আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ভূগোলের অষ্টম অধ্যায় ‘পশ্চিমবঙ্গ (প্রাকৃতিক পরিবেশ)’ এর রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর ভূগোল পরীক্ষার জন্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

পশ্চিমবঙ্গে কয়টি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল রয়েছে? এদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
অথবা, পশ্চিমবঙ্গের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে পশ্চিমবঙ্গকে মোট 3টি ভাগে ভাগ করা যায় –

পার্বত্য অঞ্চল –
- অবস্থান – পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার অধিকাংশ কালিম্পং জেলা এবং জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলার উত্তরাংশ হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্গত।
- শ্রেণিবিভাগ – পর্বতশ্রেণি, গিরিপথ, শৈলশিরা ইত্যাদি নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত। এই অঞ্চল দু-ভাগে বিভক্ত, যথা –
- তিস্তার পূর্বদিক – তিস্তা নদীর পূর্বদিকে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য পর্বতশ্রেণি হল দেওলা ও দুরবিনদারা। দুরবিনদারার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ঋষিলা (3,130 মি)। এ ছাড়া সিন্ডুলা পর্বতশ্রেণির সর্বোচ্চ শৃঙ্খ রেনিগাঙ্গো (1,885 মিটার)।
- তিস্তার পশ্চিমদিক – তিস্তার পশ্চিমভাগে সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণির চারটি শৃঙ্গ, যথা – সান্দাকফু (3,630 মি, পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ), ফালুট, টংলু ও সবরগ্রাম।

পশ্চিমের মালভুমি অঞ্চল –
- অবস্থান – পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশে ছোটোনাগপুর মালভূমির সম্প্রসারিত অংশটি পুরুলিয়া জেলার সমগ্র অংশ এবং ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান ও বীরভূম জেলার পশ্চিমাংশ নিয়ে গঠিত।
- শ্রেণিবিভাগ – এই মালভূমি অঞ্চলে অযোধ্যা, পাঞ্চেৎ, মামাভাগ্নে, শুশুনিয়া, বিহারীনাথ প্রভৃতি পাহাড় অবস্থিত। অযোধ্যা পাহাড়ের গোর্গাবুরু (677 মিটার) এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
সমভূমি অঞ্চল –
- অবস্থান – উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল এবং পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল বাদে পশ্চিমবঙ্গের বাকি অংশ সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত।
- শ্রেণিবিভাগ – গঙ্গা নদী পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলকে প্রধান দুভাগে ভাগ করেছে। উত্তরবঙ্গের সমভূমি ও দক্ষিণবঙ্গের সমভূমি।
- উত্তরবঙ্গের সমভূমি – এই সমভূমি স্থানীয় বৈচিত্র্য অনুসারে দুভাগে বিভক্ত। যথা – তিস্তা নদীর পূর্ব ও পশ্চিমদিকের সমভূমি এবং, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের দোয়াব অঞ্চল সমভূমি অবস্থিত।
- দক্ষিণবঙ্গের সমভূমি – এই সমভূমি স্থানীয় বৈচিত্র্য অনুসারে চার ভাগে বিভক্ত। যথা – মালভূমি অঞ্চলের পূর্বপ্রান্তের রাঢ় সমভূমি, গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চল, সুন্দরবনের নিম্নভূমি এবং, বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী বালুকাময় সমভূমি।
পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
অবস্থান – উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল দার্জিলিং জেলার দার্জিলিং সদর, শিলিগুড়ি মহকুমা ও কালিম্পং জেলা এবং জলপাইগুড়ি জেলার উত্তরে অবস্থিত কুমারগ্রাম ও কালচিনি থানা নিয়ে গঠিত। এটি ‘দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল’ নামে পরিচিত।
ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য –
- এটি পূর্ব হিমালয়ের অংশ।
- ভূগাঠনিক দিক থেকে এটি পশ্চিমবঙ্গের নবীনতম অঞ্চল।
- এই অঞ্চল উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালু।
- এই অঞ্চলটি পাললিক ও রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত।
- পার্বত্য অঞ্চলের ঢাল খাড়া।
- অঞ্চলটির ভূপ্রকৃতি বন্ধুর।
- সুগভীর খাতসহ নদী উপত্যকা এই অঞ্চলে দেখা যায়।
- তিস্তা নদীর গভীর খাত এই অঞ্চলকে দুটি ভূপ্রাকৃতিক বিভাগে বিভক্ত করেছে। যথা -তিস্তার পূর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চল
- তিস্তার পশ্চিম দিকের পার্বত্য অঞ্চল।
তিস্তার পূর্বদিকের পার্বত্য অঞ্চল –
- ভূপ্রকৃতি – তুলনামূলকভাবে কম প্রসারিত এবং কম উচ্চতাযুক্ত।
- পর্বতশ্রেণি – দুটি পর্বতশ্রেণি এখানে অবস্থিত – দেওলা, দুরবিনদারা।
- বিশেষত্ব ও শৃঙ্গসমূহ – পূর্ব অংশে দুরবিনদারার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ঋষিলা (3.130 মি) ভুটান-সিকিম সীমান্তে অবস্থিত।
- জলপাইগুড়ির উত্তরাংশে অবস্থিত সিওলা। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম রেনিগাঙ্গো (1,885 মি)।
- রায়ডাক নদীর পশ্চিমে বক্সাজয়ন্তী পাহাড় আছে। ক্রমাগত ক্ষয়ের ফলে এর উচ্চতা কমে গেছে।
- এখানে অবস্থিত বক্সাদুয়ার গিরিপথ হল জলপাইগুড়ি থেকে ভুটানের প্রবেশপথ।
তিস্তার পশ্চিমদিকের পার্বত্য অঞ্চল –
- প্রকৃতি – অনেক বেশি প্রসারিত এবং এখানকার উচ্চতাও বেশি।
- পর্বতশ্রেণি – এই অঞ্চলের দুটি পর্বতশ্রেণি হল – সিঙ্গালিলা ও দার্জিলিং পর্বতশ্রেণি।
- বিশেষত্ব ও শৃঙ্গসমূহ – সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণি নেপাল ও দার্জিলিং সীমান্তে অবস্থিত। এই পর্বতশ্রেণির কয়েকটি উঁচু শৃঙ্গ হল সান্দাকফু (3,630 মি), ফালুট (3,595 মি), সবরগ্রাম (3,543 মি), টাংলু (3,063 মি) ইত্যাদি।
- দার্জিলিং পর্বতশ্রেণি দক্ষিণের তরাই অঞ্চল থেকে খাড়াভাবে ওপরে উঠে উত্তরে বিস্তৃত হয়েছে। এর অপর নাম ‘ঘুম রেঞ্জ’। এই পর্বতশ্রেণির দক্ষিণে টাইগার হিল (2,585 মি) শৃঙ্গ অবস্থিত।

পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
অথবা, পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
অবস্থান – সমগ্র পুরুলিয়া জেলাসহ বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান জেলার তরঙ্গায়িত ভূভাগ নিয়ে মালভূমি অঞ্চলটি গঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশে অবস্থিত বলে একে ‘পশ্চিমের মালভূমি’ বলা হয়।
ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য – পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল ছোটোনাগপুর মালভূমির অংশ বিশেষ। এটি প্রাচীন ও রূপান্তরিত আগ্নেয় শিলা দিয়ে গঠিত। দীর্ঘদিনব্যাপী ক্ষয়ের ফলে মালভূমিটি প্রায় সমপ্রায়ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটি ভূগঠনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম অংশ। মালভূমি অঞ্চলের গড় উচ্চতা 100 মিটারের বেশি। অঞ্চলটি উঁচু নীচু অর্থাৎ তরঙ্গায়িত। সমগ্র মালভূমিটি কাঁকরযুক্ত মাটি এবং ল্যাটেরাইট মাটি দ্বারা আবৃত। মালভূমি অঞ্চলের স্থানে স্থানে কঠিন শিলাগঠিত অল্প উঁচু পাহাড় আছে। এখানে উচ্চভূমি বা টিলাকে স্থানীয় ভাষায় ‘ডুংরি’ বলে। মালভূমি অঞ্চলটিকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়- পূর্বদিকের মালভূমি ও পশ্চিমদিকের মালভূমি।
পূর্বাংশের মালভূমি –
- অবস্থান – ঝাড়গ্রাম ও বাঁকুড়ার পশ্চিমাংশ নিয়ে এই অংশটি গঠিত।
- শিলার প্রকৃতি – এই অঞ্চলটি কাঁকরপূর্ণ শিলা দ্বারা গঠিত। উল্লেখযোগ্য পাহাড় – বাঁকুড়ার শুশুনিয়া (440 মিটার), বিহারীনাথ, পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি।
পশ্চিমাংশের মালভূমি –
- অবস্থান – বীরভূমের পশ্চিমাংশ, পশ্চিম বর্ধমান এবং সমগ্র পুরুলিয়া জেলা নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত।
- শিলার প্রকৃতি – এই অঞ্চলটি প্রাচীন গ্রানাইট ও নিস্ শিলা দ্বারা গঠিত।
- উল্লেখযোগ্য পাহাড় – পুরুলিয়ার অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি (670 মিটার), পাঞ্চেৎ (643 মিটার), ভাণ্ডারি, বীরভূমের মামাভাগ্নে, মথুরাখালি, পাথুরাখালি। অযোধ্যা পাহাড়ের গোর্গাবুরু (677 মিটার) এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।

পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি ও পার্বত্য অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির বিবরণ দাও।
পার্বত্য অঞ্চল –
- অবস্থান- পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার অধিকাংশ কালিম্পং জেলা এবং জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলার উত্তরাংশ হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্গত।
- শ্রেণিবিভাগ- পর্বতশ্রেণি, গিরিপথ, শৈলশিরা ইত্যাদি নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত। এই অঞ্চল দু-ভাগে বিভক্ত, যথা –
- তিস্তার পূর্বদিক – তিস্তা নদীর পূর্বদিকে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য পর্বতশ্রেণি হল দেওলা ও দুরবিনদারা। দুরবিনদারার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ঋষিলা (3,130 মিটার)। এ ছাড়া সিন্ডুলা পর্বতশ্রেণির সর্বোচ্চ শৃঙ্খ রেনিগাঙ্গো (1,885 মিটার)।
- তিস্তার পশ্চিমদিক – তিস্তার পশ্চিমভাগে সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণির চারটি শৃঙ্গ, যথা- সান্দাকফু (3,630 মিটার, পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ), ফালুট, টংলু ও সবরগ্রাম।
মালভূমি অঞ্চল –
অবস্থান – সমগ্র পুরুলিয়া জেলাসহ বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান জেলার তরঙ্গায়িত ভূভাগ নিয়ে মালভূমি অঞ্চলটি গঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশে অবস্থিত বলে একে ‘পশ্চিমের মালভূমি’ বলা হয়।
ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য – পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল ছোটোনাগপুর মালভূমির অংশ বিশেষ। এটি প্রাচীন ও রূপান্তরিত আগ্নেয় শিলা দিয়ে গঠিত। দীর্ঘদিনব্যাপী ক্ষয়ের ফলে মালভূমিটি প্রায় সমপ্রায়ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটি ভূগঠনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম অংশ। মালভূমি অঞ্চলের গড় উচ্চতা 100 মিটারের বেশি। অঞ্চলটি উঁচু নীচু অর্থাৎ তরঙ্গায়িত। সমগ্র মালভূমিটি কাঁকরযুক্ত মাটি এবং ল্যাটেরাইট মাটি দ্বারা আবৃত। মালভূমি অঞ্চলের স্থানে স্থানে কঠিন শিলাগঠিত অল্প উঁচু পাহাড় আছে। এখানে উচ্চভূমি বা টিলাকে স্থানীয় ভাষায় ‘ডুংরি’ বলে। মালভূমি অঞ্চলটিকে দু-ভাগে ভাগ করা যায় – পূর্বদিকের মালভূমি ও পশ্চিমদিকের মালভূমি।
পূর্বাংশের মালভূমি –
- অবস্থান – ঝাড়গ্রাম ও বাঁকুড়ার পশ্চিমাংশ নিয়ে এই অংশটি গঠিত।
- শিলার প্রকৃতি – এই অঞ্চলটি কাঁকরপূর্ণ শিলা দ্বারা গঠিত। উল্লেখযোগ্য পাহাড় – বাঁকুড়ার শুশুনিয়া (440 মি), বিহারীনাথ, পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি।
পশ্চিমাংশের মালভূমি –
- অবস্থান – বীরভূমের পশ্চিমাংশ, পশ্চিম বর্ধমান এবং সমগ্র পুরুলিয়া জেলা নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত।
- শিলার প্রকৃতি – এই অঞ্চলটি প্রাচীন গ্রানাইট ও নিস্ শিলা দ্বারা গঠিত।
- উল্লেখযোগ্য পাহাড় – পুরুলিয়ার অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি (670 মিটার), পাঞ্চেৎ (643 মিটার), ভাণ্ডারি, বীরভূমের মামাভাগ্নে, মথুরাখালি, পাথুরাখালি। অযোধ্যা পাহাড়ের গোর্গাবুরু (677 মিটার) এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
সমভূমি অঞ্চল –
- অবস্থান – উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল এবং পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল বাদে পশ্চিমবঙ্গের বাকি অংশ সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত।
- শ্রেণিবিভাগ – গঙ্গা নদী পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলকে প্রধান দুভাগে ভাগ করেছে। উত্তরবঙ্গের সমভূমি ও দক্ষিণবঙ্গের সমভূমি।
উত্তরবঙ্গের সমভূমি –
এই সমভূমি স্থানীয় বৈচিত্র্য অনুসারে দুভাগে বিভক্ত। যথা –
- তরাই ও ডুয়ার্স সমভূমি- উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশে তিস্তা নদীর পশ্চিমে সমতল ভূমি তরাই নামে পরিচিত। ‘তরাই’ শব্দের অর্থ ‘স্যাঁতসেঁতে’। তিস্তা নদীর পূর্বাংশের সমভূমি ‘ডুয়ার্স’ নামে পরিচিত। ‘ডুয়ার্স’ শব্দের অর্থ ‘দুয়ার’ বা ‘দরজা’। এই সমভূমির মধ্য দিয়ে ভুটানে প্রবেশ করা যায় বলে এর এমন নামকরণ হয়েছে।
- গঙ্গা-ব্রঙ্গাপুত্র দোয়াব অঞ্চল- উত্তরে তরাই সমভূমির দক্ষিণাংশ থেকে দক্ষিণে গঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত সমভূমি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র দোয়াব নামে পরিচিত। ‘দোয়াব’ শব্দের অর্থ ‘দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল’। এই সমভূমির চারটি ভাগ। যথা- নিম্নভূমি বা জলাভূমি ‘তাল’, প্রাচীন পলিগঠিত উচ্চভূমি
‘বরেন্দ্রভূমি’, নবীন পলিগঠিত উর্বরভূমি ‘দিয়ারা’ এবং মহানন্দার পলিগঠিত ‘মহানন্দা সমভূমি’।
দক্ষিণবঙ্গের সমভূমি –
এই সমভূমি চারভাগে বিভক্ত। যথা –
- রাঢ় অঞ্চল – পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের পূর্বপ্রান্ত থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদীর অববাহিকা পর্যন্ত বিস্তৃত প্রাচীন পলিগঠিত অঞ্চলটি রাঢ় অঞ্চল নামে পরিচিত। এখানকার ভূপ্রকৃতি রুক্ষ এবং মাটির রং লাল।
- গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চল – উত্তরে গঙ্গা নদী, পূর্বে বাংলাদেশ, পশ্চিমে রাঢ় অঞ্চল এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত সমতলভূমি গঙ্গার বদ্বীপ নামে পরিচিত। বদ্বীপ অঞ্চল আবার তিনটি উপবিভাগে বিভক্ত, যথা – উত্তরাংশকে মৃতপ্রায় বদ্বীপ মধ্যাংশকে পরিণত বদ্বীপ এবং দক্ষিণাংশকে সক্রিয় বদ্বীপ বলা হয়ে থাকে।
- সুন্দরবনের কর্দমাক্ত নিম্নভূমি – সক্রিয় বদ্বীপের দক্ষিণাংশ কর্দমাক্ত নিম্নভূমির অন্তর্গত। অঞ্চলটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত বলে জোয়ারের সময় এই অঞ্চল সমুদ্রের লবণাক্ত জলে ডুবে যায়। এখানে গভীর অরণ্যের সৃষ্টি হয়েছে, যার নাম সুন্দরবন।
- উপকূলের বালুকাময় সমভূমি – হুগলি নদীর মোহানার পশ্চিমে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চল এর অন্তর্গত। এখানকার উল্লেখযোগ্য বালিয়াড়ি হল কাঁথি ও দিঘা বালিয়াড়ি।
পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চল ও মালভূমি অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির তুলনা করো।
পার্থক্যের বিষয় | পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চল | পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চল |
অবস্থান | পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে শিলিগুড়ি মহকুমা বাদে সমগ্র দার্জিলিং জেলা, কালিম্পং জেলা ও জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর ভাগ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চল অবস্থান করছে। | পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে সমগ্র পুরুলিয়া জেলাসহ বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, বীরভূম ও পশ্চিম বর্ধমান জেলা নিয়ে মালভূমি অঞ্চল অবস্থিত। |
ভূমিরূপগত অবস্থান | এই অঞ্চল হিমালয় পর্বতের অংশ বলে, একে ‘দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল’ বলে। | পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল ছোটোনাগপুর মালভূমির অংশ বিশেষ। |
শিলা | এই অঞ্চলটি পাললিক ও রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত। | এই অঞ্চলটি প্রাচীন আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত। |
বয়স | ভূ-গাঠনিক দিক থেকে এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম নবীনতম অঞ্চল। | এটি ভু-গাঠনিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম অংশ। |
ভূমিরূপের বৈশিষ্ট্য | সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি, গভীর নদীখাত, খাড়া ঢাল এখানকার ভূমিরূপের প্রধান বৈশিষ্ট্য। | ক্ষয়প্রাপ্ত ও উঁচু নীচু অর্থাৎ, তরঙ্গায়িত ভূমিসহ ছোটো পাহাড় বা টিলার অবস্থান এখানকার ভূমিরূপের প্রধান বৈশিষ্ট্য। |
গড় উচ্চতা | এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা প্রায় 600-3000 মিটার। | এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা প্রায় 150-200 মিটার বা তার বেশি। |
উল্লেখযোগ্য পর্বতশ্রেণি | এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য পর্বতশ্রেণিগুলি হল সিঙ্গালিলা, দার্জিলিং-লেবাং শৈলশিরা, দেওলা, দুরবিনদারা পর্বতশ্রেণি। | এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য পাহাড় হল অযোধ্যা, শুশুনিয়া, বাঘমুন্ডি, পাঞ্চেৎ, বিহারীনাথ, ভাণ্ডারি প্রভৃতি। |
উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ | সান্দাকফু (3,630 মিটার), ফালুট (3,595 মিটার), সবরগ্রাম (3,543 মিটার), টাংলু (3,063 মিটার), টাইগার হিল (2,585 মিটার) প্রভৃতি। | গোর্গাবুরু (677 মিটার), বাঘমুন্ডি (670 মিটার), পাঞ্চেৎ (643 মিটার), শুশুনিয়া (440 মিটার) প্রভৃতি। |
সর্বোচ্চ শৃঙ্গ | এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল সান্দাকফু (3,630 মিটার)। | এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল অযোধ্যা পাহাড়ের গোর্গাবুরু (677 মিটার)। |
ভূমির ঢাল | সমগ্র অঞ্চলটি ক্রমশ উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালু হয়ে গেছে। | সমগ্র অঞ্চলটি ধীরে ধীরে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঢালু হয়ে গেছে। |
নদী উপত্যকা | এই অঞ্চলে তিস্তা, জলঢাকা, তোর্সা, রঙ্গিত প্রভৃতি নদী গভীর নদী-উপত্যকা সৃষ্টি করে প্রবাহিত হয়েছে। | এই অঞ্চলে দামোদর, দ্বারকেশ্বর, কংসাবতী প্রভৃতি নদ-নদী অগভীর ও চওড়া নদী-উপত্যকা সৃষ্টি করে প্রবাহিত হয়েছে। |
পশ্চিমবঙ্গের ব-দ্বীপ সমভূমির বিবরণ দাও।
পশ্চিমবঙ্গের ব-দ্বীপ সমভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপ সমভূমির অংশ। এই ব-দ্বীপ সমভূমির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল।
- আবস্থান – পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম এই ভূ-প্রাকৃতিক বিভাগটি ভাগীরথী ও হুগলি নদীর উভয় তীরে মুরশিদাবাদ জেলার পূর্বাংশ, সমগ্র নদিয়া, হাওড়া, হুগলি, কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনা এবং পূর্ব বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে।
- উৎপত্তি – কোয়াটারনারি যুগের পলি দ্বারা আবৃত এই অঞ্চলটি এক সময় সমুদ্রগর্ভের মহীসোপান রূপে অবস্থান করত। ‘বেঙ্গল বেসিন’ নামক এই মহীসোপান অঞ্চলে হাজার হাজার বছর ধরে গঙ্গা, ময়ূরাক্ষী, অজয়, রূপনারায়ণ, দামোদর প্রভৃতি নদী প্রচুর পলি সঞ্চয় করে ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে। এই ব-দ্বীপগুলি ক্রমশ পরস্পর যুক্ত হয়ে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ সমভূমি সৃষ্টি হয়েছে।
- ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য –
- সমগ্র অঞ্চলটি বৈচিত্র্যহীন সমতল প্রকৃতির।
- গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 10-15 মিটারের কাছাকাছি।
- সমভূমিটি উত্তর থেকে দক্ষিণে ক্রমশ ঢালু।
- উর্বর পলি মাটি দ্বারা আবৃত।
- এখানে অসংখ্য খাল, বিল, জলাভূমি, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়।
- ভূ-প্রাকৃতিক বিভাগ – 1944 সালে অধ্যাপক কে বাগচী তাঁর ‘Ganges Delta’ বই -এ পলিসঞ্চয়ের সময় অনুসারে বদ্বীপ অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করেন। যথা –

মৃতপ্রায় ব-দ্বীপ –
- অবস্থান – মুরশিদাবাদ জেলার পূর্বাংশ ও সমগ্র নদিয়া জেলা ও উত্তর 24 পরগনার উত্তরাংশ।
- বৈশিষ্ট্য –
- এই অঞ্চলটি প্রাচীন পলিগঠিত।
- এই অঞ্চলটিতে বদ্বীপ গঠনের কাজ শেষ হয়েছে। জলঙ্গী, চূর্ণি, ইছামতী, ভৈরবী ইত্যাদি নদী ভাগীরথীর মুখে চরা পড়ার কারণে মজে গেছে বলে বদ্বীপ গঠন আর সম্ভব নয়। তাই এই অঞ্চলকে ‘মৃতপ্রায় বা মুমূর্ষু বদ্বীপ অঞ্চল’ বলে।
- গঙ্গা নদীর পূর্বদিকে সরে যাবার দরুন পলি সঞ্চয়ের পরিবর্তে এখানে ভাঙন দেখা যাচ্ছে।
- অঞ্চলটি জলাভূমি এবং অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদে পরিপূর্ণ।
পরিণত বদ্বীপ –
- অবস্থান – দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার উত্তরাংশ, উত্তর 24 পরগনা জেলার মধ্যাংশ, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর ও পূর্ব বর্ধমান।
- বৈশিষ্ট্য –
- এই অঞ্চলটি নবীন পলিগঠিত।
- একে ‘পরিণত বদ্বীপ’ অঞ্চল বলার কারণ হল এই অঞ্চলে নদীবাহিত পলি, বালি, কাদা সঞ্চিত হয়ে বদ্বীপ গঠনের কাজ প্রায় শেষ।
- অল্প কিছু অংশে এখনও বদ্বীপ গঠন ও নদীর জল নিষ্কাশনের কাজ চলছে।
- এখানে নদীর জলধারা ক্ষীণভাবে প্রবাহিত।
- এই অঞ্চলে পলি সঞ্চয়ের ফলে স্বাভাবিক বাঁধও সৃষ্টি হয়েছে।
সক্রিয় বদ্বীপ –
- অবস্থান – দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার মধ্য ও পূর্বাংশ এবং উত্তর 24 পরগনার দক্ষিণাংশ।
- বৈশিষ্ট্য –
- এই অঞ্চলটি নবীন পলিগঠিত।
- এই অঞ্চলের নদীগুলি প্রাণবন্ত থাকায় এখানে এখনও পলি সঞ্চয়ের কাজ চলছে। ফলে বদ্বীপ এখনও গঠিত হচ্ছে বলে এই অঞ্চলকে সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চল বলা হয়।
- মূলত রায়মঙ্গল, হাড়িয়াভাঙা, মাতলা, সপ্তমুখী ইত্যাদি নদী পলি সঞ্চয়ের কাজ করছে।
- এখানকার নবগঠিত দ্বীপের নাম পূর্বাশা।
পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য নদ-নদীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
অথবা, পশ্চিমবঙ্গের বরফ গলা জলে পুষ্ট নদ-নদীর পরিচয় দাও।
উত্তরাঞ্চল বা পার্বত্য অঞ্চল বা উত্তরবাজার নদনদীসমূহ –
প্রধান প্রধান নদনদী –
- তিস্তা (315 কিমি) – দার্জিলিং-হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের সর্বপ্রধান নদী তিস্তা সিকিমের জেমু হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে সিকিম ও পরে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। বড়ো রঙ্গিত, রিয়াং, রংপো, রিল্লি ইত্যাদি নদীগুলি হল তিস্তার উপনদী। বর্ষাকালে এই নদীতে ভয়ানক বন্যা হয় বলে একে ‘ত্রাসের নদী’ বলে।
- তোর্সা (প্রায় 320 কিমি) – চিনের অন্তর্গত তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা থেকে উৎপন্ন হয়ে তোর্সা ভুটানে আমুচু নামে প্রবাহিত হয়েছে। এটি উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলা অতিক্রম করে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। কালজানি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে এই নদী বাংলাদেশে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তোর্সার দুটি উপনদী হল – কালজানি ও হলং।
- মহানন্দা (প্রায় 360 কিমি) – দার্জিলিং হিমালয়ের মহালধিরাম পর্বতের পাগলাঝোরা প্রস্রবণ থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে দক্ষিণে ও তারপর দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে বিহারের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহের পর এটি পশ্চিমবঙ্গের মালদায় প্রবেশ করেছে এবং শেষে বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে মিলিত হয়েছে। এর প্রধান উপনদী হল – বালাসন ও মেচি।
- জলঢাকা (প্রায় 192 কিমি) – সিকিম-ভুটান সীমান্তবর্তী পার্বত্য অঞ্চলের বিদাং হ্রদ থেকে জলঢাকা নদী উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের যমুনা নদীতে মিলিত হয়েছে। এর উপনদীগুলি হল নকশালখোলা, মুজনাই, ডায়না, দুদুয়া, বিরুখোলা, বিন্দুখোলা প্রভৃতি।
নদীগুলির বৈশিষ্ট্য –
- এই অঞ্চলের নদীগুলির বেশিরভাগই হিমবাহ বা প্রস্রবণ থেকে সৃষ্ট।
- নদীগুলি মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ববাহিনী।
- নদীগুলি বরফগলা জলে পুষ্ট এবং নিত্যবহ।
- নদীগুলি অত্যন্ত খরস্রোতা বলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উপযোগী।
- নদীগুলির খাত খুব গভীর এবং ‘V’ আকৃতির ন্যায়।
- নদীগুলির বেশিরভাগই বাংলাদেশের যমুনা নদীর উপনদী।
- নদীগুলি বন্যাপ্রবণ।
- এখানকার নদীগুলি কোনোটাই সরাসরি সমুদ্রে মেশেনি বলে নদীগুলিতে জোয়ারভাটা হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যভাগের নদনদীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
মধ্যাঞ্চলের বা মধ্যবঙ্গের নদনদীসমূহ –
- গঙ্গা নদী (520 কিমি) – গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ গুহা থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদী পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নদী। যদিও পশ্চিমবঙ্গের খুব সামান্য অংশ দিয়ে গঙ্গা নদী প্রবাহিত হয়েছে। মুরশিদাবাদ জেলার মিঠিপুর গ্রাম থেকে গঙ্গা দুটি শাখায় ভাগ হয়ে একটি শাখা পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে এবং অন্য শাখাটি ভাগীরথী-হুগলি নাম নিয়ে সাগরদ্বীপের কাছে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
- ভাগীরথী-হুগলি নদী – পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার বদ্বীপ সমভূমি অঞ্চলের প্রধান নদী ভাগীরথী-হুগলি। গঙ্গার এই শাখা নদীটি নদিয়ার স্বরূপগঞ্জ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত হুগলি নদী নামে পরিচিত এবং বাকি অংশ ভাগীরথী-হুগলি নামে পরিচিত। এই অঞ্চলের অন্যান্য নদীগুলিকে ভাগীরথী-হুগলি নদীর ডানতীরের উপনদী ও ভাগীরথী-হুগলি নদীর বামতীরের উপনদী এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
ভাগীরথী-হুগলি নদীর ডানতীরের উপনদী –
ভাগীরথী-হুগলি নদীর ডানতীরের বা পশ্চিমতীরের উপনদীগুলি হল – দামোদর, রূপনারায়ণ, ময়ূরাক্ষী, অজয়, দ্বারকেশ্বর, হলদি, ব্রাহ্মণী, শিলাবতী, কংসাবতী বা কাঁসাই প্রভৃতি। কংসাবতী ও কেলেঘাই নদীর মিলিত প্রবাহ হলদি নদী নামে এবং শিলাবতী ও দ্বারকেশ্বর নদীর মিলিত প্রবাহ রূপনারায়ণ নদ নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য –
- বর্ষার জলে পুষ্ট।
- গ্রীষ্মকালে নদীতে প্রায় জল থাকে না বা শুকিয়ে যায়।
- বর্ষাকালে অতিরিক্ত জলপ্রবাহ প্রায়ই বন্যা ঘটায়।
ভাগীরথী-হুগলি নদীর বামতীরের উপনদী –
ভাগীরথী-হুগলি নদীর বামতীরের বা পূর্বতীরের প্রধান উপনদীগুলি হল জলঙ্গী ও চূর্ণি। এ ছাড়া কিছু শাখানদী; যেমন- পদ্মার শাখানদী মাথাভাঙা ও মাথাভাঙার শাখানদী কালিন্দী, ইছামতী এবং ভাগীরথীর শাখানদী বিদ্যাধরী এখানে প্রবাহিত হয়েছে। এ ছাড়া মাতলা, পিয়ালী নদীর কিছু অংশ এখানে প্রবাহিত।
বৈশিষ্ট্য – প্রধানত লবণাক্ত জলে পুষ্ট; পলি জমে অধিকাংশ নদীই মৃতপ্রায় বা মজে গেছে; নদী উপত্যকার গভীরতা কম বলে বর্ষাকালে বন্যা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশের নদ-নদীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
অথবা, পশ্চিমবঙ্গের জোয়ারের জলে পুষ্ট নদ-নদীর বৈশিষ্ট্য লেখো।
দক্ষিণাঞ্চলের নদনদীসমূহ –
সুন্দরবন না সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলের নদনদী –
মাতলা, পিয়ালি, গোসাবা, বিদ্যাধরী, ঠাকুরান, রায়মঙ্গল, কালিন্দী, সপ্তমুখী প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য –
- এই অঞ্চলের নদীগুলি দক্ষিণবাহিনী।
- নদীগুলি খাঁড়ির মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত।
- এগুলির উৎস খুঁজে বার করা কঠিন।
- জোয়ারের জলে নদীগুলি পুষ্ট বলে ভাটার টানে এদের ঊর্ধ্বপ্রবাহ শুকিয়ে যায়।
- নদীগুলির জল লবণাক্ত।
- নদীগুলির দৈর্ঘ্য কম।
- এগুলি মূল নদীর নিম্ন প্রবাহ।এদের গতি কম এবং পাড় নীচু।
কাঁথি বালিয়াড়ি অঞ্চলের নদনদী –
রসুলপুর, যাত্রা, পিছাবনী, চম্পা প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য –
- নদীগুলি মৃতপ্রায় অর্থাৎ প্রায় মজে গেছে।
- এগুলি মন্দস্রোতা। তাই সারাবছর জল থাকে না।
- জলের পরিমাণও কম।
- নদীগুলি মূলত সামুদ্রিক খাঁড়িতে পরিণত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলের নদনদীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
অথবা, পশ্চিমবঙ্গের বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদনদীর পরিচয় দাও।
পশ্চিমাঞ্চলের বা পশ্চিমের মালভূমি ও রাঢ় অঞ্চলের নদনদীসমূহ –
প্রধান প্রধান নদনদী –
- দামোদর (592 কিমি) – ঝাড়খণ্ডের পালামৌ জেলার খামারপাত পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে দামোদর মালভূমি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুগলি নদীতে পড়েছে। এর প্রধান শাখানদী মুন্ডেশ্বরী এবং উপনদী বোকারো ও বরাকর। পূর্বে এই নদীতে বন্যা হত বলে, একে ‘বাংলার দুঃখ’ বা ‘দুঃখের নদ’ বলা হত।
- অজয় (276 কিমি) – অজয় ছোটোনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিম বর্ধমান ও বীরভূমের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কাটোয়ার কাছে ভাগীরথীতে মিশেছে। হিংলো, কুনুর এর উপনদী।
- ময়ূরাক্ষী (241 কিমি) – ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনার ত্রিকূট পাহাড় থেকে সৃষ্ট এই নদী বীরভূম জেলাকে অতিক্রম করে ভাগীরথীতে পড়েছে। এর উপনদীগুলি হল ব্রাহ্মণী, বক্রেশ্বর, কোপাই, দ্বারকা প্রভৃতি।
- দ্বারকেশ্বর – পুরুলিয়ার তিলাবনি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের কাছে শিলাবতী বা শিলাই নদীতে মিশেছে।
- রূপনারায়ণ (138 কিমি) – মেদিনীপুরের ঘাটালের কাছে দ্বারকেশ্বর ও শিলাবতী বা শিলাই নদী মিলিত হয়ে রূপনারায়ণ সৃষ্টি হয়েছে। এই নদী দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে গেঁওখালির কাছে হুগলি নদীতে মিশেছে।
- কংসাবতী বা কাঁসাই (336 কিমি) – অযোধ্যা পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কংসাবতী পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঝাড়গ্রামে প্রবেশ করে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। এর একটি শাখা রূপনারায়ণের সঙ্গে মিলিত হয়েছে ও অপর শাখাটি কেলেঘাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে হলদি নাম নিয়ে হুগলি নদীতে পড়েছে। এর একটি উপনদী হল কুমারী।
- সূবর্ণরেখা (477 কিমি) – ঝাড়খণ্ডের ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে সৃষ্ট হয়ে এই নদী পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলের খুব অল্প স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
নদীগুলির বৈশিষ্ট্য –
- এই অঞ্চলের নদনদীগুলি পশ্চিম থেকে প্রবাহিত হয়ে পূর্ব ও দক্ষিণবাহিনী হয়েছে।
- নদীগুলি মূলত অনুচ্চ পাহাড় ও মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
- নদীগুলির অধিকাংশই ভাগীরথী-হুগলি নদীর উপনদী।
- নদীগুলি বৃষ্টির জলে পুষ্ট।
- নদীগুলি গ্রীষ্মকালে শুষ্ক থাকে।
- নদীগুলি খরস্রোতা বলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
- বর্ষাকালে নদীগুলিতে বন্যা হয়।
- নদীবক্ষে চর দেখা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চল, মালভূমি অঞ্চল এবং সুন্দরবন অঞ্চলের নদনদীর তুলনামূলক আলোচনা করো।
বিষয় | পার্বত্য অঞ্চলের নদী | মালভূমি অঞ্চলের নদী | সুন্দরবন অঞ্চলের নদী |
উল্লেখযোগ্য নদী | তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মহানন্দা, রায়ডাক, সঙ্কোশ প্রভৃতি। | দামোদর, অজয়, ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী, রূপনারায়ণ, সুবর্ণরেখা প্রভৃতি। | মাতলা, গোসাবা, পিয়ালী, রায়মঙ্গল, বিদ্যাধরী, ঠাকুরান প্রভৃতি। |
জলের উৎস | হিমালয়ের বরফগলা জল ও বৃষ্টির জলে পুষ্ট। | কেবল বৃষ্টির জলে পুষ্ট। | জোয়ারের জলে পুষ্ট। |
জলের স্থায়িত্ব | সারাবছর নদীগুলিতে জল থাকে। | শুষ্ক ঋতুতে নদীগুলির জল শুকিয়ে যায়। | ভাটার সময় নদীগুলি প্রায় শুকিয়ে যায়। |
প্রবাহের দিক | এই নদীগুলি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। | এগুলি পশ্চিম থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ- পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। | এই নদীগুলি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। |
নদী উপত্যকা | এই নদীগুলির উপত্যকা অত্যন্ত গভীর ও সংকীর্ণ। | নদী উপত্যকাগুলি অগভীর ও চওড়া। | নদী উপত্যকাগুলি অত্যন্ত প্রশস্ত ও মোহানার কাছে চওড়া খাঁড়ির সৃষ্টি হয়েছে। |
মোহানা | মহানন্দা ছাড়া অন্যান্য নদী বাংলাদেশে যমুনা নদীতে মিশেছে। | এই নদীগুলি মূলত ভাগীরথী-হুগলি নদীতে মিশেছে। | এখানকার নদীগুলি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। |
জলের প্রকৃতি | বরফগলা জলে পুষ্ট বলে নদীগুলির জল লবণাক্ত নয়। | বৃষ্টির জলে পুষ্ট বলে নদীগুলির জল লবণাক্ত নয়। | জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল প্রবেশ করায় নদীগুলির জল লবণাক্ত। |
জলসেচ | নদীগুলিতে জলসেচ ব্যবস্থা তেমন বিকাশ লাভ করেনি। | এই নদীগুলিতে প্রচুর পরিমাণে জলসেচ করা হয়। | লবণাক্ত জল হওয়ায় জলসেচ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। |
বিদ্যুৎ উৎপাদন | নদীগুলির প্রবল স্রোত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়ক। | মালভূমির খরস্রোতা নদীগুলিতেও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধা আছে। | জোয়ারভাটা শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ আছে। |
বন্যা | বর্ষাকালে প্রবল বন্যা দেখা যায়। | বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির কারণে নদীগুলিতে বন্যা দেখা যায়। | প্রবল ভরা জোয়ারের সময় সুন্দরবন অঞ্চলে বন্যা সৃষ্টি হয়। |
পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নদীর গতিপথ বর্ণনা করো।
গঙ্গা ও তার শাখানদী ভাগীরথী-হুগলি পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নদীরূপে পরিচিত। নিম্নে এর গতিপথ আলোচনা করা হল –
গঙ্গা নদীর গতিপথ –
উৎস – উত্তরাখণ্ডের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ নামক তুষারগুহা।
দৈর্ঘ্য – মোট 2,525 কিমি, পশ্চিমবঙ্গে 520 কিমি।

গতিপথ –
- উচ্চগতি – উচ্চগতি গোমুখ গুহা থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত গঙ্গার উচ্চগতি।
- মধ্যগতি – হরিদ্বার থেকে উত্তরপ্রদেশ, বিহার হয়ে ঝাড়খন্ডের রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত গঙ্গার মধ্যগতি।
- নিম্নগতি – রাজমহল পাহাড় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত গঙ্গার নিম্নগতি।
পশ্চিমবঙ্গে প্রবাহ পথ –
- ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড়ের কাছে দক্ষিণে বেঁকে গঙ্গা নদী পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় প্রবেশ করেছে।
- এর পর দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে মুরশিদাবাদের ধুলিয়ানের নিকট ভগবানগোলায় দুটি শাখায় ভাগ হয়েছে।
- প্রধান শাখা পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
- অপর শাখাটি পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে ভাগীরথী-হুগলি নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে।
- ধুলিয়ান থেকে নবদ্বীপ (ভাগীরথী-জলঙ্গীর মিলনস্থল) পর্যন্ত এই নদী ভাগীরথী এবং নবদ্বীপ থেকে মোহানা পর্যন্ত হুগলি নামে পরিচিত।
মোহানা – গঙ্গা নদী পদ্মা ও ভাগীরথী-হুগলি এই দুই শাখায় বিভক্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
উপনদী ও শাখানদী – পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা নদীর গতিপথে দামোদর, ময়ূরাক্ষী, অজয়, যমুনা, চম্বল, শোন ইত্যাদি উপনদী এবং ইছামতী, চূর্ণি, মাথাভাঙা, জলঙ্গী ইত্যাদি শাখানদী সৃষ্টি হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলের প্রধান নদ-নদীটির বিবরণ দাও।
অথবা, দামোদরের গতিপথের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
দামোদর নদের গতিপথ – দামোদর পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদ। এই নদ ঝাড়খণ্ডের (পালামৌ জেলা) ছোটোনাগপুর মালভূমির খামারপাত পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই নদ ঝাড়খণ্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে পূর্ব বর্ধমান ও হুগলি জেলার ওপর দিয়ে পূর্বে প্রবাহিত হয়েছে এবং হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়ার কাছে ভাগীরথী-হুগলি নদীতে পতিত হয়েছে। বর্তমানে দামোদর নদের মূল প্রবাহ শীর্ণ হয়ে গেছে এবং এই নদীর বেশিরভাগ জল এর প্রধান শাখানদী মুন্ডেশ্বরীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই অঞ্চলে দামোদর নদ অনেকবার গতি পরিবর্তন করেছে। এর পুরাতন নদীখাতগুলি কানাখাল, কানানদী, বাঁকা, কানা, দামোদর, বেহুলা প্রভৃতি নামে পরিচিত।

শাখানদী ও উপনদী – দামোদরের উপনদীগুলি হল – কোনার, শিবানী, বরাকর এবং শাখানদীগুলি হল – মুন্ডেশ্বরী, হিংলো, কুনুর প্রভৃতি।
বিশেষ নাম – মালভূমি অঞ্চলে প্রচুর মাটি ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট পলি দামোদর নদ বহন করতে পারে না, উপরন্তু সমভূমিতে এর গতিবেগ ও নদীখাতের গভীরতা দুই-ই কম। আবার শাখা নদী মুন্ডেশ্বরীর মধ্য দিয়ে বেশিরভাগ জল প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণ নদে চলে যায় বলে এর মোহানা অংশ খুব সংকীর্ণ ও আঁকাবাঁকা প্রকৃতির। তাই বর্ষাকালে প্রচুর জলের আধিক্য হলে বন্যা দেখা যায়। তাই এই নদকে ‘বাংলার দুঃখ’ বা ‘দুঃখের নদ’ বলা হয়। তবে বর্তমানে বাঁধ দিয়ে এই বন্যার প্রকোপ অনেকটা প্রশমিত করা হয়েছে।
উপকূলের বালুকাময় সমভূমি অঞ্চলের অবস্থান, ভূপ্রকৃতি ও নদনদী সম্পর্কে যা জানো লেখো।
অবস্থান – পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত হল পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের বালুকাময় সমভূমি অঞ্চল। এই সমভূমি উত্তর-দক্ষিণে 5-10 কিমি চওড়া এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় 50 কিমি দীর্ঘ। সমগ্র অঞ্চলটির ক্ষেত্রমান প্রায় 1,352 বর্গকিমি। এই অঞ্চলের উত্তরে ওড়িশা উপকূল, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে হলদি নদী এবং পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদীর মোহানা অবস্থিত।
ভূপ্রকৃতি – এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি প্রায় সমতল এবং উপকূলের দিকে ঢালু। দীর্ঘদিন ধরে উপকূলভাগের তটভূমিতে সমুদ্রতরঙ্গ, বায়ুপ্রবাহ, জোয়ারভাটা দ্বারা বালি সঞ্চিত হয়ে বালিয়াড়ি গঠন করেছে। বালিয়াড়িগুলি উপকূলের সমান্তরালে বিস্তৃত হয়েছে। এই অঞ্চলে দুটি শ্রেণিবদ্ধ বালিয়াড়ি দেখা যায়; যথা – কাঁথি বালিয়াড়ি, দিঘা বালিয়াড়ি।
কাঁথি বালিয়াড়ি – সমুদ্রের উপকূল থেকে প্রায় 9-10 কিমি ভিতর দিকে কাঁথি মহকুমার কাছে যে শ্রেণিবদ্ধ বালিয়াড়ি অবস্থান করছে, তাকে কাঁথি বালিয়াড়ি বলে। এই বালিয়াড়ি পুরোনো এবং বর্তমানে স্থায়ী বালিয়াড়িতে পরিণত হয়েছে। এখানকার বালিয়াড়িগুলি প্রায় 15-25 মিটার উঁচু হয়ে থাকে।
দিঘা বালিয়াড়ি – পশ্চিমবঙ্গের দিঘার নিকটবর্তী সমুদ্র উপকূলের বালিয়াড়িসমূহকে দিঘা বালিয়াড়ি বলে। এই বালিয়াড়ি অপেক্ষাকৃত নবীন ও আলগা ধরনের। সমুদ্রক্ষয়ের ফলে পশ্চিম দিকে দিঘা তটভূমি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এবং পূর্বদিকে সঞ্চয়কার্যের ফলে জুনপুটের কাছে নতুন তটভূমি গড়ে উঠেছে। বালিয়াড়িগুলি প্রায় 50–75 মিটার চওড়া ও প্রায় 10-12 মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে।
নদনদী – উপকূলের বালুকাময় সমভূমি অঞ্চলে কোনো উল্লেখযোগ্য বড়ো নদী নেই। এখানকার প্রধান নদী রসুলপুর। এছাড়া উপকূলের মধ্যভাগে পিছাবনী, যাত্রা প্রভৃতি ছোটো নদী দেখা যায়। নদীগুলির জল লবণাক্ত হয় কারণ নদীগুলি জোয়ারের জলে পুষ্ট। নদীগুলি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। নদীগুলি খাঁড়ি প্রকৃতির হয়। এদের উৎস খুঁজে পাওয়া কঠিন।
পশ্চিমবঙ্গে জলের বহুমুখী ব্যবহার আলোচনা করে জলসম্পদের প্রভাব বর্ণনা করো।
মানুষসহ সমগ্র জীবজগৎ সৃষ্টিতে জলের গুরুত্ব অপরিসীম। পশ্চিমবঙ্গের জলসম্পদ হিসেবে ভূ-পৃষ্ঠস্থ জল ও ভৌমজলের বহুমুখী ব্যবহার নিম্নে আলোচিত হল –

- কৃষিকাজে ব্যবহার – কৃষিকাজ পশ্চিমবঙ্গের প্রধান জীবিকা। ভাগীরথী, হুগলি নদীর উর্বর প্লাবনভূমিতে ভৌমজল ও জলসেচের সাহায্যে চাষাবাদ করা হয়।
- পরিবহণের কাজে – পরিবহণে জলপথের জুড়ি নেই। হুগলি নদীতে জাহাজ, ট্রলার, নৌকার মাধ্যমে পরিবহণ কার্য করা হয়। সুন্দরবনের পরিবহণের অন্যতম মাধ্যম নদী।
- জলবিদ্যুৎ উৎপাদন – পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলের কিছু খরস্রোতা নদীতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। যেমন – জলঢাকা, ম্যাসাঞ্জোর, ছোটো রঙ্গিত, বাঘমুন্ডি প্রভৃতি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
- পানীয় ও দৈনন্দিন ব্যবহারে – মাটির নীচের ভৌমজল কূপ, নলকূপের মাধ্যমে তুলে এনে বা নদীর জল বিশুদ্ধ করে পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া দৈনন্দিন কাজে প্রচুর জল ব্যবহার করা হয়।
- শিল্পাক্ষেত্রে ব্যবহার – শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জলের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক। যেমন – হুগলি নদীর জল হুগলি শিল্পাঞ্চলের এবং হলদি নদীর জল হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের জলের জোগান দিয়ে থাকে।
- মাছ চাষ – নদী ও খালের জলকে কাজে লাগিয়ে ভেড়ি তৈরি করে মাছ চাষ করা হয়। যেমন – সুন্দরবনের খাঁড়ি অঞ্চলের জলাভূমির মৎস্য চাষ।
- পশুপালন – ভৌমজল, নদী-খাল, জলাশয়ের জল পশুপালনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।
জলসম্পাদর প্রভাব –
সুপ্রভাব –
- পশ্চিমবঙ্গে কৃষি উৎপাদন বিশেষত ধান, পাট, চা -এর উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
- পশ্চিমবঙ্গে তাপবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রসার ঘটেছে।
- বিভিন্ন শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
- শহর-নগরের প্রসার ঘটেছে।
- মৎস্য চাষের উন্নতি ঘটেছে।
কুপ্রভাব –
- জলদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- আর্সেনিকের প্রভাব বেড়ে চলেছে।
- মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে।
- শহরাঞ্চলে জলসংকট প্রকট হচ্ছে।
- জলবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের জলসম্পদের অতি ব্যবহারের ফলাফলগুলি লেখো।
অথবা, পশ্চিমবঙ্গের ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভৌমজলের বহুমুখী ব্যবহার ও অতি ব্যবহারের গুণাগুণ লেখো।
জল জীবের বেঁচে থাকার জন্য একান্ত প্রয়োজন। ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভৌমজলের এই উপযোগিতা, কার্যকারিতা থাকায় জল আমাদের কাছে সম্পদ। জল মানবজীবনে বহুবিধ কাজে ব্যবহার করা হয় –
জলসম্পদের ব্যবহারের সুফল –
- বহুফসলি চাষের বৃদ্ধি করা – পশ্চিমবঙ্গের উর্বর মৃত্তিকাযুক্ত অঞ্চলে অতিরিক্ত জলসেচের ফলে একফসলি চাষের জায়গায় বহু ফসলি শস্যের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বহুফসলি কৃষি চালু না হলে পশ্চিমবঙ্গবাসী অনাহারে মারা যেত। যেমন – উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনায় বহুফসলি চাষ বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
- তৃষ্ণা ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটায় – পানীয় জল প্রাথমিক ভাবে মানুষের তৃষ্ণা মেটায় এবং গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে জলের ব্যবহার অনস্বীকার্য। নদীর জলকে পরিস্রুত করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের ফলে মানবজীবন তথা অনান্য জীবকুলও বেঁচে আছে।
- মাছ চাষে উন্নতিসাধন – পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের নদ-নদী, খাল, জলাশয় প্রভৃতি স্থানে জলের সুব্যবহারের ফলে মাছ চাষে যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ করা যায়। যেমন – দক্ষিণ 24 পরগনায় সুন্দরবনে জলাশয় নির্মাণ করে মাছ চাষের উন্নতি ঘটানো হয়েছে।
- পর্যটন শিল্পের বিকাশ – নদী উপত্যকায় যে সমস্ত স্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, সেই সমস্ত জায়গায় পর্যটকদের প্রতিটি চাহিদা পূরণ, যেমন – স্নানাদি, ধর্মীয় কাজে জলকে ব্যবহার করা দক্ষিণেশ্বর, নদিয়ার মায়াপুরে মঠে গঙ্গার জলের ব্যবহার পর্যটন শিল্পে যথেষ্ট উন্নতিসাধন করেছে।
- জলবিদ্যুৎ তৈরিতে – নদীর জলস্রোতে টারবাইনের চাকা ঘুরিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরি হয়। যেমন – পশ্চিমবঙ্গের ম্যাসাঞ্জোর, ছোটো রঙ্গিত।
- শিল্পক্ষেত্র ও বনসৃজন – যে-কোনো শিল্প গড়ে তুলতে জল ব্যবহার করা হয়। যেমন – হুগলি শিল্পাঞ্চলের জলের চাহিদা মেটায় হুগলি নদী। নতুন বনসৃজনের জন্য জল ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন।
- পরিবহণের সুবিধা – নদী ও খালপথে কম খরচে যাতায়াত ও বাণিজ্যের সুবিধা হয়।
- উর্বরতা বৃদ্ধি – কূপ-নলকূপের জলে নাইট্রেট, ক্লোরাইড, সালফেট প্রভৃতি খনিজ দ্রবীভূত থাকে, যা কৃষিজমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
জলসম্পদের অভিব্যবহারের কুফল –
আর্সেনিকের পরিমাণ বৃদ্ধি – পানীয় জল, চাষবাস প্রভৃতি কাজের জন্য প্রচুর জল মাটির নীচ থেকে তোলা হচ্ছে। ফলে সেখানে শূন্যস্থানে আর্সেনিক যৌগ মাটিতে মিশছে। পরে ওখানে আবার জল এসে পড়লে তাতে আর্সেনিক মিশছে। ওই আর্সেনিক যুক্ত জল খেয়ে মানুষ ব্ল্যাকফুট রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের জেলা ভিত্তিক আর্সেনিকের পরিমাণ
জেলা | আর্সেনিকের পরিমাণ |
মালদহ, মুরশিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনা, হাওড়া | 50 µg/L -এর বেশি |
দক্ষিণ ও উত্তর দিনাজপুর, পূর্ব বর্ধমান ও পশ্চিম বর্ধমান, হুগলি | 10-50 µg/L |
জলপাইগুড়ি, কালিম্পং, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং | 3-10 µg/L |
বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ও ঝাড়গ্রাম। | 3 µg/L -এর কম |
উদাহরণ – নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদা, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, কলকাতা এবং উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনায় আর্সেনিক দূষণ ক্রমশ বাড়ছে।
ফ্লুওরাইড দূষণ বৃদ্ধি – মাটিতে প্রচুর পরিমাণে ফসফেট সার, কাচ, প্লাস্টিক মেশার ফলে ফ্লুওরাইড জলে মিশছে। এই ফ্লুওরাইড মিশ্রিত জল খেলে মানুষের ফ্লুরোসিস রোগ হচ্ছে। ফলে দাঁতের ক্ষয়সহ অনেক রোগ দেখা দিচ্ছে।
উদাহরণ – পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, মালদা, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, দক্ষিণ 24 পরগনা জেলার 43টি ব্লকে ফ্লুওরাইড দূষণের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে।
ভৌমজলস্তরের অবনমন – গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে এত বেশি ভৌমজল উত্তোলন করা হচ্ছে যে ভৌমজলের স্তর ক্রমশ নীচে নেমে যাচ্ছে।
উদাহরণ – বিগত 40 বছরে বাঁকুড়া জেলায় 4.13 মিটার, পুরুলিয়ায় 2.24 মিটার, পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় 2.76 মিটার এবং কলকাতায় 7-11 মিটার নীচে জলস্তর নেমে গিয়েছে।
ভূমির অবনমন – অতিরিক্ত ভৌমজলের অবনমনের ফলে ভূমির ক্রমশ অবনমন ঘটছে এবং একটু একটু করে বসে যাচ্ছে। যেমন – কলকাতা মহানগরে অতিরিক্ত মাত্রায় ভৌমজল তুলে নেওয়ার ফলে প্রতিবছর ভৌমজল ক্রমশ অবনমিত হচ্ছে।
কৃষিজ ফসলের উৎপাদন ব্যাহত – কৃষিজমিতে অতিরিক্ত জলসেচ করার ফলে মাটিতে লবণের স্তর জমা হয় এবং মাটির ক্ষারকীয়তা বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষিজমিতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। যেমন – বর্ধমান ও হুগলি জেলায় বিভিন্ন নদী বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
জলদূষণ ও জলসংকট – গৃহস্থালি, শিল্পক্ষেত্র প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বর্জ্যপদার্থ পরিষ্কার করতে জলের ব্যাপক ব্যবহার মারাত্মক ভাবে জলদূষণ ঘটায়। বৃষ্টিহীন অঞ্চলগুলিতে যথেচ্ছাচারে ভৌমজলের ব্যবহার জলসংকটের মতো পরিস্থিতিও তৈরি করছে।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রকগুলি লেখো।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু বেশ কতকগুলি বিষয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জলবায়ুর নিয়ন্ত্রকগুলি হল –
- অক্ষাংশ – অক্ষাংশের তারতম্যের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা যায়। কর্কটক্রান্তিরেখা (23½° উত্তর) পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান ও নদিয়া জেলার উপর দিয়ে প্রসারিত। তাই এই রাজ্যের জলবায়ু উষ্ণ প্রকৃতির।
- হিমালয় পর্বত – এ রাজ্যের উত্তরে হিমালয় পর্বত অবস্থিত। আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এই পর্বতে বাধা পেয়ে এ রাজ্যে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়। আবার সাইবেরিয়ার অতি শীতল বায়ু এই পর্বতের দ্বারা বাধা পায় বলে আমাদের রাজ্যে শীতের তীব্রতাও কম।
- ভূমির উচ্চতা – ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা কমতে থাকে। তাই অধিক উচ্চতায় অবস্থিত হওয়ায় দার্জিলিং -এর জলবায়ু শীতল প্রকৃতির, আবার কম উচ্চতার জন্য কলকাতার জলবায়ু উষ্ণ প্রকৃতির।
- বায়ুপ্রবাহ – বায়ুপ্রবাহ পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন – দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত হয়। শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে ঠান্ডা পড়ে। গ্রীষ্মকালে স্থানীয় বায়ু ‘লু’ -এর প্রভাবে এ রাজ্যে তাপপ্রবাহ চলে। আবার কালবৈশাখীর প্রভাবে মাঝে মাঝেই ঝড়, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি হয়। শীতকালে মাঝে মাঝে পশ্চিম দিক থেকে আগত বায়ুর (পশ্চিমি ঝঞ্ঝা) প্রভাবে বৃষ্টি হয়।
- সমুদ্রের প্রভাব – জলভাগের তাপগ্রহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা কম হওয়ায় সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলের জলবায়ু সমভাবাপন্ন হয়। আবার সমুদ্র থেকে দূরের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন হয়। যেমন – বঙ্গোপসাগরের কাছে অবস্থানের জন্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলার জলবায়ু সমভাবাপন্ন। অন্যদিকে সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থানের জন্য পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলার জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। সমুদ্র উপকূলে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় (আয়লা), শরৎকালের ‘আশ্বিনের ঝড়’ পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে।
- মৃত্তিকা – মাটির গ্রথন ও গঠনের ওপর তাপগ্রহণের তারতম্য দেখা যায়। যেমন – পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের মাটি দ্রুত গরম ও ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু গাঙ্গেয় সমভূমির নবীন পলিমাটি ধীরে ধীরে তাপগ্রহণ করে। তাই জলবায়ুরও তারতম্য দেখা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
- ঋতু পরিবর্তন – পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ঋতু পরিবর্তন। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত ছাড়াও আরও দুটি ঋতুর অস্তিত্ব এখানে অনুভব করা যায় – হেমন্ত ও বসন্ত।
- মৌসুমি বায়ুর উপস্থিতি – গ্রীষ্মকালে বঙ্গোপসাগর থেকে আগত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ও শীতকালে মধ্য এশিয়া থেকে আগত উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু এই রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
- উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু – ঋতুগত বৈচিত্র্য দেখা গেলেও এই রাজ্য ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় বলয়ের মধ্যে অবস্থিত। তাই সামগ্রিকভাবে এই রাজ্যের জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র প্রকৃতির।
- উষ্ণতার স্বাভাবিক অবস্থা – মূলত পুরুলিয়া জেলা ছাড়া আর কোথাও গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা খুব অস্বাভাবিক হারে বাড়ে না। আবার শীতকালে দার্জিলিং -এর পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া কোথাও তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নামে না।
- আর্দ্র গ্রীস্মকাল ও শুষ্ক শীতকাল – পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ বৃষ্টিপাত গ্রীষ্মকালে হয়। শীতকালে বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না, শীতকাল শুষ্ক থাকে।
- বৃষ্টিপাতের বিভিন্নতা – পশ্চিমবঙ্গের সর্বাধিক বৃষ্টিপাত ঘটে উত্তরদিকে পার্বত্য অঞ্চলে। কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে। মালভূমি অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সবচেয়ে কম।
- স্থানভেদে উষ্ণতার তারতম্য – পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন ঋতুতে স্থানভেদে উষ্ণতার তারতম্য লক্ষিত হয়। যেমন – গ্রীষ্মকালে কলকাতার চেয়ে আসানসোলের তাপমাত্রা বেশি হয়। শীতকালে দার্জিলিং -এর তাপমাত্রা শিলিগুড়ির চেয়ে কম হয়।
- বর্ষার আগমনের অনিশ্চয়তা – দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এ রাজ্যে বর্ষার আগমন খুবই অনিশ্চিত। নির্ধারিত সময়ের কখনও আগে, আবার কখনও পরে বর্ষা এ রাজ্যে আসে। ফলে বন্যা বা খরা দেখা দেয়।
- তুষারপাত – এ রাজ্যে একমাত্র পার্বত্য অঞ্চলেই তুষারপাত ঘটে।
- ঘূর্ণিঝড় – গ্রীষ্মকালে ‘কালবৈশাখী’, শরৎকালে ‘আশ্বিনের ঝড়’ ও শীতকালে ‘পশ্চিমি ঝঞ্ঝা’ এ রাজ্যের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য।
তাপপ্রবাহ কাকে বলে।
বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা একনাগাড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে 5°C বা তার বেশি বিরাজ করলে তাকে তাপপ্রবাহ বলে। উদাহরণ – পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলে তাপপ্রবাহ দেখা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর ঋতুগত বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করো।
অথবা, পশ্চিমবঙ্গের ঋতু বৈচিত্র্য বর্ণনা করো।
পশ্চিমবঙ্গের ঋতু বৈচিত্র্য –
পশ্চিমবঙ্গের ঋতুবৈচিত্য পশ্চিমবঙ্গে প্রধানত চারটি ঋতুর প্রাধান্য দেখা যায়। যথা –
- গ্রীষ্মকাল
- বর্ষাকাল
- শরৎকাল
- শীতকাল
পশ্চিমবঙ্গের গ্রীস্মকাল –
- স্থিতির সময়কাল – পশ্চিমবঙ্গে মার্চ -এর শেষ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল চলে।
- গ্রীষ্মকালের প্রকৃতি – পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও তাপপ্রবাহযুক্ত।
- গ্রীষ্মকালের বৈশিষ্ট্য –
- প্রবাহিত বায়ু – এসময় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়।
- বায়ুর চাপ – এসময়ে বায়ুতে নিম্নচাপ বিরাজ করে। বাতাসে আর্দ্রতা কমতে থাকে।
- উষ্ণতম মাস – মে মাস পশ্চিমবঙ্গের উষ্ণতম মাস।
- উষ্ণতা – গ্রীষ্মকালে পশ্চিমবঙ্গের গড় উষ্ণতা 30°C-40°C হলেও স্থানভেদে উষ্ণতার পার্থক্য দেখা যায়। আসানসোলে 40°C -এর বেশি, পুরুলিয়ায় 45°C বা তার বেশি। আবার দার্জিলিং -এ 14°C-17°C।
- বৃষ্টিপাত – এসময় মাঝে মাঝে বিকালে কালবৈশাখী ঝড়ের প্রভাবে প্রায় 10 সেমি পর্যন্ত বৃষ্টি হয়।
- খরা – খুব বেশি গরমে বাঁকুড়া, বীরভূম ইত্যাদি জেলায় খরা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

পশ্চিমবঙ্গের বর্ষাকাল –
- স্থিতির সময়কাল – পশ্চিমবঙ্গে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষাকাল।
- বর্ষাকালের প্রকৃতি – এসময় বেশিরভাগ স্থানই বর্ষণসিক্ত থাকে। মাঝে মাঝে অস্বস্তিকর গরম অনুভূত হয়।
- বর্ষাকালের বৈশিষ্ট্য –
- প্রবাহিত বায়ু – এসময় আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়।
- বায়ুর চাপ ও আর্দ্রতা – এসময়ে বায়ুতে নিম্নচাপ বজায় থাকে। বাতাসে আর্দ্রতা থাকে সর্বাধিক।
- সবচেয়ে বর্ষণসিক্ত মাস – জুলাই সবচেয়ে বর্ষণসিক্ত মাস।
- উষ্ণতা – এসময়ে গড় উষ্ণতা থাকে 22°C-32°C, তবে কখনও খুব বর্ষণ হলে উষ্ণতা প্রায় 5°C মতো কমে যায়।
- বৃষ্টিপাত – বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় 175 সেমি। তবে অঞ্চল ভেদে পার্থক্য দেখা যায়। যেমন – পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় 400 সেমি, উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় 200 সেমি, মালভূমি অঞ্চলে প্রায় 100-125 সেমি।
- প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা – এসময় সাইক্লোন বা নিম্নচাপজনিত ঘূর্ণবাত মাঝে মধ্যে দেখা যায়।
- বন্যা – কোথাও মাত্রাতিরিক্ত বর্ষণ হলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গের শরৎকাল –
- স্থিতির সময়কাল – অক্টোবর ও নভেম্বর মাস জুড়ে পশ্চিমবঙ্গে শরৎকাল চলে।
- শরৎকালের প্রকৃতি – শরৎকালে উষ্ণতার তেজ প্রবল না হলেও গরম ভাব থাকে। মিঠে রোদে, মৃদুমন্দ বাতাস ও আকাশে সাদা মেঘের উপস্থিতি এই ঋতুর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য।
- শরৎকালের বৈশিষ্ট্য –
- প্রবাহিত বায়ু – এসময় প্রত্যাবর্তনকারী স্বল্প আর্দ্র মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়।
- বায়ুর চাপ – এসময়ে বায়ুতে উচ্চচাপ বিরাজ করে।
- আর্দ্রতা – এসময়ে বায়ুর আর্দ্রতা কমতে থাকে।
- উষ্ণতা – এসময়ে গড় উষ্ণতা 18°C–25°C থাকে।
- বৃষ্টিপাত – দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রত্যাবর্তন করার সময়ে আশ্বিনের ঝড়ের মাধ্যমে কিছুটা বৃষ্টিপাত ঘটায়।
- প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা – এসময়ের প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা হল ‘আশ্বিনের ঝড়’।
পশ্চিমবঙ্গের শীতকাল –
- স্থিতির সময়কাল – পশ্চিমবঙ্গে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শীতকাল চলে।
- শীতকালের প্রকৃতি – সমভূমি অঞ্চলের বেশিরভাগ স্থানেই সহনশীল ঠান্ডা পড়ে। সকালবেলা রৌদ্রকরোজ্জ্বল হয়। তবে উপকূলীয় অঞ্চলে কুয়াশা থাকে এবং পার্বত্য অঞ্চলের উষ্ণতা হিমাঙ্কের নীচে নামে।
- শীতকালের বৈশিষ্ট্য –
- প্রবাহিত বায়ু – এসময়ে শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। বায়ুর আর্দ্রতা খুব কম থাকে।
- বায়ুর চাপ – বায়ুতে এসময়ে উচ্চচাপ বিরাজ করে।
- উষ্ণতা – মোটামুটিভাবে সারা পশ্চিমবঙ্গে গড় উষ্ণতা 15°C-20°C থাকে। তবে বর্ধমান, বীরভূম ইত্যাদি জেলায় উষ্ণতা 7°C-8°C পর্যন্ত নামে। দার্জিলিং -এ 3°C-5°C উষ্ণতা থাকলেও মাঝে মধ্যে তা হিমাঙ্কের নীচে নামে।
- বৃষ্টিপাত – পশ্চিমবঙ্গের শীতকাল মূলত বৃষ্টিহীন। তবে পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রভাবে অল্প বৃষ্টিপাত হয়।
- তুষারপাত – দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে শীতকালে তুষারপাত ঘটে।
- প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা – এসময়ে ‘পশ্চিমি ঝঞ্ঝা’ নামক প্রাকৃতিক ঝড়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে।

পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর ওপর হিমালয়ের প্রভাবগুলি লেখো।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর ওপর হিমালয় পর্বতের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলা এবং সংলগ্ন নেপাল-সিকিম ও ভুটানের হিমালয় পর্বত পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন –
- বৃষ্টিপাতে সংগঠল – দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু হিমালয় পর্বতে বাধা পেয়ে প্রচুর শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি ঘটায়। যেমন – হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা-দুয়ারে পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে বেশি বৃষ্টি হয়।
- তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রক – ভূপৃষ্ঠ থেকে যত উপরের দিকে যাওয়া যায় ততই তাপমাত্রা কমতে থাকে। দার্জিলিং হিমালয়ের উচ্চতা বেশি হওয়ায় ওখানে সারা বছর তাপমাত্রা কম থাকে। শীতকালে গড় তাপমাত্রা 0°C-4°C এবং গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা 10°C-16°C হয়। হিমালয় পর্বতের অবস্থানের জন্যই দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গের শীতলতম জেলা।
- তীব্র শীত থেকে রক্ষা – মধ্য এশিয়ার সাইবেরিয়ার অতি শীতল বায়ু দার্জিলিং হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে, পশ্চিমবঙ্গ তীব্র শীতলতার হাত থেকে রক্ষা পায়।
- শীতল বাতাস – শীতকালে উত্তরের হিমালয় অঞ্চল থেকে মৃদু শীতল বাতাস দক্ষিণবঙ্গের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। ফলে শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।
- তুষারাবৃত্ত পর্বতশৃঙ্গ – অধিক উচ্চতার কারণে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে অবস্থিত হিমালয় পর্বতের কিছু অঞ্চলে তুষারপাত হয়, ফলে পর্বতশৃঙ্গগুলি তুষারাবৃত থাকে।
- কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ – পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে হিমালয় অঞ্চলে বায়ুর আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম হওয়ার কারণে এবং শীতল প্রকৃতির জলবায়ুর কারণে প্রায় সারা বছরই কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ থাকে।
সুতরাং, উপরিউক্ত কারণগুলি থেকে বোঝা যায় যে, হিমালয় পর্বত পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চল, মালভূমি অঞ্চল এবং উপকূল অঞ্চলের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য ছকের সাহায্যে বর্ণনা করো।
ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সব স্থানের জলবায়ু একই প্রকার নয়। ভূপ্রকৃতিগত তারতম্য, মালভূমি ও সমুদ্রের উপস্থিতির কারণে জলবায়ুর বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, যেমন –
বিষয় | পার্বত্য অঞ্চলের জলবায়ু | মালভূমি অঞ্চলের জলবায়ু | উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু |
অবস্থান | শিলিগুড়ি মহকুমা বাদে সমগ্র দার্জিলিং, কালিম্পং জেলা, ও জলপাইগুড়ি জেলার উত্তরাংশের কিছু এলাকা এই প্রকার জলবায়ুর অন্তর্গত। | সমগ্র পুরুলিয়া জেলাসহ পশ্চিম বর্ধমান, মেদিনীপুর, বীরভূম ও বাঁকুড়া জেলার পশ্চিমাংশ এই প্রকার জলবায়ুর অন্তর্গত। | পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল এই প্রকার জলবায়ুর অন্তর্গত। |
জলবায়ুর ধরন | পাবর্ত্য জলবায়ু শীতল প্রকৃতির। | মালভূমি অঞ্চলের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন প্রকৃতির। | উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু সমভাবাপন্ন প্রকৃতির। |
তাপমাত্রা | গ্রীষ্মকালে গড়ে 16° সে. এবং শীতকালে 2°-8° সে.। | গ্রীষ্মকালীন গড় উষ্ণতা 45° সে. এবং শীতকালীন 8°-15° সে.। | গ্রীষ্মকালে 25°-32° সে. এবং শীতকালে তাপমাত্রা 15°-18° সে.। |
বৃষ্টিপাত | এই অঞ্চলে বেশি বৃষ্টি হয়, প্রায় 400-500 সেমি। | কম বৃষ্টি হয়, প্রায় 100-125 সেমি। | মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হয়, 175-200 সেমি প্রায়। |
শীত ও গ্রীষ্মের স্থায়িত্ব | শীতকাল দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু ক্ষণস্থায়ী গ্রীষ্মকাল। | শীতকালে বেশি শীতল আবার গ্রীষ্মে বেশি গরম। | মৃদু শীতকাল ও গ্রীষ্মের প্রখরতা কম। |
বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি | দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি হয়। | পরিচলন বৃষ্টি হয়, তবে কালবৈশাখীর ফলে ঘূর্ণবাত বৃষ্টি হয়। | পরিচলন বৃষ্টি হয় এবং আশ্বিনে ঘূর্ণবাত জনিত বৃষ্টি হয়। |
বর্ষার স্থায়িত্ব | বর্ষাকাল বেশি দিন স্থায়ী হয়। | বর্ষাকাল কম দিন স্থায়ী হয়। | বর্ষাকালের স্থায়িত্ব মাঝারি। |
ঘূর্ণবাতের প্রভাব | বায়ুর শীতলতা থাকায় ঘূর্ণবাতের প্রভাব নেই। | কালবৈশাখীর সময় ঘূর্ণবাতজনিত ঝড় হয়। | উপকূলবর্তী বঙ্গোপসাগরে প্রায়শই ঘূর্ণবাতজনিত ঝড়বৃষ্টি হয়। |
বায়ুপ্রবাহ | সারাবছর শীতল বায়ু প্রবাহিত হয়। | গ্রীষ্মকালে ‘লু’ নামক উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হয়। | সমুদ্রবায়ু, স্থল বায়ু এবং মৌসুমি বায়ুর প্রভাব বেশি। |
আর্দ্রতা | সারাবছর আর্দ্রতা বেশি থাকে, প্রায় 70%-90%। | শীতকালে আর্দ্রতা কম (55%) এবং বর্ষাতে আর্দ্রতা বেশি (90%)। | বায়ুর আর্দ্রতা মাঝারি ধরনের হয়। |
কুয়াশার অবস্থা | প্রায় সারাবছরই কুয়াশা থাকে। | শরৎ ও শীতকালে কুয়াশা থাকে। | কেবল শীতকালে কুয়াশা দেখা যায়। |
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব আলোচনা করো।
অথবা, পশ্চিমবঙ্গে মৌসুমি বায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব নিম্নরূপ –
- ঋতুবৈচিত্র্য – পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ঋতুবৈচিত্র্য। প্রধানত চারটি ঋতু – গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বসন্ত হলেও পশ্চিমবঙ্গে ছয়টি ঋতু লক্ষ করা যায়। যেমন – বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য – গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ – বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন – শরৎকাল, কার্তিক-অগ্রহায়ণ – হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ – শীতকাল, ফাল্গুন-চৈত্র – বসন্তকাল।
- উষ্ণতা – পশ্চিমবঙ্গে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সামগ্রিকভাবে উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু বিরাজ করলেও স্থানভেদে উষ্ণতার পার্থক্য দেখা যায়। যেমন – গ্রীষ্মকালে কলকাতার গড় উষ্ণতা 35°C হলেও আসানসোলের গড় উষ্ণতা হয় 45°C। আবার শীতকালে উপকূলীয় অঞ্চলের গড় উষ্ণতা 12°C–18°C হলেও পার্বত্য অঞ্চলের উষ্ণতা হিমাঙ্কের নীচে নেমে যায়।
- বৃষ্টিপাত – পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত ঘটে। তবে বৃষ্টিপাত সর্বত্র সমান হয় না। গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত পার্বত্য অঞ্চলে 400 সেমি, তরাই -এ 350 সেমি, মালভূমিতে 125 সেমি ও সমভূমিতে 180 সেমি।
- আগমনের অনিশ্চয়তা – দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সময়ের আগে ঢুকলে বন্যা বা সময়ের পরে এলে খরা হয়।
- প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা – মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকালে ‘কালবৈশাখী’, শরৎকালে ‘আশ্বিনের ঝড়’ ও শীতকালে ‘পশ্চিমি ঝঞ্ঝা’র প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যায়।
- শীতল উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাব – উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিভিন্ন স্থানে শীতলতার প্রভেদ লক্ষ করা যায়। যেমন – পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলে উষ্ণতা কম হলেও দক্ষিণবঙ্গে উষ্ণতা খুব কম হয় না।
- আর্দ্র গ্রীস্মকাল ও শুষ্ক শীতকাল – পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্মকালে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টি হয় কিন্তু শীতকালে শুষ্ক উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হয় না। তাই আর্দ্র গ্রীষ্মকাল ও শুষ্ক শীতকাল পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- উষ্ণতার ওপর প্রভাব – গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের হাত থেকে মৌসুমি বায়ু রক্ষা করে। মৌসুমি বায়ুর আগমনে বৃষ্টি শুরু হয় এবং উষ্ণতা প্রায় কমে যায়। তবে শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শীতের প্রকোপ অনেক সময় বেড়ে যায়।
মানুষের জীবনে ঋতুপরিবর্তনের প্রভাব লেখো।
ঋতুপরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত এই চার ঋতুর পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যেমন –
- জীবিকার ওপর প্রভাব – মানুষের বিভিন্ন ধরনের জীবিকার ওপর ঋতুর পরিবর্তনের প্রভাব অপরিসীম।
- কৃষিকাজ – পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। ঋতুপরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে মানুষ বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করে থাকে। যেমন – ধান, পাট, তুলো, আখ, মিলেট প্রভৃতি খারিফ শস্য বর্ষায় বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভর করে চাষ করা হয়। গম, যব, আলু, সরষে প্রভৃতি রবিশস্য শীতকালে জলসেচের ওপর নির্ভর করে চাষ করে ও গ্রীষ্মের পূর্বে কাটে এবং আউশ ধান, তরমুজ, শশা, ফুটি প্রভৃতি গ্রীষ্মকালে চাষ করে ও বর্ষার আগে তোলে।
- পশুপালন – পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবং এখানকার মাটি অনুর্বর হওয়ায় মানুষ কৃষিকাজ ছাড়া পশুপালনও করে থাকে।
- মৎস্য সংগ্রহ – বর্ষাকালে খাল, বিল, নদী, নালা জলে ভরে ওঠায় মৎস্য চাষে ও সংগ্রহে সুবিধা হয়।
- পোশাক – মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ ঋতুপরিবর্তন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। গ্রীষ্মকালে মানুষ গরমের হাত থেকে বাঁচতে হালকা পোশাক ব্যবহার করে। বর্ষায় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ছাতা, রেনকোট ব্যবহার করে। আর শীতকালে গরম পোশাক পরিধান করে।
- শিল্পের বিকাশ – পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলে বর্ষাকালে ঘটা প্রচুর বৃষ্টিপাত চা উৎপাদনে সহায়তা করে, ফলে এখানে চা শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। তরাই অঞ্চলে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে যে ঘন অরণ্য সৃষ্টি হয়েছে তা কাষ্ঠ শিল্পের উন্নতি ঘটিয়েছে। সমভূমি অঞ্চলে বর্ষাকালে প্রচুর পাটের চাষ পাটশিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে।
- উৎসব অনুষ্ঠান – উৎসবপ্রিয় বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মকালে দোলযাত্রা, নববর্ষ; বর্ষাকালে জন্মাষ্টমী, রথযাত্রা, রাখিবন্ধন; শরৎকালে দুর্গাপূজা, কালীপূজা, ভাইফোঁটা; শীতকালে বড়োদিন, সরস্বতীপূজা প্রভৃতি উৎসব বাঙালির জীবনযাত্রাকে আনন্দমুখর করে রেখেছে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ – সবশেষে বলা যায়, ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আবির্ভাব ঘটে। যেমন – গ্রীষ্মকালে কালবৈশাখী, লু-প্রবাহ, বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যা, শরৎকালে আশ্বিনের ঝড় এবং শীতকালে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে।
পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকার বর্ণনা দাও।
অথবা, মৃত্তিকা কাকে বলে? পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকাকে ক-ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী? বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভূপৃষ্ঠের ওপর অবস্থিত যে আলগা আবরণ গাছপালা জন্মাতে এবং চাষ-আবাদ করতে সাহায্য করে, তাকে মৃত্তিকা বলে। মৃত্তিকা সাধারণত শিলাচূর্ণ এবং জৈব পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে। তাই মৃত্তিকার উৎপত্তি শিলার প্রকৃতি এবং জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে শিলার প্রকৃতি এবং জলবায়ু ভিন্ন ভিন্ন বলে এখানে বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকা দেখা যায়। প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, উপাদান ও উৎপত্তির পার্থক্যের জন্যে পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা – পলি মৃত্তিকা, ও ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা, পঙ্গুল মৃত্তিকা, ধূসর বাদামি রঙের মৃত্তিকা এবং উপকূলের লবণাক্ত মৃত্তিকা।

পলি মৃত্তিকা –
- অবস্থান – পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলের নদী তীরবর্তী প্লাবনভূমিতে পলিমাটি দেখা যায়।
- উৎপত্তির কারণ – নদীবাহিত পলি, বালি, কাদা ইত্যাদি সঞ্চিত হয়ে পলি মৃত্তিকার উদ্ভব হয়।
বিশেষত্ব –
- প্রকৃতি – এই মাটি খুবই উর্বর প্রকৃতির হয় ও অধিক গভীরতাযুক্ত হয়।
- বর্ণ – উত্তরের সমভূমির প্রাচীন পলিমাটি হালকা লাল রং -এর এবং দক্ষিণের সমভূমির নবীন পলিমাটি কালচে বাদামি রঙের হয়ে থাকে।
- উপাদান – বালি ও কাদার উপাদান অনুসারে পলি মাটিকে তিনটি উপবিভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। বেলে মাটি, দোআঁশ মাটি ও এঁটেল মাটি। যে মাটিতে বালির ভাগ বেশি, তাকে বেলে মাটি, যে মাটিতে বালি ও কাদার ভাগ সমান সমান, তাকে দোআঁশ মাটি এবং যে মাটিতে কাদার ভাগ বেশি, তাকে এঁটেল মাটি বলে।
- উদ্ভিদ – আম, জাম, বট, অশ্বত্থ, কাঁঠাল, ডুমুর, সুপারি, তাল, কলা প্রভৃতি গাছ জন্মায়।
- উৎপাদিত ফসল – বেলে মাটিতে তরমুজ, ফুটি, শশা ইত্যাদি; দোআঁশ মাটিতে গম, ইক্ষু, তামাক ও নানারকমের সবজি এবং এঁটেল মাটিতে ধান ও পাট ভালো জন্মায়।
ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা –
- অবস্থান – মূলত পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান ও ঝাড়গ্রাম জেলায় এই মাটি দেখা যায়।
- উৎপত্তির কারণ – অপেক্ষাকৃত বড়ো বড়ো নুড়ি, কাঁকর ইত্যাদি জমে এই মাটি তৈরি হয়েছে।
বিশেষত্ব –
- প্রকৃতি – এই মাটির সচ্ছিদ্রতা বেশি ও জলধারণ ক্ষমতা কম। এটি কাঁকরপূর্ণ মাটি।
- বর্ণ – ‘ল্যাটার’ শব্দ থেকে ‘ল্যাটেরাইট’ কথাটি এসেছে। এর অর্থ ‘ইট’। এই মাটি ইটের মতো লাল বর্ণের।
- উপাদান – এই মাটিতে লোহার পরিমাণ বেশি থাকে।
- উদ্ভিদ – কুল, পলাশ, মহুয়া ইত্যাদি পর্ণমোচী উদ্ভিদ।
- উৎপাদিত ফসল – এই মাটিতে জলসেচের মাধ্যমে ধান, ভুট্টা, আখ ও বিভিন্ন শাকসবজি উৎপন্ন হয়।
পডসল মৃত্তিকা –
- অবস্থান – মূলত দার্জিলিং, কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলার পার্বত্য অঞ্চলে দেখা যায়।
- উৎপত্তির কারণ – পার্বত্য অরণ্যের গাছ থেকে পড়া পাতা, ডাল ইত্যাদি পচে মাটির সঙ্গে মিশে এই মৃত্তিকা সৃষ্টি করে।
বিশেষত্ব –
- প্রকৃতি – এই মাটি নুড়ি, পাথরে পূর্ণ ও আম্লিক প্রকৃতির।
- বর্ণ – ‘পড়সল’ কথাটির অর্থ ‘ছাই রঙের মৃত্তিকা’। এর বর্ণ কালো, বাদামি বা ধূসর হয়।
- উপাদান – এই মাটি জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ।
- উদ্ভিদ – পাইন, ফার ইত্যাদি পার্বত্য উদ্ভিদ জন্মায়।
- উৎপাদিত ফসল – চা, সিঙ্কোনা, কমলালেবু, আপেল।
ধূসর বাদামি রাঙর মৃত্তিকা –
- অবস্থান – হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশীয় দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার সমতল অংশে দেখা যায়।
- উৎপত্তির কারণ – তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা প্রভৃতি নদী দ্বারা বাহিত নুড়ি, কাঁকর, পলি, বালি জমে তৈরি হয়েছে।
বিশেষত্ব –
- প্রকৃতি – সচ্ছিদ্র, আম্লিক এবং আর্দ্র প্রকৃতির।
- বর্ণ – এটি গাঢ় ধূসর বা কৃষ্ণবর্ণের হয়।
- উপাদান – হিউমাস, কাঁকর, পলি, বালি।
- অরণ্যসম্পদ – শাল, সেগুন, গামার, শিরীষ, জারুল, শিশু, বাঁশ, বেত প্রভৃতি গাছ জন্মায়।
- উৎপাদিত ফসল – ধান, চা, গম, যব, জোয়ার, বাজরা, আলু, কমলালেবু।
উপকূলের লবনাক্ত মৃত্তিকা –
- অবস্থান – পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে দেখা যায়।
- উৎপত্তির কারণ – নদীবাহিত পলির সঙ্গে সমুদ্রতরঙ্গবাহিত পলি যুক্ত হয়ে এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষত্ব –
- প্রকৃতি – লবণাক্ত ও ক্ষারধর্মী।
- বর্ণ – এটি কালো রঙের হয়ে থাকে।
- উপাদান – বালি, পলি ও অতিরিক্ত লবণ।
- উদ্ভিদ – সুন্দরী, গরান, গেওয়া, হোগলা, নারকেল ইত্যাদি।
- উৎপাদিত ফসল – তরমুজ, লঙ্কা, সূর্যমুখী, সুপুরি ও সামান্য কার্পাস।
পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক উদ্ভিদের বর্ণনা দাও।
মানুষের কোনোরকম হস্তক্ষেপ ছাড়া প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সৃষ্ট গাছপালাকে স্বাভাবিক উদ্ভিদ বলে। পশ্চিমবঙ্গের ভূ প্রকৃতি, জলবায়ু, মৃত্তিকার অবস্থানগত বৈচিত্র্যের কারণে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির স্বাভাবিক উদ্ভিদের উদ্ভব ঘটেছে। সেগুলি হল –
- পার্বত্য অঞ্চলের উদ্ভিদ।
- তরাই অঞ্চলের উদ্ভিদ।
- মালভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ।
- সমভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ।
- উপকূল অঞ্চলের উদ্ভিদ।
পার্বত্য অঞ্চলের উদ্ভিদ –
অবস্থান – উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের দার্জিলিং, কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলায় এই জাতীয় উদ্ভিদ দেখা যায়।
উদ্ভিদসমূহ –
- 3000 মিটার -এর বেশি উচ্চতার উদ্ভিদ – আল্পীয় উদ্ভিদ দেখা যায়। যেমন – জুনিপার, রোডোডেনড্রন, লাইকেন প্রভৃতি।
- 2000-3000 মিটার -এর মধ্যবর্তী উচ্চতার উদ্ভিদ – সরলবর্গীয় উদ্ভিদ দেখা যায়। যেমন – পাইন, ওক, প্রুস, ফার, সিডার, দেবদারু প্রভৃতি।
- 1000-2000 মিটার -এর মধ্যবর্তী উচ্চতার উদ্ভিদ – মূলত চিরহরিৎ উদ্ভিদ জন্মায়। যেমন – পিপুল, বাঁশ, শিমুল, কুসুম, বার্চ প্রভৃতি।
- পর্বতের পাদদেশ থেকে 1000 মিটার -এর মধ্যবর্তী উদ্ভিদ – এখানে চিরহরিৎ ও পর্ণমোচী উদ্ভিদের মিশ্র বনভূমি দেখা যায়। যেমন – শাল, সেগুন, শিশু, সর্পগন্ধা, গামার প্রভৃতি।

বৈশিষ্ট্যসমূহ –
- পার্বত্য অঞ্চলে যাতে গাছের মাথায় বরফ সঞ্চিত না হয়, তাই গাছগুলি শঙ্কু বা মোচাকৃতির হয়।
- গাছগুলির কাঠ নরম ও হালকা প্রকৃতির হয়।
- গাছের পাতা সরু ও সূচালো হয়।
- গাছগুলি দীর্ঘ, সরু ও ওপরের দিকে ডালপালাযুক্ত হয়।
তরাই অঞ্চলের উদ্ভিদ –
- অবস্থান – পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশে দার্জিলিং জেলার দক্ষিণভাগ, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার ডুয়ার্স অঞ্চলে দেখা যায়।
- উদ্ভিদসমূহ – শাল, সেগুন, শিশু, গর্জন, গামার, চাপলাশ, বাঁশ প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্যসমূহ –
- তরাই ডুয়ার্স অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হয় বলে এই গাছগুলি চিরহরিৎ প্রকৃতির, বেশি ডালপালা যুক্ত, ঝোপময়।
- গাছগুলির কাঠ শক্ত ও ভারী হয়।
- বনভূমির তলদেশে লতা, পরগাছা, পরজীবী উদ্ভিদ থাকে।
মালভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ –
- অবস্থান – পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি জেলায় দেখা যায়।
- উদ্ভিদসমূহ – শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, কেন্দু, অর্জুন প্রভৃতি গাছগুলি আছে।
বৈশিষ্ট্যসমূহ –
- বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার জন্য শুষ্ক পর্ণমোচী উদ্ভিদ জন্মায়।
- এই জাতীয় উদ্ভিদ ল্যাটেরাইট মৃত্তিকায় দেখা যায়।
- শীতকালে গাছগুলির পাতা ঝরে যায়।
সমভূমি অঞ্চলের উদ্ভিদ-
- অবস্থান – উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, মুরশিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগনা, হাওড়া প্রভৃতি জেলায় এই জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায়।
- উদ্ভিদসমূহ – আম, জাম, কাঁঠাল, বট, নিম, অশ্বত্থ প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্যসমূহ –
- অধিক উষ্ণতা ও আর্দ্রতার জন্য এখানে আর্দ্র পর্ণমোচী ও কিছু কিছু চিরহরিৎ বৃক্ষ জন্মায়।
- গাছগুলি মাঝারি দৈর্ঘ্যের, পুরু ও অমসৃণ ছালযুক্ত, বড়ো বড়ো পাতা যুক্ত হয়।
উপকূল অঞ্চলের উদ্ভিদ –
- অবস্থান – বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী সুন্দরবন ও মেদিনীপুরের সামান্য অংশে দেখা যায়।
- উদ্ভিদসমূহ – সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, হেঁতাল, নারকেল প্রভৃতি উদ্ভিদ জন্মায়।
বৈশিষ্ট্যসমূহ –
- জোয়ার অধ্যুষিত লবণাক্ত মৃত্তিকায় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ জন্মায়।
- সমুদ্রের জলের হাত থেকে বাঁচার জন্য উদ্ভিদগুলিতে শ্বাসমূল, ঠেসমূল, জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম দেখা যায়।

Class 9 Geography All Chapter Notes
আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ভূগোলের অষ্টম অধ্যায় ‘পশ্চিমবঙ্গ (প্রাকৃতিক পরিবেশ)’ এর রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর ভূগোল পরীক্ষার জন্য বা চাকরির পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায় দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন