আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ভূগোলের চতুর্থ অধ্যায় ‘ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়া এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ভূমিরূপ’ এর কিছু টীকা নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর ভূগোল পরীক্ষার জন্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই অধ্যায়ের মূল ধারণাগুলো থেকে পরীক্ষায় প্রায়শই প্রশ্ন আসে।

গ্রস্ত উপত্যকা (Rift Valley)
সংজ্ঞা – দুটি সমান্তরাল চ্যুতির মধ্যবর্তী অংশ নীচে বসে গিয়ে যে অবনত ভূমির সৃষ্টি করে, তাকে গ্রস্ত উপত্যকা বলে।
সৃষ্টির কারণ – প্রবল ভূ-আলোড়নের ফলে সৃষ্ট টান ও সংকোচনের জন্য শিলাস্তরে ফাটল বা চ্যুতির সৃষ্টি হয়। এরূপ দুটি সমান্তরাল চ্যুতির মধ্যবর্তী অংশ মহীভাবক আলোড়নের কারণে নীচে বসে গেলে গ্রস্ত উপত্যকার সৃষ্টি হয় এবং পাশের অংশদুটি স্তূপ পর্বত রূপে বিরাজ করে।

উদাহরণ –
- রাইন নদী উপত্যকা হল গ্রস্ত উপত্যকা এবং দুপাশের স্তূপ পর্বত দুটি হল ভোজ ও ব্ল্যাকফরেস্ট।
- আবার, মহীভাবক আলোড়নের ফলে দুটি সমান্তরাল চ্যুতির মধ্যবর্তী অংশ উত্থিত হয়ে স্তূপ পর্বত সৃষ্টি হলে তার দুপাশের অংশ অবনত ভূমি রূপে গ্রস্ত উপত্যকায় পরিণত হয়।
উদাহরণ – সাতপুরা স্তূপ পর্বতের দুপাশের নর্মদা ও তাপ্তি নদী উপত্যকা দুটি হল গ্রস্ত উপত্যকা।
পলিগঠিত প্লাবন সমভূমি (Flood Plain)
বন্যার সময় নদীর মধ্য ও নিম্নগতিতে নদীর উভয় পার্শ্বে পলি, বালি, কাঁকর ইত্যাদি সঞ্চিত হয়ে যে সমভূমি গঠন করে, তাকে পলিগঠিত সমভূমি বলে।
উৎপত্তি – বর্ষাকালে নদীর দুকূল ছাপিয়ে বন্যার সৃষ্টি হলে বন্যার জলের সঙ্গে বাহিত পলি, বালি, নুড়ি, কাদা, কাঁকর নদীর উভয় তীরের নিম্নভূমিতে সঞ্চিত হয়। বছরের পর বছর এইভাবে পলি সঞ্চিত হয়ে নীচু জায়গা ভরাট হয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে সমভূমিতে পরিণত হয়।

বৈশিষ্ট্য –
- এই সমভূমি অত্যন্ত উর্বর প্রকৃতির হয়।
- প্রতি বছর বন্যায় নতুন করে পলি সঞ্চিত হয়।
- প্লাবন সমভূমিতে কাঁকর, বালি, নুড়ি, কাদা, সঞ্চিত হয়ে স্বাভাবিক বাঁধ বা Levee গঠিত হয়।
- এই সমভূমিতে নদী বাঁক, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়।
উদাহরণ – গঙ্গা নদীর নিম্নগতি, অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, মিশরের নীলনদের অববাহিকায় দেখা যায়।
উপকূলীয় সমভূমি (Coastal Plain)
বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা ভূপৃষ্ঠ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্ষয়জাত পদার্থসমূহ সমুদ্র উপকূলে সঞ্চিত হয়ে যে সমভূমি গঠন করে, তাকে উপকূলীয় সমভূমি বলে।
উৎপত্তি –
- উপকূলভাগে সমুদ্র তরঙ্গের দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্ষয়জাত পদার্থ সঞ্চিত হয়ে এই জাতীয় সমভূমি গঠন করে।
- ভূ-আন্দোলনের ফলে উঁচু স্থান বসে গিয়ে সেখানে পলি, বালি, কাঁকর, কাদা সঞ্চিত হয়ে এই প্রকার সমভূমি গঠন করে।
- সমুদ্র তরঙ্গের আঘাতে উপকূলভাগ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এই জাতীয় সমভূমি গঠন করে।

বৈশিষ্ট্য –
- গঠন প্রক্রিয়া অনুসারে এই সমভূমি তিন ধরনের হয় –
- উন্নত সমভূমি
- অবনত সমভূমি
- বাভাবিক সমভূমি।
- এই সমভূমিগুলি সমতল প্রকৃতির হয়।
উদাহরণ – ভারতের পূর্ব উপকূলের সমভূমি।
জ্বালামুখ (Crater)
আগ্নেয়গিরি বা আগ্নেয় পর্বতের চূড়ায় যে মুখ বা গহ্বর থাকে, যার মধ্যে দিয়ে অগ্ন্যুৎগম রূপে জ্বলন্ত লাভা, গ্যাস, ছাই ইত্যাদি বাইরে বেরিয়ে আসে, তাকে জ্বালামুখ (Crater) বলে।
বৈশিষ্ট্য –
- জ্বালামুখ -এর ব্যাস কয়েক মিটার থেকে কয়েক কিলোমিটার হতে পারে।
- একটি আগ্নেয়গিরিতে কখনো-কখনো একাধিক জ্বালামুখ (একটি প্রধান, অন্যগুলি অপ্রধান) থাকে।
- জ্বালামুখের গর্ত বসে গিয়ে বা প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আগের শঙ্কুটি অবক্ষেপিত হয়ে, জ্বালামুখটি বৃহদাকার ধারণ করলে ক্যালডেরা সৃষ্টি হয়। বিশাল আকৃতির জ্বালামুখকে ক্যালডেরা (Caldera) বলা হয়।
টেথিস সাগর (Tethys Sea)
যেখানে হিমালয় পর্বত অবস্থান করছে আজ থেকে বহু কোটি বছর আগে মূলত কার্বোনিফেরাস যুগের শেষ থেকে ক্রিটেসাস যুগের শুরু পর্যন্ত যে অগভীর মহাসমুদ্র অবস্থান করত, তাকে টেথিস সাগর বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য –
- টেথিস সাগর ছিল একটি অবনমিত দীর্ঘ মহীখাত।
- এর উত্তরের ভূখণ্ডটি আঙ্গারাল্যান্ড এবং দক্ষিণের ভূখণ্ডটি গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামে পরিচিত।.
প্রভাব – টেথিস পার্শ্ববর্তী ভূখণ্ডের পলি টেথিসে স্তরে স্তরে চাপা পড়ে এক সময় সেই পলি ভাঁজপ্রাপ্ত হয়ে হিমালয় পর্বত গঠন করে।
মহীখাত বা জিওসিনক্লাইন (Geosyncline)
সাগর, মহাসাগরের অন্তর্গত সুদীর্ঘ অবনমিত প্রাচীন ভূ-ভাগ মহীখাত নামে পরিচিত।
প্রবক্তা – মহীখাত সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন ভূ-বিজ্ঞানী J. Hall, J. D. Dana প্রমুখ।
বৈশিষ্ট্য –
- মহীখাত ভূপৃষ্ঠের একটি সুদীর্ঘ, সংকীর্ণ অবনমিত জলভাগ।
- প্রতিটি মহীখাতই প্রাচীন ভূখণ্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত।
- মহীখাত সর্বদা পলি সঞ্চয়ের দ্বারা অবনমিত হয়।
- ভঙ্গিল পর্বতের উত্থানে মহীখাতের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
উদাহরণ – টেথিস মহীখাত।
ক্যালডেরা (Caldera)
কোনো আগ্নেয়গিরির যে অংশ দিয়ে লাভা, গ্যাস, ছাই প্রভৃতি ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে, তাকে জ্বালামুখ বলে। এই জ্বালামুখ যখন বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাতে নষ্ট হয়ে যে বিশালাকৃতির অবনমিত গহ্বর সৃষ্টি করে, তাকেই ক্যালডেরা বলে।
বৈশিষ্ট্য –
- ক্যালডেরাগুলির ব্যাস প্রায় 15 কিমির অধিক হয়ে থাকে।
- ক্যালডেরায় জল জমে অনেকসময় হ্রদের সৃষ্টি হয় যাকে ক্যালডেরা লেক বলে।
পর্বতবেষ্টিত মালভূমি (Intermontane Plateau)
যে-সকল মালভূমি প্রায় চারদিকেই পর্বত দ্বারা বেষ্টিত হয়ে সৃষ্টি হয়, তাকে পর্বতবেষ্টিত মালভূমি বলে।
সৃষ্টির কারণ – পাত সঞ্চারণের ফলে বা গিরিজনি আলোড়নের ফলে, ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টির সময় পর্বতের মধ্যবর্তী নিচু অসমতল ভূমি প্রবল পার্শ্বচাপে উঁচু হয়ে পর্বতবেষ্টিত মালভূমির সৃষ্টি হয়।

বৈশিষ্ট্য –
- ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে এই মালভূমি দেখা যায়।
- এগুলি অধিক উচ্চতাবিশিষ্ট হয়।
- মালভূমিগুলি পাললিক শিলায় গঠিত হয় এবং এতে জীবাশ্ম থাকতে পারে।
- চারদিক পর্বতবেষ্টিত হওয়ায় এখানকার পরিবেশ শুষ্ক প্রকৃতির হয়।
উদাহরণ – তিব্বত মালভূমি (বৃহত্তম পর্বতবেষ্টিত মালভূমি), পামির মালভূমি (উচ্চতম মালভূমি)।
মহাদেশীয় মালভূমি (Continental Plateau)
বিস্তীর্ণ মহাদেশীয় অংশ জুড়ে প্রাচীন শিলায় গঠিত মালভূমিকে মহাদেশীয় মালভূমি বলে।
সৃষ্টির কারণ – পাতসংস্থান তত্ত্ব অনুসারে পাত সঞ্চালনের ফলে পৃথিবীর প্রাচীন ভূখণ্ড (আঙ্গারাল্যান্ড ও গন্ডোয়ানাল্যান্ড) ফেটে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহাদেশীয় মালভূমি গঠিত হয়।
বৈশিষ্ট্য –
- মহাদেশীয় মালভূমি প্রাচীন ভূখণ্ডের অংশ।
- এগুলি প্রাচীন শিলায় গঠিত, তাই একে শিল্ড মালভূমিও বলা হয়।
- এই প্রাচীন শিলা অত্যন্ত কঠিন ও সহজে ক্ষয় হয় না।
- মালভূমির পৃষ্ঠদেশ বা উপরিভাগ তরঙ্গায়িত।
- এগুলি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ।
উদাহরণ – গন্ডোয়ানাল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে সৃষ্টি হয়েছে দাক্ষিণাত্য মালভূমি, আরবীয় মালভূমি, আফ্রিকা মালভূমি, ব্রাজিল মালভূমি ও পশ্চিম অস্ট্রেলীয় মালভূমি। অন্যান্য মহাদেশীয় মালভূমির মধ্যে রয়েছে কানাডিয়ান শিল্ড, সাইবেরিয়ান মালভূমি, বাল্টিক মালভূমি প্রভৃতি।
ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি (Dissected Plateau)
কোনো বিস্তীর্ণ মালভূমি অঞ্চল কতকগুলি নদী উপত্যকা দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন হলে, তাকে ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি বলে।
সৃষ্টির কারণ – কোন উচ্চ মালভূমি কঠিন ও কোমলশীলায় গঠিত হলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি যেমন আবহবিকার, নদী, বায়ু প্রভৃতির দ্বারা কোমল শিলা অধিক ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং কঠিন শিলায় গঠিত অংশগুলি উঁচু হয়ে অবস্থান করে পরবর্তীকালে ক্ষয়প্রাপ্ত নীচু কোমল শিলার উপর নদী বিন্যাস গড়ে ওঠে এবং সমগ্র মালভূমিটি নদী উপত্যকা দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমিতে পরিণত হয়।

বৈশিষ্ট্য –
- মালভূমি গুলি প্রাচীন শিলা গঠিত ও খনিজ সমৃদ্ধ হয়।
- কঠিন শিলা গঠিত অংশগুলির উচ্চতা প্রায় সমান হয়।
- মালভূমির উচ্চতা ক্রমহ্রাসমান।
- এই মালভূমির মাঝে ছোট ছোট গম্বুজাকৃতির পাহাড় দেখা যায়।
উদাহরণ – ছোটনাগপুর মালভূমি, মালনাদ মালভূমি প্রভৃতি।
ব-দ্বীপ সমভূমি (Delta Plain)
নদীবাহিত পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি নদী মোহনায় সঞ্চিত হয়ে যে মাত্রাহীন ‘ব’ বা গ্রিক অক্ষর ‘Δ’ -এর মতো সমভূমির সৃষ্টি করে, তাকে ব-দ্বীপ সমভূমি (Delta Plain) বলে।
উৎপত্তি – মোহানার কাছে সমুদ্র অগভীর হলে, জোয়ার-ভাটার প্রকোপ কম থাকলে, নদীতে স্রোতের পরিমাণ কম হলে, নদীবাহিত বোঝার পরিমাণ বেশি হলে সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সঙ্গে নদী বাহিত পলি, বালি, নুড়ি মিশে গিয়ে জমাট হয়ে এই জাতীয় সমভূমি গঠন করে।
বৈশিষ্ট্য –
- এই সমভূমি উর্বর হয়।
- এই সমভূমির আকৃতি অনেকটা মাত্রাহীন ‘ব’ বা গ্রিক অক্ষর ‘Δ’ -এর মতো হয়।
- এই সমভূমির উপরিভাগ সমতল প্রকৃতির হয়।
উদাহরণ – গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের সমভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ, মিসিসিপি নদীর ব-দ্বীপ সমভূমি।
আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ভূগোলের চতুর্থ অধ্যায় ‘ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়া এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ভূমিরূপ’ এর কিছু টীকা নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর ভূগোল পরীক্ষার জন্য বা চাকরির পরীক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায় দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।