিলাস্তরের চাপ হ্রাসজনিত প্রক্রিয়া, বৃষ্টিপাতের ক্রিয়া, কলয়েড উৎপাটন এবং কলিকরণ ইত্যাদি পদ্ধতির দ্বারা যান্ত্রিক আবহবিকার সংঘটিত হয়।

তাপীয় প্রসারণ –

প্রস্তর চাঁই খণ্ডীকরণ (Block Disintegration) –

  • সংজ্ঞা – উষ্ণতার তারতম্যের কারণে সৃষ্ট প্রসারণ ও সংকোচন বলের প্রভাবে শিলাস্তর যখন বড়ো বড়ো চাঁই -এর আকারে ভেঙে যায়, তখন তাকে প্রস্তর চাঁই খণ্ডীকরণ বলে।
  • প্রক্রিয়া – দিনের বেলা প্রখর সূর্যতাপে শিলাস্তর উষ্ণ হয়ে প্রসারিত হয় এবং রাতের বেলা তাপ বিকিরণ করে সংকুচিত হয়ে পড়ে। এইভাবে, প্রতিনিয়ত অসম প্রসারণ ও সংকোচনের কারণে শিলাস্তরে ব্যাপক পীড়নের সৃষ্টি হয়। পীড়ন নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে শিলাস্তরে অসংখ্য উল্লম্ব ও সমান্তরাল ফাটলের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে, এই ফাটল বরাবর বড়ো বড়ো চাঁই মূল শিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
  • উদাহরণ – মরু বা মরুপ্রায় অঞ্চলে পাললিক শিলা ও ব্যাসল্ট শিলায় এই আবহবিকার অধিক দেখা যায়।
প্রস্তর চাঁই খণ্ডীকরণ (Block Disintegration)
প্রস্তর চাঁই খণ্ডীকরণ (Block Disintegration)

শল্কমোচন (Exfoliation) –

  • সংজ্ঞা – ‘শল্ক’ শব্দের অর্থ ‘পেঁয়াজের খোসা’, এবং ‘মোচন’ -এর অর্থ ‘ত্যাগ’। উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে যখন কোনো শিলার উপরের স্তরটি পেঁয়াজের খোসার মতো খুলে যায়, তখন তাকে শল্কমোচন বলে।
  • প্রক্রিয়া – একই জাতীয় খনিজ দ্বারা গঠিত সমসত্ত্ব শিলার স্তরগুলি যদি সমকেন্দ্রিক হয় তাহলে দিনেরবেলা সূর্যতাপে উপরের স্তরটি ভিতরের স্তরগুলির তুলনায় অধিক উষ্ণ ও প্রসারিত হয় এবং রাতে অধিক শীতল ও সংকুচিত হয়। দীর্ঘ দিন ধরে এভাবে সংকোচন ও প্রসারণের ফলে উপরের স্তরটি পেঁয়াজের খোসার মতো খুলে যায়। এর ফলে, শিলার আকৃতি গোলাকার বা উপগোলাকার হয় বলে শল্কমোচনকে গোলাকার বা উপগোলাকার (Spheroidal) আবহবিকার বলে।
  • উদাহরণ – গ্রানাইট শিলায় এই আবহবিকার অধিক দেখা যায়। তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরমের ‘কৃষ্ণ ভেন্নাই পান্ধ’ নামক বিখ্যাত গ্রানাইট গম্বুজটি এভাবে সৃষ্ট।
শল্কমোচন (Exfoliation)
শল্কমোচন (Exfoliation)

ক্ষুদ্রকণা বিসরণ (Granular Disintegration) –

  • সংজ্ঞা – দিন ও রাতের উষ্ণতার তারতম্যের কারণে সৃষ্ট সংকোচন ও প্রসারণের প্রভাবে যখন কোনো শিলা ফেটে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়, তখন তাকে ক্ষুদ্রকণা বিসরণ বলে।
  • প্রক্রিয়া – বিভিন্ন খনিজ দ্বারা গঠিত বিষমসত্ত্ব শিলার বিভিন্ন খনিজগুলি উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে ভিন্ন ভিন্ন হারে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। এইভাবে, বারংবার অসম সংকোচন ও প্রসারণের ফলে শিলাটি বিভিন্ন খনিজের সংযোগ বরাবর সশব্দে ফেটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় ভেঙে যায়।
  • উদাহরণ – থর, সাহারা, কালাহারি প্রভৃতি মরুভূমিতে সূর্যাস্তের পর প্রায়ই পিস্তলের গুলি ছোড়ার মতো শব্দ করে শিলা ফেটে যায়।
ক্ষুদ্রকণা বিসরণ (Granular Disintegration)
ক্ষুদ্রকণা বিসরণ (Granular Disintegration)

গন্ডশিলা বিদারণ (Boulder Cleaving) –

অনেক সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত শিলার মধ্যে থাকা কোনো বড়ো বোল্ডারের অর্ধেক অংশ ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত থাকলে ওই অংশ তাপের প্রভাবে ভেঙে গিয়ে ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এই পদ্ধতিকে গন্ডশিলা বিদারণ (Boulder Cleaving) বলে।

গন্ডশিলা বিদারণ (Boulder Cleaving)
গন্ডশিলা বিদারণ (Boulder Cleaving)

ডার্ট ক্র্যাকিং (Dart Cracking) –

শিলাস্তরের ফাটলের মধ্যস্থিত পদার্থসমূহ সূর্যতাপে উত্তপ্ত ও প্রসারিত হলে ফাটলরেখা বরাবর শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়, একে ডার্ট ক্র্যাকিং (Dart Cracking) বলে।

কেলাসন প্রক্রিয়া –

কেলাসন প্রক্রিয়া দুভাবে সংঘটিত হয় – তুষার কেলাস গঠন এবং লবণ কেলাস গঠন।

তুষার কেলাস গঠন বা তুষার কার্য –

  • তুহিন খণ্ডীকরণ বা তুষার কীলক গঠন – পার্বত্য অঞ্চলে বৃষ্টির জল শিলাস্তরের ফাটলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে শৈত্যের প্রভাবে তা বরফে পরিণত হয়। জল জমে বরফে পরিণত হলে তা আয়তনে শতকরা দশভাগ বেড়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শিলাস্তরে প্রবিষ্ট তীক্ষ্ণমুখী বরফের ফলাকে তুষার কীলক বলে। এর ফলে ফাটলের দুপাশের শিলাস্তরে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি করে। এই চাপের প্রভাবে ফাটল ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং শেষে শিলাস্তর ফেটে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোণযুক্ত শিলাখণ্ডের সৃষ্টি হয়। ওই প্রস্তরখণ্ডগুলি পর্বতের পাদদেশ বরাবর সমান্তরালভাবে জমা হলে, তাকে ফেলসেনমার বা ব্লকস্পেড (Felsenmer or Blockspade) বলা হয়। আবার, ওই প্রস্তরখণ্ডগুলি পর্বতের গা বরাবর উপর-নীচে অর্থাৎ, উল্লম্বভাবে সঞ্চিত হলে, তাকে স্ক্রি বা ট্যালাস (Scree or Tallus) বলে।
  • হিমায়িত স্ফীতি – নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে বৃষ্টির জল সচ্ছিদ্র মৃত্তিকার মধ্যে ঢুকলে শীতকালে তা শৈত্যের প্রভাবে বরফে পরিণত হয়। এর ফলে, স্ফীত বরফের চাপে মাটি ফেটে যে আবহবিকার সংঘটিত হয়, তাকে হিমায়িত স্ফীতি বলে। এরকম ঘটনা ঘটলে চাষ আবাদের পক্ষে বিশেষ সুবিধা হয়।
তুষার কেলাস গঠন বা তুষার কার্য
তুষার কেলাস গঠন বা তুষার কার্য

লবণ কেলাস গঠন –

শুষ্ক অঞ্চলে ভৌমজলে দ্রবীভূত লবণ কৈশিক প্রক্রিয়ায় উপরে উঠে আসে এবং শিলাস্তরের ফাটলে লবণের কেলাস গঠিত হয়। ফলে, প্রচণ্ড চাপে শিলা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, একে লবণ কেলাস গঠন বলে।

চাপ হ্রাসজনিত প্রক্রিয়া –

শিলার উপরের চাপ হ্রাস পেলে শিলা প্রসারিত হয় এবং ফেটে যায়। কোনো শিলার ভূপৃষ্ঠের সমান্তরাল ফাটলের মাধ্যমে পাতলা পাতলা পাতের আকারে ভেঙে  যাওয়াকে শিটিং (Sheeting) বলে। পাতলা পাতের পরিবর্তে টুকরো টুকরো খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়াকে স্প্যালিং (Spalling) বলে।

চাপ হ্রাসজনিত প্রক্রিয়া
চাপ হ্রাসজনিত প্রক্রিয়া

বৃষ্টিপাতের ক্রিয়া –

  1. বৃষ্টিপাতের ফলে বিভিন্নভাবে যান্ত্রিক আবহবিকার হয়ে থাকে। যথা –
  2. কোমল শিলাস্তর দীর্ঘকাল ধরে বৃষ্টির ফোঁটার আঘাতে দুর্বল হয়ে ভেঙে যায়
  3. অনেক সময় শিলার মধ্যস্থিত খনিজ পদার্থ রাসায়নিক বিক্রিয়া ছাড়াই বৃষ্টির জলের সংস্পর্শে আয়তনে বেড়ে যায় এবং অবশেষে ভেঙে যায়
  4. শিলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রগুলি বৃষ্টির জলে ভরে যায়, আবার সূর্যের তাপে শুকিয়েও যায়। ক্রমাগত আর্দ্রতা ও শুষ্কতার পরিবর্তনে শিলা টুকরো টুকরো হয়ে যায়
  5. মরু অঞ্চলে অতি উষ্ণ শিলার উপর হঠাৎ বৃষ্টির জল পড়লে শিলা সংকুচিত হয় ও ফেটে যায়।

কলয়েড উৎপাটন (Coloid Plucking) –

‘কলয়েড’ শব্দের অর্থ ‘আঠা’। খনিজ ও জৈব সংমিশ্রণে সৃষ্ট মাটির একপ্রকার আঠালো উপাদান হল ‘কলয়েড’। এই কলয়েড ধর্মের জন্য শিলার গায়ে লেগে থাকা মাটি শুকিয়ে পড়ে যাওয়ার সময় শিলার গা থেকে কিছু অংশ উৎপাটন করে, একে কলয়েড উৎপাটন (Coloid Plucking) বলে।

কলিকরণ (Slaking) –

সমুদ্র উপকূল বরাবর পর্যায়ক্রমে জোয়ার-ভাটা বা সমুদ্রতরঙ্গের প্রভাবে শিলা আর্দ্র এবং সূর্যতাপে শুষ্ক হয়। ফলে, শিলাস্তরে অসম টান বা পীড়নের সৃষ্টি হয় ও শিলা ফেটে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এই আবহবিকার প্রক্রিয়াটি কলিকরণ নামে পরিচিত।

বুদবুদজনিত আবহবিকার –

শিলার ফাটলের মধ্যে জলের বুদবুদ প্রবেশ করে ফেটে গেলে তা শিলাস্তরে প্রচন্ড চাপ দিয়ে শিলাকে ফাটিয়ে দেয়।

অন্যান্য যান্ত্রিক আবহবিকার –

ক্রমান্বয়ে শিলা আর্দ্র ও শুষ্ক হওয়ার ফলে, মরু অঞ্চলে প্রচণ্ড উত্তপ্ত শিলার উপর হঠাৎ বৃষ্টির জল পড়লে, দাবানলের প্রচণ্ড তাপে, বৃহৎ উল্কাপিণ্ডের সংঘাতে শিলাস্তর ফেটে গিয়ে আবহবিকারপ্রাপ্ত হয়।

রাসায়নিক আবহবিকার কাকে বলে? প্রধান চার প্রকার রাসায়নিক আবহবিকারের বর্ণনা দাও।

রাসায়নিক আবহবিকার – যে প্রক্রিয়ায় জল, অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, জলীয় বাষ্প ও বিভিন্ন অম্লের প্রভাবে শিলা বিয়োজিত হয়ে রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয়, তাকে রাসায়নিক আবহবিকার বলে।

প্রধান চার প্রকার রাসায়নিক আবহবিকারের বর্ণনা –

জারণ (Oxidation) –

সংজ্ঞা – শিলা গঠনকারী খনিজের সঙ্গে অক্সিজেনের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে জারণ বা অক্সিডেশান বলে।

প্রক্রিয়া – সাধারণত লোহাযুক্ত শিলায় জারণ ঘটে থাকে। লোহা যখন ফেরাস অক্সাইডরূপে শিলার মধ্যে অবস্থান করে তখন তা ভীষণ কঠিন, কিন্তু জারণ প্রক্রিয়ায় তা যখন ফেরিক অক্সাইডে পরিণত হয় তখন সহজেই শিলা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। শিলার উপর হলদে-বাদামি ছোপ দেখা যায়, একে মরচে বলে। ফেরাস অক্সাইড এই প্রক্রিয়ায় লিমোনাইটে পরিণত হয়।

বিক্রিয়া –

4FeO + O₂ → 2Fe₂O₃
ফেরাস অক্সাইড + অক্সিজেন → ফেরিক অক্সাইড

4FeO + 3H₂O + O₂ → 2Fe₂O₃, 3H₂O
ফেরাস + জল + অক্সিজেন → লিমোনাইট অক্সাইড

অঙ্গারযোজন (Carbonation) –

সংজ্ঞা – শিলা গঠনকারী খনিজের সঙ্গে কার্বন ডাইঅক্সাইডের সংযোগকে অঙ্গারযোজন বা কার্বনেশান বলে।

প্রক্রিয়া – বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO₂) বৃষ্টির জলের (H₂O) সঙ্গে মিশে মৃদু কার্বনিক অ্যাসিড (H₂CO₃) সৃষ্টি হয়। এই অ্যাসিডবৃষ্টি ভূপৃষ্ঠে চুনাপাথর, ডলোমাইট, ক্যালসাইট প্রভৃতি শিলাকে সহজেই রাসায়নিকভাবে বিয়োজিত করে দেয়। যেমন ক্যালশিয়াম কার্বনেট ক্যালশিয়াম বাইকার্বনেটে পরিণত হয়, যা অতি দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

বিক্রিয়া –

CO₂ + H₂O → H₂CO₃
CaCO₃ + H₂CO₃→ Ca(HCO₃)₂
ক্যালশিয়াম + কার্বনিক → ক্যালশিয়াম
কার্বনেট অ্যাসিড বাইকার্বনেট

জলযোজন (Hydration) –

সংজ্ঞা – শিলা গঠনকারী খনিজের সঙ্গে জলযুক্ত হয়ে শিলা বিয়োজিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে জলযোজন বা হাইড্রেশান বলে।

প্রক্রিয়া – শিলা মধ্যস্থ খনিজে আণবিক বিশুদ্ধ জল প্রবেশ করলে রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয় এবং ওই শিলার গঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে, শিলাটি সহজেই আবহবিকারপ্রাপ্ত হয়। অনার্দ্র ক্যালশিয়াম সালফেট জলযোজনের ফলে ভঙ্গুর জিপসামে পরিণত হয়। হেমাটাইট ভঙ্গুর লিমোনাইটে পরিণত হয়।

বিক্রিয়া –

CaSO4 + 2H₂O → CaSO4, 2H₂O
ক্যাসশিয়াম + জল → জিপসাম সালফেট

2Fe2O3 + 3H2O → 2Fe2O3, 3H₂O
হেমাটাইট + জল → লিমোনাইট

আর্দ্র বিশ্লেষণ (Hydrolysis) –

সংজ্ঞা – শিলা মধ্যবর্তী খনিজ ও জলের অণুর একসঙ্গে বিয়োজন ও বিক্রিয়াকে আর্দ্র বিশ্লেষণ বা হাইড্রোলিসিস বলে।

প্রক্রিয়া – জলের অণু বিয়োজিত হয়ে যে হাইড্রোজেন আয়ন (H+) ও হাইড্রক্সিল আয়ন (OH−) গঠন করে, তা শিলা গঠনকারী খনিজের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নের সঙ্গে বিক্রিয়া ও আয়ন বিনিময় করে আবহবিকার ঘটায়। সাধারণত ফেল্ডসপার ও অভ্রের উপর এই প্রক্রিয়া বিশেষভাবে কার্যকরী হয়।

বিক্রিয়া –

KAISi3O8 + HOH → HAISi3O8 + KOH
আর্থক্লেজ + জল → অ্যালুমিনো পটাশিয়াম ফেল্ডসপার সিলেসিক অ্যাসিড হাইড্রক্সাইড

দ্রবণ (Solution) – রাসায়নিক আবহবিকারের একটি অন্যতম প্রক্রিয়া হল দ্রবণ বা সলিউশন। বেশ কিছু নরম শিলা খনিজ, যেমন – জিপসাম, হ্যালাইট, সৈন্ধব লবণ প্রভৃতি জলের সংস্পর্শে এসে সহজেই দ্রবীভূত হয়ে যায়, একে দ্রবণ বলে। এর ফলে, শিলার রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন ঘটে।

জৈব আবহবিকার কাকে বলে? জৈব আবহবিকার কী কী পদ্ধতিতে সংঘটিত হয়?

অথবা, জৈব আবহবিকার একই সঙ্গে যান্ত্রিক এবং রাসায়নিক – প্রমাণ করো।

সংজ্ঞা – জীবজগৎ দ্বারা যান্ত্রিক ও রাসায়নিক পদ্ধতিতে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ ও বিয়োজিত হলে, তাকে জৈব আবহবিকার বলে।

পদ্ধতি – জৈব আবহবিকার প্রধানত দুটি পদ্ধতিতে সংঘটিত হয়। যথা – জৈব-যান্ত্রিক আবহবিকার, জৈব- রাসায়নিক আবহবিকার।

জৈব-যান্ত্রিক আবহবিকার (Bio-Mechanical Weathering) –

জৈব-যান্ত্রিক আবহবিকার আবার তিন ভাগে বিভক্ত। যথা – উদ্ভিদ দ্বারা সৃষ্ট জৈব-যান্ত্রিক আবহবিকার, প্রাণীদের দ্বারা সৃষ্ট জৈব-যান্ত্রিক আবহবিকার এবং মানুষের বিভিন্ন কার্যাবলি।

  • উদ্ভিদ দ্বারা সৃষ্ট জৈব-যান্ত্রিক আবহবিকার – শিলাস্তরের উপর কোনো গাছপালা জন্মালে ওই গাছপালার শিকড় শিলার মধ্যস্থিত ফাটলের মধ্যে প্রবেশ করে শিলাস্তরকে ফাটিয়ে দেয়। এর ফলে, শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মূল শিলাস্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
  • প্রাণীদের দ্বারা সৃষ্ট জৈব-যান্ত্রিক আবহবিকার – কেঁচো, ছুঁচো, ইঁদুর, খরগোশ, প্রেইরী কুকুর ইত্যাদি প্রাণী এবং নানা প্রকার কীটপতঙ্গ শিলার উপর গর্ত খুঁড়ে শিলার আবহবিকারে সাহায্য করে।
  • মানুষের বিভিন্ন কার্যাবলি – রাস্তা নির্মাণ, কৃষিকাজ, খনিজ দ্রব্য উত্তোলন, বৃক্ষচ্ছেদন -এর ফলেও শিলায় আবহবিকার হয় এবং এর ফলে শিলা বিচূর্ণও হয়ে থাকে।
  • জৈব-রাসায়নিক আবহবিকার (Bio-Chemical Weathering) – শিলার উপর অনেক সময় মস্, লিচেন, শৈবাল ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ জমে থাকে। এরা শিলাস্তরের উপরিভাগে জল আটকে রাখে। ওই সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদসমূহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পচে গিয়ে হিউমাসের (Humus) সৃষ্টি করে। ওই হিউমাসের ওপর বৃষ্টির জল পড়লে হিউমিক অ্যাসিড বা জৈব অ্যাসিডের (C40H24O12) সৃষ্টি হয়। ওই হিউমিক অ্যাসিড ব্যাসল্ট, ম্যাগনেশিয়াম, ফেল্ডসপার এবং সালফার যৌগ দ্বারা গঠিত শিলাস্তরে খুব দ্রুত রাসায়নিক আবহবিকার ঘটায়।
জৈব আবহবিকার পদ্ধতি সমূহ
জৈব আবহবিকার পদ্ধতি সমূহ

বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে আবহবিকারের প্রক্রিয়াগুলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।

অথবা, জলবায়ুর উপর নির্ভর করে কী কী ভাবে আবহবিকার প্রক্রিয়া কার্যকরী হয় তা উল্লেখ করো।

অথবা, আবহবিকারের সঙ্গে জলবায়ুর সম্পর্ক লেখো।

পৃথিবীতে জলবায়ুগত তারতম্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন আবহবিকার প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। যেমন –

উষ্ণ-শুষ্ক জলবায়ুতে সৃষ্ট আবহবিকার –

উষ্ণ-শুষ্ক জলবায়ুতে তাপমাত্রার প্রসর যথেষ্ট বেশি এবং সেখানে বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না বললেই চলে। এর ফলে, শিলায় সংকোচন ও প্রসারণজনিত টান সবচেয়ে বেশি ঘটে, তাই যান্ত্রিকভাবে এখানকার শিলা ক্ষুদ্রকণা বিসরণ, শল্কমোচন, লবণ কেলাস গঠন প্রভৃতি প্রক্রিয়ায় আবহবিকারগ্রস্ত হয়।

উদাহরণ – অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ধরনের আবহবিকার দেখা যায়।

ক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ুতে সৃষ্ট আবহবিকার –

পৃথিবীর উভয় গোলার্ধে থাকা আর্দ্র ক্রান্তীয় অঞ্চলে বছরে অধিক বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার প্রভাবে ভূপৃষ্ঠস্থ শিলা ধৌতকরণের প্রভাবে রাসায়নিকভাবে অঙ্গারযোজন, জারণ, দ্রবণ, আর্দ্রবিশ্লেষণ প্রভৃতি প্রক্রিয়ায় আবহবিকারগ্রস্থ হয়।

উদাহরণ – ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমারের বেশ কিছু অঞ্চলের শিলা এইভাবে আবহবিকারগ্রস্থ হয়।

নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে সৃষ্ট আবহবিকার –

পৃথিবীর মধ্যভাগে থাকা নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে মাঝারি তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের কারণে উদ্ভিদের ক্রিয়া অণুখাদ্যঘটিত কারণে যথেষ্ট প্রাধান্যলাভ করে।

উদাহরণ – রাশিয়ার সরলবর্গীয় অরণ্য অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া দেখা যায়।

উচ্চ-অক্ষাংশীয় ও হিমশীতল মেরু জলবায়ু –

পৃথিবীর কোনো উচ্চ-অক্ষাংশীয় ও হিমশীতল মেরু জলবায়ুতে বরফ কিংবা তুষারের ক্রিয়ার ফলে যান্ত্রিকভাবে ভূপৃষ্ঠস্থ শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আবহবিকারগ্রস্ত হয় এবং কোণ বিশিষ্ট শিলা অবয়ব ট্যালাস বা স্ক্রি সৃষ্টি করে।

উদাহরণ – হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল কিংবা তুন্দ্রা জলবায়ুতে এটি পরিলক্ষিত হয়।

উষ্ণ মরু অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রাধান্য লাভের কারণ উল্লেখ করো।

মরু অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রাধান্য লাভের কারণগুলি হল –

  • তাপমাত্রার উচ্চ প্রসর – মরু অঞ্চল উষ্ণ প্রকৃতির হলেও এখানে দিন ও রাত্রির তাপমাত্রাগত প্রসর অনেক বেশি। উদাহরণ স্বরূপ, এখানে দিনের তাপমাত্রা যেমন যথেষ্ট বেশি, তেমনি রাতের তাপমাত্রা যথেষ্ট কম। ফলে, এখানকার শিলা ক্রমাগত সংকোচন ও প্রসারণের ফলে যান্ত্রিকভাবে বিচূর্ণীকৃত হয়।
  • বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা – মরু অঞ্চলে স্বল্প বৃষ্টিপাতের কারণে যান্ত্রিক আবহবিকার ছাড়া অন্য কোনো আবহবিকার প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
  • শিলায় বিষম প্রকৃতির খনিজের উপস্থিতি – মরু অঞ্চলে একই শিলায় বিষম প্রকৃতির খনিজের উপস্থিতি থাকে যাদের একই উষ্ণতায় সংকোচন ও প্রসারণের হার ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, বলা যায় গ্রানাইট ও নিস্ শিলার মধ্যে ‘কোয়ার্টজ এবং অভ্র’ –এই দুরকমের খনিজ পদার্থই অবস্থান করে। উষ্ণতার সংস্পর্শে এলে কোয়ার্টজ অতি সহজেই স্ফীত এবং সংকুচিত হয়, কিন্তু অভ্র তা হয় না। ফলে, ওই শিলার মধ্যে অসমান চাপের সৃষ্টি হয় বলে প্রচণ্ড টানের (Strain) উদ্ভব ঘটে এবং শিলাটি একসময়ে শব্দ করে ফেটে যায়। এই কারণে, মরু অঞ্চলে সন্ধ্যার সময় মাঝে মাঝে বন্দুকের গুলি ছোড়ার মতো শিলা ফাটার শব্দ শোনা যায়।
  • শিলায় সমপ্রকৃতির খনিজের উপস্থিতি – অনেক সময় সমপ্রকৃতির শিলার উপরের স্তর ভেতরের স্তরের চেয়ে অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে আয়তনে বৃদ্ধি পেলে তা পেঁয়াজের খোসার মতো ধীরে ধীরে খুলে যায়, একে শল্কমোচন বলে।
  • হঠাৎ বর্ষণ – অধিক উষ্ণ শিলায় হঠাৎ বর্ষণের ঠান্ডা জল পড়ে শিলার মধ্যে হঠাৎ সংকোচনের কারণে পীড়ন সৃষ্টি হয় যা শিলাকে বিচূর্ণ করে। অন্যদিকে, লবণ সমৃদ্ধ বৃষ্টির জল বাষ্পীভূত হয়ে লবণ কেলাস গঠন করে ও শিলাকে বিচূর্ণ করে।
  • অধিক বাষ্পীভবন – উষ্ণ মরু অঞ্চলে বাষ্পীভবন বেশি পরিমাণে হলে লবণ কেলাস তৈরি হয়ে ভূপৃষ্ঠস্থ শিলা যান্ত্রিকভাবে আবহবিকারগ্রস্থ হয়।
  • বায়ুর কার্যাবলি – মরুভূমিতে বাতাস বাধাহীনভাবে প্রবল বেগে বয়ে চলায় বাতাসের আঘাতে কিছু শিলা যান্ত্রিকভাবে বিচূর্ণীকৃত হয়।

আবহবিকারের ফলে কীভাবে মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়?

অথবা, মৃত্তিকার উৎপত্তিতে আবহবিকারের ভূমিকা আলোচনা করো।

মৃত্তিকার উৎপত্তিতে আবহবিকারের গুরুত্ব সর্বাধিক। বিভিন্ন যান্ত্রিক ও রাসায়নিক আবহবিকার প্রক্রিয়ার ফলে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ ও বিয়োজিত হয়ে ছোটো ছোটো কণায় পরিণত হয়। এই চূর্ণবিচূর্ণ পদার্থগুলি ভূপৃষ্ঠের উপর এক শিথিল ও কোমল আবরণ গড়ে তোলে। একে রেগোলিথ বলে। এই রেগোলিথই হল মাটি সৃষ্টির মূল উপকরণ বা কাঁচামাল। অর্থাৎ, মাটি গঠনের প্রথম পর্যায় হল রেগোলিথ সৃষ্টি, যা সম্পূর্ণ আবহবিকারের উপর নির্ভরশীল। পরবর্তী পর্যায়ে রেগোলিথের সঙ্গে আণুবীক্ষণিক জীবকুল, মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ পচনক্রিয়ার সাহায্যে মিশে গিয়ে হিউমিফিকেশন প্রক্রিয়ায় হিউমাস সৃষ্টি হয়। এরপর, জৈবরাসায়নিক পদ্ধতিতে হিউমাস পুনরায় বিয়োজিত হয়ে বিভিন্ন খনিজের আবির্ভাব ঘটে। একে খনিজকরণ বলে। মাটি গঠনকারী প্রক্রিয়া চলার সময় এলুভিয়েশন পদ্ধতিতে বিভিন্ন খনিজ মাটির নীচে প্রবেশ করতে থাকে এবং ইলুভিয়েশন পদ্ধতিতে মাটির নীচের স্তরে সেগুলি জমতে থাকে। এইভাবে আবহবিকার ও মৃত্তিকাগঠনকারী প্রক্রিয়ার মিলিত ক্রিয়াকলাপে মৃত্তিকা গঠিত হয়। বিভিন্ন আবহবিকার প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধরনের মৃত্তিকার উৎপত্তির সূচনা করে। যেমন –

  • চুনাপাথর অঙ্গারযোজনের মাধ্যমে চুন সমৃদ্ধ চারনোজেম মাটির সৃষ্টি হয়।
  • জারণ প্রক্রিয়া বৃক্ষ ল্যাটেরাইট মাটি সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
মৃত্তিকা সৃষ্টি
মৃত্তিকা সৃষ্টি

মৃত্তিকা বিজ্ঞানী মোর (More) 1969 খ্রিস্টাব্দে মৃত্তিকার উৎপত্তি ও আবহবিকারের সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পাঁচটি পর্যায় উল্লেখ করেছেন। যথা –

  • প্রারম্ভিক পর্যায় – অপরিবর্তিত জনকশিলা বা আদিশিলা।
  • তরুণ পর্যায় – আবহবিকারের শুরু।
  • যৌবন পর্যায় – পরিবর্তনযোগ্য খনিজের বিয়োজন ও কর্দম কণার পরিমাণ বৃদ্ধি।
  • বার্ধক্য পর্যায় – অত্যন্ত প্রতিরোধকারী খনিজ ছাড়া সব খনিজের বিয়োজন।
  • অন্তিম পর্যায় – মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ার সমাপ্তি।

আবহবিকারের ফলাফল সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ভূপৃষ্ঠে আবহবিকারের ফলে নানা অবস্থার সৃষ্টি হয় বলে পৃথিবীতে আবহবিকারের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবহবিকারের ফলাফল ধ্বংসাত্মক হলেও অনেক ক্ষেত্রে মানুষের অশেষ কল্যাণসাধন করে। আবহবিকারের ফলাফলগুলি নিম্নরূপ —

  • ভূ-আস্তরণের উৎপত্তি – আবহবিকারের ফলে শিলাসমূহ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে একপ্রকার ভূ-আস্তরণের সৃষ্টি করে, যা রেগোলিথ (Regolith) নামে পরিচিত। এটি শিলা ও মৃত্তিকার মধ্যবর্তী অবস্থা।
  • মৃত্তিকার উৎপত্তি – রেগোলিথ থেকে পরবর্তীকালে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। ক্রান্তীয় মৌসুমী অঞ্চলে শুষ্ক ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে রাসায়নিক আবহবিকারের হার অত্যন্ত বেশি। এই কারণে উক্ত অঞ্চলটিতে ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার উদ্ভব ঘটে।
  • খনিজ সৃষ্টি – রাসায়নিক আবহবিকারের ফলে বিভিন্ন প্রকার খনিজ দ্রব্য, যেমন – লৌহ আকরিক, ম্যাঙ্গানিজ, বক্সাইট, নিকেল, লিমোনাইট, জিপসাম, কেওলিন ইত্যাদি খনিজ পদার্থ সৃষ্টি হয়।
  • মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধি – রাসায়নিক আবহবিকারের ফলে বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য মৃত্তিকার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এর ফলে, উদ্ভিদের পক্ষে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও সার সংগ্রহ করতে সুবিধা হয়।
  • ভূ-বৈচিত্র্যের সৃষ্টি – বিখ্যাত ভূ-বিজ্ঞানী William Thornbury -এর মতে, আবহবিকারের ফলে কোনো নতুন ভূমিরূপ সৃষ্টি হয় না, শুধুমাত্র ভূমিরূপের কিছু কিছু পরিবর্তন হয়। যেমন – গ্রানাইট শিলাগঠিত অঞ্চলে শল্কমোচন প্রক্রিয়ায় গোলাকার ভূমিরূপ, ব্যাসল্ট শিলা গঠিত অঞ্চলে উল্লম্ব দারণ, চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে রাসায়নিক আবহবিকারের দ্রবণ ফলে গহ্বর, স্তম্ভ, স্ট্যালাকটাইট, স্ট্যালাগমাইট, টানেল, সুড়ঙ্গ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়।
  • প্রস্তরক্ষেত্র গঠন – যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে ছোটো বড়ো নানান আকৃতির অজস্র ছুঁচোলো পাথরের খণ্ড বিক্ষিপ্ত ভাবে অবস্থান করে প্রস্তরক্ষেত্র গঠন করে।
  • কৃষিকাজে সহায়ক – আবহবিকারের ফলে মৃত্তিকা বিচূর্ণীকৃত হয়ে কৃষিকার্যে সহায়তা করে।
  • ভৌমজল সঞ্চয় – আবহবিকারের ফলে শিলাস্তরে ভৌমজল সঞ্চয়ের সুবিধা হয়।
  • ভূমিকম্পের সম্ভাবনা – আবহবিকারের ফলে ভূপৃষ্ঠে চাপ হ্রাসের ফলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা থাকে।
  • ভূমিরূপের উচ্চতা হ্রাস – আবহবিকারের দ্বারা ভূপৃষ্ঠস্থ যাবতীয় ভূমিরূপের উচ্চতা হ্রাস পায়।
  • নদীর নাব্যতা হ্রাস – আবহবিকারগ্রস্ত পদার্থ নদীবক্ষে জমে নদীর নাব্যতার হ্রাস ঘটায়।
  • মরুকরণ – ব্যাপক আকারে ঘটিত আবহবিকার মরুকরণ (Desertification) বাড়ায়।
আবহবিকারের ফলে ভূমিরূপের পরিবর্তন
আবহবিকারের ফলে ভূমিরূপের পরিবর্তন

আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির বর্ণনা দাও।

আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল –

  • রেগোলিথ – আবহবিকারের ফলে শিলাস্তর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভূপৃষ্ঠের ওপর যে আলগা আবরণের সৃষ্টি করে তাকে রেগোলিথ বলে।
  • স্যাপ্রোলাইট – আবহবিকারের ফলে বিয়োজিত শিলা যখন স্থানান্তরিত না হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে তখন তাকে স্যাপ্রোলাইট বলে।
  • মরুভার্নিস – মরু অঞ্চলে কোয়ার্টজ কণা শিলাখণ্ড বা বোল্ডারের ওপর লোহা ও ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইডের যে কমলা-বাদামি চকচকে আস্তরণ পড়ে তাকে মরুভার্নিস বলে।
  • টর বা ক্যাসল কাপিজ – সাধারণত অন্তঃস্থ কঠিন শিলার চারপাশের দারণযুক্ত অংশ আবহবিকারের ফলে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এই ভঙ্গুর অংশ পরবর্তীকালে অপসারিত হলে অন্তঃস্থ কঠিন শিলাটি অনুচ্চ টিলার ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। একে টর বলে।
  • ইলাসেলবার্জ বা বোর্নহার্ডট – কয়েকশো ফুট গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত আবহবিকার এবং ধীরে ধীরে আবহবিকারজাত পদার্থের অপসারণের ফলে যে গম্বুজাকৃতির পাহাড় বা টিলা বেরিয়ে আসে তাকে ইনসেলবার্জ বা বোর্নহার্ডট বলে।
  • চাপ হ্রাসজনিত গম্বুজ – আগ্নেয় শিলায় গঠিত উদবেধ বহুকাল ধরে ক্ষয়কার্যের ফলে ভূপৃষ্ঠে আত্মপ্রকাশ করলে ওপরের চাপ হ্রাসের জন্য তা প্রসারিত হয়ে ধনুকের মতো বেঁকে গম্বুজে পরিণত হয়। একে চাপ হ্রাসজনিত গম্বুজ বলে।
  • কেন্সপ্রাঙ – প্রসারণজনিত আবহবিকারের ফলে বিশালাকার বোল্ডারগুলিতে এমন কিছু ফাটল সৃষ্টি হয়, যেগুলি থেকে বোল্ডারটি কম সংখ্যক বড়ো বড়ো খণ্ডে ভেঙে যায়। এই ফাটলগুলিকে কেন্সপ্রাঙ বলে।
  • স্ক্রি বা ট্যালাস – শীতপ্রধান পার্বত্য অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকারের মাধ্যমে শিলাস্তর ফেটে টুকরো টুকরো অসংখ্য কোণবিশিষ্ট প্রস্তরখণ্ডের সৃষ্টি করে। এই কোণবিশিষ্ট প্রস্তরখণ্ডগুলি উল্লম্বভাবে পর্বতগাত্রে অবস্থান করলে তাকে স্ক্রি বা ট্যালাস বলে।
  • গামাগর্ত – সাধারণত গ্রানাইট, নিস বা বেলেপাথর জাতীয় শিলায় ক্ষুদ্রকণা বিসরণ বা ফ্লেকিং -এর কারণে গর্তের সৃষ্টি হয়। এই গর্তগুলিকে আবহবিকার গর্ত বা গামাগর্ত বলে।
  • আবহবিকার গুহা – স্থানীয় অঞ্চল জুড়ে ফ্লেকিং এবং ক্ষুদ্রকণা বিসরণ ইত্যাদি কারণে বৃহদায়তন গুহার সৃষ্টি হয়। এগুলিকে আবহবিকার গুহা বা নিশে বলে।
  • হানিকম্ব – আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট বেলেপাথরের ফাটলগুলি আয়রন অক্সাইডের দ্বারা ভরাট হলে তাকে হানিকম্ব বলে।
  • কার্স্ট ভূমিরূপ – চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে কার্বনেশন ও দ্রবণ প্রক্রিয়ায় সিঙ্ক হোল, সোয়ালো হোল, ডোলাইন, ওভালা, পোলজি, গুহা, স্ট্যালাকটাইট, স্ট্যালাগমাইট, গ্রাইকস প্রভৃতি ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়। এদের একত্রে কার্স্ট ভূমিরূপ বলে।
  • গোলাকৃতি বোল্ডার – কোনো বোল্ডার বা প্রস্তরখণ্ডের তীক্ষ্ণ কোণগুলিতে বিভিন্ন দিক থেকে আবহবিকার পদ্ধতি কার্যকর হয়। কিন্তু বোল্ডারের পাশগুলিতে একদিক থেকে আবহবিকার পদ্ধতি কার্যকরী হয়। এর ফলে গোলাকৃতি বোল্ডার সৃষ্টি হয়।
  • রুওয়ার (Ruware) – যান্ত্রিক আবহবিকারের দ্বারা গম্বুজাকৃতি ভূমিরূপ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং অভ্যন্তরস্থ শিলা ভূপৃষ্ঠে উন্মোচিত টিলারূপে অবস্থান করে। একে রুওয়ার বলে।
  • ড্যুরিক্রাস্ট – আর্দ্র অঞ্চলে রাসায়নিক আবহবিকারের ফলে বিয়োজিত অদ্রবণীয় পদার্থ মৃত্তিকার স্তরে জমা হয়ে কঠিন আবরণ সৃষ্টি করে। একে ড্যুরিক্রাস্ট বলে।
  • ইচ্ প্লেন (Etch Plain) – ভূ-তাত্ত্বিক E.J.Wayland সর্বপ্রথম ইচ্ প্লেন (Etch plain) বা চাঁচন তল কথাটি ব্যবহার করেন। রেগোলিথের আস্তরণ যুক্ত ভূপৃষ্ঠে রেগোলিথ অপসৃত হলে তা পুনরায় আবহবিকারপ্রাপ্ত হয় এবং রেগোলিথে পরিণত হয়। পরে আবার ওই স্থান থেকে রেগোলিথ অপসৃত হলে নীচের কঠিন শিলা উন্মুক্ত হয়। এই ভাবে উন্মোচিত তলটির উপর পুনরায় আবহবিকার কার্যকরী হয় ও ওই তলের উপর রেগোলিথ সৃষ্টি হয়। সেই রেগোলিথ আবার অপসারিত হয়। ক্রমান্বয়ে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে প্রতি বার অপসারণের ফলে বিভিন্ন তলদেশে সৃষ্ট সমতল ভূমিকে ইচ্ প্লেন বলে।

ক্ষয়ীভবন (Erosion) কাকে বলে? ক্ষয়ীভবনের শক্তি বা মাধ্যমসমূহ (Agents of Erosion) সম্পর্কে লেখো।

সংজ্ঞা – আবহবিকারের অপর নাম বিচূর্ণীভবন। এই বিচূর্ণীভবনের সঙ্গে অপসারণ যুক্ত হলে, তাকে ক্ষয়ীভবন বলে। অর্থাৎ সূর্যতাপ, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, নদী, হিমবাহ সমুদ্রতরঙ্গ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে ভূত্বক চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে অপসারিত হলে, তাকে ক্ষয়ীভবন (Erosion) বলা হয়।

ক্ষয়ীভবনের শক্তি বা মাধ্যমসমূহ –

যে-সব প্রাকৃতিক কারণে ভূত্বকের শিলাসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তাদের বলা হয় ক্ষয়ীভবনের শক্তি বা মাধ্যমসমূহ (Agents of Erosion)। কাজেই ক্ষয়ীভবনের মাধ্যমগুলি হল – সূর্যতাপ, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, জলপ্রবাহ বা ভৌমজল, নদী, হিমবাহ, সমুদ্রতরঙ্গ ইত্যাদি। এইসব প্রাকৃতিক শক্তিগুলির সম্মিলিত প্রভাবে ভূত্বকের শিলাসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে থাকে।

  • সূর্যতাপ (Heat of the Sun) – দিনের বেলায় সূর্যকিরণে ভূপৃষ্ঠের শিলাসমূহ উত্তপ্ত হয়ে আয়তনে বৃদ্ধি পায়। আবার, রাত্রিকালে সূর্যকিরণের অভাবে তা শীতল হয়ে যায়। এভাবে, প্রতিদিন প্রসারণ ও সংকোচনের ফলে শিলার উপরিভাগ আলগা হয়ে পড়ে। তখন তা সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
  • বায়ুপ্রবাহ (Wind) – প্রবল বায়ুপ্রবাহের আঘাতে ভূত্বকের শিলাস্তর ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বায়ুপ্রবাহ ঘর্ষণ, অবঘর্ষ, অবনমন ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের ক্ষয়কার্য চালায়।
  • বৃষ্টিপাত (Rainfall) – প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে ভূপৃষ্ঠের আলগা শিলাস্তর ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
  • জলপ্রবাহ বা ভৌমজল (Ground water) – জলপ্রবাহ বা ভৌমজল যান্ত্রিক এবং রাসায়নিক উভয় প্রক্রিয়ায় ক্ষয়কার্য চালায়।
  • নদী (Rivers) – নদীর প্রবল স্রোতে ভূত্বকের শিলাসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। নদী তার জলের পরিমাণ ও গতিবেগ দ্বারা ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হবার সময় ক্ষয়কার্য চালিয়ে নিজের চলার পথ করে নেয়।
  • হিমবাহ (Glacier) – মেরুপ্রদেশ এবং উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ চলার সময় তার ঘর্ষণে ভূপৃষ্ঠের শিলাসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
  • সমুদ্রতরঙ্গ (Sea Wave) – সমুদ্রতরঙ্গের আঘাতে উপকূলের শিলাস্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে থাকে।

মৃত্তিকাক্ষয় বলতে কী বোঝো? মৃত্তিকাক্ষয়ের কারণগুলি লেখো।

মৃত্তিকাক্ষয় – বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি, যেমন – জলপ্রবাহ, বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির দ্বারা এবং মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে মাটির উপরের অংশ অসংবদ্ধ ও আলগা হয়ে অপসারিত হলে, তখন তাকে মৃত্তিকাক্ষয় বলে।

মৃত্তিকাক্ষয়ের কারণ – মৃত্তিকাক্ষয়ের কারণগুলিকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা – প্রাকৃতিক কারণ ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণ।

প্রাকৃতিক কারণ –

  • জলপ্রবাহ – তীব্র জলপ্রবাহের কারণে মৃত্তিকার উপরের স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ভূমির ঢাল বরাবর প্রবাহিত নদীর জলস্রোতের আঘাতে মৃত্তিকা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
  • বায়ুপ্রবাহ – শুষ্ক ও আলগা মাটির পৃষ্ঠস্তরের উপর দিয়ে প্রবল বেগে বায়ু প্রবাহিত হলে মাটি সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
  • হিমবাহ ও সমুদ্রতরঙ্গ – পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে এবং উপকূলবর্তী অঞ্চলে সমুদ্রতরঙ্গের আঘাতে মাটি ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
  • বৃষ্টিপাত – উপর থেকে সবেগে নামতে থাকা বিভিন্ন আকৃতির বৃষ্টির ফোঁটা মাটিকে সজোরে আঘাত করে। ফলে, মাটির দানাদার গঠন ধ্বংস হয়, মাটি আলগা হয়ে যায় এবং সহজে ক্ষয় হয়।
  • ভূমিঢাল – যেসমস্ত অঞ্চলে ভূমির ঢাল সর্বাধিক সেখানকার মৃত্তিকা কণা দ্রুত অপসারিত হয়ে ভূমিক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। এই কারণে, পার্বত্য অঞ্চলে বেশি ভূমিক্ষয় দেখা যায়।

মনুষ্যসৃষ্ট কারণ –

  • অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষচ্ছেদন – উদ্ভিদের শিকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে। গাছের পাতা বৃষ্টির আঘাত থেকে মাটিকে রক্ষা করে। কিন্তু, মানুষ নিজের চাহিদা মেটাতে ব্যাপক হারে বৃক্ষচ্ছেদন করে চলেছে, ফলে মৃত্তিকাক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  • অবৈজ্ঞানিক কৃষিপদ্ধতি – চাষের জমিতে লাঙল, ট্র্যাক্টর, হারভেস্টর প্রভৃতি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেশি হলে মৃত্তিকা ক্ষয় পায়। এ ছাড়া, স্থানান্তর কৃষিকাজের ফলে মৃত্তিকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • অনিয়ন্ত্রিত পশুচারণ – অনিয়ন্ত্রিত পশুচারণের ফলে তৃণভূমির তৃণ নির্মূল হয়ে মাটি আলগা হয়ে পড়ে। এ ছাড়া, পশুদের পায়ের ক্ষুরের আঘাতে পৃষ্ঠস্তরের মাটি ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
  • নির্মাণ কাজ – রাস্তাঘাট ও সেতুনির্মাণ, ইটভাঁটা স্থাপন, বাঁধনির্মাণ, বাড়ি তৈরি, পুকুর, খাল, পরিখা খনন, পয়ঃপ্রণালী তৈরি, খনি খনন প্রভৃতি কাজের সময় যন্ত্রের আঘাতে মৃত্তিকা আলগা হয়ে পড়ে ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
মৃত্তিকাক্ষয়ের কারণসমূহ
মৃত্তিকাক্ষয়ের কারণসমূহ

মৃত্তিকা সংরক্ষণ বলতে কী বোঝো? মৃত্তিকা সংরক্ষণের উপায়গুলি লেখো।

মৃত্তিকা সংরক্ষণ – ক্ষয় ও অবনমনের হাত থেকে রক্ষা করে, মৃত্তিকা সম্পদকে মানুষের কল্যাণে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করার জন্য যেসমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাকে মৃত্তিকা সংরক্ষণ বলে।

মৃত্তিকা সংরক্ষণের উপায় বা পদ্ধতিসমূহ –

  • বৃক্ষরোপণ (Afforestation) – গাছের শিকড় মাটিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। তাই, মৃত্তিকাক্ষয় রোধ করার জন্য বৃক্ষরোপণের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
  • নিয়ন্ত্রিত পশুচারণ – ভূমির উপর তৃণের আচ্ছাদন জলের পৃষ্ঠপ্রবাহের হাত থেকে মৃত্তিকাকে রক্ষা করে। তাই, পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ করে তৃণভূমির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলে মৃত্তিকা সংরক্ষণ করা যায়।
  • শস্যাবর্তন (Crop rotation) – কৃষি জমি পতিত না রেখে সারাবছর বিভিন্ন ধরনের ফসল শস্যাবর্তন পদ্ধতিতে চাষ করলে একদিকে যেমন – মৃত্তিকার উর্বরতা বজায় থাকে, তেমনি অপর দিকে সারাবছরই মাটি শস্য দ্বারা আবৃত থাকায় ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়।
  • ধাপ চাষ (Step farming) – পাহাড় বা পর্বতের ঢালে ধাপ কেটে চাষ করলে জলের গতি হ্রাস পায় ও মৃত্তিকাক্ষয় নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • সমোন্নতিরেখা বরাবর চাষ (Contour farming) – পার্বত্য অঞ্চলে সমোন্নতিরেখা বরাবর বাঁধ দিয়ে চাষ করলে প্রবাহিত জলধারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্তিকা ক্ষয় হ্রাস পায়।
  • ফালি চাষ (Strip cropping) – সমোন্নতিরেখার সমান্তরালে চাষ না করে ঢালের আড়াআড়িভাবে ফালি তৈরি করে চাষ করলে মাটি সংরক্ষণ করা যায়।
  • স্থানান্তর কৃষি (Shifting cultivation) রোধ – আদিবাসী কৃষকদের সচেতন করে স্থানান্তর কৃষি বা ঝুমচাষ বন্ধ করতে পারলে অরণ্য সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে মাটির ক্ষয় রোধ করা সম্ভব হবে।
  • জৈবসারের ব্যবহার বৃদ্ধি – মৃত্তিকাতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে অধিক পরিমাণে জৈবসার ব্যবহার করলে মৃত্তিকার গঠন, গ্রথন, প্রবেশ্যতা প্রভৃতি ধর্মগুলি বজায় থাকে, ফলে মৃত্তিকা সংরক্ষণ সম্ভব হয়।
  • বাঁধ নির্মাণ – নদীপাড়ে বা সমুদ্র উপকূলে বাঁধ নির্মাণ করলে, অথবা কংক্রিট দিয়ে নদীপাড় ও উপকূল অংশ বাঁধালে মৃত্তিকাক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
  • শেল্টার বেল্ট (Shelter Belt) – শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের গতিপথে অসংখ্য গাছ সমান্তরালভাবে রোপণ করলে বায়ুপ্রবাহের গতি প্রতিরোধ করে মৃত্তিকাক্ষয়ের পরিমাণ হ্রাস করা যায়। মরু অঞ্চলে এভাবে মাটির ক্ষয় রোধ করা সম্ভব।
  • মালচিং – শুষ্ক বা মরুপ্রায় অঞ্চলে মাটির উপর লতাপাতা, খড়কুটো, ঘাস, আগাছা প্রভৃতি বিছিয়ে রাখলে মাটির বাষ্পীভবনের হার হ্রাস পায় এবং আর্দ্রতা বজায় থাকে। ফলে, চাষাবাদের সুবিধা হয়। মৃত্তিকা সংরক্ষণের এই পদ্ধতিকে মালচিং বলে।
  • অন্যান্য পদ্ধতি – এ ছাড়া অম্লধর্মী মৃত্তিকায় চুন মিশিয়ে অম্লতা নিয়ন্ত্রণ, জল নিষ্কাশনের সুব্যবস্থার মাধ্যমে মৃত্তিকার লবণতা হ্রাস, প্রভৃতি ব্যবস্থার মাধ্যমে মৃত্তিকা সংরক্ষণ করা যায়।
মৃত্তিকা সংরক্ষণ
মৃত্তিকা সংরক্ষণ

ভারতের কোথায় কোথায় মৃত্তিকা গবেষণাগার তৈরিকরা হয়েছে?

মৃত্তিকা সংরক্ষণের জন্য ভারতে যোধপুর, দেরাদুন, চন্ডীগড়, কোটা, আগ্রা প্রভৃতি স্থানে মৃত্তিকা গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে।


এই আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় ‘আবহবিকার’-এর রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর ভূগোল পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলি প্রায়শই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনার প্রস্তুতিতে সহায়ক হয়েছে। যদি কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তাহলে আমাদের টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করব। পোস্টটি আপনার বন্ধু ও সহপাঠীদের সাথে শেয়ার করুন, যাতে তারাও উপকৃত হতে পারে। ধন্যবাদ!

Share via:

মন্তব্য করুন