আজকের এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক বাংলার প্রথম পাঠের, “জ্ঞানচক্ষু” এর “বিষয়সংক্ষেপ” নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।

আশাপূর্ণা দেবী – লেখক পরিচিতি
আশাপূর্ণা দেবীর জন্ম এবং শৈশব –
1909 খ্রিস্টাব্দের 8 জানুয়ারি উত্তর কলকাতার এক রক্ষণশীল পরিবারে আশাপূর্ণা দেবীর জন্ম হয়। তাঁর আদি বাড়ি ছিল হুগলির বেগমপুরে। কোনো স্কুলকলেজে আশাপূর্ণা দেবীর পড়ার সুযোগ হয়নি। মাত্র পনেরো বছর বয়সে কালিদাস গুপ্তের সঙ্গে আশাপূর্ণা দেবীর বিয়ে হয়। দীর্ঘজীবনে একজন গৃহবধূ ও মায়ের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি তিনি বহু অনবদ্য সাহিত্যও সৃষ্টি করেছেন।
আশাপূর্ণা দেবীর কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন –
তেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম লেখা শিশুসাথী পত্রিকায় ছাপা হয়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ছোট ঠাকুরদার কাশীযাত্রা (1938 খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রেম ও প্রয়োজন (1944 খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর লেখায় মধ্যবিত্ত পুরুষ ও নারী চরিত্র নানা মহিমায় প্রকাশ পেয়েছে। আশাপূর্ণা দেবী আধুনিক মেয়েদের কথা বলেছেন। কিন্তু আধুনিকতার বিলাসীদের প্রশ্রয় দেননি। তাঁর লেখা একদিকে যেমন বাঙালি নারীদের উজ্জীবিত করেছে, অন্যদিকে তেমনই পুরুষদের মানসিকতার দিকটিও তুলে ধরেছে। তিনি বিরামহীনভাবে সত্তর বছরেরও বেশি বয়স পর্যন্ত লিখে গিয়েছেন। সহজ কথাটা সহজে বলার মতো কঠিন কাজটাই আশাপূর্ণা দেবী আজীবন ধরে করে গেছেন। লেখা দেওয়ার ব্যাপারে কাউকে তিনি কখনও বিমুখ করতে পারতেন না। তাঁর এই বিশেষ স্বভাবটির জন্য কাগজের লোকেরা সবসময়ই তাঁর শরণাপন্ন হতেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে 176টি উপন্যাস, 30টি ছোটোগল্প সংকলন, 47টি ছোটোদের বই, 25টি অন্যান্য সংকলন। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় তাঁর 63টি গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে। তাঁর রচিত ট্রিলজি প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা, বকুলকথা-য় তিনি নারীসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দুঃখবেদনার কথা বলেছেন।
আশাপূর্ণা দেবীর পুরস্কার –
প্রথম প্রতিশ্রুতি গ্রন্থের জন্য 1978 খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান ‘জ্ঞানপীঠ‘ পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও সাহিত্যকৃতির জন্য তিনি পেয়েছেন ‘রবীন্দ্র পুরস্কার‘, ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার‘, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট ডিগ্রি ও সরকারি খেতাব।
আশাপূর্ণা দেবীর মৃত্যু –
1995 খ্রিস্টাব্দের 13 জুলাই তাঁর দেহাবসান হয়।
জ্ঞানচক্ষুর উৎস
আশাপূর্ণা দেবী রচিত কুমকুম গল্পসংকলন থেকে ‘জ্ঞানচক্ষু‘ গল্পটি গৃহীত হয়েছে।
জ্ঞানচক্ষুর বিষয়সংক্ষেপ
আশাপূর্ণা দেবী রচিত ‘জ্ঞানচক্ষু’ গল্পে আমরা তপন নামের একজন ছোটো ছেলের কথা পাই, যার কাছে লেখকমাত্রেই ধরাছোঁয়ার বাইরের কোনো মানুষ। তাঁরা যে আর পাঁচজন মানুষের মতোই সাধারণভাবে জীবন যাপন করেন, সেটা তপনের ধারণাতেই ছিল না। কিন্তু তপনের এই ধারণা ভেঙে যায় যখন সে শোনে তার সদ্যবিবাহিতা ছোটোমাসির স্বামী, অর্থাৎ তার নতুন মেসোমশাই একজন ‘সত্যিকার লেখক’। সে এই দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় যে, লেখক হওয়া সত্ত্বেও তিনি তপনের বাবা, ছোটোমামা বা মেজোকাকুর মতো সিগারেট খান, দাড়ি কামান, ঘুমোন কিংবা স্নান করেন।
ছোটোমাসির বিয়ে উপলক্ষ্যে মামাবাড়িতে এসেছে তপন। তার অধ্যাপক ছোটোমেসোমশাইয়েরও কলেজ ছুটি থাকায় তিনিও শ্বশুরবাড়িতে রয়ে গিয়েছিলেন কিছুদিন। এই সময়ই তপন তার প্রথম গল্পটি লিখে ফেলে। তপনের গল্প লেখার কথা জানতে পেরে তার ছোটোমাসি গল্পখানি একরকম জোর করেই তুলে দেয় ছোটোমেসোর হাতে। তিনি গল্পটির প্রশংসা করেন এবং সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় তা ছাপানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর বাড়ির লোকজনের ঠাট্টা ও ইয়ার্কির মধ্যেই তপন তার লেখা গল্পটি ছাপার অক্ষরে দেখতে পাওয়ার আশায় দিন গুনতে থাকে। এরমধ্যে তপন আরও দু-তিনটি নতুন গল্প লিখে ফেলে।
এদিকে দিন চলে যায়, তপনের লেখা গল্পটি প্রকাশিত হয় না। এ বিষয়ে সে যখন হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছে তখনই একদিন তার বাড়িতে ছোটোমাসি ও মেসোর আগমন হয় সন্ধ্যাতারা পত্রিকা হাতে নিয়ে। সেখানে সে নিজের চোখে দেখে, লেখকসূচিতে তার নাম প্রকাশিত হয়েছে – ‘প্রথম দিন’ (গল্প), শ্রীতপন কুমার রায়। মেসোমশাই অবশ্য জানিয়ে দেন যে কাঁচা হাতের লেখা হওয়ার জন্য তপনের লেখাটিতে তাঁকে কিছু সংশোধন করতে হয়েছে। একসময় দেখা যায়, তপনের কৃতিত্বের পুরোটাই যেন চাপা পড়ে গেছে তার মেসোর কৃতিত্বের আড়ালে।
তপনের দুঃখ পাওয়ার অবশ্য এখানেই শেষ নয়। গল্পটি পড়তে গিয়ে সে দেখে ‘কারেকশানের’ নামে তার লেখক মেসো গল্পটি আগাগোড়াই পালটে ফেলেছেন। গল্পের প্রতিটি বাক্যই তপনের কাছে ঠেকেছে নতুনের মতো। সে কিছুতেই গোটা গল্পটির সঙ্গে নিজেকে লেখক হিসেবে মেলাতে পারে না। গভীর দুঃখ ও হতাশায় তপন সংকল্প করে, এরপর যদি কখনও পত্রিকায় লেখা ছাপতে দিতে হয়, তাহলে সে নিজেই গিয়ে সেটা দেবে। কখনোই সে আর অন্যের কৃতিত্বের ভাগীদার হবে না। আর এভাবেই সাহিত্যিক বা লেখক এবং সাহিত্যসৃষ্টি সম্পর্কে তপনের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়।
জ্ঞানচক্ষুর নামকরণ
যে-কোনো সাহিত্যকর্মের নামকরণ করা হয় বিষয়বস্তু, চরিত্র বা ভাব অনুযায়ী, আবার কখনও তা হয় ব্যঞ্জনাধর্মী। যে-কোনো সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রেই নামকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জ্ঞানচক্ষু গল্পের নামকরণটি মূলত ব্যঞ্জনাধর্মী। ‘জ্ঞানচক্ষু’ কথাটির অর্থ হল অন্তর্দৃষ্টি বা জ্ঞানরূপ দৃষ্টি। এই গল্পের একেবারে শেষ পর্যায়ে দেখা যায় তপন চরিত্রটির প্রকৃত জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হয়েছে।
এই গল্পে প্রাথমিকভাবে তপনের জ্ঞানচক্ষুর উন্মোচন ঘটেছে যখন প্রথমবার সে তার লেখক ছোটোমেসোকে দেখেছে। লেখকরা যে অন্য জগতের বাসিন্দা নন, বাস্তবের চেনা মানুষদের মতোই তাঁদের জীবনযাপন – এই সত্য উপলব্ধি করেছে তপন। তপনের লেখা প্রথম গল্পটি নতুন মেসোমশাই অর্থাৎ ছোটোমেসো কিছু সংশোধন করে সন্ধ্যাতারা পত্রিকায় ছাপিয়ে, দেন। কিন্তু ছাপার অক্ষরে নিজের লেখাটি সকলের সামনে পড়তে গিয়ে তপন মনে খুব আঘাত পায়। কারণ সে বুঝতে পারে, মেসোমশাই সংশোধনের নামে পুরো লেখাটাই বদলে দিয়েছেন। সেটাকে আর নিজের বলে চিনতেই পারে না তপন। লজ্জায়, অপমানে, দুঃখে সে যেন মাটিতে মিশে যায়। নিজের গল্প পড়তে বসে, অন্যের লেখা লাইন পড়তে গিয়ে তপনের ভিতরে গ্লানিবোধ জেগে ওঠে। সে সংকল্প করে, লেখা যদি ছাপতেই হয় তাহলে পত্রিকা দফতরে নিজে গিয়ে তা দিয়ে আসবে। নিজের সেই লেখাটি না ছাপলেও দুঃখ থাকবে না তার। সেখানে তপনেরই নিজস্বতা থাকবে, অন্য কেউ সেই কৃতিত্বের ভাগীদার হবে না। এভাবেই আত্মমর্যাদা ও নিজের লেখার প্রতি অধিকারবোধ তপনের জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটিয়েছে। তাই বলা যায়, গল্পের ‘জ্ঞানচক্ষু’ নামকরণটি যথাযথ হয়েছে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক বাংলার প্রথম পাঠের, ‘জ্ঞানচক্ষু’ এর “বিষয়সংক্ষেপ” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই অধ্যায়ের প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের কাজে আসবে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা সমস্যা থাকে, তাহলে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা যথাসাধ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। এছাড়াও, পোস্টটি আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন