আমরা আমাদের আর্টিকেলে দশম শ্রেণীর ভৌতবিজ্ঞানের অষ্টম অধ্যায়ের ‘পদার্থের ভৌত রাসায়নিক ধর্মসমূহ‘ থেকে ‘আয়নীয় ও সমযোজী বন্ধন’ এর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণীর ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষার জন্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

বিভিন্ন মৌলের পরমাণুগুলির রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের কারণ কী?
নোবেল গ্যাস পরমাণুগুলির ইলেকট্রন-বিন্যাস, বিশেষত পরমাণুগুলির সর্ববহিস্থ কক্ষের ইলেকট্রন-বিন্যাস অত্যন্ত সুস্থিত। তাই নোবেল-গ্যাস পরমাণুর মতো সুস্থায়ী ইলেকট্রন-বিন্যাস লাভ করার জন্যই বিভিন্ন মৌলের পরমাণুগুলি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
রাসায়নিক বন্ধন কাকে বলে?
যোজ্যতা-কক্ষে ইলেকট্রন গ্রহণ অথবা যোজ্যতা-কক্ষ থেকে ইলেকট্রন বর্জন অথবা ইলেকট্রন-জোড় গঠনের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী পরমাণুগুলির সর্ববহিস্থ কক্ষে নিকটতম নিষ্ক্রিয় মৌলের ইলেকট্রন-বিন্যাস অর্জনের ফলে যে আকর্ষণ বলের সৃষ্টি হয় তাকে রাসায়নিক বন্ধন বলে।
অষ্টক সূত্র কাকে বলে?
রাসায়নিকভাবে সুস্থিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন মৌলের পরমাণু তাদের যোজ্যতা-কক্ষে ইলেকট্রন গ্রহণ বা যোজ্যতা-কক্ষ থেকে ইলেকট্রন বর্জন বা ইলেকট্রন-জোড় গঠনের মাধ্যমে নিকটবর্তী নিষ্ক্রিয় মৌলের পরমাণুর ইলেকট্রন-বিন্যাস লাভের প্রবণতা দেখায়। মৌলসমূহের পরমাণুগুলির সর্ববহিস্থ ইলেকট্রনীয় কক্ষের অষ্টক পূর্ণ করার স্বাভাবিক প্রবণতাকে অষ্টক সূত্র বলে।
অষ্টক সূত্রের সীমাবদ্ধতাগুলি উল্লেখ করো।
অষ্টক সূত্রের সীমাবদ্ধতাগুলি নিম্নরূপ –
- কিছু অণুর কেন্দ্রীয় পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষে 8টির কম বা বেশি ইলেকট্রন থাকা সত্ত্বেও অণুগুলি যথেষ্ট স্থিতিশীল। এই ঘটনা অষ্টক সূত্রানুসারে ব্যাখ্যা করা যায় না।
- নোবেল গ্যাসগুলির নিষ্ক্রিয়তার ভিত্তিতে অষ্টক সূত্র প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কিছু নোবেল গ্যাস অক্সিজেন বা ফ্লুরিনের সাথে যুক্ত হয়ে যৌগ গঠন করে।
- এই সূত্র বিভিন্ন অণুর তুলনামূলক স্থিতিশীলতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
অষ্টক নিয়মের ব্যতিক্রম গুলি লেখ।
BeCl2, BF3 ইত্যাদি যৌগে কেন্দ্রীয় পরমাণুর অষ্টক সম্পূর্ণ হয়নি। আবার, PCl5, SF6, IF7 ইত্যাদি যৌগের কেন্দ্রীয় পরমাণুর সর্বশেষ কক্ষে 8টির বেশি ইলেকট্রন থাকে।
তড়িৎযোজ্যতা কাকে বলে?
নিকটতম নিষ্ক্রিয় গ্যাসের পরমাণুর মতো ইলেকট্রন-বিন্যাস লাভের চেষ্টায় কিছু পরমাণু এক বা একাধিক ইলেকট্রন ত্যাগ করে সুস্থিত ইলেকট্রন-বিন্যাসবিশিষ্ট ক্যাটায়নে পরিণত হয় এবং কিছু পরমাণু এক বা একাধিক ইলেকট্রন গ্রহণ করে সুস্থিত ইলেকট্রন-বিন্যাসবিশিষ্ট অ্যানায়নে পরিণত হয়। ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নের মধ্যে স্থির তড়িৎ-আকর্ষণ বলের মাধ্যমে যৌগ গঠনের ক্ষমতাকে তড়িৎযোজ্যতা বা আয়নীয় যোজ্যতা বলে।
তড়িৎযোজী বন্ধন কাকে বলে?
তড়িৎযোজ্যতার ফলে পরমাণু দুটির মধ্যে যে বন্ধনের সৃষ্টি হয়, তাকে তড়িৎযোজী বা আয়নীয় বন্ধন বলা হয়। তড়িৎযোজ্যতার ফলে সৃষ্ট যৌগ বা তড়িৎযোজী বন্ধন সমন্বিত যৌগকে তড়িৎযোজী যৌগ বলা হয়।
দ্বৈত সূত্র কী?
যেসব মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা হিলিয়ামের কাছাকাছি, সেইসব মৌল রাসায়নিক সুস্থিতির জন্য, তাদের পরমাণুর ইলেকট্রনীয় কক্ষে ইলেকট্রন গ্রহণ বা কক্ষ থেকে ইলেকট্রন বর্জন বা ইলেকট্রন-জোড় গঠনের মাধ্যমে হিলিয়াম পরমাণুর মতো সুস্থিত ইলেকট্রন-বিন্যাস লাভের প্রবণতা দেখায়। মৌলের পরমাণুগুলির সর্ববহিস্থ ইলেকট্রনীয় কক্ষ দুটি ইলেকট্রন দ্বারা পূর্ণ করার এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে দ্বৈত সূত্র বলে।
তড়িৎযোজ্যতার পরিমাপ কীভাবে করা হয় উদাহরণ সহযোগে বুঝিয়ে দাও।
যৌগ গঠনের সময় একটি পরমাণু যত সংখ্যক ইলেকট্রন বর্জন করে বা গ্রহণ করে, সেই সংখ্যা দ্বারা ওই পরমাণুর তড়িৎ-যোজ্যতা পরিমাপ করা হয়। যেমন – NaCl যৌগ গঠন করার সময় Na -পরমাণুগুলি একটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে Na+ আয়নে এবং Cl -পরমাণুগুলি একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে Cl– আয়নে পরিণত হয়। অতএব, NaCl যৌগে সোডিয়ামের তড়িৎযোজ্যতা 1 এবং ক্লোরিনের তড়িৎযোজ্যতা 1।
তড়িৎযোজী বন্ধনকে প্রকৃত বন্ধন বলা যায় না – উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
সমযোজ্যতার ক্ষেত্রে একই ইলেকট্রন-জোড় দুটি পরমাণু দ্বারা সমভাবে ব্যবহৃত হয়, ফলে পরমাণু দুটির মধ্যে একটি বন্ধন সৃষ্টি হয়, যার একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ থাকে। কিন্তু তড়িৎযোজ্যতার ক্ষেত্রে ইলেকট্রন আদান-প্রদানের ফলে উৎপন্ন ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নগুলি স্থির তড়িৎ-আকর্ষণ বলের মাধ্যমে পরস্পর আবদ্ধ থাকে। আয়নগুলির মধ্যে কোনো ইলেকট্রন-জোড় থাকে না এবং আকর্ষণ বলের কোনো নির্দিষ্ট অভিমুখ থাকে না। তাই তড়িৎযোজী বন্ধনকে প্রকৃত বন্ধন বলা যায় না।
আয়নীয় যৌগগুলির গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক বেশি হয় কেন?
আয়নীয় যৌগে বিপরীত তড়িৎধর্মী আয়নসমূহের মধ্যে তীব্র আকর্ষণ বল ক্রিয়া করে বলে আয়নীয় যৌগের কেলাস ঘনসংঘবদ্ধ হয়। ফলে আয়নীয় যৌগের কেলাস থেকে আয়নগুলিকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রচুর পরিমাণ তাপশক্তির প্রয়োজন হয়। তাই আয়নীয় যৌগের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক বেশি হয়।
আয়নীয় যৌগের ভৌত অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করো।
সাধারণ উষ্ণতা ও চাপে আয়নীয় বা তড়িৎযোজী যৌগগুলি কঠিন ও কেলাসাকার হয়। আয়নীয় যৌগে পৃথক স্বতন্ত্র অণুর অস্তিত্ব নেই। তড়িৎযোজী যৌগে বিপরীত তড়িদ্গ্রস্ত অসংখ্য আয়ন ত্রিমাত্রিকভাবে নির্দিষ্ট রীতিতে সজ্জিত হয়ে বিশেষ জ্যামিতিক আকারবিশিষ্ট কেলাস গঠন করে।
আয়নীয় যৌগ কঠিন অবস্থায় তড়িৎ পরিবহণ করে না কিন্তু গলিত বা জলে দ্রবীভূত অবস্থায় তড়িৎ পরিবহণ করে কেন?
কঠিন অবস্থায় আয়নীয় যৌগগুলি তড়িৎ পরিবহণ করে না, কারণ কঠিন অবস্থায় ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নসমূহ তীব্র তড়িৎ আকর্ষণ বল দ্বারা দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু গলিত অবস্থায় বা জলে দ্রবীভূত অবস্থায় আয়নগুলি কেলাস-জালক থেকে মুক্ত হয়ে গতিশীল হয় এবং এর ফলে আয়নীয় যৌগ তড়িৎ পরিবহণ করতে পারে।
আয়নীয় যৌগের কাঠিন্য বেশি হয় কেন?
আয়নীয় যৌগে বিপরীত তড়িৎধর্মী আয়নগুলি কেলাসের মধ্যে তীব্র তড়িৎ-আকর্ষণ বল দ্বারা পরস্পরের সাথে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে এবং সমগ্র কেলাসটি একটি অতিকায় অণু হিসেবে অবস্থান করে। তাই আয়নীয় যৌগের কাঠিন্য বেশি হয়।
উদাহরণসহ আয়নীয় যৌগের দ্রাব্যতার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
আয়নীয় যৌগগুলি সাধারণত ধ্রুবীয় দ্রাবকে (যেমন – জল) দ্রবীভূত হয়, কিন্তু ধ্রুবীয় দ্রাবকে (যেমন – CS2, CCl4, বেঞ্জিন) দ্রবীভূত হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আয়নীয় যৌগ NaCl জলে সহজে দ্রবীভূত হলেও বেঞ্জিনে অদ্রাব্য।
আয়নীয় যৌগের বিক্রিয়ার হার দ্রুত হয় কেন?
দ্রবণে তড়িৎযোজী যৌগগুলি আয়নরূপে অবস্থান করে। দ্রবণে আয়নীয় যৌগের রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রকৃতপক্ষে ওই যৌগের উপাদান আয়নসমূহের বিক্রিয়া। অন্যভাবে বলা যায়, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই আয়নগুলিই অংশগ্রহণ করে। দ্রবণে উপস্থিত এই বিপরীতধর্মী আয়নগুলি অধিক দ্রুততার সঙ্গে আয়নীয় যৌগের বিক্রিয়া সম্পন্ন করে।
NaCl -এর জলীয় দ্রবণে AgNO3 দ্রবণ যোগ করলে অত্যন্ত দ্রুত বিক্রিয়া ঘটে কেন?
AgNO3 ও NaCl উভয়েই তড়িৎযোজী যৌগ। জলীয় দ্রবণে যৌগ দুটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে আয়নিত হয়ে বিপরীত তড়িৎধর্মী আয়ন উৎপন্ন করে এবং দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
\(AgNO_3(aq)\rightarrow Ag^+(aq)\;+\;NO_3^-(aq)\\\)\( NaCl\left(aq\right) \) → \( Na^+\left(aq\right)+Cl^-\left(aq\right) \)
তাই \( NaCl \) -এর জলীয় দ্রবণে \( AgNO_3 \) দ্রবণ যোগ করলে অত্যন্ত দ্রুতহারে বিক্রিয়া ঘটে এবং \( AgCl \) (জল ও অ্যাসিডে অদ্রাব্য) অধঃক্ষিপ্ত হয়।
\( NaCl\left(aq\right)+AgNO_3\left(aq\right) \) → \( AgCl\downarrow+NaNO_3\left(aq\right) \)
আয়নীয় যৌগ ধ্রুবীয় দ্রাবকে দ্রাব্য হয় কেন?
যখন কোনো আয়নীয় যৌগকে ধ্রুবীয় দ্রাবকে যোগ করা হয়, তখন দ্রাবক অণুর ঋণাত্মক প্রান্ত আয়নীয় যৌগের কেলাস-জালকে অবস্থিত ক্যাটায়নগুলিকে ও ধনাত্মক প্রান্ত অ্যানায়নগুলিকে আকর্ষণ করে। ফলে কেলাস-মধ্যস্থ আয়নগুলি কেলাস-জালক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দ্রাবকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রাবকের মধ্যে আয়নগুলি নির্দিষ্ট সংখ্যক দ্রাবক অণু দ্বারা পরিবেষ্টিত বা দ্রাবকায়িত হয়ে স্থায়িত্ব লাভ করে। তাই আয়নীয় যৌগগুলি ধ্রুবীয় বা পোলার দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়।
আয়নীয় যৌগ অধ্রুবীয় দ্রাবকে দ্রবীভূত হয় না কেন?
অধ্রুবীয় দ্রাবক আয়নীয় যৌগের আয়নগুলিকে দৃঢ়ভাবে আকর্ষণ করতে পারে না। এর ফলে অধ্রুবীয় দ্রাবকে সংশ্লিষ্ট আয়নীয় যৌগ গঠনকারী আয়নগুলি কেলাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না, ফলে যৌগটি অধ্রুবীয় দ্রাবকে দ্রবীভূত হয় না।
সংকেত ভর (formula mass) কাকে বলে? সংকেত ভর কোন্ প্রকার যৌগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
আয়নীয় যৌগকে যে সংকেতের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়, সেই সংকেতে উপস্থিত পরমাণুগুলির পারমাণবিক ভরের সমষ্টি হল ওই যৌগের সংকেত ভর।
আয়নীয় যৌগের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন অণুর অস্তিত্ব নেই বলে আণবিক ভরের পরিবর্তে সংকেত ভর ব্যবহার করা হয়। সমযোজী যৌগের ক্ষেত্রে আণবিক ভর ও সংকেত ভর অভিন্ন।
একটি যৌগের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক উচ্চ। কঠিন অবস্থায় যৌগটি তড়িতের অপরিবাহী হলেও গলিত অবস্থায় যৌগটি তড়িৎ পরিবহণে সক্ষম। যৌগটিতে কী ধরনের রাসায়নিক বন্ধন আছে? যৌগ গঠনকারী কণাগুলির প্রকৃতি কী?
যৌগটিতে তড়িৎযোজী বা আয়নীয় বন্ধন আছে।
যৌগ গঠনকারী কণাগুলি হল ধনাত্মক আধানযুক্ত ক্যাটায়ন ও ঋণাত্মক আধানযুক্ত অ্যানায়ন।
সমযোজী বন্ধন এবং সমযোজী যৌগ কাকে বলে?
দুটি পরমাণুর মধ্যে এক বা একাধিক ইলেকট্রন-জোড় (বন্ধন সৃষ্টিকারী প্রতিটি পরমাণু থেকে আগত সমসংখ্যক ইলেকট্রন দিয়ে গঠিত) সমভাবে ব্যবহৃত হয়ে যে রাসায়নিক বন্ধন গঠিত হয়, তাকে সমযোজী বন্ধন বলে। সমযোজী বন্ধন সমন্বিত যৌগকে সমযোজী যৌগ বলা হয়।
ভ্যান ডার ওয়ালস্ আকর্ষণ বল কী?
সমযোজী যৌগের অণুগুলির মধ্যে যে দুর্বল প্রকৃতির আকর্ষণ বল কাজ করে তাকে ভ্যান ডার ওয়ালস্ আকর্ষণ বল বলে। সমযোজী যৌগের আণবিক গুরত্ব বৃদ্ধির সাথে এই আকর্ষণ বলের মানও বৃদ্ধি পায়।
সমযোজ্যতা (covalency) কাকে বলে?
নিকটতম নিষ্ক্রিয় মৌলের মতো সুস্থিত ইলেকট্রন-বিন্যাস লাভের চেষ্টায় একই বা ভিন্ন মৌলের দুটি পরমাণু ভূমিস্তরে বা উদ্দীপ্ত শক্তিস্তরে তাদের সর্ববহিস্থ কক্ষের অযুগ্ম ইলেকট্রনগুলির মিলনে গঠিত এক বা একাধিক ইলেকট্রন-জোড় সমভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে রাসায়নিকভাবে মিলিত হওয়ার যে ক্ষমতা লাভ করে তাকে সমযোজ্যতা বলে।
সমযোজী অণু কয় প্রকার ও কী কী?
সমযোজী অণু দুপ্রকারের হয়, যথা –
- সমযোজী মৌলের অণু – একই মৌলের পরমাণুগুলি সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সমযোজী মৌলের অণু গঠন করে। যেমন – H2, O2, N2, F2 প্রভৃতি সমযোজী মৌলের অণু।
- সমযোজী যৌগের অণু – ভিন্ন মৌলের পরমাণুগুলি সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সমযোজী যৌগের অণু গঠন করে। যেমন – NH3, HCl, CO2, CH4 প্রভৃতি সমযোজী যৌগের অণু।
সমযোজী অণুতে কোনো মৌলের সমযোজ্যতার পরিমাপ করা হয় কীভাবে?
সমযোজী মৌল বা যৌগের অণু গঠনের সময় কোনো মৌলের একটি পরমাণু যতগুলি ইলেকট্রন-জোড় গঠন করে, সেই সংখ্যাই সংশ্লিষ্ট মৌলটির সমযোজ্যতা নির্দেশ করে। যেমন – মিথেন (CH4) অণুতে C -পরমাণু 4টি H -পরমাণুর সাথে 4টি ইলেকট্রন-জোড় গঠন করে বলে মিথেনে কার্বনের যোজ্যতা 4।
অসমযোজ্যতা ও অসমযোজী বন্ধন কাকে বলে?
তড়িৎযোজ্যতা ও সমযোজ্যতা ছাড়াও অসমযোজ্যতার অস্তিত্ব রয়েছে। রাসায়নিক সংযোগে অংশগ্রহণকারী দুটি পরমাণুর মধ্যে একটি পরমাণু একজোড়া ইলেকট্রন যোগান দিলে এবং উভয় পরমাণুই সেই ইলেকট্রন-জোড় ব্যবহার করে নিজ নিজ বহিস্তম কক্ষে অষ্টক পূর্ণ করলে পরমাণু দুটি পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার যে ক্ষমতা লাভ করে, তাকে অসমযোজ্যতা বলে। অসমযোজ্যতার মাধ্যমে যে বন্ধন সৃষ্টি হয়, তাকে অসমযোজী বন্ধন বলে। অসমযোজী বন্ধনকে তির চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করা হয়। তির চিহ্নের অগ্রভাগ গ্রহীতার দিকে ও পশ্চাদভাগ দাতার দিকে থাকে। অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড যৌগে অসমযোজী বন্ধন লক্ষ করা যায়।
চিনি বা গ্লুকোজ সমযোজী পদার্থ হলেও জলে দ্রবীভূত হয় কেন?
জল একটি ধ্রুবীয় দ্রাবক যার অক্সিজেন পরমাণু ঋণাত্মক আধানগ্রস্ত ও হাইড্রোজেন পরমাণু দুটি ধনাত্মক আধানগ্রস্ত। চিনি বা গ্লুকোজের অণুতে -O-H মূলক থাকে যার O -পরমাণু উচ্চ তড়িৎ-ঋণাত্মক হওয়ায় O-H বন্ধনটি পোলার প্রকৃতির ও H -প্রান্ত কিছুটা ধনাত্মক আধানযুক্ত। এর ফলে জলের ঋণাত্মক O -পরমাণু ও চিনি বা গ্লুকোজের ধনাত্মক H -পরমাণুর (O-H গ্রুপের) মধ্যে তড়িৎ-আকর্ষণ বল ক্রিয়া করে। এর ফলেই চিনি বা গ্লুকোজের অণুগুলি জলে দ্রবীভূত হয়।
সমযোজী গ্লুকোজ কঠিন হলেও সমযোজী মিথেন গ্যাসীয় হয় কেন?
সমযোজী পদার্থের অণুগুলির মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বল খুব দুর্বল প্রকৃতির হয় এবং এই আকর্ষণ বলের মান আণবিক গুরুত্ব বৃদ্ধির সাথে বৃদ্ধি পায়। গ্লুকোজের আণবিক গুরুত্ব মিথেনের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় গ্লুকোজের অণুগুলির পারস্পরিক আকর্ষণ বল মিথেন অণুর পারস্পরিক আকর্ষণ বলের তুলনায় বেশি হয়। তাই গ্লুকোজ সাধারণ উষ্ণতায় কঠিন হলেও মিথেন গ্যাসীয়।
ন্যাপথালিন জলে দ্রবীভূত হয় না কিন্তু ইথানলে দ্রবীভূত হয় কেন?
সমযোজী যৌগগুলি সাধারণত অধ্রুবীয় দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়, কিন্তু ধ্রুবীয় দ্রাবকে দ্রবীভূত হয় না। জল একটি ধ্রুবীয় দ্রাবক কিন্তু ইথানল অধ্রুবীয় দ্রাবক। তাই সমযোজী পদার্থ ন্যাপথালিন জলে দ্রবীভূত না হলেও ইথানলে দ্রবীভূত হয়।
সোডিয়াম ক্লোরাইডের জলীয় দ্রবণ তড়িৎ পরিবাহী হলেও চিনি বা গ্লুকোজের জলীয় দ্রবণ তড়িৎ পরিবাহী হয় না কেন?
সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) আয়নীয় যৌগ এবং জলীয় দ্রবণে NaCl -এর কেলাসের বিয়োজনের ফলে Na+ ও Cl– আয়নগুলি মুক্ত হয়। এই আয়নগুলি তড়িৎ পরিবহণ করতে পারে বলে সোডিয়াম ক্লোরাইডের জলীয় দ্রবণ তড়িৎ পরিবাহী। সমযোজী যৌগ চিনি বা গ্লুকোজের অণুগুলি জলীয় দ্রবণে আয়নে বিয়োজিত হয় না। তাই চিনি বা গ্লুকোজের জলীয় দ্রবণ তড়িৎ পরিবহণ করতে পারে না।
HCl সমযোজী যৌগ হলেও এর জলীয় দ্রবণ তড়িৎ পরিবাহী হয় কেন?
HCl সমযোজী যৌগ হলেও Cl -পরমাণু, H -পরমাণুর তুলনায় অধিক তড়িৎ-ঋণাত্মক। ফলে H-Cl বন্ধনের ইলেকট্রন-জোড়টি Cl -পরমাণুর দিকে কিছুটা সরে যায়। ফলে HCl অণুর H -প্রান্তটি কিছুটা ধনাত্মক আধানযুক্ত ও Cl -প্রান্তটি কিছুটা ঋণাত্মক আধানযুক্ত হয়। জল একটি পোলার দ্রাবক যার O -প্রান্ত কিছুটা ঋণাত্মক ও H -প্রান্ত কিছুটা ধনাত্মক তড়িৎধর্মী। জলের অণুর আধানযুক্ত প্রান্তগুলি দ্বারা আকর্ষিত হওয়ার ফলে HCl অণু আয়নিত হয়ে দ্রবণে H3O+ ও Cl– মুক্ত করে। দ্রবণে আয়নের উপস্থিতির জন্য HCl -এর জলীয় দ্রবণ তড়িৎ পরিবহণে সক্ষম – HCl + H2O → H3O+ + Cl–
সমযোজী পদার্থের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্কের মান সাধারণত কম হয় কেন?
সমযোজী যৌগের অণুগুলির মধ্যে আন্তরাণবিক আকর্ষণ বল অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় একটি অণুকে অপর অণু থেকে পৃথক করতে অধিক শক্তির প্রয়োজন হয় না। তাই কতগুলি বিরাট আকারবিশিষ্ট সমযোজী কঠিন পদার্থ (SiO2, হীরক, SiC ইত্যাদি) ছাড়া অন্যান্য সমযোজী পদার্থের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক আয়নীয় যৌগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম হয়।
সমযোজী যৌগের রাসায়নিক বিক্রিয়া ধীরগতিতে সম্পন্ন হয় কেন?
সমযোজী যৌগের অণুমধ্যস্থ শক্তিশালী সমযোজী বন্ধন ভাঙার জন্য যথেষ্ট শক্তি, সময় ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুঘটকের প্রয়োজন হয়। আবার নতুন সমযোজী বন্ধন সৃষ্টি হতেও যথেষ্ট সময় লাগে। তাই সমযোজী যৌগগুলির রাসায়নিক বিক্রিয়া ধীরগতিতে সম্পন্ন হয়। যেমন – সন্ধান প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজের ইথানলে পরিণত হতে 3 দিন সময় লাগে।
Cl2 অণু গঠিত হয় কিন্তু Ne2 অণু গঠিত হয় না কেন?
Cl -পরমাণুর যোজ্যতা-কক্ষে 7টি ইলেকট্রন থাকে। দুটি Cl -পরমাণু তাদের যোজ্যতা-কক্ষের বিজোড় ইলেকট্রন দুটির সাহায্যে একটি ইলেকট্রন-জোড় গঠনের মাধ্যমে তাদের অষ্টক-পূর্তি ঘটায়। ফলে Cl2 অণু গঠিত হয়। Ne -পরমাণুর ক্ষেত্রে অষ্টক পূর্ণ থাকায় 2টি Ne -পরমাণু পরস্পরের মধ্যে বন্ধন গঠনের প্রবণতা দেখায় না। তাই Ne2 অণু গঠিত হয় না।
ধ্রুবীয় (polar) সমযোজী বন্ধন কাকে বলে?
যখন দুটি ভিন্ন তড়িৎ-ঋণাত্মকতাসম্পন্ন মৌলের পরমাণুর মধ্যে সমযোজী বন্ধন গঠিত হয় তখন বন্ধন ইলেকট্রন-জোড়টি অধিক তড়িৎ-ঋণাত্মক মৌলের দিকে বেশি পরিমাণে সরে যায়। ফলে অধিক তড়িৎ-ঋণাত্মক মৌলটি আংশিক ঋণাত্মক আধানপ্রাপ্ত হয় এবং কম তড়িৎ-ঋণাত্মক মৌলটি আংশিক ধনাত্মক আধান প্রাপ্ত হয়। এর ফলে বন্ধনটি ধ্রুবীয়তা (polarity) লাভ করে। এইরূপ সমযোজী বন্ধনকে ধ্রুবীয় সমযোজী বন্ধন বলে। যেমন – \(\overset{\delta+}H-\overset{\delta-}F\) একটি ধ্রুবীয় সমযোজী বন্ধন।
অক্সিজেন অণুর লুইস-ডট ডায়াগ্রামের যথার্থতা বিচার করো।
দুটি O -পরমাণু (2, 6) পরস্পরে সঙ্গে দুটি ইলেকট্রন-জোড় গঠনের মাধ্যমে O=O বন্ধন সৃষ্টি করে এবং Ne -পরমাণুর সুস্থিত ইলেকট্রন-বিন্যাস লাভ করে। কিন্তু এই লুইস-ডট ডায়াগ্রাম অক্সিজেন অণুর গঠন সম্পর্কিত পরীক্ষালব্ধ ফলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় একে বর্জন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে O2 অণুর এমন কোনো লুইস-ডট ডায়াগ্রাম অঙ্কন করা সম্ভব নয় যা পরীক্ষালব্ধ ফলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
Class 10 Physical Science – Notes for All Chapters
আমরা আমাদের আর্টিকেলে দশম শ্রেণীর ভৌতবিজ্ঞানের অষ্টম অধ্যায়ের ‘পদার্থের ভৌত রাসায়নিক ধর্মসমূহ‘ থেকে ‘আয়নীয় ও সমযোজী বন্ধন’ এর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণীর ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষার জন্য বা চাকরির পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি দশম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায় দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।