আজকের এই আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ভৌতবিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায় ‘পরিবেশের জন্য ভাবনা’ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যও সহায়ক, কারণ এগুলো মাধ্যমিক বা বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই এসে থাকে।
বায়ুমণ্ডলের হোমোস্ফিয়ার ও হেটেরোস্ফিয়ার অঞ্চল বলতে কী বোঝ?
বায়ুমণ্ডলের নীচের অংশে (ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 100 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত) উপাদান গ্যাসীয় পদার্থগুলির (যেমন – N2, O2, Ar, CO2, H2O ইত্যাদি) অনুপাত সর্বত্র প্রায় সমান থাকে। তাই এই অংশটিকে হোমোস্ফিয়ার বা সমমন্ডল বলে।
হোমোস্ফিয়ারের ওপরের অংশে যেখানে বায়ুমণ্ডলের উপাদানগুলির অনুপাত স্থির নয়, তাকে হেটেরোস্ফিয়ার বা বিষমমণ্ডল বলে। এটি ভূপৃষ্ঠের ওপর 100 কিমি উচ্চতা থেকে প্রায় 10,000 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত।
বায়ুমণ্ডলকে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয় এবং কী কী?
উষ্ণতা ও উচ্চতার ভিত্তিতে বায়ুমণ্ডলকে মূলত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়, যথা –
- ট্রোপোস্ফিয়ার (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 10 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত)।
- স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার (ট্রোপোস্ফিয়ারের উপরিভাগ থেকে 45 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত)।
- মেসোস্ফিয়ার (স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের উপরিভাগ থেকে 40 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত)।
- থার্মোস্ফিয়ার (ভূ-পৃষ্ঠের সাপেক্ষে প্রায় 86 কিমি থেকে 500 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত)।
- এক্সোস্ফিয়ার (ভূ-পৃষ্ঠের সাপেক্ষে 500 কিমি থেকে 1500 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত)।
ট্রোপোস্ফিয়ার কাকে বলে? একে ক্ষুব্ধমণ্ডল বলার কারণ কী?
বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরের নাম ট্রোপোস্ফিয়ার। এই স্তরটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে 10 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
এই স্তরে বায়ুর মধ্যে ধূলিকণা, জলীয় বাষ্প, মেঘ প্রভৃতি থাকে। ফলে এই স্তরের মধ্যেই ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি ঘটে। তাই ট্রোপোস্ফিয়ারকে ‘ক্ষুব্ধমণ্ডল’ বলা হয়।
ট্রোপোস্ফিয়ারকে ক্রমহ্রাসমান উষ্ণতা স্তর (layer of falling temperature) বলা হয় কেন?
ভূপৃষ্ঠ থেকে ট্রোপোস্ফিয়ারের যতই ঊর্ধ্বে যাওয়া যায় বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা ক্রমশ কমতে থাকে। প্রতি 1000 মিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে গড়ে 6.5°C বা প্রতি 1000 ফুট উচ্চতা বৃদ্ধিতে 3.6°F হারে বায়ুর উষ্ণতা কমে। তাই এই স্তরকে ‘ক্রমহ্রাসমান উষ্ণতা স্তর‘ বলে।
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার কাকে বলে? একে ‘শান্তমণ্ডল’ বলা হয় কেন?
ট্রোপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে 50 কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুস্তরটিকে স্ট্যাটোস্ফিয়ার বলে।
এই বায়ুস্তর প্রায় মেঘমুক্ত। সমান্য ধূলিকণা থাকলেও জলকণাশূন্য। ফলে এই স্তরে ঝড়, বৃষ্টি, বায়ুপ্রবাহের সম্ভাবনাও নেই। তাই এই স্তরের নাম শান্তমণ্ডল।
ওজোনোস্ফিয়ার কাকে বলে? এই স্তরটি আমাদের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ কেন?
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওপরের দিকে ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে 16-30 কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটিতে বায়ুর মধ্যে ওজোন (O3) গ্যাসের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, সেজন্য এই অঞ্চলটিকে ওজোনোস্ফিয়ার বলে।
ওজোন গ্যাসের স্তর সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মিকে শোষণ করে। অতিবেগুনি রশ্মি জীবজগতের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক। সুতরাং, ওজোনোস্ফিয়ার স্তরটি সূর্যের এই ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে। এজন্য এই স্তরটি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মেসোস্ফিয়ার কাকে বলে? মেসোস্ফিয়ারের সর্বোচ্চ অংশটিকে কী বলা হয়?
স্ট্যাটোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে 50-80 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুমণ্ডলীয় স্তরটিকে ‘মেসোস্ফিয়ার’ বলে।
মেসোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বসীমাকে ‘মেসোপজ’ বলে।
থার্মোস্ফিয়ার কাকে বলে? এরূপ নামকরণের কারণ কী?
মেসোস্ফিয়ারের ওপরে 80 কিমি থেকে 480 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুমণ্ডলীয় স্তরের নাম থার্মোস্ফিয়ার (thermosphere)।
বায়ুমণ্ডলের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই স্তরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। প্রায় 120 কিমি উচ্চতায় এই তাপমাত্রা হয় প্রায় 500°C, 200 কিমিতে প্রায় 700°C এবং 480 কিমিতে প্রায় 1232°C। উষ্ণতা খুব বেশি থাকে বলেই এই স্তরের নাম ‘থার্মোস্ফিয়ার’।
আয়নোস্ফিয়ার কাকে বলে? এরূপ নামকরণের কারণ কী?
থার্মোস্ফিয়ারের নীচের অংশের (80-400 কিমি) বায়ুস্তরটিতে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদি অণুর প্রাধান্য থাকে। এই অঞ্চলটিকে আয়নোস্ফিয়ার বলে।
সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন গামা রশ্মি, X-রশ্মি ও মহাজাগতিক বিকিরণের (cosmic radiation) – প্রভাবে এই অঞ্চলের নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাসের অণুগুলি ভেঙে গিয়ে অসংখ্য আয়ন বা তড়িদ্গ্রস্ত কণার সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে অসংখ্য মুক্ত ইলেকট্রনও উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ, এই অংশের বায়ু আয়নিত অবস্থায় থাকায় এই স্তরকে আয়নোস্ফিয়ার বলে।
মেরুজ্যোতি (aurora) কীভাবে সৃষ্টি হয়? ‘সুমেরু প্রভা’ ও ‘কুমেরু প্রভা’ কাকে বলে?
থার্মোস্ফিয়ারের অন্তর্গত আয়নোস্ফিয়ারে (80-400 কিমি) থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন গ্যাসের অণুগুলি সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন গামা রশ্মি এবং X-রশ্মির প্রভাবে আয়নিত হয় (O+ ও N2O+)। সেই সঙ্গে অসংখ্য মুক্ত ইলেকট্রনও উৎপন্ন হয়। এই মুক্ত ইলেকট্রনগুলি আবার অন্য আয়নগুলি দ্বারা গৃহীত হওয়ার সময় আলোকরশ্মি বিকিরণ করে। একেই মেরুজ্যোতি বলে।
উত্তর মেরুতে সৃষ্ট মেরুজ্যোতিকে সুমেরু প্রভা (aurora borealis) এবং দক্ষিণ মেরুতে সৃষ্ট মেরুজ্যোতিকে কুমেরু প্রভা (aurora australis) বলে।
ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরগুলির উষ্ণতার কীরূপ পরিবর্তন হয় লেখো।
- উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে ট্রোপোস্ফিয়ারের উষ্ণতা ক্রমশ হ্রাস পায়। এই স্তরে প্রতি কিমি উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রায় 6.5°C উষ্ণতা হ্রাস পায়। এই স্তরের উপরের দিকের উষ্ণতা প্রায় -56°C।
- স্ট্যাটোস্ফিয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে উষ্ণতা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
- মেসোস্ফিয়ার বায়ুমণ্ডলের শীতলতম স্তর। এই স্তরের ক্ষেত্রে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে উষ্ণতা ক্রমশ কমতে থাকে।
- থার্মোস্ফিয়ারের ক্ষেত্রে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। সূর্য থেকে বিকিরিত কসমিক রশ্মি ও অন্যান্য রশ্মির প্রভাবে এই স্তরের উষ্ণতা বেড়ে প্রায় 1200°C হয়।
- এক্সোস্ফিয়ারের উষ্ণতা 1200°C অপেক্ষা বেশি হয়।
উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে বায়ুমণ্ডলের চাপ কীভাবে পরিবর্তিত হয়?
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে ওঠা যায় বায়ুস্তরের ঘনত্ব তত কমতে থাকে। তাই চাপও কম হয়। সাধারণত 110 মিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে বায়ুচাপ 1 সেমি করে হ্রাস পায়। তবে উপরের দিকের বায়ুস্তরের সব অংশে এই হারে বায়ুচাপ হ্রাস পায় না।
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অঞ্চলে উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায় কেন?
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে উপস্থিত অক্সিজেন গ্যাসের অণু (O2) সূর্য থেকে আগত অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে অক্সিজেন পরমাণুতে (O) বিয়োজিত হয়। এই পারমাণবিক অক্সিজেন আণবিক অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে ওজোন অণু (O3) সৃষ্টি করে। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে তাপের উদ্ভব হয়। এর ফলে দেখা যায় ট্রোপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অংশে (18-50 কিমি) বায়ুর উষ্ণতা কমার বদলে বৃদ্ধি পায়। 50 কিমি উচ্চতায় উষ্ণতা সর্বোচ্চ 0°C (32°F) হয়।
পরিচলন কাকে বলে? পরিচলন স্রোত কী?
পরিচলন – যে প্রক্রিয়ায় তরল বা গ্যাসের উত্তপ্ত কণাগুলি নিজেরাই উষ্ণতর থেকে শীতলতর অংশে স্থানান্তরিত হয়ে তাপ সঞ্চালন করে, তাকে পরিচলন বলে।
পরিচলন স্রোত – তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ উত্তপ্ত হলে তার আয়তন প্রসারণের জন্য ঘনত্ব কমে, ফলে উত্তপ্ত তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ হালকা হয়ে ওপরে ওঠে ও ওপরের শীতল ভারী অংশ নীচে নেমে আসে। ফলে যে চক্রাকার স্রোতের সৃষ্টি হয় তাকে পরিচলন স্রোত বলে।
বায়ুতে পরিচলন স্রোত কীভাবে সৃষ্টি হয়?
কোনো স্থানের বায়ু উত্তপ্ত হলে ওই বায়ুর আয়তন বৃদ্ধি পায় ও ঘনত্ব কমে যায়। ফলে উত্তপ্ত বায়ু হালকা হয়ে ওপরে ওঠে। এর ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করতে আশেপাশের অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও ভারী বায়ু ওই জায়গায় ছুটে আসে। এভাবে বায়ুতে পরিচলন স্রোতের সৃষ্টি হয়।
পরিচলন স্রোতের দুটি প্রাকৃতিক উদাহরণ দাও। কখন এদের তীব্রতা বেশি হয়?
পরিচলন স্রোতের দুটি প্রাকৃতিক উদাহরণ হল – সমুদ্রবায়ু এবং স্থলবায়ু।
সমুদ্রবায়ু সকালবেলায় প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং সন্ধ্যাবেলায় এর তীব্রতা বাড়ে। স্থলবায়ু সন্ধ্যাবেলায় প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং সমগ্র রাত্রি ধরে প্রবাহিত হয়। এটির তীব্রতা ভোরবেলায় বাড়ে।
ওজোন স্তরকে ওজোন ছত্র বলার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের অন্তর্গত ওজোন স্তরকে ওজোন ছত্র (Ozone umbrella) বলে। ছাতা যেমন রোদ-বৃষ্টি থেকে আমাদের রক্ষা করে, ওজোন স্তর তেমন সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মির পৃথিবীতে আগমনকে প্রতিরোধ করে। তাই ওজোন স্তরকে ওজোন ছত্র বলা হয়।
ওজোন ছিদ্র বা ওজোন গহ্বর কী?
মানুষের কিছু ক্রিয়াকলাপের ফলে ওজোন তৈরির হার অপেক্ষা বিয়োজনের হার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের অন্তর্গত ওজোন স্তরটি প্রায় সর্বত্র কমবেশি পাতলা হয়ে যাচ্ছে। ওজোন স্তরের এই পাতলা হওয়ার ঘটনাকে ওজোন স্তরের ক্ষয় বা ওজোন ছিদ্র বা ওজোন গহ্বর (Ozone hole) বলে।
মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বা ব্যবহৃত কয়েকটি রাসায়নিক পদার্থের নাম করো যেগুলি ‘ওজোন গহ্বর’ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
মানুষের দ্বারা পরিবেশে যুক্ত হওয়া ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC) বা ফ্রেয়ন জাতীয় রাসায়নিক পদার্থগুলি, নাইট্রিক অক্সাইড (NO), নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2) ইত্যাদি গ্যাসগুলি ‘ওজোন গহ্বর’ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
ওজোনস্তরের ঘনত্বের একক কী?
ওজোন স্তরের ঘনত্বের একক হল ‘ডবসন’। 0°C উষ্ণতা ও 760 mm Hg চাপে সংকুচিত 0.01 mm পুরু ওজোনের ঘনত্বকে 1 ডবসন একক (1 DU) বলে।
পরিবেশের উপর ওজোন স্তরের প্রভাব সংক্ষেপে উল্লেখ করো।
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে উপস্থিত ওজোন স্তর পৃথিবীর জীবকুলের পক্ষে এক নিরাপদ আচ্ছাদনের কাজ করে। সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির বেশিরভাগ অংশই ওজোন স্তরে ওজোন গ্যাসের উৎপাদন ও বিয়োজনের প্রয়োজনে শোষিত হয়ে যায়। ওজোন স্তর না থাকলে এই অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীপৃষ্ঠে এসে পড়ত যার ফলস্বরূপ –
- ভূপৃষ্ঠ ও ভূপৃষ্ঠসংলগ্ন বায়ু এত উত্তপ্ত হয়ে যেত যে স্থল ও জলভাগের সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ত।
- অতিবেগুনি রশ্মির প্রকোপে পৃথিবীপৃষ্ঠে বসবাসকারী জীবকুলের নানাবিধ রোগের সৃষ্টি হত।
জলবায়ুর ওপর ওজোন গহ্বর সৃষ্টির প্রভাব কী কী হতে পারে উল্লেখ করো।
- ওজোন গহ্বর সৃষ্টি হলে সূর্য থেকে আগত অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীপৃষ্ঠে এসে পড়বে, ফলে পৃথিবী ক্রমাগত উত্তপ্ত হবে ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রতীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধীরে ধীরে জলের তলায় নিমজ্জিত হবে।
- অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি। বৃদ্ধি পাবে, ফলে ধোঁয়াশার পরিমাণ এবং স্থায়িত্ব বাড়বে।
গ্রিনহাউস প্রভাব কী?
যে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত কয়েকটি গ্যাসীয় পদার্থ (যেমন, CO2, CH4, CFC, N2O, O3, ইত্যাদি) পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত তাপের একাংশকে মহাশূন্যে ফিরে যেতে না দিয়ে ভূপৃষ্ঠ ও তৎসংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত রাখে এবং ফলস্বরূপ পৃথিবীতে জীবকুলের বেঁচে থাকার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাকে গ্রিনহাউস প্রভাব (green house effect) বলে।
গ্রিনহাউস গ্যাস কাদের বলে?
বায়ুমণ্ডলের যেসব গ্যাসীয় পদার্থ উত্তপ্ত পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট অবলোহিত রশ্মির (infrared ray) কিছু অংশ শোষণ করে এবং অবশিষ্টাংশ পুনরায় পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রতিফলিত করে ভূপৃষ্ঠ ও তার সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত রাখে, তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস বলে।
উদাহরণ – কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC), ওজোন (O3), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O), জলীয় বাষ্প (H2O) ইত্যাদি।
গ্রিনহাউস প্রভাবের উপযোগিতা উল্লেখ করো।
বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত \(CO_2\), জলীয় বাষ্প ইত্যাদি গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে অবলোহিত রশ্মিরূপে বিকিরিত তাপকে মহাশূন্যে বিলীন হতে না দিয়ে ভূপৃষ্ঠ ও তার সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে এমন এক উষ্ণতা সীমার মধ্যে (গড় মান \(\underline\sim\) 15°C) উত্তপ্ত রাখে, যা মানুষসহ সমগ্র জীবজগতের বেঁচে থাকার পক্ষে অনুকূল। বায়ুমণ্ডলে যদি গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি না থাকত, অর্থাৎ গ্রিনহাউস প্রভাব না ঘটত তাহলে পৃথিবীপৃষ্ঠ ও সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলের গড় উষ্ণতা হত প্রায় -30°C। এই উষ্ণতায় পৃথিবীপৃষ্ঠে জীবজগতের কোনো অস্তিত্বই থাকত না।
গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা কীভাবে বৃদ্ধি করে?
সূর্য থেকে আগত ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট অবলোহিত রশ্মি পৃথিবীর চারপাশের গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির আচ্ছাদন ভেদ করে পৃথিবীপৃষ্ঠে আসতে পারে। ভূপৃষ্ঠ অবলোহিত রশ্মির কিছুটা শক্তি শোষণ করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ও এর ফলে ভূপৃষ্ঠ দ্বারা বিকিরিত অবলোহিত রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। এই দীর্ঘতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলোহিত রশ্মি গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে যেতে পারে না। উক্ত গ্যাসগুলি ভূপৃষ্ঠ দ্বারা বিকিরিত অবলোহিত রশ্মির কিছু অংশ শোষণ করে নিজেরা উত্তপ্ত হয় এবং বাকি অংশ পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রতিফলিত করে ভূপৃষ্ঠ ও তার সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে উত্তপ্ত রাখে।
পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন দেশের অবদান লিখ।
বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির পরিমাণ বৃদ্ধিতে পৃথিবীর সবদেশই কমবেশি দায়ী। তবে শিল্প-সমৃদ্ধ দেশগুলিতে কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানিগুলি বেশি ব্যবহৃত হয় বলে এবং মাটিতে নাইট্রোজেন-ঘটিত সার বেশি ব্যবহৃত হয় বলে বাতাসে CO2, CH4, N2O প্রভৃতি গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং কাকে বলে?
বিজ্ঞাননির্ভর আধুনিক জীবনযাত্রায় মানুষের নানাবিধ ক্রিয়াকলাপের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এর প্রভাবে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে এবং সারা বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত উষ্ণতা বৃদ্ধির এই ঘটনাকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং (global warming) বলে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং -এর ফলে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হবে কেন?
গ্লোবাল ওয়ার্মিং -এর ফলে ভূ-পৃষ্ঠ ও তৎসংলগ্ন অংশের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রে জলস্ফীতি ঘটবে। এর ফলে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় মহাপ্লাবন দেখা দেবে এবং উর্বর কৃষিজমিগুলি সমুদ্রের লবণাক্ত জলের প্রভাবে চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে, যার পরিণতি হিসাবে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে। এছাড়াও গ্লোবাল ওয়ার্মিং -এর জন্য জমির আর্দ্রতা কমে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হবে।
স্থিতিশীল উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়?
যে উন্নয়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট না করেও দেশ ও দশের মঙ্গল করা যায়, তাকে স্থিতিশীল উন্নয়ন বলে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বুভুক্ষা প্রভৃতি আর্থ-সামাজিক অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্ত করাই এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য।
এজেন্ডা-21 (Agenda-21) কী?
1992 সালে 3 থেকে 14 জুন ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরো শহরে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রসংঘের ‘বসুন্ধরা সম্মেলনে’ (Earth Summit) স্থিতিশীল বা স্থায়ী উন্নয়নের রূপায়ন-সংক্রান্ত 21 দফা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। এই কর্মসূচী ‘এজেন্ডা-21’ নামে বিখ্যাত। এই অধিবেশনে ভারতসহ পৃথিবীর 130টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল।
ব্রান্টল্যান্ড কমিশন বা বিশ্ব পরিবেশ ও উন্নয়ন কমিশনের মতে ‘স্থিতিশীল উন্নয়নের’ সংজ্ঞা কী?
ব্রান্টল্যান্ড কমিশন বা বিশ্ব পরিবেশ ও উন্নয়ন কমিশনের মতে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজন অক্ষুন্ন রেখে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা বা কার্যক্রমকে স্থিতিশীল উন্নয়ন বলে (Sustainable development is the development that meets the needs of the present without compromising the ability of future generations to meet their own needs.)।
জীবাশ্ম জ্বালানি বলতে কী বোঝ?
জীবাশ্ম হল প্রাকৃতিক উপায়ে মাটি বা পাথরের অভ্যন্তরে সঞ্চিত অতি প্রাচীনকালের উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহাবশেষ। ভূগর্ভে প্রচণ্ড তাপ, চাপ ও ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে জীবাশ্মগুলি থেকে সৃষ্টি হয়েছে কয়লা, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস -এর মতো জ্বালানি। এগুলিকে বলা হয় ‘জীবাশ্ম জ্বালানি’। জীবাশ্ম জ্বালানিগুলি হল প্রচলিত শক্তির উৎস এবং এরা অনবীকরণযোগ্য।
চিরাচরিত শক্তির উৎস বা অনবীকরণযোগ্য (non-renewable) শক্তির উৎস বলতে কী বোঝ? উদাহরণ দাও।
যেসব শক্তির উৎসগুলিকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করার ফলে বর্তমানে নিঃশেষিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে এবং যেগুলি নিঃশেষিত হলে ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তাদের চিরাচরিত বা অনবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস বলে।
উদাহরণ – জীবাশ্ম জ্বালানিগুলি যেমন কয়লা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস হল চিরাচরিত বা অনবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস।
পুনর্নবীকরণযোগ্য (renewable) বা অচিরাচরিত শক্তির উৎস কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যেসব শক্তির উৎসগুলির ব্যবহার সাম্প্রতিককালে শুরু হয়েছে এবং যে উৎসগুলিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে চললেও নিঃশেষিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই সেইসব শক্তির উৎসগুলিকে পুনর্নবীকরণযোগ্য বা অচিরাচরিত শক্তির উৎস বলে।
উদাহরণ – সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জোয়ার-ভাটার শক্তি, ভূ-তাপশক্তি ইত্যাদি।
সৌরশক্তিকে চিরাচরিত শক্তির বিকল্পরূপে ভাবা হচ্ছে কেন?
সূর্য এক বিপুল শক্তির আধার। প্রতি ঘন্টায় সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ সূর্যরশ্মি পৌঁছায়, তাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করলে যে তাপশক্তি পাওয়া যাবে তা 21 × 1012 টন কয়লার সমান। সৌরশক্তি পুনর্ভব, প্রবহমান ও সর্বব্যাপ্ত। সূর্যের অসীম শক্তিকে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করার কারিগরি জ্ঞান মানুষ যেদিন আয়ত্ত করতে পারবে সেদিন পৃথিবীতে জ্বালানির আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। তাই সৌরশক্তিকে চিরাচরিত শক্তির বিকল্পরূপে ভাবা যায়।
বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়?
প্রকৃতপক্ষে প্রবাহিত বায়ুর গতিশক্তিই হল বায়ুশক্তি। বায়ুকলের সাহায্যে এই বায়ুশক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। বায়ুকলের বায়ুচক্রের কেন্দ্রীয় অক্ষদণ্ডের সঙ্গে বৈদ্যুতিক জেনারেটরের টারবাইনকে সংযুক্ত করা হয়। ফলে টারবাইনে প্রবল ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয়, যা বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
বায়ুশক্তিকে চিরাচরিত শক্তির বিকল্পরূপে ব্যবহার করা যাবে কি?
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বাতাসের প্রবহমান শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে সারাবছর এত জোরে বাতাস বয় যে, ওই শক্তিকে সহজেই মানুষ নানা কাজে লাগাতে পারে। এছাড়া বায়ুশক্তি হল অফুরন্ত সম্পদ। কয়লা বা খনিজ তেলের মতো বায়ুশক্তির নিঃশেষিত হওয়ার আশঙ্কা নেই এবং বায়ুশক্তি হল দূষণমুক্ত শক্তি। তাই বায়ুশক্তিকে চিরাচরিত শক্তির বিকল্পরূপে ব্যবহার করা যায়।
জোয়ার-ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা হয়?
ভরা কোটালের সময় সমুদ্রে যখন প্রবল জলস্ফীতি হয় তখন বাঁধের সাহায্যে ড্যামে জল আটকে রাখা হয়। পরে মরা কোটালের সময় জলস্তর নেমে গেলে জলাশয় থেকে আটকে রাখা জলকে নীচে নিক্ষেপ করা হয় এবং সৃষ্ট জলস্রোতের গতিশক্তির সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
জোয়ার-ভাটার শক্তিকে চিরাচরিত শক্তির বিকল্পরূপে ব্যবহার করা যাবে কি?
জোয়ার-ভাটার শক্তির সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এই শক্তি পুর্নভব, অফুরন্ত সম্পদ। পৃথিবীতে চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ যতদিন বজায় থাকবে, ততদিন প্রাকৃতিক নিয়মে জোয়ার-ভাটা হবে। কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জ্বালানি সম্পদের মতো জোয়ার-ভাটার শক্তি নিঃশেষিত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তাই পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলিতে জোয়ার-ভাটা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচেষ্টা অনেকদিন আগে শুরু হয়েছে। বর্তমানে ভারতসহ কয়েকটি দেশে চিরাচরিত শক্তির বিকল্পরূপে এই শক্তি উৎপাদনের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ভূ-তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা হয়?
লাভা উদগিরণের সময় ভূ-গর্ভ থেকে নির্গত ম্যাগমার বেশিরভাগ অংশই ভূ-পৃষ্ঠের 5-10 কিমি গভীরে বিভিন্ন শিলাস্তরের ফাঁকে আটকে যায়। এই উত্তপ্ত ম্যাগমার সংস্পর্শে এসে সংলগ্ন কঠিন শিলাস্তর প্রচন্ড উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর যখন অতিতপ্ত শিলাস্তরের কাছাকাছি আসে, তখন প্রচন্ড তাপে তা বাষ্পে পরিণত হয়। এই উত্তপ্ত বাষ্প ভূগর্ভে যেখানে আটকা পড়ে, সেখানে নল ঢুকিয়ে ওই বাষ্পকে তুলে আনা হয় এবং এর সাহয্যে টারবাইনের চাকা ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
ভূ-তাপশক্তিকে চিরাচরিত শক্তির বিকল্পরূপে ভাবা যায় কি?
ভূ-অভ্যন্তরের তাপকে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদন করা হয়। এই অচিরাচরিত শক্তি হল অফুরন্ত সম্পদ। কয়লা, খনিজ তেলের মতো এই শক্তি নিঃশেষ হওয়ার আশঙ্কা নেই। বৈজ্ঞানিক হিসেব অনুযায়ী, ভূ-অভ্যন্তরের 10 কিমি গভীরতা পর্যন্ত প্রাপ্ত ভূ-তাপশক্তির মোট পরিমাণ বছরে 12 হাজার কিলোওয়াট-ঘন্টা। এই বিপুল শক্তিকে কাজে লাগানোর দক্ষতা বা কারিগরি জ্ঞান পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেরই নেই। তবে কয়েকটি দেশে, যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, জাপান, ইটালি, আইসল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডে ভূ-তাপশক্তি ব্যাপকভাবে আহরণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে এই শক্তি দুষণমুক্ত। তাই ভবিষ্যতে চিরাচরিত শক্তির বিকল্পরূপে এর বহুল ব্যবহার সম্ভব বলে মনে করা হয়।
মিথানোজেনিক ব্যাকটেরিয়া কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যেসব ব্যাকটেরিয়া বায়ুর অনুপস্থিতিতে বায়োমাসের বিয়োজন ঘটিয়ে প্রকৃতিতে মিথেন গ্যাস মুক্ত করে তাদের মিথানোজেনিক ব্যাকটেরিয়া বলে।
উদাহরণ – মিথানোকক্কাস (Methanococcus), মিথানোব্যাকটেরিয়াম (Methanobacterium) ইত্যাদি।
বায়ুমন্ডলে মিথেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে মিথানোজেনিক ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা লেখো।
পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, জলাভূমি ও বর্ষা-অরণ্যের (rain forest) মিথানোজেনিক ব্যাকটেরিয়া নানাবিধ উদ্ভিজ্জ বর্জ্য পদার্থের বিয়োজন ঘটিয়ে প্রকৃতিতে মিথেন গ্যাস মুক্ত করছে। এভাবে মিথানোজেনিক ব্যাকটেরিয়া বায়ুমণ্ডলে মিথেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে চলেছে।
বায়োমাস শক্তি বলতে কী বোঝায়? এর ব্যবহারে কী অসুবিধা দেখা যায়?
কৃষিজাত বর্জ্য, পচা গাছপালা, আখের ছিবড়ে, ধানের তুষ শহরের কঠিন আবর্জনা, রান্নাঘরের অব্যবহৃত জৈব অবশেষ, প্রাণীর মলমূত্র, মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ প্রভৃতি বিভিন্ন কার্বনঘটিত পদার্থ অর্থাৎ বায়োমাসের মধ্যে যে রাসায়নিক শক্তি সঞ্চিত থাকে, তাকে ‘বায়োমাস শক্তি’ বলে।
অনবীকরণযোগ্য জীবাশ্ম জ্বালানির সংরক্ষণের জন্য তাদের ব্যবহার কমিয়ে অন্য যেসব বিকল্প শক্তি উৎসের কথা ভাবা হচ্ছে তার মধ্যে বায়োমাস শক্তি অন্যতম। কিন্তু এই জ্বালানির মূল অসুবিধা হল এর দহনজনিত দূষণ।
জৈব গ্যাস বা বায়োগ্যাস (Bio gas) কাকে বলে? বায়োগ্যাসের উপাদানগুলি লেখো।
মানুষ ও প্রাণীর মলমূত্র, শাকসবজির খোসা, কৃষিকার্যের ফলে উৎপন্ন বর্জ্য, রান্নাঘরে অব্যবহৃত জৈব অবশেষ, কচুরিপানা, ফলের খোসা প্রভৃতি বায়োমাসকে বৃহদাকার বদ্ধ প্রকোষ্ঠে রেখে মিথানোজেনিক ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে যে দাহ্য গ্যাস উৎপাদন করা হয়, তাকে জৈব গ্যাস বা বায়োগ্যাস বলে।
জৈব গ্যাসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল মিথেন (CH4)। এছাড়া কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) এবং অল্প পরিমাণে H2, N2, CO, O2, H2S ও জলীয় বাষ্প থাকে।
জৈব গ্যাসের ব্যবহার সম্পর্কে লেখো।
- আলো জ্বালাতে, জল গরম করতে ও রান্নার কাজে জ্বালানি হিসাবে জৈব গ্যাস ব্যবহার করা হয়।
- এছাড়া পৃথিবীর বহু দেশে ইট প্রস্তুতি, সেরামিক টাইল তৈরি, তামাক শুকনো করা ইত্যাদি কাজে জৈব গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয়েছে।
- জৈব গ্যাস থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ দ্বারা ছোটো বৈদ্যুতিক পাম্প চালানো ও কুটিরশিল্পের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়।
বায়োফুয়েল বলতে কী বোঝ? উদাহরণ দাও।
বায়োমাস থেকে যে জ্বালানি উৎপন্ন হয়, তাকে বায়োফুয়েল বলা হয়।
উদাহরণ – আখ বা ভুট্টা থেকে সন্ধান প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন বায়োইথানল একটি বায়োফুয়েল যাকে গ্যাসোলিনের (পেট্রোলের) সাথে মিশিয়ে যানবাহন চালানোর কাজে ব্যবহার করা হয়।
মিথেন হাইড্রেট কী?
মিথেন হাইড্রেট হল কেলাসাকার কঠিন পদার্থ যেখানে মিথেন অণুগুলি জলের অণু দ্বারা সৃষ্ট কেলাস গঠনের মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় থাকে। এর সংকেত 4CH4⋅23H2O। উপযুক্ত উষ্ণতা এবং চাপেই কেবল এর অস্তিত্ব বজায় থাকে।
কয়লা খনিতে মিথেন গ্যাস কীভাবে সঞ্চিত হয়?
কয়লার স্তরে অনুজীবের ক্রিয়ায় অথবা ভূগর্ভের তাপে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। প্রায়শই দেখা যায় পাথরের স্তরের মাঝে আবদ্ধ পাতলা কয়লা স্তর জল দ্বারা সম্পৃক্ত থাকে এবং এই জলের চাপই মিথেন গ্যাসকে কয়লার স্তরে আবদ্ধ করে রাখে।
কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের আগে মিথেন গ্যাস উত্তোলন করা হয় কেন?
কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের আগে কয়লার স্তর থেকে মিথেন গ্যাসকে যথাসম্ভব উত্তোলিত করা হয়, কারণ –
- এর ফলে আগুনের সংস্পর্শে বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা দূর করা যায় এবং কয়লা খনন করার সময় মুক্ত মিথেনের বায়ুতে মিশে যাওয়া রোধ করা যায়।
- কয়লা খনি থেকে প্রাপ্ত মিথেন গ্যাসকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। অনেক সময় কয়লা উত্তোলন নানা কারণে সম্ভব না হলেও শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য কয়লাখনি থেকে মিথেন গ্যাস উত্তোলন করা হয়।
কী ধরনের ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশে মিথেন হাইড্রেট পাওয়া যায়?
পৃথিবীর কয়েকটি অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ মিথেন হাইড্রেটের গঠন ও স্থায়িত্বের জন্য উপযুক্ত। এগুলি হল –
- মেরু অঞ্চলের হিমায়িত মৃত্তিকা স্তরের (permafrost) নীচের পলি ও পাললিক শিলাস্তর।
- মহাদেশীয় প্রান্ত (continental margin) অঞ্চলে সঞ্চিত পলিস্তর।
- বৃহৎ হ্রদ (lake) ও সমুদ্রের নীচে জমা পলিস্তর।
- মেরু অঞ্চলে সঞ্চিত বরফের তলদেশ।
শক্তির উৎস হিসেবে মিথেন হাইড্রেট -কে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে কেন?
পৃথিবীতে যে পরিমাণ মিথেন হাইড্রেটের সঞ্চয়ের কথা জানা গিয়েছে, তা হাইড্রোকার্বন জ্বালানির উৎস হিসেবে পৃথিবীতে মজুত সমগ্র খনিজ তেল ভাণ্ডার, প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার মিলিত ভাণ্ডারের চেয়েও বৃহৎ। মিথেন হাইড্রেটে মিথেনের পরিমাণও খুব বেশি থাকে। 1 m3 মিথেন হাইড্রেটের গলনে প্রায় 160 m3 মিথেন গ্যাস পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানিগুলি নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এদের বিকল্প হিসেবে মিথেন হাইড্রেট আমাদের শক্তিসংকট থেকে পরিত্রাণের সহায়ক হতে পারে। তাই শক্তির উৎস হিসেবে মিথেন হাইড্রেটকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
শক্তির উৎস হিসেবে মিথেন হাইড্রেট ব্যবহারের অসুবিধাগুলি উল্লেখ করো।
শক্তির উৎস হিসেবে মিথেন হাইড্রেটের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধাও রয়েছে –
- মিথেন হাইড্রেট অন্যান্য খনিজ পদার্থের মতো স্থায়ী নয়। উষ্ণতা বৃদ্ধি বা চাপের হ্রাস ঘটলে এটি দ্রুত বিয়োজিত হয়ে জলে পরিণত হয় ও মিথেন গ্যাস মুক্ত করে। এর ফলে ভূপৃষ্ঠের তলায় হঠাৎ ধস নামতে পারে। এভাবে ধস নামলে মিথেন গ্যাস উত্তোলনের যন্ত্রপাতি ও পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- মিথেন একটি অন্যতম গ্রিনহাউস গ্যাস। উষ্ণতা হঠাৎ বৃদ্ধি পেলে মিথেন হাইড্রেট গলে গিয়ে বায়ুতে মিথেন মুক্ত করে। ফলে পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হবে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ভৌতবিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায় ‘পরিবেশের জন্য ভাবনা’ থেকে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো আপনার পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিংবা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহায়ক হবে, কারণ এ ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনার কাজে এসেছে। যদি কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, নির্দ্বিধায় টেলিগ্রামে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ!