আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ভূগোলের অষ্টম অধ্যায় ‘পশ্চিমবঙ্গ (প্রাকৃতিক পরিবেশ)’ এর টীকা নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর ভূগোল পরীক্ষার জন্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

কালবৈশাখী/নরওয়েস্টার (Nor-Wester) – টীকা।
পশ্চিমবঙ্গে প্রবাহিত একটি স্থানীয় বায়ুপ্রবাহ হল কালবৈশাখী। মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্মকাল থাকে। এসময়ে স্থলভাগ ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে থাকলে বায়ুর আর্দ্রতা কমে গিয়ে বায়ু হালকা হতে থাকে এবং নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। নিকটবর্তী সমুদ্রের শীতল ও আর্দ্র বায়ু শূন্যস্থান পূরণের জন্যে প্রবল বেগে ওই নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসতে থাকে এবং ঝড়ের সূচনা হয়। একে ‘কালবৈশাখী’ বলে।
বৈশিষ্ট্য –
- উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগত বায়ুর প্রভাবে এই ঘূর্ণিঝড় হয় বলে একে নরওয়েস্টার বলে।
- উষ্ণতা প্রায় 10°C-15°C পর্যন্ত কমে যায়।
- এই ঝড় ক্ষণস্থায়ী হয়।
- কৃষিক্ষেত্রের ক্ষতিসাধন করে।
‘পশ্চিমি ঝঞ্ঝা’ (Western Disturbance) – টীকা।
পশ্চিমবঙ্গে শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে শীতল ও শুষ্ক মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় বলে এসময় ঝড়বৃষ্টি সাধারণত হয় না এবং শান্ত আবহাওয়া বিরাজ করে। তবে সুদূর পশ্চিমের ভূমধ্যসাগর থেকে সৃষ্টি হয়ে আসা নিম্নচাপের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে ঝড়বৃষ্টি হয়। পশ্চিমদিক থেকে আসার কারণে এই নিম্নচাপ তথা ঘূর্ণিঝড়কে ‘পশ্চিমি ঝঞ্ঝা’ বা ‘পশ্চিমি ঝামেলা’ বলে।
বৈশিষ্ট্য –
- পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রভাবে 75–100 সেমি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়।
- পাহাড়ে তুষারপাত হয়।
- অনেক বেলা পর্যন্ত কুয়াশা থাকে।
আশ্বিনের ঝড় – টীকা।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষে সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হয়। অক্টোবর মাস নাগাদ উত্তর-পশ্চিম ভারতের উষ্ণতা হ্রাস পেতে থাকে। ফলে পাঞ্জাব অঞ্চলে উচ্চচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। ওই উচ্চচাপ নির্গত বায়ুর সঙ্গে প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ুর সংঘর্ষ হয়। এর ফলে যে ঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয়, তাকে ‘আশ্বিনের ঝড়’ বলে। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আশ্বিন মাসে হয় বলে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে এই ঝড় ‘আশ্বিনের ঝড়’ নামে পরিচিত। আবার, এ সময়ে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে যে ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়, তাকেও ‘আশ্বিনের ঝড়’ বলা হয়ে থাকে। আশ্বিনের ঝড়ের প্রভাবে মাঝে মাঝে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিও হয়।
সক্রিয় বদ্বীপ – টীকা।
অবস্থান – দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার মধ্য ও পূর্বাংশ এবং উত্তর 24 পরগনার দক্ষিণাংশ।
বৈশিষ্ট্য –
- এই অঞ্চলটি নবীন পলিগঠিত।
- এই অঞ্চলের নদীগুলি প্রাণবন্ত থাকায় এখানে এখনও পলি সঞ্চয়ের কাজ চলছে। ফলে বদ্বীপ এখনও গঠিত হচ্ছে বলে এই অঞ্চলকে সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চল বলা হয়।
- মূলত রায়মঙ্গল, হাড়িয়াভাঙা, মাতলা, সপ্তমুখী ইত্যাদি নদী পলি সঞ্চয়ের কাজ করছে।
- এখানকার নবগঠিত দ্বীপের নাম পূর্বাশা।
মৌসুমি বায়ু (Monsoon) – টীকা।
‘মৌসুমি’ কথাটি আরবি শব্দ ‘মৌসিম’ থেকে এসেছে যার আক্ষরিক অর্থ ‘ঋতু’। ‘ঋতু’ অনুসারে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে মৌসুমি বায়ু বলে।
বৈশিষ্ট্য –
- মৌসুমি বায়ু গ্রীষ্মকালে জলভাগ থেকে স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হয় যা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু নামে পরিচিত।
- শীতকালে স্থলভাগ থেকে জলভাগের দিকে প্রবাহিত হয় যা উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু নামে পরিচিত।
- মৌসুমি বায়ুর আচরণ খামখেয়ালি। বর্ষা কখনও আগে আসে, কখনও পরে।
- পশ্চিমবঙ্গে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে ঘূর্ণবাতও সৃষ্টি হয়।
সুন্দরবন অঞ্চল – টীকা।
দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার দক্ষিণাংশে প্রায় 4,264 বর্গকিমি অরণ্যময় ভূভাগের নামই সুন্দরবন। এই অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গভীর বনভূমি গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে সুন্দরী গাছের প্রাধান্য দেখা যায়। ওই গাছের নাম অনুসারেই এই অরণ্যের নাম সুন্দরবন হয়েছে। এই অরণ্য পৃথিবী বিখ্যাত ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’ -এর বাসভূমি। এই বনভূমির সীমানা নির্ণয় করা হয় 1830 সালে দুই ইংরেজ সার্ভে অফিসার ডাম্পিয়ার ও হজেস -এঁর দ্বারা। তাঁদের দ্বারা চিহ্নিত সুন্দরবনের সীমানারেখার নামই ডাম্পিয়ার-হজেস রেখা। বর্তমানে অরণ্য ধ্বংস ও বাসভূমি বিস্তারের ফলে সুন্দরবনের প্রকৃত সীমা অনেকটাই দক্ষিণে সরে গেছে।
ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ (Mangrove) – টীকা।
সমুদ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলে যে-সকল উদ্ভিদ কিছু শারীরবৃত্তীয় অভিযোজন অর্থাৎ শ্বাসমূল, ঠেসমূল, জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম ইত্যাদির মাধ্যমে লবণাক্ত মৃত্তিকায় প্রতিকূল পরিবেশে জন্মায় ও বেড়ে ওঠে, তাদের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলে।
প্রাপ্তিস্থান- পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ 24 পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ পাওয়া যায়।
উদাহরণ – সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, হোগলা, গোলপাতা, ক্যাওড়া, ছাতিম, ধূদুল, পিঠালি ইত্যাদি।
ব্যাবহারিক গুরুত্ব –
- এই উদ্ভিদের পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া হয়।
- এই উদ্ভিদগুলির কাঠ জ্বালানিরূপে ও গৃহনির্মাণের উপকরণ রূপে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া এই অরণ্যে মোম ও মধু পাওয়া যায়।
- ম্যানগ্রোভ অরণ্য ও সুন্দরবনের সৌন্দর্য এখানে পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা – টীকা।
- অবস্থান – মূলত পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান ও ঝাড়গ্রাম জেলায় এই মাটি দেখা যায়।
- উৎপত্তির কারণ – অপেক্ষাকৃত বড়ো বড়ো নুড়ি, কাঁকর ইত্যাদি জমে এই মাটি তৈরি হয়েছে।
বিশেষত্ব –
- প্রকৃতি – এই মাটির সচ্ছিদ্রতা বেশি ও জলধারণ ক্ষমতা কম। এটি কাঁকরপূর্ণ মাটি।
- বর্ণ – ‘ল্যাটার’ শব্দ থেকে ‘ল্যাটেরাইট’ কথাটি এসেছে। এর অর্থ ‘ইট’। এই মাটি ইটের মতো লাল বর্ণের।
- উপাদান – এই মাটিতে লোহার পরিমাণ বেশি থাকে।
- উদ্ভিদ – কুল, পলাশ, মহুয়া ইত্যাদি পর্ণমোচী উদ্ভিদ।
- উৎপাদিত ফসল – এই মাটিতে জলসেচের মাধ্যমে ধান, ভুট্টা, আখ ও বিভিন্ন শাকসবজি উৎপন্ন হয়।
উপকূলের লবণাক্ত মৃত্তিকা – টীকা।
- অবস্থান – পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে দেখা যায়।
- উৎপত্তির কারণ – নদীবাহিত পলির সঙ্গে সমুদ্রতরঙ্গবাহিত পলি যুক্ত হয়ে এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষত্ব –
- প্রকৃতি – লবণাক্ত ও ক্ষারধর্মী।
- বর্ণ – এটি কালো রঙের হয়ে থাকে।
- উপাদান – বালি, পলি ও অতিরিক্ত লবণ।
- উদ্ভিদ – সুন্দরী, গরান, গেওয়া, হোগলা, নারকেল ইত্যাদি।
- উৎপাদিত ফসল – তরমুজ, লঙ্কা, সূর্যমুখী, সুপুরি ও সামান্য কার্পাস।
সাগরদ্বীপ – টীকা।
সাগরদ্বীপ দক্ষিণ 24 পরগনা জেলায় অবস্থিত। এটি সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে হুগলি নদীর মোহানার কাছে অবস্থিত। সুন্দরবনের জনবসতিপূর্ণ দ্বীপগুলির মধ্যে এই দ্বীপ সবচেয়ে বড়ো এবং সবচেয়ে বেশি জনবহুল। সাগরদ্বীপে অবস্থিত কপিলমুনির আশ্রম গঙ্গাসাগরের একটি পবিত্র তীর্থস্থান। এখানে প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে বিরাট গঙ্গাসাগর মেলা বসে। ওই সময়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার পুণ্যার্থী এখানে আসেন। শুধু তাই নয়, ওই মেলা উপলক্ষ্যে প্রচুর বিদেশিও এখানে আসেন। এ ছাড়া এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসাবাণিজ্য কেন্দ্রও বটে।
ফারাক্কা ব্যারেজ – টীকা।
আসন্ন অবলুপ্তির হাত থেকে কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার জন্যে মুরশিদাবাদ জেলার ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর ওপর একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, এরই নাম ফারাক্কা ব্যারেজ। আগে গঙ্গার প্রধান জলধারার জল পদ্মা নদীর মাধ্যমে বাংলাদেশে চলে যেত। আর ভাগীরথী-হুগলি নদী যে জল পেত তা দিয়ে কলকাতা বন্দরের কাজ চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তাই ফারাক্কায় ব্যারেজ নির্মাণ করে গঙ্গার জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটি ফিডার খালের মাধ্যমে গঙ্গার জলধারাকে ভাগীরথী-হুগলি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে ভাগীরথী-হুগলি নদীর জলপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কলকাতা বন্দরের কাজকর্ম অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে।
অরণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা – টীকা।
অরণ্য সংরক্ষণ বলতে আমরা সেই প্রক্রিয়াকে বুঝি যার দ্বারা সুপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে অরণ্য সম্পদকে রক্ষা করা হয় এবং মানুষ তার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলি বনভূমি থেকে পেতে পারে।
পদ্ধতি – অরণ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলি হল –
- পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ।
- অপ্রয়োজনীয় বৃক্ষচ্ছেদন রোধ ও কাঠ পাচারকারী দমন।
- অরণ্যের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ। গাছ কাটার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া।
- অরণ্য সংরক্ষণ সম্বন্ধে সঠিক জনচেতনা গড়ে তোলা।
প্রয়োজনীয়তা – অরণ্য সংরক্ষণের ফলে –
- মৃত্তিকা সংরক্ষিত হয়।
- বন্যপ্রাণীরা নির্ভয়ে বাস করার জায়গা পায়।
- বৃষ্টিপাতও সঠিক পরিমাণে হয়।
- বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে।
- অরণ্যভিত্তিক নানা শিল্প, যেমন – কাষ্ঠ শিল্প, কাগজ শিল্প, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটে।
অভয়ারণ্য (Sanctuary) – টীকা।
যে অরণ্যে বন্যপ্রাণীরা নির্ভয়ে বসবাস করতে পারে, তাকে অভয়ারণ্য বলে।
ব্যাবহারিক গুরুত্ব –
- বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্য নিয়ে অভয়ারণ্যকে রক্ষা করা হয়।
- অভয়ারণ্যে পশুহত্যা, গাছকাটা, মাছধরা নিষিদ্ধ।
- অভয়ারণ্য পর্যটনের কেন্দ্ররূপে গড়ে ওঠে। উদাহরণ – পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। এখানে একশৃঙ্গ গণ্ডার, হাতি, বাঘ, হরিণ, চিতাবাঘ ইত্যাদি জীবজন্তু পাওয়া যায়।
Class 9 Geography All Chapter Notes
আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ভূগোলের অষ্টম অধ্যায় ‘পশ্চিমবঙ্গ (প্রাকৃতিক পরিবেশ)’ এর টীকা নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর ভূগোল পরীক্ষার জন্য বা চাকরির পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায় দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।